ভালোবাসার রংধনু ৮

0
1485

ভালোবাসার রংধনু

_______________
(১৩)

রাস্তায় পড়ে যাওয়ার দরুন পায়ের ক্ষতটা বেশ গভীরই ছিল। পাজামা অবধি ছিঁড়ে গেছে জায়গাটায়। পাজামা ছেঁড়ার ব্যাপারটা জিনিয়াই আগে খেয়াল করলো। খানিক অবাক হয়ে শুধল,
— পাজামা ছিঁড়লি কীভাবে? এখানে তো দেখছি রক্তও লেগে আছে। অ্যাক্সিডেন্ট করেছিলি?
ওর কথায় আমিও মুখ ঘুরিয়ে দেখলাম। পাজামা ছিঁড়ে কেমন হা হয়ে আছে জায়গাটা।
— উঁহু পড়ে গিয়েছিলাম রাস্তায়। মনে হয় কোনোকিছুর সাথে লেগে ছড়ে গেছে।
— আগে খেয়ালও করিসনি?
— ব্যথা অনুভব করছিলাম। আমলে নেইনি।
— এত কেয়ারলেস তুই! আচ্ছা আয় ঘরে আয় পাজামাটা পাল্টে নিবি আর ক্ষততে ঔষধও লাগাতে হবে।
মাথা নেড়ে আমি বাধ্য মেয়ের মতো জিনিয়ার পিছু পিছু চললাম। সিঁড়িতে যে একটা অদ্ভুত ছেলের সাথে দেখা হয়েছিল এটা কি ওকে জানানো উচিৎ?
— জানিস আমি একটা প্রেম করছি।
আমার ভাবনার মাঝেই জিনিয়া বলে উঠলো। কথাটা শুনে কয়েক সেকেন্ড ওর মুখপানে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলাম। তারপর আস্তেধীরে জিজ্ঞেস করলাম,
— ভালো তো। কবে থেকে?
— এক সপ্তাহ হলো।
— ওহ্।
— ইশশ তোর কোনোকিছুতেই আগ্রহ নেই কেন? জিজ্ঞেস করবি না, কীভাবে হলো! কার সাথে হলো! সবকিছুতেই এত ঠান্ডা রিঅ্যাকশন।
মুখ গোমড়া করলো জিনিয়া। আমি হেসে ফেললাম। হাসতে হাসতেই বললাম,
— জিজ্ঞেস করবো কি না দ্বিধান্বিত ছিলাম। আগে তো কখনও বন্ধু হয়নি তাই এসব ব্যাপার জিজ্ঞেস করা উচিৎ নাকি অনুচিত এ নিয়ে দ্বিধায় পড়ে যাই।
— হ্যাঁ পেয়েছিস ঐ এক বাহানা। কিছু জিজ্ঞেস করতে হবেনা তোকে। নিজে নিজেই বলছি।
ওর নাম অভিক। জগন্নাথে পড়ছে। আমাদের টু ইয়ার সিনিয়র। পরিচয় হলো আমার বাবার এক কলিগের মেয়ের বিয়েতে গিয়ে। কনের কাজিন হয় অভিক।
— তুই তো খুব চ্যুজি ছেলেদের ব্যাপারে। এ ছেলে মনে ধরলো কীভাবে?
আমার প্রশ্নে লজ্জিতভাবে হাসলো জিনিয়া।
— ইন্টারেস্টিং ক্যারেক্টার বুঝলি! চোখে ধরে গেছে একদম। অদ্ভুতভাবে কথাবার্তা বলে। দেখলে মনে হয় দেশান্তরি। এই উদাস হয়ে অতিপ্রাকৃত কথাবার্তা বলছে তো এই স্বাভাবিক হয়ে গানটান গাইছে। গানের গলা কিন্তু হেব্বি।
— তুই ইন্টারেস্টিং ক্যাটেক্টার দেখে দিওয়ানা হলি নাকি গান শুনে?
— দুটোতেই।
আবারও লজ্জিত হাসলো জিনিয়া।
— ছবি টবি কিছু দেখা?
— আচ্ছা দাঁড়া।
ছুটে গিয়ে পড়ার টেবিল থেকে ফোন নিয়ে এলো ও। কত এক্সাইটেড মেয়েটা! অথচ এই মেয়ে একদিন বলেছিল, “এক ব্যক্তির সাথে দীর্ঘ সময় মানুষ কীভাবে থাকতে পারে? ঐ এক নিয়মতান্ত্রিক জীবন বোরিং লাগেনা? আমি তো বাবা কখনোই পারবোনা এসব। আমার দ্বারা হবেনা। নিয়মের অধীনে আমি নেই। আমি হলাম মুক্ত স্বাধীন”
— আমি এই ভেবে খুশি যে রিলেশনশিপ এর প্রতি তোর বিদ্বেষমূলক মনোভাব নেই। দীর্ঘ সময়ের জার্নিটা এখন আর শেকল পরা মনে হবেনা। তাইনা?
— হু। আমরা দু’জন মিলে ঠিক করেছি একে অপরের ব্যক্তি স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করবো না। যদি করি তাহলে ঐ দিনই সম্পর্ক শেষ।
— লাভিউ টাভিউ আগে বলল কে?
— বলিনি তো। কেউ কাউকে বলিনি। না বলেই জানি একে অপরকে পছন্দ করে ফেলেছি।
ফোনটা এগিয়ে দিলো জিনিয়া।
— বাঃ অমন হয় নাকি?
— হয় তো। সবসময় ভালোবাসলে কি জাহির করবার প্রয়োজন আছে?
— প্রেমে পড়ে কত ভারী ভারী কথা বলতে শুরু করলি রে তুই।
— তুইও বলবি একদিন। নে মুখদর্শন কর আমার মানুষটার। বল দেখি কেমন লাগলো?
— দেখছি।
মুচকি হেসে আমি স্ক্রিনে চোখ রাখলাম। সাথেসাথেই মুখের হাসি উবে গেল আমার। আরেহ এ তো ঐ রাস্তার বদ্ধ উন্মাদ ছেলেটা। যে প্রথমে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়ে পরে আমারই দোষ দিল।
একবার ছবির দিকে একবার জিনিয়ার দিকে তাকালাম আমি। ও ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
— কি কেমন দেখতে? জোস না?
আমি কোনোরকমে মাথা নেড়ে বললাম,
— হু। ইন্টারেস্টিং ক্যারেক্টার বটে। আমার এই পাজামা ছেঁড়ার পেছনে তোর এই মিঃইন্টারেস্টিং এরই হাত আছে।
— মানে?
ভ্রু কুঁচকে ফেললো জিনিয়া। বিছানার ওপর ফোনটা রেখে চাপা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আমি বিয়ের ব্যাপারটা চেপে গিয়ে বাকি সব ঘটনা ওকে বললাম। শুনে জিনিয়া খানিক চুপ করে রইলো তারপর হা হা করে হেসে উঠে বলল,
— রাস্তাঘাটে এমন পাগলামি করে নাকি মানুষটা? হিমু হিমু গন্ধ আসছে না ব্যাপারটা থেকে?
তোর গল্প অনেক করেছি ওর সামনে। দেখা করাবো বলেছিলাম। কিন্তু তার আগেই তো দেখা হয়ে গেল, স্ট্রেঞ্জার হিসেবে।
হেসেই চলেছে জিনিয়া। এখানে হিমু হিমু গন্ধ পেলো কই? মেয়েটা দেখছি এক সপ্তাহেই প্রেমে পাগলাটে হয়ে গেছে। বাপরে প্রেম এত ডেঞ্জারাস!
চিন্তা করেই ভেতরে দু’বার চমক খেলাম।
ওর বাড়িতে আসার পর দ্বিতীয় কিম্ভুত ছেলেটার সম্পর্কে আর কিছু বললাম না। দেখা যাবে সেও লতানো পাতানো কোনো সম্পর্কের হয়ে গেল। থাক আমি অত ইন্টারেস্টেড না জানার জন্য।
,
কোনোরকমে আসর পর্যন্তই জিনিয়ার সাথে থাকা সম্ভব হলো। ব্যস্ততা কাটলে যখনই আমার খোঁজ করলেন মাউইমা, তখনই শুনলেন আমি বাড়িতে নেই। সাথেসাথে কল এলো। কল করেই গম্ভীর স্বরে বললেন,
— আমাদের এখনও আপন ভাবতে পারোনি তাইনা মা? পরিবারের একটা গুরুত্বপূর্ণ অকেশান অথচ বাড়ির মেয়ে বাড়িতে নেই। এটা কোনো কথা?
আমি চট করে কি উত্তর দেব ভেবে পেলাম না। অবশ্য আমার এক্সকিউজ দেবার পূর্বেই উনি অভিমানী গলায় বললেন,
— থাক অত এক্সকিউজ ভাবতে হবেনা মা। বাড়ি চলে এসো। তুমি আমাদের আপন ভাবতে না-ই বা পারলে। আমি তোমাকে আমার আরেকটা মেয়ে হিসেবে দেখি। এক মেয়ের বিয়েতে আরেক মেয়ে উপস্থিত থাকবে না। ভাবলেও কষ্ট হচ্ছে।
ইশির হলুদে পরবে জন্য পছন্দ করে একটা শাড়ি কিনেছি। চট করে এসে পড়ো তো। আমার পছন্দ করা কাপড়ে তোমায় কেমন লাগে একটু দেখি।
এত আবেগী কথা শোনবার পরেও কি মনের দরজায় আর খিল দিয়ে বসে থাকা যায়? আমিও মন থেকে ইনতিসার ভয় সহ সব নেগেটিভ চিন্তা ঝেড়ে ফেলে বাড়ি ফেরার সিদ্ধান্ত নিলাম।
ইদানিং নিজের মধ্যে একটা বিষয় লক্ষ্য করেছি। মাউইমা ডাকলে আমি এক দণ্ড চুপ করে থাকতে পারিনা,সাঁড়া দেবার জন্য মনটা ব্যাকুল হয়ে ওঠে আমার। এই অনুভূতি কেবল শ্রদ্ধা থেকে নয় অন্যরকম একটা টান থেকে। মাকে পাইনি তো তাই মায়ের মতো কনসার্ন আমাকে লোভী করে তুলছে । অথচ বেশিদিন এই সান্নিধ্য আর পাবোনা। নাইবা পেলাম! তবে মাউইমাকে আমি কখনোই ভুলব না। আমার মনে সর্বদা তিনি উঁচু স্থানে থাকবেন।
জিনিয়াকে বলেছিলাম দরকার পড়লে রাতটা কাটাতে চাই ওদের বাড়িতে, কোনো সমস্যা হবে কি না! ও বেশ খুশি হয়েছিল শুনে। এখন যখন চলে যাচ্ছি তখন রেগে মুখ গোমড়া করে বলল,
— রাতে থাকবি বললি। মনে মনে কত কিছু করার প্ল্যান করলাম। এখন কল পেয়ে আমার সব প্ল্যান বাঞ্ছাল করে চলে যাচ্ছিস?
আমি ওর হাত চেপে ধরে অপরাধী গলায় বললাম,
— স্যরি রে। না গেলেও তো নয়। খুব আর্জেন্ট বুঝলি না? আজ না হলো একদিন অবশ্যই তোর বাসায় এসে থাকবো প্রমিস।
— উহ্ তোর প্রমিস আমার জানা আছে। বাবা-মা থাকলে তুই জীবনেও আসবি না। আজও আসতি না জানি।
হাত ছাড়িয়ে নিলো ও। আমি আবারও ওর হাত চেপে ধরে কাতর হয়ে বললাম,
— প্লিজ রাগ করিস না। প্রমিস তো, আসবো। আঙ্কেল-আন্টি বাসায় থাকলেও আসবো। সত্যি।
— আচ্ছা যা বিশ্বাস করলাম তোর কথা। কথা দিয়ে কথা না রাখলে তখন বুঝবি। হুহ্
— রাখবো তো বাবা,কথা রাখবো। দেখিস।
— আচ্ছা চল তোকে পৌঁছে দিই গেইট পর্যন্ত।
— গেইটে যেতে হবেনা। লিফট পর্যন্ত দে ওতেই হবে।
— ঠিকাছে চল।
মুচকি হেসে ও ওড়না জড়িয়ে বেরুলো আমার সাথে। লিফট এখন ফাঁকাই।
ওর থেকে বিদায় নিয়ে লিফটে উঠে গেলাম। তিন তলা তো, গ্রাউন্ডে নামতে বেশি সময় লাগলো না। লিফটের মজাই পেলাম না। আক্ষেপ হলো খানিক। তবে আমলে নেয়ার সময় নেই। দেরি হয়ে যাচ্ছে। লিফট থেকে তড়িঘড়ি করে বেরুনোর পথে আবারও ধাক্কা খেলাম একটা। এবার সোজা কপালে লাগলো। মৃদু চিৎকার দিয়ে কপাল চেপে ধরে মাথা তুলে তাকাতেই দেখি তখনকার কবিতা বলা ছেলেটা। সে আমাকে দেখেই দ্রুততার সাথে বলে উঠলো,
— আরেহ্ মিস নীলিমা আবারও আপনি! এই স্যরি এবারের ধাক্কার জন্য হ্যাঁ? আমি একদম দেখতে পাইনি।
ছেলেটার ম্যানার্স আছে। এক পলক তাকিয়ে বেরুতে বেরুতে ক্ষীণ স্বরে বললাম, “ইটস ওকে। পরেরবার থেকে আশপাশ দেখে চলবেন”
— তা অবশ্যই। আপনার বেশি লাগেনি তো?
পেছন থেকে চেঁচাল ছেলেটা। উত্তর দিতে চেয়েও পরে আর দিলাম না।
তড়িঘড়ি করে বেরিয়ে রিকশা নিলাম। কোনোদিকে তাকানোর সময় নেই। মাউইমা ডেকেছেন, জলদি যেতে হবে।
____________________
(১৪)

বাড়ি ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। আবারও জ্যামে পড়েছিলাম হালকা। ভাড়া শেষ হয়ে গেছিল, পরে আপাকে ডেকে ভাড়া মেটালাম। আপা মুচকি হেসে শুধলো,
— বেড়িয়ে ভালো লাগলো?
— হু অনেক।
— কোথায় গিয়েছিলি?
— আমার ফ্রেন্ড জিনিয়ার বাড়িতে।
— ভালো করেছিস। খাওয়াদাওয়া হয়েছে ওখানে? নাকি খাবি এখন?
— নাহ্ খাবোনা। খেয়ে এসেছি।
— আচ্ছা যা ভেতরে যা। আমি একটু এদিকটা দেখি।
আমাকে বাড়ির ভেতর পাঠিয়ে আপা ভ্যেনিউয়ে চলে গেল। আপা সাধারণত আমার সাথে হেসে হেসে কথা বলেনা। আজ সত্যিকার অর্থেই ও খুশি, কত হাসছে! ব্যাপারটা ভেবে ভালো লাগলো। কিন্তু ওকে মেহেদি পরাবো ভেবেছিলাম। কিনতেই তো ভুলে গিয়েছি তাড়াহুড়োয়। চট করে মন খারাপ হয়ে গেল আমার।
এখানে আর দাঁড়িয়ে না থেকে ভেতরের দিকে পা বাড়ালাম। কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে বাড়ির নকশা পাল্টে গেছে। এত ফুল, লাইটিং।এই না হলো বিয়ে বাড়ি!
কাঁচা ফুলের মিহি সুবাসে চারিদিক ম ম করছে। বিয়ে বাড়ি মানেই ফুলের ছড়াছড়ি। ব্যাপারটা খুবই আনন্দদায়ক। ফুল জিনিসটাই আনন্দদায়ক। এর সুরভি নিমেষে বিষণ্ণ মনকে তরতাজা করে দেয়।
বাড়িতে ঢোকার মুখে মাফিনের সাথে দেখা হলো। আমাকে দেখেই ছুটে এলো ও। হাত টেনে ধরে বলল,
— তাম্মি কই ছিলে সারাদিন? দাদুমনি কত্ত খুঁজলো তোমায়।
— কাজে গিয়েছিলাম যে। এত খুঁজলো কেন?
— বাঃ সবাই কত মজা করে মেহেদি দিলো। আমিও দিয়েছি দেখো। শুধু তুমিই দিলেনা। খুঁজবে না?
— আমার যে ইম্পর্ট্যান্ট একটা কাজ ছিল।
— আচ্ছা সমস্যা নেই। মা তোমাকে রাতে দিয়ে দেবে। আমি একটা মেহেদি সরিয়ে রেখেছি তোমার জন্য।
— আরে বাপরে। তাই? মেহেদি সরিয়েছ তুমি আমার জন্য। এত বুদ্ধি কোথায় পেলে?
— পেয়েছি আরকি। এখন চলো তো দাদুমনির ঘরে যাবে।
হাতে টান দিল ও।
— হ্যাঁ চলো।
আলতো হেসে ওর সাথে পা বাড়ালাম মাউইমার ঘরের দিকে।
আগে কখনো মাউইমার ঘরে যাওয়া পড়েনি। চার দেয়ালটাই তো আমার জগৎ। এর বাইরে পা রাখার আগ্রহ কখনো জন্মায়নি। তবে আজকের ব্যাপারটা অন্যরকম। ভয় ভয় করে তাই গেলাম।
মাউইমা ঘরেই ছিলেন। ইশি আপুর তত্ত্ব না কি যেন ওগুলো দেখছিলেন সব। আমায় দেখে মিষ্টি করে হাসলেন।
— অবশেষে এলে তুমি?
আমিও পাল্টা হেসে মাথা নাড়লাম।
— হাতে সময় নেই। জলদি শাওয়ার নিয়ে তৈরি হয়ে এসো তো। শাড়ি পরতে পারো?
শাড়ির প্যাকেট এগিয়ে দিতে দিতে শুধলেন উনি।
আমি না বোধক মাথা নেড়ে বললাম,
— পারিনা।
— আচ্ছা সমস্যা নেই। আমি বউমাকে বলছি ও পরিয়ে দেবে। তুমি শাওয়ার নিয়ে নাও কেমন?
— জ্বী।
ব্যাগ হাতে বাইরে বেরিয়ে এসে দেখি ইনতিসার খুব ব্যস্ত হয়ে ছোটাছুটি করছে। সিঁড়ির কাছে তাকে দেখলাম। ব্যস্ততায় সে দেখতে পেলোনা আমায়। ভাগ্যিস!
গা বাঁচিয়ে ঘরে চলে এলাম।
খুব ক্লান্ত লাগছে, সাথে পায়ের ব্যথাটা বেড়েছে যেন। ঔষধের রিঅ্যাকশন এত জলদি কমে কীভাবে?
মনটা বিছানা বিছানা করছে। ঘর অন্ধকার করে দু চার ঘণ্টার একটা ঘুম হলে দারুণ হত। কিন্তু সে সুযোগ নেই।
কোনোরকমে ব্যাগ রেখে, ফোন চার্জে দিয়ে ছুটে বাথরুম ঢুকলাম।
ঠান্ডা পানি শরীর স্পর্শ করার পরেই যেন একটু শান্তি লাগলো। তবে সে শান্তিও বেশিক্ষণ রইলো না। দশ মিনিটও হয়নি আপা এসে বাথরুমের দরজায় বাড়ি দিতে শুরু করলো, সাথে ডাকাডাকি। দৌড়ের ওপর গা ভিজিয়ে বেরুতে হলো। আপা ধমকের সুরে বলল,
— শাড়িও পরতে শিখিসনি। ইশ আমার কত কাজ না বাইরে! তোকে এখন শাড়ি পরাতে কতগুলো সময় নষ্ট হবে।
আমি মন খারাপ গলায় বললাম,
— আগে তো শাড়ি পরার সুযোগই হয়নি। হলে শিখে নিতাম।
— হয়েছে আয়। মা যে কেন আবার শাড়ি কিনতে গেল তোর জন্য! জামা কিনেছিলাম আমি।
— তুমি আবার জামা কিনতে গেলে কেন খামোখা?
— কিনতে হয়। তুই বুঝবি না। নে জলদি ব্লাউজ, প্যাটিকোট পরে আয়।
শপিং ব্যাগ থেকে শাড়ি বের করতে করতে বলল আপা।
গাঢ় হলুদ তসরের শাড়ির সাথে খয়েরী মত একটা ব্লাউজ। পরে খুব আরাম লাগলো আমার। একদম ফিট। মাউইমা বডি মেজারমেন্ট বুঝলেন কি করে? অদ্ভুত।
কাপড় দুটো পরে আসতে আসতে আপাকে শুধলাম,
— দেখো আপা ব্লাউজটা কেমন ফিট হয়েছে। মাউইমা আমার ঠিক মাপটা বুঝলেন কীভাবে?
প্রশ্ন শুনে কীভাবে যেন তাকালো আপা। তারপর বলল,
— তুই যে ঢ্যাঁড়শের মতো চিকন। মার্কেটের সব ছোট সাইজের কাপড় তোর ফিট।
— ইশশ আমি অত চিকনও না।
— নিজের চোখে তো হবিনা। আমাদের চোখ দিয়ে দেখ।
হাত ধরে টেনে নিয়ে শাড়ি পরাতে শুরু করলো আপা। আমিও সুযোগ পেয়ে তার সাথে গুটুর গুটুর গল্প করলাম।
শাড়ি পরানো শেষে সে একে একে আমার চুল শুকিয়ে আঁচড়ে দিলো, সাজিয়েও দিলো।
কলেজে থাকা অবস্থায় মেকআপ আর্টিস্ট হবার শখ ছিলো আপার কিন্তু বাবা সমর্থন করেনি। বড়পা বলেছিল নাকি হেল্প করবে কিন্তু পরে তো বিদেশে চলে গেল। মেজোপা বোনেদের শখ আহ্লাদ নিয়ে অত কনসার্ন নয় তাই তারও সাড়া ছিল না। আর দুলাভাইয়ের বাড়িতে আসার পর তো মনে হয় ওর নিজ ইচ্ছেও উবে গেছে।
আহারে এক জীবনে বোনটার আমার স্বপ্ন পূরণ করা হয়নি।
ওর সাজানোর হাত খুব ভালো। মেকআপ সৌন্দর্য ফোটাতে পারে আর্টিস্টের হাতের কামালে।
আপা আমাকে সাজিয়ে স্বস্তি পায়। চুপচাপ পুতুলের মতো বসে থাকি। আমার স্কিনেও সব স্যুট করে। কোনোই সমস্যা নেই।
ঘণ্টাখানেকের ঘষামাজা শেষে আপা তৃপ্তি নিয়ে তাকায় আমার দিকে। বলে,
— আয়নায় দেখ তো কেমন লাগছে?
আপার কথায় আমি আয়নায় দৃষ্টি রাখি। আড়ালে রাখতে চাওয়া আমার রূপ টেনে বের করে এনেছে আপা। মুগ্ধ হয়ে যাই নিজেকে দেখে।
আপা সব গুছিয়ে রাখতে রাখতে বলে,
— তুই একদম মায়ের মতো সুন্দর হয়েছিস নীরদ। যে কাপড়ই পরিস, যে সাজই দিস তোকে সুন্দর লাগে। মেয়ে মানুষই তোকে দেখে মুগ্ধ হয়ে যায়।
আমি আপার কথায় চমকাই। এত প্রশংসা ও আগে করেছে আমার? ভাবতে গিয়ে লজ্জা লাগে।
ও যেন বুঝতে পারে ঘোরেই কত কথা বলে ফেলেছে। চট করে নিজের গাম্ভীর্য টেনে আনে মুখে।
— খবরদার চশমা পরবি না আজ।
— চশমা ছাড়া তো দেখতেই পারবো না আপা।
সাথে করে নে কিন্তু ছবি তোলার সময় পরে থাকবি না।
— আজ তুমি আমায় আছাড় খাওয়াবে দেখো।
— মাফিনের হাত ধরে ধরে ঘুরবি।
মুচকি হেসে বলে আপা।
— ওকে ডেকে দাও তুমি।
— আচ্ছা দিচ্ছি। বসে থাক ঘরে ও আসলে যাস। কেমন?
— হু।
আপা বেরিয়ে যায় মাফিনকে ডাকতে। আমি উঠে গিয়ে ফোনটা হাতে নেই। ফোন চাপা ছাড়া এখন আর কোনো কাজ আছে?
ফোন আনলক করতেই দেখি মেসেজ এসেছে। ইনতিসারের নম্বর থেকে। বুকটা ধ্বক করে ওঠে আমার। শুকনো ঢোক গিলে ভয়ে ভয়ে মেসেজটা ওপেন করি। লিখেছে,
“আবারও আমায় ইগনোর করলে নীরদ? এর শাস্তি তুমি পাবে। খুব ভালো করেই চেনো তো আমাকে তাইনা?”
মেসেজ পড়ে হাত কেঁপে ওঠে আমার। আল্লাহ কেন ফিরে এলাম আমি? আজকের রাতটা জিনিয়ার ওখানে কাটাতে পারলেই তো হত।
__________
(১৫)

ভ্যেনিউতে যাওয়ার পর ইনতিসারের সামনে যেন না পড়তে হয় তাই গা বাঁচিয়ে চলছি খুব। মাফিনকে বলে দিয়েছি সেইফ কোনো জায়গা খুঁজতে। আড়ালে কোথাও। ওখানে খুঁটি গেঁড়ে বসবো আর এক চুল নড়বো না। মাফিন বাধ্য ছেলের মতো আমার আদেশ পালন করছে।
আমি এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে আছি একটু বাইরের দিকে। ইনতিসারকে এখন পর্যন্ত তো দেখিনি। সামনেও যেন না আসে।
— তুমি বাইরে কি করছো মেয়ে?
আচমকা মহিলা কণ্ঠে চমকে ফিরে তাকাই। আমার না হওয়া শ্বাশুড়ি। জোরপূর্বক হেসে বলি,
— আপাকে খুঁজছিলাম আন্টি।
উনি আমার হাত চেপে ধরে বাইরে টেনে আনেন। গলাটা খাদে নামিয়ে বলেন,
— আজকের বিষয়টার জন্য আমি খুব লজ্জিত। তুমি মাইন্ড করবে না যেন! ছেলেটার যে এত রাগ একদম বুঝতে পারিনি।
— ইটস ওকে আন্টি। ভুল তো আমারও ছিলো। অত লেইট করা একদমই উচিৎ হয়নি।
— কোনোই ভুল নেই তোমার। জ্যামে তোমার হাত আছে নাকি? জানো ছেলের অমন হঠকারী সিদ্ধান্তে রেগে গিয়েছিলাম আমি। বকে দিয়েছি ভালো মতো। এখন আবারও দেখা করতে রাজি হয়েছে, স্যরিও বলবে বলেছে । তাই তো নিয়ে এলাম ওকে এবাড়িতে। তোমাকেই খুঁজছিলাম এতক্ষণ বুঝলে! তুমি কিন্তু মা রাগ করবে না কেমন? ছেলেটা এমনিতে সোনার টুকরো। নিজের ছেলে বলে বলছি না। ওর মতো ছেলে আর দু’টো হয়না। তুমি খুব সুখী হবে ওর সাথে।
আমার গালে হাত বুলিয়ে বললেন আন্টি।ওনার কথা শুনে আমার রক্ত হিম হয়ে উঠলো। মনে হলো পাখির ন্যায় আকাশে উড়তে গিয়ে দূর্ভাগ্যে শিকারির খপ্পরে পড়ে গেছি। এখন আমাকে আর কেউ বাঁচাতে পারবে না, খাঁচায় বন্দী হতেই হবে।
সারাদিন বৃথাই বিয়ে ভাঙার আনন্দ উদযাপন করলাম। চোখের কোণে পানি চলে এলো একদম। ইতিউতি চোখ বুলিয়ে আপাকে খুঁজতে চেষ্টা করলাম। আমি কোনোভাবেই ঐ লোকটার সাথে দেখা করবো না। মরে যাব তবুও না।
— কই চলো?
হাত চেপে ধরে ভেতরে যেতে উদ্যত হলেন আন্টি। আমি দূর্বল অথচ নড়লাম না এক পা। মুখ দিয়ে একটা শব্দ বেরুচ্ছে না। তবুও কিছু বলবার চেষ্টা করবো ঠিক সেই মুহুর্তে একটা ঠান্ডা হাত স্পর্শ করলো আমার অপর হাতটা। বজ্রমুষ্ঠিতে শক্ত করে চেপে ধরলো আমার কবজি। ফিরে তাকাতেই দেখলাম ইনতিসার। চোখমুখ কঠোর করে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। এবার যেন নিঃশ্বাসটাই বন্ধ হয়ে যাবে আমার।
আন্টি বললেন,
— আরে ইনতিসার তুমি?
একটু অন্ধকার থাকায় ও যে আমার হাত ধরেছে বিষয়টা বুঝতে পারেননি আন্টি।
ইনতিসার আমার হাতটা আরেকটু শক্ত করে চেপে ধরে বলল,
— স্যরি খালাম্মা নীরদ এখন আপনার সাথে যেতে পারবে না। ওকে আমার সাথে যেতে হবে।
— কেন? কোনো কাজ আছে?
— হ্যাঁ একটা বোঝাপড়া আছে।
আমার চোখে চোখ রেখে বলল ও। এই যে সিনক্রিয়েট শুরু করে দিয়েছে। আমি হাতটা ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা করলাম। কিন্তু একটুখানিও নড়াতে পারলাম না। চোখের পানিও আটকালো না এবার। সীমানা ছাড়িয়ে ঠিক গড়িয়ে পড়লো। আন্টি ভারী অবাক হয়ে বললেন,
— মানে!
সে প্রশ্নের উত্তর দেবার প্রয়োজন মনে করলো না ইনতিসার।
— এগেইন স্যরি।
বলে এক ঝটকায় আমাকে টেনে নিলো। তারপর এক মুহুর্ত অপেক্ষা না করে দ্রুত পায়ে বেরিয়ে যেতে লাগলো কোথাও একটা। আমি ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলাম আর নিজেকে ছাড়াতে চেষ্টা করতে থাকলাম। পেছন থেকে আন্টি “এ্যাই ইনতিসার ওকে কই নিয়ে যাও”
চেঁচাতে চেঁচাতে আমাদের পিছু পিছু আসতে লাগলেন। ইনতিসারের কোনোদিকে কান নেই। ও আমাকে হিড় হিড় করে টেনে নিয়ে চলেছে। মনে হচ্ছে হাতটাই টেনে খুলে ফেলবে আজ। তবে ব্যথার চাইতে ভয় পাচ্ছি বেশি। ওর পাগলামির কারণে আজই না আমার এ বাড়িতে শেষ দিন হয়!
ও টানতে টানতে সোজা বাড়ির পেছনে নিয়ে এলো। এখানে আলো প্রায় নেই বললেই চলে। কারোর চেহারা স্পষ্ট দেখবার মতো তো নয়ই। পেছন দিকটায় একটা উঁচু দেয়াল ছাড়াও আর কিছু নেই। ওদিকটায় নিয়ে গিয়ে ও আমায় একদম দেয়ালের সাথে চেপে ধরলো।
আমি কিছু বলার ভাষাই পাচ্ছি না এতটা ভয় পেয়ে আছি।
ওদিকে এখনও আন্টির ক্ষীণ গলা শোনা যাচ্ছে । উনি এখনও খুঁজছেন আমাদের। ভাবলাম ওনার মাধ্যমেই একমাত্র বাঁচতে পারি। যা হয় হোক এখন ওনাকে ডাকতে হবে আমার। কান্না থামিয়ে মন শক্ত করে যখনই আমি আন্টিকে ডাকতে যাব ঠিক ঐ মুহুর্তে, ঐ মুহুর্তে ইনতিসার আমার কবজি ছেড়ে বাহুর কাছটায় শক্ত করে চেপে ধরে নিজের খুব কাছে টেনে নিলো এবং সেকেন্ডও অতিবাহিত না করে অন্য হাতে চুলের গোড়া খামচে ধরে তার ধারালো দাঁত গুলো দিয়ে ভীষণ জোরে কামড়ে ধরলো আমার দু ঠোঁট। যন্ত্রণায় ছটফট করে উঠে আমি ওর পাঞ্জাবির হাতা শক্ত করে চেপে ধরলাম। এটাই করতে চেয়েছিল ও, এতবড় সিনক্রিয়েটটাই আমার শাস্তি। এর চাইতে মেরে ফেলল না কেন আমায়?

চলবে,
sinin tasnim sara

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here