সন্ধি_হৃদয়ে_হৃদয়ে,পর্ব_৪৬ শেষ

0
2110

#সন্ধি_হৃদয়ে_হৃদয়ে,পর্ব_৪৬ শেষ
#লেখিকাঃ আসরিফা সুলতানা জেবা

‘ স্ট্যাচু হয়ে গেলে কেনো?তুমি চাইছো না তোমার জামাইয়ের শান্তি?বড্ড নিষ্ঠুর বউ তুমি শ্রেয়সী। ভিতরটা জ্বলে যাচ্ছে।’

নিবিড়, নির্জন বিভাবরীতে ছাঁদের অপর পাশ হতে মৃদুমন্দ জ্যোতি আসছে যেন ভেসে ভেসে। চমকিত শ্রেয়ার শিরা উপশিরায় তরঙ্গ খেলা করছে। পুরোনো অভ্যেস ক্ষণে ক্ষণে কিংবা আকস্মিক নব্য হয়ে ওঠে। অতিরিক্ত বিস্ময়ে, ভয়ে গলায় শুষ্ক শুষ্ক ভাব হয়। কন্ঠনালি শুকিয়ে কেমন কাঠ কাঠ হয়ে যায়। শ্রেয়ার এই অভ্যেস টা বদলায় না। ধীর গতিতে পদলি ছাঁদের মেঝেতে ছুঁয়ে এগিয়ে এলো তূর্যর সান্নিধ্যে। বুকটা থরথর করে কাঁপছে। একটা দমকা হাওয়া বয়ে গেল সেই সময়টাতে। এলোমেলো করে দিয়ে গেল ওর কেশগুচ্ছ। অঙ্গ- প্রত্যঙ্গ, সর্বাঙ্গে শিরশির অনুভূতি জাগিয়ে তুলে মুহুর্তেই।

তূর্যর বুঝি তর সইল না। লাজুক হাসি নিয়ে স্থির নেত্রে নিম্নে তাকিয়ে থাকা শ্রেয়াকে হ্যাঁচকা টানে বুকে মিশিয়ে নিল। হকচকিয়ে গেল ও। নিশ্চল চাহনি পড়লো তূর্যর আংশিক উন্মুক্ত বক্ষে৷ উতলা হয়ে পড়লো অভ্যন্তর। সমস্ত কায়ায় প্রবল উত্তেজনা। তূর্যর কন্ঠে উৎকন্ঠা,

‘ মন খারাপ কি কমেছে আপনার?এই যে সারাক্ষণ মন খারাপ করে থাকতেন আমি যাওয়ার পর এটা কি উচিত হয়েছে? আমার বউ থাকবে সদা প্রাণবন্ত। অতীতে কতটুকু হেসেছে,কি পরিমাণ কেঁদেছে তা আমার মাথা ব্যথা নই,আমার সার্থকতা তাতেই যে আমি আমার অর্ধাঙ্গিনীকে কতটুকু সুখে রাখতে পেরেছি। তার হৃদয়স্থলে আমার দ্বারা কতবার হিম শীতল বাতাস বইয়ে গিয়েছে, কতবার রক্তাক্ত হয়েছে তাও আমি জানতে চাই। ‘

শ্রেয়া দেরি করলো না। একটুও না৷ উদ্বেলিত হয়ে জবাব দিল,
‘ একবারও রক্তাক্ত হয় নি। ‘

তূর্য তাকালো কপালে ভাঁজ ফেলে। দায়সারাভাবে বাঁকা হেসে বলে উঠলো,’ এটা মিথ্যে। আই হার্ট ইউ। হিট আওয়ার ফার্স্ট এন্ড সেকেন্ড ফ্লাওয়ার বেডস। ‘

গলায় কম্পন শ্রেয়ার। মুখ উঁচিয়ে অস্পষ্ট কন্ঠে বলার চেষ্টা করে,’ কিন্তু ওটা তো আপনি মানসিকভাবে বিধস্ত ছিলেন। আর দ্বিতীয় বার সেটা আমার ভালোর জন্যই। ‘

‘ তাই বলে অন্যায় ঢাকা পড়ে যাবে?ভালোবাসো বলে সব মাফ?কোমল মনের বউ সামলাতে ঠিক কি পরিমাণ কঠিন হতে হবে বলো তো?নাকি শক্তিশালী হতে হবে?এমনিতেই আমার দেহ বলিষ্ঠ। বউ যা কোমল এই দেহেই জোর খাটিয়ে জড়িয়ে ধরলেই পিষে যাবে। ‘

শ্রেয়া কথা কাটানোর জন্য ফটাফট জিজ্ঞেস করে বসলো,
‘ আপনি এত রাতে আসলেন যে?আগামীকাল ভার্সিটি? সমস্যা হবে না?এমনিতেই অনেক ঘন ঘন ছুটি কাটিয়েছেন। ‘

‘ চিন্তা কি আমার জন্য নাকি আমার ভবিষ্যৎ টেমা টুমির জন্য?’

ভ্রুঁ যুগল কুঁচকে প্রশ্ন টা করলো তূর্য। শ্রেয়া হতবিহ্বল,হতবুদ্ধি। কন্ঠ গলিয়ে বেরিয়ে আসলো চমক মিশ্রিত ধ্বনি,’ টেমা টুমি?’

তূর্য তার বাহুবন্ধনে আবদ্ধ মেয়েটার ললাটে ঠোঁট ছুঁয়ে পার করলো কয়েক মিনিট। নিঃশ্বাস ভারী ভারী ঠেকছে শ্রেয়ার। ঢেউ গর্জে ওঠছে যেন বক্ষস্থলে। পরক্ষণেই অনুভূত হয় ওষ্ঠ যুগল ধীরে ধীরে ওর সরু নাক খানা স্পর্শ করে অনবরত নড়তে থাকা ঠোঁটের কার্নিশে নেমে এসেছে। ভেতরটা লুব্ধ শ্রেয়ার। স্পর্শ পাবার তীব্র আকাঙ্ক্ষা।

তূর্য প্রখর চাউনি নিক্ষেপ করে ওর সমগ্র বদনে। ফিচেল হেসে কর্ণধারে মুখ নিয়ে বললো,
‘ এই যে এভাবে আদর করি এটার ফলাফল আসবে না?ফলাফল গুলোর নাম আপাতত টেমা টুমি। পরে সুন্দর নাম ভেবে দেবো। আর মিসেস শ্রেয়সী, আমার বউ,আমার শুভ্রপরী কাল শুক্রবার। ভার্সিটি অফ। চাকরি যাবে না, আমাদের ভবিষ্যতের টেমা টুমিও অভাবে ভুগবে না। কিন্তু আফসোস!টেমা টুমির মা’কে আদর করতে গেলে তার লজ্জা আমাকে বাঁধা দেয়। এত লজ্জা রেখে তাদের আনা যাবে টেমা টুমির আম্মা?’

লাল রঙের সাথে এ মুহুর্তে শ্রেয়ার মুখশ্রীর তুলনা করলে মন্দ হবে না। শক্ত বক্ষে চট করে মুখ গুঁজে ফেলেছে। ইচ্ছা অনিচ্ছা সব মিলিয়ে নরম ওষ্ঠাধরের স্পর্শ এঁকেছে সেই খোলামেলা বুকের বা পাশে। তূর্য শরীরের সর্বস্ব শক্তি দিয়ে মিশিয়ে নিল ওকে। তারও হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া প্রক্রিয়া অস্বাভাবিক হয়ে পড়লো। বললো,

‘ তোমাকে ছাড়া থাকতে পারবো না৷ যেদিন গেলাম সেদিন থেকে ভিতরে জ্বালাতন শুরু হয়। আমার ক্লান্তির অবসান হওয়ার মাধ্যম আমি রেখে গিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারি?’

শ্রেয়া ভুলবশত মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বলে ফেললো। নিমেষে ক্ষিপ্র দৃষ্টি ছুঁড়ে মা’রলো তূর্য। ভয়ে কুঁকড়ে গেল ও। আমতা আমতা করে বলে,’ না। ফেলতে পারেন না। ‘
তবুও লাভ হলো না। তূর্য আগুনের শিখার ন্যায় জ্বলে উঠলো। ওর ওড়না টা টেনে নিয়ে নিজের গলায় পেঁচিয়ে পড়লো। কিঞ্চিৎ থ্রে’টের আভাস কন্ঠে। কড়া সুর। বলে উঠলো,

‘ ভালোবাসি বলো তবেই ওড়না পাবে। নয়ত সারা রাত দাঁড়িয়ে রোমান্স করবো। ভাই ভাবী,আয়ুশী,প্রিয়ু সবাই কিন্তু আরও বাড়িয়ে চড়িয়ে ভাববে। ‘

অকস্মাৎ মস্তিষ্ক সজাগ হলো শ্রেয়ার। ও তো এতসময় ভাবেই নি ছাঁদে উপস্থিত বাকি সবার কথা। লজ্জায় কুঁকড়ে যেতে মন চাইছে। এখন ওড়না ছাড়া যেতেও পারবে না। ভালোভাবেই দড়ি বিহীন-ই ওকে শক্ত, কঠিন বাঁধনে বেঁধে ফেলেছে সুযোগ পেলেই হেঁয়ালিপনায় মাতোয়ারা হওয়া এই সুঠাম দেহী পুরুষ। অদৃশ্য বাঁধন অথচ কি কঠিন! উপায়ন্তর না মেলায় মনে মনে সাজিয়ে নেয় বর্ণমালা। বুকের ধুপধাপ আওয়াজ সমেত বললো,

‘ ভা,,ভালোবাসি। ‘
তূর্য রেলিংয়ে হেলান দিয়ে দাঁড়ালো। চেহারায় নির্লিপ্ত ভাবসাব। প্রশ্ন করলো,’ কবে থেকে?’
শ্রেয়ার এমনিতেই রূদ্ধশ্বাস অবস্থা তার উপর তূর্যর বেপরোয়া অভ্যেস। জেনেশুনেও ওর সাথে ইচ্ছেকৃত এমন করে।
‘ বিয়ে ঠিক হবার পর থেকে। ‘
‘ না দেখেই ভালোবাসা? বাহ!বউ আমার রিয়েল লাভার। আই লাভ ইউ টু টু টু বউ। ‘

শ্রেয়া বেক্কল বনে গেল। এত বার টু টু টু!আশ্চর্যজনক কান্ড। ভারি শরমও লাগছে। প্রতিদিন যেন নতুন করে আবিষ্কার করে ও তূর্যকে। হেঁয়ালিপনা,গম্ভীরতা মিলিয়ে ভালোবাসা প্রকাশ করে যায় লোকটা।

‘ এবার ওড়না দিন। ‘

হাত পাতে শ্রেয়া। তূর্য ওকে অগ্রাহ্য করে কয়েক কদমে ওর পিছনে গিয়ে দাঁড়ালো। তৎক্ষনাৎ মাথায় কিছু অনুভব করলো ও। ওড়না টা জড়িয়ে দিয়েছে ওর মাথায় তূর্য। হাত টা ধরে সাথে করে নিয়ে এলো আড্ডা স্থানে। ওদের দেখে হৈচৈ করে উঠলো সবাই। আয়ুশী তো রীতিমতো খিলখিল করে হেসে গেল। ঠিক কতক্ষণ হিসেব করা হয় নি সময়ের। কখনো কখনো বেহিসেবী অনেক কিছুই ভালো লাগে।

সেই রাতে আড্ডা হয় জমপেশ। তন্মধ্যে আরিয়ানা সবাইকে স্বাক্ষী রেখেই তূর্যর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানায় ওদের এ বাড়িতে ফিরিয়ে আনার জন্য। ক্ষমাও চায়। বিপরীতে তূর্য কেবল এটাই বলে,’ মানুষের হৃদয়স্থল কাঁচ ন্যায় স্বচ্ছ হলে ত্রিভুবনের সবকিছু সুন্দর। সেই কাঁচ যদি ঘোলাটে হয়ে যায় আশেপাশের, চারিধারের সকল জিনিস কুৎসিত, তুচ্ছ। ‘

পরের প্রাতঃকালে তোহাশ,তূর্য হাঁটতে বের হয় বাবার সঙ্গে। দুই ছেলেকে নিজের দু পাশে পেয়ে নুরুল চৌধুরী এখন বেশ সুস্থ হয়ে উঠেছেন। চিন্তা,কষ্ট, দুঃখ,মানসিক অশান্তি একজন সবল মানুষকেও নেতিয়ে দেয়। মানুষটাকে পরখ করলে মনে হয় সে যেন কত্ত কঠিন রোগে ভুগছে,অসুস্থ। এগুলো থেকে মুক্তি পেলেই সুস্থ আর শান্তি। নুরুল চৌধুরীর ক্ষেত্রেও তাই হলো। আজকাল মানুষকে দেখিয়ে তিনি নিজের তাগড়া তাগড়া দুই যুবককে নিয়ে মহানন্দে ঘুরে বেড়াতে পারেন। হাঁটতে হাঁটতে কবরস্থানের কাছাকাছি আসে তিনজন। অদূরে মায়া মা’য়ের কবর টা। তিনজনই অপলক দৃষ্টে তাকিয়ে রইল। কতশত সেকেন্ড যে পার হলো এর মাঝে সে খেয়াল কারোই নেই। মোবাইলটা বেজে ওঠতেই তোহাশ একটু ঝক্কি দিয়ে ওঠে। মা’কে দেখে নি সে কিন্তু কল্পনায় খুঁজে পায় প্রতিনিয়ত। মোবাইল টা নিয়ে একপাশে সরে আসে।

‘ বাবা কে নিয়ে বাড়িতে এসো। ওনি ওষুধ না খেয়ে বেরিয়ে পড়েছেন আম্মা এখন বললো। ডায়াবেটিসের রোগী হয়ে এত অনিয়ম করলে চলে?জলদি এসো। ‘

হুম’কিধামকি দিয়ে আরিয়ানা টুপ করে কল টা কেটে দিলো। তোহাশের মনটা ছেয়ে যায় প্রশান্তিতে নিমিষেই। এক রাতেই আরিয়ানা নিজেকে আরও পাল্টেছে। তূর্যর কথাটা মাথায় অত্যন্ত সুন্দরভাবে গেঁথে নিয়েছে। পরিষ্কার হৃদয়ের হতে হবে। হৃদযন্ত্রে কোনো রকম ভেজালের অস্তিত্ব রাখা যাবে না। কেননা মেদিনীর সবটা মুগ্ধ হয়ে সুন্দর চক্ষে অনুভব করতে হবে। তোহাশ ফিরে এসে বললো,

‘ বাবা বাড়িতে চলুন। ‘
দেহের কোনো এক অংশে পুরোনো অনুভূতিদের উচাটন ক্রমশ বেড়ে গেলো। কিছু বলতে পারলেন না নুরুল চৌধুরী। উনি দু হাত অনুচ্চ অর্থাৎ সামান্য উঁচিয়ে দুই ছেলের কাঁধে রাখে। রাশ ভারী গলায় বলে,’ ভালোবাসা আগলে রেখো দু’জনে। ‘

ফাতেমা চৌধুরী প্যাসেজওয়েতে লাঠির ঠকঠক শব্দ তুলে এগোচ্ছিলো। হুট করে তাঁর চোখে বিঁধে প্রিয়ুর চুমু খাওয়া। তড়িৎ বেগে দু দুইবার চুমু খেল মেয়েটা আয়ুশের খসখসে গালে,খোঁচা খোঁচা দাঁড়ির উপর। লজ্জায় উল্টো ঘুরে ঘরের দিকে হাঁটা ধরলো। বিড়বিড় করলো,’ পেরেম করবো স্বামীর লগে,দরজা ডা লাগাইয়া করবো না?শরম নাই। ‘

রহিমা খালা ফাতেমা চৌধুরীর রুমেই ছিল। হাতের ঝাড়ু টা ফেলে দৌড়ে এসে বলে উঠলো অস্থির গলায়,’ কি বিড়বিড় করেন আম্মা?’

বেজায় বিরক্ত ফাতেমা। রাগে গজগজ করলো,
‘ তুই একটা কানপাতা বেডি। সব হুনা লাগবো তোর। বিড়বিড় করছি তোরে লাথি মে’রে কই পাঠামু ওই বিষয়ে। ‘

‘ এডি কি কন আম্মা?আমি কি করছি?’

‘ করছ নাই। কিন্তু এহন আমার মাথার উপর নাচতেছস। যা চা লইয়া। চা খামু। ‘

‘ আনতে হবে না৷ রহিমা খালা বসুন। আমি এনেছি দাদি। ‘

আদুরে, নম্র কন্ঠস্বরটা শুনে কান খাঁড়া হয়ে ওঠে ফাতেমা চৌধুরীর। মুখ ঘুরিয়ে দেখে আরিয়ানা চায়ের কাপ হাতে দরজায় দাঁড়িয়ে। ঠোঁটে মিষ্টি হাসি ঝুলানো। ওনি ভূত দেখার মতোন করে বিস্ময়কর দৃষ্টিতে তাকালো। নিচু কন্ঠে বললো,

‘ তুমি?’
আরিয়ানা প্রশ্ন টা উপেক্ষা করে এগিয়ে এলো। মেহরিমা শিখিয়ে পড়িয়ে দিয়েছে কিভাবে দাদির মন জয় করতে হবে। চায়ের কাপ টা এনে টেবিলের উপর রাখলো সে।
‘ নিচে যেতে আপনার কষ্ট হবে তাই উপরেই নিয়ে আসলাম। ‘
বিশ্বাসযোগ্য মনে হচ্ছে না কথাগুলো ফাতেমা চৌধুরীর নিকট। কন্ঠে দৃঢ়তা টানে,
‘ তোমার হাতের চা খাবো না। ‘
‘ কেনো?’– বিরস স্বর আরিয়ানার।
‘ যদি কিছু মিশিয়ে আনো?’
গটগট করে কাপ টা হাতে তুলে নিজে চুমুক বসালো আরিয়ানা। তৎপরে বললো,’ বেঁচে আছি দাদি। আমাকে সুন্দর ভাবে আপনাদের সাথে বাঁচার সুযোগ দিন৷ ‘
কয়েক পল ভেবে ফাতেমা চৌধুরী বলে উঠলো,’ দিমু। এখন চায়ের কাপ টা দাও। বরবাদ তো কইরা দিলা। এইডাই খাইয়া লই। ‘

আরিয়ানা স্মিত হাসলো। সেই হাসিতেই যেন মুক্ত ঝরছে। মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় তাকিয়ে দেখলো নিষ্পলক অক্ষিতে ফাতেমা চৌধুরী ও রহিমা।
______________

কুরবানির ঈদ পালনের জন্য সম্পূর্ণ চৌধুরী পরিবার গ্রামে এলো। বিশাল বড়সড় একটা গরু কিনেছেন চৌধুরী সাহেব। এই প্রথম ছেলে,পুত্রবধূ নিয়ে গ্রামে ঈদ পালন। গ্রামে বহুবছর না আসায় আগের আধাপাকা, উপরে টিনের চাল দেওয়া দু’টো ঘর রয়ে গিয়েছে। উঠোন পেরিয়ে এ ঘর থেকে ওই ঘরে যেতে হয়। মাঝেমধ্যে আসলে মানুষ থাকবে ভেবে এরকম ঘর তুলে রাখা। কিন্তু ব্যস্ত জীবন ফেলে রেখে গ্রামমুখী হয় ক’জন। মেহরিমা বেতের মোড়ায় বসে তিন পুত্রবধূর আলামত দেখছেন। তিনজনেই জেদ ধরেছে আজ শীল নোরায় মশলা বাটার৷ শহরে ব্লেন্ডারে কাম চালিয়ে এখন কাঁচা হাতে এসব কি পারবে?তবুও প্রবল চেষ্টা তিনজনের। শ্রেয়া এক প্রকার যুদ্ধই চালাচ্ছে। যে করেই হোক দারচিনি একদম মিশ করেই সাড়বে ও। ত্রিহা বার কতক বলেছে প্রিয়ুকে এসব ছেড়ে ঘরে গিয়ে বিশ্রাম নিতে কিন্তু শুনতে অপারগ। এখানে এসে রহিমা খালার একজন সখি হলো তার নাম কুসুম। কুসুম খালা বলেই ডাকে সবাই। পাশের বাড়িতেই থাকেন তিনি। ওনি তিনজনের উদ্দেশ্য বলে উঠলেন,

‘ আজকাল এমন বউ পাওয়ায়ই যায় না। আমার পোলার বউ ডা সারাদিন খায় আর ঘুমায়। তোমাগো মতো শহর থাইকাই তো প্রেম কইরা বিয়া কইরা আনছিল আমার পোলাডা। ‘

নিজের ঘরের সব তেঁতো, পরের ঘরের সব মিষ্টি। মহিলার কথার পৃষ্ঠে হাসিমুখে বলে উঠলেন মেহরিমা। কথার মারপ্যাঁচ বুঝতে পেরে শ্রেয়া নিঃশব্দে হাসলো। কে জানে কুসুম খালা বুঝলো কিনা!কি নিরবে তীর টা-ই না ছুঁড়লেন মেহরিমা চৌধুরী।

শিল নোরায় মশলা বেঁটে হাতের অবস্থা নাজেহাল আরিয়ানার। তবুও আনন্দ পেলো ও। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। রাতের খাবার উঠোনের এক পাশে গর্ত করে চুলো বানিয়ে রাঁধা হবে। ইতোমধ্যে ইট দিয়ে চুলা বানানোর কাজ সমাপ্ত। শ্রেয়া খয়েরী রঙের শাড়িটার আঁচল মাথায় টেনে কেরোসিনের বোতল টা নিয়ে এলো। তূর্য ওর হাত থেকে বোতল টা নিয়ে অভিজ্ঞদের মতো ঝটপট আগুন জ্বালিয়ে ফেললো। বহ্নিশিখা বাড়ছে। তূর্যর কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। পড়নের কালো শার্ট টা ঘেমে একাকার। শ্রেয়ার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে লহু স্বরে বলে উঠলো,

‘ তোমাকে সবসময় নতুন বউ বউ লাগে কেনো?এই যে টুকটুকে লাল খয়েরী শাড়ি পড়ে মাথায় ঘোমটা টানলে মনে হচ্ছে আমার সদ্য বিয়ে করা বউ। বুকের বা পাশ টা ধ্বক করে ওঠে। তোমাকে একটু না দেখতে পেলে মন চায় এ পাশের হৃদয় নামক অঙ্গ টা আমি আগুনে পুড়িয়ে ফেলি। ভালোবাসি আমার শুভ্রপরী। ‘

শ্রেয়া চারপাশে একনজর মেলে তূর্যর গা ঘেঁষে দাঁড়ালো। ঢিমেতালে হাতে হাত রাখলো। মুষ্টিবদ্ধ করে ফেললো তূর্য তাৎক্ষণিক। মোহনীয় স্বরে বললো শ্রেয়া,

‘ আমি আপনার সাথে মিশে থাকবো। চিরকাল থাকবো। ‘

( সমাপ্ত)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here