ছিলে অচেনা|ভালোবাসার গল্প

0
3517

ছিলে অচেনা
লেখনীতেঃ কথা চৌধুরী

—“কথামনি! আরে উঠ না মা। আর কত ঘুমাবি? এগারোটায় ফ্লাইট তোর কি সেই দিকে কোনো খেয়াল আছে? তোর বাবা তো বসে আছে। আমাদের নিয়ে নাস্তা করতে যাবেন রেস্টুরেন্টে। আরে উঠ না। উফ বাবা! এই মেয়েকে নিয়ে যে আমি কি করবো?”

এক নাগাড়ে বিরতিহীনভাবে মায়ের বকবকানি চলছে। আর আমি আয়েশ করে বিছানায় পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছি। এতো কথা শোনার পরও উঠছি না দেখে মা আমার গা থেকে কম্বল সরিয়ে জোরে জোরে ঝাঁকুনি দিয়ে বলতে লাগলো,

—“এই! তুই কি উঠবি নাকি তোর গায়ে পানি ঢেলে দিবো?”

এখনও আমি ঘুম আঁকড়ে বিছানায় পড়ে আছি। মার ধৈর্যের বাঁধ ভাঙতে লাগলো। অসহ্য হয়ে বললো,

—“এমন বেহায়া মেয়ে যে আমার কপালে কেন এলো কে জানে? এতো কথা শোনার পরও গরুর মতো ঘুমাচ্ছে।”

একটু থেমে মা বলতে লাগলো,

—“এই কথামনি! উঠবি নাকি তোকে কক্সবাজারে ফেলে রেখেই চলে যাবো?”

সাধ্যের ঘুমের বারোটা তো অনেক আগেই বেজে গেছে। মার কথার কোনো জবাব না দিয়ে শোয়া থেকে উঠে বসলাম। বিছানায় বসে মাথা চুলকচ্ছি আর চোখ বুঁজে এখনও ঘুম ঘুম ভাবটা ধরে রেখেছি। তবে মাথায় ছোট্ট একটা গবেষণা চলছে,

—“গরু কি আমার মতো বকবকানি শুনেও ঘুমিয়ে থাকে? উম! ভাবনার বিষয়। এখন একটা গরু পেলে জিজ্ঞেস করতাম। কিন্তু আফসোস! কক্সবাজারে আমি গরু কোথায় পাবো?”

ঘুমের ঘোরে এইসব অদ্ভুত চিন্তা আমার মাথায় সবসময়ই আসে। আমার দায়সারা অবস্থা দেখে মা আরো ক্ষেপে গিয়ে বললো,

—“এই! তোর কি কান দিয়ে কথা ঢুকছে না? সকাল থেকে এই পর্যন্ত না হলেও দু’শ বার ডেকেছি। গলা ব্যথা হয়ে গেল আমার।”

মা রেগে বললেও আমি ঘুমঘুম চোখে শান্ত গলায় বললাম,

—“উঠেছি তো। আর তোমাকে কে বলেছে আমাকে ডেকে ডেকে গলা ব্যথা করতে? তাছাড়া আমার মোটেও খিদে নেই। তোমরা যাও গিয়ে খেয়ে নাও।”

—“দেখ! উল্টো পাল্টা বলিস না। সকালে এখান থেকে কিছু খেয়ে নেয় কারন দুপুরের খাবার খেতে অনেক দেরি হতে পারে।”

ভাবলেশহীন ভাবে বললাম,

—“সমস্যা নেই। তোমরা গিয়ে খেয়ে আসো। ততক্ষণে আমি আরেকটু ঘুমিয়ে নেই।”

আবারও শোয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। কিন্তু তার আগেই চড় দেওয়ার ভঙ্গিতে ডান হাত উঁচিয়ে মা বলে উঠলো,

—“থাপ্পড় দিয়ে কানের বারোটা বাজিয়ে ফেলবো। বেয়াদব মেয়ে! এতো ঘুম কিসের তোর? সারারাত কি করেছিস?”

এটা সেটা গোছাতে ব্যস্ত ছিল মা কিন্তু আমার কাছ থেকে উত্তরের আশায় চুপ করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি বুঝতে পেরেও নিরবতা পালন করছি। মা আবার গোছানোর কাজে মন দিলো হয়ত বুঝতে পেরেছে আমার কাছ থেকে উত্তর পাবার কোনো সম্ভাবনা নেই। সোফায় রাখা আমার জামাগুলো ব্যাগে ভরে রাখতে রাখতে বললো,

—“তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে আয় খেতে যাবো। আর একবারও যেন বলতে না হয় আমায়।”

আমি কিছু না বলে ওয়াশরুমে চলে গেলাম ফ্রেশ হতে। সকাল থেকে এতো কথা শোনার পর হয়ত আমার রাগ করার দরকার ছিল। কিন্তু এই মূহুর্তে ঘুমটা আমার কাছে সবচেয়ে দামী মনে হচ্ছে। তাই আমার মাঝে বিন্দুমাত্র রাগের সৃষ্টি হলো না। তবে ঘুমাতে না পেরে বেশ বিরক্ত লাগছে। কালকে রাতে একটা মুভি দেখে তিনটা বেজে গিয়েছিল ঘুমোতে। তাইতো সকালে ঘুম থেকে উঠতে পারি নি। আর মা সেই সুযোগে আমায় কাপড় কাচার মতো বকে বকে কেচে দিয়েছে।

একটা হলুদ রঙের থ্রি পিস পড়ে কোনোরকম চুলগুলো বেঁধে একেবারে তৈরি হয়ে গেলাম। তারপর মা বাবার সাথে সকালের নাস্তা করতে একটা রেস্টুরেন্টে চলে এলাম। খাবারের কত-শত বাহার কিন্তু তেমন কিছুই খেতে ইচ্ছে করছে না। পরোটা আর ডাল নিলাম খেতে কিন্তু সেটাও এঁটো করে রেখে দিলাম। খাচ্ছি না বলে মা আরেক দফা বকা আমার এই সকালের নাস্তায় যোগ করলো। আর আমিও সেটা খেয়েই পেট ভরালাম।

‘সময়ের সমুদ্রে আছি, কিন্তু একমুহূর্ত সময় নেই’_____রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

যখন শুনেছিলাম চারদিন থাকবো তখন মনে মনে বলেছিলাম,

—“এতো দিন! তাহলে তো অনেক কিছু দেখতে আর জানতে পাবো।”

এখন চলে যাওয়ার সময় মনে হচ্ছে খুবই কম সময় ছিল সত্যিই কম সময়। কারন এই বিশাল সমুদ্রের সৌন্দর্য একবিন্দুও দেখা হয় নি আমার। হয়ত সারাজীবন দেখলেও শেষ হবে না। সমুদ্রের শব্দ দূর থেকেই কানে এসে পৌঁছায় আর ভিন্ন তালে চারপাশ মুখরিত করে তোলে। সূর্যাস্তের অপূর্ব সৌন্দর্য আমায় এতোটাই মুগ্ধ করেছে যে আমি সমুদ্রের প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম মুহূর্তেই। আর মনে মনে একটা অদ্ভুত ইচ্ছে জাগ্রত হয়েছিল। ইচ্ছেটা পূরণ হবে কি না জানি না? তবে ঐ সমুদ্রে তাকিয়ে আমি মনে মনে বলেছিলাম,

—“আমি তোমার প্রেমে পড়ে গেছি সমুদ্র। তাই জীবনসঙ্গী হিসেবে সমুদ্রকে চাই।”

এয়ারপোর্টে এসে অটোরিকশা থেকে নেমে দাঁড়ালাম। আমার চোখে এখনও ঘুমঘুম ভাব। মনে হচ্ছে রাস্তায়ই পড়ে পড়ে একটা ঘুম দিয়ে নেই। বাবা অটোরিকশার ভাড়া মিটিয়ে আমাদের বললো,

—“হুম! চলো ভিতরে।”

বাবার পিছু পিছু আমি আর মা হাঁটতে হাঁটতে এয়ারপোর্টের ভিতরে এসে দাঁড়ালাম। চেকিং চলছে তাই বাবা আর মা সেসবেই ব্যস্ত আর আমি একরাশ বিরক্তি নিয়ে চুপচাপ দাড়িয়ে আছি। এদিক সেদিক তাকিয়ে দেখতে লাগলাম। আচমকা কারো চোখের মায়ায় আমার বেহায়া চোখ আরো বেহায়া হয়ে গেল৷ অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম আমার চোখ যার চোখ দেখে বেহায়া হয়েছে তার দিকে।

—“ছেলেদের চোখ এতোটা সুন্দর হয়?”

নিজেকে জিজ্ঞেস করলাম আর উত্তরও পেয়ে গেলাম,

—“হ্যা হয়!”

হয় বলেই তো আমার চোখ উনার চোখে আটকে আছে। নিজের সুন্দর ঐ চোখ জোড়া উনি কালো ফ্রেমের চশমায় আবদ্ধ করে রেখেছেন। আবদ্ধ হয়েও কত সুন্দর লাগছে চোখ দুটো। কপালে পড়ে থাকা কালো চুলগুলো দেখে খুব করে ইচ্ছে করছে নিজ হাতে আলতো করে পিছনে ঠেলে দেই। পরনে লাল টি-শার্টের উপর ব্ল্যাক জ্যাকেট আর নীল রঙের জিন্স। পোশাকের কম্বিনেশনটা কতটা ঠিক জানি না। তবে উনাকে বেশ মানিয়েছে। হঠাৎ মার ডাকে আমি খানিকটা আঁতকে উঠলাম। মা ডেকে বললো,

—“চল! বসতে হবে কারন আমাদের ফ্লাইট আরো পরে।”

উনার থেকে চোখ সরালেও মাথায় এখনও উনার ভাবনাই চলছে। তাই ছোট্ট করে মাকে জবাব দিলাম,

—“হুম।”

আমি আর মা একপাশে এসে বসলাম। বাবা সব কিছু ঠিকঠাক মতো শেষ করে অন্যদিকে গিয়ে বসলো। কারন আমাদের এইদিকে চেয়ার ফাঁকা নেই। আমি এদিক সেদিক তাকিয়ে উনাকে খোঁজার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলাম। আমার চোখের ঘুম কিছু সময়ের জন্য হাওয়া হয়ে গিয়েছিল কিন্তু এখন বসে থাকতে থাকতে আবার ভীষণ ঘুম পাচ্ছে। চেয়ারে ঘুমানো কোনো ভাবেই সম্ভব না। কি করবো বুঝতে পারছি না? হঠাৎ মেকাপ পাগলী আমার বান্ধবী মিশুর কথা মনে পড়লো। মেকাপ এতোটাই পছন্দ করে যে ওর ব্যাগ চেক করলে কিছু না কিছু মেকাপের সরঞ্জাম পাওয়াই যায়। মিশু একদিন বলেছিল,

—“ঘুম পেলে সাজুগুজু করবি তাহলে দেখবি ঘুম চলে যাবে।”

সকাল সকাল মার বকা খেয়ে কোনো রকম তৈরি হয়েছিলাম বলে আমাকে পুরো ফকিন্নির মতো লাগছে। তাই ভাবলাম মিশুর ফর্মুলা ট্রাই করে দেখি। আশপাশে তাকিয়ে ওয়াশরুম খুঁজে ব্যর্থ হয়ে মাকে জিজ্ঞেস করলাম,

—“মা! ওয়াশরুমটা কোন দিকে?”

ডান দিকে দেখিয়ে মা বললো,

—“ঐদিকে।”

ব্যাগ নিয়ে উঠতে উঠতে বললাম,

—“ঠিক আছে। আমি একটু ওয়াশরুম থেকে আসছি।”

—“হুম যা।”

ওয়াশরুমে এসে আয়নার সামনে দাড়িয়ে কিছুক্ষন অহেতুক নিজের দিকে তাকিয়ে রইলাম। তারপর ছোট একটা নিঃশ্বাস ফেলে ব্যাগ থেকে কাজল বের করে দুই চোখ কাজলে ভরিয়ে দিলাম। লাল লিপস্টিক দিয়ে ঠোঁট রাঙিয়ে দিলাম। চুলগুলো বিনুনি করে বিনুনিটা বামদিকে সামনে এনে ঝুলিয়ে রাখলাম। সব কিছু কমপ্লিট করে আয়নাতে তাকিয়ে মুচকি হাসি দিয়ে বললাম,

—“হায়! নাজার না লাগে।”

ব্যাগের চেইন লাগাতে লাগতে হেঁটে আসছি তখন আবার উনাকে দেখতে পেলাম। প্রথম পলকে মনের ভুল ভেবেছিলাম পরে আবার ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম। আমার থেকে খানিকটা দূরে একটা চেয়ারে বসে বসে ফোন স্ক্রোল করছেন। উনাকে এক দেড় মিনিট পর্যবেক্ষণ করে মার পাশে এসে বসে রইলাম। কারন এতো এতো মানুষের সামনে উনার দিকে তাকিয়ে থাকাটা বড্ড বেমানান হবে।

সাজুগুজু করেও কোনো লাভ হলো না। ঘুমে জন্য তাকিয়ে থাকতে পারছি না দেখে মনে মনে মিশুকে খুব করে গালি দিতে লাগলাম,

—“পাজি মেয়ে! দেখা হোক একবার তোর সাথে তারপর এই আজগুবি ফর্মূলা বলার জন্য তোকে আমি পঁচা নালায় নিয়ে চুবাবো। হুহ।”

বিমানে উঠবে বলে সবাই লাইন ধরে দাঁড়িয়ে আছে। উনাকে দেখলাম একদম সামনেই দাঁড়িয়ে আছেন। আমি দূর থেকে উনাকেই শুধু দেখছি। জানি না কেন খুব করে ইচ্ছে করছে উনার ঠিক পিছনে গিয়ে দাঁড়াতে। এসব অদ্ভুত চিন্তায় একগাল হেসে মাথা নুইয়ে মনে মনে বলতে লাগলাম,

—“মনটা আজ এতো বেহায়া কেন হয়ে উঠলো অচেনা এই মানুষটার জন্য?”

বিমানে উঠে বসার জন্য সিট খুঁজে চলেছি। আমাদের সিট নাকি একদম পিছনে বাবা বলেছিল। মা বাবার পিছু পিছু আমি হাঁটছি আর এদিক সেদিক দেখছি। উনাকে দেখলাম একটু তফাতেই বসে আছেন। সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় চোখাচোখি হলো দুজনার। মুহূর্তেই মনে হলো উনার চোখ যেন কথা বলছে। কিন্তু তাড়াহুড়োর জন্য উনার চোখের ভাষা আমার বোধগম্য হলো না।

আমি আমার সিটে এসে বসলাম। উনার থেকে অনেকটা দূরে কোনাকুনি সিট পড়লো তাই পিছন থেকে উনার মাথা ছাড়া কিছুই দেখছি না। হতাশ হয়ে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে চেয়ারে হেলান দিলাম। চোখ বুঁজে মনকে শান্তনা দিতে লাগলাম,

—“এক তো অচেনা আবার তোর সাথে তোর মা বসে আছে। তাই অদ্ভুত চিন্তা করে কোনো লাভ হবে নারে কথামনি। এর চেয়ে ভালো হয় ঘুমিয়ে থাক কিছু সময়।”

ঘুমানো তো সম্ভব নয় তাই পুরো সময় চোখ বুঁজেই কাটিয়ে দিলাম। মাঝে মাঝে এক-দুবার মার ডাকে মার সাথে খানিকটা কথা বলেছি এই-যা!

ঢাকা এয়ারপোর্টের ভিতরে এসে দাঁড়িয়ে আছি। বাবা ছোটাছুটি করছেন লাগেজ আনতে আর গাড়ির ব্যবস্থা করতে। বিমান থেকে নেমে উনাকে এক ঝলক দেখার পর আর দেখিনি। মার সাথে দাড়িয়ে কথা বলছি আর একটু আধটু হাসছি। হঠাৎ কি ভেবে যেন হাসতে হাসতে বা’দিকে তাকালাম। আমার হাসি মাখা মুখ যেন কারোর মাঝে প্রশান্তির সৃষ্টি করছে। উনাকে দেখলাম মুগ্ধ হয় আমার দিকে তাকিয়ে হেঁটে চলে যাচ্ছেন। চোখে চোখ রেখে আমার মুখে হাসিটা বিরাজমান রইলো। কিন্তু চোখের পলকে উনি হেঁটে চলে গেলেন। চলে যেতেই মলিন মুখে মনে মনে বলতে লাগলাম,

“আঁড়চোখে চেয়ে চেয়ে
জানান দিলো কি সে মনের কথা?
নাকি অপরিচিতা মেয়ের নিরবতার
করলো সে ছোট্ট সমীক্ষা।”

আজ চার পাঁচ বছর হয়ে গেছে উনাকে যে দেখেছিলাম। উনার হয়ত মনে নেই আমায়, থাকার কথাও না। কিন্তু আমার প্রায়ই মনে হয় আর খুব করে মনে হয়। যখনই মনে হয় তখন মনে মনে বলি,

—“অচেনা ছিলে কিন্তু আমার মনে এখনও চেনা কেউ হয়ে আছো।”

কবিতা লিখতে পারি না তবুও বিশেষ কারোর জন্য ব্যর্থ চেষ্টা করে মনকে খানিকটা প্রশান্তি দেওয়া। মনের ডায়েরিতে উনাকে নিয়ে লেখা আমার ছোট্ট কবিতা,

“অবোধ্য সেই চোখের ভাষা
মন গহীনে আজও অজানা,
কিন্তু অল্প সেই মূহুর্তে
মনে হয় নি ছিলে অচেনা।”

__________ সমাপ্তি __________

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here