#অলকানন্দা
#পর্ব-৪৫,৪৬,৪৭
#লেখিকা_আনিকা_রাইশা_হৃদি
৪৫
১১৯.
সিলেটের আবহাওয়া বড়ই অসহনীয় হয়ে উঠেছে রুমানার কাছে। জিদান তার কলিজাকে মেরে ফেলেছে! কি করে পারলো! এত ছোট একটা বাচ্চাকে মেরে ফেলতে। সম্পত্তির লোভ কি এতটাই তীব্র! অনিক রুমানাকে নিয়ে ঢাকা চলে গিয়েছে। আজ একমাস হলো। সেদিন জ্ঞান ফিরার পর থেকে রুমানা খুবই পাগলামি করছিলো। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। ডাক্তার বললেন এখান থেকে দূরে কোথাও রুমানাকে নিয়ে যেতে। তারপরই রুমানাকে নিয়ে ঢাকায় পাড়ি জমায় অনিক। মাহা এই ঘটনায় খুবই ভেঙে পড়েছে। এই অচেনা শহরে একজন ভালো বন্ধু ছিলো। সেও ছেড়ে চলে গেলো। রাতুলকে যেন মস্তিষ্ক থেকে সরাতেই পারছেনা মাহা। ছোট বাচ্চাটা। কি মায়াবী! দীর্ঘশ্বাস আসে মাহার বুক চিড়ে।
এই বাড়ির ছাদটা ভিষণ সুন্দর। নাহার বাড়ির খেয়াল রাখে। ছাদটা মনোরম করে সাজিয়েছে নাহার। চারপাশে পাহাড়ে ঘেরা। ছাদের মাঝখানে দোলনা রাখা। মাহা প্রায়শই আসে ছাদে। সার্থক বাসায় না থাকলে একাই সময় কাটে মাহার। কখনো ঢাকা থেকে আনা বই পড়ে, কখনো খাঁচায় বন্দী পাখিগুলোর সাথে কথা বলে। বাইরে বের হতে বেশি একটা ইচ্ছে করেনা। ডেভিডের নজর ভালো না। কেমন চোখে যেন তাকায়। সেই লুবানের মতো নোংরা নজর। পড়ন্ত বিকেল। স্বচ্ছ হিমেল হাওয়া বইছে। আকাশটা একদম রক্তবর্ণ। লাল টকটকে হয়ে আছে। কিছু পাখি ফিরছে নীড়ে। মাহা দোলনায় বসে আকাশ পানে চেয়ে আছে। নিজেকে অপয়া মনে হয়। সে যার সংস্পর্শে যায় তারই ক্ষতি হয়। প্রথমে চৈতি, এবারে রুমানা। সার্থককেও বাবা হওয়ার সুখ দিতে পারেনি। লোকটা দ্বিতীয় বিয়েও করতে চায় না। একবার বলার পরই কতদিন কথা বলেনি। হঠাৎ পিছনে কারো উপস্থিতি টের পেয়ে গা শিউরে ওঠে মাহার। অন্ধকার হয়ে এসেছে। আকাশের রক্তিম আভা সরে কালোর দল হানা দিচ্ছে। মাহা পিছনে না ফিরে উঠে দাঁড়ায়। আজকাল মুইংচিন কে বাসায় দেখা যাচ্ছেনা। খাজা নামের বিশাল দেহী লোক আর ডেভিডের হরহামেশাই চলাচল ঘটে বাড়িতে। মূলত মাহা এ কারণেই বাইরে বের হয়না। ডেভিড কে সুবিধার মনে হয়না তার। হঠাৎ পিছন থেকে কেউ ঝাঁপটে ধরলো মাহাকে। মাহা কিংকর্তব্যবিমূঢ়। বিশালদেহী মানবটার থেকে কোনো ক্রমেই নিজেকে ছাড়াতে পারছেনা মাহা।
“অনেকদিন পর পেলাম তোমায়। জানি মৃত্যু আমার হবেই। তোমাকে ছুঁয়ে দিলে সে আমাকে মেরে ফেলবে। কিন্তু তারপরও একবারের জন্য হলেও তোমাকে চাই।”
ডেভিড? ডেভিডের কন্ঠস্বর না এটা। মাহা চিৎকার করে উঠে।
“আমাকে ছেড়ে দিন।”
হা হা করে হেসে উঠে ডেভিড। আজ মাহাকে সে কোনোক্রমেই ছাড়বেনা। মাহা নিজেকে মুক্ত করতে চাইছে। তবে বিশালদেহী মানবের কাছে মাহা যে বড়ই অসহায়। মাহাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে মাহার ঘাড়ে ঠোঁট ছুঁয়ায় ডেভিড। মাহা শত চেষ্টা করেও তাকে সরাতে পারছেনা। মাহার দুটো হাত ডেভিড ধরে রেখেছে। এক পর্যায়ে মাহা নিজের হাঁটু দিয়ে ডেভিডের গোপনা’ঙ্গে আঘাত করে। ডেভিড একটা অশ্রাব্য গালি দিয়ে মাহাকে ছেড়ে দেয়। ভিষণ যন্ত্রণা হচ্ছে তার। মাহা দৌড়ে ছাদের দরজার কাছে যায়। দরজা খোলার কালে ডেভিড দৌড়ে আসে। মাহার উড়না মাটিতে পড়ে আছে। ডেভিড মাহার থ্রি-পিসের হাতাটা টেনে ছিঁড়ে ফেললো। মাহার উপর প্রবল আক্রমণ করে সে। মাটিতে ধস্তাধস্তি শুরু হয়। ডেভিডের হাত মাহার পায়জামা স্পর্শ করেছে। যেকোনো সময় টেনে ছিঁড়ে ফেলবে। মাহার মুখ অপর হাত দিয়ে ধরা। মাহা চিৎকার করতে পারছেনা। কেবল গোঙাচ্ছে। তার মন চিৎকার করে বলছে,
“সার্থক। সার্থক কোথায় আপনি? আমাকে রক্ষা করুন সার্থক।”
মাহার ধস্তাধস্তিতে রাগ উঠে যায় ডেভিডের। থাপ্পড় লাগায় মাহার গালে। হলদে ফর্সা মুখটা রক্তিম হয়ে উঠে। মাহা আর পারেনা। শরীর ছেড়ে দেয়। আজ হয়তো ও আর নিজের সম্ভ্রম রক্ষা করতে পারবেনা। তখনই ডেভিডের মুখে তীব্র আক্রোশে ঘুষি লাগায় কেউ। মাহার উপর থেকে ছিটকে সরে যায় ডেভিড। লাল টকটকে হয়ে আছে সার্থকের চোখমুখ। মাহা সার্থক কে দেখার সাথে সাথেই জ্ঞান হারায়।
ডেভিড হকচকিয়ে যায়। শরীর নরম হয়ে আসে তার। মাথা ভনভন করে ঘুরছে। নিজের মৃত্যু নিজের চোখে দেখতে পারছে সে। পালিয়ে যেতে চাইলে তাকে আঁকড়ে ধরে সার্থক। কানে কানে ফিসফিসিয়ে বলে,
“বুক কাঁপলো না একবারও?”
গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছে ডেভিডের। হঠাৎ সে টের পায় তার গলায় সূক্ষ্ম আঘাত। ছাদের কৃত্রিম মাটিতে লুটিয়ে পড়ে ডেভিড। সার্থক মাহাকে কোলে নিয়ে নিজের ঘরে চলে আসে। জামা পাল্টে দেয় মাহার। এক ধ্যানে তাকিয়ে থাকে মাহার ঘুমন্ত মুখমণ্ডলের পানে। মাহার চুলে হাত বুলায়। সবকিছু ধ্বংস করে দিতে মন চাইছে তার। তার ফুল, তার অলকানন্দা। ডেভিড কি করে পারলো তার ফুলে আঘাত করতে!
“আমি তোমার জন্য আমার সাম্রাজ্য ধ্বংস করে দিবো, অলকানন্দা।”
মাহার কপালে চুমু খেয়ে উঠে দাঁড়ায় সার্থক। একটা ইনজেকশন পুশ করে মাহার হাতে।
__________
ওয়েন্ডিগো এক তীব্র মাংসাশী প্রাণী। নিজের শিকার কে ছিন্ন বিচ্ছিন্ন করে আহারেই তার সুখ। আজ বহুদিন বাদে মানুষের মাং’স গ্রহণ করে ছায়ামানব। বুক চিড়ে টকটকে লাল হৃদপিণ্ডে কামড় বসায় সে। নিজের শত্রুর মাং’স গ্রহণে সে যে বড়ই মজা পায়।
১২০.
“আমার ডেভিড কোথায়?”
মেরির চিৎকারে ঠোঁটে হাত দিয়ে চুপ থাকতে বলে সার্থক। মেরি আক্রশে ফেটে পড়ে।
“কেন চুপ থাকবো আমি? আমার ডেভিড কে আমার ফেরত চাই।”
“ডেভিডের নাম আরেকবার উচ্চারণ করলে কি যে হবে তুমি কল্পনাও করতে পারবেনা।”
সার্থকের ঠান্ডা আর শান্ত বুলিতে থমকে যায় মেরি। কোনো কথাই সে আর বলার মতো পায় না। সমস্ত ক্ষোভ গিয়ে পড়ে মাহার উপর।
সকালে ঘুম থেকে উঠে মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে মাহা। মাথাটা ভিষণ ভারী লাগছে। সে গতকাল বিকেলে ছাদে দোলনায় বসেছিলো। পরে? পরে কি হলো? কোনোভাবেই মনে পড়ছেনা।
“মাহা, উঠে গেছো। কাল তো ভয়ই পাইয়ে দিয়েছিলে। আমি ছাদে উঠে দেখি তুমি দোলনা থেকে নিচে পড়ে আছো।”
সার্থকের কথায় অবাক হয় মাহা। সে নিচে পড়ে গিয়েছিলো? তার তো মনে পড়ছেনা!
“আমার কিছুই মনে পড়ছেনা সার্থক।”
“মনে থাকবে কি করে? জ্ঞান হারিয়ে গিয়েছিলো ম্যাডাম। আমাকে অশান্তিতে রেখে কি মজা পান বলেন তো? আমি কতটা ভয় পেয়েছিলাম জানো তুমি?”
মাহার নাকটা আলতো করে টেনে দিয়ে বলে সার্থক।
“যাও ফ্রেশ হয়ে এসো। আমি স্যূপ নিয়ে এসেছি।”
“হুম”
চলবে….
#অলকানন্দা
#পর্ব- ৪৬
#লেখিকা_আনিকা_রাইশা_হৃদি
১২১.
“দেখি হা করো।”
সার্থক মাহাকে স্যূপ খাইয়ে দিচ্ছে। মাহা আনমনে খাচ্ছে।
“এমন আনমনা কেন?”
“আমার না কি যেন হয়েছে সার্থক। সব খালি ভুলে যাই।”
“খাবার তো নিয়মিত খাও না। তাই স্মরণশক্তি কমে যাচ্ছে। বেশি বেশি খাবে।”
রসিকতা করে বলে সার্থক। তার মুখে আলতো হাসি। মাহা বাঁকা চোখে তাকায়। এই লোকটাকে বোঝা দায়। এমন সিরিয়াস পরিস্থিতিতেও রসিকতা করছে।
“সার্থক, মুইংচিন কে অনেকদিন যাবত দেখিনা। উনি কি কোথাও গিয়েছে?”
“হুম, চীনে ফিরে গিয়েছে।”
অবাক হয় মাহা। অদ্ভুত মানুষ তো! মাহাকে যাওয়ার আগে কিছু বলে যায়নি। এতদিনের পরিচয়।
“মাহা, ঘুরতে যাবে?”
“কোথায়?”
“যেখানে আমরা পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলাম।”
“সেই সাঁওতাল পল্লি?”
“জ্বি, ম্যাডাম।”
মাহা ভাবলো খানিকক্ষণ। সার্থককে তো কাছেই পাওয়া যায় না। আর এই বদ্ধ বাড়িতে থাকতেও আর ভালো লাগছেনা। একটু মুক্ত বাতাস, একটু সার্থকের সান্নিধ্য প্রয়োজন। ঘুরে আসলে মন্দ হয় না। মানসিক শান্তিও পাওয়া যাবে।
“কি ভাবো? যাবে?”
“যাওয়া যায়।”
“আচ্ছা, এবার একটু কাছে আসো তো আদর করি।”
এমন বেহায়াপনা কথায় ভারী লজ্জা পায় মাহা। দূরে সরে যেতে চায়। তবে সার্থক কি তা হতে দিবে? একটানে মাহাকে নিজের বুকের উপর নিয়ে আসে সার্থক। উত্তপ্ত চুমো খায় অধরে। গভীর হয় স্পর্শ।
সহস্র সময় বাদে সার্থকের বুকে মাথা রেখে শুয়ে আছে মাহা। সার্থক মাহার উন্মুক্ত চুলের ঘ্রাণ নিতে ব্যস্ত।
“মাহা, ঔষধ নিয়মিত খাচ্ছো তো? ঔষধটা কিন্তু তোমার শরীরের জন্য জরুরি।”
“খাচ্ছি”
মিথ্যে বলে মাহা। সে ঠিকমতো ঔষধ খাচ্ছেনা বিগত কয়েকদিন যাবত। ঔষধ তার মোটেও পছন্দ না।
_____________
দুদিন বাদে মেরি, নাহার, সজল সবাইকে বিদায় জানিয়ে সাঁওতাল পল্লির উদ্দেশ্যে রওনা দেয় দুজনে। অনেকখানি পথ। আজ দিনটা বড়ই স্বচ্ছ। দুপাশে সারি সারি সুপারি গাছ পেরিয়ে পাজেরো গাড়িটা ছুটছে আপনগতিতে। কালো পোলো টি-শার্ট, জিন্স পরনে সার্থক ড্রাইভ করছে সামনে তাকিয়ে। রুষ্ট পুষ্ট শরীরের হাতের মাসল গুলো ফুলে আছে। ফর্সা মুখটা। ঝাঁকড়া চুলগুলো। ইস! মাহা আবার যেন প্রেমে পড়লো সার্থকের। কিন্তু মনটা ভিষণই খারাপ তার। এই যে মাহা এত সুন্দর কালো জামদানী পরেছে, কাঁচের চুরি পরেছে। কোঁকড়া চুলগুলো ছেড়ে রাখা। সার্থক একবারের জন্যও তার প্রশংসা করেনি। মাহাও এখন পর্যন্ত টু শব্দটি করেনি। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে সে। হঠাৎ গাড়ি থামায় চমকে উঠে মাহা। আকাশে উড়ে বেড়ানো পাখিগুলো দেখা হয়না। প্রশ্নবোধক চাহনি মেলে দেয় সার্থকের পানে। ততক্ষণে সার্থক একদম মাহার কাছাকাছি চলে এসেছে। মাহা চোখ বন্ধ করে নেয়। সার্থক ভালোবাসার পরশ এঁকে দেয় কপালে। কানে কানে ফিসফিসিয়ে বলে,
“এক বুক ভালোবাসা দিলাম আমার রমণীকে। ভিষণ সুন্দর লাগছে।”
লজ্জা পেয়ে সার্থকের বুকে মুখ লুকায় মাহা। সার্থক হাসে। বড় প্রাণখোলা সে হাসি। পথিমধ্যে মাহাকে একবার আইসক্রিমও কিনে দিয়েছে সার্থক। সকাল পেরিয়ে বিকেল। একটু পর সন্ধ্যা নামবে। পাহাড়ি উপত্যকা দিয়ে গাড়ি চলছে। আকাশ তখন ধূসর বর্ণ। শো শো বাতাস বইছে। অবশেষে রাতের বেলায় সাঁওতাল পল্লিতে প্রবেশ করে তারা। এখানে আগামীকাল সারাদিন থাকবে দুজনে। ছোট জনপদ। মাটির ঘরগুলোতে মশাল জ্বালিয়ে রেখেছে সকলে। সার্থক মাহাকে নিয়ে নামতেই কানুসহ বাকিরা এগিয়ে আসে হাতে মশাল হাতে।
“ভালো আছেন বাবু? আপনারা এসেছেন আমরা বড়ই খুশি হয়েছি।”
“ভালো আছি কানুভাই। আপনি ভালো আছেন তো?”
“আছি, আছি। বেশ আছি। চলুন আপনারা আমাদের প্রধানের বাড়ি যাবেন। উনি অপেক্ষা করে আছেন।”
এক হাতে মাহাকে ধরে অপর হাতে ব্যাগ নিয়ে সার্থক চলছে কানুদের সাথে। মিষ্টির প্যাকেট মাহার হাতে। সেই পুরানো ছিমছাম বাড়ি। এই এলাকার সবচেয়ে বড় বাড়ি এটা। ধুতি, ফতুয়া পরনে জগত মুর্মু নিজের আসনে বসে আছেন। কলাপাতার বেড়া পেরিয়ে সার্থক মাহা প্রবেশ করে বাড়ির উঠানে। সার্থকের চোখ যায় বাঁশের তৈরি মাচায়। এই মাচার উপরই মাহাকে নিয়ে বসেছিলো সে। আর মাহা তখনও ঘুমে। সান্তালী ভাষায় কুশল বিনিময় করলেন সাঁওতাল প্রধান জগত মুর্মু। কানু সেসব বিশ্লেষণ করে দিলো। কানুর সাথে কয়েকদিন আগে হাসপাতালে দেখা হয়েছিলো সার্থকের। জগত মুর্মুর মেয়ের অপারেশনে সাহায্য করেছিলো সার্থক। তারপর থেকেই তারা কৃতজ্ঞ সার্থকের প্রতি। দাওয়াতও দিয়ে গিয়েছিলেন। মিষ্টির প্যাকেটগুলো হাতে পেয়ে বড়ই খুশি হলেন জগত। ফতা পরিহিত জগত মুর্মুর স্ত্রী তাদের অতিথি কক্ষে নিয়ে এসেছেন। ভদ্রমহিলা খুবই ভালো। এই ঘরটায় একটা জানালা রয়েছে। মাহা সেই জানালার ধারে গিয়ে দাঁড়ায়। একদিন এক অপরিচিত ব্যাক্তির সাথে এই ঘরে ছিলো মাহা। সময় পেরিয়েছে। আজ সেই ব্যাক্তিটা আর অপরিচিত নেই। মাহার ধ্যান, জ্ঞান সবই তিনি। মাহার একান্তই মনের মানুষ। মাহার আপনজন। মাহাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে সার্থক।
“কি ভাবছো এতো?”
“সময় কত তাড়াতাড়ি চলে যায়। তাই না সার্থক?”
“কেন এমনটা মনে হলো?”
“এই যে দেখুন না। এই ঘরে বছর চারেক আগেও আমি আপনি ছিলাম সম্পূর্ণ অপরিচিত। আর আজ..
” আজ কি?”
“আজ আপনি আমার একমাত্র আপনজন।”
জানালার পাশে অনেকটা সময় দাঁড়িয়ে ছিলো দুজনে। খাবার দিতে ডাকা হয় তাদের। তখনই ধ্যান ভাঙে দুজনের। খাবার খেয়ে শুয়ে পড়ে তারা। বড়ই ক্লান্ত কিনা। ভোরের দিকে সার্থকের ডাকে ঘুম ভাঙে মাহার। একটু নড়েচড়ে আবার ঘুমে তলিয়ে যায় সে।
“মাহা, উঠো। উঠো পাখি।”
“উফ্! সার্থক আরেকটু। ঘুমাতে দিন না।”
“আচ্ছা, এসে ঘুম দিও আবার। এখন চলো না প্লিজ।”
অগত্যা মাহাকে উঠতে হলো। রাতে শাড়ি পাল্টে নীল রঙের একটা থ্রিপিস পরেছিলো মাহা। তারই উড়না গায়ে জড়িয়ে নেয়। সার্থক তাড়া দিয়ে মাহাকে বাইরে নিয়ে এসেছে।
“কোথায় যাবেন?”
“আসার সময় একটা বিস্তৃত মাঠ দেখেছিলাম। সেখানে যাবো।”
এই লোকটাকে নিয়ে আর পারা গেলো না। মাঠ কি পরে দেখলে হতো না। মাহার ঘুম ভাঙালো শুধুশুধু। এত বিস্তৃত না হলেও মাঝারি আকৃতির একটা মাঠ। দূরে কেবল পাহাড় আর পাহাড়। সবুজে ঘেরা চারপাশ। আকাশে তখনো সূর্য উঠেনি। মাঠের ঘাসগুলোতে শিশির বিন্দু জমে আছে। ঠান্ডা হাওয়া বইছে। সার্থক শুয়ে পড়লো ঘাস আবৃত মাঠে। সাথে মাহাকেও নিলো। মাহা সার্থকের বামহাতের উপর মাথা রেখে শুয়ে।
“কি করছেন বলেন তো আপনি? কেউ দেখে ফেললে কি হবে?”
“দেখলে দেখুক। আমার বউ। আমি যা খুশি তাই করবো।”
“পাগল একটা।”
নীলচে আকাশ চিড়ে আস্তে আস্তে বেরিয়ে আসছে রক্তিম সূর্য। ধূসর মেঘের দলেরা ভিড় জমিয়েছে চারপাশে। লালচে সূর্যটা এবার সম্পূর্ণ বেরিয়ে এলো। হলুদ, লাল আর নীলের সমন্বয়ে সে এক অভাবনীয় দৃশ্য। মাহা অবাক নয়নে চেয়ে রইলো। চোখ দুটো চকচক করে উঠে তার। কি মনোরম প্রকৃতি! সার্থক কে আলতো করে জড়িয়ে ধরে ধন্যবাদ জানায় মাহা। তারপর সারাদিন তারা কতকিছু করলো! চা বাগান ঘুরলো, ভাপা পিঠা খেলো। রাতে পোড়া মুরগীর ভোজন করলো। খুবই সুন্দর কেটেছে তাদের সময়। আজ আবার ফিরে যাচ্ছে বাড়ি। আচ্ছা, এটা তো সার্থকের জীবন? অভিশপ্ত জীবন। এত সুখ দুজনার কপালে সইবে তো?
চলবে….
#অলকানন্দা
#পর্ব-৪৭
#লেখিকা_আনিকা_রাইশা_হৃদি
১২২.
সার্থক বাসায় নেই। আজ দিনটা বেশ রৌদ্রজ্জ্বল ছিলো। একেবারে কাঠফাটা রোদ গিয়েছে আজ। এমন দিনে মন কেমন করে। গরম হাওয়ায় মন দোলে। বোধ জাগে হয়তো ঘটবে কোনো অশোভন ঘটনা। সারাদিনে অবশ্য তেমন কিছুই ঘটেনি। এখন সন্ধ্যে গিয়ে রাতের আর্বিভাব। মাহার শরীরটা আজকাল বেশি একটা ভালো যাচ্ছেনা। খাবারে বেশি রুচি নেই। সাঁওতাল পল্লি থেকে তারা বাড়ি ফিরেছে আজ মাসখানেক হতে চললো। মাহার দিনগুলো ভালোই কেটেছে। পাহাড়ের মনোরম নয়নাভিরাম, প্রিয় মানুষটার গভীর ভালোবাসা। সব চাইতে বড় কথা ডেভিড বাসায় আসেনা। মাহা স্বাচ্ছন্দ্যে ঘুরে বেড়ায়। নাহার অবশ্য সঙ্গে থাকে। ম্যাম এটা করবেন না ওটা করবেন না। এখানে যাবেন না ওখানে যাবেন না। সবকিছুতে বাঁধা। মাহা ভ্রু কুঁচকায়। বিরক্ত হয়। অদ্ভুত তো! মনিব কে আর কর্মচারী কে মাহা যেন গুলিয়ে ফেলে। সার্থক স্যার মানা করেছেন এই তার একমাত্র অজুহাত। এই তো সেদিন মাহা বাড়ির পাশে পরিত্যক্ত গ্যারেজের মতো জায়গাটায় যেতে চাইলো। কোথ থেকে দৌড়ে এসে নাহার চিৎকার দিয়ে বললো, ‘ঐদিকে যাবেন না। সাপ আছে।’ অগত্যা মাহাকে ফিরে আসতে হলো। শরীরটা ভিষণ ক্লান্ত লাগছে মাহার। নাহারকে দুবার ডেকেছে একটু লেবু শরবত করে দিতে। কিন্তু কোনো সাড়া নেই। মেরির কি যেন হয়েছে। কথা বলেনা। প্রশ্ন করলে জবাব দেয় না। তাই মাহাও আর আগ বাড়িয়ে কিছু জিজ্ঞেস করতে যায় না। নাহার কে আরেকদফা ডেকেও কোনো সাড়া পাওয়া গেলো না। মাহাকেই নামতে হলো নিচে। ডিএনএর ডাবল হেলিক্স সূত্রের ন্যায় প্যাঁচানো সিড়ি। ঘুরে ঘুরে নামতে হয়। মাহা এক পা এক পা করে এগুচ্ছে। নিরব চারপাশ। হলদে বাতির টিমটিমে আলো। বাইরে একটা দাঁড়কাক ডাকছে বোধহয়। কা কা করে। বিচ্ছিরি আওয়াজ। মনে হলো পিছনে কেউ আছে। মাহা মাথা ঘুরিয়ে পিছনে চাইলো। উঁহু, নেই। আবারো হাঁটছে মাহা। একপা একপা করে সিঁড়ি ডিঙিয়ে নিচে নামছে। কেউ একজন আছে পিছনে। গা শিরশির করছে। মাহা এবার পায়ের গতি বাড়ায়। সেই সাথে পিছনের মানুষটার পায়ের গতিও বাড়ে। মাহা ভয় পায়। পিছনে তাকানোর নিয়মটা সে ভুলে গিয়েছে। অর্থাৎ কি করে ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে চাইতে হয় তার মস্তিষ্ক মনে করতে পারছেনা। সেই সাথে গলার স্বরযন্ত্রও শত্রুতা শুরু করেছে। স্বর তৈরি করার নিয়ম ভুলে বসেছে। চিৎকার করতে পারছেনা মাহা। হাত পা কাঁপছে। প্যাঁচানো সিঁড়িটার প্রায় শেষপ্রান্তে মাহা। হঠাৎ তীব্র ধাক্কা লাগলো পিঠে। কিন্তু মাহা পড়ে যায়নি। সে শক্ত করে সিঁড়ির কাঠের বেষ্টনী ধরেছিলো। এখনো সে পিছনে ফিরে তাকায়নি। কিন্তু বুঝতে পারলো হয়তো হামলা হবে। অনুভব হলো তেমনই। দিশেহারা হয়ে মাহা ডানপাশে গলিতে ছুটে গেলো। অন্ধকার এপাশটা। পিছনের ব্যাক্তিটাও আসছে পিছুপিছু। এই গলিটাতেই রাতুল বসে কান্না করছিলো। সেদিন যে মাহা এসেছিলো। এরপরে আর এখানে আসা হয়নি। এখানে না একটা দরজা দেখেছিলো মাহা? পিছনের ব্যাক্তি ক্রমশ এগিয়ে আসছে। মাহা অন্ধকারেই গলির দেয়ালে দরজা খুঁজে চলেছে। শরীর কাঁপছে তার। ব্যাক্তিটা এগিয়ে এসেছে। দরজাটা খোলাই ছিলো। মাহা ভিতরে ঢুকে দরজা আটকানো কালে বিপত্তি বাঁধে। কেউ একজন দরজা ঠেলে ভিতরে প্রবেশ করতে চাইছে। মাহা নিজের সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগ করছে। অবশেষে দরজা আটকাতে সফল সে। ঘরটায় বিদঘুটে অন্ধকার। কেমন এক ভ্যাপসা গন্ধ। হঠাৎ মনে হলো কি যেন একটা উড়ে গেলো সামনে দিয়ে। এদিকে দরজায় আঘাত করেই চলেছে কেউ। মাহা ধপ করে নিচে বসে পড়ে। বদ্ধ স্থানে দম আটকে আসছে তার। ক্লাস্টোফোবিয়ায় আক্রান্ত মাহা। বদ্ধ স্থানে উন্মাদের মত লাগছে তার। মাথা ঘুরছে। দরজায় আঘাতও কমে গিয়েছে। তবে এত চাপ নিতে না পেরে কোথায় যেন হারিয়ে যায় মাহা।
____________
পাহাড়ের ধারে ইংলিশ তরুণীকে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে। দু’হাত বাঁধা, মুখ বাঁধা। চোখে বাঁচার আকুতি। সামনে দাঁড়িয়ে মাউথ অর্গান বাজাচ্ছে ছায়ামানব। বড়ই অদ্ভুত সুরে। তরুণী মুখে শব্দ করার চেষ্টা করছে। বিরক্ত হয়ে রক্তচক্ষু নিয়ে মেরির পানে চাইলো ছায়ামানব। হৃদয়ে হিম ধরানো চাহনি। তরুণী শব্দ করা বন্ধ করে চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে রইলো। পুরো নাম মেরি পারকার। চোখের সামনে ভেসে উঠলো অতীত। বাবা-মায়ের বিচ্ছেদ। নিজের দেশ ছেড়ে কানাডায় চলে আসা।জীবিকার তাগিদে ঘুরে বেড়ানো। এক রহস্যময় মানবকে মাঝরাতে খুঁজে পাওয়া। বিশাল এক গোষ্ঠীর সাথে পরিচিত হওয়া। অদ্ভুত খাদ্যের সন্ধান। মা’নু’ষের মাং’স। প্রথমে জোর করে এক টুকরো খাওয়ানো হয়েছিলো। বমি করতে করতে গলা দিয়ে র’ক্ত চলে এসেছিলো তার। তবে কেমন যেন নেশা ধরানো স্বাদ। মৃ’ত্যুর মুখে এসেও জিহ্বায় পানি চলে আসে মেরি পারকারের। আস্তে আস্তে আসক্তি। মাংসের বিনিময়ে কাজ। কত বছর কেটে গেলো। অতঃপর বাংলাদেশে আগমন। ডেভিড..
কিছু ভাবার পূর্বে নিজের শরীরে ধাক্কা অনুভব করে মেরি পারকার। সময় ফুরিয়ে এসেছে। শূন্যে ভেসে যাচ্ছে মেরি পারকার। হঠাৎ শরীরে আকস্মিক সংঘাত। চোখ বুজে আসে। অবসান ঘটে আরো একটা অধ্যায়ের।
____________
অন্ধকার রাস্তা। মাহা হেঁটে চলেছে একমনে। দু’ধারে বন্য তরুর মেলা। হাঁটছে তো হাঁটছেই। রাস্তা ফুরোয় না। পাশ দিয়ে একটা ঘোড়া দৌড়ে যাচ্ছে। মাহা তাকায় এক পলক। কালো রঙের এক ঘোড়া। তার উপরে চৈতি বসেনা? সাদা শাড়ি পরে চৈতি মুখ অন্ধকার করে আছে। ছোঁয়ার আগেই কোথায় যেন মিলিয়ে গেলো সেই ঘোড়া সহ চৈতি। মাহা হাঁটছে। মিলিয়ে গেলো সব। ঢাকার এক ব্যস্ত রাস্তা। ‘ভুট্টা, ভুট্টা, আফা ভুট্টা নিবেন?’ হাঁক ছাড়ছে ভুট্টা বিক্রেতা। মাথার উপর কাক ডাকছে। কাঠফাটা রোদ। রাস্তার যানবাহনের বিকট শব্দ। একটা বাচ্চা কান্না করছে। তার মা তাকে থামানোর চেষ্টা করছে। আবার…
আবার সব থমকে গেলো। বিশাল এক মাঠ। বালুর মাঠ। মাহা হেঁটে চলেছে। এখানে অবশ্য শব্দ নেই। আবছা আলো। মাহা সামনে চেয়ে থমকে গেলো। ম’র্গে দেখা চৈতির পা সামনের দিক থেকে উড়ে আসছে। কেবল ছি’ন্ন পা। দেহের অন্যান্য অংশ নেই। মাহা ভয় পেয়ে পিছনে ফিরলো সেদিক থেকেও একটা পায়ের খ’ন্ড আসছে। ডান বাম থেকেও। এবারে স্বরযন্ত্র কাজ করেছে। চিৎকার করছে মাহা। হঠাৎ কারো স্পর্শ পায় গালে।
(চলবে)