অলকানন্দা #পর্ব-৩৬,৩৭,৩৮

0
548

#অলকানন্দা
#পর্ব-৩৬,৩৭,৩৮
#লেখিকা_আনিকা_রাইশা_হৃদি
৩৬

১০১.
বহুদিন বাদে চৈতির অবয়বের কাউকে দেখছে মাহা। সুবিস্তীর্ণ মাঠ। যেদিকে চোখ যায় কেবল সবুজ আর সবুজ। ধূসর শাড়ি পরনে দূর পাহাড়ের দিকে ছুটে চলেছে চৈতি। মাহা পিছন থেকে চৈতির নাম ধরে ডাকলো। চৈতি থমকে দাঁড়ালো। মাহা দৌড়ে চৈতির কাছে যেতে চাচ্ছে। চৈতি স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তবে মাহা পারছেনা। মাহা চৈতিকে ধরতে পারছেনা। হঠাৎ… হঠাৎ সব অন্ধকার। তীব্র আলোয় চোখ মেললো মাহা। চৈতির হাতে লাল টকটকে গোল জামা পরনে একটা ফুটফুটে বাচ্চা। খুব কান্না করছে বাচ্চাটা। মাহা নিজের পেটে হাত বুলালো। পেট ফুলা না কেন! সার্থকের মতো মুখের আকৃতি আর মাহার গাঁয়ের রঙ বাচ্চাটার। মাহা চিৎকার করে উঠলো। মাতৃ মন বুঝে গেলো বাচ্চাটা তার। মাহা প্রাণপণে দৌড়ে বাচ্চাটাকে ছুঁয়ার চেষ্টা করলো। এগিয়ে চলেছে। এই তো আরেকটু। না, মাহা পারছেনা তো। কেন! কেন মাহা পারছেনা। মাহার মস্তিষ্ক অবশ হয়ে আসছে ক্রমশ। বাচ্চাটা হাত বাড়িয়ে মা, মা করে কাঁদছে। “চৈতি, চৈতিরে আমার বাচ্চা আমাকে দিয়ে দে। আল্লাহর দোহাই লাগে। আমার কলিজাটাকে ছিনিয়ে নিস না। দয়া কর। চৈতি রে।”
কাঁদছে আর ছুটছে মাহা। চৈতি এতো আকুতি মিনতি শুনেও সামনে ফিরে কোথায় যেন হারিয়ে গেলো। মাহা ছুটতে নিবে তাদের পিছু তখনই কেউ একজন আঁকড়ে ধরলো তাকে। মাহা ছটফট করছে। তাকে যে করেই হোক যেতে হবে। তার বাচ্চাটা কাঁদছে। হঠাৎ নাকে এসে ঠেকলো প্রিয় ঘ্রাণ। এটা তো প্রাণপ্রিয় পুরুষটার গাঁয়ের ঘ্রাণ। অবচেতন অবস্থায় মাহা আঁকড়ে ধরলো সার্থক কে। চোখ মেলে তীব্র আলোয় চিৎকার করে উঠলো সে। সার্থক শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো মাহাকে। মাহা ছটফট করছে।
“সার্থক, সার্থক আমাদের বাচ্চা চৈতি নিয়ে যাচ্ছে। আমি তাদের কাছে পৌঁছাতে পারছিনা সার্থক। আমার কষ্ট হচ্ছে। ভিষণ কষ্ট হচ্ছে। আপনি, আপনি তাদের ধরুন সার্থক।”
উত্তেজিত হয়ে যাচ্ছে মাহা। প্রেশার হাই হয়ে স্ট্রোক করার চান্স সর্বোচ্চ। সার্থক শক্ত করে আঁকড়ে ধরলো মাহাকে। চৈতির মৃ’ত্যুর খবর শোনার পর এমনি পাগলামি করতো মাহা। ম’র্গে ছুটে যেতে চাইতো। কত কত রাত নির্ঘুম কাটিয়ে মাহাকে স্বাভাবিক করে তুলেছে সার্থক! তবে আজ? আজ তো সন্তান হারিয়ে পাগলপ্রায় হয়ে যাবে মাহা। সার্থক কি করে সামাল দিবে! মাহার ছটফটানি বাড়ছে।
“আপনি কিছু করছেন না কেন? আমার বাচ্চা নিয়ে চলে যাচ্ছে। আর আপনি নিরব?”
মাহার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে সার্থক।
“শান্ত হও মাহা।”
“আমাকে শান্ত হতে বলছেন আপনি! আমার বাচ্চা!”
“বাস্তবতা বুঝতে চেষ্টা করো মাহা। সে চলে গিয়েছে।”

‘সে চলে গিয়েছে’ কথাটা শুনে স্তব্ধ হয়ে গেলো মাহা। ছটফটানি কমে গেলো তার। স্থির, নিশ্চল দেহখানা সার্থক কে সঁপে জ্যান্ত লা’শের মতো পড়ে রইলো সে। সার্থক মাহার চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। একখানা ভালোবাসার পরশ এঁকে দিলো সাথে কপালে।
“একটা গল্প শুনবে মাহা?”

মাহা নিরুত্তর। সার্থক উত্তরের আশা না করেই বললো,
“ছোটবেলা থেকে একাই বড় হয়েছি আমি। আমার কোনো ভাই-বোন ছিলোনা। কানাডার প্রতিদিনকার আর্কটিক বরফাচ্ছন্নের শৈত্যপ্রবাহে আমি আনন্দ খুঁজে পেতাম। প্রজাপতি থেকে শুরু করে চিল প্রতিটা প্রাণীকে জানার প্রবল আগ্রহ ছিলো আমার। ছয় বছর পর্যন্ত আমি ছিলাম একটা প্রফুল্ল মেজাজের বাচ্চা। যে সব কিছুতে আনন্দ খুঁজে পায়। সবার সাথে মিশে। হাসি-খুশি থাকে। কারণ তখনো পর্যন্ত আমি সুন্দর একটা পারিবারিক পরিবেশে বেড়ে উঠছিলাম। বাবা-মায়ের মাঝে কখনো আমি ঝগড়া দেখিনি। আমার বাবা ডক্টর ফারহান। তাকে খুব ভালোবাসতাম আমি। একসময় আমার মা প্রেগন্যান্ট হন। আমি শুনলাম আমার একটা বোন হবে। ছোট আমি অনেক খুশি হয়েছিলাম সেদিন। বোন আসবে, বোন আসবে করে মাতিয়ে রাখতাম সারাবাড়ি। তবে ভালো সময়গুলো যে জলদি ফুরিয়ে যায়! বাবা-মায়ের মাঝে হঠাৎ প্রচুর ঝগড়া শুরু হয়। মা লুকিয়ে কাঁদতেন। আমি দরজার পিছনে লুকিয়ে থাকতাম যখন বাবা-মা ঝগড়া করতো। বাবা জিনিসপত্র ভাংচুর করতেন। উচ্চ গলায় মাকে বকতেন। বিশ্বাস করো মাহা আমার, আমার খুব কষ্ট হতো তখন। বাহিরের দুনিয়ার সামনে তারা আদর্শ স্বামী-স্ত্রী অথচ… দীর্ঘশ্বাস ফেলে সার্থক। আবার বলে,
“আমার বাবার এক কানাডিয়ান নার্সের সাথে খারাপ সম্পর্ক ছিলো। মা সেটা মেনে নিতে পারেন নি। আমি আর মা বাইরে বেরিয়েছিলাম সেদিন। বাসায় ফিরে খুবই অন্তরঙ্গ অবস্থায় দুজন কে হাতেনাতে ধরেন মা। বাবা-মায়ের ঝগড়া শুরু হয়। চিৎকার, চেঁচামেচি, ভাংচুর। একসময় বাবা আমার মাকে ধাক্কা দেন। মা ছিটকে নিচে পড়ে চিৎকার করে উঠেন। র’ক্ত মাহা… পুরো ফ্লোর র’ক্তে ভরে গিয়েছিলো মাহা। আমার.. আমার মা যন্ত্রণায় কাঁতরাচ্ছিলেন। আ…আমি

কন্ঠ রুদ্ধ হয়ে আসছে সার্থকের। মাহাকে জড়িয়ে রাখা বাঁধন আলগা হতে থাকে। মাহা তা হতে দেয়নি। নিজেই সার্থক কে জড়িয়ে ধরলো সে। সার্থকও তো বাবা হতো। ওর মনেও তো অনেক কষ্ট হচ্ছে। মাহাকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য তো সার্থক আছে। সার্থক কে সান্ত্বনা কে দিবে!

১০২.
“আমি পর্দার আড়ালে কেবল একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলাম সেই র’ক্তের পানে। আমার ছোট বোনটা র’ক্তের পিন্ড হয়ে বের হয়ে আসছে। বাবা ঘাবড়ে গেলেন। অনেকক্ষণ বাদে আমার মাকে হসপিটালে নেওয়া হলো। আমার মা সুস্থ হলেন। বাড়ি ফিরলেন। একেবারে নিশ্চুপ হয়ে গেলেন তিনি। যেনো কোনো জীবন্ত লা’শ মাহা। আমার চোখের সামনে আমার পরিবার আস্তে আস্তে ধ্বংস হতে দেখেছি আমি। বাবা দিনের পর দিন বাড়ি ফিরতেন না। মা ঘরে দরজা দিয়ে বসে থাকতেন। একলা আমার সময় কাটতো আকাশ পানে তাকিয়ে। প্রাণবন্ত সার্থক যেন কয়েকদিনের ব্যবধানে প্রাণহীন সার্থক হয়ে গেলো। আমার দুইখালা কে কানাডা নিয়ে আমার মা ই বিয়ে দিয়েছিলেন। তারা আসতো মাঝেমধ্যে। তখন বাবা-মা খুবই স্বাভাবিক আচরণই করতো। আমার বাবা আমার মাকে ভয় দেখিয়েছিলেন। কানাডিয়ান নার্স বিবাহিত ছিলেন। উনার হাসবেন্ড পুলিশে চাকরি করতেন। তাদের অনৈতিক সম্পর্ক জানাজানি হলে ঝামেলায় পড়তে হতো বাবাকে। সেকারণে আমাকে মেরে ফেলার ভয় দেখিয়ে আমার মাকে চুপ করিয়ে দেওয়া হয়। আমার জীবনটা খুবই অদ্ভুত কেটেছে মাহা। আমার ছেলেবেলা আমার কাছে এক বিভীষিকা। এই ফায়রাজ সার্থকের মনে একসময় অনেক ক্ষত ছিলো মাহা। তুমি আমার ক্ষতের ঔষধ। আমার অবাধ্য জীবনের বাধ্য সূচনা।”

মাহা অশ্রু মিশ্রিত গলায় শুধালো,
“আমি আপনাকে ভালোবাসি সার্থক। অনেক ভালোবাসি।”
“যদি কখনো শুনো তোমার ভালোবাসার মানুষটা অপবিত্র?”
“ভালোবাসার মানুষেরা কখনো অপবিত্র হয়না সার্থক।”

সার্থক মলিন হাসে,
“এতো বিশ্বাস করো আমায়?”
“নিজের চাইতেও বেশি।”
“এতো ভালো কাউকে বেসোনা কন্যা।
ভেঙে দিবে তোমার বিশ্বাসের বন্যা।”
“আমি কিচ্ছু জানিনা। বুঝিনা। শুধু জানি আমার ভালোবাসার মানুষটা কখনো কোনো খারাপ কাজ করতে পারেনা।”

বলেই সার্থকের বুকে অশ্রুসিক্ত নয়ন সমেত মুখ গুঁজে দেয় মাহা। সার্থক মাহার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে আনমনে সুরে শুধায়,
“সারা দুনিয়া করলো পর, তুই করলি আপন।
ভয় পাই, আমি ভিষণ ভয় পাই তোর ভালোবাসার কাফন।”

সার্থক আনমনা হয়ে উঠে। বারান্দা দিয়ে দিগন্ত পানে আকাশ দেখে। সিক্ত হয়ে উঠে তার নয়ন। মাহা কি মেনে নিতে পারবে প্রিয় মানুষের অপ্রিয় রূপ?

চলবে…

#অলকানন্দা
#পর্ব-৩৭
#লেখিকা_আনিকা_রাইশা_হৃদি

১০৩.
মাহা অনেকটা সুস্থ এখন। তবে মানসিকভাবে অনেকটা ভেঙে পড়েছে। আজ একসপ্তাহ যাবত হাসপাতালে রয়েছে তারা। মাহা দু-চোখ বুজতে পারেনা। ঘুম আসেনা তার। মনে হয় কে যেন ডাকছে। দূর হতে হাত বাড়িয়ে, “মা, মা” করে চিৎকার করছে। তখন মাহাও চিৎকার করে উঠে। হাত-পা কাঁপে তার। মাথার ভেতরটা ভোঁ ভোঁ করে। নার্ভসগুলো দপদপ করে। এই যে এখন। মাহা ঘুমিয়ে ছিলো কিছুক্ষণ আগে। রাতে নার্স নাজমা ঘুমের ইনজেকশন দেওয়াতে ঘুমের কোলে ঢলে পড়ে মাহা। মাঝরাতের দিকে। হঠাৎ নিজেকে একটা বিস্তৃত উদ্যানে আবিষ্কার করে মাহা। বুকের উপর তুলার পুটলির মতো আদুরে এক মানবশিশু। মায়ের স্তন পান করছে নির্বিঘ্নে। কি আশ্চর্য! মাহা সেই মায়ের ভূমিকায় রয়েছে। হঠাৎ ঝড় শুরু হলো। দূর হতে দানবাকৃতির বিশাল এক কালো হাত বাচ্চাটাকে মাহার বুক থেকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। মাহা চিৎকার করছে। ভিষণ চিৎকার করছে। সব… সব অন্ধকার। নিস্তেজ হয়ে যায় মাহা। একটা বদ্ধ ঘর। চারিদিকে সাদা। ডানে, বামে, উপরে, নিচে। কেবল সাদা। দেয়ালগুলো আস্তে আস্তে ছোট হচ্ছে। চারদিক থেকে এগিয়ে আসছে। চেপে ধরার চেষ্টা করে মাহাকে। মাহা আবারও চিৎকার করে উঠে। হাতে কি যেন একটা বাঁধা। শিরার মাঝে। একটানে ছিঁড়ে ফেলে তা। গলগল করে লাল তরল বের হয়। তখনই কেউ একজন ছুটে আসে। উদভ্রান্ত মানব। ফিট বডির মানুষটা এই কয়েকদিনে যেন মমির মতো শুকিয়ে গিয়েছে। মুখভর্তি দাঁড়ি। দুটো চোখ লাল রঙা। মাহার হাতটা জলদি করে আঁকড়ে ধরে পরিষ্কার করে দেয় মানুষটা। মাহার ছটফটানি কমে আসে। নির্নিমেষ তাকিয়ে রয় মানুষটার দিকে। এত ধৈর্য্য কেন এই মানবের? র’ক্ত মুছিয়ে সেই স্থানে পরপর কয়েকটা ভালোবাসার পরশ দেয় সার্থক। নিরব থেকে হাতটা টেনে ধরে বুকের বাঁ পাশে। মাহা কিংকর্তব্যবিমূঢ়।
“কিছু অনুভব করো, মাহা?”

মাহা নিশ্চুপ। সার্থক মলিন হাসে। মাহার আদুরে গালটা অপর হাতে টেনে দিয়ে বলে,
“বুঝোনা কিছু? তুমি এতো অবুঝ কেন?”

মাহা নির্লিপ্ত তাকিয়ে রয়। সার্থক মাহার হাতটা আলতো করে বুকের বাঁ পাশটায় চেপে ধরেই আছে। মাহা অনুভব করছে সার্থকের হৃদপিণ্ডের ধুকপুক দ্রুত হচ্ছে। ভিষণ দ্রুত। মাহা আঁতকে উঠে। অস্বাভাবিক হৃদপিণ্ডের গতি। মুখ খুলে সে।
“আপনার.. আপনার কি হয়েছে সার্থক। এতোটা অস্বাভাবিক..
“শসস্”
সার্থক মাহার ঠোঁটের উপর আলতো করে আঙুল রাখে। চুপ হয়ে যায় মাহা। তাকিয়েই রয় কেবল।
“আমার এই হৃদপিণ্ডটা ভিষণ বেহায়া মাহা। একেবারেই অবাধ্য। এই বেহায়া খন্ডটাকে বাঁচাতে হলেও আমার তোমাকে প্রয়োজন। আমি ভিষণ একা মাহা। তুমি জানো বিগত দিনগুলোতে আমার উপর দিয়ে কি গিয়েছে? আমি শ্বাস নিতে পারছিলাম না, মাহা। আমি খাবার খেতে পারছিলাম না। আমার পৃথিবী থমকে গেছে। আমি ছিটকে পড়েছি আমার পথ থেকে। কেন এলে মাহা? কেন আমার জীবনে এলে? আমার এই এলোমেলো জীবনে কেন তোমার আগমন ঘটলো মাহা? আমি আর সহ্য করতে পারছিনা। এই সাদা বেডের উপর নির্লিপ্ত আবেগহীন মাহাকে তো আমি চিনিনা। তুমি যতবার যন্ত্রণায় ছটফট করেছো ততবার মনে হয়েছে আমার বুকে কেউ ব্লেড দিয়ে এলোমেলো দাগ কাটছে। আমার কষ্ট হয় মাহা। ভিষণ কষ্ট হয়। আমি কি করবো? আমার তো কেউ নেই। আমি না পারছি সহ্য করতে আর না পারছি দেখতে। তুমি তো সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাসী। একবার তাকে আমার হয়ে জিজ্ঞেস করবে কেন এলোমেলো আমার জীবন? কেন আর পাঁচটা মানুষের মতো আমি বাঁচতে পারিনা?”

নিজের সমস্ত দুঃখ যেন মুহুর্তে ভুলে যায় মাহা। মানুষটা এত কষ্টে আছে! এতোটা কষ্ট! মুহূর্তের জন্য তার মস্তিষ্ক থেকে বিলীন হয়ে যায় নিজের সমস্ত দুঃখ, কষ্ট, যন্ত্রণা। শক্ত করে আঁকড়ে ধরে সার্থক কে। ফুঁপিয়ে কাঁদছে মাহা। সার্থকের বুকে লাগছে সে কান্না। কিন্তু মাহাকে ইচ্ছে করেই মনের দুঃখগুলো এভাবে বলেছে সার্থক। মাহা বিগত কয়েকদিন যাবত নির্লিপ্ত হয়েছিলো। না কান্না, না হাসি। সম্পূর্ণ আবেগহীন এক মাংসপিণ্ড। ডক্টর ওয়াসিফ সার্থক কে ডেকে নিয়ে বলেছেন মাহার মানসিক কন্ডিশন খুবই খারাপ। ভালো মনোরোগ বিশেষজ্ঞ দেখানো প্রয়োজন। মাহাকে কয়েকদিন যাবত হাসপাতালের ভিতরেই অবজারভেশনে রেখেছে সার্থকের এক বন্ধু। আফরান। সে একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ। অবজারভেশন শেষে বলেছে মাহার ভিতর থেকে বিগত কয়েকমাসের স্মৃতিগুলোকে ভুলিয়ে দিতে হবে। মাহার ভিতরের ইমোশন কে পুনরায় জাগ্রত করতে হবে। নয়তো মানসিক ভারসাম্য হারাবে মাহা।

১০৪.
সার্থক চায় না। এমন কিছু হোক। তার যে মাহাকে ভিষণ প্রয়োজন। তাই তো আজ মাহাকে ইচ্ছে করেই কাঁদালো সার্থক। সে তো জানে তার মাহা তার কষ্ট সহ্য করতে পারেনা। মাহার পিঠে হাত বুলিয়ে দেয় সার্থক। আজ তারা বাড়ি যাবে।
“কাঁদছো কেন তুমি?”
“আমার ভিষণ কষ্ট হচ্ছে তাই।”
“তুমি কাঁদলে আমার কষ্ট লাগে জানোনা।”
“আপনাকে আমি অনেক কষ্ট দিচ্ছি, সার্থক। আমি..আমি একটা অপরাধী।”

মাহাকে টেনে নিজের মুখোমুখি করে সার্থক। কেঁদে কেটে হলদে ফর্সা মুখটা লালচে করে ফেলেছে একেবারে। তবে অনেকটা স্বাভাবিক হয়েছে। সার্থক খানিক হাসে। অভিমান হয় মাহার। লোকটা কত বজ্জাত! মাহা কাঁদছে আর লোকটা হাসছে!
“হাসছেন কেন আপনি?”
“তুমি নিজেকে কেন অপরাধী ভাবছো মাহা?”
“কারণ আমি আপনার যত্ন নিতে পারিনি। আপনি কষ্ট পেয়েছেন।”
“বোকা মেয়ে।”

মাহা আবার আঁকড়ে ধরে সার্থক কে। মুখ গুঁজে দেয় বুকে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে সার্থক। আস্তে আস্তে মাহাকে এভাবেই সুস্থ করতে হবে। দায়িত্ব সম্পূর্ণটাই এখন তার। আনমনা হয়ে উঠে সার্থক।
“শুনছেন?”
“হুম?”
“আপনার বোন আমার সাথে কেন এমনটা করলো সার্থক? আমি কি দোষ করেছি সার্থক? আমাকে নিভা আপু কেন পানিতে ফেলে দিলেন?”

আবারও দীর্ঘশ্বাস ফেলে সার্থক। মাহার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
“নিভা মানসিক ভাবে অসুস্থ। নিজের বাচ্চা হবেনা কোনোদিন। তাই তোমার বাচ্চা হবে বিষয়টা সহ্য করতে পারছিলোনা ও। তাই..

মাহা সার্থকের বুকেই মাথা রেখে বসে থাকে। চেনা মানুষগুলোও কত অচেনা। কেবল হিংসার বশবর্তী হয়েই নিভা এই কাজ করেছে? নাকি এর নেপথ্যে অন্য কোনো গল্প আছে? সার্থক তো মাহাকে মিথ্যে বলবেনা। মাহার বিমূঢ় হয়ে রয়। নিভাকে বাড়ি গিয়ে অবশ্যই প্রশ্ন করবে মাহা। কেন তার সাথে এত অন্যায় করা হলো!

_______________

রেজওয়ান গাড়ি চালাচ্ছিলো। হঠাৎ রাস্তার সামনে জটলা দেখে গাড়ি থামাতে বাধ্য হলো সে। মনের দৃশ্য পটে ভেসে উঠলো কয়েকটা পুরাতন স্মৃতি। বেকুব মেয়েটা তো প্রতিবারই ছিনতাইকারীর কবলে পড়ে। দুনিয়ার সকল চোর আর ছিনতাইকারী তো কেবল ঐ মেয়েটার পিছনেই পড়ে। ব্যাপারটা দুঃখের হলেও মজার মনে হয় রেজওয়ানের। এই মেয়েকেই খালি চোখে দেখে সবাই! ভাবতে ভাবতেই গাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে রেজওয়ান। পুলিশ দেখে মানুষজন সরে দাঁড়ায়। রেজওয়ান যা ভেবেছিলো তাই। সেই শ্যামবতীই রাস্তায় বসে। কে যেন ভিড় থেকে বলে উঠে, “স্যার, মাইয়াটার মোবাইল লইয়া ভাগছে এক পোলায়।” অকারণেই হা হা করে হেসে উঠে রেজওয়ান। এশা ভয়ানক চোখে তাকায় রেজওয়ানের পানে। মানুষজন অবাক। পুলিশ অফিসার হাসছে কেন! এশা রাগে নিজের পার্সটা রেজওয়ানের দিকে ছুঁড়ে মারে। তা ধরে ফেলে রেজওয়ান। ভেঙচি দিয়ে অপরদিকে হাঁটা শুরু করে এশা। রেজওয়ানও ছুটে তার পিছুপিছু।

(চলবে)…

#অলকানন্দা
#পর্ব-৩৮
#লেখিকা_আনিকা_রাইশা_হৃদি

১০৫.
অনেকদিন বাদে গুলশানের ফ্ল্যাটে মাহার দম বন্ধ লাগছে। সে ছিলো সাথে। এই তো পেটের ভিতরে। নিজের জানান দিতো। নিজের অস্তিত্বের জানান দিতো। সে নাই। মাহার বুকটাকে খালি করে পাড়ি জমিয়েছে অজানায়। আজ সকালেই হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরেছে মাহা আর সার্থক। নিভা নেই বাসায়। মাহার ভিষণ ইচ্ছে ছিলো একবার জিজ্ঞেস করবে কেন এমন করা হলো তার সাথে! এমিলিনও বাসায় নেই। সার্থক কে জিজ্ঞেস করতে সে বললো তারা নাকি কানাডা চলে গিয়েছে। সার্থক কি করে তাদের যেতে দিলো! একটা হত্যা করেও নিভা পার পেয়ে যাবে? সার্থক কি নিজের বোন কে কিছুই বলবেনা? এই নতুন সার্থক কে তো মাহা চিনেনা। মাহা রাগ করে সার্থকের সাথে আর কথা বলেনি। বাড়িতে পুরাতন কর্মচারী কেউই নেই। মুইংচিন, মেরি আরো কয়েকটা পুরুষ পরিচারক। কেউই নেই। একটা নতুন মেয়ে আছে কেবল। নাহার নামে। যদিও মাহা তাকে পূর্বে দেখেছিলো। বছর চারেক আগে। মাহা যখন প্রথম এই বাড়িতে আসে তখন। এরপরে কোথায় যেন হারিয়ে যায় নাহার। বিগত বছরগুলোতে মাহা কখনো নাহার কে দেখেনি। রাজকীয় খাটে হেলান দিয়ে নানাবিধ কথা ভেবে চলেছে মাহা। শরীরটা প্রচন্ড দুর্বল। ডক্টর বেড রেস্টের নির্দেশ দিয়েছেন। সার্থকের সাথে রাগ করে ঘুমিয়ে পড়েছিলো মাহা। এখন মাত্র উঠে বসলো। মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে হাজারো চিন্তাভাবনা।
“মাহা”

ক্লান্ত সার্থকের সুর। হাসপাতাল থেকে ফিরেছে মাত্র। হাতে সাদা এপ্রোন। বাসন্তী রঙের শার্ট আর জিন্স প্যান্ট পরনে লোকটাকে প্রানবন্ত লাগছে অনেক। ঝাঁকড়া চুলের মানবটা যেন পুরোদমে স্বাভাবিক। মাহা জবাব দিলোনা। মুখ ঘুরিয়ে ফেললো অপরদিকে। সার্থক বার কয়েক ডাকলো। মাহা সাড়া দেয়নি। সার্থকেও আর ডাকেনি। আলমারি থেকে কাপড় বের করে ফ্রেশ হতে চলে গিয়েছে। মাহার মনঃক্ষুণ্ন হলো এবার। অভিমান হলো খুব। চুপচাপ মাথাটা হেলিয়ে দেয় বালিশে। দুচোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ে নিশ্চুপ নোনাজল। কিছুক্ষণ বাদেই সার্থক খালি গাঁয়ে থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট পরনে হাজির হয় মাহার সামনে। মাহা ডান হাত কপালের উপর রেখে শুয়ে আছে। সার্থক খাটের পাশে বসে। মাহা টের পেলেও কোনো সাড়া দেয়নি।
“আমি কি করেছি, মাহা? এমন করছো কেন?”
মাহা নিশ্চুপ।
“তুমি আমার সাথে কথা বলছো না কেন?”
আর চুপ থাকতে পারলোনা মাহা। মুখ খুললো এবার। শান্ত, কান্না মিশ্রিত অথচ দৃঢ় কন্ঠে বললো,
“আপনি জানেন না? আমি আমার বাচ্চা হারিয়েছি সার্থক। আপনি আপনার বোনকে কেন কিছু বলেন নি?”
সার্থক চুপ করে আছে। ‘মাহা যদি তুমি জানতে! সন্তান হারানোর প্রতিশোধ এই সার্থক নেয় কি নেয়নি!’ মনে মনে আওড়ায় সার্থক।
“কি হলো কথা বলছেন না কেন আপনি? জবাব দিন সার্থক। আমার উত্তর চাই।”
চিৎকার করে উঠে মাহা। সার্থক শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো মাহাকে। পিঠে হাত বুলিয়ে বললো,
“শান্ত হও, মাহা। প্লিজ এমন পাগলামি করো না।”
মাহা কাঁদতে কাঁদতে বলে,
“আমার উত্তর চাই সার্থক!”
“আমি তোমাকে নিয়ে হাসপাতালে চলে যাওয়ার পরই নাকি নিভা, এমিলিন বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছে। আমি বাড়ি ফিরে নিভাকে পাইনি। বিশ্বাস করো মাহা। নিভাকে হাতের কাছে পেলে আমি খু’ন করতাম। আমিও তো সন্তান হারিয়েছি।”

মাহা কতক্ষণ সার্থকের বুকে মাথা রেখে কাঁদলো। মানুষটাকে ভুল বুঝেছিলো সে।
“কান্না অফ করো প্লিজ। তোমার ক্রন্দন মুখ আমি সহ্য করতে পারিনা মাহা।”

বলেই মাহার চোখের পানি মুছিয়ে দিলো সার্থক। মাহা এতক্ষণে শান্ত হয়েছে কিছুটা। বুকের ভার কমেছে।
“বারান্দায় যাবে?”
“ইচ্ছে করছেনা।”
“তোমার জন্য একটা উপহার এনেছিলাম।”
“কি উপহার?”
“চলো, দেখাচ্ছি।”
বলেই মাহাকে কোলে তুলে নিলো সার্থক। খোলামেলা বৃহৎ বারান্দা। হরেকরকম তরুর মেলা। মেঘাচ্ছন্ন আকাশ। ঝিঁঝি পোকার ডাক ভেসে আসছে দূর থেকে। বারান্দার মাটিতে পেতে রাখা বিছানায় মাহাকে আলতো করে নামিয়ে দিলো সার্থক। মাহা চোখ বুজে আছে। এত উৎকন্ঠা, চিন্তা সবকিছু ছাপিয়ে আজো সার্থকের কাছাকাছি আসলে মাহা লজ্জা পায়।
“মাহা, চোখ খুলো।”
চোখ খুলেই চোখের সামনে জিনিসটা দেখে ছলকে উঠে হৃদপিণ্ড। একটা বীণা। কতদিন বীণা বাজানো হয়না। গান গাওয়া হয়না। মাহার গানের গলা এতটাই শ্রুতিমধুর যে তার বান্ধবী রুমানা তাকে কোকিল বলে ডাকতো। জীবন ছন্দের আড়ালে আজ কোথায় যেন হারিয়ে গেলো সেই সুর। সেই গান। মাহার কোলে আলতো করে মাথা রাখে সার্থক। “বাজাবেনা বীণা? তোমার বান্ধবী রুমানার কাছে শুনলাম তুমি নাকি বীণা বাজাতে পারো? আমাকে তো কখনো বলোনি।”
“সময় হয়ে উঠেনি।”
“আজ বাজাবে একটু? একটা গান শুনাবে?”
“এতোদিন পরে। সব ভুলে গিয়েছি। তাছাড়া গলাও তো ভালোনা।”
“উফ্ মেয়ে! আমিই তো।”

সার্থক উঠে মাহার কাছে এগিয়ে দেয় বীণা। মাহা হাত বুলায় বীণাতে। পুরনো স্মৃতি মাথা চাড়া দিয়ে উঠে। মা খুব ভালো বীণা বাজাতেন। ছোটবেলায় মাহা ছাদে মায়ের বীণা বাজানো শুনতো। স্মৃতিগুলো আজ আবছা আবছা।

১০৬.
মন খারাপ। প্রিয় জিনিসটা সামনে পেয়েও সুর তুলতে ইচ্ছে করছেনা।
“মাহা, আমাকে বাজিয়ে শোনাবেনা?”
সার্থকের আকুতি। মাহা ভগ্ন হৃদয়ে আবারও হাতে তুলে নেয় বহুদিনের পুরানো বন্ধুকে। কান্নার ফলে গলা ভেঙে আছে। মাহা চোখ বন্ধ করলো। বাইরে মেঘাচ্ছন্ন আকাশ চিড়ে টুপটাপ বৃষ্টি পড়ছে। ঝিঁঝির ডাক নেই। নিস্তব্ধতা। মন দুলানো স্নিগ্ধ পবন। বীণার তারে তারে সুর তুলছে মাহা। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের,

আমিও পথের মত হারিয়ে যাব
আমিও নদীর মত আসবোনা ফিরে আর
আসবোনা ফিরে কোনদিন

আমিও দিনের মত ফুরিয়ে যাব
আসবোনা ফিরে আর আসবোনা ফিরে কোনদিন

মন আমার বাঁধলো বাসা ব্যাথার আকাশে
পাতা ঝড়া দিনের মাঝে মেঘলা বাতাসে।
আমিও ছায়ার মত মিলিয়ে যাব
আসবোনা ফিরে আর আসবোনা ফিরে কোনদিন

যাবার পথে পথিক যখন পিছন ফিরে চায়
ফেলে আসা দিনকে দেখে মন যে ভেঙ্গে যায়।

চোখের আলো নিভলো যখন মনের আলো জ্বেলে
একলা এসেছি আমি একলা যাব চলে।
আমিও সুখের মত ফুরিয়ে যাব
আসবোনা ফিরে আর…..

শেষের চরণটুকু আর গাইতে পারলোনা মাহা। সে হারিয়ে গিয়েছে। পথের মতো। আর কখনো ফিরে আসবেনা বাবা-মায়ের কোলে। আজ নিজের বাবা-মা, চৈতিকেও খুব মনে পড়ছে মাহার। সার্থক মাহাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেলো কপালে। চোখের পানি শুষে নিতে নিতে বললো,
“আমি আছি। থাকবো। নিজের জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তোমার থাকবো। একমাত্র সৃষ্টিকর্তা ছাড়া পৃথিবীর কোনো শক্তি তোমাকে আমার কাছ থেকে আলাদা করতে পারবেনা, অলকানন্দা।”

ফিসফিসিয়ে বলা কথা। হয়তো মাহা শুনেছে কিংবা শুনেনি।
“ওকে কোথায় কবর দিয়েছেন সার্থক? আমাকে একবার নিয়ে যাবেন? আমার বুকটা ভিষণ ফাঁকা লাগছে সার্থক।”

_________________

বিছানার সামনেই বড় জানালা। বিছানায় শুয়ে পা দুটো জানালার গ্রিলে তুলে বাইরের বৃষ্টি দেখতে মগ্ন এশা। সেদিন এতো রিয়েক্ট করা বোধহয় ঠিক হয়নি। পুলিশটা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুনে গিয়েছে কেবল। কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায়নি। ভাবা যায় এএসপি রেজওয়ান এশার কাছে ক্ষমা চেয়েছে! ইহা ভারি আশ্চর্য ঘটনা! লজ্জায় লাল হয় শ্যাম দুটো কপোল। এই তো সেদিন….

(চলবে)…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here