অলকানন্দা #পর্ব-৩৯,৪০,৪১

0
330

#অলকানন্দা
#পর্ব-৩৯,৪০,৪১
#লেখিকা_আনিকা_রাইশা_হৃদি
৩৯

১০৭.
“সেই কখন থেকে আপনি আমার পিছন পিছন আসছেন। আপনার সমস্যাটা কি?”
“কোনো সমস্যা নাই। তোমার ব্যাগটা আমার কাছে। এটা নাও।”

বলেই ব্যাগটা এগিয়ে দেয় রেজওয়ান। ‘ওহ্, খালি ব্যাগ ফেরত দিতেই এসেছে আর আমি কত কি…’
মনে মনে ভেবে দীর্ঘশ্বাস ফেলে এশা। ব্যাগটা হাতে নেয় সে। দুজনেই দাঁড়িয়ে। কেটে গিয়েছে সহস্র সময়। কোনো কথা কারো মুখে নেই। একজনের মনে সুপ্ত অভিমান আরেকজনের অপরাধবোধ। কিছু বলতে গিয়েও আমতা আমতা করছে রেজওয়ান।
“কিছু বলবেন?”
“না মানে হঠাৎ দেশ ছেড়ে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছিলে কেন?”
“দেশে দম বন্ধ হয়ে আসছিলো, তাই।”
“এখন কোথায় মানে এখন কি কোথাও কর্মরত আছো?”
“হ্যাঁ, সিলেটে একটা কোম্পানিতে আছি।”
“ওহ্, তারমানে সিলেট থাকো এখন? ঢাকায় কতদিন আছো?”
“হুম। থাকবো আর কিছুদিন। আরো কিছু বলবেন?”
“তাড়া আছে?”
“ছিলো একটু।”
“একটা কথা বলতাম মানে আসলে…
” এএসপি রেজওয়ান কে তোতলানো মানায় না। বলুন কি বলবেন। সরাসরি বলুন।”

মেয়েটা আগের চেয়ে অনেকটা বদলে গিয়েছে। কি তেজ কন্ঠে! থতমত খায় রেজওয়ান। দীঘল চুলের শ্যামবতী পরিপূর্ণ নারী। ধারালো যার কন্ঠস্বর। এলোমেলো বেণী করে রাখা হাঁটু সমান চুলগুলোতে।
“তুমি কি এখনো আমার উপর রাগ করে আছো, এশা?”
“আশ্চর্য! আমি আপনার উপর রেগে থাকবো কেন?”
“ঐদিনের ঐ আচরণের জন্য আমি সত্যিই দুঃখিত এশা। কাজটা সঠিক হয়নি আমার। তখন এতটা স্ট্রেসের ভিতর ছিলাম।”
“সমস্যা নেই মিঃ রেজওয়ান। আপনি আমার এতোটা কাছের মানুষও নন যে এতটুকু কারণেই আপনার উপর রাগ করা লাগবে। আমার তো সেই ঘটনা মনেও নেই।”
এশার হেয়ালি করা কথাটা যেন তীরের মতো রেজওয়ানের বুকে আঘাত করলো। এই মেয়েটাকে রেজওয়ান ভালোবাসেনা। ভালোবাসা সব ঐ একজনকে ঘিরে। কিন্তু তবুও কেমন যেন একটা টান মেয়েটার প্রতি। রেজওয়ান দাঁড়িয়ে রইলো কিছু সময়। কথা হয়নি দুজনাতে। মৃদু হিমেল বাতাস বইছে।
“আজ তাহলে আসি মিঃ রেজওয়ান। ভালো থাকবেন।”

রেজওয়ান কে কোনো কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই সম্মুখে অগ্রসর হয় এশা। মুখে বিশ্বজয়ী হাসি। এইতো চাচ্ছিলো সে। গত চারটা বছর অনলে পুড়েছে হৃদপিণ্ড। পছন্দের মানুষের কাছে অপমানিত হওয়ার দুঃখ যে ঠিক কতটা। কতটুকু গভীর, কতটুকু জ্বালাময়ী! আহ্! রেজওয়ান যদি তুমি এই অনল বুঝতে। একতরফা ভালোবাসা বুঝতে তাহলে হয়তো স্বয়ং লেখিকারও তোমাদের নিয়ে এত ভাবতে হতোনা। বর্তমানে ফিরে এশা। হঠাৎ করেই ভিষণ কাঁদতে ইচ্ছে করছে তার। বিগত বছরগুলোতে সেই বিদেশি ভাটিতে কেমন করে পড়েছিলো এক এশা জানে আর তার সৃষ্টিকর্তাই জানে। ক্ষমা করবেনা এশা। এত সহজ সবকিছু?

_____________

বাইরে ঘোর অন্ধকার। একটানা বৃষ্টি। কেমন যেন বৃষ্টির শব্দটা। একঘেয়ে। কানে তব্দা লাগানো। ঝুম ঝুম ঝুম ঝুম। গাঁয়ে কাঁটা দিয়ে উঠে। মনে হয় দূরে কোনো অশরীরী ডাকছে। হাত বাড়িয়ে। গুলশানের বহুতল ভবনের ডুপ্লেক্স বাড়ির বারান্দায় পাগলামি করছে এক নারী। এই ঘোর অন্ধকার রাতে সে কবরে যেতে চাচ্ছে। সার্থক ঝাপটে ধরে আছে মাহাকে। মাহা কোনোমতেই মানতে চাচ্ছেনা। সে এখনই যাবে।
“আপনি একটা পাষাণ। আপনি বাবা হয়ে এমন করছেন! আমি যাবো। এখনই নিয়ে চলুন আমায়।”
“মাহা, শান্ত হও। এতরাতে কবরস্থানে যাওয়া ঠিক হবেনা মাহা। তাও নাহয় যেতাম। বাইরে যে এত বৃষ্টি?”
“আপনি কেন এত বাহানা দিচ্ছেন সার্থক? আপনি, আপনি একটা নিষ্ঠুর।”
“আমি পাষাণ, আমি নিষ্ঠুর। সব মানলাম। একটু শান্ত হও মাহা।”
“শান্ত হতে বলছেন আমায়? আমি কি করে শান্ত হবো? আমার মেয়েটা হাত বাড়িয়ে ডাকছে। আমাকে যেতেই হবে।”
“না, তুমি যাবেনা।”
“আপনি আমায় ছাড়ুন। আমি যাবোই। নয়তো আমি আমার জীবন দিবো আজ।”
“মাহা!”

যা কোনোদিন হয়নি তাই হয়েছে আজ। সার্থক মাহার হলদেটে লালচে হয়ে আসা গালটা ছুঁয়ে বলে,
“আমি কি করলাম এটা মাহা। আমি এটা কি করলাম!”

মাহা নিজের গাল থেকে সার্থকের হাতটা সরিয়ে দেয়। লালচে হয়ে আসে তার চোখ। অভিমানে গাঢ় হয় মুখমন্ডল। তবুও পাগলামি করে মাহা। তাকে যে যেতেই হবে। সার্থক একা হাতে সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে মাহাকে। ওর অর্ধেক ওজনের মেয়েটার শরীরে আজ যেন কোনো পিশাচের শক্তি ভর করেছে। মাহাকে জোর করে ঘরে নিয়ে এসেছে সার্থক। মাহা পাগলামি করেই যাচ্ছে। তার যেতেই হবে আজ। হঠাৎ করেই বৃষ্টি থেমে গেলো।

১০৮.
হুম, একেবারে হঠাৎ করে। নিস্তব্ধতা চারপাশে। ঘড়ির টিকটিক আওয়াজের মাঝেই ঢং ঢং শব্দ জানান দেয় রাত তিনটা বাজে। মাহার হাতদুটো ওড়না দ্বারা বেঁধে দেয় সার্থক। ছোট টেবিলের ড্রয়ার হাতড়ে তাড়াহুড়ো করে কিছু একটা খুঁজতে ব্যস্ত সে।
“বৃষ্টি তো থেমেছে। এবার নিয়ে চলুন আমাকে। ও ডাকছে। কষ্ট হচ্ছে ভিষণ। আপনি না ওর বাবা?”

সার্থক জবাব না দিয়ে একমনে খুঁজে যাচ্ছে ইনজেকশনটা।
“কি হলো জবাব দিন? যাবেন না আপনি? আমি যাচ্ছি তবে। আমার হাত বেঁধে আপনি আমাকে আটকে রাখতে পারবেন না।”
বলেই উঠে দাঁড়ায় মাহা। ছুটে যায় দরজার কাছে। সার্থকও দৌড় দেয় মাহাকে ধরতে। পিছন থেকে ঝাপটে ধরে মাহাকে।
“ছাড়ুন আমায়। আমি যাবোই।”

চিৎকারে কানে তব্দা লেগে যাওয়ার মতো অবস্থা। সার্থক সবক্ষেত্রে কঠিন হলেও মাহার বেলায় সে ধীরস্থির, নরম, কোমল, ধৈর্যশীল, শান্ত।
“চুপ মাহা। আর একটা কথা বললে তুমি আমার মরামুখ দেখবে।”

অসহায় হয়ে আসে লালচে অভিমানী চোখজোড়া। এটা কি শুনালো সার্থক! এতক্ষণের পাগলাটে মাহা যেন একেবারেই শান্ত, নিরব, নিশ্চল। একটা মাংসপিণ্ডে বেস্টিত পাথরে মূর্তি। মাহাকে নিয়ে খাটে বসিয়ে তার হাতে আলতো করে ঘুমের ইনজেকশন পুশ করে সার্থক। নেতিয়ে আসে মাহার চোখজোড়া। কয়েকঘন্টার জন্য অন্ধকার জগতে পাড়ি জমায় সে। ঘুম নেই কেবল সার্থকের চোখে। ভালোবাসা! কি অদ্ভুত এই ভালোবাসা। নরপিশাচকেও মানুষে পরিণত করে দিতে পারে! যার অন্তরে বিন্দুমাত্র ভালোলাগা, ভালোবাসা ছিলোনা সেই বুকে ভালোবাসার উদ্রেক জাগিয়ে, সবকিছু নিঃশেষ করে কেন পাগলামি করছে জ্বালাময়ী নারী! এ কি তবে কৃতকর্মের ফল? এতটা যন্ত্রণাময়?

দীর্ঘশ্বাস ফেলে সার্থক। আলমারি থেকে নিজের এবং মাহার কিছু কাপড় গুছিয়ে লাগেজে তুলে নেয়। মাহাকে কোনোভাবেই কবরস্থানে নিয়ে যাওয়া যাবেনা। পাগলামি করবে। বাচ্চাকে দেখতে চাইবে। তারপর হার্ট অ্যাটাক কিংবা স্ট্রোক করতে পারে। সার্থক কোনোক্রমেই তা চায় না। তাই তো আজ রাতেই এই শহর ছেড়ে, কৃত্রিমতা ছেড়ে পারি জমাবে সিলেটে। যদিও পিছুটান থাকবে তবুও ভালো থাকবে মাহা। সার্থকের অলকানন্দা। এটা কি তবে গল্পের নতুন অধ্যায় নাকি সমাপ্তির ঘন্টা?

(চলবে)…

#অলকানন্দা
#লেখিকা_আনিকা_রাইশা_হৃদি
#পর্ব-৪০

১০৯.
মৃদু আলোর ঝলকানি তে ঘুম ভাঙে মাহার। মাথাটা ভনভন করছে। ধপধপ করছে নার্ভস। ভিষণ ব্যথা। মাহা সহ্য করতে পারলোনা। দু’হাতে মাথা চেপে ধরে চিৎকার করে উঠলো সে। সার্থক পাশেই ছিলো। তন্দ্রায় আচ্ছন্ন হয়ে ঝিম ধরে। মাহার চিৎকারে সচল হয় মস্তিষ্ক।
“কি হয়েছে মাহা? বেশি ব্যথা করছে?”
“হুম।”

ভারী গলায় সায় দেয় মাহা। মাথায় কয়েকটনের বস্তা রেখেছে কি কেউ? অনেক ভারী লাগছে মাথাটা।
“তুমি ফ্রেশ হয়ে এসো। ব্রেকফাস্ট খেয়ে ঔষধ খাবে।”

ফ্রেশ হয়ে বাইরে বের হয় মাহা। সার্থক বিছানায় খাবারের প্লেট হাতে বসে আছে। মাহা এতক্ষণ যাবত খেয়াল করেনি। এই ঘর তো সম্পূর্ণ ভিন্ন! এটা কোথায়? টাওয়াল দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে মাহা বিছানার কাছে এগিয়ে আসে।
“এটা তো আমাদের ঘর না। আমরা কোথায় আছি, সার্থক?”
“বসো, খাবে।”
“আপনি আমায় এড়িয়ে যাচ্ছেন।”
“বলবো সোনা। আগে খেয়ে নাও।”
মাহাকে পাশে বসিয়ে রুটি খাইয়ে দেয় সার্থক। অতঃপর ঔষধ।
“এবার বলুন।”
“কেমন উষ্কখুষ্ক হয়ে আছে চুলগুলো। আমি নারিকেল তেল গরম করে নিয়ে আসি। তুমি বসো চুপচাপ।”

সার্থক বেরিয়ে গেলো ঘর থেকে। চারবছরে মাহা সার্থক কে অনেকটুকুই চিনেছে। নিজে কোনো কথা বলতে না চাইলে সে কথা ওর মুখ হতে বের করা অসম্ভব প্রায়। হঠাৎ চোখ চলে যায় পাশের পর্দা দিয়ে ঢাকা বিস্তর কাঁচের দরজার পানে। মাহা এগিয়ে যায় সেদিকে। দু’হাতে পর্দা সরাতেই কাঁচের দরজা ভেদ করে দেখা মিলে কয়েক সারি পাহাড়ের। মাঝে বয়ে গিয়েছে নীলচে নাম না জানা এক বিস্তৃত নদী। মাহা পুলকিত, উচ্ছ্বসিত। ভুলে গেলো জাগতিক সকল ভাবনা। কাঁচের বিস্তর দরজাটা খুলে বৃহদাকার এক খোলা বারান্দা আবিষ্কার করে মাহা। হিমেল স্নিগ্ধ বাতাস বইছে। সারি সারি পাহাড়। সবুজের সায়র যেন! দালানটা বেশ উচ্চতায় গড়া। নদীর ছলাৎ ছলাৎ জলের মুগ্ধ শব্দ কানে বাজছে। আকাশে হরেকরকম পাখি। মাহা আনমনা হয়ে যায়। কি সুন্দর প্রকৃতি! রেলিং ধরে অবলোকন করে প্রাকৃতিক নয়নাভিরাম।
“মাহা, ঘরে এসো।”

সার্থকের আহ্বানে ঘরে ফিরে মাহা। চারিদিক সে ভালো করে পরখ করে এতক্ষণে । অফ হোয়াইট রঙের দেয়ালে ঘেরা ঘর। একপাশে একটা খাট, খাটের পাশে ছোট একটা টেবিল, একটা আলমারি আর গুটিকয়েক আসবাবপত্র। বড়সড় ছিমছাম ঘর। সার্থক একটা বাটিতে নারিকেল তেল গরম করে দাঁড়িয়ে আছে।
“তুমি নিচে বসো। আমি খাটে বসে তেল দিয়ে দেই।”
“আচ্ছা”

মাহা টাইলসে নিচে বসে পড়ে। সার্থক বসে খাটে। মাহার কোঁকড়া চুলগুলো এলোমেলো, জট লাগানো। বহুদিন চুল আঁচড়ানো হয়নি বোধহয়। কোনোমতে একটা খোঁপা করা। আস্তে করে খোঁপাটা খুলে দেয় সার্থক। কোমড় সমান চুলগুলো সারা পিঠময় ছড়িয়ে পড়ে লহমায়। চিরুনি দিয়ে আস্তে আস্তে চুলের জট ছাড়ায় সার্থক। অতঃপর গরম তেল দু হাতের তালুতে ঘষে অতি যত্নে মাহার চুলে লাগাচ্ছে সার্থক। মাহা চুপ করে অনুভব করছে সময়টা। মস্তিষ্ক ঠান্ডা, মন শান্ত। সার্থক একমনে চুলে তেল মালিশ করে যাচ্ছে।
“আপনি আমাকে দূরে নিয়ে এসেছেন, তাই না?”

কিছুক্ষণের জন্য হাত থেমে যায় সার্থকের তবে পুনরায় সচল হয় হাতদুটো। যেন মাহার কথা শুনেনি সার্থক। মাহার নার্ভস শান্ত রাখার ঔষধ দেওয়া হয়েছে। তাছাড়া দূরে চলে এসেছে তারা। মাহার অস্থিরতাও কমেছে অনেকটা। হয়তো সময়ের সাথে সাথে আরো কমে যাবে সকল অস্থিরতা।

“আমরা এখন সিলেট রয়েছি। এটা আমার বাগান বাড়ি।”
“সিলেট?”
“আমি এখানকার একটা ভালো হসপিটালে জয়েন করেছি। অফারটা অনেকদিন আগেই পেয়েছিলাম। তোমাকে জানানো হয়নি।”

মাহা নিশ্চুপ। দৃষ্টি বারান্দায়। সার্থক মাহার চুলগুলো সরিয়ে ভালোবাসার পরশ একে দেয় মাহার গ্রীবাতে। বহুদিন বাদে সুপরিচিত সেই স্পর্শটা পেয়ে মাহা শিউরে ওঠে। সকল যন্ত্রণা ঠেলে দিয়ে নিজের মাঝে এক অন্য সত্তা আবিষ্কার করে মাহা। যার এই মুহূর্তে একান্ত স্পর্শ প্রয়োজন। বহুদিনের তৃষ্ণার্ত মাহা। আরো গভীর হয় সার্থকের স্পর্শ। বাইরে আসমানের পূর্বাংশে দিবাকর তেজস্বী হচ্ছে। ঘরে থাকা প্রাণদুটিও তেজস্বী হয়ে উঠছে ভালোবাসার দাবানলে।

____________

দরজায় ঠকঠক করছে কেউ। মুইংচিনের গলা,
“সাতক, সাতক। একতু বাইরে আছো। জরুরি প্রয়োজন আছে।”

দুপুর দুটো বাজে প্রায়। সার্থকের বুকে মাথা রেখে নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে মাহা। আস্তে করে মাহাকে সরিয়ে গায়ে টি-শার্ট জড়িয়ে দরজার কাছে আসে সার্থক। দরজার এপাশ থেকে ফিসফিসিয়ে বলে,
“আসছি। তুমি নিচে অপেক্ষা করো।”
“ওকে।”

ফ্রেশ হয়ে নিচে আসে সার্থক। মুইংচিন, মেরি, নাহার এই বাড়িতে এসেছে সার্থকের সাথে। পাহাড়ের উপরে দু’তালা ডুপ্লেক্স বাড়ি। আশেপাশে দূরদূরান্ত পর্যন্ত কোনো জনবসতি নেই। শুভ্র রঙের বাড়িটা। বাড়ির সম্মুখে বিস্তৃত বাগান।
“ডেভিড দেকা করতে এসেছে সাতক।”
“আমাদের ‘HBP’ এর কি খবর?”

ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলে সার্থক।
“আমি সতিক জানিনা।”
“কোথায় সে এখন?”
“বাইরে বাগানে।”
“আচ্ছা, ভিতরে আসতে বলো।”

বাড়ির ভিতরটা ভিষণ মনোরম। একপাশ ঘেরা কাঁচের দেয়াল। সেখান থেকে দেখা মিলে সারি সারি পাহাড়ের। কাঁচের দেয়াল ঘেঁষেই সোফা রাখা। মাঝে সেন্টার টেবিল। বড়সড় ছিমছাম বাড়িই বলা যায়। জাম্বিয়ার লুসাকা অঞ্চলের বাসিন্দা ডেভিড। বিশালাকৃতির দেহের কৃষ্ণাঙ্গ মানব। ডেভিড মূলত বামপন্থী। জন্মগতভাবে খ্রিস্টান হলেও সে কোনো ধর্মে বিশ্বাসী নয়। সার্থকের ডানহাত বলা চলে। সার্থক কে গুরু হিসেবে মেনে আসছে ডেভিড সেই ছোটকাল থেকে। বিশ বছরের এই যুবক সার্থকের জন্য প্রাণ দিতে রাজি আর সময় আসলে সার্থকের কথায় প্রাণ নিতেও রাজি।
“কি খবর ডেভিড?”
“গুড, ব্রো।”

আরো কিছু কথা হলো। অতি গোপন কিছু কথা।

১১০.
নিচতলাটা উপরতলার চাইতেও সুন্দর। মাহা ঘুরে ঘুরে দেখছে বাড়িটা। মেরি পাশেই আছে।
“বাড়িটা ভিষণ সুন্দর মেরি।”
“জ্বি, ডক্টর স্যার নিজের মতো সাজিয়েছেন সবটা।”
“কোথায় তোমার ডক্টর স্যার?”
“ডক্টর স্যার জরুরি কাজে বাইরে বেরিয়েছেন ম্যাম। আপনাকে বলেছেন খাবার খেয়ে নিতে।”

মাহা অবলোকন করছে চারপাশ। নিচতলাটা ভিষণ বড়। ঘরের মাঝ দিয়ে ডিএনএ ডাবল হেলিক্স সূত্রের মতো প্যাঁচানো গোল সিঁড়ি উপরতলায় উঠে গিয়েছে। বাড়ির মূল ফটক সেগুন কাঠে নির্মিত। ড্রয়িং রুমটাও বিশাল। দেয়ালে একটা মৃত হরিণের মাথা সাজিয়ে রাখা। যা দেখে খানিক কষ্ট পেলো মাহা। এরকম মৃত প্রাণী ঘরে সাজিয়ে রাখা মাহার পছন্দ নয়।
“ম্যাম, চলুন খেয়ে নিবেন। নয়তো স্যার আমাকে বকবেন।”
মাহারও ভিষণ ক্ষুধা লেগেছে। তাই কোনো দ্বিরুক্তি সে করেনি। খাবার খেয়ে সোফায় বসে মাহা। মাথার যন্ত্রণা কমেছে অনেকটা। তবে মাহার কিছু প্রশ্নের উত্তর চাই। যার উত্তর কেবল সার্থকের কাছেই রয়েছে। এমন সময় বাইরে হতে একটা করুণ চিৎকার ভেসে এলো। মাহা দৌড়ে বেরিয়ে এলো বাইরে। সাথে মেরি এবং নাহারও। বিস্তৃত অংশজুড়ে বাগান। পশ্চিম কোণে বাগানের দিক হতেই ভেসে আসছে আর্তনাদ। মাহা এগিয়ে যায় সেদিকে। নাহার ও মেরি একে অপরের মুখের দিকে তাকালো। স্পষ্ট ভয় তাদের চেহারায়। তারাও ছুটে মাহার পিছুপিছু। মাহা বাগানের ভিতর প্রবেশ করে দেখে একজন মালি বয়স চল্লিশ কি পয়তাল্লিশ হাত চেপে বসে আছেন। হাত দিয়ে গলগল করে র’ক্ত পড়ছে। হাফ ছেড়ে বাঁচে মেরি ও নাহার। নাহারের ছিপছিপে পাণ্ডুর মুখে স্বস্তি।
“কি হয়েছে আপনার?”
বিচলিত কন্ঠ মাহার।
“নাহার আপনি একটু ফার্স্ট এইড বাক্সটা নিয়ে আসুন জলদি।”

নাহার বাক্সটা আনতেই মাহা মধ্যবয়স্ক লোকটার হাত পরিষ্কার করে ব্যান্ডেজ করে দেয়। লোকটা চোখমুখ খিঁচে বসে। হয়তো পুরুষ বিধায় কাঁদতে পারছেন না তিনি।
“ব্যথা কমেছে চাচা?”
কি মায়াময় মেয়েটার মুখ। কি মনোমুগ্ধকর মেয়েটার সুর। হিন্দু সজল দাস যেন দেবী দূর্গার দেখা পেলেন। মুখে কিছু না বললেও অপর হাত দিয়ে মেয়েটার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন তিনি। হায়রে নিয়তি! পাপপুণ্যের মিলন ঘটিয়েছে। নিষ্পাপ মেয়েটার জন্য মায়া হলো সজল দাসের। সজল বোবা মানুষ। কথা বলতে পারেন না। মুখে আ আ করলেন। মেরি এবার বিচলিত হয়ে বললো,
“ম্যাম, ঘরে চলুন। বাগানে প্রচুর সাপ আছে। প্লিজ ম্যাম। আপনার কিছু হলে ডক্টর স্যারকে কি বলবো আমি।”
“মেরি তুমি ভিষণ ভয় পাও।”

অতঃপর সজল দাসের দিকে চেয়ে মাহা বলে,
“চাচা, বাড়িতে চলুন। একটু রেস্ট নিয়ে খাবার খাবেন।”

সজল ইশারায় বুঝায় সে ভালো আছে। মাহা যেন চলে যায়। সবাই এতো তাড়া দিচ্ছে। অগত্যা মাহাকে বাড়ির ভিতর ফিরে যেতে হলো। বাগান থেকে একটা লা’শ টেনে নেওয়া হচ্ছে বাড়ির দক্ষিণকোণে। বাগানে অশরীরী আত্মার ন্যায় হাতে ছুরি সমেত বাঁকা হেসে হাঁটছে চীন দেশের শান ধর্মের অনুসারী লোকটা।

(চলবে)….

#অলকানন্দা
#পর্ব-৪১
#লেখিকা_আনিকা_রাইশা_হৃদি

১১১.
সিলেটে আজ বিশদিন পূর্ণ হলো। চারদিকের পরিবেশটা ভিষণ সুন্দর। মাহার অবচেতন মস্তিষ্ক খানিক ভুলে গিয়েছে ‘তার’ কথা। দূরে পাহাড়ে, নীলচে নদীর জলে নিজেকে নতুন করে খুঁজে পাচ্ছে মাহা। আজ সার্থক মাহাকে নিয়ে ঘুরতে এসেছে বাগানে। মালনীছড়া চা-বাগান। কি ভিষণ সুন্দর! যতদূর চোখ যায় সবুজ সায়র। উঁচু-নিচু ঢিবিতে তাজা চায়ের গাছ। বেশি মানুষজন নেই। আকাশে বৃষ্টি হওয়ার পূর্বাভাস। থম মেরে আছে প্রকৃতি। চায়ের দোকানে বসে চা খাচ্ছে মাহা আর সার্থক। মাহার কেবল একটাই চিন্তা আসছে মাথায়। এমন কিছু কি তার সাথে আগেও ঘটেছিলো! সে কি কখনো মালনীছড়ায় এসেছিলো! এমন কোনো স্মৃতি তো মনে নেই। আনমনে হয়ে আছে মাহা। সার্থক ভিষণ মজা করে চা খাচ্ছে। চা আবার সার্থকের খুবই প্রিয়।
“আনমনে কেন? চা ভালোলাগছে না?”
ধ্যান ভাঙে মাহার। সচকিত হয়ে সার্থকের পানে তাকায় মাহা। মন উদাসীন লাগছে।
“আমার মনে হচ্ছে এর আগেও মালনীছড়ায় এসেছিলাম আমি।”
“হয়তো এসেছো ছোটবেলা কিংবা তোমার দেজা ভ্যুও হতে পারে।”
“এমনটা না। আমার…

“আসসালামু আলাইকুম, ভাইজান। ভালো আছেন?”
শক্তপোক্ত শরীর। ইয়া বড় গোফ। পরনে লুঙ্গি, শার্ট আর উপরে কালো চাদর। চৌকিদার খাজার মুখে হাসি। সার্থকও হেসে জবাব দেয়,
“ভালো আছি৷ তুমি ভালো তো খাজা?”
“আমিও খুব ভালো আছি ভাইজান।”
মাহা অবাক হয়ে খাজার পানে চেয়ে আছে। এই লোকটাকেও তো পূর্বে দেখেছে মাহা!
“তোমার ভাবি।”
মাহাকে দেখিয়ে বলে সার্থক। খাজা হাসে। হাসলে তাকে ভিষণ বিদঘুটে দেখায়।
“ভালো আছেন ভাবি?”
“হু…হুম। আচ্ছা, আমার মনে হচ্ছে আমি আপনাকে পূর্বে দেখেছি।”
“হতে পারে অন্য কাউকে দেখছেন। ভাইজান আমি যাই।” লোকটা দ্রুত পায়ে প্রস্থান করে।
ঘুরাঘুরি শেষে বাড়িতে ফিরে আসে তারা। মাহার মাথায় কেবল ঘুরছে একটাই কথা। এসব তো পূর্বেও দেখেছিলো মাহা। কিন্তু স্পষ্ট কিছুই মনে পড়ছেনা কেন! মুইংচিন এখন বেশি একটা মাহার সামনে আসেনা। এ বাড়িতে মুইংচিন, মেরি, নাহার, মালী সজল, ড্রাইভার লতিফ, দারোয়ান দুলাল আর সার্থক, মাহা থাকে। মাঝেমধ্যে ডেভিড আসে। কৃষ্ণাঙ্গ এই পুরুষটাকে মাহার পছন্দ নয়। কেমন করে যেন চেয়ে থাকে। খুবই বাজে দৃষ্টি তার। বাড়ির একপাশে পাহাড় আর অপরপাশে অর্থাৎ দক্ষিণাংশে ঝোপঝাড় সাথে ছোট একটা গ্যারেজ। মেরি বলেছে এই গ্যারেজটা নাকি বহুদিন পুরানো। আজ আকাশে চাঁদ নেই। বারান্দায় পেতে রাখা বেতের চেয়ারে বসে দূরে পাহাড়ের দিকে চেয়ে আছে মাহা। শো শো কেমন একটা আওয়াজ ভেসে আসছে দূর পাহাড় হতে। সার্থক বাইরে বেরিয়েছে একটু। রুমানার কলে ধ্যান ভাঙে মাহার। আজকাল ভিষণ আনমনে হয়ে যাচ্ছে মাহা। বাচ্চাটা মারা যাওয়ার পর কোনো কিছুই ভালোলাগে না তার। ফোন রিসিভ করে কানে ঠেকায় মাহা।
“কি রে কোকিল? তোরা সিলেটে শিফট করেছিস?”
“হুম”
“হারামী একবারও বললি না আমাকে। রেজওয়ান ভাইয়ার কাছে শুনলাম।”
“সরি, রুমানা। আমার আসলে কি যে হয়েছে। কিছুই ভালোলাগেনা। তুই কি আগামীকাল একটু আসতে পারবি আমার বাসায়? তোর বাবুটাকে নিয়ে আয়। দেখা হয়নি ওকে।”
“আচ্ছা, দেখি। শরীর কেমন এখন?”
“আছে, মোটামুটি। মনটা খালি উদাসীন লাগে।”
“চিন্তা করিস না। আমি আসবো আগামীকাল। আমাকে একটু তোর ঠিকানাটা মেসেজ করে দে।”
“আচ্ছা”

ঠিকানা মেসেজ করে মোবাইল রাখতেই সার্থকের ডাক।
“মাহা, তুমি কি বারান্দায়?”
“হুম”
“ঘরে এসো।”
ক্লান্ত দেখাচ্ছে সার্থক কে। সারাদিনে অনেক পরিশ্রম করে মানুষটা। মাহা এক গ্লাস পানি এগিয়ে দেয়। সার্থক এক লহমায় পান করে পুরো পানিটুকু। পিপাসা লেগেছিল খুব। মেয়েটাকে কিছু না বললেও অনেককিছু বুঝে যায়। মাহা সার্থকের পাশে খাটে বসতেই সার্থক মাহার কোলে মাথা রাখে। মাহাও আনমনে টেনে দিচ্ছে সার্থকের ঝাঁকড়া চুলগুলো। চোখ বুজে সার্থক।
“মাহা”
“হুম”
“আমি যদি কখনো না থাকি তুমি চলতে পারবেনা একা একা?”

হাত থেমে যায় মাহার।
“এসব কি বলছেন আপনি?”
“এমনি বাদ দাও। ঔষধ খাচ্ছো নিয়মিত?”
“কথা ঘুরাবেন না সার্থক। আপনি জানেন না এই পৃথিবীতে আপনাকে ছাড়া আমার আর কেউ নেই? কেন কষ্ট দেন আমাকে?”
“আহা রে। বোকা মেয়ে। আমি মজা করছিলাম রে বাবা।”
“এমন মজা কখনো করবেন না। আমার এমন মজা একটুও পছন্দ না।”
“ওকে, ওকে। এই যে কানে ধরলাম। আর কখনো বলবো না।”

ক্ষান্ত হয় মাহা। গোপনে দীর্ঘশ্বাস ফেলে সার্থক। জীবন নামক খেলায় এবার ক্লান্ত হয়ে পড়েছে সার্থক। মাহাকে নিয়ে একটা সুন্দর জীবনের স্বপ্ন কখনো পূরণ হবেনা সার্থকের। তাই যতদিন আছে মাহাকে নিয়েই থাকতে চায় সার্থক। আর কোনো পিছুটান নয়।

১১২.
সূর্যোদয়টা কি যে মনোরম! ধূসর আকাশে লালচে সূর্যের উঁকি! ধীরে ধীরে নিজের অস্তিত্বের বহিঃপ্রকাশ ঘটাচ্ছে লালচে সূর্যটা। বাগানে হরেকরকম ফুলের ছড়াছড়ি। পরাগ, বেলী, কুঁড়ি, দোপাটি, জবা, চাঁপা, কামিনী, চামেলী, ডালিয়া,গুলবাহার, কাঠ গোলাপ, ড্যাফোডিল, মালতি, টগর, গন্ধরাজ, জুঁই কি নেই বাগানটায়। এক কোণায় সারিতে অলকানন্দা গাছের সমাহার। সবুজের মাঝে থোকায় থোকায় ছড়িয়ে হলদে ফুলগুলো। কাঁচা হলুদ। মাহার গাঁয়ের রঙটাও এমন। সজল পানি দিচ্ছেন বাগানে। বাড়ির সবাই ঘুমে।
“চাচা, ভালো আছেন?”
মাথা নাড়ায় সজল। মাহা মাথার উড়না টেনে সজলের সামনে দাঁড়িয়ে।
“আমাকে দিন আমি পানি দেই।”

না বোধক মাথা নাড়ায় সজল। বাড়িয়ে থাকা হাতটা গুটিয়ে নেয় মাহা।
“আপনি কথা বলতে পারেন না, চাচা?”
এবারও না বোধক মাথা নাড়ায় সজল। আহারে! মাহার বড্ড মায়া হলো সজলকে দেখে। আশেপাশে ঘুরে দেখছে মাহা। স্নিগ্ধ ভোরের দাপটে সবকিছুই যেন অভূতপূর্ব হয়ে উঠেছে। পাহাড়, নদী, বাগান। অপূর্ব! মাহা মুগ্ধ। সবই ভালো তবে কেমন জানি গা ছমছমে লাগে। বিশেষ করে বাড়ির দক্ষিণ দিকটা। হয়তো পুরানো গ্যারেজ আর ঝোপঝাড় আছে বলে। মাহা রান্না বসিয়েছে আজ। সার্থকের পছন্দের খিচুড়ি, গরুর মাংস ভুনা আর বিরিয়ানি রান্নায় ব্যস্ত গৃহিণী। সার্থক উঁকি দিয়ে গিয়েছে দুয়েকবার। মাহা বকে পাঠিয়েছে। মেরি, নাহার সাহায্য করতে চেয়েছিলো। তবে মাহা নাছোড়বান্দা। সব করবে নিজ হাতে। টেবিলে খাবার সাজানোর সময়ই দাড়োয়ান দুলাল এসে জিজ্ঞেস করেন,
“স্যার, রুমানা নামে এক মহিলা আসছেন। ম্যাডামের নাকি পরিচিত।”
“হ্যাঁ। ভিতরে নিয়ে আসো।”

রুমানা আর ওর চার বছরের ছেলে এসেছে। বাড়িতে ঢুকেই দৌড়ে মাহাকে জড়িয়ে ধরে রুমানা।
“কেমন আছিস, কোকিল? ইস্ রে, একদম শুকিয়ে গেছিস।”
পাশে ছোট রাতুল দাঁড়িয়ে। মাহা খানিক হাসলো রুমানার কথায়। রাতুল কে কোলে নিয়ে বললো,
“তোমার মা সেই আগের মতোই আছে বাবা।”

সার্থকের সাথে কুশল বিনিময় হয় রুমানার। সোফায় বসে কথায় ব্যস্ত হয়ে গেলো দুই রমনী। সার্থক নিজেই খাবার নিয়ে খেয়ে নিয়েছে। অনেকদিন বাদে হাসোজ্জল দেখাচ্ছে মাহাকে। তাই ওকে আর বিরক্ত করতে চায়নি সার্থক। হাতে সাদা এপ্রন নিয়ে মাহার সামনে হাজির হয় সার্থক।
“মাহা, আমি আসি। আজ একটু ফিরতে দেরি হবে। রুমানা আজ থেকে যাবে কিন্তু!”

জিহবায় কামড় দেয় মাহা। ‘ইস্! গল্প করতে করতে সার্থক কে খাবার দিতেই ভুলে গিয়েছে সে!’ সার্থক খেয়াল করেছে সবটা। অতঃপর মুচকি হেসে বেড়িয়ে পড়ে সে।
“ফ্রেশ হয়ে খেয়ে নে। আজ আমি রান্না করেছি। রাতুল বাবা বিরিয়ানি খাবে তুমি?”

কি কিউট বাচ্চাটা! মাহার কথা শুনে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে।
“আন্টি কি বলছে? আন্টিকে বলো ইয়েস আন্টি। রাতুল খাবে।”

রাতুল চুপ। মাহা কোলে উঠিয়ে নেয় রাতুল কে। রাতুল প্রথমে চুপচাপ থাকলেও আস্তে আস্তে মাহার সাথে ভালো বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছে ওর। ‘আন্তি এতা কি? আন্তি ওতা কি?’ করে পাগল করে দিচ্ছে মাহাকে। মাহাও মনের আনন্দে জবাব দিচ্ছে। খাবার দাবার সেড়ে নাহারকে নিয়ে সারা বাড়ি ঘুরিয়ে দেখালো রুমানাকে। এখন দুজনে মিলে চা নিয়ে সোফায় বসেছে গল্প করতে। বিকেল ছুঁইছুঁই। রক্তিম আকাশ। পাখিগুলো ফিরে যাচ্ছে আপন নীড়ে। রাতুল সারা হলরুম ঘুরে ঘুরে খেলছে। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে রুমানা বলে,
“টুকিকে ভিষণ মনে পড়ছে রে কোকিল।”
কিছুক্ষণ শান্ত থাকে উভয়েই।

১১৩.
“টুকির বাবা চলে গেলেন বছর দুয়েক আগে। মেয়ের বিচার দেখে যেতে পারলেন না। পুলিশও তো কেসের কোনো অগ্রগতিই করছেনা। রেজওয়ান ভাইয়া কেসটা ছেড়ে দিলো আর কোনো গতিই হলোনা কেসটার। কি সুন্দর মায়াবী ছিলো টুকি। আহারে! ভালো মানুষগুলোই বুঝি আগে চলে যায়।”

দীর্ঘশ্বাস ফেলে রুমানা। মাহাও আনমনে হয়ে আছে।
“মাম্মা, মাম্মা….

হঠাৎ রাতুলের চিৎকারে সচকিত হয় দুজনে।
“কোকিল, রাতুল কই?”
“আব্বু, রাতুল আব্বু কই তুমি?”

দুজনেই পাগলের মতো খুঁজছে রাতুল কে। তবে রাতুল নেই! রুমানা কান্না করে দিলো এবারে। মাহা চিৎকার করে নাহার, মেরিকে ডাকলো। রাতুলের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। তবে কোথাও পাওয়া যাচ্ছেনা। প্যাচাঁনো সিড়ির অগ্রমুখের ডানপাশে একটা গলি। এদিকটায় লাইটের আলো কম আসে বিধায় গলিটা সহজে চোখে পড়েনা। দুপাশে সাদা দেয়াল। সম্মুখেও সাদা দেয়াল। তবে ছোট একটা জানালা আছে। একপাশের দেয়ালে একটা ঘরের দরজা। রাতুল ছোট গলিটায় বসে কাঁদছে। মাহা, রুমানা অনেক খুঁজাখুঁজির পর রাতুল কে সেখান থেকে উদ্ধার করলো। ভয়ে কাঁপছে ছেলেটা। রুমানা ছেলেকে কোলে নিয়ে বেরিয়ে আসে। কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি তুলছে রাতুল।
“আব্বু, ভয় লাগছে?”
“হু”
“ভয় পেয়োনা। মাম্মা আছিনা।”
“মাম্মা, লক্ত। অনেক লক্ত।”

ভয় পেয়ে আবোল তাবোল বকছে রাতুল। তাই রুমানা আর সেসব কথায় পাত্তা দেয়নি। কোলে ঘুম পাড়িয়ে দেয় ছেলেকে।
“আজ তবে আসি, কোকিল। ওর বাবা নিতে আসবে।”
“রাতুল কে আমার দেখে রাখা উচিত ছিলো। সরি রে রুমানা। আমার জন্য..
“তুই সব সময়ই বড্ড বেশি বকিস। তোর জন্য কিছুই হয়নি। ছেলেটা হয়েছে দুরন্ত। সব সময় খালি ছুটাছুটি।”

গেট থেকে রুমানাকে গাড়ি অবধি এগিয়ে দেয় মাহা। রুমানার স্বামী অনিক অপেক্ষা করছিলো গাড়ি নিয়ে। রুমানা গাড়ি থেকে বাইরে তাকিয়ে হঠাৎ কৃষ্ণবর্ণের এক লোকের পাশে জিদানের মতো কাউকে দেখলো মনে হলো। তারা মাহাদের বাড়িতে ঢুকছে। জিদান, রুমানার চাচাতো ভাই। কিন্তু জিদান এখানে কি করে! আদোও জিদান তো? নাকি ভুল দেখেছে রুমানা। গাড়ি অনেকদূর চলে এসেছে। তাই সেই ছেলেটিকে আর দেখা হয়নি রুমানার।

____________

“বাচ্চাটাকে মেরে ফেললেই হতো।”
“বোকার মতো কথা বলোনা। প্রাণের ভয় নাই।”
“কতদিন খাওয়া হয়না কাঁচা মাংস। কচি বাচ্চাদের মাংস!”

বলেই আফসোসের সুর তুলে লোকটা। কি বিভৎস দেখাচ্ছে তাকে!

(চলবে)……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here