ভালোবাসার রংধনু
৫
______
(৯)
যাব না যাব না করেও মাউইমার কথার মান রাখতে সেজেগুজে বেরুলাম। ড্রয়িংরুমে পৌঁছতে পৌঁছতে মাফিনের সাথে দেখা হয়ে গেল। ও ছাড়া এ মুহুর্তে পরিচিত আর কেউ নেই আশেপাশে। মন খারাপ করে বসে ছিলো বাচ্চাটা। ইশারায় ডাকতেই “তাম্মি, তাম্মি” করে ছুটে এলো। বয়স ছয় পার হবে, কথাবার্তাও স্পষ্টই বলতে পারে শুধু আমার সম্বোধনটাই পারেনা। হাজার চেষ্টা করেও তাম্মি শব্দকে খালামনিতে রূপান্তর করতে পারিনি। এটা অবশ্য ও ইচ্ছে করেই করে। বড় আপা, মেজো আপার সাথে যখন ভিডিও কলে কথা বলে দেখি খালামনি খালামনি করে মুখের ফেনা তুলে দিচ্ছে। আমার বেলায় খালামনি ডাক হারিয়ে যায়। সেজোপা বলে এটা ওর আদরের ডাক। যতই আদরের ডাক হোক একবার তো খালামনি শব্দটা উচ্চারণ করবি আমার বেলা? শুনে কানদুটো জুড়বো। নাহ্ সে বলবে না৷
কাছে এলে ওকে জিজ্ঞেস করলাম,
— মা কই তোমার?
উত্তর দিল না । ইশারায় বোঝালো, “চুপ, আমি কিছু ভাবি”
এটা ওর স্বভাব। কোনো গুরুত্বপূর্ণ কথা বলবার সময় এভাবে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকবে, মনে মনে কথা সাজিয়ে নেবে তারপর বলবে। ততক্ষণ অবধি সামনের মানুষটাকে একদম স্ট্যাচু হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে।
আমিও ওকে হাতের ইশারায় বুঝিয়ে দিলাম, “জলদি ভাবো”
ও কাঁধ ঝাঁকিয়ে সম্মতি দিলো।
বেশ কিছুক্ষণ এক ধ্যানে তাকিয়ে থাকবার পর আমার হাত টেনে ধরে বলল,
— আজ তোমাকে ভীষণ প্রিটি লাগছে তাম্মি।
ও যে কমপ্লিমেন্ট দেবার জন্য এতক্ষণ ভাবছিল কল্পনাও করিনি আমি। বিস্ময়ে খানিক নির্বাক থেকে হেসে ফেললাম। হাঁটু মুড়ে বসে ওর চুলগুলো আলতো করে ছুঁয়ে বললাম,
— এটাই তোমার গুরুত্বপূর্ণ কথা?
— হুঁউ।
— তোমাকেও খুব হ্যান্ডসাম লাগছে বাবা।
— তোমাকে বেশি। একদম সাতসমুদ্র দূরের রাজকন্যার মত।
— সাত সমুদ্র দূরের রাজকন্যাকে তুমি দেখেছো?
— হু। চাচ্চু দেখিয়েছে তো ফোনে।
— তাই নাকি? আচ্ছা আমাকেও দেখাও?
— উঁহু দেখানো যাবেনা। কাউকেই দেখানো যাবেনা। টপ সিক্রেট।
— ওহ্ বাবা! একেবারে টপ সিক্রেট? তাহলে তো আসলেই দেখা যাবেনা। রাজকন্যাকে না দেখি, চলো তোমার ফুপির ফটোশুট দেখে আসি?
— যাব আগে আমাকে তোমার মত সাজিয়ে দাও?
— আমার মতো করে সাজবে!
— হু। এই কালারের একটা পাঞ্জাবি আছে না আমার? মা কিনে দিয়েছিল। ওইটা পরিয়ে দাও। তাম্মি আর আমি ম্যাচিং ম্যাচিং।
— কোথায় যে আছে তোমার পাঞ্জাবি! এই অসময়ে চেঞ্জ করবে?
— হু। চলো আমি দেখিয়ে দিচ্ছি।
হাত টেনে ধরলো ও। অগত্যা আমাকে যেতে হলো ওর পিছু পিছু।
কাপড়চোপড় পরিয়ে দেবার পর মাফিন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখতে দেখতে খুব সিরিয়াস ভঙ্গিতে বলল,
— শোনো তাম্মি তুমি কিন্তু সবার সামনে আমাকে মাফিন বলে ডাকবে না। আমার নাম ধরে ডাকবে। ইঊশা বলে ডাকবে। মনে থাকবে?
— ইশশ তোমার নাম যে কঠিন। আমি তো উচ্চারণই করতে পারিনা। মাফিন সোজা।
— এই না না মাফিন বলা যাবেনা। আমার একটা প্রেস্টিজ আছে না? আসো আমি তোমাকে শিখিয়ে দেই। বলো ই ঊ শা। একবার হ্রস্ব ই, তার পাশে দীর্ঘ ঊ আর তার পাশে তালব্য শ। ইঊশা।
সিম্পল।
— ওহ্ এত সিম্পল ছিল? আমি তো বুঝতেই পারিনি।
হাসি চেপে বললাম। ও সম্মতিসূচক মাথা নেড়ে বলল,
— অনেক সহজ। এখন চলো?
________
ভেন্যিউতে আমার হাত ধরে সব ঘুরিয়ে দেখাতে লাগল ইঊশা । ইশি আপুর ফটোশুট চলছে একদিকে। বিভিন্ন বয়সী ছেলেমেয়েদের মিলনমেলা ওখানে। ইশি আপুর ফ্রেন্ডস, হাজবেন্ড এর ফ্যামিলির লোক, কাজিনস সব ওখানে। ওদের সবাইকে দেখে আমার গলা শুকিয়ে আসতে শুরু করলো। অকারণে নার্ভাস লাগছিল। কত সুন্দর ড্রেসআপ, সাজগোজ তাদের। এলিগেন্ট লাগছে সবাইকে৷ এদের সবার মাঝে আমি বড্ড ফিঁকে।
মাউইমা বলছিলেন ইনতিসার ফটোগ্রাফি করছে। কই? সে তো নেই। অনিচ্ছায় চোরা চোখে আশেপাশে তাকিয়ে খোঁজবার চেষ্টা করলাম তাকে।
কয়েকহাত দূরে একটা চেয়ারে বসে ফোন চাপছে আর বোতল থেকে অল্প অল্প করে পানি খাচ্ছে।
ওকে দেখার পর আমার এখানে থাকার ইচ্ছেটা আরও মরে গেল। ইঊশার হাত ছেড়ে দিয়ে বললাম,
— ইঊশা ঐ যে তোমার চাচ্চু বসে আছে। এক ছুটে তার কাছে চলে যাও, খালামনির শরীর খারাপ লাগছে। ভেতরে যাব।
— না না।
ইঊশা তড়িঘড়ি করে হাত টেনে ধরলো আমার।
— আরেকটু থাকো, মাকে বলছি ঔষধ এনে দিতে।
— আমার তো কোনো কাজ নেই এখানে।
— আছে তো। চলো না আমরা ঘুরি, পিক তুলি? এই যে ম্যাচিং ম্যাচিং পরেছি সবাইকে দেখাতে হবে না!
— কিন্তু ইঊশা..
— চলো আগে চাচ্চুকে দেখাই। চাচ্চু পিক তুলে দিবে।
আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই হাত ধরে দৌড় শুরু করলো ইঊশা। ওকে আটকাতে চেয়েও পারলাম না। তার পূর্বেই ইনতিসারের সামনে উপস্থিত। দু’টো মানুষ সামনে এসে দাঁড়িয়েছে বুঝতে পেরেও কোনো হেলদোল নেই ইনতিসারের। সে একমনে ফোন চেপে যাচ্ছে। ওর কোনো রেসপন্স না দেখে ইঊশাই ডেকে উঠল,
— চাচ্চু এ্যাই চাচ্চু। দেখো তাম্মি আর আমি এরকম সেজেছি, একদম সেম সেম। আমাদের একটা ছবি তুলে দাও তো?
মাফিনের ডাকে ভদ্রলোক এবার ফোন ফেলে মুখ তুলে চাইল আমাদের দিকে। কেন যে আমি ওর দিকেই তাকিয়ে ছিলাম! ও তাকাতেই চোখে চোখ পড়ল। বড়জোর পাঁচ সেকেন্ড তাকিয়ে ছিলো আমার পানে, তারপর দৃষ্টি ফিরিয়ে ইঊশার দিকে তাকাল। বোতলের ক্যাপটা আটকাতে আটকাতে বলল,
— এটা কোনো পাঞ্জাবি পরেছিস? এই কালার ছেলেদের মানায়? আর আজকে স্যুট পরার কথা ছিলোনা? পাঞ্জাবি পরলি কেন?
ওর কাটকাট কথা শুনে নিমেষেই মুখের হাসি মিলিয়ে গেল ইঊশার। মনখারাপ গলায় বলল,
— সুন্দরই তো লাগছে আমাকে। সবাই প্রশংসা করেছে, বলেছে হ্যান্ডসাম লাগছে।
— ছাতার মাথা লাগছে। তুই কি মেয়ে? ওশন কালার পরে ঘুরে বেড়াবি! যা এক্ষুনি চেঞ্জ করে আয়। মাকে বল তোকে স্যুট প্যান্ট পরিয়ে দিতে।
ধমকের সুরে বলল ইনতিসার। ওর ধমক শুনে ঈষৎ কেঁপে উঠে আমার মুখের দিকে তাকাল ইঊশা। চোখ পানিতে টুলটুল করছে।
চট করে মেজাজ খারাপ হয়ে গেল আমার। এটা কোনো নিয়ম বাচ্চাদের সাথে কথা বলার? চোখমুখ কঠিন করে ওর দিকে তাকালাম। আজ আর কন্ট্রোল করা সম্ভব নয় নিজেকে।
— এটা কোনো সিস্টেম হলো বাচ্চাদের সাথে কথা বলার?
— এক্সকিউজ মি!
ভ্রু কুঁচকে আমার চোখে চোখ রাখলো ইনতিসার। আমিও ওর দিকে তাকিয়েই বললাম,
— এভাবে কেউ বাচ্চাদের সাথে কথা বলে? কি এমন ভুল করেছে ও, যে আপনি এভাবে ধমক দিয়ে কথা বলছেন ওর সাথে? এমন কঠিন কথা শুনলে ওর মস্তিষ্কে এর কেমন প্রভাব পড়বে আইডিয়া আছে?
— আমার কথার ধরন এরকমই।
— এরকম হলে সেটা পাল্টাতে হবে। অন্ততপক্ষে বাচ্চাদের সাথে কথা বলার সময় নরম সুরে কথা বলতে হবে। কোনো ভুল করলে তাকে শান্তভাবে বোঝাতে হবে।
— এ্যাই মেয়ে, তুমি কে আমার ভুল ধরার? তোমার কথায় এখন আমার নিজের স্বভাব পাল্টাতে হবে? তুমি কে আমাকে জাজ করার? স্ট্রেইট ফরওয়ার্ড কথা শোনার অভ্যেস ওর থাকতে হবে। এখন মধুর কথা বলে ওকে নরম করে গড়ে তুললে ভবিষ্যতে যখন কঠিন কথা শুনবে তখন আর সহ্য করতে পারবে না। তখন যে মানসিক চাপ যাবে তার দায়িত্ব কে নেবে? তুমি?
আজ আমার কাছে কঠিন কথা শুনে যখন সহনীয় হয়ে যাবে তখন অন্য কারোর কঠিন কথা আর গায়ে লাগবে না ওর।
— বাচ্চাদের বাস্তবতা শেখানোরও একটা নিয়ম আছে। নিশ্চয়ই সেটা সম্পর্কে আপনি অবগত না।
— হ্যাঁ জানি না তো আমি। এক কাজ করো তুমি জানাও আমাকে। কার সাথে কীভাবে কথা বলতে হয় শেখাও। টিচার এসেছ না তুমি?
— দেখুন আপনি অযথাই কথা পেঁচিয়ে ঝগড়ার দিকে নিয়ে যাচ্ছেন। নিজের ভুল স্বীকার করতে শিখুন।
— কে দিচ্ছে আমাকে ঠিক-ভুলের জ্ঞান!
তাচ্ছিল্যের সাথে হাসলো ইনতিসার। ওর আচরণে আমি ভীষণ বিরক্ত হলাম। কথাবার্তার কোনো লাগাম তো নেই ই, নেই লজিকও। অযথাই গতরে বেড়েছে বদমাশটা, ভেতরে ভেতরে এখনও একরোখা-জেদি ইনতিসারই আছে।
থাক আমার তাতে কি?
— এ্যাই মেয়ে শোনো?
অকস্মাৎ পেছন থেকে এক মহিলা কণ্ঠ ভেসে আসলো এবং সেই কণ্ঠের মালিক আমার কাঁধে হাত রাখলো। চকিতে ফিরে তাকাতেই দেখলাম এক মধ্যবয়সী মহিলা হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছেন। আমি ফিরতেই মুচকি হেসে বললেন,
— তোমাকে অনেকক্ষণ থেকে দেখছিলাম। কে তুমি? বরপক্ষের কেউ নাকি কনে পক্ষের?
তড়িৎ ওনার প্রশ্নের উত্তর দেয়া সম্ভব হলো না। খানিক থেমে বললাম,
— কনেপক্ষের।
— ওহ্ হো? কেমন আত্মীয় তুমি মেয়ের?
— ও আমার খালামনি।
পাশে থেকে ইঊশা ফট করে উত্তর দিলো। এই প্রথম ওর মুখে খালামনি সম্বোধন। উপস্থিত আমরা তিনজনই ওর মুখের দিকে তাকালাম। ভদ্রমহিলা হেসে উঠলেন। ইঊশার গালে হাত বুলিয়ে শুধলেন,
— তুমি ইশির মেজো ভাইয়ের ছেলে না?
— হ্যাঁ।
— ওহ তাহলে তো তোমরাও সুমুন্দি। তো তোমার বাবা-মাকে দেখছি না?
আশেপাশে নজর বুলোতে বুলোতে আমার উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন উনি। আমি হালকা গলায় বললাম,
— আমার বাবা-মা এক্সপায়ার্ড হয়েছেন অনেক আগে।
— ওহ হো। কষ্ট পেও না মা। আমি জানতাম না।
— সমস্যা নেই আন্টি।
— তো তুমি কিসে পড়ো?
— ইন্টার দিলাম। এডমিশান প্রিপারেশন নিচ্ছি।
— তাহলে তো আঠারো পার হয়েছে?
আবারও মুচকি হাসলেন উনি। ওনার এহেন প্রশ্নে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম আমি। মাথা নেড়ে বললাম,
— জ্বী।
এবারে উনি আরেকটু এগিয়ে এলেন। আমার গালে হাত রেখে বললেন,
— ভীষণ সুন্দর দেখতে তুমি। দূর থেকে নজরে পড়ার মতো। জানো আমার চোখটা বারবার তোমার দিকেই পড়ছিল। ভাবলাম একবার কথা বলা উচিৎ মেয়েটার সাথে। একদম চাঁদের মতো সুন্দর তুমি।
ওনার চোখেমুখে মুগ্ধতা প্রকাশ পেতে থাকল। মুগ্ধ চোখে আমায় নিরীক্ষণ করবার সময় নাকের ব্যান্ডেজটায় ওনার চোখ পড়ল৷ খুব কনসার্ন হয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
— নাকে ব্যান্ডেজ কেন? ব্যথা পেলে কীভাবে?
আমি সত্যিটা একটু ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে বললাম।
তা শুনে উনি ভারী বিরক্ত হয়ে বললেন,
— আজকালকার ছেলেরা ভীষণ ইরিসপন্সিবল। খেলাধুলা করবে দেখে করবে না? পথচারীদের আঘাত লেগে যেতে পারে এটা তো ভাবতে হবে। ভদ্রমহিলার কমেন্টস শুনে আমার চোখ অটোম্যাটিক্যালি ইনতিসারের দিকে চলে গেল। ও কীভাবে যেন হাসছে। খুব আনকম্ফোর্টেবল ফীল করলাম তা দেখে ।
ইনতিসার এতক্ষণ বোবার মত বসে ছিল ওপাশে। এবার উঠে দাঁড়ালো। গলা খাকারি দিয়ে প্যান্টের পকেটে ফোন ঢোকাতে ঢোকাতে ভদ্রমহিলাকে সালাম দিলো। উনি বোধহয় খেয়াল করেননি ওকে। সালাম পেয়ে ঘুরে তাকালেন। অবাক হয়ে বললেন,
— আরেহ ইনতিসার তুমি এখানেই ছিলে?
— জ্বী খালাম্মা।
মৃদু হাসলো ও।
তারপর ভদ্রমহিলার সাথে কুশল বিনিময় শেষে বলল,
— তাহলে আপনারা কথা বলুন আমি একটু ওদিকটায় যাই?
— হ্যাঁ হ্যাঁ যাও। আর মেয়ে তুমি এসো, তোমার সাথে অনেক গল্প আছে আমার।
আমার হাত টেনে ধরে চেয়ারটায় বসিয়ে দিলেন উনি। ইনতিসার আমার দিকে তাকিয়ে আবারও অদ্ভুতভাবে হেসে মাফিনের হাত ধরে চলে গেল। আমি বোকার মত ওদের গমন পথে তাকিয়ে থাকলাম।
_______
(১০)
ভদ্রমহিলার পরিচয় হলো উনি ইশি আপুর হাজবেন্ড তুহিন ভাইয়ের একমাত্র ফুপু। পুরো ফ্যামিলি বিদেশে সেটেল্ড। ফ্যামিলিতে ওনারা হাজবেন্ড,ওয়াইফ আর এক ছেলে, এক মেয়ে। ছেলে প্রিতম, পাইলট। মেয়ে পুনম আমারই সমবয়সী । ছেলে,মেয়ে কেউই আসেনি এখনও। আগামীকাল হয়তোবা আসবে। ওনার কথাবার্তার ধরনে আমার কেন যেন মনে হলো ছেলের জন্য পাত্রী খুঁজছেন। কিন্তু একটা বিষয় মিলছে না। আমার মত অর্ডিনারী মেয়ে কেন ওনার চোখে লাগবে। ওনাদের স্ট্যাটাস কত হাই! ছেলের জবটাও সেরকম। তাদের স্ট্যাটাসের মেয়ের সাথেই তো সম্বন্ধ করার কথা। এসব ভাবতে গিয়ে আমার ভুল ধারণা ভাঙল। কথা বলতে আসলেই যে ছেলের জন্য পছন্দ করবেন এরকম তো কোনো কথা নেই। নিজের বোকামির ওপর হাসি পেলো আমার।
উনি একাধারে বকবক করে চলেছেন। আমি নীরব শ্রোতা ছাড়া আর কিছু নই। বিরক্তিকর লাগলেও শুনছি আর মনে মনে প্রার্থনা করছি ওনার হাত থেকে রেহাই হোক। সেদিন যেমন অনিক সাহেবের থেকে চট করে রেহাই পেয়েছিলাম ঠিক তেমন ভাবে। কিন্তু আজ আমার প্রার্থনা সৃষ্টিকর্তা শুনলেন না। উনি একাধারে নিজের পরিবার, ছেলে-মেয়ের গুনগান গেয়ে যেতে থাকলেন। স্পেশালি ছেলের!
কম সময়ে এত বেশিই কথা বলে ফেললেন মনে হলো গল্প শুনেই ওনার ছেলেকে অর্ধেক মুখস্থ করে ফেললাম। সামন-সামনি দেখা হলে একমুহূর্ত লাগবে না চিনতে।
ওনার এসব পরিবার আর ছেলে সম্পর্কিত গল্প শেষ হলো একটা ফোনকল আসায়। একটু থেমে বিরক্তির সাথে বললেন,
— সময় পেলো না। এখনই ফোন করতে হবে? দেখি তো কে। বিরস বদনে পার্স থেকে ফোন বের করলেন। আমি একবার উঠে যেতে চাইলাম কিন্তু হাতের ইশারায় উনি বসতে বললেন।
মিনিট দুই কথা বলে ফোন রেখে মিষ্টি করে হেসে বললেন,
— আমাকে এবার উঠতে হচ্ছে মেয়ে। জরুরি কাজ পড়ে গেছে। তোমার সাথে আবার কথা হবে ঠিকাছে?
— জ্বী অবশ্যই।
ভেতরে ভেতরে আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লাম। আরও কথা বলবো আমি আপনার সাথে? আপনাকে দেখলে একশো হাত দূরে থাকবো।
— অবশ্য এখন তো ঘনঘন দেখাসাক্ষাৎ, কথাবার্তা হতেই থাকবে। সুমুন্দি হতে যাচ্ছি আমরা।
— জ্বী অবশ্যই।
— আমি কিন্তু ইশির কথা বলিনি। তোমার কথা বলেছি।
হাসিটা বিস্তর হলো ওনার। আমি জোরপূর্বক হাসবার চেষ্টা করে বললাম,
— জ্বী? মানে? বুঝলাম না।
— তোমাকে আমার পছন্দ হয়েছে মেয়ে। আমার প্রিতমের জন্য পারফেক্ট ম্যাচ তুমি।
আমার গালে এক হাত রেখে এমন অপ্রত্যাশিত কথাটা বললেন উনি। আমি তৃতীয় বারের মত বিস্ময়ে বিমূঢ়। তারমানে আমার ধারণাটাই ঠিক ছিল? উনি ওনার ছেলের জন্য আমাকে পছন্দ করেছেন। এজন্যই এতক্ষণ ধরে ইন্টারভিউ নিলেন?
আমাকে বিস্মিত রেখেই উনি উঠে পড়লেন।
— তোমার আপার সাথে শীঘ্রই কথা বলতে আসবো আমি। চাঁদের টুকরো মেয়েটাকে যত তাড়াতাড়ি ঘরে নিয়ে যেতে পারবো ততই আমার শান্তি। ভালো থেকো মা।
মাথায় হাত বুলিয়ে চলে গেলেন উনি।
আমি কোনোরকমে মাথা নেড়ে হতভম্ব হয়ে বসে রইলাম।
______
হাতের কাজগুলো শেষ করে রাতের বেলা আপা আমার ঘরে এলো। তখন আমি পড়ছিলাম। এসেই দরজাটা ভেতর থেকে আটকে দিলো। চোখমুখের এক্সপ্রেশন সিরিয়াস। ইশি আপুর ফুপু শ্বাশুড়ি নিশ্চয়ই যোগাযোগ করেছে ওর সাথে?
কিছু জিজ্ঞেস করতে হলোনা ও নিজেই আমার পাশে বসে বললো,
— বইটা বন্ধ কর। জরুরি কথা আছে।
বিনা বাক্য ব্যয়ে আমি বই বন্ধ করে ওর মুখোমুখি বসলাম। ও প্রশ্ন করলো,
— দুপুরবেলা ভেন্যিউতে গিয়েছিলি?
— হু।
— ইশির ফুপু শ্বাশুড়ির সাথে কথা হয়েছে?
— হু। উনি নিজে এসে কথা বললেন আমার সাথে।
— তাহলে তো জানিস আমি কি ব্যাপারে কথা বলতে এসেছি?
— হ্যাঁ ধারণা করছি।
— ওনারা আজ সন্ধ্যায় কল করেছিলেন আমাকে। ইশির বিয়ের পরপরই সম্বন্ধ নিয়ে আসতে চাইছেন।
— এটা কেমন কথা আপা? আমরা বিয়েতে রাজি কি-না এটা জানারও প্রয়োজন মনে করলেন না উনি? ছেলেকে দেখিনি অবধি!
— হু। আগামীকাল আসছে প্রিতম। ভোরবেলাতেই ল্যান্ড করবে। প্রিতমের আম্মা চায় তুই আগামীকাল বিকেলে ওর সাথে দেখা কর।
— বলিস কি! এমন হুট করে?
— হু।
— পারবো না আপা, কিছুতেই পারবো না। আমি একদমই প্রিপেয়ার্ড নই এসবের জন্য।
— আমিও নিজেও নই। কিন্তু সুমুন্দি হয়, এই মুহুর্তে মুখের ওপর না-ও তো করা যায়না।
— তারমানে তুমি বলেছ আমি দেখা করবো ওনার ছেলের সাথে?
— তাছাড়া আর কি কিছু করার ছিল আমার?
— এটা তুমি একদমই ঠিক করোনি আপা। বিয়েই যদি দেবে তাহলে এত কষ্ট করে লেখাপড়া করাচ্ছ কেন?
— দেখা হলেই কি বিয়ে হয়ে যায়? কে বলেছে তোকে আমি এখনই বিয়ে দিতে চাই? বিয়ে যে কতবড় বোঝা সেটা উপলব্ধি করার পরেও আমি কীভাবে চাইবো তোর ওপর এই বোঝা চাপিয়ে দিতে।
— তবে হ্যাঁ বলেছ কেন?
— অনেক বাধ্যবাধকতা থাকে নীরদ। তুই বুঝবি না। তবে আমার ধারণা প্রিতম তোকে পছন্দ করবে না। আজকালকার ছেলেরা কি আর তোর মতো সাদাসিধে মেয়ে পছন্দ করে? ও ছেলে আবার বিদেশে বড় হয়েছে।
— পছন্দ করবে না এই ধারণাটাও খুব নড়বড়ে আপা। যদি পছন্দ করে ফেলে তখন কি করবো?
— তুই চিন্তা করিস না নীরদ। তোর জীবনটা আমি কখনোই নষ্ট হতে দেবো না এতটুকু ভরসা রাখ। এখন বিয়ের ঝামেলা তাই এর মাঝে নতুন কোনো সমস্যা সৃষ্টি হোক চাচ্ছিনা। যতই হোক এটা আমার শ্বশুরবাড়ি। এতদিনে তো চিনে গিয়েছিস সবাইকে। এরা প্রয়োজনে যেমন আপন করতে পারে, এদের পথে বাঁধার সৃষ্টি হলে তেমনই ছুঁড়ে ফেলতে পারে। শোন, দেখা যেহেতু করতে চাইছে কালকের দিনটা দেখা করে আয়। তারপর না-হয় অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নেয়া যাবে একটা।
— কিন্তু আপা আমার ভয় করছে, নার্ভাস লাগছে।
— ভয় পাসনা নীরদ। আমি আছি তো। আসলে ভুলটা আমারই। তোকে তক্ষুনি হোস্টেলে পাঠিয়ে দেয়া উচিৎ ছিল। কেন যে পাঠালাম না! যাহোক যা হবার হয়ে গেছে, এখন আর এসব নিয়ে ভেবে লাভ নেই। এই বিপদের হাত থেকে কীভাবে রক্ষা পাওয়া যায় সেটা নিয়ে ভাবছি আমি। তুই চাপ নিস না। আমি থাকতে তোর কোনো ভয় নেই।
মাথায় হাত রাখলো আপা। আজকে ওকে খুব অন্যরকম লাগছে। শক্ত খোলসের ভেতরে কোমল মনটায় যে এত মায়া-মমতা। কই আগে কখনও দেখায়নি তো!
আর বারবার বিয়ে মানে জীবন নষ্ট বলছে কেন? ও কি তাহলে ওর সাংসারিক জীবনে সুখী নয়? দুলাভাই কি ওকে ভালোবাসেনা? নাকি ওদের মধ্যেকার ঝামেলাটা কি কোনোভাবে আমায় নিয়ে সৃষ্টি?
চলবে,
sinin tasnim sara