ভালোবাসার_রংধনু ১

0
2698

#ভালোবাসার_রংধনু
১.
_________________
লোকমুখে শুনে এসেছি, বাড়ির ছোটরা নাকি সব্বার চোখেরমণি হয়! ছোট সন্তান মানেই আদর অন্যরকম৷ ছোটদের জীবনে সুখের শেষ নেই। কিন্তু আমার ক্ষেত্রে কথাটা ছিল উল্টো। আমি ছোট ছিলাম বলেই সকলের চোখে অবহেলার পাত্রী ছিলাম। বোনেরা সবসময় আমার দায়িত্বটাই এড়াতে চেষ্টা করেছে। আমার মনে হতো ওরা হয়তো আমাকে ঘৃণা করে। ঘৃণা করবার যথেষ্ট কারণ অবশ্য খুঁজে পেতাম না। বাবা মায়ের শেষ বয়সের সন্তান আমি। এটা কি ঘৃণা করবার মত কোনো বিষয়? কি জানি!
কড়ে আঙুলে গুনে আমরা চার বোন। সন্তান নেবার পরিকল্পনা করেছে থেকে আমার মায়ের বাসনা ছিল একটা পুত্রের জন্ম হোক তার উদর থেকে;পুত্র সন্তানের জননী হবার সৌভাগ্য লাভ করুক একবার। কিন্তু সৃষ্টিকর্তা তার ইচ্ছেটা অপূর্ণ রাখলেন। পুত্র বাসনায় পর পর তিন কন্যার জন্ম দিয়ে ফেললেন মা। চরম হতাশ তাকে সামলে নিলো বাবা। বললেন,
“আল্লাহ চায় নাই হয়নাই, দুঃখ কইরো না। মেয়েরা আমাদের জীবনে সৌভাগ্য বয়ে আনবে।”
সৌভাগ্য বয়ে এনেছিল কি না জানিনা! তবে আমার বোনেরা বাবা-মাকে ভীষণ ভালোবাসতো। তাদের বাধ্যগত সন্তান ছিল তিনজনই। এত ভালো সন্তান পেয়েও মায়ের পুত্র আকাঙ্ক্ষা কমলো না। এক পুত্রের আশায় ডাক্তার, কবিরাজ দেখাতে দেখাতে চুলে পাক ধরিয়ে ফেলল। মানত টানত করে শরীরের ঝুঁকি নিয়ে আবারও সন্তান জন্ম দিল। কিন্তু তার ইচ্ছাপূরণ হলো কই? সেই কন্যাই তো জন্ম নিলো। এবার এমন হলো যে বাকি তিন বোনের চাইতে রূপ-লাবণ্য, নারীসুলভ জড়তা-সংকোচ, লজ্জা সব বেশি বেশি পেলাম আমি। আমার এত রূপ লাবণ্য দেখে বাবা নাম দিল নীরদ, মানে মেঘ।
আমাকে দেখলে নাকি নীল আকাশের বুকে একরাশ পবিত্রতা মাখানো সাদা মেঘগুলোর মত মনে হত। তাই নীরদ।
এই জীবনে আমাকে ভালোবাসবার, আমাকে নিয়ে চিন্তা করবার একজনই ছিল, বাবা। যার সান্নিধ্য আমি বেশিদিন পাইনি। বয়স যখন সাত, তখনই হার্ট অ্যাটাকে মারা যায় বাবা। অবশ্য বাবার মৃত্যুর জন্য সকলে আমাকেই দায়ী করে। কিন্তু আমি বুঝতে পারিনা নিজ সন্তান কীভাবে তার বাবার মৃত্যুর কারণ হতে পারে?
এ নিয়ে আমার বোনেদের যুক্তি ছিল ইন্টারেস্টিং।
আমার জন্মের পর যখন মা দেখলো এ সন্তানও মেয়ে তখন থেকে নাকি তার সংসারের ওপর থেকে মন উঠে গেল। সুখী একটা সংসারে বিষাদের ছায়া নেমে এলো। বড় আপার মাত্র বিয়ে হয়েছে, নতুন শ্বশুরবাড়িতে মায়ের এই বয়সে সন্তান জন্মদানের কথা লজ্জায় বলতে পারেনা। দুলাভাই প্রবাসী, তাই বুদ্ধি করে আপা লজ্জার হাত থেকে বাঁচার উপায় হিসেবে বাবার বাড়ির পরিবারের সাথে চিরজীবনের জন্য সকল সম্পর্ক ছিন্ন করে বরের সাথে পাড়ি জমালো বিদেশ। আপার যাওয়ার পর মা আরও ভেঙে পড়ল। এবং ডিপ্রেশনে ভুগতে ভুগতে একদিন জমিতে দেয়া কীটনাশক খেয়ে আত্নহত্যা করে ফেলল। প্রথমে আপার প্রস্থান, তারপর মায়ের মৃত্যু। বোনেরা এত শোক সইতে পারলো না। মায়ের পর বড় আপা ছিলো তাদের দ্বিতীয় মা। তাকেও আজীবনের জন্য হারিয়ে মেজো আপার সমস্ত রাগ এসে পড়লো আমার ওপর। জন্ম থেকেই আমি তার কাছে অচ্ছুৎ। এই যে এতগুলো বছর হয়ে গেল, ভুল করে একদিন ফিরেও তাকায়না আমার দিকে। বেঁচে আছি নাকি মরে গেছি সে খবর সে জানেনা।
তবে সেজো আপা বোধহয় আমায় ততটা ঘৃণা করতো না । কারণ যদি ঘৃণাই করতো তাহলে আজকের আমি কখনোই হয়ে উঠতে পারতাম না।
বাবার মৃত্যুর পর আমায় দ্বিতীয় জীবন দানকারী মানুষটা তো সেজো আপাই।
আমার প্রতি তার মমতা হয়তোবা শুরু থেকে ছিল, কিন্তু মেজো আপার জন্য তা দেখাতে পারেনি কখনও। তবে সেজো আপার সান্নিধ্য একটুখানি পেয়েছিলাম আমি। মায়ের মৃত্যুর ঠিক আড়াই বছর পর যখন প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে মেজো আপা বিয়ে করে নিলো! তার শ্বশুরবাড়ি চলে যাওয়ার পর বাসায় বাবা, আমি আর সেজো আপা। বাবা তো সারাদিন ব্যবসা দেখাশোনা করে, আমাকে ঐ সময়টা সেজো আপাই দেখে রাখতো। কোলে নিতো না কিংবা কখনো খাওয়া-গোসল করিয়ে দেয়নি তবে চোখে চোখে রাখতো। কি করছি; না করছি খোঁজ নিতো। অতটুকু বাচ্চা আমি সেই বয়স থেকেই নিজের হাতে খাওয়া শিখেছি।
যাহোক এভাবে চলছিল আমাদের জীবন। আমার বয়স নাকি যখন পাঁচ তখন মেজো আপার বাসায় ঘনঘন যাতায়াতের দরুণ সেজো আপার সম্পর্ক হয়ে যায় মেজো দুলাভাইয়ের কোটিপতি এক বন্ধুর সাথে। আপা সোজাসুজি বাবাকে জানায় সে কথা। বাবা ছেলের পরিবার দেখে আর না করতে পারেনা। বিয়ে হয়ে যায় ওরও। তারপর বাড়িতে আমরা বাপ-মেয়ে একা। বাবার দায়িত্ব বেড়ে যায়। চাকরি সামলে গৃহস্থালি আর সামলাতে পারতো না । লোকে দ্বিতীয় বিয়ের পরামর্শ দিলেও তা গ্রাহ্য করেনি। মাকে ভীষণ ভালোবাসতো কি না!
অনেক চিন্তাভাবনা করে সিদ্ধান্ত নেয় গ্রাম থেকে তার এক দুঃসম্পর্কের বিধবা বোনকে নিয়ে আসবে বাড়িতে। বিধবা সে বোন একাই থাকে ওখানে। দু বেলা খাবারও পায়না ঠিকঠাক। তারচেয়ে বরং এখানে থাকুক। আমায় দেখেও রাখবে, নিজের খাওয়া-পরার কষ্টটাও লাঘব হবে!
আপাদের সাথে আর পরামর্শ করার প্রয়োজন মনে করলো না বাবা। তারা এমনিতেও আমাদের সাথে তেমন যোগাযোগ রাখেনি। বলে আর কি হবে!
শেষে নিয়ে এলো ঐ ফুপুকে গ্রাম থেকে।
যার কেউ থাকেনা, রক্তের সম্পর্কের থেকে অবহেলা-অনাদর জোটে তার জন্য বোধহয় সৃষ্টিকর্তা রক্তের সম্পর্কের থেকে বড় কাউকে রাখেন। আমার জন্য রেখেছিলেন ঐ ফুপুকে। তার আগমনের পর আমি যেন একটু একটু করে প্রাণ পাচ্ছিলাম। খাওয়ার কষ্ট নেই, আদরের অভাব নেই। বাবাও চিন্তা থেকে রেহাই পেয়েছিলো।
বছর দুই ভালোই কাটলো আমাদের। তবে আমার জীবনে সব ভালো হবে কেন? অভাগ্য নিয়ে জন্ম আমার, হারিয়ে ফেললাম বাবাকে। ব্যবসায় লস হয়েছিল। সইতে পারেনি বাবা, এক রাতে হার্ট অ্যাটাক করে।
বাবার মৃত্যুর পর বাড়িসহ সকল স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি ব্যাংক হস্তান্তর করে নিলো। আমি আর ফুপু পথে!
ফুপু একবার ভাবলেন গ্রামে চলে যাবেন আমায় নিয়ে। ও পথে পাড়িও জমিয়েছিলেন, কিন্তু অন্তিম মুহুর্তে আমাদের আটকে দিলো আমায় দ্বিতীয় জীবন দানকারী মানুষটা অর্থাৎ সেজো আপা। এরপরই যেন আমি আমার জীবনের একটা অন্যতম সত্যি আবিষ্কার করলাম৷ আমার যে ধারণা ছিল কেউই আমাকে ভালোবাসেনা, কেয়ার করবার মতো কেউ নেই। একথা মিথ্যে। এইতো পেয়েছি আমার পাশে মা স্বরূপ সেজো বোনকে; যে আমার অনেক কেয়ার করে, আমায় ভালোবাসে ৷
সেদিন আপা আমাদের শহরে দু রুমের একটা ফ্ল্যাটে থাকার ব্যবস্থা করে দিল। তারপর থেকে ক্লাস নাইন পর্যন্ত আমাদের সমস্ত খরচ ওই চালালো। বুঝতে শিখেছি থেকে ফুপু আমাকে লড়াই করার কথা বলতেন, নিজে কিছু করার কথা বলতেন। কিন্তু আমার লজ্জা, ভয়-জড়তা, এসব কাটিয়ে কিছু করতে পারতাম না। বইপোকা ছিলাম, তাই রেজাল্টগুলো বরাবরই ভালো হতো। রেজাল্ট ভালো হতো বলে স্যারদের সুনজরে ছিলাম। পড়ালেখায় কষ্ট হয়নি। ভাঙা তরীতে দুলতে দুলতে ঐ নাইন পর্যন্ত ঠিকঠাক এগোতে পারলাম কিন্তু তারপর আবার বিপর্যয় নেমে এলো আমার জীবনে। এক সকালে ফুপু মারা গেলেন। কোনো রোগবালাই নেই। খুব স্বাভাবিক মৃত্যু।
কিন্তু তার স্বাভাবিক মৃত্যু যে আমার কাছে অপ্রত্যাশিত ছিল। আমি হয়ে গেলাম সম্পূর্ণ একা। ভাবতে লাগলাম কোথায় যাব! কি করবো! কি হবে আমার?
আমার ভাবনার তল খুঁজে পাওয়ার পূর্বেই আল্লাহ তার দয়া দেখালেন। সেজো আপা ফুপুর মৃত্যু সংবাদ শুনে ছুটতে ছুটতে চলে এলো। ফুপুকে কবরস্থ করার পর ঐ পথে আমায় নিয়ে গেল তার শ্বশুরবাড়ি।
রাজা,রাজপ্রাসাদ সম্পর্কে সবসময় বইতে পড়েছি কখনও সামনাসামনি দেখা হয়নি, দেখতে যে পাবো তাও ভাবিনি। সেই দেখা ভাগ্যে জুটে গেল ষোলো বছর বয়সে।
আপার শ্বশুরবাড়ি রাজপ্রাসাদের থেকে কম নয়। অসংখ্য লাইটিং, কি দামি দামি আসবাবপত্র। একেকটা ঘর কত্ত বড় বড়! ও বাড়িতে গিয়ে মনে হচ্ছিল ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্নের জগতে আটকা পড়েছি। খুব দ্রুতই আমার ঘুম ভাঙবে আর ধড়ফড় করে উঠে বসে দেখবো ঐ দু কামরার ফ্ল্যাটেই আমি আছি, বিষাদে পরিপূর্ণ জীবন নিয়ে।

আপার শ্বশুরবাড়ি মানুষে ভরা। শ্বশুর-শ্বাশুড়ি, ভাসুর-জা, দেবর, ননদ সব্বাইকে নিয়ে যৌথ পরিবার। আপার শ্বাশুড়ি এবং জা ছাড়া ও বাড়িতে কেউই আমায় ঠিক মেনে নিতে পারলো না। আমায় দেখলেই কেমন নাক কোঁচকাত, তাচ্ছিল্যের হাসত। লোকের উপহাস বোঝার বয়স আমার হয়েছিল এবং যথেষ্ট আত্মসম্মানিও আমি তাই ওদের তিরস্কার খুব কষ্ট দিতে লাগলো আমাকে। আপাকে বললাম, আমাকে রেখে আসো ঐ ফ্ল্যাটে। এখানে আমার দমবন্ধ হয়ে আসে। এত তিরস্কার আমি নিতে পারিনা। আপা আমার কথা শুনে চোখ রাঙায়। বলে,
“একা একটা মেয়ে ওখানে থাকবি তারপর কিছু হয়ে গেলে দোষ আমার?”
আমি বললাম, “এখানে থাকা আরও ভয়ানক। এটা তো তোমার শ্বশুরবাড়ি। এখানে থাকা আরও কঠিন”
আপা কি যেন চিন্তা করে উত্তর দেয়,
“এসএসসি এখানে থেকেই দে। তারপর কলেজে উঠলে হোস্টেলে পাঠিয়ে দেবো”
ওর সিদ্ধান্ত আমার পছন্দ হলো। কষ্ট হলেও থেকে গেলাম ওখানে। কিন্তু এসএসসি পরীক্ষা কমপ্লিট হলেও আপা আর আমায় ছাড়ল না। বলল,
— কলেজ জীবন আর ক’দিনের? এই ক’টা দিন নাহয় থাক এখানেই। এইচএসসি শেষে ভার্সিটিতে চান্স নিয়ে নাহয় যাবি। তাছাড়াও বাবু ছোট। ওকে সামলে সংসার দেখা কষ্ট হয় আমার। তুই থাকলে একটু সাহায্যও হলো।
বিরোধ করতে চেয়েছিলাম কিন্তু যে আমাকে অসহায় মুহুর্তে আগলে নিয়েছে তার বিরোধ করব!মনটা সায় দেয়নি ।
তবে নিজের সীমা সম্পর্কে খুব ভালোভাবেই অবগত ছিলাম আমি। সারাটা সময় বইয়ে মুখ গুঁজে দরজা আটকে পড়ে থাকতাম। কেউ ডাকলে তখন বের হতাম এছাড়া নয়। ঐ ক’বছরে একটা নিয়মতান্ত্রিক জীবন হয়ে গেছিল আমার। কিন্তু নিয়মের ব্যতায় ঘটলো একদম হুট করে একজনের আগমনে ৷ এইচএসসি তখন দরজায় কড়া নাড়ছে। দিন দুনিয়া ভুলে পড়াতেই ডুবে আছি এমন মুহুর্তে আপার একমাত্র ননদের বিয়ে পাকা হলো। বাড়ির একটাই মেয়ে তার বিয়ে কি যেন-তেন উপায়ে হবে? লেগে গেল বিরাট আয়োজন। একটা বিয়ে উপলক্ষে এত বড় কোনো অনুষ্ঠানের আয়োজন হতে পারে তা আমি বিস্ময় নিয়ে দেখছিলাম। যদিওবা খুব সাধারণ উৎসবগুলো এরা অনেক বড় আয়োজন করে পালন করে দেখতাম, তবে বিয়ের আয়োজন আরও বেশি অবাক করার মত ছিল। আমায় অবাক হতে দেখে আপা বলল,
— এ তো কিছুই নয়। বাড়ির বাকি সদস্যরা আসুক তখন দেখিস আরও কত আয়োজন।

বাকি সদস্য বলতে আপার দেবর আর ভাসুর। দু’জনেই থাকে দেশের বাইরে। একজন বিজনেস পারপাসে আর অন্যজন লেখাপড়ার উদ্দেশ্যে ।যদিওবা আপার ভাসুর সুযোগ পেলে আসতেন দেশে, কিন্তু ওর দেবর কখনই আসেনি। না আসার কারণ আমি জানতাম না। কখনো আগ্রহ জন্মায়নি। আপা যখন ছবিতে দেখিয়েছিল ওকে তখনও না। কিন্তু একমাত্র বোনের বিয়ে ঠিক হবার পর ও জানালো, আসছে দেশে। ওর আসার খবর শুনে বাড়িতে অন্যরকম প্রিপারেশন শুরু হলো। সবাইকে অ্যালার্ট করা হলো এটা করা যাবে না-ওটা করা যাবেনা।
আপা আমায় কড়া ভাবে বলে রাখলো,
— ইনতিসারের সামনে একদম পড়বি না, একদম না৷
আমি কোনো উচ্চবাচ্য করলাম না। এবং আপার কথাটা মাথায় গেঁথে নিলাম খুব ভালোভাবে। কোনোভাবেই ওর দেবর ইনতিসারের সামনে পড়া যাবেনা। যাবেনা মানে যাবেনা।

২.

যথারীতি সময় হলে চলে এলো ইনতিসার। তার আগমনের পর পুরো দু’দিন আমি একদমই ঘর ছেড়ে বেরুলাম না। আমার খাবারদাবারসহ যাবতীয় যা লাগে আপা কাজের মেয়ের হাত দিয়ে ঘরে পাঠিয়ে দিল। আপার বাচ্চাটাও চাচাকে পেয়ে আমায় ভুলে গেল। ঐ ব্যাপারটায় খানিক কষ্ট পেয়েছিলাম বটে, তবে তা চোখের পলকে ভুলেও গেলাম।
এ পর্যন্ত সব ঠিক ছিল কিন্তু বিপত্তি বাঁধল দু’দিন পর এক রাতে। রাত জাগা শুরু যেদিন থেকে সেদিন থেকেই পড়ার ফাঁকে এটা-ওটা খাওয়ার অভ্যেস হয়ে গেছিল। আপার দেয়া হাত খরচের টাকা জমিয়ে খাবারের কন্টেইনার কিনতাম৷ সেদিন আমার খাবার শেষ হয়ে গেছিল। ক্ষুধায় কিছুতেই পড়তে পারছিলাম না। বাধ্য হয়ে সিদ্ধান্ত নিলাম পানি খেয়ে পেট ভরবো। বোতল ভরে পানি নেয়ার উদ্দেশ্যে বেরুলাম ঘর ছেড়ে। রাত তখন কত হবে? আড়াইটা কি তিনটা! পুরো বাড়ি তখন নিস্তব্ধ। ড্রয়িং-ডাইনিং উভয়ের লাইট নেভানো ছিলো। আমিও আর জ্বালালাম না৷ ফোনের ফ্ল্যাশ জ্বালিয়ে আশেপাশে তাকাতে তাকাতে যাচ্ছিলাম ডাইনিংয়ের দিকে। ড্রয়িংও ক্রস করেছি মাত্র ঐ মুহুর্তে হঠাৎ দোতলার সিঁড়ি থেকে কেউ একজন আচমকা চেঁচিয়ে উঠল,
— এ্যাই কে? কে ওখানে?
এত রাতে এভাবে পুরুষালী কণ্ঠ স্বভাবতই আমায় চমকে দিল৷ চমকে হাত থেকে বোতল আর ফোন ফেলে দিলাম। আমতা আমতা করে কিছু বলতে যাব তার পূর্বেই ওপাশের ব্যক্তি চোর, চোর বলে চেঁচাতে চেঁচাতে নেমে আসতে লাগল। ঘটনা এত দ্রুত হয়ে গেল যে আমি মুখ দিয়ে একটা শব্দও উচ্চারণের সুযোগ পেলাম না৷ সে ছুটে এসে জাপটে ধরল আমায় আর তার স্বরে চেঁচিয়ে গেল, চোর চোর বলে।
তার অমন বিরাশি চিৎকারে পুরো বাড়ির লোক জেগে গেল নিমেষে । একে একে প্রত্যেকটা ঘরের লাইট জ্বলে উঠল এবং তড়িঘড়ি করে বেরিয়ে এলো সবাই। সবার প্রথমে সেজো আপাই ছুটে এসে লাইট জ্বালালো ড্রয়িংয়ের। নিমেষে অন্ধকার গায়েব হয়ে গেল পুরো বাড়ির। লাইটের আলোর সাথে দৃশ্যমান হলো আমার চেহারা। লজ্জায় এতটুকু হয়ে গেছিলাম আমি। চোখ ছিল মেঝের দিকে নিবদ্ধ। আপা কিছু বলবে তার পূর্বেই ওর শ্বাশুড়ি অবাক হয়ে শুধল,
— চোর কে? কোথায় চোর? ও? ও তো..
— দেখেছেন খালাম্মা দেশ কত উন্নত হয়ে গেছে। মেয়েরা আজকাল চুরি করতে শুরু করেছে।
ওনাকে কথা শেষ করতে না দিয়েই আমার পেছন থেকে পুরুষালী কণ্ঠটা কথা বলে উঠল।
তার কথা শুনে উপস্থিত সকলের চোখ ছোট ছোট হয়ে গেল। আপা ছুটে এসে আমায় ছাড়িয়ে নিতে নিতে বলল,
— তোমার ভুল হচ্ছে ভাই। এ চোর নয়, এ তো আমার বোন নীরদ।
— হ্যাঁ আমি তো তাই বলছিলাম এ তো আমাদের মেজো বউমার বোন নীরদ৷ অনিক তোর বুঝতে ভুল হয়েছে বাবা।
— মেজো ভাবীর বোন?
ছেলেটা যেন ভারী অবাক হলো। মুখ তুলে না তাকিয়েও বুঝতে পারলাম তার জিহ্বায় কামড় পড়েছে। তড়িৎ সে লজ্জিত ভঙ্গিতে বলল,
— আ’ম সো স্যরি। এত রাতে এমন নিঃশব্দে এপাশ ওপাশ তাকাতে তাকাতে আসছিল তাই ভেবেছি…
ইশশ অনেক বড় ভুল হয়ে গেছে।
— তা নাহয় ঠিকাছে কিন্তু এই মেয়ে এত রাতে কি করছে এখানে?
বেশ বিরক্তি মাখানো গলায় প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিলো আপার ননদ। আপাও এবার প্রশ্ন করলো আমায়,
— কি রে বল? কি করছিলি এত রাতে এখানে!
আমি কোনো রকমে কাঁপতে কাঁপতে জবাব দিলাম,
— পানি নিতে এসেছিলাম। আসলে পানি শেষ হয়ে গেছিল তো! ঐ দেখো বোতল।
আঙুল দিয়ে পড়ে থাকা ফোন আর বোতলটা দেখিয়ে দিলাম আমি।
আপা ওগুলো তুলে নিতে নিতে ধমকের সুরে বলল,
— পানি শেষ হয়ে গেছে এটা আমায় সন্ধ্যারাতে বলবি না? আমি নিয়ে গিয়ে রেখে দিতাম।
— তুমি ব্যস্ত ছিলে, বলার সুযোগ পাইনি।
মিনমিন করে উত্তর দিলাম আমি। আপার কানে সে কথা পৌঁছুল কি না! মাউইমা মানে আপার শ্বাশুড়ি স্নেহমাখা কণ্ঠে বললেন,
— আহ্ হয়েছে তো বাচ্চা মেয়েটাকে ধমকানোর কি আছে! ভুল তো আমাদেরই ওর কখন কি লাগে একটু খোঁজ নিতে পারিনা। বেচারি রাত জেগে পড়াশোনা করে এই সময় ভালো খাবার দাবার, যত্ন-আত্তি তো ওর প্রাপ্য। নাহলে ব্রেইন খুলবে কীভাবে! মেজো বউমা তুমি কাল থেকেই ওকে সময় দেবে। কখন কি লাগে খেয়াল রাখবে। মনে থাকবে?
মাউইমার কথা শুনে তড়িৎ আমার চোখে পানি চলে এলো। এমন স্নেহমাখা গলায় কেউ আমার যত্নের কথা বলেনা। বাবা-র পর এই প্রথম।
আপা ওনার কথায় সম্মতি দিয়ে সকলের কাছে আমার হয়ে ক্ষমাটমা চেয়ে আমায় নিয়ে ঘরের দিকে যেতে উদ্যত হলো, সেই মুহুর্তে পুনরায় দোতলার সিঁড়ি থেকে গুরুগম্ভীর আরেকটা কণ্ঠ ভেসে এলো,
— এত রাতে কিসের গ্যাঞ্জাম হচ্ছে এখানে?
কেন জানিনা কন্ঠটা কানে আসতেই আমি মুখ তুলে চাইলাম ওপরে। চোখের কোলে যে জলটুকু জমে ছিল মুখ তোলার সাথে সাথেই তা গাল বেয়ে চিকন ধারা হয়ে গড়িয়ে পড়ল। ছেলেটাকে চিনতে সমস্যা হলো না । ইনতিসার ইলহাম, যার থেকে ১০০ হাত দূরে থাকার নির্দেশ ।
ইনতিসার আমার দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নিলো। মাউইমাকে উদ্দেশ্য করে বেশ রাগত স্বরে বলল,
— এখনও রাত বিরেতে সার্কাস চলে এই বাড়িতে? এসব দেখার জন্যই দেশে এসেছি আমি? আর এই মেয়ে কে? কাঁদছে কেন এভাবে? অঘটন ঘটিয়ে ফেলেছে নাকি?
ইনতিসারের কথা শুনে নিমেষে আমার কান গরম হয়ে উঠল। তার ইঙ্গিত যে খারাপ দিকে সেটা বুঝতে সমস্যা হলো না। আপা রক্তশূন্য মুখে ফ্যাসফ্যাসে গলায় জবাব দিল,
— তুমি যা ভাবছো সেরকম নয় ভাই। ও একটু পানি খেতে উঠেছিল। এখানে একটা মিসআন্ডারস্ট্যান্ডিং হয়ে যায় এ কারণেই…
— আর ও বাইরের মেয়ে নয় আমাদের মেজো বউমার বোন। কথা বলার সময় হুঁশজ্ঞান করে তো বলবা ইনতিসার৷
আপাকে কথা সম্পূর্ণ করতে না দিয়েই মাউইমা বলে উঠলেন। তারপর আপা সহ বাকি সবাইকে আদেশ করলেন,
— তুমি এক্ষুনি নীর মাকে নিয়ে ঘরে যাও মেজো বউমা। আর বাকি সবাই যার যার ঘরে চলে যাও।

মাউইমার এক কথা তারপর সবাই যে যার ঘরের দিকে হাঁটা দিল। যাওয়ার সময় বিরক্তি প্রকাশ করতে ভুললো না। আর যে ছেলেটা আমায় চোর ভেবে ভুল করেছিল সে আমার সামনে এসে লজ্জিত ভাবে বলল,
— আ’ম রিয়্যালি স্যরি মিস. আপনাকে অপমানিত করার কোনো ইনটেনশন ছিলো না আমার।প্লিজ কাঁদবেন না আপনি।
— ইটস ওকে।
ক্ষীণ স্বরে জবাব দিলাম আমি।

— যত্তসব নাটক।
ভীষণ বিরক্তি নিয়ে কথাটা বলল ইনতিসার। মাউইমা চোখ গরম করে তাকালেন ওর দিকে। তারপর আর এক মুহুর্ত দাঁড়াল না ও। হনহন করে হেঁটে ঘরে চলে গেল।
আমি লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে আপার হাতে মৃদু চাপ দিলাম, যার অর্থ ঘরে চলো। আপাও আর দেরি করলো না।
ঘরে আসবার পর আপা বেজায় রেগে গেল আমার ওপর। কঠিন ধমক দিয়ে বলল,
— পানি নিবি সেটাও এমন লুকিয়ে? ড্রয়িংয়ের লাইটটা জ্বালালে কি হতো? অযথাই এমন লজ্জাজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি করে দিলি।
— স্যরি আপা। আমি বুঝতে পারিনি এত রাতে কেউ জেগে থাকবে আর এরকম কিছু একটা ঘটে যাবে।
ঐ ছেলেটা সম্পর্কে কিছু জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করলো, কিন্তু ভয়ে প্রশ্ন আলজিব পর্যন্ত এসেই আটকে গেল। অবশ্য আপা নিজে থেকেই বলল ওর সম্পর্কে।
— তুইওবা কি করে জানবি কেউ জেগে থাকে কি না! ঘর ছেড়েই তো বেরোস না। ঐ ছেলেটাকে দেখলি যে তোকে চোর ভেবে ভুল করেছিল?
ও আমার শ্বাশুড়ির বোনের ছেলে অনিক। ইনতিসারের সমবয়সী। বিদেশে ওরা একই ইউনিভার্সিটিতে লেখাপড়া করেছে, থাকতোও একসাথে। ইনতিসারের সাথেই এলো ছেলেটা।
আসলে ওখানে সময়ের ব্যবধানটা তো অনেক। ইনতিসার আর অনিকের মনে হয় সময় মেলাতে কষ্ট হচ্ছে, এতদিনের অভ্যাস!
রাতে ঘুমোয়না দুজন। সারারাত জেগে কি কি যে করে! তারপর ভোরের দিকে ঘুমোতে যায়।

— সারারাত জেগে থাকে!
— হু। আচ্ছা শোন তুই কিন্তু আর কখনও রাত-বিরেতে এভাবে ঘর ছেড়ে বেরুবি না ঠিকাছে?
— আচ্ছা ।
— আর আবারও বলছি ইনতিসারের থেকে দূরে থাকবি৷
— হ্যাঁ হ্যাঁ থাকবো। এমনিতেও অমন রাগী, ষাঁড়ের মত চিৎকার করা ছেলের সামনে যেতে আমার ভয় লাগে।
শেষের কথাটা ফিসফিসিয়ে বললাম যেন আপা শুনতে না পারে।
জবাবে সন্তুষ্ট হয়ে আপা বোতল হাতে বেরিয়ে গেল পানি আনতে। আমি বসে রইলাম চুপচাপ। চার বছর আগের ইনতিসার আর আজকের ইনতিসারের মধ্যে আকাশ-পাতাল তফাৎ। আগে যাকে শুধু দাম্ভিক এবং অসভ্য বলেই জানতাম আজ সে আরও দু ডিগ্রি ওপরে চলে গেছে। ওভার এগ্রেসিভ, বেয়াদব।

চলবে,

sinin tasnim sara

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here