#অলকানন্দা,৪৮,৪৯,৫০
#লেখিকা_আনিকা_রাইশা_হৃদি
#পর্ব- ৪৮
১২৩.
গালে পরিচিত মানুষটার স্পর্শে ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে মাহা। চোখ মেলতে কষ্ট হয়। লাইটের কড়া আলোয় চিনচিনে ব্যথা হচ্ছে চোখে। সহনশীল হয়ে উঠে আলোর মাত্রা। সার্থক কে চোখের সামনে দেখে জড়িয়ে ধরে মাহা। হাত পা কাঁপছে তার। সার্থক মুখে কিছু বলেনা। কেবল একখানা চুমু খায় মাহার অগোছালো চুলের ভাঁজে।
“ভয় পেয়ো না মাহা। আমি আছি তো। চারপাশে তাকিয়ে দেখো। এটা একটা লাইব্রেরি বোকা মেয়ে।”
মাহা সার্থক কে জড়িয়ে ধরেই চোখ বুলায় চারপাশে। সত্যিই তো। গুলশানের বাসার লাইব্রেরির মতো এটাও একটা লাইব্রেরি। তবে মাকড়সার জালে ভরপুর। উপরে দু একটা বাদুড়ও উল্টে শুয়ে আছে তারে। তখন বোধহয় এই বাদুড়গুলোই উড়ছিলো। মাহা মুখ খুলে কিছুই বলতে পারছেনা। ভিষণ ভয় হচ্ছে তার। সার্থক কথা না বাড়িয়ে মাহাকে কোলে নিয়ে নিজ ঘরে চলে আসে। মাহা তখনও ভয়ে স্তব্ধ, বাকরুদ্ধ। মাহাকে জড়িয়ে ধরে বিছানায় কতক্ষণ বসে থাকে সার্থক।
“কি হয়েছে মাহা? ভিষণ ভয় পেয়েছিলে?”
“হু”
“এখনও ভয় লাগছে?”
মাহা মাথা নাড়ায়। অর্থাৎ তার ভয় লাগছেনা।
“কি হয়েছিলো?”
“কে যেন পিছু নিচ্ছিলো আমার। আমি ভয় পেয়ে ঐখানে লুকিয়ে পড়ি।”
“চোর ছিলো বোধহয়। সজল দেখেছিলো কে যেন গেট দিয়ে বাইরে বের হয়ে যাচ্ছে। আমি পুলিশে জানিয়েছি। ভয় নেই আর।”
মাহা সার্থকের বুকে মাথা রাখে। এত সুখ, এত শান্তি কেন এই বুকটায়?
_____________
বিগত কয়েকদিন যাবত মেরিকে বাসায় দেখতে পাচ্ছেনা মাহা। কি আশ্চর্য! একে একে কোথায় হারিয়ে যাচ্ছে সবাই? লুবান, নিভা, রবার্ট, মুইংচিন, ডেভিড আর এখন মেরি। সার্থক কে জিজ্ঞেস করবে করবে করেও আর করা হয়নি। আজ রুমানার সাথে কথা হয়েছিলো মাহার। মেয়েটা একটু স্বাভাবিক হয়েছে। কিন্তু ক্ষ’ত কি এত সহজে মুছে যায়? বাগানের অলকানন্দা ফুলগুলো ভিষণ ভালোলাগে মাহার। ফুলগুলোই দাঁড়িয়ে দেখছিলো সে। হঠাৎ পিছন থেকে সার্থক জড়িয়ে ধরে।
“কি দেখো?”
“ফুলগুলো ভিষণ সুন্দর। তাই না?”
মাহাকে ছেড়ে দিয়ে একখানা অলকানন্দা ফুল ছিঁড়ে সার্থক। মাহার কানে গুঁজে দেয় ফুলখানা। হলদে মুখশ্রী তে কি অপূর্ব দেখাচ্ছে তার অলকানন্দা কে। কুঁকড়া চুলের এই রমনীকে যত দেখে ততই তৃষ্ণা বাড়ে তার। মাহা মাথা নুইয়ে আছে। লজ্জা লাগছে তার। সার্থক মাহার কপালে ভালোবাসার পরশ এঁকে দেয়। মাহার কোমড় ধরে নিজের কাছে এনে ফিসফিসিয়ে বলে,
“আমার অলকানন্দার কাছে এই ফুল তুচ্ছ। আমার অলকানন্দার রূপে চাঁদও যে লজ্জা পায়।”
বলেই ঠোঁট জোড়া আঁকড়ে ধরে। লজ্জায় মাটিতে মিশে যাওয়ার দশা মাহার। বাইরে দাঁড়োয়ান আছে। একটু দূরে সজল মালি দাঁড়িয়ে। নাহার আছে। এত মানুষের সামনে এমন বেহায়াপনা মানায়! লোকটা কি নির্লজ্জ হয়ে গেলো নাকি! মাহা নিজেকে ছাড়িয়ে বাসায় ছুটে যায়। সার্থক হাসতে হাসতে কাজে বেরিয়ে পড়ে।
বিকেলবেলা মাহা বই পড়তে আসে সেই লাইব্রেরিটায়। সেদিনের পর সার্থক লাইব্রেরিটা পরিষ্কার করিয়েছে। সার্থকের ইচ্ছে ছিলো না। মাহার জিদে। অনেক অনেক বই এখানে। মাহা প্রায়শই এখানে বসে বই পড়ে। ডানদিকের দেয়ালে বড় একটা জানালা রয়েছে। খুলে দিলে আলো সারা ঘরে ছড়িয়ে পড়ে। মাহার বেশ লাগে। তবে বেশ গাঁ ছমছমে এই ঘরটা। কেমন যেন বসে থাকলেই শরীর কাঁটা দিয়ে উঠে হঠাৎ করে। মাহা হুমায়ুন আহমেদের নন্দিত নরকে বইটি খুলে আনমনে বসে আছে। আসলে সে একটা কথা জানতে পেরেছে। যদিও বিষয়টা এখনো সার্থক কে জানায়নি। সার্থক ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছে কিনা তাও মাহা জানেনা। ডাক্তারের চোখ বলে কথা। কিংবা ব্যস্ততার কারণে এতদিকে খেয়াল করেনি। মাহা একটা প্রেগ্ন্যাসি কিট এনে পরীক্ষা করেছিলো। স্পষ্ট দুটো দাগ। এরমানে বুঝায় মাহা প্রেগন্যান্ট। কিন্তু ডাক্তার যে বলেছিলো সে কখনো মা হতে পারবেনা? হুট করে একটা শব্দ হয়। পিনপতন নীরবতার মাঝে ভয়ংকর শুনায় কানে। মাহা সেদিকে তাকিয়ে দেখে একটা বই নিচে পড়ে আছে। নিশ্চয়ই কোনো ইঁদুর ফেলেছে হয়তো। মাহা বইটা উঠিয়ে রাখতে এগিয়ে যায় বুক সেলফের পাশে। নিচে ঝুঁকে বইটা নিয়ে রাখার সময়ই বড় বুক সেলফের ভিতরে একটা ডায়েরি চোখে পড়ে মাহার। লাল রঙের একটি ডায়েরি। বহুদিনের পুরানো হয়তো। কৌতূহলী হয়ে ডায়েরিটা হাতে নেয় মাহা। কিন্তু বিবেক বাঁধা দেয়। কার না কার ডায়েরি। কত পার্সোনাল কথা লিখা আছে হয়তো। খুলবে কি খুলবেনা? বইটা সেলফে রেখে কাঠের চেয়ারে বসে মাহা। ডায়েরিটা খুলেই ফেলে৷ প্রথম পৃষ্ঠায় বড় বড় করে লিখা, “The story of a shadow man”. সেডো ম্যান মানে তো ছায়া মানব? আচ্ছা, কি ঘটেছে তার জীবনে? মাহা কৌতূহলী হয়ে পৃষ্ঠা উল্টায়। উপরে স্পষ্ট করে ইংরেজিতে একটি লাইন লিখা,
“No darkness, no pain, no sorrow”
আমি ছায়ামানব। অন্ধকার রাজ্যের রাজা। বিধ্বংসী খেলায় আমার বেশ নাম ডাক। ডার্ক সোসাইটি তে আমি বেশ শক্তপোক্ত অবস্থান গড়েছি। কিন্তু এই অন্ধকার আমার পছন্দ না। একসময়ের নাজুক আমি আজ মানুষ খুন করি, ভক্ষণ করি। মানুষের মাং’সে অদ্ভুত স্বাদ। বড়ই জিভে জল আনা স্বাদ। আজ খুব একাকিত্বে ভুগছি। তাই লিখবো। লাজুক এক বালকের হিংস্র ওয়েন্ডিগোর ন্যায় হয়ে উঠার গল্প আজ লিখবো।
এতটুকু পড়েই মাহার শরীর কাটা দিয়ে উঠে। কার ডায়েরি এটা! মানুষের মাংস ভক্ষণ করে! কি ভয়ানক!
(চলবে)
#অলকানন্দা
#পর্ব- ৪৯
#লেখিকা_আনিকা_রাইশা_হৃদি
১২৪.
ছোটবেলা থেকে একাই বড় হয়েছি আমি। আমার কোনো ভাই-বোন ছিলোনা। কানাডার প্রতিদিনকার আর্কটিক বরফাচ্ছন্নের শৈত্যপ্রবাহে আমি আনন্দ খুঁজে পেতাম। প্রজাপতি থেকে শুরু করে চিল প্রতিটা প্রাণীকে জানার প্রবল আগ্রহ ছিলো আমার। জীবন মানেই আমার কাছে রঙিন প্রজাপতি। বাবা-মায়ের আদরের ছেলে। ছয় বছর পর্যন্ত আমি ছিলাম এক হ্যাপি চাইল্ড । যে সব কিছুতে আনন্দ খুঁজে পায়। সবার সাথে মিশে। হাসি-খুশি থাকে। কারণ তখনো পর্যন্ত আমি সুন্দর একটা পারিবারিক পরিবেশে বেড়ে উঠছিলাম। বাবা-মায়ের মাঝে কখনো আমি ঝগড়া দেখিনি। আমার বাবা ডক্টর ফারহান। তাকে খুব ভালোবাসতাম আমি। আমার দুনিয়া ছিলো আমার বাবা। বাবার পিঠে চড়ে ঘোড়া ঘোড়া খেলতাম। একসময় আমার মা প্রেগন্যান্ট হন। আমি শুনলাম আমার একটা বোন হবে। ছোট আমি অনেক খুশি হয়েছিলাম সেদিন। বোন আসবে, বোন আসবে করে মাতিয়ে রাখতাম সারাবাড়ি। তবে ভালো সময়গুলো যে জলদি ফুরিয়ে যায়! বাবা-মায়ের মাঝে হঠাৎ প্রচুর ঝগড়া শুরু হয়। আস্তে আস্তে পরিবর্তন হতে শুরু করে সবকিছু। বাবা আমাকে আর আগের মতন ভালোবাসেন না। মা লুকিয়ে কাঁদতেন। আমি দরজার পিছনে লুকিয়ে থাকতাম যখন বাবা-মা ঝগড়া করতো। বাবা জিনিসপত্র ভাংচুর করতেন। উচ্চ গলায় মাকে বকতেন, মা’রতেন। আমার, আমার খুব কষ্ট হতো তখন। বাহিরের দুনিয়ার সামনে তারা আদর্শ স্বামী-স্ত্রী অথচ বদ্ধ কামড়ায় তারা বিচ্ছিন্ন দুই মানব মানবী।
এতটুকু পড়ে মাহার মনে হচ্ছে এটা তো সে আগেও কোথাও শুনেছে। কিংবা পড়েছে। দেজা ভ্যু কি? পাতা উল্টায় মাহা।
আমার বাবার এক কানাডিয়ান নার্সের সাথে খারাপ সম্পর্ক ছিলো। মা সেটা মেনে নিতে পারেন নি। আমি আর মা বাইরে বেরিয়েছিলাম সেদিন। বাসায় ফিরে খুবই অন্তরঙ্গ অবস্থায় দুজন কে হাতেনাতে ধরেন মা। বাবা-মায়ের ঝগড়া শুরু হয়। চিৎকার, চেঁচামেচি, ভাং’চুর। একসময় বাবা আমার মাকে ধাক্কা দেন। মা ছিটকে নিচে পড়ে চিৎকার করে উঠেন। পুরো ফ্লোর র’ক্তে ভরে গিয়েছিলো। আমার আমার মা যন্ত্রণায় কাঁতরাচ্ছিলেন। আমি পর্দার আড়ালে কেবল একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলাম সেই র’ক্তের পানে। আমার ছোট বোনটা র’ক্তের পিন্ড হয়ে বের হয়ে আসছে। বাবা ঘাবড়ে গেলেন। অনেকক্ষণ বাদে আমার মাকে হসপিটালে নেওয়া হলো। আমার মা সুস্থ হলেন। বাড়ি ফিরলেন। একেবারে নিশ্চুপ হয়ে গেলেন তিনি। যেনো কোনো জীবন্ত লা’শ। আমার চোখের সামনে আমার পরিবার আস্তে আস্তে ধ্বং’স হতে দেখেছি আমি। বাবা দিনের পর দিন বাড়ি ফিরতেন না। মা ঘরে দরজা দিয়ে বসে থাকতেন। একলা আমার সময় কাটতো আকাশ পানে তাকিয়ে। প্রাণবন্ত সেই আমি যেন কয়েকদিনের ব্যবধানে প্রাণহীন হয়ে গেলাম। আমার দুইখালা কে কানাডা নিয়ে আমার মা ই বিয়ে দিয়েছিলেন। তারা আসতো মাঝেমধ্যে। তখন বাবা-মা খুবই স্বাভাবিক আচরণই করতো। আমার বাবা আমার মাকে ভ’য় দেখিয়েছিলেন। কানাডিয়ান নার্স বিবাহিত ছিলেন। উনার হাসবেন্ড পুলিশে চাকরি করতেন। তাদের অনৈতিক সম্পর্ক জানাজানি হলে ঝামেলায় পড়তে হতো বাবাকে। সেকারণে আমাকে মে’রে ফেলার ভয় দেখিয়ে আমার মাকে চুপ করিয়ে দেওয়া হয়। দিনদিন বেড়েই চলেছিলো অ’ত্যা’চার। আমার খুব ইচ্ছে করতো বাবাকে হ’ত্যা করি। চারটা বছরে প্রাণবন্ত আমি প্রাণহীন সত্তায় পরিণত হয়েছিলাম। দুয়েকবার চেষ্টা করেছিলাম বাবাকে হ’ত্যা করার। আমার বয়স তখন সবে দশ। একদিন চা’কু দিয়ে পিছনে আ’ঘা’ত করতে গেলেই বাবা আমাকে ধরে ফেলেন। খুব মে’রেছিলেন সেদিন। কানাডায় উনার একটা রেপুটেশন ছিলো। চাইলেই আমাকে আর আমার মাকে কিছু করতে পারবেন না তিনি। নার্সের সাথে মিলে সিদ্ধান্ত নিলেন আমাদের নিয়ে বাংলাদেশ ফিরবেন তারপর হ’ত্যা করবেন। আমার মা তখন পাথর। কোনো কথাই তিনি বলেন না। এক অন্ধকার মানবী তিনি। আমি বাবার পরিকল্পনা ধরতে পেরে মাকে বারবার বললাম বাংলাদেশ যাবো না। বাংলাদেশে নিয়ে বাবা আমাদের হ’ত্যা করবেন কিংবা গু’ম করবেন । মা আমার কথার কোনো জবাবই দিলেন না। বাংলাদেশে আসার সময় ঘনিয়ে আসছিলো আর সাথে আমার মৃ’ত্যু শঙ্কা। কেউ আমার কথা শুনতো না। কেউ আমাকে বুঝার চেষ্টা করতো না। মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ছিলাম আমি। কেমন অদ্ভুত অদ্ভুত স্বপ্ন আসতো আমার। কানাডা থেকে বাংলাদেশ ফিরার পথে আমাদের প্লেন এক্সিডেন্ট ঘটে। সাগরে আপতিত হয় প্লেন। আমি যখন চোখ খুলি তখন তীব্র অন্ধকার চারপাশে।
“Sightings of the Wendigo
Eating the flesh of the enemy’s body”
চারপাশে ঘনজঙ্গল। হালকা চাঁদের আলো। আমি মাথা চেপে ধরে উঠে বসি। মাথাটা তখন ভিষণ ভারী লাগছিলো। পেটে খুব ক্ষুধা। কতক্ষণ পর আমার জ্ঞান ফিরেছে আমি জানিনা। ক্ষুধায় ব্যথায় ক্লান্ত আমি। শরীরে কোনো শক্তিই পাচ্ছিলাম না। উঠে বসার শক্তিও আমার নেই। আবার জ্ঞান হারালাম। এরপর যখন চোখ খুললাম তখন সময়টা রাতের মধ্যভাগ। আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ। চারদিকে আলোকিত। কত রকমের গাছপালা। আমি ক্ষুধায় কাতরাচ্ছি। হঠাৎ কারো গোঙানির আওয়াজে সেদিকে লক্ষ্য করে দেখি বাবা গোঙাচ্ছেন। র’ক্তে ভরা চারপাশ। আমি বহু কষ্টে উঠে দাঁড়ালাম। মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠলো আমার। দাঁড়ানোর সাথে সাথেই বুঝলাম আমাকে কারা যেন ঘিরে ধরেছে। কাকের মতো সরু মুখ, মাথায় গজানো অনেকগুলো হরিণের ন্যায় শিং। অদ্ভুত মানুষের আকৃতি বিশিষ্ট প্রাণী। নখগুলো বড় বড়। নখগুলো লাল, ঠোঁটও লাল। আমার দিকে কেমন করে তাকিয়ে রইলো তারা। আমি ভয়ে মিইয়ে গেলাম। তারা আমার চারপাশে ঘুরতে লাগলো। একেকটা ঘূর্ণনে আমি হিংস্র হয়ে উঠছিলাম। বাবার প্রতি রাগ, জিদটা বেড়ে যাচ্ছিলো বহুগুণে। আমার পিঠে হাত রাখলো প্রাণীটা। শীতল হাত। বাবার প্রতি রাগটা আরো বহুগুণে বেড়ে গেলো। চোখ জ্বলে উঠলো। পাশে থাকা পাথর নিয়ে থেঁ’ত’লে দিলাম বাবার মুখ। ক্ষুধার্ত আমি ভক্ষণ করলাম বাবার মাং’স। লাল টকটকে মাং’স। ছি’ন্ন বি’চ্ছি’ন্ন করে দিয়েছিলাম বাবার দেহ। কতরাত সেখানে ছিলাম মনে নেই। তারাও আসতো প্রতিরাতে। আমার সাথে ভক্ষণ করতো বাবার দেহ। বাবার হাড়গোড় মাটিতে পুঁতে রাখলাম। শরীরে আমার পৈশাচিক শক্তি। এর কয়েকঘন্টা বাদেই আমাকে উদ্ধার করা হয়। মাকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। আমার স্থান হলো মেঝো খালার বাসায়। বাবার সব সম্পত্তি তিনি নার্সকে দিয়ে দিয়েছিলেন। আমার জন্য কিছুই ছিলোনা। প্রতিদিন রাতে তারা আসতো আমার স্বপ্নে। অনেক চিৎকার করতাম আমি। মানুষের মাং’স আমাকে নেশা ধরিয়ে দিয়েছে। র’ক্ত, মাং’স। আমার সব চাই। সব। এত স্বাদ! জিহ্বায় জল আনা স্বাদ। উফ্! আমার চাই। মাং’স আমার চাই। খুব চিৎকার করতাম আমি। সময় পেরিয়ে যাচ্ছিলো। আর আমিও উন্মাদ হয়ে যাচ্ছিলাম।
“Discover WCS and become an active member”
তখনই আমি ‘World Cannibal Society’ এর সন্ধান পেলাম। বড়ই অদ্ভুতভাবে সে সন্ধান পেয়েছি। সেদিন রাত একটার দিকে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েছি। উদ্দেশ্য রাস্তায় কাউকে পেলে খু’ন করে তার মাং’স ভক্ষণ করবো। জন মানব শূন্য রাস্তা। এক মাতাল লোক হেঁটে যাচ্ছে রাস্তা দিয়ে। আমি তাকে অনুসরণ করছি। আমার মাং’স দরকার। বড় পাথরটা নিয়েছি আঘাত করবো তার আগেই মাঝ বয়সী এক লোক তাকে আঘাত করে। মাতাল ব্যাক্তিটি মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। লোকটা তাকে পাশে ঝোপঝাড়ে টেনে নেয়। আমিও তার পিছু নেই। মাতাল লোকটাকে কে’টে মাং’স গ্রহণ করছে সে। আমিও তীব্র নেশায় এগিয়ে গেলাম তার কাছে। মাঝ বয়সী ব্যাক্তি চমকে উঠেন। আমি আশ্বাস দেই ভয় পাওয়ার কিছু নেই। আমিও মাং’স গ্রহণ করতে চাই। দুজনে মিলে মাং’স ভক্ষণ করি। তার নাম শেলটন। শেলটন আমাকে WCS এর সাথে পরিচিত করায়। শেলটন ফিজির নাগরিক। তার পূর্ব পুরুষ মানুষের মাং’স গ্রহণ করতো। জঙ্গলের মাঝে বিশাল বাড়ি। সেখানে আমার মতো কতশত মানুষ। মাঝরাত্রি হাতে মাং’স সাথে হু’ই’স্কি। সাথে আদিবাসী নৃত্য। সবচেয়ে ছোট সদস্য আমি।
যত আস্তে আস্তে বড় হচ্ছিলাম। ততই সেই বিস্তৃত দুনিয়ায় প্রবেশ করছিলাম। আমার প্রয়োজন টাকা। অনেক অনেক টাকা। আমরা রাতে শিকারে বের হতাম। মানব শরীরের মস্তিষ্ক, হৃদপিণ্ড অতিশয় সুস্বাদু অংশ। আমরা শরীরের গুরুত্বপূর্ণ কিছু অংশ চোখ, কিডনি বিক্রি করে দিতাম। বিভিন্ন বিজ্ঞানীদের মানব সাপ্লাই করাও আমাদের কাজ। এর মাঝে আমি ডাক্তারি পেশা বেছে নিলাম। ছোটবেলা থেকেই আমি তুখোড় মেধাবী। আমার কেবল নেশা মানুষ খু’ন, ভক্ষণ আর সাপ্লাই। মধ্যমণি হয়ে উঠছিলাম আমি। অন্ধকার রাজ্যের রাজা।
“The story of becoming the king of the dark kingdom
Shadow man, the name of a terror”
আমার সাথে যোগ দিলো নিভা। আমার খালাতো বোন। রবার্ট, ইংল্যান্ডের ব্রিস্টলের নাগরিক। আমি মানুষ সাপ্লাই করতাম তাকে। সে একজন বিজ্ঞানী। আমার পেশায় অনেক টাকা। তাই সেও যোগ দিলো আমার কাজে। মুইংচিন WCS এর পুরাতন সদস্য। চীনের নাগরিক, শান ধর্মাবলম্বী। আমি যখন মানুষ খু’নে নিখুঁত আর পারদর্শী হয়ে উঠলাম। আমার হিংস্রতা, ক্ষিপ্রতায় কেঁপে উঠতো সকলে। সার্জিক্যাল ব্লেড দিয়ে এলোমেলো মানব দেহ ছিন্ন বিচ্ছিন্ন করায় এক অন্য রকম আনন্দ। ‘will you drink juice’ এটা আমার মানুষ মা’রা’র কোড। ছি’ন্ন পা রেখে যাওয়ায় বহুত ভালো লাগতো আমার। Everyone should know dark man, shadow man is a terror । অল্প বয়স থেকেই মুইংচিন আমার সেক্রেটারি। ডেভিড জাম্বিয়ার নাগরিক। আমার এক কথায় সে জীবন দিতেও রাজি। মেরি কে রাস্তায় পেয়েছিলাম আমি। প্রথম কয়েকদিন জোর করে মানুষের মাং’স দেওয়া হতো। পরে নিজেই পাগল হয়ে যেতো। কাজের বিনিময়ে মাং’স পেতো। লুবান, আমার বন্ধু। আমাদের সোসাইটির বাংলোতে তার সাথে দেখা হয়। নাহারসহ আরো অনেক অনেক সদস্য। কম বয়সী ছিন্নমূল তরুণ তরুণীদের ধরে আনতাম আমরা। প্রথম কয়েকদিন মানুষের মাং’স তাদের জোর করে দেওয়া হতো। পরে তারা নিজেরাই নেশাক্ত হয়ে উঠতো। আমাদের উদ্দেশ্য একটাই আমাদের WCS কে বিস্তৃত করা। সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দেওয়া। এডওয়ার্ড ছিলেন আমার মেঝো খালার হাসবেন্ড। সেই আমার বাবার মতো খালাকে ধোঁকা দিয়েছিলেন তিনি। তাকেও আমি নিজ হাতে হত্যা করেছি। এমিলিন খালার ছেলে ইফাতটা বড্ড জ্বালাতন শুরু করেছিলো। তাই ওকেও হ’ত্যা করি। অবশ্য খু’ন করারও কারণ ছিলো। ইফাতের রক্তে এক অবাক করা পদার্থ ছিলো। আমার এক বিজ্ঞানী বন্ধু দশ কোটির বদলে ওকে চেয়ে বসে। দশ কোটির বদলে আমিও তার দেহ বিক্রি করে দেই। এমিলিন খালা অবশ্য তখন থেকেই আমাদের পছন্দ করেন না। তবুও তিনি আমাদের সাথে রয়েছেন। রবার্ট, নিভা বিয়ে করে নিলো। আমারও MBBS, fcps ডিগ্রি অর্জন হয়েছে। আমি তখন কোটি কোটি টাকার মালিক। সব ভালোই চলছিলো। এর মাঝে মেঝো খালা মা’রা গেলেন। কোনো ভাবে প্রশাসন আমাদের কিছুটা খবর পেয়ে গেলো। এক ঘটনার মাধ্যমে। শেলটন কে ধরে নিয়ে গেলো। আমাদের এত বড় সোসাইটির মানুষজন বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলাম। শেলটন আমাদের সম্পর্কে কিছু বলেনি। নিজেকে দোষী করে নিয়েছিলো। ফাঁ’সি হলো তার। খুবই কষ্ট পেলাম আমরা। সিদ্ধান্ত নিলাম বাংলাদেশে আসবো। যোগাযোগ করলাম এদেশের WCS এর সদস্যের সঙ্গে। ততদিনে আন্ডারওয়ার্ল্ডে আমার অনেক নাম ডাক। বাংলাদেশের সদস্য প্রধান আলবার্ট। ডেভিড কে পাঠালাম বাংলাদেশে। তার কিছুদিন পর আমরাও পাড়ি জমালাম বাংলাদেশ।
মাহার হাত পা কাঁপছে। বাকরুদ্ধ হয়ে বাকি লেখায় মনোযোগী হয় সে।
(চলবে)…
#অলকানন্দা
#পর্ব-৫০
#লেখিকা_আনিকা_রাইশা_হৃদি
১২৫.
“Arrival of shadow man in Bangladesh
101 mu’r’d’ers of 2012”
বাংলাদেশ শিকার করার ভালো স্থান। মানুষের মাং’সও বড়ই সুস্বাদু। এদের দেহে তেল,চর্বির মাত্রা বেশি। মাং’সও স্বাদ লাগে খেতে। এটা অবশ্য আমার ব্যাক্তিগত অভিমত। আমি হৃদপিণ্ড ভক্ষণ করতে বেশি পছন্দ করি। যদিও মস্তিষ্কও আমার প্রিয়। এদেশে মানুষ গু’ম হলেও পুলিশ তাদের নিয়ে এতো তৎপর হয়না। বিষয়টাকে কাজে লাগালাম। বহুস্থানে WCS এর সদস্যরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। আমি সিলেটে একটা হাসপাতালে ঢুকলাম। প্রথম বছর আমরা তেমন কিছুই করিনি। সদস্য বাড়িয়েছি কেবল। ঐ তো আমাদের একটাই নীতি মাং’সের বিনিময়ে কাজ। কিছুদিনের মাঝেই বাংলো কিনলাম পাহাড়ে। আমাদের সোসাইটির একটা মিলনস্থান প্রয়োজন। কাজের সূত্রে খাজার সাথে পরিচয়। শক্ত পোক্ত শরীর। যেন কোনো গ্রীক মাইথোলজির শোষক রাজা। চা বাগানে কাজ করে। সে আমাদের একজন সক্রিয় সদস্য হয়ে উঠলো। খাসিয়া পল্লী, গারোদের আবাসস্থল থেকে আমরা নৃগোষ্ঠী শিকার করা শুরু করলাম। বিকেল, রাত, সন্ধ্যায় চা বাগানে ওৎ পেতে থাকতাম। কাউকে পেলেই ঝাঁপিয়ে শেষ করে দিতাম তাকে। মানব সাপ্লাই, অর্গান সাপ্লাইয়ের ব্যবসা আমার রমরমা। রুৎবা, মাতব্বর শরীফ। দুই স্বামী স্ত্রী। চা বিক্রি করতো তারা। মাতব্বর শরীফের ছেলে ফয়সাল। মূলত ফয়সালকে WCS এর সদস্য করেছি। এরপরই মাতব্বর শরীফ, রুৎবা যোগ দেয়। আমি আরো বিধ্বংসী হয়ে উঠলাম। টাকার নেশা, খু’নের নেশা, মাং’সের নেশায় আমি তখন বদ্ধ উন্মাদ। গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়তাম রাতে। খু’ন করে সার্জিক্যাল ব্লেড দিয়ে ছি’ন্ন পা রেখে আসায় অদ্ভুত শান্তি লাগতো আমার। তবে বিষয়টা চাপা রইলোনা। খু’নের সংখ্যা যখন ১০১ ছাড়ালো তখন আতঙ্কিত হয়ে উঠলো দেশবাসী। মিডিয়ায় মিডিয়ায় এই খবর। আজিজের উপর পড়লো এর তদন্ত ভার। এরমাঝেই একটা রহস্য উদঘাটন করলাম। মাতব্বর শরীফের আরেক সংসার আছে। সে ঘরে বউ, মেয়ে আছে। পুলিশ ফাঁদ পেতেছিলো আমার জন্য। আমিও ফাঁদে পা দিলাম। মিস তাজ ছিলো দায়িত্বে। বোকা মহিলা প্রেমে পড়লো আমার। সেই রাতে বাঁচিয়ে দিলো আমাকে। মাতব্বর শরীফের ছেলেটা মারা গেলো।ওর স্ত্রী রুৎবা তখন পাগলপ্রায়। আমাদের অনেক কাজ সম্পর্কেই জানতো রুৎবা। বাইরে মানুষের হাতে খামছে ধরে বলতো তার মৃ’ত্যু সংবাদ। কেউ অবশ্য আমলে নিতো না। ওকে বললাম পুলিশ আমাকে খুঁজছে সমস্ত দায় যেন ও নিজের ঘাড়ে নেয়। সে প্রথমে রাজি হয়নি। আমি নিরবে মাউথ অর্গান বাজালাম কতক্ষণ। দ্বিতীয় সংসারের স্ত্রী, সন্তানের খোঁজ দিতেই রাজি হলো সে। রাজি না হয়েও উপায় নেই। প্রিয়জনকে হারানোর ভয় সবারই থাকে। যদিও পরে তাদের আমি হ’ত্যা করেছি। মাতব্বর শরীফ জানে তারা বেঁচে আছে। তাজ সব ব্যবস্থা করে দিলো। গর্দভ মানবী! কি আছে আমার মাঝে? এর মাঝে আজিজটা আবার সব জেনে গেলো। পরিবার সহ রাস্তা থেকে সরিয়ে দিলাম। একেবারে সিলিন্ডার বিস্ফোরণে সব শেষ। বুম!
হা হা হা। আমার সাথে খেলায় নেমেছিলো। মৃত্যু তো তার নিশ্চিত। সিলেট থাকা যাবেনা। ডেভিডকে সিলেটে রেখে ঢাকায় চলে আসলাম বাকিদের নিয়ে। এবারে ছি’ন্ন পা রাখিনা আমি। ঢাকার হসপিটালটা অনেকদিন যাবতই পরিচিতি আমার। আমি পার্টটাইম হিসেবে দেশে আসার পর থেকেই এখানে যুক্ত ছিলাম। যাই হোক এখন একেবারে ডাইরেক্ট খু’ন করি।
“Exploration of Energy Harvesting Cells”
ক্যালিফোর্নিয়ার এক বিজ্ঞানী আমাকে ৬০ কোটি টাকা অফার করলো। তার ও নেগেটিভ র’ক্তধারী একজন মানব কিংবা মানবী চাই। লোহিত রক্তকণিকা, শ্বেত রক্তকণিকা আর অণুচক্রিকা ব্যতীত আরো একটি বিশেষ কণিকা আছে। বিজ্ঞানী ডেনিয়েল সেই কণিকার নাম দিয়েছেন ‘Energy harvesting cells’. তারমতে সারাবিশ্বে কেবল ৫ জন ব্যাক্তি রয়েছে এই EHC ধারী। তাদের সবাইকে একত্র করে রক্তের এই কণিকা সংগ্রহ করে প্রক্রিয়াজাত করলে দেহের শক্তি বৃদ্ধি সম্ভব। যে ব্যাক্তি সেই ফর্মুলা শরীরে নিবে সে হয়ে উঠবে অন্যতম শক্তিশালী মানব। যার রাজত্ব থাকবে সারাবিশ্বে। ডেনিয়েল অনেক টাকা খরচ করেছে এর পিছনে। যদিও তাকে অর্থ দিয়ে সহায়তা করছে ক্যালিফোর্নিয়ার ধনী ব্যাক্তিরা। সেসবে আমার মন নেই। আমার শুধু টাকা হলেই চলবে। এরপর সারাদেশে ফ্রী র’ক্ত পরীক্ষা শুরু করে দিলাম। সাথে তাদের পূর্ণাঙ্গ ঠিকানা সংগ্রহ। EHC মাপার জন্য বিশেষ যন্ত্র ডেনিয়েল পাঠিয়েছিলো আমায়। একের পর এক পরীক্ষা করে চলেছি। কারোটাই ম্যাচ করছিলো না। ডক্টর জিনিয়া। ওর সাথে আমার পরিচয় ঢাকায় হসপিটালে। এই মানবীও আমাকে ভালোবেসে ফেললো। আমি বুঝিনা নরপিশাচদেরও মানুষ ভালোবাসে? সম্পূর্ণ না জানলেও ও কিছু কথা জানতো আমার। টাকার পাগল জিনিয়া। দশ লাখ অফার করলাম। হসপিটালে আসা প্রত্যেক ব্যাক্তির র’ক্তের নমুনা আর ঠিকানা আমার চাই। ২০১২ এরপর দেড়বছরে ব্যবসা কিছুটা মন্থর চলছিলো। যদিও WCS এর সদস্যরা গভীর রাতে ট্রাক নিয়ে বের হয়ে মানুষ শিকার করতো। তবুও ৬০ কোটি অনেক দরকার আমার। একদিন রাতে জিনিয়া ফোন করে বললো আজ হাসপাতালে দুজন মেয়ে এসেছিলো। রিকশা দুর্ঘটনায় দুজনেই ব্যথা পেয়েছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। তার মধ্যে একজন মাহা হোসেন যার রক্তে EHC উপস্থিত।
মাহার হাত থেকে ডায়েরিটা নিচে পড়ে গেলো। এই Shadow man যে সার্থক তা আর তার বুঝতে বাকি নেই। মাহার এখনো বিশ্বাস হচ্ছেনা। তবে কি চৈতির মৃ’তুর সাথেও সার্থকের সম্পৃক্ততা আছে? গলা শুকিয়ে আসছে মাহার। বুক ফেটে কান্না আসছে। চারটা বছর এক সিরিয়াল কি’লা’রের সংসার করেছে সে! যে মানুষ ভক্ষণ করে! বাইরে সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। মাহার চোখ দুটো বারবার ভিজে উঠছে। কেন সত্যের মুখোমুখি হলো সে! বুকটায় কামড়ে ধরেছে কয়েক হাজার পিঁপড়া। “মাহা?” হঠাৎ সার্থকের ডাকে কেঁপে উঠে মাহা। তড়িঘড়ি করে লুকিয়ে রাখে ডায়েরিটা। ক্রন্দনরত লালচে হয়ে আসা অক্ষি যুগলকে মুছে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা চালায় । বাইরে বেরিয়ে দেখে সার্থক সোফায় মাথা এলিয়ে আছে। সার্থকের কাছে যেতেও হাত পা কাঁপছে মাহার। কপালের দুপাশে সূক্ষ্ম ঘামের রেখা। শরীর কাঁপছে থরথর। মাহাকে খেয়াল করে সার্থক হাসে। মাহা বিনিময়ে অনিচ্ছায় হাসে। ভালোবাসার মানুষের দুই রূপে হতভম্ব মাহা। মাহা তো তাকে ভালোবাসে। নিজের চাইতেও বেশি ভালোবাসে। “মাহা?”
সার্থক চোখ বুজেই আবার ডেকে উঠে।
“জ্…জ..জ্বি”
“কি হয়েছে?”
“কিছু না”
“আমার মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দাও মাহা। ক্লান্ত লাগছে অনেক।”
মাহা ধীরে ধীরে এগিয়ে যায় সার্থকের কাছে। কাঁপা কাঁপা হাতটা সার্থকের মাথায় রাখে। গা শিউরে উঠছে তার। সার্থক মাহার একটা হাত চেপে ধরে ঠোঁট ছুঁয়ায়। ছেৎ করে উঠে মাহার হৃদপিণ্ড। চিৎকার করে উঠে তার ভিতরটা। “কেন আমার ভালোবাসার মানুষটা অপবিত্র! কেন? পৃথিবীর বুকে সে ছাড়া আমার আর কেউ নেই। এই যন্ত্রণা আমি কেমন করে সইবো?”
“তোমার কি মন খারাপ মাহা?”
“না..না তো।”
সার্থক কোনো প্রশ্নই করেনি আর। ডাইনিং টেবিলে মাং’সের তরকারি দেখে বমি আসছে মাহার। ভিতরের সবকিছু গুলিয়ে আসে তার। মুখ চেপে ধরে ছুটে যায় বেসিনে। গড়গড় বমি করে দেয়। চোখে ভাসে মানুষের কা’টা মাং’স। সেগুলো ভক্ষণ করার দৃশ্য। লাল টকটকে র’ক্তে চুবচুবে সদ্য মৃ’ত মানুষের মাং’স। পিছনে ঘুরতে নিতেই মাহা দেখে সার্থক তোয়ালে হাতে দাঁড়িয়ে। মাহা খানিকটা ভড়কে যায়। সার্থক মাহার এলোমেলো চুল গুলো গুঁজে দেয় কানের পাশে। তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছিয়ে বলে,
“শরীর কি বেশি খারাপ লাগছে?”
“না। আসলে ঐ.. দুপুরে একটু ভাজাপোড়া খেয়েছিলাম।”
“কি যে করো না তুমি মাহা। আজেবাজে খাবার খেলে তো সমস্যা হবেই। আমার একটা কথাও যদি শুনতে।”
মাহা আর কোনো জবাব দেয়নি। প্রতিদিন সার্থকের বুকে মাথা রেখেই মাহা ঘুমায়। এত শান্তি সার্থকের বুকে! আজ মাহার দমবন্ধ লাগছে। এই যে সার্থক মাহার চুলে, মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে তাও বিরক্ত লাগছে। মন, মস্তিষ্কের সাথে যুদ্ধ করতে করতে ঘুমিয়ে পড়ে মাহা। মস্তিষ্কে অত্যধিক চাপ পড়ছে মাহার। ঘাড়ের পিছনে চিনচিন ব্যথা হচ্ছে। মাথায় অসহনীয় চাপ। মনে হচ্ছে দু’দিক থেকে দুইটা দেয়াল মাহার মাথায় চেপে ধরেছে। অসহনীয় এই যন্ত্রণা। ঘুম ভেঙে যায় মাহার। সার্থক ঘুমিয়ে আছে পাশে। মাহা নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে খাটে হেলান দিয়ে বসলো। হুট করেই কয়েকবছর আগের আবছা স্মৃতিগুলোকে পুনর্জীবিত করার চেষ্টা চলছে তার মস্তিষ্কে! স্মৃতিকে বারবার মনে করতে থাকলে স্মৃতিটি যে নিউরোনে সংরক্ষিত আছে, সেটার সিন্যাপ্স বারবার আন্দোলিত হয়। যত বেশী সিন্যাপ্স আন্দোলিত হবে, সেই স্মৃতি তত শক্তিশালী হবে। মাহার ক্ষেত্রে তা হচ্ছেনা। সিন্যাপ্স আন্দোলিত হচ্ছে তবে কিছু মনে পড়ছেনা। মাহা আরো জোর চালালো মস্তিষ্কে। সিন্যাপ্স আন্দোলিত হচ্ছে বারবার। অসহনীয় যন্ত্রণায় হাত কামড়ে ধরলো মাহা। মাথার শিরা ফুলে উঠলো তার। মাহা উঠে দাঁড়ায়। কাঁচের গ্লাসটা সরিয়ে বারান্দায় প্রবেশ করে। শো শো করে বাতাস বইছে। চারদিকে অন্ধকার। চৈতির কথা ভিষণ মনে পড়ছে। বারান্দায় বসে মাথা চেপে ধরে মাহা। এই যন্ত্রণা সে সহ্য করতে পারছেনা। চোখমুখ বুজে হেলান দিয়ে নিচে বসে সে। হঠাৎ করেই আবছা কিছু স্মৃতি চোখের সামনে অদৃশ্যে ভেসে উঠে।
(চলবে)…