কাঞ্চাসোনা #১৩,১৪

0
1660

#কাঞ্চাসোনা
#১৩,১৪
#জাকিয়া_সুলতানা_ঝুমুর
১৩

সকালের জ্বর ভালো হলো।তার শাশুড়ী গতকাল আসবে।ধ্রুব এখন আগের চেয়েও বেশি জ্বালায়।সারাদিন পিছে পিছে ঘুরে।একদন্ড সকালকে একা ছাড়ে না।এই যে রান্না করার সময়ও কাছে দাঁড়িয়ে থাকবে,ফু দিয়ে সকালের চুল উড়াবে,যখন তখন বেনী ধরে কাছে টানবে।আর সাথে তো উল্টাপাল্টা আবদার আছেই।ধ্রুবর এই পাগলামি,আগোছালো কাছে টানা সকালের খুব ভালো লাগে,সব মেয়েইতো এমনি হাজবেন্ড আশা করে।যে কিনা ভালোবাসে,ভালো রাখে।সকালের মনে হয় সব ছেলেদেরই এমন পাগল পাগল ভাব থাকা উচিত,সবার সামনে না হোক বদ্ধ ঘরেই এমন পাগলামি করুক।মেয়েদের সুপ্ত মনে নিজেরা নরম পাখির বাসা বানিয়ে নেক।

বিয়ের প্রায় দুই মাস হতে যাচ্ছে ধ্রুব নিয়মিত অফিসে যায়।হাজারো ব্যস্ততার মাঝেও সকালকে সময় দেয়ার চেষ্টা করে।আগে অফিস থেকে এসে মোবাইল হাতে নিতো।এখন এই সময়টা সকালের জন্য বরাদ্দ রাখে।তার মনে হয় সম্পর্ক ভালো রাখার জন্য দুজন দুজনকে সময় দেয়া খুব প্রয়োজন।ফিজিক্যাল হলেই যে সম্পর্ক মজবুত হয় এমনটা না। সম্পর্ক মজবুত করতে হলে দরকার মনের সম্পর্ক আত্মার সম্পর্ক।আর এই সম্পর্ক গুলো তৈরি করার জন্য দরকার একে অপরকে সময় দেয়া।একে অপরের আস্তা ভরসা হওয়া।এই যে সকালের ছোট ছোট আহ্লাদগুলো তাকে হাসায়।অভিমানী চোখে যখন ধ্রুবকে দেখে তখন ধ্রুব অভিমান ভাঙ্গায় আর মনে মনে হেসে খুন হয় এটা ভেবে যে একটু আদর আদর কথা বললেই যে পাখির অভিমান কমে যায়!একটু জড়িয়ে ধরলেই যে কান্না থেমে যায়।এই অল্পদামি শাড়ি চুড়িতেই গাল ভরে হাসে।এটুকু পাওয়াতেই কেন এতো খুশী মেয়েটা!

সকালের রেজাল্ট দেয় সে ফোর পয়েন্ট সেভেন ফাইভ পেয়েছে।সবাই খুব খুশী হয়।
সকালের বাবা আসে সকাল আর ধ্রুবকে নিতে বিয়ের পরে একবারো যাওয়া হয়নি।ধ্রুব যেতে পারবে না তার এখন ছুটি নেই।ঠিক করা হলো সকাল তার বাবার সাথে গিয়ে কয়েকদিন থাকার পরে ধ্রুব গিয়ে নিয় আসবে।ধ্রুব কথাটা শুনে মন খারাপ হয়,আড়চোখে সকালকে দেখে সকালও তার দিকেই তাকিয়ে আছে।ধ্রুব চোখের ইশারা করে রুমে যায়,
সকাল রুমে গেলে টেনে কোলে বসিয়ে গলায় মুখ গুজে চুপচাপ বসে থাকে।এতো দিন হয়ে যাচ্ছে বিয়ের কিন্তু ধ্রুব এখনো স্পর্শ করলে শরীরে শিহরণ বয়ে যায়।লজ্জারা কতো তাজা!ছোঁয়াটা কতো পবিত্র!সকাল ধ্রুবর মাথায় হাত ভুলিয়ে,মাথা উচু করে ধ্রুবর নাকের সাথে নিজের নাক দিয়ে হালকা ধাক্কা দিয়ে খিলখিল করে হাসে।ধ্রুব হাসে না চুপ করে তাকিয়ে আছে।সকাল আদর আদর গলায় বললো,
“কি হলো? ”

ধ্রুব নাক ফুলিয়ে বললো,
“বুঝতে পারছো না?”

সকাল বুঝতে পারছে,তারপরেও ধ্রুবকে রাগাতে বললো,”না।”

ধ্রুব মন খারাপ করে বললো,
“না করে দাও।বলো যে এখন না পরে যাবে।”

সকালের মনও খারাপ হয়।কি করে থাকবে এই মানুষটাকে ছেড়ে?আবার গ্রামে যেতেও মন চাইছে।

ধ্রুব বুঝতে পারছেনা তার এতো খারাপ লাগছে কেন।মনে হচ্ছে মেয়েটা কাছে না থাকলে সে মরেই যাবে।সকাল গলায় জড়িয়ে ধরে।
“আমি তো মাত্র দুইদিন থাকবো।”

“যা ইচ্ছা করো।”

“কি করবো?”

ধ্রুব কিছু বলে না।চুপচাপ অফিসে যাওয়ার জন্য রেডি হয়ে যায়।রেডি হয়ে সবাইকে বলে যায় শুধু সকালকে ছাড়া।সকাল মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে দেখে।মনোয়ারা সকালকে ডেকে কাছে নেয়।
“কোন সমস্যা হয়েছে সকাল?”

ধ্রুবর রাগ খুব ঠান্ডা মাথায় চলে,এটা সকাল বুঝতে পেরেছে।সে আমতা আমতা করে বললো,
“মা,আসলে উনি চাইছিলেন আমি উনার সাথেই যাই।প্রথমবার তো একা একা গেলে…..”

মনোয়ারা ব্যাপারটা বুঝতে পারে।সকালের বাবাকে বুঝিয়ে বললে তিনিও বুঝেন।সকাল গেলো না।সারাদিন ধ্রুব একবারো ফোন দেয়নি।সকালের খুব অভিমান হয়।
গেলো কি না এটাও তো জিজ্ঞেস করতে পারতো।অভিমানে,রাগে সন্ধ্যায় রুম অন্ধকার করে বিছানার এককোনে বসে থাকে।

ধ্রুবর সারাদিন মন বিষিয়ে থাকে।বউ চলে গেছে আর সে কিনা বসে বসে অংক করছে!আজকে বাসায় যেতেও মন চাইছে না,বউ নেই শান্তিও নেই।আজকে বাসায় গিয়ে হাসির রিনিঝিন,লজ্জার বহর আর দেখা হবেনা।তারপরেও ধ্রুব বাসায় যায়।নিজের রুমে গিয়ে তার মনে হয় একরাশ শূন্যতা আঁকড়ে ধরে আছে।প্রতিদিন অফিস থেকে আসলে বউটা এটা সেটার বাহানায় আশেপাশে ঘুরঘুর করতো।আজকে নেই!অন্ধকার রুমে দাঁড়িয়ে তার মনে হয় পিচ্ছিকে ছাড়া থাকা অসম্ভব।বিয়ে করে এই কোন জ্বালা হলো?ব্যাগটা বিছানায় ছুড়ে ফেলে ধ্রুব খুব কষ্ট কষ্ট গলায় গেয়ে উঠে, ❝আমি ফাইসা গেছি,আমি ফাইসা গেছি মাইনকার চিপায়❞

ধ্রুবর এমন গান শুনে সকাল নিজের অভিমান ভুলে খিলখিল করে হেসে উঠে।
প্রিয় হাসি,প্রিয় মানুষের উপস্থিতি টের পেয়ে ধ্রুব লাইট জ্বালায়,সকালকে দেখে এগিয়ে এসে বললো,
“তুমি যাওনি?!

সকাল হেসে বললো,
“না আমার বরকে মাইনকার চিপায় দেখার জন্য থেকে গেছি।”

ধ্রুবও হেসে দেয়।সকালকে জড়িয়ে ধরে বললো,
“বউ থাকলে কি আর এই গান গাই?”

তারপর চকাস করে কয়েকটা চুমু দিয়ে বললো,
“কেন যাওনি?”

সকাল আবার অভিমানী হয়।ঠোঁট ফুলিয়ে বল,
“আপনি রাগ করে চলে গেলেন।গেলে শান্তি পেতাম নাতো।”

ধ্রুব হাসে।তার বউটা তাকে বুঝে।একটু রাগ করেছে তাই যায়নি।কানের কাছে মুখ গুজে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললো,
“তাইতো এতো ভালোবাসি।”

ধ্রুবর হাবভাব ভালো না দেখে সকাল বললো,
“ঘামযুক্ত শার্ট নিয়ে বউকে ধরা যায় না।”

ধ্রুব কোমড়ের বাধন শক্ত করে বললো,
“বর চাইলে সব করা যায়।”

সকাল ছুটে চলে যেতে নিয়েও পারে না,কাকে বুঝাবে?এই পাগলকে?যে কিনা সকালের সানিধ্যে এলে ছোট ছেলে হয়ে যায়।সকাল আবেশে চোখ বন্ধ করে।
ধ্রুব সে তো অগোছালো কাজের জন্যই এক্সপার্ট,মূহুর্তের মাঝেই সকালকে অগোছালো করে দেয়।নিজেও অগোছালো রাজ্যে শিকারের খুঁজে বেরিয়ে পড়ে।

আজকাল সকালের কেমন জানি লাগে,হঠাৎ করেই শরীর ঝিমিয়ে উঠে,চোখ চেপে বন্ধ হয়ে আসে।দুই দিন ধরে খাবারও খেতে পারছেনা।মনোয়ারা বিকেলে সকালের ঘরে আসে সকাল তখন বাথরুমে বমি করছে,বাথরুম থেকে আসার পথেই পিছলে পড়ে যায়।মনোয়ারা ধরে রুমে আনে,সকালের শরীরের অবস্থা উনার চোখ এড়ায়নি।এখন বমি করাতে সন্দেহ প্রবল হয়।সকালের হাত ধরে বললেন,
“সকাল আম্মু,কবে থেকে বমি হচ্ছে?”

সকালের চোখ ডুলডুল করছে।মাথা নেড়ে বললো,
“দুই দিন ধরে।”

মনোয়ারা জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বললো,
“ধ্রুব কি দেখেনি?শরীর যে খারাপ?”

“মা,সকালে আর দুপুরেই বেশী খারাপ লাগে,রাতে ভালই লাগে।আমিই বলি নি উনাকে।তাই জানে না।”

মনোয়ারার মন কু ডাকে,এখন যে পিছলে পড়লো?

মনোয়ারা তখনি সকালকে বগলদাবা করে ছুটলেন হসপিটালে।ঘন্টাখানেক পরে মনোয়ারা হসপিটালের কড়িডোরে বসে আছেন।ইউরিন আর আল্ট্রাসাউন্ড করে রিপোর্ট হাতে পেয়ে মাত্রই ডাক্তারের চেম্বার থেকে আসলেন।কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম ঝড়ছে।ধ্রুবকে ফোন করা হয়েছে।সকালকে পিছলে পড়ার জন্য কেবিনে ওষুধ দেয়া হচ্ছে।ধ্রুব তখনি এলো।
মাকে দেখে বললো,
“আম্মা কি হয়েছে?সবাই ঠিক আছো তো?”

মনোয়ারা যেন তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে।চিবিয়ে চিবিয়ে বলে,
“তোকে এতো বড়ো বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়িয়ে কি লাভ হলো?গাধার বাচ্চা গাধা”

মায়ের হঠাৎ বকাঝকার কারন ধ্রুবর বোধগম্য হয় না।আশেপাশের সবাই মাথা ঘুরিয়ে তাকে দেখছে।মুখ কালো করে বললো
“আমি কি করেছি আম্মা।এতো লোকের মাঝে বাপ নিয়ে গালি দিচ্ছো কেন?”

“খুব না লাফিয়েছিলি আমি বাচ্চা মেয়ে বিয়ে করিয়ে দিয়েছি।”

ধ্রুব কি বলবে বুঝে না।আজকে আবার কি হলো?
“কি হয়েছে আম্মা?”

ধ্রুবর দিকে অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললো,”গাধা।”

ধ্রুব কিছু বলবে তার আগেই মনোয়ারা বলেন,
“বউয়ের শরীরের দিকে খেয়াল রাখা যায় না?আমি আজকে যদি না যেতাম তখন কি হতো বল তো?এই অবস্থায় পিছলা খেয়ে বসে আছে।”

ধ্রুব ভ্রু কুচকে বললো,
“এই অবস্থায় মানে?”

মনোয়ারা হাতের রিপোর্ট ধ্রুবর কাছে দিয়ে বলেন,
“লেখাপড়া কাজে লাগা।নে।”

এটা বলে উনি বিল দিতে যায়।ধ্রুব ইউরিন টেস্টে স্পষ্ট দেখে পজিটিভ লেখাটা।আল্ট্রার রিপোর্টে লেখা ❝ফাইভ উইক প্রেগ্ন্যাসি,এন্ড টু ফিটাস।❞

ধ্রুব ধপ করে চেয়ারে বসে পড়ে।কিভাবে সম্ভব?আয় হায় এই মুখ সবাইকে কিভাবে দেখাবে?খুব লাফা লাফি করেছিলো বাচ্চা বউ বাচ্চা বউ করে এখন এই বাচ্চার পেটেই কিনা দুই বাচ্চা!ভাবা যায়!ধ্রুবর বুক ধরফর করে কাপেঁ।গলা শুকিয়ে কাঠ কাঠ।ধীরপায়ে উঠে কেবিনে যায়।সকাল বিছানায় শুয়ে আছে। ধ্রুব মাথা চুলকে পাশে গিয়ে বসে।ছোট্টখাটো শরীরে কিনা দুইটা বেবী!!টুইন!ধ্রুবর মনে হচ্ছে সে অজ্ঞান টজ্ঞান হয়ে পড়ে যাবে।বাচ্চার পেটে দুই বাচ্চা!

চলবে…..

#কাঞ্চাসোনা
#১৪
#জাকিয়া_সুলতানা_ঝুমুর

বাসায় এসে মনোয়ারা জানায় এখন থেকে সকাল উনার সাথে থাকবে।এমন দায়িত্বহীন ছেলের কাছে বউ রাখা উচিত না।কখন কোন দূর্ঘটনা ঘটে যায়!ধ্রুব চোখ বড় বড় করে বললো,
“আম্মা এটা ঠিক না।বউটা আমার।”

মনোয়ারাও কম না।খুচানোর সুযোগ পেয়েছে ঠেস মেরে বললো,”বাচ্চাটা আমার।”

ধ্রুব চোখ খিচে বন্ধ করে নেয়,অহ আবার সেই বাচ্চা!সকালের দিকে তাকিয়ে বললো,
“সকাল রুমে চলো।”

সকাল অসহায় চোখে স্বামী আর শাশুড়ীকে দেখে।
মনোয়ারা তেতে উঠে বলে,
“যদি কিছু হয় খবর আছে।”

ধ্রুব কিছু না বলে মুচকি হাসে।সকালের হাত ধরে রুমে যায়।

সকালকে বিছানায় বসিয়ে ধ্রুব ফ্লোরে বসে।তারপর সকাল আর ধ্রুব একে অপরের দিকে তাকিয়ে ফিক করে হেসে দেয়।ধ্রুব মাথা নাড়িয়ে বলে,
“এটা কিভাবে হলো?”

সকাল অবাক হওয়ার ভান করে বললো,
“কিভাবে মানে?”

“মানে এতো সতর্কতার পরেও কেমনে কি ভাই?”

সকাল মুচকি হেসে বললো,
“আপনি অনভিজ্ঞ লোক তাই এই অবস্থা।”

ধ্রুব ভ্রু নাচিয়ে বললো,
“মোটেও আমার কোন দোষ নেই।সব দোষ তোমার।আর বাচ্চার পেটে আবার বাচ্চা আসবে কেন?”

“তাদের আসার অনেক তাড়া।তাই কোন বাধা মানতে রাজি না।”

ধ্রুব সকালের উজ্জ্বল মুখের দিকে তাকায়।খুশীর ঝিলিক চুয়ে চুয়ে পড়ছে।সকালকে একটু বাজিয়ে দেখার জন্য বললো,
“সকাল তুমার বয়স খুব কম।এই অবস্থায় দুই বেবি ঠিক না এক কাজ করি এভোরশন করে ফেলি।”

মূহুর্তেই সকালের দুই চোখে পানি টলমল করে হাত আপনা-আপনি পেটে চলে যায়।ফুপিয়ে উঠে বলে,
“কি বললেন?”

“তুমি ছোট যে।”

“তাতে কি?”

“যদি কিছু হয়ে যায়?”

“কিছুই হবে না।”

“তারপরেও।”

সকালের গাল বেয়ে পানি পড়ে।
“আপনি যানেন আমার কতো সুখ সুখ লাগছে?বুকটা মা মা গন্ধে ভরে যাচ্ছে।আর আপনি কিনা বলেন নষ্ট করে ফেলতে?”

ধ্রুবও যে প্রথম বাবা হচ্ছে।তারও যে আকাশ সমান খুশী।তার বলা কথায় যে সকাল এভাবে কেঁদে দিবে সেটা ধ্রুব ভাবেনি।উঠে বিছানায় বসে সকালকে একহাতে জড়িয়ে মুখটা তার দিকে করে।
“আমি মজা করেছি।দেখলাম তোমার রিয়াকশন কেমন হয়।”

সকাল থমথমে গলায় বলে,
“এমন কথা কেউ বলে?আমি মা হচ্ছি না?”

ধ্রুব চোখের পানি মুছে দেয়।খুশী খুশী গলায় বলে,
“আমিও তো বাবা হচ্ছি।এই যে খুশীতে মন চাইছে তোমাকে নিয়ে উড়ে বেড়াই।”

সকাল ধ্রুবর দুই গালে হাত রেখে বললো,
“আপনি কি খুশী না?”

ধ্রুবও খুব খুশি।এই যে বুকে কেমন অনুভূতি হচ্ছে তা তো প্রকাশ করার মতো না।
“আমি খুব খুশী জান।তবে তোমাকে নিয়ে যে আমার খুব ভয়।”

“ভয়ের কি আছে সবাই তো মা হচ্ছে।”

ধ্রুব সকালের মাথাটা তার বুকে নেয় বলে,
“হচ্ছে কিন্তু এই অল্প বয়সে কেউ দুইটা বেবির মা নয়।”

সকাল ধ্রুবর বুকে বিড়ালের মতো মিশে যায়।
“মরব না তো এতো চিন্তা কিসের?”

ধ্রুব হাতের বাধন শক্ত করে বুকে মিশিয়ে নেয়,
“এসব মুখেও আনবে না।আমার বাচ্চা টাচ্চা চাই না আমার বউকে এভাবে চাই।সারাজীবন।”

“আচ্ছা।”

সকাল বুক থেকে মাথা উঠিয়ে বললো,”কংগ্রাচুলেশনস।”

ধ্রুব মাথা নেড়ে বললো,
“কংগ্রাচুলেশনস তোমাকেও।”

সকাল খুশীতে বললো,
“আমার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না।”

“আমারো।আবার নাকি দুইটা!ভাবা যায়?আম্মা তো আমাকে হসপিটাল থেকেও বকা শুরু করে দিয়েছে।কথায় কথায় খোটা দিচ্ছে বাচ্চা বউ বলেছিলাম সেটা।”

সকাল হাসে।ধ্রুবর মুখ দেখেই বুঝা যাচ্ছে কতো খুশী।
ধ্রুবই আবার বলে,”সকাল আমরা দুইটা দোলনা আনতে হবে তাই না?”

ধ্রুব কথা শুনে সকাল হেসে খুন।
“বেবী আসতে আরো অনেক দেরী।”

“তাতে কি আমরা কিনে রাখবো।”

“আচ্ছা।”

“সকাল কলেজে ভর্তি হবে না?”

সকাল আহ্লাদী গলায় বললো,
“এ বছর মা হবো।সামনের বছর কলেজে পড়বো।”

ধ্রুব সকালের কথা শুনে নাক টেনে আদর করে আবার বুকে শক্ত করে ধরে বললো,
“এই যে বুকে বাবা বাবা শান্তি অনুভব হচ্ছে,এটা স্পর্শ করানোর জন্য ধন্যবাদ।”

সকাল স্পষ্ট বুঝতে পারে ধ্রুব কাঁদছে।বাবা হবে সেই খুশীতেই কি কাঁদছে?তার চোখেও আবার পানি জ্বমে।মাথা উঠিয়ে ধ্রুব চোখের পানি মুছে বলে,
“আপনাকেও ধন্যবাদ আমাকে মা মা শান্তি এনে দেয়ার জন্য।”

সকাল আর ধ্রুব গিয়ে পাঁচ দিন গ্রামে থেকে আসে।সকালের এখন বেহাল দশা।বমি করতে করতে জান যায় যায় অবস্থা।কিছুই পেটে রাখা যায় না।সারাদিন হাতে লেবুপাতা নিয়ে বসে থাকে।এর মাঝে দুই সাপ্তাহ,সে ধ্রুবকে মোটেই পছন্দ করতে পারছে না,দেখলেই ঘৃনা লাগছে,ধ্রুবর গায়ের গন্ধ মনে হচ্ছে পৃথিবীর বিশ্রী গন্ধের একটা।দেখলেই বমি আসে।ধ্রুব বেচারার এমন অবস্থা দেখে মন বড্ড খারাপ হয়,বউয়ের কাছেই যেতে পারছেনা,কাছে গেলেই সকাল চেচিয়ে উঠে বলে,”গোসল করে আসেন।”এই দুই সাপ্তাহ ধ্রুব গোসল করতে করতে শেষ।এর পর থেকে সকালের সিকনেস পাল্টে গেলো,সারাক্ষণ ধ্রুবর গায়ে লেপ্টে থাকা চাই,অফিসে গেলেও কান্নাকাটি।কখন আসবে কখন আসবে।রাত দিনের ঠিক ঠিকানা নেই যখন তখন আদর চাই,আদর না দিলেই কান্নাকাটি।ধ্রুব কোনভাবেই বুঝাতে পারে না।তার আদর লাগবেই।ধ্রুবর এখন মনে হচ্ছে এই আদর টাদর না শিখালেই বরং ভালো হতো,আদরের কারনেই সব উল্টাপাল্টা বেগে ছুটছে।সকালের যখন চার মাস তখন গ্রাম থেকে তার মা বাবা আসে সকালকে নিয়ে যাবে এই জন্য।মেয়েরা বাবু হলে মূলত বাবার বাড়িই থাকে।ধ্রুব শুনে সোজাসাপ্টা সবার সামনেই বললো,

“দেখেন বাবা গ্রামে ডাক্তারের ব্যবস্থা ততোটা ভাল না।টুইন প্রেগ্ন্যাসি যে কোনো সময়ই ডাক্তার লাগতে পারে আপনারা কিছু মনে না করলে সকাল এখানেই থাকবে।”

তার কন্ঠে লুকায়িত কথাগুলো সবাই বুঝে নেয়।বউ দিতে সে রাজি না এটা স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে।
ধ্রুব রুমে চলে যায়।মনোয়ারা ছেলের কথা শুনে মুচকি হাসে,’হয়েছে ঠিক বাপের মতো,বউ ছাড়া থাকা সম্ভব না।’
ছেলের মনোভাব বুঝে বললো,
“ভাবি আপনার মেয়ে আমারও মেয়ে তাকে আমি মায়ের মতোই যত্ন করি।ডেলিভারীর আগে আপনারা চলে আসবেন।”

উনারা মেয়ের সুখ নিজের চোখেই দেখেন।তাই আপসেই চলে যান।স্বামী যেভাবে রাখতে চায় এখন সেভাবেই থাকুক।
সকালের বড্ড মন খারাপ হয়,মায়ের কাছে থাকার লোভ হয়। গাল ফুলিয়ে সে ধ্রুবর কাছে গিয়ে পাশে বসে,
“কি হতো গেলে?”

ধ্রুব বললো,
“আরে বাবা তুমি চলে গেলে আমি কিভাবে থাকবো?”

সকাল ধ্রুবর কথা শুনে হাসে,
“বিয়ের আগে যেভাবে থাকতেন।”

“ওটা বিয়ের আগের কাহীনি।এখন আমার একটা বউ আছে।গুরুজনেরা বলেছে বিয়ের পর বউ ছাড়া থাকা যাবে না,থাকলে বোবাভূতে ধরবে।”

ধ্রুব কথা শুনে সকাল হেসে গড়াগড়ি খায়,
“আচ্ছা আমি যদি মরে যাই তখন কি করবেন?”

মূহুর্তেই ধ্রুবর প্রসস্থ হাসি উধাও হয়ে যায়।উজ্জ্বল মুখে ফুটে উঠে একরাশ বিষাদের ছাঁয়া।
“সবসময় মরন মরন করো কেন?”

“ওমা যেকোনো সময়ই তো মরে যেতে পারি।বললে ক্ষতি কি?”

ধ্রুব একনজরে তাকিয়ে থাকে সকালের মুখের দিকে।তারপর পেট বরাবর শুয়ে পেটে চুমু খায়।ফিসফিস করে বলে,
“দেখ আম্মু এই পঁচা মহিলা শুধু পঁচা কথা বলে।তুমি আসো আমরা তিনজন মিলে মহিলাটাকে ভালো কথা শিখাবো।”

সকালের খুব কান্না পায়।তার কেন জানি মনে হয়,সে তার বাবুদের দেখতে পারবেনা।ধ্রুবর চুল খামচে বুকে চেপে ধরে।ফিসফিস করে বলে,
“আপনার সাথে অনেক বছর বাঁচতে চাই ধ্রুব।অনেক বছর।”

ধ্রুব কিছু বলে না,প্রিয়তমার বুকে শুয়ে শুনতে থাকে বুকের টিপটিপ শব্দ।

একদিন সকালে খুব ভোরে ধ্রুবকে ডেকে তুলে।ধ্রুব ধরফরিয়ে উঠে বলে,
“কি হয়েছে সকাল বমি পাচ্ছে?পিঠে ব্যাথা হচ্ছে?”

সকাল কিছুই বলে না।ধ্রুব খেয়াল করে দেখে সকাল কাঁদছে।ধ্রুব ভয় পেয়ে যায়।
“কি হয়েছে সোনা? আমার বউ কাঁদে কেন?”

সকাল প্লাজো সরিয়ে তার সদ্য উঁচু পেটটা দেখায়,লাল লাল হয়ে সকালের পাতলা চামড়া টান পড়ে আছে।সকাল কেঁদে বলে,
“আমার পেটে কি যানি হয়ে যাচ্ছে,চুলকাচ্ছে আর চামড়ায় দাগ পড়ছে।”

ধ্রুব মনোযোগ দিয়ে তাকিয়ে বুঝলো,এগুলো,মাতৃত্বের দাগ।সে একটু গুগুল ঘেটে বললো,
“সোনাবউ ভয় পাওয়ার কিছু নেই।এগুলা মাতৃত্বের দাগ।কমবেশি সবারই এগুলা হয়।মূলত আট মাসে পড়লে দাগ হয়,কিন্তু আমাদের তো দুইটা চডুই পাখি আসছে তাই তোমার আগেই শুরু হলো।ভয় পাওয়ার কিছু নেই।খুব খারাপ লাগছে?”

সকাল ঠোঁট উল্টে কেঁদে দেয়,
“খুব চুলকাচ্ছে,জ্বলছে।”

ধ্রুব পেটে ফু দিয়ে জ্বালাপোড়া কমাতে চেষ্টা করে,এই মেয়েটা কাঁদলে তারও কান্না পায়।বরাবরের।মতো নিজেকেই অপরাধী লাগে,মনে হয় আর একটু সতর্ক থাকলে এই অল্প বয়সে এতো ধকল নিতে হতো না।পেটে হাত বুলিয়ে বললো,
“অলিভ অয়েল দিলে নাকি ভালো লাগে,আজকেই এনে দেব।”

সকাল কাঁদে।মাথা নেড়ে বললো,
“আমার অসহ্য লাগছে আমার কি সুন্দর পেট কি হচ্ছে।”

ধ্রুব বললো,
“বাবুরা যখন আসবে তখন দেখবে বাবুদের দিকে তাকালে তোমার সব কষ্ট দূর হয়ে যাবে।তখন মনে হবে বাবুদের কাছে এই পেটের দাগ কিছুই না।”

সকাল ধ্রুবর দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে বিললো,
“আর আপনি কি বিশ্রী বলবেন না?”

ধ্রুব বেশ অবাক হয়ে বলে,
“আমার অংশ দুনিয়ায় আনার জন্যই তো এতো লড়াই।তাহলে আমি বিশ্রী কেন বলবো?আমি তো তোমার কাছে সারা জীবন কৃতজ্ঞ।”

সকাল চুপ করে ঠান্ডা চোখে তাকিয়ে থাকে।ধ্রুব আবার বলে,
“সকাল,তোমার ফর্সা নিটোল পেটে যদি চুমু খেতে পারি,বাবা হওয়ার স্বাধ গ্রহন করে এই দাগযুক্ত পেটেও চুমু খেতে পারবো।তুমি কি এসব নিয়ে ভাবছো?আমি তোমাকে এখন যেমন ভালোবাসি সমসময় এমনি ভালোবাসবো।”

ধ্রুব কথা শুনে সকালের মন ঠান্ডা হয়।আনমনেই বলে,
“আপনি এতো ভালো কেন?”

ধ্রুব তখনি পেটে একটা চুমু খেয়ে বললো,”পিচ্ছির বর যে এজন্য।”

সকালের ছয়মাসের সময়ই সারা শরীরে পানি আসে।ছোট্টখাট্টো শরীরটা এখন গুলুমুলু হয়ে গেছে।হাটা চলা করতে সেকি কষ্ট!মনোয়ারা এখন সকালকে কিছুই করতে দেয় না।সারাক্ষণ কাছে বসিয়ে রাখবে।সকালের এই লম্বা চুলের যত্ন সে করতে পারেনা মনোয়ারাই যত্ন করে,আচড়িয়ে,তেল দিয়ে বেনী করে দেয়।দেড় মাসের সময় মিতু এসেছিলো,তার কি রাগ,এতো অল্প বয়সে কেন বেবী নিতে হবে?তারপর নিজেই আবার বুঝেছে আল্লাহর জিনিস আল্লাহ দিতে চাইলে কি না করা মানায়!!
সে এসে সকালকে তার পছন্দের খাবার রান্না করে খাইয়েছে এখনো প্রায় প্রতিদিনই এটা সেটা পাঠায়।এই এতো এতো খেয়ে সকাল বেশ ভারিক্কি হয়ে গেছে।ধ্রুব খুব যত্ন নেয় সকালের।সারাদিন অফিসে কাজ করেও রাতে সকালের যত্ন নেয়।যে মেয়েটা তাকে এতো ভালো উপহার দিতে যাচ্ছে তাকে তো একটু বেশী বেশি যত্ন করাই যায় তাই না?সকালের আজকাল হাত পা খুব ব্যাথা করে,ধ্রুব খুব যত্ন নিয়েই হাত পা টিপে দেয়,পেটটা ভারী হওয়াতে রাতে বাথরুমে যাওয়ার দরকার হলে উঠতেই পারে না ধ্রুবকে একটু ডাকলেই সজাগ হয়ে যায়।পিঠে ধরে উঠিয়ে দেয়।আজকাল রাতে সকালের ঘুম আসেনা,কেমন হাফসাফ লাগে।ধ্রুব মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়।পেটে হাত বুলিয়ে দেয়।পেটে কান লাগিয়ে কত কথা যে বলে।সকাল মুচকি হেসে সব কথা শুনে।বাবুরা খুবই দুষ্টু,একসাথে দুজনই খেলা করতে চায়,তখন সকাল খুব ব্যাথা পায়,অস্পষ্ট স্বরে কেঁদে দেয়।ধ্রুব হাত ভুলিয়ে দিলেই আবার চুপ হয়ে যায়।ধ্রুবর মাঝে অপরাধবোধ বাড়তেই থাকে,সকালের যে খুব কষ্ট হচ্ছে সেটা বুঝাই যায়,পেট খুবই বড়ো দেখাচ্ছে।সেদিন আল্টা করার পরে জানালো একটা মেয়ে একটা ছেলে।
দুজনের সেকি খুশী সেদিন রাতেই দুজনে নাম ঠিক করে ফেললো।আজকাল সকাল ধ্রুবর হাতের নুডুলস খেতে চায়।ধ্রুবর হাতে বেনী করতে চায়,ধ্রুব কোলে শুয়ে থাকতে চায়।একটা মেয়ের প্রেগ্ন্যাসির সময় যার আদর,যত্ন,ভালোবাসা সবচেয়ে দরকার সে হলো তার হাজবেন্ড।এই সময়ের যত্ন অবহেলা সারাজীবন মনে থাকে।ধ্রুব যে সকালকে খুব ভালোবাসে যত্ন নেয় এই শক্তিটাই সকালকে এতো সাহস যোগায়।

সকালের তখন নয় মাস।ভরা পেট নিয়ে নড়তেও কষ্ট হয়।ধ্রুব অফিসে যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছে।সকাল বলে,
“আজকে অফিসে না গেলে হয় না।আমার মনে হচ্ছে আমি বোধহয় মরে যাবো।”

এটা বলতে বলতেই সকাল কেঁদে দেয়।এমন কথা শুনে ধ্রুবও ভয় পায়।কাছে গিয়ে বুকে জড়িয়ে নিয়ে মোবাইলটা বের করে অফিসে ফোন দিয়ে ছুটির কথা বলে,উনারা জানায় আজকে তিনটা বড় কম্পানি থেকে লোন নিবে,সুতরাং ধ্রুবর থাকা মাস্ট।
ধ্রুব সকালের দিকে তাকালে সকাল হেসে বললো,
“কোন ব্যাপার না আপনি যান আমি ফোন দিয়ে কথা বললো।”

ধ্রুবর বুকটা কেমন করে,মাতৃকালীন ছুটির সাথে পিতৃকালীন ছুটি দেয়াও আবশ্যক।এই যে ধ্রুব তার বউয়ের কাছে থাকা খুব জরুরী এটা তো কেউ বুজলনা।একরাশ হাহাকার নিয়েই ধ্রুব অফিসে যায়,সকাল করুন চোখে তার প্রিয় স্বামীকে দেখে যে কিনা পাওয়ার থেকেও বেশী ভালোবাসে।

দুপুরে মনোয়ারার কাছে সকাল শুয়ে থাকে,তারপর উঠে বলে,”আম্মু আমি বাথরুম থেকে আসছি।”

মনোয়ারা বাথরুমে পাঠিয়ে বাহিরে দাঁড়িয়ে থাকে।তখনি ভেতর থেকে ভেসে আসে ধরাম করে পড়ার শব্দ।মনোয়ারা দরজা খুলে দেখে সকাল পড়ে গেছে,মুখটা নীল দেখাচ্ছে ঠোঁট নেড়ে কি জানি বলার চেষ্টা করছে।মনোয়ারা দেয়াল কাঁপিয়ে চিৎকার দিয়ে সকালকে ধরে,আসাদ মির্জা তখন দুপুরের খাবার খেতে বাসায় এসেছিলো,উনি এসব দেখে ইমারজেন্সী এম্বুলেন্স আনে।সকালকে নিয়ে তখনি ছুটে হসপিটালে।ধ্রুবকে ফোন দিয়ে জানালে সেও আসে।
হসপিটালে নেয়ার পরে ডাক্তাররা সকালকে চেকাপ করে জানায়,এখুনি সিজারিয়ান অপারেশন করতে হবে,বাচ্চাদের হার্টবিট কমে গেছে।সকাল তখন আধো জাগরনে।ধ্রুবর চোখে পানি টলটল,ঠোঁট কামড়ে সকালের হাত ধরে দাঁড়িয়ে।ডাক্তাররা সব রেডি করছে।ধ্রুবর বাবা মা বোধহয় দুজনকে একটু একা কথা বলার সুযোগ দিতেই বের হয়ে যায়।সকাল তখন কাঁদছে,পেটে প্রচুর ব্যাথা সাথে তার পাখিরা আর নড়ছেও না।ধ্রুব নিজেকে শক্ত করে বললো,
“কাঁদো কেন?কিছুই হবে না।দেখবে কিছুক্ষণ পড়েই বেবীরা চলে আসবে।”

সকাল হাত দিয়ে ধ্রুবর মুখ ছোঁয়।সারা মুখে হাত ভুলিয়ে বলে,
“আমার বাচ্চাদের খুব ভালো বাবা হবেন কথা দিন।”

ধ্রুব বললো,
“কথা দিতে হবে কেন?তুমি নিজেই দেখো।”

সকালের ঠোঁট তিরতির করে কাঁপে।জড়ানো গলায় বলে,
“একটু জড়িয়ে ধরবেন?”

সকালের কথায় ধ্রুব কেঁদে দেয়।হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরে কান্নার শব্দ আটকায়।তারপর সকালকে একটু উপরে তুলে জড়িয়ে নেয়।সকাল ঘুঙ্গিয়ে কেঁদে উঠে।ধ্রুব বুকে মিশিয়ে নিতে চায়।সকাল আবার বলে,”আপনি খুব ভাল হাজবেন্ড।”

ধ্রুব কপালে চুমু খেয়ে বলে,
“আমি জানি তো সোনা।এখন চুপ করে শুয়ে থাকো।আর একটু সময়।”

ধ্রুবর এই আদর মাখানো কথায় সকালের বুকটা পুড়ে যায়।সকাল ধ্রুবর হাতটা শক্ত করে ধরে বলে,
“কথা বলার আর যদি সুযোগ না পাই।”

সকালের একেকটা কথা,ধ্রুবর বুকটা ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছে।কান্নায় গলা বন্ধ হয়ে আসছে তারপরেও বললো,
“কি বল এগুলো?”

“ধ্রুব আপনার সাথে আরো অনেক বাঁচার ইচ্ছে ছিলো।”

ধ্রুব দু’দিকে মাথা নাড়িয়ে কাঁদে।সকালের হাত তার মুখে ঘষে বলে,
“বাঁচবে।তুমি কেঁদো না।”

“আপনিও কাঁদবেন না।প্লিজ কাঁদলে বুকে কষ্ট পাই।”

ধ্রুব কিছু বলার আগেই নার্স এসে সকালকে নিয়ে যায়।সকাল ব্যাকুল চোখে ধ্রুবকেই দেখে।আরেকজন নার্স এসে বললো,
“এখুনি তিন ব্যাগ এ বি নেগেটিভ রক্ত লাগবে।জরুরিভাবে।”

সকালকে যে বিছানায় শুয়িয়ে রেখেছিলো ধ্রুব সেদিকে তাকিয়ে দেখে সাদা বেডসিট রক্তে ভিজে আছে।সকালের ডেলিভারি ডেট আরো পরে বিধায় ধ্রুব সেই ডেট অনুযায়ী ডোনারদের সময় বলেছিলো, তারা এখন দূরে আছে আসতে সময় লাগবে,কে যানতো হঠাৎ করেই এমন দূর্ঘটনা ঘটে যাবে।এখন ধ্রুব সব জায়গায় ফোন দিয়েছে এই ব্লাড নেই,দুই জন কে পেয়েছিলো,কিন্তু তাদের একজন চট্রগ্রাম আরেকজন আসতে দুই ঘন্টা লাগবে।ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছে পাওয়া গেছে কিন্তু আসতে লেট হবে।অসহায় হয়ে ধ্রুব অটির বাহিরে দাঁড়িয়ে থাকে।ভিতরে বাচ্চাদের কান্না শুনা যায় নার্স বেড়িয়ে এসে বলে,”রক্ত যোগার করছেন?”

ধ্রুব না বলে, উনি আবার ভেতরে চলে যায়।মিনিট পাঁচেক পড়েই দায়িত্বরত ডাক্তার বেড়িয়ে আসে।ধ্রুবকে বলে,
“রক্ত যোগার করতে পারেননি?”

‘জ্বী না স্যার।আমার ওয়াইফ কেমন আছে?”বলার সময় ধ্রুবর ঠোঁট কাঁপে।

“আপনার ওয়াইফের বয়সের তুলনায় প্রেগ্ন্যাসিটা খুব রিক্স হয়ে গেছে।অল্প বয়সে বেবী নেয়ার জন্য,আর অতিরিক্ত রক্তক্ষরনের জন্য প্রি-একলামসিয়া বা খিচুনি এসে পড়েছে।রুগীর অবস্থা আশংকাজনক।তাড়াতাড়ি রক্তের ব্যাবস্থা করেন,রক্তের স্বল্পতার কারনে প্রেশেন্টের নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে,তাই আই সি ইউ তে নিতে হবে।”

ধ্রুব পাথর হয়ে কথাগুলো শুনে। আইসিইউ?তার মানে খুব খারাপ?সকালের একটা কথাই তার কানে বাজে “আর যদি কথা বলার সুযোগ না পাই?”

ধ্রুব ডাক্তারকে বললো,
“স্যার একবার কি দেখা করা যাবে?”

ডাক্তার ধ্রুবর অবস্থা দেখে বলেন,
“দুই মিনিট।এর বেশি না।”

ধ্রুব সকালের কাছে যায়।বিছানা কাঁপিয়ে তার সকালটা কাঁপছে।ধ্রুব পাশে দাঁড়িয়ে বলে,”জান,খুব কষ্ট হচ্ছে?”

ধ্রুবর গলার স্বর শুনে সকাল তার দিকে তাকায়,টেনে টেনে নিশ্বাস নিচ্ছে।খুব কষ্টে বলে,
“আপনাকে খুব ভালোবাসি।”

ধ্রুব কাঁদে ফুপিয়ে ফুপিয়ে বলে,”আমিও খুব ভালোবাসি।”

সকালের শরীরটা দুইজন নার্স চেপে রাখতে চাইছে।কিন্তু কাঁপছেই।ধ্রুব বললো,”বাবুদের দেখবেনা?”

সকাল জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে অনেক কষ্ট করে টেনে টেনে বললো,”আমার বাবুদের কখনো কষ্ট দিবেননা।”

ধ্রুবর চোখ দিয়ে টপ টপ করে পানি পড়ে।
“তোমার কিচ্ছু হবেনা।”

সকাল শব্দ করে কাঁদে।
“আমার খুব কষ্ট হচ্ছে।আমাকে মাফ করে দিয়েন।”

ধ্রুব সকালের হাতে চুমু খেয়ে বলে,জান তোমার কিছু হবেনা।আমরা একসাথে বেবিদের দেখবো।”

সকাল ঠোঁট উল্টে কাঁদে।তখনি সকালকে আইসিইউ তে নেয়ার জন্য রুম থেকে বের করা হয়।
ধ্রুব দৌড়ে দৌড়ে সাথে সাথে যাচ্ছে আর বলছে,”ভয় পেও না সোনা।আমি এই বাহিরেই আছি।”

সকাল ছটফট করে বলে,
“একটু থামেন ভাই,আমার ধ্রুবকে আরেকটু দেখবো।”

ধ্রুব হাউমাউ করে কাঁদে,সকালের সাদা হয়ে যাওয়া মুখে চুমু খায়,সকালের অবস্থা তখন আরো খারাপ।ঢেলে কেবিনে ঢুকিয়ে ফেলে।ধ্রুব হাউমাউ করে কেঁদে তখনি পাগলের মতো লোকভর্তি করিডোরে গড়াগড়ি খেয়ে কাঁদে।মনোয়ারা ছেলেকে সামলাতে পারে না,তিনিও কাঁদে।ধ্রুব চিৎকার করে কেঁদে কেঁদে বলে,
“আম্মা আমার সকাল,আম্মা আমার সকালের কি হলো,সকালকে ছাড়া বাঁচবো কি করে আম্মা…”

আশেপাশের লোকজন দাঁড়িয়ে দেখে,স্ত্রীর জন্য স্বামীর হাহাকার,বুক ফাটানো চিৎকার।

দূরে কোথাও মন মাতিয়ে বাজে,
❝তারে আমার আমার করি করি,আমার হইয়েও আর হইলো না।❞

❝দেখেছি,দেখেছি রূপসাগরে মনের মানুষ কাঞ্চাসোনা ❞

চলবে???

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here