#সন্ধি_হৃদয়ে_হৃদয়ে,০৬,০৭
#লেখিকাঃ আসরিফা সুলতানা জেবা
#পর্ব___৬
ফাতেমা চৌধুরী মাথায় হাত দিয়ে বসে আছেন। রহিমা আইসব্যাগ টা নিয়ে দৌড়ে এলো। মাথায় ঠেসে ধরলো সাথে সাথে। এত জোরে রেখেছে মনে হলো ফাতেমা চৌধুরীর মাথার খুলি খুলে পড়ে যাবে। ব্যাথায় চোখ মুখের আকার বিকৃত করে পুরো বাড়ি কাঁপিয়ে চেঁচিয়ে উঠলেন,
‘ রহিমা বাইদ্যানি এইডা কি করছস?মাথা ফাটাই লাইছস আমার। ওমাগো,,,,চামড়া খসে পইড়া গেছে মনে হয়। ‘
‘ স্যরি স্যরি আম্মা,আমার ভুল হইয়া গেছে। আমি চিন্তা করলাম আপনের মাথা গরম তাই ঠান্ডা করবার জন্য বরফ লইয়া আইছি। আর ভুল হইব না। ‘
‘ মাইয়া বিয়া দিয়া নানি হইয়া গেছস,এই বয়সে তোর আবার ভুল?নিকুচি করলাম তোর ভুলের। ফাজিল বেডি। সর এনতে। সহ্য হয় না তোগো কাউরে। কোন কুনজর যে পড়ল আমার বাড়িটাতে। ‘
রহিমা মুখ বাঁকিয়ে ফাতেমা চৌধুরীর আড়ালে আবডালে ভেংচি কাটল। চাপা স্বরে বললো,
‘ বুইড়া বেডি নিজে বাড়িতে অশান্তি ডাইকা আনছে, আবার চাপা ছাড়ে কার কু নজর পড়ছে!বিয়ে না করলে মনে হয় জোর কইরা করাইব। জমের মতোন ভয় পায় তূর্য বাবারে। মুখ ফুটে কিছু কইতে পারে না। সারাদিন খালি বিলাপ করে। ‘
শাশুড়ির চিৎকারের শব্দ শুনে ড্রইং রুম ছেড়ে তড়িৎ গতিতে ছুটে এলো ত্রিহা ও মেহরিমা দুজন। রহিমার দিকে এক নজর তাকিয়ে ইশারায় জিজ্ঞেস করলো ত্রিহা- কি হয়েছে? রহিমা এমন ভাব করলো যেন কিছুই জানে না। মৌনতা পালন করাই এখন তার বৈশিষ্ট্য ও মূখ্য কর্ম। মুখে কুলুপ এঁটে দাঁড়িয়ে আছে ঠাঁই। মেহরিমা উদ্বিগ্ন কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,
‘ কি হয়েছে আম্মা?’
প্রশ্নটা মাথা ব্যাথার মাত্রা দ্বিগুণ করে দেয় ফাতেমা চৌধুরীর। তিনি আফসোসের স্বরে বলতে লাগলেন,
‘ আমার দুই দুইডা বলিষ্ঠ শরীরের নাতি আছে বাড়িতে। আমি কি এখন তাদের বাচ্চা -কাচ্চা না দেইখা ম’রে যাইতাম বউ?এ কেমন অবিচার আমার সাথে?’
শাশুড়ির ভংচং কথার মানে বুঝতে বেশিক্ষণ লাগল না দু জা’য়ের। দু’জনেই নিরব,বাকরুদ্ধ হয়ে পড়ে। তাদের চোহারা দেখে ফাতেমা চৌধুরী লাঠি আঁকড়ে ধরে দাঁড়ালেন। থমথমে কন্ঠে বলে উঠলেন,
‘ আমারে ড্রইং রুমে লইয়া যাও বউরা। আর ডাকো তোমাদের দুই পুত্রকে। ‘
ত্রিহা ও রহিমা ধরে ফাতেমা চৌধুরীকে নিচে নিয়ে আসলেন। পায়ের হাড্ডি ক্ষয়ে গিয়েছে ওনার। সিঁড়ি ভাঙতে কষ্ট হয় বেশ। সোফায় বসে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে বললেন,
‘ তূর্য কই বউ?’
মেহরিমা নিচু স্বরে জবাব দিলেন,
‘ ছেলেটা ঘুমোচ্ছে আম্মা। ‘
‘ সন্ধ্যা হয়ে যাইতেছে,এখন ঘুমোচ্ছে?মিছেমিছি অসুস্থের বাহানা ধরে ওরে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা মুখো করলাম পড়ে পড়ে ঘুমানোর জন্য? এলো তিনটা দিন অথচ গত দু’দিনই বাহিরে কাটালো। যা করতে হবে জলদি করতে হবে। কথাটা বলতেই হবে ওর সামনে। ডাকো ওরে। ‘
‘ আপনি ডাকেন আম্মা,আমি পারব না। ‘— সোজাসাপ্টা স্বগোক্তি মেহরিমার।
তূর্যর রাগ,গম্ভীর মুখটাকে অনেক ভয় পায় এ বাড়ির সকলে। বিশেষ করে ফাতেমা চৌধুরী একটু বেশিই আতঙ্কগ্রস্থ হয়ে থাকে এই বুঝি তূর্য রাগে,ক্রোধে চৌধুরী বাড়ির একেকটা প্রাচীর ভাঙতে শুরু করলো। বাড়ির একেকটা সদস্য তার রাগ সম্পর্কে অবগত। তাছাড়া পাগল অবস্থায় আড়াইবছর যা করেছে তাতে সবাই ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে থাকে তূর্যকে দেখলেই। ফাতেমা চৌধূরীর কন্ঠস্বর কেঁপে কেঁপে উঠে,
‘ কি কও? তোমার পোলারে তুৃমি ডাকো। তোমারে তো কিছু বলবে না। তার আগে ওই অহমিকা না টহমিকা ওরে কল দাও এখানে আসার জন্য। আর চিন্তা করতে পারমু না। করতে করতে মাথা ব্যাথায় ছিঁড়ে যাইতাছে। ওদের একটা গতি না করে শান্তি পামু না আমি। ‘
ত্রিহা আঁড়চোখে মেহরিমার দিকে তাকায়। ফোঁড়ন কেটে বলে,
‘ আম্মা। এটা কি উচিত হবে?তূর্য বিবাহিত। ওকে এ বিষয়ে অজ্ঞাত রেখে আরেকটা বিয়ে?’
‘ ত্রিহা! ‘
সঙ্গে সঙ্গে চাপা গর্জন করলেন মেহরিমা। ঘটনার আকস্মিকতায় ফাতেমা, রহিমা সবাই হতভম্ব। ত্রিহা চমকালো না। এটাই যেন হওয়ার ছিল। মুখভঙ্গি স্বাভাবিক, নির্লিপ্ত।
‘ ক্ষমা করো আপা। কিন্তু ছেলেটার কাছ থেকে লুকানো ঠিক হচ্ছে না। তূর্য যদি কখনও জানতে পারে ও বিবাহিত, বিয়ের পরদিন ওর বউ পালিয়ে গিয়েছে তাহলে কি হবে ভেবে দেখেছ?ছেলেটা আমাদের দিকে মুখ তুলেও তাকাবে না এত বড় একটা সত্য লুকানোর জন্য। তাছাড়া ওর জীবনের কয়েকটা বছর তিক্ত করে তোলার জন্য দায়ী অহমিকা। ‘
‘ যার জন্য ন’ষ্ট হয়েছিল সে-ই তো সঠিক করেছে তাই না?ওই মেয়ে আমার ছেলের যোগ্য না। পাগল দেখে ছেড়ে চলে গিয়েছে। বিয়ের পরদিন নিকট আত্মীয় স্বজনরা থু থু ফেলেছে আমাদের উপর। আমার ছেলে পাগল এটাও লোক মুখে ছড়িয়ে গেল,শুধু মাত্র ওই মেয়ের জন্য। তূর্যর পাগল হয়ে যাওয়ার বিষয়টা চাপা রেখেছিলাম সমাজের কাছে। যথেষ্ট সম্মান দিয়ে এতিম ওই মেয়েকে ঘরে তুলেছিলাম,চেয়েছি সমাজের চোখে উচ্চ স্থান দিতে কিন্তু নিজ স্বার্থে আমাদের মুখে চুন কালি মাখিয়ে পালালো। কখনও ওই মেয়েকে ক্ষমা করবো না আমি। কখনও না। এই বিষয়ে আর একটা কথাও কেউ বলবি না। যেই সম্পর্ক তূর্যর অগোচরে তৈরি হয়েছে তা ওর সামনে কোনোমতেই যেন না আসে। আমি চাই না অতীত টেনে ওর জীবনটা নষ্ট হোক। অহমিকা যেহেতু দিন রাত এক করে ওকে সুস্থ করে তুলেছে ওর জীবনে থাকার অধিকারও অহমিকার। দ্যাটস ইট। ‘
মেহরিমা একনাগাড়ে কথাগুলো বলে তপ্ত নিঃশ্বাস ছাড়লেন। ওই মেয়ের নামটা শুনলে পর্যন্ত গা জ্বলে উঠে। ত্রিহা তবুও থামল না। একরোখা জেদ ধরে বললো,
‘ অন্যা-য়, অন্যা/য়ই হয় আপা। একদিন না একদিন তূর্য সবটা জানবে। তখনকার জন্য প্রস্তুত থেকো। ‘
চোয়াল শক্ত হয়ে উঠলো মেহরিমার। চারটে খানি কথা শোনাতে পারলেই বোধহয় স্বস্তি মিলবে। কিন্তু বাহিরের একটা মেয়ের জন্য বোনের মতোন জা এর সঙ্গে তর্কে জড়াতে চায় না। ত্রিহা স্বভাবতই অতিরিক্ত নরম মনের। তাই যে কারো জন্যই মায়া জন্মে যায়। ফাতেমা চৌধুরী নাক মুখ কুঁচকে বললেন,
‘ বাদ দাও। এসব কথা আর বলবা না ছোট বউ। যাও আয়ুশকে ডেকে আনো। ‘
ত্রিহা এক পা বাড়াতেই কর্ণধারে ভেসে আসে পুরুষালি গম্ভীর স্বর।
‘ কি কথা বলার জন্য নিষেধ করা হচ্ছে চাচি কে?’
নিমিষেই সবার কন্ঠনালি শুকিয়ে কাঠ। মেহরিমা সিঁড়ির দিকে চাইতেই চক্ষে পড়ে তূর্য নেমে আসছে। চুলগুলো পিছনে ঠেলে দিচ্ছে এক হাতে। গায়ে কালো একটা টি শার্ট জড়ানো। সবকটা সিঁড়ি অতিক্রম তূর্য সোফায় এসে বসলো। সবার দিকে দৃষ্টি বুলিয়ে দেখে মুখে ভয়ের ছাপ। কিন্তু কেন?সন্দিহান দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখেই রহিমার উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল,
‘ কি হয়েছে? ‘
শুকনো ঢোক গিলে মেহরিমা কিছু বলতে নিলে,ফাতেমা চৌধুরী ব্যগ্র গলায় বলে উঠলেন,
‘ আয়ুশের বিয়ের কথা কইতেছিলাম। ছোট বউ কইতাছে এখন না,প্রিয়ুর পড়া শেষ হলে বিয়ে করাই আনবো। পড়া শেষ হতে হতে আমার হাড্ডি থাকবো কি-না তাতে সন্দেহ। তাই এখনই বিয়ের কথা তুলতে কইতেছি। আজ বাদে কাল প্রস্তাব পাঠামু। ‘
‘ তুমি না অসুস্থ দাদি?’
তূর্যর তীক্ষ্ণ প্রশ্নে স্থবির হয়ে পড়লেন ফাতেমা। বলার মতো সদুত্তর খুঁজে পাচ্ছেন না। একটা মিথ্যে কথা যে একশ মিথ্যে বাক্যের রচনা করে তা যেন অক্ষরে অক্ষরে ফলে যাচ্ছে। তূর্য নিষ্পলক, তীর্যক নেত্রে চেয়ে আছে উত্তরের প্রতীক্ষায়। না আর বিলম্ব করা যাবে না,করলেই চু’রি ধরা পড়ার আশংকা রয়ে যাবে। কান্নামিশ্রিত স্বরে বললেন,
‘ হ। অসুখে ভুগতেছি বইলা তোরার বিয়ে দেখে যেতে চাইতাছি। তোদের দুই ভাইরে একটা একটা বউ ধরায় দিতে পারলেই শান্তি। আয়ুশী ছোট। সবে কলেজে উঠছে। ওরে লইয়া চিন্তা নাই। বিয়া করে দাদির আশা পূর্ণ করে দেন না লেকচারার সাহেব। ‘
ফাতেমা চৌধুরী শেষোক্ত কথাটায় অত্যধিক আহ্লাদের ছাপ। তূর্যর ভ্রঁ জোড়া কিঞ্চিৎ কুঁচকালো। ‘ অতিভক্তি যে চোরে’র লক্ষণ ‘ সে আজ হারে হারে টের পেল।
সোফা ছেড়ে উঠতেই একটা মেয়ে গটগট পায়ে সদর দরজা পেরিয়ে ড্রইং রুমে এসে উপস্থিত হয়। পড়নে লাল রঙের সেলোয়ার-কামিজ। ঠোঁটে বিস্তর হাসি। রহিমার চক্ষু কোটর ছেড়ে বেরিয়ে আসার উপক্রম। বিড়বিড় করলো–‘ এই ওয়েস্টার্নের গাট্টি আজ দেশি পোশাকে! সূর্য যে আজ কোন দিকে উঠছে!’
মেয়েটার মাথার কেশ উন্মুক্ত। ঘাড় ছুঁই ছুঁই। মেহরিমা একগাল হাসলেন অহমিকাকে দেখে। তন্মধ্যে আয়ুশও হাজির হয়েছে। চক্ষুদ্বয় নিক্ষেপ করলো সে তূর্যর দিক। ফর্সা চেহারা রক্তিম হয়ে উঠেছে। চোয়াল শক্ত, দাঁতে দাঁত চেপে ক্রোধ সংবরণের প্রয়াস চালাচ্ছে হয়ত। পরিস্থিতি এখন না সামলালে অবস্থা বেগতিক হয়ে দাঁড়াবে। অহমিকা এসময় এখানে কেন বুঝতে পারছে না আয়ুশ। সে কিছু বলবে তার পূর্বেই অহমিকার দিক রোষপূর্ণ অগ্নিময় চাহনি নিক্ষেপ করে গর্জে উঠে তূর্য,
‘ এই মেয়ে এখানে কি করছে?ওর সকল পেমেন্ট করা শেষ না?কি করছে এই বাড়িতে?আর বিয়ে?চট্টগ্রাম যাওয়ার আগে স্পষ্ট বলে গিয়েছি বিয়ে করবো না আমি। বাহ!ফাতেমা চৌধুরী অভিনয়ে সেরা পুরস্কার টা আপনার প্রাপ্ত। চৌধুরী বাড়ির একেকজন চরম লেভেলের অভিনেতা,অভিনেত্রী হয়ে উঠছেন দিনকে দিন। মিথ্যে অসুস্থতার বাহানা দিয়ে টেনে আনলে আবারও বিয়ের কথা বলতে?’
ছেলের কথার ধাঁচে মেহরিমা আৎকে উঠলেন। মন টা কু ডাকছে তার। চট্টগ্রাম যাওয়ার পর থেকে ঠিকঠাক কথা বলছে না তূর্য ওনার সঙ্গে। কেমন এড়িয়ে চলছে। তূর্য সব জেনে যায় নি তো?না না জানার আগে অহমিকার সঙ্গে জুটি বেঁধে দিতে হবে এবং জল বেশিদূর গড়ানোর পূর্বেই। তার দৃঢ় বিশ্বাস অহমিকার সাথেই সুখী হবে তূর্য। যে বিপদে থাকে সেই সারাজীবন পাশে থাকা ডিজার্ভ করে। অহমিকা ভুল করেছে, প্রায়শ্চিত্ত স্বরূপ নিজের সবটা দিয়ে তূর্যকে সুস্থ করে তুলেছে। তাই ওনার চোখে অহমিকাই সেরা। আমতা আমতা করে ডাকলেন,
‘তূর্য শোন,,’
‘ আমি আপনার কোনো কথা শুনতে রাজি নয়। ‘
কাঠ কাঠ জবাব তূর্যর। কথাটা বলে এক মুহুর্তও দাঁড়াল না সে, বেরিয়ে গেল চার দেয়ালের মাঝ হতে। আয়ুশও ছুটে গেল পিছু পিছু। মেহরিমার মাথা চক্কর দেয়। পড়ে যেতে নিলে অহমিকা দু’হাতে জড়িয়ে রক্ষা করে তাকে। ক্রমাগত বিচলিত, উত্তেজিত কন্ঠে বলে,
‘ আন্টি ঠিক আছেন আপনি?’
মেহরিমার চোখ ভর্তি জল। গলায় কথা জড়িয়ে যাচ্ছে। ফুপিয়ে উঠলেন,
‘ আমার তূর্য আমাকে আপনি সম্বোধন করেছে অহমিকা। ও নিশ্চয়ই আমার সাথে রাগ করে আছে। রাগলেই তো এমন করে আমার সাথে। এটা ওর রাগের বহিঃপ্রকাশ। রাগলে আমাকে আপনি ডাকে। হঠাৎ এমন করছে কেন?সুস্থ হবার পর তো সব ঠিক ছিল। ‘
ছোটখাটো একটা ঝড় বয়ে গেল চৌধুরী বাড়িতে। রহিমা ঝড়ের নাম দিল–‘ অহমিকা। ‘
_____________
বাবার জরুরি তলবে ঢাকা শহরে ছুটে এলো প্রিয়ু। সাথে নিয়ে এলো শ্রেয়াকে। শ্রেয়া বারংবার বলছিল — ‘আমি যাবো না প্রিয়ু,তুই যা। কোচিং বন্ধ হলে চাকরিটা হারাতে হবে। ‘ কিন্তু প্রিয়ু শুনলোই না,উল্টো কোচিংয়ে গিয়ে কিছু দিনের ছুটি চেয়ে এক প্রকার টেনে হিঁচড়ে নিয়ে আসে ওকে।
শ্রেয়া পুনরায় এই ইট পাথরের শহরে ফিরতে নারাজ ছিল। মন সায় দিচ্ছিল না। এখানে আসলেই পুরোনো ক্ষত তাজা হয়ে যায়। লাল রঙে রঞ্জিত হয়ে যায় হৃদয়স্থল। অথচ সেই রক্ত কারো চোখে পড়ে না। জমাট বেঁধে কালসিটে রূপ ধারণ করে,শুকিয়ে যায়। আবারও তাজা হয় ক্ষণে ক্ষণে।
প্রিয়ুদের বাড়িতে কখনও আসে নি শ্রেয়া। প্রথম বার এলো। বিশাল বড় বাড়ি। এখানে এসে জানতে পারে কাল চৌধুরী বাড়ির লোকজন আসবে বিয়ের তারিখ ঠিক করতে। প্রিয়ু শুনে বিস্ময়ের শীর্ষে পৌঁছে যায়। আয়ুশের সাথে সারাদিন কথা হয় নি। হুট করে কেমনে কি!প্রিয়ুর মা-বাবার সাথে শ্রেয়ার পরিচয় হয়েছে চট্টগ্রামে। কিন্তু এখানে এসে কেমন অপরিচিত লাগছে সবকিছু পরিবারের বাকি সবার সঙ্গে পরিচয় না থাকায়। প্রিয়ুর মামার বাড়ির লোকও এসে হাজির আজকে। সকলের আগমন,আয়োজন দেখে মনে হচ্ছে কালই যেন বিয়ে।
প্রিয়ু সারা ঘরময় পায়চারি করছে। চিন্তায় মস্তিষ্কে ঝং ধরে যাওয়ার অবস্থা। আয়ুশ ফোন তুলছে না। শ্রেয়া নিচে ওর মা’য়ের সাথে। মেয়েটাকে জেঁকে ধরেছে ওর মামি,মা সবাই। বেশ পছন্দ হয়েছে শ্রেয়াকে সবার। মেয়েটার অবস্থা হয়ত নাজেহাল। ওইখান থেকে বের করে আনতে হবে ওকে তার আগে আয়ুশের সাথে কথা বলা জরুরি। উদভ্রান্তের ন্যায় একের পর এক কল করতে থাকে। একটা সময় কল রিসিভ হয়,বাড়িয়ে দেয় প্রিয়ুর মেজাজের উত্তাপ।
‘ কাল তোমরা আসবে বলো নি কেন?এসব কি আয়ুশ?হঠাৎ কেন?শ্রেয়াকে নিয়ে এসেছি আমি। ও যখন তোমার পুরো পরিবারকে দেখবে চিনে ফেলবে না?তখন কি করবো?প্ল্যান সাকসেসফুল হওয়ার আগেই সব ভেস্তে যাবে। ‘
আয়ুশের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো। মৃদু চিল্লিয়ে উঠলো সে,
‘ হোয়াট? তুমি ওকে নিয়ে এসেছো?’
‘ হ্যা। আমি কি জানতাম কাল তোমরা আসবে?ওকে একা রেখে আসতে ভালো লাগে না,তাই এবার ধরে বেঁধে নিয়ে আসি। সারাদিন ফোন করেছি। ছিলে কোথায়?’
‘ বাড়িতে ভেজাল লেগে গিয়েছে। ভাই আজকেই চট্রগ্রাম চলে যেতে চেয়েছিল চাচির অনুরোধে অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে রেখেছি আরো দু’টো দিন থাকার জন্য। বাড়িতে এসে শুনি আব্বু তোমার বাবাকে কালকে বিয়ের ডেট ফিক্সড করার জন্য যাবে জানিয়েছে। সব কেমন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। আমি ঠিক বুঝতে পারছি না কি করবো!তবে কোনোভাবেই শ্রেয়সী-ই ভাইয়ের বউ সেটা ভাইকে এখন জানতে দেওয়া যাবে না প্রিয়ু। না দেখেই পালিয়ে যাওয়া বউয়ের জন্য এক আকাশ সমান ঘৃ’ণা তার মনে।
#চলবে,,!
#সন্ধি_হৃদয়ে_হৃদয়ে
#লেখিকাঃ আসরিফা সুলতানা জেবা
#পর্ব___৭
প্রিয়ুর মা ও মামীর মাঝের আসনে বসে আছে শ্রেয়া। তাদের দু’জনের চারপাশে গোল করে বসেছে ছোট বড় সকলে। সবই মহিলা,ছোট বাচ্চা-কাচ্চা,যুবতী। বেশ বড়সড় প্রিয়ুর মা’য়ের কক্ষ টা। সেখানেই বিছানা,মেঝে যে যেখানে পারে বসে আছে, আড্ডা জমিয়ে তুলেছে। আড্ডা বাঙালী জাতির যেন এক অনিবার্য চাহিদা। কার না ভালো লাগে আড্ডা দিতে?চেনা পরিচিত লোক পেলে তা আরও জমে উঠে। টপিক প্রিয়ুর বিয়ে নিয়ে। বাড়ির মুরুব্বি,প্রিয়ুর ফুপাতো,মামাতো ভাই যারা এসেছে সব ছেলেরা ছাদে। আজ রাত তারা চন্দ্রিমার আলো গতরে মেখে ছাদেই গভীর নিদ্রায় তলিয়ে যাওয়ার ভাবনা-চিন্তা করেছে। শ্রেয়ার মনে হচ্ছে কালই বোধহয় প্রিয়ুর বিয়ে। কতসব আয়োজন!শুধুমাত্র ডেট ফিক্সড করতে আসবে তাতে কি রাজকীয় ভাবসাব!
প্রিয়ু সত্যিই খুব ভাগ্যবতী। সবাই কত ভালোবাসে ওকে। সামান্য কিছুতেই কল্পনা জল্পনার শেষ নেই। এই যে আসছে পর্যন্ত ওর মামী,মা,কাজিনদের ওর বিয়ে নিয়ে কত প্ল্যান। কোথায় থেকে শাড়ি কিনবে। বেনারসি নাকি লেহেঙ্গা পড়লে প্রিয়ুর জন্য মানানসই হবে আরো কত কি!এছাড়া আয়ুশের চোখেও দেখেছে ও অসীম প্রেম। বোনের মতন বান্ধবীর এত আনন্দে শ্রেয়া নিজেও আনন্দিত না এমন নয়। বরং একটু বেশিই মনটা শীতল প্রিয়ুর খুশিতে।
কিন্তু এখন এত মানুষের ভিড়ে একদমই থাকতে ইচ্ছে করছে না। লং জার্নি করে আসার পর পরই ফ্রেশ হয়ে সেই যে এখানে এসে বসেছে প্রায় ঘন্টার পর ঘন্টা অতিবাহিত হয়েছে। কোথাও গিয়ে একটু একান্তে কাটাতে মন স্পৃহা জাগছে শ্রেয়ার। তবে এভাবে গুরুজন রেখে উঠে যাওয়া চরম বেয়া/দবি বৈকি কিছুই নয়। কোনো ছুতো মিলছে না। প্রিয়ুও গায়েব। শ্রেয়ার অন্তঃপুরের ডাক প্রিয়ুর কর্ণ অব্দি পৌঁছালো হয়ত। মেয়েটা দরজার সামনে এসে হাজির। উচ্চ আওয়াজে ডেকে বললো,
‘ শ্রেয়া আয় খাবি। মা খাবার দাও আমাদের। সেই যে আসলাম এখনও না খেয়ে। মেয়েকে কংকাল বানিয়ে বিদায়ের ফন্টি এঁটেছ বুঝি?সাথে আমার কলিজার বান্ধবীটাকেও। ‘
প্রিয়ুর আহ্লাদী কন্ঠ শুনে তড়িঘড়ি করে আসর ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন রাশেদা। শ্রেয়াকে হাত টেনে উঠিয়ে বললেন,
‘ চল মা খাবি। আমার একদম খেয়াল ছিল না। দেখলি কথা বলতে বলতে ভুলেই গেলাম। নিচে হয়ত সবাই খেয়ে নিয়েছে তোরা কয়েকজনই বাকি। ‘
প্রিয়ুসহ ওদের কয়েকজন কাজিন ঠোঁট টিপে হাসে। রাশেদা এমনই। কথায় একবার মশগুল হলে ওনার দিন দুনিয়ার খবর থাকে না। রাত কেটে নতুন প্রভাত ধরণী স্পর্শ করবে তবুও ওনার কথার অন্তিমকাল আসবে না। কেউ কেউ তো অগোচরে বাঁচাল বলে বেড়ায়। বিশেষ করে ওনার শাশুড়ি কথায় কথায় সেই রাশেদার বিয়ের পর হতে ওনাকে বাঁচাল বলে সম্বোধন করে আসছে। তবে প্রিয়ুর বাবার স্ত্রীর এই গুণ টা খুবই প্রিয় ও মনকাড়া। তার ভাষ্যমতে,কথা ভিতরে চেপে রেখে গুমরে গুমরে ম’রবার চেয়ে অতিরিক্ত কথা-ই ভালো। এতে স্বাস্থ্যের ক্ষতি হবে না। সবসময় এমনটা করেন না রাশেদা। আপনজন কাছে পেলেই কথার ফুল ঝরে।
শ্রেয়া পাতের ভাত নাড়তে নাড়তে মিহি স্বরে প্রিয়ুর উদ্দেশ্যে বললো,
‘ কাল এতিমখানায় যাবো একবার প্রিয়ু। চলে আসবো বিকেলের দিকে। এখন শুধু বিয়ের ডেট ফিক্সড করা হবে,আমি না থাকলে চলবে না?এখানে আসার পর মনটা আনচান করছে এতিমখানায় যেতে। শৈশবের স্মৃতি টানছে খুব। ‘
প্রিয়ু সবে এক নলা মুখে দিয়েছিল। শ্রেয়ার কথা শ্রবণ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ভাত গিয়ে আটকালো গলায়। নাকে মুখে কাশতে আরম্ভ করে মেয়েটা। অতর্কিতে এমন কান্ডে শ্রেয়া ভড়কে গেল। পানির গ্লাস এগিয়ে দিয়ে পিঠে হাত ঢলতে ঢলতে অস্থির হয়ে পড়ল শ্রেয়া,
‘ পানি পান কর। হঠাৎ কি হলো তোর?পানি নে জলদি। ‘
প্রিয়ুর দাদি বেজার মুখে বলে উঠলেন,
‘ এই মাইয়া এমনিতে সবকিছুতে দেরি করে। এখন আবার তাড়াতাড়ি খাইতে গেছে ক্যান?দেরি করার মানুষ তাড়াতাড়ি করতে গেলে এমনই হয়। ‘
প্রিয়ুর চোখে মুখে পানি চলে এসেছে। দাদির দিকে ক্ষিপ্র দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললো,
‘ আমি দেরি করি?হিং-সায় জ্বলো রুফায়া?আমার সুন্দর একটা জামাই হইব। বুঝি,বুঝি। এ কারণেই আমার নামে মিথ্যে রটাও। ‘
‘ এ্যা। তোর যেই একটা জামাই। চার চোখ লেকচারার। এমন লেকচারার আমার জীবনে কত আইছে গেছে, পাত্তা দিলাম। তোর দাদা ম্যাজিস্ট্রেট আছিল বইলা আব্বা জোর কইরা বিয়া দিছিল,নাহলে তারেও গুনার টাইম আছিল না। ‘
দাদি-নাতিনের খুনশুটি দেখে শ্রেয়া হাসি আটকে রাখতে পারল না। সবকিছু কত সুন্দর, পরিপূর্ণ একটা পরিবার। ওর যদি এরকম একটা পরিবার থাকত!বুকটা হাহাকার ধ্বনি তোলে বারবার। নিঃশ্বাস ক্রমশ ভারী হয়ে আসে। পরিবার, ভালোবাসা কিছুই পেল না। সব হাতের নাগালের বাহিরে যেন। চাইলেই কি চাঁদে যাওয়া যায়?শ্রেয়ার জীবনটা হয়েছে ঠিক এরকম- “অভাগা যেদিকে যায়, সাগর শুকিয়ে যায়।” আপনজন,পরিবার কিছুই নেই এই তুচ্ছ জীবনে। আগেও বলত,এখনও মনে মনে সহস্র, কোটি বার আওড়ায়–‘ ভালোবাসার বড্ড অভাব। ‘
প্রিয়ু পানির গ্লাস রেখে তীক্ষ্ণ চাউনিতে চেয়ে দেখে শ্রেয়ার অঙ্গভঙ্গি। মেয়েটার বিস্বাদ চেহারা ওর অন্তরআত্মা কাঁপায়। শ্রেয়া যদি কাল এ বাড়িতে না থাকে তাহলে যা ভেবেছিল তার কিছুই হবে। কত আর লুকিয়ে থাকবে ও?প্রিয়ু চায়,মন থেকে চায় অতীত তিক্ত হলেও শ্রেয়া সেটা আঁকড়ে ধরেই অভিনব রূপে রাঙিয়ে তোলুক নিজেকে। শুভ্র রং ভালো কিন্তু সবসময় যে এটা মানায় না। প্রিয়ু চাওয়া হলো শ্রেয়ার জীবনে রংধনু উঠুক। মেয়েটার নামে একটা আকাশ হোক। সেই আকাশে দিনের বেলায় রংধনু উঠুক এবং রাতে একটা থালা সমান চন্দ্র ও কোটি কোটি নক্ষত্র। তাই সে আয়ুশের বিরুদ্ধে গিয়ে নিজ থেকে একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যেই মেয়ে বিবাহিত হওয়া স্বত্বেও স্বামীর মুখ না দেখে কিশোরী জীবন ফেলে এসেছে, তিন তিনটে বছর পেরিয়ে এসেছে কাল দেখবে স্বামীর মুখ। শুভ দৃষ্টি হবে। দৃঢ় বিশ্বাস প্রিয়ুর কোনো একদিন দুটো হৃদয় মিলিত হবে। স্পন্দিত হবে সমান তালে।
শ্রেয়া আজও ওকে বলেনি ওর অতীতের সত্যগুলো। প্রথম যখন আয়ুশের ফোন পেয়ে সাথে রিয়াকে নিয়ে সকল বাসস্ট্যান্ডে শ্রেয়াকে খুঁজে বেড়ায় প্রিয়ু তখনও জানত না শ্রেয়া নামের মেয়েটা আয়ুশের কি হয়,কেন খুঁজতে বলছে!আয়ুশ ওকে সচরাচর ফোন দিত না,কথাও হতো না। ঢাকা শহরে এলে মাঝে মাঝে সম্মুখে পড়ে গেলে দু’ একটা কথা বলত। ওই নিশ্চুপ স্বভাবের পুরুষের দুই একটা গম্ভীর কথা-ই যেন প্রিয়ুর হৃদয় উতলা করে তুলত। সেদিন যখন ফোন দিয়ে বললো প্রিয়ু তোমার একটা সাহায্য লাগবে, আমাদের বাড়ির সম্মান রক্ষা করতে হবে তখনই সে বিনা বাক্যে জানায় যা বলবেন তা-ই করবো আয়ুশ। আয়ুশ বললো সবকটা বাস স্ট্যান্ড চেক করতে যদি সম্ভব হয় একটা লাল টুকটুকে বেনারসি পড়া বিধস্ত মেয়েকে খুঁজে বের করে নিজের কাছে আশ্রয় দিতে হবে। লাল রঙের ড্রেস পরিহিতা একটা মেয়ের ছবিও পাঠিয়ে দেয়। আয়ুশ কিছু উচ্চারণ করার আগে প্রিয়ু বুঝে নেয় এই মেয়েটাকে ওর জীবন দিয়ে হলেও খুঁজে বের করতে হবে। শত হলেও ভালোবাসার মানুষের যে আদেশ,তবে শর্ত ছিল এমনভাবে মেয়েটার কাছে নিজেকে উপস্থাপন করতে হবে ও যেন কখনও বুঝতে না পারে আয়ুশ কিংবা চৌধুরী বাড়ির কেউ ওকে পাঠিয়েছে।
সেদিন শ্রেয়াকে নিয়ে আসার পর সে জানায় ও তার স্বামীর বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছে। কেন পালিয়ে এসেছে, স্বামী কই এসব জিজ্ঞেস করলেই চুপ থাকে মেয়েটা। পরিচয়ে জানায় ও এতিম। প্রিয়ু আর জোরাজোরি করে নি। বাকি সবটা আয়ুশের কাছ থেকেই শুনে নেয়। আয়ুশ ওকে কড়াভাবে নিষেধ করে দেয় শ্রেয়াকে যেন এ বিষয়ে আর জিজ্ঞেস করা না হয়। কস্মিনকালেও ভাবনায় আসে নি প্রিয়ুর চৌধুরী বাড়ির মানুষ এতিম একটা মেয়েকে এভাবে ঠ-কাবে। আয়ুশ কে জিজ্ঞেস করলে বলে বিয়ের কথা ও ঘূনাক্ষরেও টের পায় নি। ইউনিভার্সিটি থেকে ট্যুরে গিয়েছিল রাঙামাটি। যেদিন ফিরল এসে দেখে শ্রেয়াকে বধূ রূপে। প্রিয়ু অচেনা মেয়েটার জন্য ভেবে কষ্টে জর্জরিত হয়ে পড়ে দিনকে দিন। কখন যে মেয়েটা ওর কাছের হয়ে গেল খবরও রাখে নি। সহমর্মিতা দেখাতে গিয়ে আপন মানুষ হয়ে উঠলো পরিপূর্ণভাবে।
তূর্য ভালো হওয়ার পর চট্টগ্রামে আসার ব্যাপাার টা শুনে আয়ুশ ও প্রিয়ু চিন্তায় পড়ে যায় শ্রেয়া তো নিজের হাসবেন্ড কে দেখলেই চিনে ফেলবে। তূর্য চিনবে না এতে ওরা নিশ্চিন্ত। কারণ পাগলামির দিনগুলোর কোনো কিছুই তূর্যর মস্তিষ্ক ধরে রাখতে পারে নি। ওদের সেই চিন্তায় গরম জল ঢেলে আরো উত্তপ্ত করে তোলে শ্রেয়া।
তূর্যকে দেখার পরও শ্রেয়ার না চেনার বিষয়টা ভাবিয়ে তুলে ওদের। একটা সময় ঠাওর করে নেয় সেই অমানিশায় শ্রেয়া নিজের স্বামীর মুখই দেখে নি। আয়ুশ বুদ্ধি করে প্রিয়ুর পাশের বাসা খালি আছে জানায় তূর্যকে। উদ্দেশ্য শ্রেয়ার প্রতি তূর্যর মনে অনুভূতি জাগানো। অজান্তেই হোক কাছাকাছি থাকলে না জানা বউয়ের প্রতি অনুভূতি তো জাগবে!কিন্তু তূর্য জেনে গেল সে বিবাহিত এবং অদেখা বউকে প্রচন্ড ঘৃণা করে এতেই সব চেষ্টা বিফলে চলে গেল আয়ুশের। তূর্যর চট্টগ্রামে ইউনিভার্সিটিতে লেকচারার হিসেবে নিয়োগ দিচ্ছে জেনে আশার আলো খুঁজে পেয়েছিল শ্রেয়াকে সসম্মানে চৌধুরী বাড়িতে ফিরিয়ে আনার অথচ সেই আশার প্রদীপ নিভে যায় তার মনের কথা জানতে পেরে। যে না দেখেই বউকে ঘৃণা করে চোখের সামনে এলে কি করবে ভেবে কূল পায় না। ফলস্বরূপ আয়ুশ চায় শ্রেয়াকে আগে ভালো মেয়ে হিসেবে জানুক তূর্য। শ্রেয়া ঠিক কেমন মেয়ে নিজ চক্ষে দেখুক। শ্রেয়ার প্রতি পজিটিভ ভাবনা আসলেই তা আচ করে আয়ুশ জানিয়ে দিবে তূর্যকে এই মেয়েই তার বউ। কিন্তু শ্রেয়ার জানতে বাধা কই যে তূর্য স্যারই ওর স্বামী?প্রিয়ু কৌশলে ঠিক জানিয়ে দিবে শ্রেয়াকে। মেয়েটা অতীতের অধ্যায় না খুলতে চাইলেও তাতে সমস্যা নেই।
শ্রেয়ার নরম,রিনঝিনে স্বর কানে আসলো পুনর্বার। ডাকলো প্রিয়ু বলে। বললো,
‘ কাল যাবো আমি?রাগ করিস না প্লিজ। আর কবে ফিরি এই শহরে তা অনির্দিষ্ট। এসেই বা করবো কি আমার কোনো পরিচিত মুখের দেখা মিলবে না এখানে। কার টানে আসবো?মাদারের সাথে দেখা করে যাবো। ‘
প্রিয়ু বিচলিত কন্ঠে বললো,
‘ যেতে পারবি। তবে সকালে গিয়ে বারোটার আগে চলে আসিস প্লিজ। তোকে ছাড়া আমি একা হয়ে যাবো। ‘
‘ সেকি!কোথায় যাবে শ্রেয়া মা?’
রাশেদার উৎকন্ঠা। শ্রেয়া কাল বিলম্ব না করে প্রতুত্তরে জানালো,
‘ এতিমখানায় যাবো আন্টি। চলে আসবো বারোটার আগেই। ‘
প্রিয়ু স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ল। এঁটো হাতেই শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো শ্রেয়াকে। অতীব খুশিতে গদগদ হয়ে মুখ ফস্কে বলে বসল,
‘ আমরা দুই বান্ধবী, দু জা যেন এমন করেই সবসময় একসাথে থাকতে পারি। ‘
শ্রেয়া কি ভুল শুনল?জা?প্রিয়ুকে ছেড়ে চোখ বড় বড় করে অবাক গলায় জিজ্ঞেস করলো,
‘ জা?’
‘ জা?’– প্রিয়ুর দ্বিরুক্তি।
‘ হ্যাঁ। তুই এখন এটা বললি না?’
প্রিয়ু মেকি হাসি ফুটিয়ে বলে উঠল,
‘ মুখ দিয়ে ‘ন’ টা বের হতে দেরি হয়ে গেছে। ওটা দু জান হতো জানেমান।’
শ্রেয়ার সন্দেহাতীত দৃষ্টি দমে যায় মুহুর্তেই। প্রিয়ুর হাত টা ধরে নির্দ্বিধায় স্বীকার করে,
‘ আপন বলতে তোকেই চিনি প্রিয়ু।’
___________
তিন বছর পর চেনা জায়গা টায় এসে খন্ডিত হলো শ্রেয়ার হৃদপিন্ড। কাছের মানুষ টা আর নেই। নেই মাদার বলে যাকে ডাকত সেই সুন্দর চেহারার মহিলা টা। হঠাৎ স্ট্রোক করে মারা গিয়েছেন তিনি প্রায় বছর দেড়েক হবে। এসব শুনে শ্রেয়ার পায়ের নিচের মৃত্তিকার ফাটল শুরু হলো যেন। কেঁপে উঠে ওর সমগ্র ধরিত্রী। কান্না চেপে রেখে বেরিয়ে আসে এতিমখানা থেকে। প্রায় ঘন্টা দুয়েক ছিল। এখন ফিরতে হবে। কোথায় ভাবলো মাদারের কোলে মাথা রেখে মায়ের সুগন্ধ টুকু নেওয়ার সৌভাগ্য হবে। কিন্তু ভাগ্য বড়ই নির্ম-ম। বলাই হলো না মাদার আপনার মারফতে সেই কোচিং সেন্টারে এখন আমি জব করছি,দিব্যি চলে যাচ্ছে জীবন। অবক্ত হয়ে রইল বাক্যটা। গেট থেকে বেরিয়ে সাদা ওড়না টা মাথায় টেনে সিধা সড়ক ধরে হাঁটা ধরে শ্রেয়া। তখনই একটা গাড়ি সজোড়ে ব্রেক কষে ওর সন্নিকটে,পাশে। সহসা ধরাস করে উঠলো শ্রেয়ার সমস্ত কায়া। তড়িৎ বেগে পাশ ফিরতেই ভেতর হতে ভেসে আসে কিছুটা পরিচিত রুক্ষ কন্ঠস্বরের ডাক,
‘ শ্রেয়সী। ‘
শ্রেয়া হকচকালো আকস্মিক ডাকে। ভালো করে গাড়ির ভিতরে দৃষ্টি তাক করতেই মানুষটাকে দেখে যতটা না চমকালো তার চেয়েও ভারী বিস্ময়াবিষ্ট হয়ে পড়লো আজ মিস অর মিসেস শব্দমালা শুনতে না পেয়ে।
#চলবে,,,!