#ষড়রিপু,০৪,০৫
#প্রাপ্তমনস্কদের জন্য
চতুর্থ পর্ব
” ওহ্ মিয়া , বাচ্চাদের মত বিহেভিয়ার কোরোনা প্লিজ , ট্রাই টু আন্ডারস্ট্যান্ড সিচুয়েশন ,” মুঠোফোনটা কানে চেপে ওপ্রান্তকে বোঝানোর আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে রিক্ত , ” হেলথ কন্ডিশনটা না বিগড়ালে নিশ্চয়ই আসতাম আমি ,”
উত্তেজনা আবেগের বশবর্তীতে চওড়া পুরুষালী কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে ,
মেক্সিকো সিটিতে এই সময়ে বেশ ঠান্ডা পড়লেও ফায়ারপ্লেসের ছাইচাপা উত্তাপে ঘরটা যথেষ্ট কম ,
বাইরের ঝিরিঝিরি বৃষ্টিপতনের দিকে তাকিয়ে কপালের ঘামটা হাতের চেটোয় মুছে ফেললো রিক্ত , তারপর অত্যন্ত সতর্ক ভঙ্গিতে চাপাস্বরে ফিসফিসিয়ে বলে উঠল ” ফার্স্ট ডে শো মিস হয়েছে মানছি , কিন্তু গোটা ফেস্টিভ্যাল তো মিস হয়নি তাই না ? প্রমিস করলাম কাল আমি আসবোই ,”
ওপ্রান্ত সম্মতি দেওয়ার পর কলটা ডিসকানেক্ট করে দিলো রিক্ত , দিনের শেষে এই সময়টুকু তার একান্তই নিজের , আধঘণ্টা খানেক ধরে মিয়ার সাথে বার্তালাপ শেষে ঘুমোতে যায় সে ,
পরিচয় হওয়ার কিছুদিন পর থেকেই অলিখিত এই নিয়মের নড়চড় হয়নি এখনও ,
উপরন্তু রাত্রিটুকু ডরোথি একসাথে না থাকায় একরকমের সুবিধাই হয়েছে ওর ,
দিনভর সন্দেহপ্রবণতা আর গায়ে পড়া ভাবটা রিক্তকে অতিষ্ঠ করে তোলে তা বলাই বাহুল্য ,
সেই মতো ঘণ্টাখানেকের বিরতিতে নিজেকে বাঁধনহারা পাখির মত মনে করে রিক্ত ,
বিছানায় নিজের শরীরটাকে ফেলে দিয়ে ভাবনার অতলে ডুবে গেল রিক্ত , সত্যিই কতটা পার্থক্য মিয়া আর ডরোথির মধ্যে ,
বয়সের , শরীরের গঠন কাঠামোর ব্যবধানের সাথে সাথে একজন ঘোর সন্দেহবাতিক আর একজন নাছোড়বান্দা মেজাজের ,
“উফফ” বিরক্তিটা উগরে বেরিয়ে আসতে চাইলো রিক্তর , গতকাল কিকরে বার হবে সেই চিন্তাতেই বিভোর হয়ে আছে সে ,
দুইমুহূর্ত চিন্তা করে হ্যান্ডসেট থেকে আনসেভড নম্বরটা ডিলিট করে ফোনটা চার্জে বসিয়ে দিল ও , তারপর ঠান্ডা হয়ে যাওয়া পাদুটোকে গরম করতে কম্বলমুড়ি দিয়ে আয়েশ করে চেপে বসল বিছানাতে , দেওয়ালের একপ্রান্তে ঝোলানো বৃহদাকার গ্র্যান্ডক্লকটা জানান দিচ্ছে রাত্রি বারোটা বাজতে চলেছে প্রায় , বিশালাকার এই চৌহদ্দিতে রিক্তর প্রেমালাপের সাক্ষী এই ঘড়িটা আর ছড়ানো-ছিটানো কিছু আসবাবপত্র ,
অন্যদিন এই সময় ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসলেও আজ কিছুতেই ঘুম আসছেনা ওর , দিনব্যাপী খাটাখাটুনিতে পরিশ্রান্ত থাকলেও আজ যেন নিদ্রাদেবীরও সংকোচ বোধ হচ্ছে রিক্তর কাছে আসতে ,খানিকটা অস্বস্তিবোধ হওয়াতে খাট থেকে নেমে মেঝেতে গিয়ে দাঁড়াল রিক্ত ,
তারপর ফেলে রাখা জুতোটা গলিয়ে ঘরময় পায়চারি শুরু করল সে ,
দামি দামি আসবাবে ঠাসা ঘরের কারুকাজ দেখতে লাগল খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে , এই ওর একটা বদ অভ্যাস ।
সৌন্দর্যের প্রতি অকৃত্রিম টান …
সেটা প্রাকৃতিক হোক বা কৃত্রিম , মন ভরে উঠে সবেতেই , তার সাথে সাথে কলাকুশলীদের প্রতিও একধরনের মোহ জন্মে যায় রিক্তর ,
প্রতিপত্তি থাকার সুবাদে একসময় অগণিত নারী তার জীবনচক্রে আবর্তিত হলেও সময়ের ফেরে সে নিজেই এক রমণীর বেড়াজালে আবদ্ধ হয়ে গিয়েছিল ,
সহজাত সৌন্দর্যের অধিকারী দিয়ার কাব্যচর্চার প্রতি ‘ ঝোঁক ‘ ই হয়তো তাকে টেনে নিয়ে গেছিল চক্রব্যূহের কেন্দ্রবিন্দুতে ,
নামটা মনে পড়তেই চোরা বিরক্তিতে ভরে উঠলো মনটার আনাচ-কানাচ , অন্ধবিশ্বাসের ফলাফল হিসেবে স্বল্পপরিচিত একজন মানুষের কাছে নিজের নিঃশর্ত সমর্পণ এর মাশুল গুনছে এখনও , শিরায় শিরায় বয়ে নিয়ে বেড়ানো এইডসের মারণ জীবাণু দাপিয়ে বেড়াচ্ছে এখনও , মৃত্যু অবধি রেহাই নেই ,
দুনিয়ার সকল সম্পদ একত্রিত করে দিলেও হয়তো এর থেকে নিষ্কৃতি নেই ,
মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী ।
” দিয়া , দিয়া !” নামটা বারদুই উচ্চারণ করে রিক্ত , এই মেয়েটার জন্যেই সবটুকু হারাতে বসেছিল সে , কিন্তু এত বড় ঘটনা ঘটে যাবার পরেও মেয়ে মানুষের প্রতি জেগে থাকা কামনার আগুন কমাতে পারল কই !
“স্বভাব হয়তো মরলেও যায় না” এই আপ্তবাক্যটিই রিক্তর জীবন গাথার সুস্পষ্ট প্রমাণ যে ,
অতীতের বিষাক্ত স্মৃতি মানসপটে জীবন্ত থাকলেও ফের অন্য নারীর প্রতি মোহাবিষ্ট হয়েই পড়লো শেষমেশ ,
“মেক্সিকান সৌন্দর্যই হোক বা উঠতি চিত্রশিল্পী , আবার জড়িয়ে পড়লাম আমি ,” আপন মনেই বলে ওঠে রিক্ত , অন্যান্য শিল্পের মতো মেক্সিকোতে বডি পেইন্টিং এর চাহিদা তুঙ্গে ,
উঠতি চিত্রশিল্পী মিয়াও তেমনি একজন বডি পেইনটার , রিক্তর মতো উচ্চাকাঙ্ক্ষী এবং ভাগ্যান্বেষী ,
ক্যানভাস তথা মানব শরীরের উত্থান-পতনে রঙের সমারোহ ফোটাতে মিয়ার জুড়ি নেই , সেই মতো মেক্সিকোর পৃথিবীবিখ্যাত বডি আর্ট ফেস্টিভ্যালে সে একজন পার্টিসিপেট ।
এমন সময় দরজার ওপারে ভেসে আসা কারোর ফিসফিসানির শব্দ শুনে চমকে ওঠে রিক্ত ,
এতোক্ষনে তো ডরোথির ঘুমিয়ে পড়ার কথা ,
ডিনার সেরে গুডনাইট অভিবাদন জানিয়ে চলে গিয়েছে তাও প্রায় ঘণ্টাখানেক হতে চললো প্রায় ,
~” তবে কে ওখানে !” আপন মনেই বলে উঠল রিক্ত ,” বাড়ির চাকর বাকর ?”
বেশি না ভেবে চটপট নিজের বিছানায় ফিরে এসে কম্বলটা চাপিয়ে নিল গায়ের উপরে ,
এই রিয়েল এস্টেটটা বড্ডো রহস্যময় , তার সাথে নির্জনও বটে , প্রায় দেড় একর জমির উপর গাছ গাছালি পূর্ণ এই জায়গাটা দ্বীপের মতো খানিকটা ,
চারদিকে দীঘির গভীর জল আর মাঝখানে শক্ত পাথুরে প্রাচীরের মধ্যে গড়ে উঠেছে বাংলো প্যাটার্নের এই বাড়িটা ,
সংযোগস্থলের উপায় হল বাঁশের তৈরি একটা সাঁকো , দীঘির জলে লেপ্টে থাকা সেই সেতুবন্ধন নড়বড়ে দেখতে হলেও বেশ পোক্ত ,
বার কয়েক যাতায়াতের পর রিক্ত বুঝেছে বাঁশের সাথে লোহার গাঁথুনিও আছে ,
জনপদ থেকে বেশ খানিকটা দূরে এমন নির্জন জায়গায় বাসস্থানের কারণ না জানলেও রিক্ত মাথা ঘামায় নি কখনো , বিয়েটা হলে ধীরে ধীরে জানা যাবে সবকিছুই ,
কিন্তু আপাতনিরীহ এই বাংলো বাড়ির অন্তরালে যে জমাটবাঁধা এক রহস্য লুকিয়ে আছে, তা অবচেতন মন জানান দেয় মাঝেসাঝেই ,
এমন সময় বন্ধ হয়ে যাওয়া ফিসফিসানি আওয়াজটা ক্রমশ তীব্রতর হতে শুরু করলে কৌতুহল দমাতে না পেরে বিছানা থেকে নেমে জুতোটা গলিয়ে নিলো রিক্ত ,
তারপর অতি সন্তর্পনে পায়ে পায়ে এগিয়ে গিয়ে বন্ধ কাঠের আগলে কান ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো চুপচাপ , দরজার ওপাশ থেকে ভেসে আসা সেই শব্দই জানান দিচ্ছে একাধিক মানুষ উপস্থিত রয়েছে সেখানে ,
” এত রাত্রে চাকর বাকর কি করছে!” ভ্রুদুটো কুঁচকে বলে উঠলো রিক্ত ,
~” দুটো পেটি কম কেন ! নিজেরা ঝেঁপে দিয়েছিস তাই না !” রাগত স্বরে হিসহিসিয়ে বলে ওঠা শব্দসমষ্টি রিক্তর কর্ণপটহ ছুয়ে গেল ,
সঙ্গে সঙ্গে ভেসে আসা গলাটা চিনতে পেরে প্রবল ভাবে চমকে উঠল রিক্ত ,
এ যে ডরোথির গলা !
” এত রাত্রে কার সাথে কথা বলছ ও !” আপন মনেই বলে উঠল রিক্ত ,
জানার দুর্দমনীয় কৌতূহল বজায় থাকলেও দরজার পাল্লা ফাঁকা করার সুযোগ নেই একেবারেই ,
বাড়ির মালকিন তথা হবু স্ত্রী এর নির্দেশ আছে , রাত্রি এগারোটার পর ঘরের বাইরে কেউ যেন বার না হয় । সেই মতো বেডরুমের সাথে এটাচ বাথরুমেরও বন্দোবস্ত আছে ,
এক অলিখিত নিয়মে রাত এগারোটা থেকে ভোররাত অবধি এই বাড়িতে বিরাজ করে শ্মশানের করাল নিস্তব্ধতা ,
” কার পেটি , কিসের পেটি !” ফিসফিসিয়ে কথাগুলো বলে উঠতেই মস্তবড় জিভ কেটে দাঁড়িয়ে পড়ে রিক্ত ,
নিস্তব্ধতায় অমোঘ ছোঁয়ায় মৃদু সেই শব্দধ্বনিই জোরালো হয়ে উঠেছে ভীষণভাবে , অন্ততপক্ষে একজন মানুষের কানে পৌঁছে যাবার জন্য যথেষ্ট ,
নিজের ভুলটা বুঝতে পেরে বিছানার দিকে বিড়ালপায়ে এগোতে থাকে রিক্ত , কিন্তু শেষ রক্ষা হয় না ।
বলিষ্ঠ হাতের ধাক্কায় দরজাটা খুলে যায় ধড়াম করে , আগলের ওপারে দাড়িয়ে থাকা মধ্যবয়স্কা ডরোথিকে দেখে বুকটা ছ্যাৎ করে ওঠে ভয়ে ,
কি নিষ্ঠুর দৃষ্টির পরত মেলে রেখেছেন বাদামী রঙের চোখদুটো থেকে ,
সাথে দাঁড়িয়ে থাকা গাট্টা গোট্টা চেহারা দুজন রেড ইন্ডিয়ানকে দেখে ভ্রু কুঁচকে যায় রিক্তর ।
” তোমাকে বলেছিলাম না ঘুমিয়ে পড়তে !” দাঁতে দাঁত ঘষে বলে ওঠে ডরোথি ,” এত রাত্রে জেগে কি করছো তুমি ?”
‘ এমন ব্যবহার করছ , যেন আমি তোমার পোষা কুকুর । তোমার কথা মতো মিলনে রাজী হতে হবে , ঘুমোতে হবে , জাগতে হবে , অসহ্যকর !” মাতৃভাষায় বিড়বিড়িয়ে বলে ওঠে রিক্ত ,
” কি হলো জবাব দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করছোনা যে ! ফিসফিসিয়ে কি বলে চলেছ তুমি ,” তীক্ষ্ণ কন্ঠির চিৎকার আছড়ে পরে এবার ,
” এত রাত্রে তুমি কেন জেগে ?”
” এই প্রশ্নটা তো আমার তোমাকে করা উচিত ডরোথি , এত রাত্রে দুজন অচেনা পুরুষের সাথে তুমি কেন জেগে আছো !” অবাধ্য প্রশ্নটা জিভের আগায় চলে এলেও আত্মসংবরণ করতে বাধ্য হলো রিক্ত ,
দেখাই যাক না ব্যাপারটা কি …
নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করতে করতে মুখে কপট হাসি ফুটিয়ে উঠে বলে উঠলো ,
” ঘুম আসতে চাইছিলো না , তোমার কথা খুব মনে পড়ছিল ,” তোতলাতে তোতলাতে মিথ্যেটুকু সম্বল করে কোনমতে জবাব দিল সে ,” একলা ঘরে ….”
” বিয়েটা হওয়ার পর অবশ্যই একাকীত্ববোধ ঘুচে যাবে তোমার ,” মুখের কাঠিন্য বিন্দুমাত্র পরিবর্তন না করে কথার মাঝেই বলে উঠল ডরোথি ,
” নাউ স্লীপ , কুইক !” তারপর রিক্তর জবাবের অপেক্ষা না করেই মুখের উপর দরজাটা বন্ধ করে দিল সজোরে ,
বাইরে থেকে লকড হওয়ার শব্দ স্পষ্ট শুনতে পেল রিক্ত ,
সেদিকে তাকিয়ে ওর সারা গা রাগে বিতৃষ্ণায় চিড়বিড়িয়ে উঠল ,
“ব্লাডি ক্রাপ ! এমন বিহেভিয়ার করছে যেন আমি ওর ফিয়ানসে নই , পয়সা দিয়ে কেনা ভৃত্য !”
চোয়ালটা শক্ত হয়ে গেলেও রাগের পারদ চড়তে দিলনা রিক্ত ,
এই সময় মাথা গরম করার অর্থ নিছক বোকামি ছাড়া আর কিছুই নয় ,
অন্তত আজকের পর ভালোমতোই বুঝে গিয়েছে ডরোথি কোনো স্বাভাবিক সাধাসিধা নারীর প্রতীক নয় , প্রচন্ড ধুরন্ধর এবং সুচতুরও বটে ,
এবং অবশ্যই কোন না কোন অবৈধ চক্রান্তে সরাসরি লিপ্ত ,
” রতনে রতন চেনে ” প্রবাদ বাক্যটি আপনমনেই বলে উঠল রিক্ত , নিজেও একসময় অবৈধ নারী পাচারের কাজে যুক্ত ছিল প্রত্যক্ষভাবে ,
সেই মতো সমাজের বিভিন্ন স্তরে বহু মানুষের সাথে ঘাটাঘাটি করার অভিজ্ঞতাও আছে যথেষ্ট ।
ডরোথির সাথে মিলনকালে পর্যাপ্ত পরিমাণে শরীরসুখ না পেলেও আজ এই মুহূর্তে কেমন একটা সৌহার্দ অনুভব করল রিক্ত ,
মনে হচ্ছে দুজনেই যেন একই গমনপথের সঙ্গী ,
আজন্মের সাথী ,
চিন্তার রেখাটা কপালে জিইয়ে রেখে কাঁচের শার্শির কাছে এসে দাড়ালো রিক্ত ,
ঝিরিঝিরি বৃষ্টি থেমে গিয়েছে ততক্ষণে , পূর্ণিমার সুগোল চাঁদ জেগে উঠেছে মেঘের পাতলা আবরণকে তুড়ি মেরে ,
ধবধবে জ্যোৎস্নায় খালি চোখে বহুদূর দেখা যাচ্ছে স্পষ্ট ভাবে ,
সেদিকে তাকিয়ে প্রকৃতির সৌন্দর্য সুধা পান করতে করতে প্রবলভাবে চমকে উঠল রিক্ত ,
বাঁশের সাঁকোর শেষ প্রান্তে হুডির আবরণে আবৃত একটা নারী অবয়ব মুখ ফিরিয়ে দাঁড়িয়ে আছে এদিকেই । আলো-আঁধারিতে মুখমন্ডল স্পষ্টভাবে বোঝা না গেলেও সেটা যে একটা মেয়েই ,
সে ব্যাপারে সন্দেহ নেই ।
টুপির আবরণ ছাপিয়ে লম্বা চুলগুলো দমকা বাতাসে উড়ছে , ওভারকোটের দুই পকেটে হাতদুটো রেখে পা’টা অল্প ফাঁক করে তাকিয়ে আছে রিয়েল এস্টেটের দিকে ,
যেন স্থির , নির্জীব কোন নিষ্প্রাণ বস্তু ।
~” কিন্তু এত রাতে কে ওখানে !” কপালে গাঢ় চিন্তার প্রলেপ ফেলে আপন মনেই বলে উঠল রিক্ত , মিনিটখানেক সেইভাবেই থাকার পর অবয়বটা পা ফেলে চলে গেল বাঁশের সাঁকো পেরিয়ে মূল ভূখণ্ডের দিকে , ঝোপঝাড়ের আড়ালে চেহারাটা মিলিয়ে যেতেই চিন্তিত মুখে বিছানায় ফিরে এলো রিক্ত ,
কিছুই যে মাথায় ঢুকছেনা ওর ,
প্রথমে ডরোথি তারপর এই অজানা মেয়েটা …
দুইয়ের মেলবন্ধনে মাথাটা কতক্ষণে তালগোল পাকিয়ে গিয়েছে তা বলাই বাহুল্য ,
” ধুত ! যা হবে কাল দেখা যাবে , ” বেড সাইডে রাখা টেবিল ল্যাম্পটা বন্ধ করে দিল রিক্ত ,
তারপর আজগুবি ভাবনা ভাবতে ভাবতে তলিয়ে গেলো ঘুমের অতলে ,
ক্রমশ
#ষড়রিপু ( পঞ্চম পর্ব )
#প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য
ভি’নেক বডিকন ড্রেসটার ফাঁকফোঁকর দিয়ে ডরথির দুধসাদা যৌবনটা নির্লজ্জভাবে উঁকি দিচ্ছে ,
স্লিভলেস চেরিরেড গাউনটা আষ্টেপৃষ্ঠে চেপে বসার জন্য থলথলে দুই বাহু বড্ড দৃষ্টিকটু দেখাচ্ছে ,
মোটাসোটা শরীরের চর্বি পরতের দিকে একবার তাকিয়ে ঝট করে মুখটা অন্যদিকে ফিরিয়ে নিল রিক্ত ,
বড্ড অস্বস্তি হচ্ছে ডরোথিকে এই পোশাকে দিনের আলোতে দেখে ,
মিলনকালে কামত্তজনায় বশবর্তী হয়ে তালতাল চর্বিস্তর গুলো অতটাও খুঁটিয়ে দেখা হয়নি ,
কিন্তু স্বচ্ছ দিবালোকে এতটা খোলামেলা পোশাকে এতটা কাছ থেকে দেখে অদ্ভুত বিবমিষা মিশ্রিত
অনুভুতিতে ছেয়ে গেল ওর মনটা ,
রিক্তকে ইমপ্রেস করার জন্য গাউনটা চাপালেও ওকে মানাচ্ছেনা মোটেই ,
বরং পিঠ পেটের চর্বিগুলো ফুটে উঠেছে বড় বিশ্রীভাবে ,
সেদিক থেকে চোখ ফিরিয়ে আপন মনেই বলে উঠল রিক্ত ,” নিজেকে আয়নায় দেখেনা নাকি !
পোশাকের সাথে বয়স , ব্যক্তিত্বের কোন সাযুজ্যতাই নেই , সালা কচি সাজার সখ জেগেছে !”
বলাই বাহুল্য ফিটনেস সচেতন রিক্ত বসু জীবন সঙ্গিনী হিসেবে এমন থলথলে চেহারা পছন্দ করে না মোটেই ,
“কাকের শরীরে ময়ূরের পালক গুঁজে রেখেছে যেনো !”
” কি এত ভাবছো ,” রিক্তকে আনমনা দেখে প্রশ্ন করে ওঠে ডরোথি , তারপর মাখন লাগানো ব্রেডটা এগিয়ে দেয় ওর দিকে ,” আমাকে কেমন লাগছে বললেনা তো ,”
” ভালো , খুব ভালো ,” কপট হাসি মুখে ফুটিয়ে বলে ওঠে রিক্ত , তারপর এগিয়ে রাখা টোস্টটা হাতের ফাঁকে নিয়ে নিল , ডরোথি বোধহয় চাইছিল নিজের হাতে খাইয়ে দিতে ওকে , কিন্তু সেই প্রচেষ্টা সফল না হওয়ায় খানিকটা অবাক হয়ে গেল ও , দৃষ্টিটা পড়তে বিন্দুমাত্র ভুল করল না রিক্ত , খানিকটা এগিয়ে গিয়ে নিজের নাকটা ডরোথির গালে ঘষে বলে উঠলো ,” দুর্ধর্ষ লাগছে তোমাকে ,”
” সত্যি ! ” বাচ্চা মেয়ের মতো খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো ও , হাসি মুখের দিকে তাকিয়ে খানিকটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল রিক্ত ,
অন্যান্য নারীদের মতো ডরোথিকেও কপট প্রশংসা বাক্যে সন্তুষ্ট করে ফেলা যায় সহজেই ,
কিন্তু , এই মানুষটার সাথে পা ফেলতে হয় বড্ডো মেপেযুপে , খানিকটা চ্যুতি ঘটলেই পাখি উড়ে যাবে টুক করে ,
তাই বিয়ে অব্ধি ডরোথির কাছে নিজেকে নিঃশর্ত সমর্পনে থাকার সিদ্ধান্ত বহাল রাখল রিক্ত ,
গতরাত্রে ওরকম ব্যবহারের কারনটা জানতে প্রচন্ডভাবে ইচ্ছা হলেও নিজেকে শান্ত করে রাখাটাই হয়ত অধিক সমীচীন ,
এই বিয়েটা করা ওর জীবনের অন্যতম সঠিক সিদ্ধান্ত সেটা নিয়ে দ্বিমত নেই ,
অপার ধন-সম্পদের মালিক হওয়ার সাথে সাথে
দেশে ফিরে প্রতিশোধ স্পৃহা পূরণ করতে পারবে প্ল্যানমাফিক ,
সামান্য ত্রুটি বিচ্যুতি হলে নিজের লক্ষ্য পূরণ থেকে সরে যেতে পারে রিক্ত , তা ভালো মতই জানে , সেইমতো গতরাত্রে দেখা হুডি পরিহিত মেয়ের কথাটাও ডরোথির কাছে চেপে গেল রিক্ত ,
” ড্রেসটা কবে কিনলে ?” পরিস্থিতি আরেকটু স্বাভাবিক করার জন্য ডরোথির হাত থেকে খাবারটা মুখে পুরে বলে উঠলো রিক্ত , ” দারুন মানাচ্ছে ,”
দিন কয়েক এক ছাদের তলায় থাকার সুবাদে এই মানুষটিকে চিনে ফেলেছে বেশ খানিকটা ,
সোজা ভাষায় মিডল-এজ ক্রাইসিসে ভোগা এক মধ্যবয়সী নারী , যার শারীরিক সৌন্দর্য পড়তির দিকে হলেও মিলন সুখের চাহিদার খামতি পড়েনি মোটেই ,
সাথে মানসিক সাহচর্য চাওয়া একাকিনী নিপাট মধ্যবয়স্কা মহিলা ,
যার মধ্যে হরমোনাল জটিলতার কারণে অস্থিরচিত্ততা , মুড সুইং , রাফ টাফ বিহেভিয়ার খুবই কমন ,
অ্যাংজাইটির সাথে সাথে নিরাপত্তাহীনতাও থাকে যথেষ্ট পরিমাণে , এই কারণেই যে নিম্নস্তরের একজন মানুষকে জীবনসঙ্গী করার ইচ্ছা পোষণ করেছে তা ভালোমতোই বুঝে গিয়েছে রিক্ত ,
যার কাছে নিজের জোর খাটাতে পারবে সহজেই ,
আবেগের সাথে সাথে স্বার্থ পূরণের সূক্ষ্ম চিন্তাও যে জুড়ে আছে তা বলাই বাহুল্য ,
আপাত সহজ-সরল , ভাগ্যান্বেষী এক যুবককে জীবনসঙ্গী হিসেবে নির্বাচন করার সিদ্ধান্ত নিয়ে হয়ত কোনো ভুল করেনি ডরোথি , কিন্তু কারণটা যে ধরা দিচ্ছে না কিছুতেই !
অনুমান ক্ষমতা সহজাত হলেও তার সীমাবদ্ধতাও আছে বৈকি ,
সুতরাং বিয়ে অবধি অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই ,
” ডরোথি ” নরম স্বরে ডেকে উঠল রিক্ত ,” আমরা কবে বিয়ে করছি ?”
” কেন ? খুব তাড়া দেখছি তোমার ,” অদ্ভুত ভঙ্গিতে মুখটা নাচিয়ে বলে উঠলো ও , ” তর সইছে না যে আমাকে নিজের করে পাওয়ার !”
” তোমাকে পাওয়া মাই ফুট !” আপন-মনে বলে উঠলো রিক্ত , তারপর স্বভাবজাত কুটিল হাসিটা মুখে ঝুলিয়ে রেখে বলে উঠলো ,” একদমই তাই , তর সইছে না আমার ,” দু মুহূর্ত থেমে ফের বলে উঠলো ,” এই উইকেন্ডেই সেরে ফেলি ? যত দেরি করবো ততই…..”
ওর উৎসাহ দেখে ভ্রূর মাঝে সন্দেহ দানা বাঁধলেও বুঝতে দিলনা ডরোথি , এই মানুষটিকে তার বিশেষ প্রয়োজন ,
শারীরিক স্যাটিসফ্যাকশনের সাথে সাথে মানসিক বন্ধনেও জড়িয়ে গিয়েছে যে ,
” হাজার খারাপ বিহেভিয়ার করলেও মুখ ফুটে কোনদিন একটা জবাব বা বিরক্তি প্রকাশ করে ওঠেনি লোকটা , ” আপন মনেই বলে উঠে সে
” এরকম একটা ধৈর্যশীল মানুষই আমার প্রয়োজন
তাই বিয়ে বিষয়টা বড্ড তাড়াতাড়ি সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলেও মুখের উপর না বলতে পারল না সে ,
নিজের কাজকর্মের দায়িত্বভার দেওয়ার জন্য বিশ্বস্ত একজন সঙ্গীর সাথে সাথে আইনি সীলমোহর থাকাও একান্ত প্রয়োজন যে ,
” উচ্চাকাঙ্ক্ষী পেটানোর চেহারার মানুষটি হয়তো আমার হাজবেন্ডের অবর্তমানে ব্যবসাপাতি তথা আমার দায়িত্ব সঠিকভাবে সামলাতে পারবে , ” আপন মনে বলে উঠল সে , তারপর হাসি মুখে জবাব দিল ” তাহলে হাতে আর মাত্র একদিন , আর তোমাকে বলে রাখছি কোনরকম আড়ম্বর অনুষ্ঠান আয়োজন করবো না আমি ,
বয়সটা বড়ো ফ্যাক্টর ,সেইমত
সিম্পল রেজিস্ট্রি ম্যারেজের মাধ্যমে বিয়েটা করবো , তুমি রাজি তো !”
রিক্তর মনে তখন খুশির শত রোশনাই জ্বলে উঠেছে , আইন অনুসারে এদেশীয় মেয়েকে বিয়ে করলে গ্রীনকার্ড ওর হাতের মুঠোয় চলে আসবে ,
সেই মতো পার্মানেন্ট রেসিডেন্সি পেতেও বিশেষ অসুবিধা হবেনা ,
তখন ইন্ডিয়ান পুলিশ ডিপার্টমেন্ট কোন ভাবে তার লোকেশন ট্রেস করতে পারলেও বেশি কিছু স্টেপ নিতে পারবে না , কারণ রিক্ত তখন মেক্সিকোর ইমিগ্র্যান্ট রূপে স্থায়ী বসবাস করবে এই এস্টেটে ,
” দেশান্তরী দাগি আসামি দিন কয়েক পরেই পাকাপাকিভাবে মেক্সিকোতে ঘাঁটি গাড়তে চলেছে তবে !” মনের মধ্যে বয়ে চলা খুশির চোরাস্রোতটা মনের মধ্যে চাপা রেখে আপন মনে বলে উঠল রিক্ত ,
স্বপ্নপূরণের একটা কলি ফুটল অবশেষে ,
তারপর ডরোথির কপালে একটা চুম্বন এঁকে বলে উঠলো ” তোমার মত একজনকে জীবন সঙ্গিনী হিসেবে পেয়ে আমি গর্বিত , রাজি না হয়ে উপায় আছে কি !” ছলকপটতা ভরা কথাগুলো ঠিক ধরতে না পেরে লাজুক হেসে মুখটা ভরিয়ে রাখল
ডরোথি ,
সেদিকে দুই মুহূর্ত তাকিয়ে পূর্বনির্ধারিত প্রস্তাবটা রেখেই ফেলল রিক্ত ,” আজ আমাকে বেরোতে হবে , ড্রাইভিং সংক্রান্ত কিছু ফর্মালিটিস বাকি আছে , তুমি লাঞ্চ সেরে নিও , অপেক্ষা করো না ফিরতে দেরী হবে আমার ,”
” কতক্ষণ !” নিমেষেই হাসিমুখটা বদলে গিয়ে গম্ভীর স্বরে বলে উঠলো ডরোথি ,” প্রস্তাবটা যে একেবারেই পছন্দ হয়নি ওর , সেটা মুখের অভিব্যক্তিতে বোঝা যাচ্ছিল বেশ ,”
” রাত হয়ে যাবে ফিরতে , তুমি চিন্তা করোনা , আমি তোমাকে জানিয়ে দেবো ,” পাশে ফেলে রাখা ন্যাপকিনে হাতটা মুছতে মুছতে বলে উঠল রিক্ত ,
কালকের মত একই ভুল রিপিট করল না ও ,
এই মহিলার সামনে মিউ মিউ করে অনুরোধ ভঙ্গিতে কথা বললে বিন্দুমাত্র কাজে দেবে না ,
প্রখর বুদ্ধির জোরে রিক্ত বুঝে গিয়েছে ততক্ষণে ।ব্যক্তিত্বে কঠোরতাবোধ এলে ডরোথি নিমরাজি হতে বাধ্য ,
তাই খানিকটা কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলার পদ্ধতি অবলম্বন করল ও , অভিজ্ঞতায় ততক্ষনে ধরা পড়ে গিয়েছে মহিলা বিশ্বাস করতে শুরু করেছে ওকে , সেইমতো প্লান মাফিক বিশ্বাস জিতে নেওয়ার পর নিজের পরবর্তী পদক্ষেপ স্থির করে নিল রিক্ত ,
“তাড়াতাড়ি চলে এসো , চিন্তিত মুখে বলে উঠতেই ডরোথির পার্সোনাল হ্যান্ডসেট টা বেজে উঠল সশব্দে ,
ডিজিটাল অক্ষরে ফুটে ওঠা নাম্বারটা দেখেই চোখ মুখের ভাব সম্পূর্ণ বদলে গেল ওর , দ্রুত হাতে রিসিভ করে ফোনটা কানে চেপে ঘরের অন্য প্রান্তে চলে গেল সে ,
মনের অদম্য কৌতুহল টা চাপতে না পেরে রিক্তও
গেল পিছু পিছু ,
” কাল দুটো পেটি কম ছিল , আর আজ খুন হয়েছে , আমাকে বোকা পেয়েছিস তোরা ! একবার খোঁজ পাই কে বেইমানি করছে তারপর হারামের টাকার গরম করে ওর পিছনে গুঁজে দেবো , বাবাগো বলার সময় পাবে না !”
বাদ বাকিটুকু কথার শোনার সাহস রাখলো না রিক্ত ,
ওর আড়িপাতা স্বভাবটা ডরোথির কাছে গত রাত্রে ধরা পড়ে গিয়েছে , ফের একই জিনিস রিপিট হলে কি হতে চলেছে তা সহজেই অনুমেয় ,
দেড় একর এর প্রপার্টিতে ওকে মেরে পুঁতে দিলেও কারোর বোঝার সাধ্য থাকবে না ,
আর এই বিদেশ-বিভুঁইয়ে নিরস্ত্র অসহায় ভাবে প্রাণ হারানোর কোনো মানেই হয়না ,
ডরথির বিপরীতে ওর লোকবল শূন্য আর পয়সা কড়ি নেই বললেই চলে ,
সেইমত বিড়াল পায়ে ডাইনিং টেবিলে ফিরে এসে
এঁটো কাঁটা চামচ গুলো প্লেটের উপর রাখতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল রিক্ত , কানটা ঘরের অন্য প্রান্তে দিয়ে রাখলে দূরত্বের জন্য স্পষ্টভাবে শোনা যাচ্ছে না কিছুই ,
” হাই !” মিনিট খানেক পরেই গম্ভীর মুখে ফিরে আসলো ডরোথি ,” তুমি চাইলে আমার গাড়িটা নিয়ে বেরোতে পারো !”
” নানা , অভ্যাস আছে আমার ,” কথার মাঝপথেই বলে উঠল রিক্ত , যাক ওষুধের কাজ হয়েছে তবে !
তারপর দেওয়ালে ঝোলানো ডরোথির ফ্যামিলি ফটোগ্রাফ এর দিকে তাকিয়ে মনের মধ্যে জেগে থাকা অজস্র প্রশ্নসমূহ নিয়ে পা বাড়ালো বাইরের দিকে ,