#ষড়রিপু,১৬,১৭
#কঠোরভাবে প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য
ষষ্ঠদশ পর্ব
এক চিলতে স্যাঁতস্যাঁতে ঘরের তক্তপোশে দীর্ঘদেহী পুরুষালী অবয়বটা একমনে নিজের মুঠোফোনে ব্যস্ত। ঘুপচি চৌহদ্দি পেরিয়ে কাঁটাচামচের টুংটাং আওয়াজ ভেসে আসছে এই ঘরে। একঘেয়ে সেই শব্দের রেশ কাটাতে সন্তর্পনে ঘরের অন্য প্রান্তে চলে এলো রিক্ত। ক্যানভাস, আর্ট পেপার, রং তুলি আর রদ্দি ছাপমার্কা আসবাবের মেলবন্ধনে হাঁটাচলার রাস্তা খুবই কম।
ছোট্ট শার্শি পেরিয়ে রোদও ঢোকে যৎসামান্য।
তাই রোদ বাতাসের অভাবে একটা ভ্যাপসা গন্ধ ছড়িয়ে রয়েছে চারপাশে।
“উফফ, এই ঘরে মানুষজন থাকতে পারে! মিয়া কিভাবে মাসের পর মাস এই ঘরে কাটাচ্ছে কে জানে!” বিরক্তি উগরে আসলো রিক্তর কণ্ঠস্বর বেয়ে। খানিকটা এগিয়ে যেতেই রঙচটা দেওয়ালের সাথে সেঁটে থাকা ছোট আয়নাটার দিকে চোখ গেল রিক্তর। বিবর্ণ সেই দর্পণে নিজেকে দেখতে দেখতে পকেট থেকে ছোটো কাঠের চিরুনিটা বার করলো ও।
কুঁচকে যাওয়া ভ্রূ দুটো মনের অসন্তুষ্টতার স্পষ্ট চিহ্ন বহন করছে। কয়েক মুহূর্ত আগে চিত্রটা অবশ্য এরকম ছিল না। কয়েক সপ্তাহ বাদে মিয়ার রেন্টেড ফ্ল্যাটে আসার আনন্দে বিভোর হয়ে উঠেছিল ও। কিন্তু কিছুক্ষণ আগেই নিজের গার্লফ্রেন্ডের ব্যবহারটা বড় অদ্ভুত লাগল ওর।
খানিকটা যেন এড়িয়ে যেতে চাইছে মিয়া রিক্তকে।
“তবে কি পেটে বাচ্চা আসার কারণেই মিয়া আমার সাথে মিলনে অনীহা প্রকাশ করল?” আপনমনেই বলে উঠলো রিক্ত, “কিন্তু প্রেগনেন্সি পিরিওড চললেও তো মিনিমাম কিসটুকু তো করাই যায়!”
“5 মিনিট অপেক্ষা করো, তাড়াতাড়ি হাত চালাচ্ছি আমি।” বাইরের কিচেন থেকে জোর গলায় হাঁক ছেড়ে বলল মিয়া।
আরো পাঁচ মিনিট! অপেক্ষার অবসান হচ্ছেনা যেন…
যে ঘরে একসময় রাতের পর রাত কাটিয়েছে, সেই ঘরেই আজ রীতিমত দমবন্ধ লাগছে রিক্তর। দিনের-পর-দিন ডরোথির রিয়েল এস্টেটে অর্থ সম্পদের প্রাচুর্য্যে কাটানোর দরুন অতিচেনা এই ঘরে একমুহূর্তও থাকতে মন চাইছে না ওর।
কিন্তু যুবতী নারীমাংসের আকর্ষণ কাটানো কী অতই সহজ!
তাই একপ্রকার বাধ্য হয়ে নড়বড়ে তক্তপোশের কোণে বসে পড়ে রিক্ত।
” নতুন কোট টাই, স্যুটেড-বুটেড… এক্কেবারে পারফেক্ট জেন্টলম্যান যে।”হাতে রাখা খাবারের প্লেটটা সামলাতে সামলাতে বলে উঠলো মিয়া।
এনামেলের সস্তা প্লেটে গোটা দুই সসেজ, আর মাখন লাগানো ব্রাউন ব্রেড উঁকি মারছে।
“খেয়ে নাও,” মুখটা অন্যদিকে ফিরিয়ে মিয়া প্লেটটা তুলে দিলো রিক্তর হাতে।
“আরে এসবের আবার কি দরকার ছিল,” টিপিক্যাল বাঙালি ছেলের মত কথাটা মুখ ফস্কে বেরিয়ে আসতে চাইলেও চুপ হয়ে গেল রিক্ত।
ভরা প্লেট থেকে একটা সসেজ মুখে দিয়ে চিবোতে চিবোতে বলে উঠলো,”আমি আসার আগে একটা ছেলে এসেছিল, তাই না?”
“হুম, ” সংক্ষেপে জবাব দিয়ে মিয়া আরেকটু দূরত্বে সরে গেলো।
“কে উনি?” নেহাতই কৌতূহলবশে রিক্ত প্রশ্ন করল।
“আমার দাদা,” নিজের ভাগের সসেজটা মুখে পুরে বলে উঠলো মিয়া,” কেন বলতো?”
“আগে কোনদিন দেখিনি ,তাই আরকি…
হঠাৎ আজ মেক্সিকো সিটিতে?” কৌতুহল চাপতে না পেরে প্রশ্ন করে উঠলো রিক্ত।
“মিয়া আমাদের ব্যাপারে ওর দাদাকে কিছু বলেছে নাকি! নাকি ওর দাদা জেনে গেছে মিয়া প্রেগনেন্ট, আর আমি ওকে বিয়ে করতে চাইছিনা..” ভাবনার আঁকিবুকি টা মাথার উপর চেপে বসতে শিরদাঁড়া বেয়ে একটা ঠান্ডা শীতল স্রোত নেমে গেল রিক্তর। প্রায় ছয় ফুট দুই ইঞ্চি লম্বা বলিষ্ঠ পেটানো চেহারার সেই পুরুষ মানুষটা তার চোখের সামনে ভেসে উঠতেই কেমন একটা ভয় ধরে গেলো ওর।
“মিয়া,” কোনমতে সাহস সঞ্চয় করে প্রশ্ন করে উঠলো রিক্ত
“দাদা এ ব্যাপারে কিছুই জানে না, অত টেনশন নেওয়ার কারণ নেই কোনো।” রিক্তর চোখে চোখ রেখে বলল মিয়া।
সেই চাহনিতে অন্তরাত্মাটা কেমন কুঁকড়ে গেলো রিক্তর। বিবেকের ঝাপটায় দিশেহারা হতে চাইল ওর কঠিন কুটিল মনটা।
“জানানোর প্রয়োজন মনে করিনি, কারণ বাচ্চাটাকে আমি অাবর্ট করে ফেলেছি ।” কণ্ঠস্বরের কাঠিন্য বিন্দুমাত্র কমেনি মিয়ার তরফ থেকে।
“হোয়াট!” ঘটনার আকস্মিকতায় তক্তপোশের প্রান্তে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো রিক্ত। হাতে ফেলে রাখা সসেজটা ফসকে গিয়ে পড়ল মেঝেতে।
“তুমি যে বলেছিলে বাচ্চাটাকে অ্যাবর্ট করবে না! তাহলে হঠাৎ এরকম সিদ্ধান্তের কারণ?”
“বাচ্চা অ্যাবর্ট করি, বা রাখি…তোমার কি তাতে কোনো প্রভাব পড়বে রিক্ত? জীবনটা তো বেশ মসৃণ গতিতে চলছে তোমার, তবে এত প্রশ্ন করে লাভ কি? মেঝেতে পড়ে থাকা খাবারের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো মিয়া।
“নাথিং , সত্যিই আমার কোন কিছু যায় আসে না,”
রূঢ় বাস্তবে মোড়া সত্যি কথাটা বে’ফোসকে অবশেষে বেরিয়েই গেল রিক্তর মুখ থেকে।
” তাহলে?”
“অ্যাকচুয়ালি তোমার এই সিদ্ধান্তের কারণটা বোধগম্য হচ্ছে না, মনে হচ্ছে কোনো মানসিক স্থিরতা নেই!”
“আমার মানসিক স্থিরতা নেই?” খিলখিলিয়ে হাসতে হাসতে চৌহদ্দিটা ভরিয়ে দিলো মিয়া।
ওর আচরণে বড্ড বিরক্ত বোধ হলো রিক্ত। উত্তরে কিছু বলার আগেই মিয়া বলল,” রোগেভোগে ভোগা বাচ্চাকে পৃথিবীর আলো দেখানোর পরিবর্তে গর্ভেই মেরে দেওয়া ভালো। তাছাড়া আমি অল্পতে সন্তুষ্ট থাকতে পারি, ষড়রিপু দ্বারা প্রভাবিত হইনা সহজে।তাই মাতৃত্বের ক্ষণিক ছোঁয়াতেই নিজেকে খুশি রাখতে চেষ্টা করেছি।’
“তুমি কি আমাকে ক্ষমা করেছ মিয়া?” পাশে বসে থাকা মেক্সিকান তরুনীর হাতদুটো নিজের শক্ত পাঞ্জাবন্দি করে আবেগঘন ভঙ্গিতে বলে উঠলো রিক্ত,”আমি জানি, আমি ক্ষমা পাওয়ার যোগ্য নয় তবুও,…”
প্রত্যুত্তরে কোন জবাব না দিয়ে মেঝেতে পড়ে থাকা আধখাওয়া সসেজের টুকরোটা নিজের হাতে নিয়ে নিল মিয়া। তারপরে রিক্তর দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে চোখে চোখ রেখে বলল,”আশা করি আমার ঘরে এখন তুমি ব্রাউন ব্রেড খাওয়া পছন্দ করবে না, কাজেই আমার মনে হয় তোমার এখন চলে যাওয়াই বেটার!” খাবারে লেগে থাকা ধুলো-ময়লা মুছতে মুছতে বলল মিয়া।
“তুমি এরকম পিকিউলিয়ার বিহেভিয়ার করছ কেন !” আর সহ্য করতে না পেরে বলল রিক্ত, “বলছি তো আমি অন্যায় করেছি, তাই বলে আমাকে এড়িয়ে যেতে পারোনা তুমি…”
“ক্ষমা চাওয়া আর বিবেক দংশনে আকাশ পাতাল পার্থক্য , অনুভূতিহীন ক্ষমা চাওয়ার মধ্যে নিজের স্বার্থসিদ্ধির সূক্ষ্ম চিন্তা লুকিয়ে থাকে, আর দ্বিতীয় ক্ষেত্রে মানুষ অনুশোচনায় ডুবে মরে!” মেঝেতে দাঁড়িয়ে বলে উঠলো মিয়া। ” তুমি আজ এখানে ক্ষমা চাইতে আসোনি , তুমি এসেছ আমার সাথে ফিজিক্যালি ইন্টিমেট হওয়ার স্বার্থ পূরণ করতে। কাজেই সেই প্রসঙ্গে বলে দি, আমি এখন মানসিক এবং শারীরিক ভাবে বিধ্বস্ত । তাই কিছুদিন একলা ছেড়ে দাও।”
ঘরের বাইরে এগোতে এগোতে বলল মিয়া,” ওয়ান মোর, দাদা কেন মেক্সিকো সিটিতে এসেছে তোমাকে জানিয়ে রাখি, ইদানিং ড্রাগ মাফিয়ারা বড্ড বেশি মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। তাই তাদের গ্যাং এর হেড লিস্ট বার করে এনকাউন্টার করে দেওয়ার নির্দেশ এসেছে উপরতলা থেকে ….”
কথাটা বলে হাসিমুখে পা বাড়ালো মিয়া ঘরে বাইরে।
“ড্রাগ মাফিয়া!” আপন মনেই কথাটা বার কয়েক উচ্চারণ করলো রিক্ত। ডরোথি এর সাথে বিয়ে হওয়ার সুবাদে সে নিজেও যে একজন ড্রাগ মাফিয়ার তকমা পেয়ে বসেছে!
“তাহলে কি আমার সাথে সাথে ডরোথিকেও এনলিস্টেড করা হয়েছে!”
এমন সময় নেহাতই টেনশন বশত পকেটে হাত চলে যেতেই লুকিয়ে রাখা ওয়েডিং রিংটা সিমেন্টের মেঝের উপর পড়লো।
“এটাই হওয়ার বাকি ছিল!” রাগে মাথাটা জ্বলে উঠলো রিক্তর।
“তোমার কোনো দামি জিনিস পড়ে গিয়েছে, তুলে নাও।” রিংটার দিকে এক ঝলক দেখে মিয়া ফের ডুবে গেলো কাজে।
“না না ,সেরকম কিছু না… চাবি রিং ছিল একটা।”
বুকের মধ্যে লাবডাবের শব্দ স্পষ্ট টের পাচ্ছিল রিক্ত। মিয়া যদি ঘুণাক্ষরেও জেনে ফেলে রিক্ত ওর অজান্তে ডরোথিকে বিয়ে করে ফেলেছে ইতিমধ্যেই, তবে সর্বনাশ হতে আর দেরি নেই!
তাই আমতা আমতা করে মিথ্যা কথাগুলো বলে উঠলেও মিয়ার চোখে চোখ রাখার সাহস করে উঠতে পারল না ও।
“চাবি রিং হোক বা অন্য কিছু,” কাজ করতে করতে নিস্পৃহ ভঙ্গিতে জবাব দিলো মিয়া।
———
নিজের বাড়িতে এসে যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল রিক্ত।
বুকের এখনো ভয় ধুকপুক করে চলেছে ওর। সকাল থেকে একের পর এক কাণ্ডকারখানা ঘটে মাথাটা ততক্ষণে তালগোল পাকিয়ে গেছে।
“কেন যে আজকে মিয়ার বাড়িতে গেলাম!” আপন-মনে খেদোক্তি করে উঠলো রিক্ত..
” কাম! কাম’ই আমি আমাকে সর্বনাশের দোরগোড়ায় টেনে নিয়ে যাবে!” হাঁপাতে হাঁপাতে বলে উঠলো রিক্ত।
বিয়ের পর ডরোথির অর্থ-সম্পদের প্রাচুর্যতে খুশি থাকলেও শারীরিক মিলনে যে এক্কেবারে অতৃপ্ত তা বলাই বাহুল্য।
প্রৌঢ়ের আঙিনায় পৌঁছে গেলেও আজও এই শরীরটা মিয়াকেই খোঁজে দিনভর।
সকলের নজর বাঁচিয়ে নিজের বেডরুমে ঢুকেই কোনের সেলফে নিজের রিপোর্টটা লুকিয়ে রাখলো রিক্ত।
” উফফ বাঁচলাম,” স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে ধপ করে বসে পড়লো বিছানাতে।
বাইরে ফেলে আসারও জো নেই। ট্রিটমেন্টের জন্য যে এই রিপোর্টটাই লাগবে , তা বলাই বাহুল্য।
“কিন্তু টাকা?”
“রিপোর্ট কি দিল?” রিক্ত ফিসফিস করে বলে ওঠার সাথে সাথেই ঘরে ঢুকে প্রশ্ন করে উঠলো ডরোথি। ” কই আমাকে দাও..”
” এই রে! আমি যে ডক্টরের কেবিনেই ফেলে এসেছি..” মস্ত বড় জিভ কেটে উঠলো রিক্ত।
” কালই ফের চেম্বারে যেতে হবে।’
“তুমিও দিনকে দিন আমার মত ভুলোমনা হয়ে উঠেছো!” রিক্তর ওভারকোটটা খুলতে খুলতে বলে ওঠে ডরোথি। ” আমি তো ভুলেই গেছিলাম নেক্সট উইকে তোমাকে ইন্ডিয়া যেতে হবে।”
“উফফ,” মনের বিরক্তিটা গিলে নিয়ে ডরোথির ভারী কোমরটা জড়িয়ে নিয়ে আবদারের ভঙ্গিতে রিক্ত বলে উঠে,”আমার কিছু টাকার আর্জেন্ট দরকার , প্লিজ…”
” আগে ইন্ডিয়া ট্যুর, তারপর..” হালকা হেসে রিক্তকে জড়িয়ে বলে ডরোথি।
সম্প্রীতি রায়
#ষড়রিপু (সপ্তদশ পর্ব)
#কঠোরভাবে প্রাপ্ত বয়স্কদের জন্য
“দুধকলা দিয়ে নতুন কালসাপ পুষছো, বেশ ভাল! কিন্তু দেখো , সময়মতো তোমাকেই না আবার মরণছোবল মেরে বসে!”
নিজস্ব গোডাউনের একচিলতে কর্নারে স্তম্ভিত মুখে বসে আছে ডরোথি। বদ্ধ ঘরের ধুলোময় চৌহদ্দিতে
বসে থাকার কারণে ওর ফর্সা ত্বকে চাকা চাকা লাল দাগ বসে গিয়েছে। অ্যালার্জির কারণে গোটা শরীরময় অসহ্য চুলকানি শুরু হলেও ওর সেদিকে কনামাত্র ভ্রুক্ষেপ নেই।
মুঠোবন্দী করে রাখা আপাত নিরীহ চিরকুটটাই ওর মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে।
মেক্সিকান ভাষায় গোটা গোটা অক্ষরে লেখা শব্দসমষ্টি গুলো বারকয়েক আউরে নিলো ডরোথি। তারপর দুর্ভাবনায় বোঝা হয়ে যাওয়া মাথাটা খানিকটা হাল্কা করতে আপন মনেই বলে উঠল, “কার এতো বড় আস্পর্ধা হতে পারে! আমার বাঙলোর এন্ট্রানস পয়েন্টে এসে গিফট বক্স এর মধ্যে চিরকুট রেখে চলে গিয়েছে…”
আজগুবি চিন্তায় ওর মাথাটা ততক্ষণে জট পেকে গিয়েছে, তা বলাই বাহুল্য।
চিঠিতে কারোর নাম দেওয়া নেই, সাদা রুলবিহীন পাতায় পরিষ্কার হস্তাক্ষরে লাল কালিতে সেই চিঠির সেন্ট্রাল ওয়ার্ড এ আবার হাইলাইট করা।
“ভেনোমাস” ….চিঠিতে লেখা শব্দটা আপন মনেই বারকয়েক উচ্চারণ করে নিলো ডরোথি। তারপর মনের মধ্যে চেপে রাখা শঙ্কাটা ঝলক দিয়ে ওঠে এক নিমিষে, তার মানে কি রিক্তকে বোঝাতে চাইছে!
“কিন্তু রিক্তই কেন! ও তো আমার কোন ক্ষতি করেনি, ইনফ্যাক্ট বাঁচিয়েছে আমাকে।” আপনমনেই ফের বিড়বিড় করে উঠতে পাশে রাখা গিফট বক্সটার দিকে নজর পড়লো ওর।
ওর ফ্যাক্টরিতে নিউকামার বলতে যে একমাত্র রিক্তই আছে, তা বলাই বাহুল্য।
লাল কাপড়ে মোড়া সেই বাক্সে একটা কঙ্কালের খুলির চিহ্ন আঁকা রয়েছে। বড্ড অদ্ভুত।
মনে হচ্ছে, যেন কেউ বিপদ বোঝাতে চেয়েছে।
কি মনে হতে বাক্সটা ফের নিজের দিকে টেনে নিল ডরোথি। লাল কাপড়ে মোড়া বাক্সটার ডালা খুলতেই ভ্রূদুটো কুঁচকে উঠল ওর।
“ওটা আবার কি!” গোল্লা পাকানো আরেকটা কাগজের দিকে ওর নজর দিয়েছে ততক্ষনে।
কাঁপা কাঁপা হাতে কাগজটা খুলে সেই হস্তাক্ষরের কতগুলো শব্দসমষ্টি পড়তে উত্তেজনায় উঠে দাঁড়ালো ও।
” তুমি জানো রিক্ত কে? কি তার পরিচয়? তুমি কি জানো কি কারণে ও নিজের দেশ ছেড়ে মেক্সিকোতে এসেছে? কেনই বা এসেছে?
তোমার মত একজন মধ্যবয়সি ড্রাগ মাফিয়াকে বিয়ে কেনো করেছে?”
উত্তেজনায় থরথর করে কাঁপতে লাগলো ডরোথি।
“তুমি কি ভেবেছিলে? কঠোর পরিশ্রমী, নির্লোভ, বিশ্বস্ত একজনকে নিজের সাম্রাজ্যের দায়িত্বভার অর্পণ করে নিশ্চিন্তে বসে থাকবে?
বিয়ে নামক টোপ গিলিয়ে নিজের বাকি জীবন পায়ে পা তুলে কাটাবে? কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় রিক্ত তোমার টোপ গেলেনি। তুমি ওর টোপে ধরা পড়েছ!
এখনও সময় আছে, ওর স্বরূপ চিনে নাও, আশা করি এই ব্যাপারে তোমাকে গুগল, অথবা অন্য কিছু সাহায্য করবে!”
পরের চিঠিটা পড়ে ততোক্ষণে ডরোথির পা মাটির সাথে লেগে গিয়েছে। সরু সরু চোখদুটোতে অবিশ্বাসের বিন্দু বিন্দু দানা ফুটে উঠেছে।
প্রচন্ড আক্রোশে দলা পাকানো কাগজটা দূরে ছুঁড়ে ফেলে দিল ডরোথি। তারপর পকেটে রাখা মোবাইলটা বার করে সার্চ অপশনে টাইপ করলো।
মিনিটের পর মিনিট কেটে যাচ্ছে। সময়ের সাথে সাথে ওর এলার্জিতে ভরে যাওয়া লাল মুখটাও ক্রমশ হিংস্র হয়ে উঠেছে।
“তোমার সাথে এটাই হওয়া উচিত মিসেস ডরোথি মারিয়া। সরকার, রাষ্ট্রকে ফাঁকি দিয়ে দেশের জনগণ, যুবসমাজকে বিপথে ঠেলে ফেলে দেওয়ার শাস্তি বোধহয় এই ভাবেই পাবে তুমি!”
চিঠির শেষ বাক্যে লিখে রাখা লাইনটা ওর মনের মধ্যে ঘুরে চলেছে তখনও। রীতিমত দপদপ করে চলেছে মাথার শিরা দুটো।
একের পর এক পেজ খুলে কাঁপা হাতে স্ক্রল করে যাচ্ছেন ডরোথি। এত বড় বিশ্বাসঘাতকতা যে রিক্ত করতে পারে, তা যেন এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না তার। অবিশ্বাস বিশ্বাসের দোলাচলে এবার ইন্টারনেটে ফটো খুঁজতে শুরু করলো ডরোথি। প্রায় ছয় ফুট লম্বা গৌরবর্ণ চেহারার চেনা অবয়বটা ডিজিটাল স্ক্রিনে ধরা দিতেই বুকটা কেঁপে উঠল ধক করে!
এত বড়ো প্রতারণা!
রাগে দুঃখে ততক্ষনে চোখে জল চলে এসেছে ডরোথির।
————-
পলিভিনাইল ক্লোরাইড নির্মিত শক্ত কার্ডটা নিয়ে একমনে নাড়াচাড়া করে যাচ্ছে রিক্ত। আজ সকালেই কুরিয়ারে ওর গ্রিনকার্ডটা এসে পৌঁছেছে।
এতদিন বাদে অভীষ্ট লক্ষ্যের দোরগোড়ায় পৌঁছে ওর মনটা আনন্দ, উদ্বেগের মিশ্র অনুভুতির দোলাচলে দুলে চলেছে।
শক্ত প্লাস্টিক নির্মিত বস্তুটাই এখন ওর প্রাণভোমরা বলা চলে।
“কিন্তু এতো তাড়াতাড়ি হয়তো দেশে ফেরাটা ঠিক হবেনা।” বিড়বিড় করতে করতে বলে উঠল রিক্ত,
” যতই হোক, ওদেশে আমি ড্রাগ পেডলার হিসেবে যাচ্ছি।” সেই মতো ডরোথির কাছ থেকে অতিরিক্ত সাহায্য পাওয়ার কোনো আশা নেই, তা বলাই বাহুল্য।
“আশায় বাঁচে চাষা” চলতি প্রবাদটা নিজের মধ্যে আওড়াতে-আওড়াতে শিস দিয়ে উঠল রিক্ত।
তারপর ঘরের কোণে এগিয়ে গেল পায়ে পায়ে, পরনের ওভারকোটটা দু-তিনটি সাদাটে গোলাকার বস্তু মুঠোবন্দী করে নিল সে।
” আর মাত্র কয়েকঘণ্টার অপেক্ষা” প্রফুল্ল মনে শিস দিতে দিতে একমনে ডরোথির উইল কাম জয়েনট লাইফ ইনসিওরেন্সটা পড়তে লাগলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে।
মনের মধ্যে ছকে রাখা পরিকল্পনাটা চিন্তা করে নিচ্ছে বারে বারে। প্রায় ঘন্টাখানেক হতে চললো ডরোথি ফ্যাক্টরিতে গিয়েছে।
আজ টোটাল দশটা পেটি ক্লিয়ার করার কথা আছে।প্রায় একশো কোটির উপরে থাকা ডিলগুলো ডরোথি নিজেই ক্লিয়ার করে। সব ফর্মালিটিস জানা সত্ত্বেও রিক্তকে কখনও মেইন ক্লিয়ারেন্সর পারমিট দেয়নি ডরোথি।
দিনকয়েক আগেও এই অসম অধিকার দেখলে রিক্তর প্রতিহিংসাবোধ জেগে উঠলেও আজ তার পরিবর্তে মনটা চঞ্চল হয়ে গিয়েছে।
“আর কতক্ষন! উফফ!” অধৈর্যের মত রিক্ত এগিয়ে গেল সামনের কাবার্ড এর দিকে। তারপর শক্ত নলাকার সাদাটে বস্তুটা বার করে গুড়ো মিশ্রণটা পুরে দিল ওর ভিতরে।
“সব কমপ্লিট! এখন শুধু ডরোথি আসার অপেক্ষা!”
এমন সময় রক্ত পেরিয়ে এগিয়ে আসা দরজাটা ওর কানে ধাক্কা মারতে সতর্ক হয়ে গেল তারপর হাতে রেখে দেওয়া ললাটে বাঁকানো বস্তুটি পকেটে ঢুকিয়ে নিল তড়িত্গতিতে।
” হাই ডরোথি, আজও তুমি ফ্যাক্টরিতে শাড়ি পড়ে গিয়েছিলে, কি ব্যাপার!” স্বভাবগত কুটিল হাসিটা মুখে ফুটিয়ে রিক্ত এগিয়ে গেছে দরজার কাছে। ধুলোময়লার বিষবাষ্পে লাল হয়ে যাওয়া ডরোথির চোখমুখের দিকে ততক্ষনে দৃষ্টি পড়েছে রিক্তর।
” আরে তোমার এমন অবস্থা কেন!”
কথাটা বলার আগেই ডরোথি বলে উঠলো,”তুমি কে রিক্ত? আমার সাথে বিয়ে করার কারণ কি?”
সেই প্রশ্নের সামনে রিক্ত ততক্ষনে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গিয়েছে। হালকা গলাখাকারী দিয়ে নিজের মধ্যে কথাগুলো গুছিয়ে নেওয়ার আগেই ডরোথী বলে উঠলো ফের, “তুমি যা বলবে সত্যি বলবে, তারপর আমি ঠিক করব তোমার সাথে কনজুগলে থাকবো কি না! একের পর এক অপরাধ করে নিজেকে ভাগ্যান্বেষী গরিব ইন্ডিয়ান বলে পরিচয় দিতে তোমার লজ্জা করল না?”
উত্তেজনায় ততক্ষণে হাঁপিয়ে উঠেছে ডরোথি। চিৎকারের সাথে সাথে ওর বুকদুটো ওঠানামা করছে। সেদিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে রিক্ত বলে উঠলো,” আই থিঙ্ক তোমার এখন ইনহেলারের প্রয়োজন।”
বলে নিজের পকেট থেকে ইনহেলারটা চেপে ধরলো ডরোথির মুখের সামনে।
“কি করছো! ছাড়ো আমায়!” প্রাণপণে চিৎকার করতে চাইলেও ডরথী সেই শক্তি পেলনা।
একমুঠো তাজা বাতাসের আশায় বিপুল ড্রাগ মাফিয়ার শরীরটা ততক্ষনে মাটিতে গড়িয়ে গিয়েছে। দুইচোখ দিয়ে নেমে আসা জলের ধরার দিকে তাকিয়ে নিষ্ঠুর হেসে উঠলো রিক্ত।
তারপর হাসিমুখে চিবিয়ে চিবিয়ে বলে উঠলো,
“এটাই আমার পরিচয়!”
“কিন্তু কেন?”অতিকষ্টে গুঙিয়ে ওঠা মেয়েলি কণ্ঠস্বর রিক্তর কানে পৌঁছে গিয়েছে ততক্ষণে।
ডরথীর সোনালী চুলে নিজের আঙ্গুল বুলিয়ে রিক্ত বলে উঠলো,”কারবারে যে কখনোই সম্পর্কের বাঁধন ধোপে টেকেনা ডরোথি। এই কথাটা তো তুমিই আমাকে বলেছিলে! ডেভিডকে মেরে ফেলার পর….”
ক্রমশ