সন্ধি_হৃদয়ে_হৃদয়ে,৪২,৪৩

0
1500

#সন্ধি_হৃদয়ে_হৃদয়ে,৪২,৪৩
#লেখিকাঃ আসরিফা সুলতানা জেবা
#পর্ব___৪২

শ্রেয়াকে গাড়ি থেকে বের করে একটা বিশাল আকারের গেইট পেরিয়ে ঢুকে পড়লো তূর্য। চমৎকৃত নয়ন ফেলছে শ্রেয়া আশেপাশে। ঢের সুন্দর একটা বাড়ি। প্রাচুর্যে ভর্তি। সাদা রঙটা কেমন ঝিলিমিলি করছে। ছোটোখাটো একটা বাগান পেরিয়ে ওরা সদর দরজার সামনে এসে দাঁড়ালো। কলিংবেল চাপতেই যে দরজা মেলল তাকে দেখেই চক্ষুদ্বয়ের আকার নিমিষেই বড় হয়ে আসে শ্রেয়ার। চকিতে তূর্যর দিকে তাকালো ও। তাকিয়ে রইল অনিমেষ। নেত্র পল্লব ফেলতে পর্যন্ত ভুলে বসলো। তূর্য ওকে বিস্ময়ের চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে দিয়ে সামনের ভ্রুঁ কুঁচকে, কপালে ভাঁজ ফেলে প্রশ্নবোধক চাহনি নিক্ষেপ করে রাখা মেয়েটাকে প্রশ্ন করলো,

‘ কেমন আছেন আপু?আমাদের ঘরে ঢুকাবেন না?’

অহমিকার দরজার হাতল ধরে নিজেকে সামলে নেয়। চোখ জোড়া সংকুচিত হয়ে আসে তার। বিস্মিত কন্ঠস্বর, ‘ আপু?আপু কেন ডাকছো?আর তোমরা এখানে?’

শ্রেয়া নিজেও হতবাক। কথা বলার শক্তি হারিয়ে নির্বাক। তূর্য অধর কার্নিশে বাঁকা হাসি আঁকে। নিরলস হাবভাব তার। কন্ঠে গুরুতর ভাব এনে প্রতি উত্তর করে। বললো, ‘ খালা শাশুড়ির মেয়ে সম্পর্কে আমার বড় হলে আপু ডাকবো না?আর এটা তো ডাবল শশুর বাড়ি৷ মানে নানা ও খালা শাশুড়ির বাড়ি। টানে টানে ছুটে এলাম। ‘

‘কি?’
একই সঙ্গে দুটো ভিন্ন ভিন্ন মানুষের কন্ঠনালি গলিয়ে অভিন্ন শব্দ বেড়িয়ে আসে। কর্ণে বেজে ওঠে তূর্যর। বিরক্ত মাখা স্বরে বলে উঠলো, ‘ পা ধরে গিয়েছে ভিতরে গিয়ে বসে বসে বলবো। ‘
ফের অহমিকার দিকে তাকিয়ে বলে,’ আপু প্লিজ সাইড। ‘

তাজ্জব হয়ে চেয়ে চেয়ে একপাশে চেপে গেল অহমিকা। তূর্য শ্রেয়ার হাত ধরে ড্রইং রমে এলো। শ্রেয়াকে সোফায় বসিয়ে বললো,’ এটা তোমার নানার বাড়ি ও খালার বাড়ি। দুটোই। বলতে পারো তোমার মা’য়ের বাড়িও। ‘

অহমিকা ও শ্রেয়ার উভয়ের পায়ের নিচ থেকে শক্তপোক্ত মেঝেটা যেন সরে গেল। তূর্য ওদের হতভম্ব দৃষ্টি এড়িয়ে গিয়ে গাঢ় স্বরে বলে উঠলো,’ আপনার বাবা কোথায় অহমিকা আপু? আর নানু?’
তখনই রাশভারী গলায় কেউ ডেকে উঠলেন অহমিকা বলে। শ্রেয়া তাকিয়ে দেখে একজন বয়স্ক লোক। ওনাকে প্রিয়ু ও আয়ুশের বিয়েতে দেখেছিল সে। সম্পর্কে অহমিকার বাবা। ইনিই তাহলে ওর খালু?খালা কোথায়?তূর্য যে নানুর কথা বললো তার মানে নানুও আছেন। অহমিকার বাবা হাতের খবরের কাগজ টি টেবিলের উপর রেখে খানিক ঈষৎ ক্রোধমিশ্রিত গলায় তূর্যকে জিজ্ঞেস করলেন,

‘ তোমরা এখানে কি করছো?আমার মেয়েকে সবার সামনে অপমান করে শান্তি হয় নি তোমার?এখন বউ নিয়ে বাড়ি অবধি চলে আসলে?সেদিন কিছু বলি নি কারণ তুমি আগে থেকে বিবাহিত ছিলে। নাহলে আমার মেয়েকে তোমার পরিবার বিয়ের আশ্বাস দিয়ে অপমান করে এর একটা বিহিত আমি করেই ছাড়তাম। মেয়েটা দিন রাত এক করে সুস্থ করেছে তোমায়। তোমার মা তো তোমাকে এক রুমেই বন্দী বানিয়ে রেখেছিল। আমার মেয়ে মিনতি করে মেন্টাল হসপিটালে ভর্তি করায়। তোমার সব অত্যাচার সহ্য করেছে। সাইকোসিস ডিসঅর্ডারে ওকে কল্পনা করেই মানুষকে আ’ঘাত করতে,তাহলে সামনে পেয়ে কি করতে মনে নেই? কতবার আহত হয়ে বাড়ি ফিরেছে মেয়েটা। তবুও তোমার ট্রিটমেন্টে পিছুপা হয় নি সে। তোমার পাগলামি সইয়ে গিয়েই পাশে থেকেছে শুধুমাত্র নিজের ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করতে। সামান্য কৃতজ্ঞতাবোধ নেই তোমার।’

তূর্যর নাসারন্ধ্র দিয়ে সূক্ষ্ণ, তপ্ত নিঃশ্বাস বেরিয়ে এলো। ঠোঁটে ফিচেল হাসি৷ অত্যন্ত শান্ত কন্ঠে আওড়ালো,
‘ বসুন খালু। আপনার মেয়ের প্রতি কৃতজ্ঞ বলেই কিছু বলি নি। আপনার মেয়ের অন্যায় টা ছোট ছিল না৷ কাউকে ভিতর থেকে দুমড়েমুচড়ে দেওয়া অনেক বড় অপ’রাধ। চিকিৎসার জন্য আমার মা যথেষ্ট পেমেন্ট করেছে। তাছাড়া আপনার মেয়ে আমার জীবনের সবথেকে বেশি প্রিয় একটা মানুষ দিয়েছে। ও ছেড়ে না গেলে কখনও আমার শ্রেয়সীকে পেতাম না আমি। সেটার জন্য সহস্র বার ধন্যবাদ বলতেও দ্বিধা নেই আমার। ‘

শ্রেয়া বিমুগ্ধ। অহমিকার মাথা নত হয়ে গেল। সে লন্ডনে থাকতেই নিজের ভুল বুঝতে পেরেছে। আসলে কাউকে ঠকিয়ে ততক্ষণ পর্যন্ত তার যন্ত্রণা পরখ করা যায় না যতক্ষণ না স্বয়ং ঠকে। আজ বুঝে ও জীবনে কি হারিয়েছে এবং তা নিয়ে আক্ষেপের শেষ নেই। মেহরিমার কথায় তূর্যকে পাওয়ার স্বার্থ টা জাগ্রত হলেও নিজের অপরাধবোধে তা এখন দমে গিয়েছে। সাইদ সাহেব ধমকে উঠলেন,
‘ তো এখন কেন এসেছো?’
‘ নানা,খালা শাশুড়ির বাড়িতে আসতে মানা আছে?’– পাল্টা প্রশ্ন তূর্যর।
সাইদ সাহেবের কপালে বলিরেখার ভাঁজ পড়লো। ভাঁজের সংখ্যা কতশত হবে গুণে নি শ্রেয়া। কন্ঠে প্রবল অস্থিরতা মেখে প্রশ্ন করলেন,’ মানে?’
‘ আপনার একজন শালী সাহেবা ছিল, ভুলে গেলেন?’

‘ না। বাবার জেদের জন্য মা ও অহমিকার আম্মু কখনও ওকে এ বাসায় ফিরিয়ে না কিংবা যোগাযোগ করতে পারে নি। কিন্তু ওনার মৃ’ত্যুর পর শিমুলকে অনেক খুঁজেছি আমরা। একবার শিমুল যোগাযোগ করে আমাদের সাথে সাহায্যের জন্য। বাবা কেমন করে সেটা জেনে যায়। অসহায় ছিলাম আমরা। কারণ বাবা কথা নিয়েছিলেন আড়ালেও যেন আমরা কেউ ওর সাহায্য না করি। পরে একটা সময় জানতে পারি স্বামীর হাতে ও খু’ন হয়েছে। স্বামীও বেঁচে নেই। আশেপাশে জিজ্ঞেস করে জানি ওর একটা মেয়েও আছে। আমি অনেক খুঁজি কিন্তু মেয়েটাকে পাই নি। তার জন্য ধরে নিই মেয়েটাও বেঁচে নেই। ‘

শেষোক্ত কথাটা বলতে গিয়ে গলা ধরে আসে ওনার। শ্রেয়ার চোখ ছলছল করে ওঠে। তূর্য ওর হাতের উপর হাত রেখে বললো,
‘ আমার বউই শাশুড়ি মা’র মেয়ে। আশেপাশের এতিম খানায় খোঁজ নিলেই পেয়ে যেতেন। এতকাল কষ্ট বড় হতে হতো না ওর। আপনাদের খোঁজায় গাফিলতি রয়ে গিয়েছিল। ‘

সাইদ সাহেবের কন্ঠ কেঁপে কেঁপে উঠলো। বললেন,’ ও শিমুলের মেয়ে?’
গম্ভীরভাবে প্রতুত্তর তূর্যর,’ হ্যাঁ। ‘
‘ তুমি কিভাবে জানলে?’
‘ খুব একটা বেগ পোহাতে হয় নি, শাশুড়ি মা’র বাবার নামটা কালেক্ট করতে। সেই নামের সূত্রপাত ধরেই জানলাম অহমিকা ও শ্রেয়সী একে অপরের খালাতো বোন। আমি চাইছিলাম শ্রেয়সীর নানুর বাড়ির খোঁজ নিতে। তারা মানুক আর না মানুক নিজ চোখে একবার নিজের আত্মীয় স্বজন দেখুক ও,চিনুক তাদের। নানু কোথায়?’

‘ বছর খানেক আগে স্ট্রোক করে অহমিকার মা মা’রা যাবার পর থেকেই তিনি অসুস্থ। পরিবারে তো আর কেউ নেই। আমিও একা মানুষ। তাই অহমিকা কে নিয়ে এখানেই থাকা। ওনি রুমে আছেন। পায়ের হাড্ডি ক্ষয়ে গিয়েছে তাই চলাফেরা করতে পারেন না। ‘
__________

ত্রিহা নিজের রুমের দিকে যাচ্ছিল। অজান্তেই দৃষ্টি মেহরিমার রুমের সামনে যেতেই দেখলো তোহাশ দরজায় আলগোছে মাথা ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অথচ নক করছে না,ডাকছে না। হয়ত দ্বিধাদ্বন্দে ভুগছে সে। মৃদু হাসলো ও। সবই সময়ের খেল। প্রকৃতি কাউকে ছাড় দেয় না। যেটা মানুষ অবজ্ঞা করে নিয়তি যেন টেনে হিঁচড়ে সেখানেই সুখের খোঁজে দাড় করিয়ে দেয়। কয়েক পল চেয়ে নিরবে প্রস্থান করলো। টের পেতে দিল না তোহাশকে। পাছে যদি সে লজ্জায় চলে যায়।

রহিমা পানের বাটা টা নিয়ে ফাতেমা চৌধুরীর সামনে রাখলো। গড়গড় করে বললো,’ আজকের পান টা অনেক ভালো কইরা বানামু আম্মা। ‘
ভ্রুঁ কুঁচকে দুই অধর ফাঁক করে চাপা গর্জন করে ফাতেমা,

‘ তুই কি বাকিদিন আমারে খারাপ বানাইয়া খাওয়াইতি?’

‘ আরে আম্মা। তা না। আজ তো খুশির দিন। বাঘিনী জালে ফাঁসছে। কত ভাব দেখাইয়া,মিছা প্যাঁচ লাগাইয়া তোহাশ বাবারে একলা কইরা কাইড়া নিছিল মনে নাই আপনার?’
ফাতেমা ভেংচি কাটলেন। থমথমে মুখে বললেন,

‘ তোহাশ কিতা বাচ্চা লো?হেতে ফিডার খায়?বললেই চইল্লা যাইব?বদ একটা। মায়ার মতো নিষ্পাপ মাইয়ার ঘরে কেমনে এই বদ হইল আমি বুঝি না। বউয়ের কথায় নাচে খালি। ভালা হইছে নুরু কথা শুনায় দিছে। আমার আত্মা ডা শান্তি পাইলো। আমি নুরুর মা। ও কোনোদিন আমারে কষ্ট না দিলেও আমি বুঝি সন্তান কষ্ট দিলে কেমন লাগে। দুনিয়াতে যদি কারো সাথে সবথেকে উত্তম ব্যবহার করা লাগে তা মায়ের লগে,তারপর বাপ। কষ্ট ছাড়া সৎ মায়ের আদর পাইয়া বড় হইছে এ কারণে কদর কিতা তা জানে না। এখন বুঝবো হারে হারে। তোহাশের চেহারায় আমি কষ্ট দেখছি। ‘

‘ আমিও দেখছি আম্মা। ‘– বিবশ কন্ঠে বললো রহিমা।

#চলবে,,,!
(ভুল-ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)

#সন্ধি_হৃদয়ে_হৃদয়ে
#লেখিকাঃ আসরিফা সুলতানা জেবা
#পর্ব___৪৩

টিনের চালে বৃষ্টির সেতার বাজছে। তারই নিচে দাঁড়ানো মানব মন করছে আনচান। রিমঝিম ছন্দ তুলছে বৃষ্টি ফোঁটা। ফুটো চাল দিয়ে বিন্দু বিন্দু হয়ে প্রবেশ করছে জল। শ্রেয়ার সমগ্র সত্তা জুড়ে স্নিগ্ধ পবনের তীব্র ছোঁয়া। ভালো লাগায় নিমজ্জিত ও। বিষাদে, তিক্ততায় ভরা প্রাণে হঠাৎ করে শান্তির আগমন। এমনি এমনি ঘটে নি। ঘটিয়েছে। ওর পাশে উপস্থিত সুদর্শন, সুঠাম দেহী, গম্ভীরমুখো পুরুষ টার জন্যই অন্ধকারাচ্ছন্ন জীবন আজ আলোকিত। কত বছর পর মায়ের পর তারই আপন কারো স্পর্শ পেল ও। কাঁপা কাঁপা হাতে বয়স্ক নানুর মাথায় হাত বুলিয়ে দেওয়া,কেঁদে বুকে জড়িয়ে ধরা সবটুকু যেন স্বপ্ন ওর নিকট। সবথেকে ভাবিয়েছে অহমিকার আচরণ। কত নিঃস্বার্থ ছিল প্রতিটা কথা। এখনও কানে বাজছে। নানুর কক্ষে ওর দু হাত নিজের হাতের মুষ্টিমেয় নিয়েছে অহমিকা। চক্ষু কোটরে ছিল ঘোর অনুশোচনা। কন্ঠে অপ’রাধের ছাপ। নতজানু স্বরে বলে,

‘ তুমি আমার খালাতো বোন বলে আমি এতটা দুর্বল হচ্ছি না। আমি ভেঙে পড়েছি সত্যিকারে ভালোবাসা হারিয়ে। তূর্যর ভালোবাসা আমি বুঝি নি। অন্যের মিছে টানে নিজেকে বিলীন করেছি। আর যতক্ষণে বুঝলাম তূর্য আমাকে চায় না। সে চায় তার পবিত্র সম্পর্ক কে,তার স্ত্রীকে। তুমি ভাগ্যবতী শ্রেয়া। যে যুগে মানুষ স্ত্রী রেখে পর’কীয়া করে বেড়ায়,ভালোবাসার মানুষকে গোপনে ঠ’কায়, সেই যুগে তূর্য একটা সম্পর্কের টানে তোমাকে চেয়েছে। এখন ওর চোখের দিকে তাকালে কেবল তোমাকেই যেন দেখতে পাই। সত্যিকারে ভালোবাসতে চেহারা,যোগ্যতা,সৌন্দর্য এসব লাগে না। লাগে হৃদয়। ভালো থেকো। বার বার এখানে এসো। অপেক্ষায় থাকবো। আমার শাস্তি আমার অনুতপ্ততা,যা প্রতিনিয়ত কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে আমাকে। ‘

কয়েক পল নিস্তব্ধতায় পার করে শ্রেয়া। মানুষ বদলায়। কেউ খুব বাজেভাবে প্রতা’ণা করে, বেইমানি করে তো কারো পরিবর্তনে মিলে দুঃখের ছোঁয়া। বদলানোর অনেক রূপ থাকে। যদিও এ পৃথিবীর মানুষগুলো আজ গিরগিটির ন্যায় আবরণ বদল করে ভাঙ্গে অন্য কারো হৃদযন্ত্র। সেই মুহুর্তে অহমিকাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ও। নির্বাক কাটে সময়। তৎপরে চলে আসে তূর্যর সাথে। মাঝ রাস্তায় এসেই বাঁধে বিপত্তি। গাড়ি নষ্ট হয়ে গিয়েছে। পাশেই মেকানিক শপ, তাই তত একটা সমস্যা হয় নি। মেকানিক গাড়ি ঠিক করতে মগ্ন।

শ্রেয়া কিঞ্চিৎ ঘাড় বাঁকিয়ে পাশে চাইতেই থমকে যায়। নজর আঁটকে গেল তূর্যর চাহনিতে। নিষ্পলক দৃষ্টে চেয়ে আছে। শরীর জুড়ে আন্দোলন শুরু হলো ওর। তূর্য ক্ষীণ বাঁকালো অধর কার্নিশ। বললো,’ বউয়েরও কি এই শ্রাবণ ধারাতে প্রেম পাচ্ছে? যেমন করে আমার পাচ্ছে। ‘

আপনাআপনি আলগা হয়ে গেল শ্রেয়ার ওষ্ঠাধর। বুকের ধুকপুকানি নিয়ে এলোমেলো দৃষ্টিতে আশেপাশে তাকালো ও। তূর্য ওর চাউনি পরখ করে আফসোসের স্বরে বলে ওঠে,’ শুনছে না বউ। বৃষ্টির আওয়াজে আমার কথার শব্দ মেকানিকের কান অব্দি পৌঁছাবে না। এমনকি আমি তোমাকে কিস করলেও টের পাবে না। প্রমাণ দেখবে?’

শ্রেয়া চোখ জোড়া বড়সড় করে তাকালো। লজ্জায় ঈষৎ পিছিয়ে গেল দেহ। ঠোঁট নেড়ে ‘ না’ শব্দটুকু বের করতে যাবে তার পূর্বেই সমস্ত কায়ায় শিহরণ বয়ে যায়। ছলাৎ ছলাৎ করে ওঠে অন্তস্থল। অচিরেই হাত ঠেকে রক্তাভ গালে। তূর্য ধমকে ওঠে,’ তোমার হাতের দ্বারা আমার ঠোঁটের স্পর্শ মুছে গেলে ডাবল চুমু খাবো আমি। তাও একদম গভীর ভাবে। ‘

হাত সরিয়ে শ্রেয়া অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে বিড়বিড় করলো, ‘ মুছবো না। আপনার স্পর্শ কি মুছে ফেলার মতো?আপনি হলেন আমার জীবনের খুশির মাধ্যম। ‘

মেকানিক ছেলেটা রেইনকোট গায়ে ছুটে আসলো। ভর সন্ধ্যের সময় চলছে। মানুষজন নেই রাস্তায়। শ্রাবণ বর্ষণ হয়ত সবাইকে কাঁথা মুড়ি দিতে বাধ্য করেছে। ছেলেটার কন্ঠে ক্লান্তি। হাঁপানো স্বরে কি যেন বলে। শ্রেয়া প্রথমে ঠিকঠাক শুনতে পায় নি। পরবর্তীতে ছেলেটা আবারও তড়তড় গলায় বললো,’ গাড়ি ঠিক। ‘

তূর্য ওয়ালেট বের করে ছেলেটার টাকা চুকিয়ে দিল তৎক্ষনাৎ। নির্ধারিত টাকা থেকে আরও বাড়িয়ে দিল। খুশির ঝিলিক কলেজ পড়ুয়া ছেলের পরিশ্রমী মুখমন্ডলে। হাত ঘড়ির দিকে তাকালো সে। বড্ড দেরি হয়ে গিয়েছে। সন্ধ্যার প্রহরের পর নুরুল চৌধুরী উপস্থিত থাকতে বলেছিল। শ্রেয়াকে নিয়ে ঝটপট গাড়িতে ওঠে বসলো ছোট্ট টিনের ছাউনি থেকে বের হয়ে।

একটা বিষয় নিয়ে খুঁত খুঁত করছে শ্রেয়ার মন। সিটে তূর্যর দিক তাকিয়ে মিহি কন্ঠে আওড়ালো,’ একটা কথা বলি?’
তূর্য সায় দিল সঙ্গে সঙ্গে,’ বলো। ‘

শ্রেয়া সাহস পেলো। মনের জোর পেলো। মনের কথা আর অব্যক্ত রাখে না। বলে বসে,’ আমার মনে হয় আরিয়ানা আপু নিজেকে যেমন দেখায় উনি তেমন না। কিছু একটা আছে। ওনার লোভ নেই। থাকলে তিনি বাড়ি ছেড়ে ভাইয়াকে নিয়ে একা থাকতেন না। আমি খেয়াল করেছি ভাইয়াকে খুব ভালোবাসেন ভাবী। শুধু নিজের করে, একান্তে রাখতে চান। যাকে ওভার পজেসিভনেসও বলা যায়। ভাবীর মেন্টালি প্রবলেম আছে কিনা জানিনা। তোহাশ ভাইয়ার সাথে তো আপনার কথা হয়। আপনি কিছু জানেন?’

‘ অনেক কিছু জানি। সেই জানাতেই আজ ভাইকে চৌধুরী বাড়িতে আনা। আমি ভাইকে নির্দোষ মনে করি না। মিসেস আরিয়ানা পজেসিভ হতে পারে কিংবা মানসিক দিক থেকে বিক্ষিপ্ত তাই বলে ভাইও কি তেমন?না। কিন্তু পরিবারকে এক করা আমার কর্তব্য মনে করি আমি। ছেলে হিসেবে বাবাকে কি দিয়েছি?হাজার, লাখ টাকা ইনকাম করে দিলেও বাবা মায়ের ঋণ আমি শোধ করতে পারবো না। কিন্তু যেটা করলে তারা প্রকাশ্যে না হোক মনে মনে তৃপ্তি পাবে সেটা আমি করবো। বাবা আজ যতই অভিমান প্রকাশ করুক তিনি মনে প্রাণে চেয়েছেন তোহাশ ভাই চৌধুরী বাড়িতেই ওনার চোখের সামনে থাকুক। ‘

শ্রেয়ার কন্ঠে ভারি বিস্ময়। প্রশ্ন করলো,’ সত্যিই ভাবী মানসিকভাবে বিক্ষিপ্ত? ‘
তূর্য গম্ভীর কন্ঠে প্রতুত্তর করলো,’ হ্যাঁ। মিসেস আরিয়ানার বাবা দু বিয়ে করেছিলেন। প্রথম মা মা’রা যায় হুট করে। জ্বর আসে। দীর্ঘ দিন জ্বরে ভুগে বিনা চিকিৎসায় মা’রা যান। এতে ওনার বাবার অবহেলা ছিল। বউয়ের প্রতি টান ছিল না বললেই চলে। তারপর বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করলে আমাদের সমাজে অহরহ যা দেখা যায়। সেটার শিকার হোন তিনি। ছয় বছর বয়স থেকে দিন রাত সৎ মা’য়ের অত্যা’চার। ওনার বারো বছরের মাথায় বাবা ও সৎ মা দু’জনেই এক্সিডেন্টে প্রাণ হারান,সাথে তিন বছরের ছোট্ট ভাই। সৎ ভাই। কিন্তু একটা ভীতি খুব ভয়ংকর ভাবে নিজের মধ্যে পোষণ করেন তিনি এবং তা হলো সৎ মা মানেই খারাপ। বলতে গেলে এটা ওনার মানসিক রোগে পরিণত হয়। সেই থেকে এমন। যেদিন জেনেছে তোহাশ ভাইয়ের সৎ মা আছে সেদিন থেকেই একটু একটু করে তাকে আলাদা করে ফেলেছে। ভয় পেতেন ভাইকে হারানোর। ভাবতেন আমরা সবাই খারাপ। কেউ তোহাশ ভাইয়ের আপন না। তার জন্য শুধু ভাইকে আপন ভেবে সবার থেকে আলাদা করে ফেলা। মিসেস আরিয়ানার ভাষায় যাকে বলে আগলে রাখা। ‘

ভয় মানুষের মনে এমনভাবে বাসা বাঁধতে পারে?সত্যিই তো মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ থাকে। আরিয়ানার ভীতি টা ভুল না। তবে ওর এই ভীতি কতজনের সুখ কেড়ে নিয়েছে। বাবা মা, ছেলের মধ্যিখানে তুলেছে দেয়াল। অস্ফুট নড়ে উঠলো শ্রেয়ার দু ওষ্ঠ। জিজ্ঞেস করলো,’ আপনি এসব কবে জেনেছেন?’

তূর্যর রাগে মাথা গরম হয়ে উঠলো। এই মেয়ে কি দেখছে না সে ড্রাইভ করছে?সাধে কি গা’ধী বলে?রাগ সংবরণ করে দাঁতে দাঁত চেপে বললো, এটাই আপনার প্রশ্নের শেষ উত্তর দেবো। এরপর আমার ড্রাইভ করা অবস্থায় আর একটা প্রশ্ন করলে সোজা হা’মলা। ‘

শ্রেয়া শুকনো ঢোক গিলে। তূর্যর এক পলকের রোষপূর্ণ চক্ষুদ্বয়ের চাহনি পড়ে ওর কম্পনরত ওষ্ঠে। প্রশ্ন করবে না আর। একদম না। কর্ণধারে ভারী কন্ঠস্বর প্রতিধ্বনিত হয়,

‘ তোহাশ ভাইয়া কানাডা গিয়ে আস্তেধীরে বুঝতে পারে। মিসেস আরিয়ানার এ বিষয়টা বিয়ের আগে ধরতে পারে নি ভাইয়া। পারবেই বা কিভাবে!তখন তো আর আরিয়ানাকে মা’য়ের মুখোমুখি করা হয় নি যে ভিতরকার সেই ভীতি জেগে ওঠবে। পরে সাইকিয়াট্রিস্ট দেখানো হয়। এখন আগের থেকে কিছুটা নরমাল। তবে ওনার ভালোবাসা ভয়ংকর বলতে হবে। ইশ!আমার বউটা যদি এমন হতো। ‘
শেষমেশ তূর্যর ফিচেলমাখা স্বরে লাজুক হাসে শ্রেয়া। ও ভালোবাসে। মারাত্ম’কভাবেই ভালোবাসে। তার মানে এই নয় আপনজন থেকে দূর করে রাখবে। মনে মনে ঠিক করে নিল,আরিয়ানাকে বুঝাবে ও। যত্ন করেই বুঝাবে। ওর অতীত বলবে। আপনজনের সান্নিধ্য কত মধুর হয় সেটার মর্মার্থ বিশ্লেষণ করবে। মাঝে মাঝে একজন সঠিক বুঝ দাতার অভাবে মানুষের অনেক ভুলই ঠিক মনে হয়। পৃথিবীতে সকল মানুষ পারফেক্ট হয় না।
_____________

ড্রইং রুমে বসে আছে সবাই। বৃষ্টি মাথায় নিয়েই আসতে হলো উকিল সাহেবকে। উকিল সাহেব আবার নুরুল চৌধুরীর বন্ধু বলে কথা,তাই এক ডাকেই কাগজ পত্র তৈরি করে চলে এলেন। মেহরিমা রুম ছেড়ে বেরিয়েছেন। ত্রিহার সাথে হাতে হাতে নাস্তা রাখছেন উকিল সাহেবের সামনে। কাতর দৃষ্টিতে মা’য়ের দিকে তাকালো তোহাশ। তখন চেয়েও পারে নি দরজায় একটা টোকা দিতে,মা’য়ের সম্মুখীন হতে। কি বলে ক্ষমা চাইবে?কিভাবে শুরু করবে কথা?আদৌ সে কি মেহরিমা চৌধুরীর সামনে দাঁড়ানোর যোগ্যতা রাখে?অভ্যন্তর জ্বলছে তার। পুড়ে ছাড়খাড় হয়ে যাচ্ছে সকল অনুভূতি। মেহরিমা একবারও ফিরে তাকায় নি তার দিকে।

তূর্য কাপড় পাল্টে ভেজা চুলে হাত বুলাতে বুলাতে নেমে আসলো। তার পিছন পিছন শ্রেয়া ও প্রিয়ু। যেহেতু সম্পত্তি ভাগ হবে নুরুল চৌধুরীর আদেশ মোতাবেক সবাই আছেন। আরিয়ানা উপর থেকে চেয়ে আছে। এ সংসার, এই বাড়ির একটা ইটও ওর চায় না। তোহাশ ওকে জোর করে নিয়ে এসেছে। ও শুধু তোহাশকে নিয়ে, তিতিশাকে নিয়ে সুন্দর ছোটো একটা পরিবার চায়। সবাইকে ভয় হয়। সারাক্ষণ মনে হয় তোহাশ,তিতিশাকে ছিনিয়ে নিবে সবাই।

সোফায় বসে তূর্য তার মতামত রাখলো। বললো,’ আমাকে ততটুকু সম্পত্তি দিলেই চলবে যতটুকু দিলে আমি, আমার বউ, ভবিষ্যত বাচ্চা কাচ্চার মাথা গুজার ঠাঁই হবে। বাকিসব আয়ুশও ভাইকে দিয়ে দিন। হিসেবে আয়ুশ বেশি পাওনা। কারণ চাচার ভাগের টার অংশীদার কেবল সে। আর আমাদের অংশ থেকে ভাইকে বেশি দিন। ‘

আয়ুশ হেসে উঠলো। হেসেই বলে,’ আমি রাক্ষস না ভাই। কোনোমতে লেকচারারের চাকরিটা করে যেতে পারলেই চলে। ‘

তোহাশ ভেঙে পড়ে ভিতর থেকে। সহ্য হচ্ছে না ভাগ বন্টন। সোফা ছেড়ে দাঁড়িয়ে বহু কষ্ট বলে উঠলো,’ আমাকে তোমার সাথে থাকতে দিলেই হবে বাবা। সম্পত্তি লাগবে না। এসব ভালো লাগছে না আমার। ‘
পরক্ষণেই মেহরিমার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। মৃদু হাসলেন মেহরিমা। বললেন,’ নিয়ে নাও। তোমার যদি আমার উপস্থিতি খারাপ লাগে আমি চলে যাবো। তবুও থাকো এখানে। ‘

অশ্রু কণা দলা পাকিয়ে স্বরনালী রোধ করে বসে তোহাশের। দৃষ্টি হয় নিচু। মিনিট কয়েক কাটতেই সূক্ষ্ম নিঃশ্বাস ছেড়ে থেমে থেমে ক্রন্দনমিশ্রিত গলায় বাক্যগুলো উচ্চারণ করে,

‘ তোমার কাছে ক্ষমা চেয়েও আমি শান্তি পাবো না মা। কিছু ভুলের কখনোই ক্ষমা হয় না। অনুশোচনা নিয়েই আমি তোমাদের সাথে থেকে শাস্তি ভোগ করতে চাই। মা ডাক মধুর। আমাকে জন্ম না দিলেও যেমন আপন করে বড় করেছো তেমনি আরিয়ানাকে আল্লাহ সেই পরিস্থিতিতে ফেলেছে। ও হয়ত অসুস্থতার জন্য এখনও পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারে নি। কিন্তু সেও জন্ম না দিয়েও মা। নিজের অন্যায় বুঝার জন্য এর থেকে সুন্দর আর কি হতে পারে?’

তড়তড় করে গরম নোনতা জল নেমে গেল আরিয়ানার কপোল বেয়ে। শ্রেয়াসহ সকলে স্তব্ধ। কি বলছে তোহাশ!

#চলবে,,!
(ভুল-ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here