বৃহন্নলার ডিভোর্স পর্ব-ছয়,সাত

0
476

#ধারাবাহিকগল্প
#বৃহন্নলার ডিভোর্স
পর্ব-ছয়,সাত
মাহাবুবা বিথী
ছয়

আপু প্রতিবার পিরিয়ডের পর আমার শাশুড়ী আমাকে বাঁজা মেয়ে বলে গালিগালাজ করে। আমি ত্যাক্ত বিরক্ত হয়ে সেদিন প্রতিবাদ করতে বাধ্য হয়েছি। তবে আমার একটু ভয় লাগছে। কারণ আমার শাশুড়ী ভীষণ ভয়ঙ্কর মানুষ।

ঝড়ের আগে যেমন প্রকৃতিতে গুমোট পরিবেশের সৃষ্টি হয় তেমনি রুমির শ্বশুরবাড়ির পরিবেশটা থমথমে হয়ে আছে। সবাই রুমিকে এড়িয়ে চলছে। রুমি সেদিন ডিনারের পর রুমে এসে দেখে আবীর ঘর অন্ধকার করে বারান্দায় বসে আছে। তখন রাত এগারোটা বাজে। রুমি ওর সাথে কোনকথা না বলে বিছানায় শুয়ে পড়ে।ফোনে মেসেজ পাঠিয়ে রুম্মান ঠিক মতো বাড়ি পৌঁছেছে কিনা সেই খবরটা নেয়। হঠাৎ নজরে আসে জারার ভাই রায়হান ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছে। রুমিএকসেপ্ট করে। তারপর ওনার সাথে টুকটাক কথা বলে। কথা প্রসঙ্গে জানতে পারে ওনার ওয়াইফের সাথে ওনার ডিভোর্স হয়ে গেছে। তখন রুমি উনাকে জিজ্ঞাসা করে,
—-ভাই আপনার কোন পরিচিত উকিল আছে?
রায়হান বললো,
—-আছে। আপনার কেন দরকার?
রুমি বলে,
—আমি আপনাকে সময়মতো জানাবো।
গুমোট দমবন্ধ পরিবেশে রুমির জীবনের সময়গুলো পার হয়ে যায়। খাঁচাবন্দী পাখির মতো মুক্তির উপায় খুঁজে বেড়ায়।
কারণ মাকে যদি বলে ও ডিভোর্স দিবে আবীরকে মা প্রচন্ড ধাক্কা খাবে।এবং সেটা শরীরের উপর খারাপ প্রভাব ফেলতে পারে। আবার মাকে যদি ওর সাথে ঘটা ঘটনাগুলো বলে দিত সেখানেও বিবেকের দংশনে দুমড়ে মুচড়ে যেতো। রুমি পড়ে গেছে উভয় সংকটে।
মাঝে মাঝে রায়হানের সাথে মেসেঞ্জারে রুমির কথা হয়। রুমিও মুক্তির পথ খুঁজে বেড়ায়। ওদের যে নোংরা চেহারা রুমি দেখেছে এরপর ওদের সাথে থাকা ঠিক না।
যদিও রুমির উপর অত্যাচারের মাত্রাটা একটু কমে আসে। তবে প্রয়োজন ছাড়া রুমির সাথে কেউ কথা বলে না।
এদিকে একদিন রাতে রুমির মা ফোন দিয়ে রুমিকে বলে,
—-তুই কি এর মাঝে ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলি?
রুমি বলে
—নাতো।আমারোতো কোন সমস্যা হয়নি যে ডাক্তারের কাছে যেতে হবে। কেন হঠাৎ এই প্রশ্ন করলে?
রুমির মা বলে,
—-তোর চাচার সাথে আবীরের আব্বার ফোনে কথা হয়েছে। উনি জানিয়েছেন, ডাক্তার নাকি বলেছে তোর নাকি বাচ্চা হবে না। তোকে বউ করে এনে ওনারা বড্ড ভুল করেছেন। এর থেকে গ্রাম থেকে উনিশ বা বিশ বছরের অল্প বয়সি মেয়ে আনলে এতোদিনে ওনারা নাতির মুখ দেখতে পারতেন। তোর উপর ওনারা অত্যাচার করছেন নাতো?
দেখ মা কোন কিছু গোপন করিস না। আমি মনে হয় নিজ হাতে তোর জীবনটা নষ্ট করে দিলাম।
রুমি বলে,
—-আমার কপালে যা লেখা আছে তাই হবে। তুমি শুধু শুধু নিজেকে দোষারোপ করছো। আমার শাশুড়ী মাঝে মাঝে একটু সমস্যা করছে। তবে কোন সমস্যা হলে আমি তোমাকে জানাবো।তবে তুমি এসব নিয়ে বেশী চিন্তা করো না। সময়ের সাথে সাথে সব ঠিক হয়ে যাবে। নিজের শরীরের দিকে খেয়াল রেখো।
মায়ের সাথে কথা বলে রুমি ফোনটা রেখে দেয়।
এরপর রায়হানের সাথে দেখা করার জন্য মেসেজ পাঠায়।

আপু পরদিন আমি দুপুর বারোটার দিকে আমার শাশুড়ীকে জানিয়ে চাকরির ইন্টারভিউ দেওয়ার কথা বলে বাসা থেকে বের হই।তারপর আমরা দুজনে বসুন্ধরা মার্কেটে দেখা করি। ল,ইয়ার তো অনেক আছে। তবে আমি একজন মহিলা ল,ইয়ার খুঁজেছিলাম যার কাছে সহজভাবে আমার কথাগুলো বলতে পারি। রায়হান ভাই আমাকে বলে,
—-চিন্তা করো না আমি শীঘ্রই আপনাকে একজন ভালো উকিলের খোঁজ দিব।
এরপর সন্ধার দিকে বাসায় ফিরে আসি। তখন আমার শাশুড়ী দরজা খুলে দেয়। উনি নিজে আমাকে কিছু বলে নাই। তবে আবীরকে দিয়ে আমাকে চরমভাবে অপমান করে। কারণ আবীরের আমার তখন অনেক দূরত্ব তৈরী হয়ে গেছে। এক বাসায় থেকেও ওর সাথে আমার কথা হয় না। ও আর আমি একঘরে আলাদা বিছানায় শুই। ও সোফায় ঘুমায় আমি ঘুমাই খাটে। আমি আবীরকে বলেছি খাট যেহেতু আমার বাবার বাড়ি থেকে দিয়েছে আমি খাটেই ঘুমাবো। যাই হোক ও আমাকে অপমান করার সুযোগ হাতছাড়া করলো না। আবীর আমাকে বলে,
—-তোমার নাগরের সাথে চলে গেলেই পারতে। আবার আমার কাছে ফিরে আসলে কেন?
আমি বললাম,
—-কি আজে বাজে কথা বলছো? আমি চাকরির ইন্টারভিউ দিতে গেছিলাম।
আবীর বলে,
—-আমাকে কচি খোকা পাওনি। যা বলবে তাই বিশ্বাস করবো। নিজেকে বেশী চালাক ভাবো তাই না। বসুন্ধরা মার্কেটে কার সাথে সময় কাটালে।
আমি বললাম,
—-চাকরির ইন্টার ভিউ দিতে গিয়ে উনার সাথে আমার দেখা হয়। তাই ওখানে একটু বসে কথা বলেছিলাম
আবীর বলে,
—-আমার সব জানা আছে। ডেট ঠিক করে ডেটিং এ গিয়েছো। চরিত্রহীন মেয়ে কোথাকার !
এমন সময় শাশুড়ী ফোঁস করে বলে,
—-আমি এরকমটা হবে আঁচ করেছিলাম। এইজন্য সাব্বিরকে নিষেধ করেছি যেন ওর সাথে কোন কথা না বলে।
আমি আমার শাশুড়ীকে বলি,
—-আপনারা যেমন নোংরা মানুষ তেমনি আপনাদের নোংরা মন।
আমার কথা শুনে শ্বশুর তেড়ে এসে বলে,
—-তা নোংরা মানুষের সাথে এখনও পড়ে আছো কেন? কে থাকতে বলেছে তোমাকে?
আমি সে রাতটা কোনরকমে পার করি।আর এটাও বুঝে নেই ওর আমার মোবাইল চেক করে।যাইহোক মোবাইলের পাসওয়ার্ড চেইঞ্জ করলাম। রায়হান ভাই ওই রাতে আমাকে আপনার বাসার ঠিকানাটা দিয়ে দেয়।
আমি আসার আগে আবীরের মেডিকেল রিপোর্টের ছবি তুলে আনতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আবীর চলে আসার কারনে সম্ভব হয়নি।

পরদিন বাসা থেকে বের হয়ে আপনার বাসায় চলে আসি।ছ,মাস আগে যেদিন আপনার বাসায় এসেছিলাম সেদিনকার কথা। তারপর এখান থেকে বাসায় চলে যাই।
আপু আমি আর একটা কারনে বাসা থেকে চলে যাই কারন আমার মনে হয়েছে ওরা যে কোন সময় আমাকে মেরে ফেলতে পারে। তারপর আমার মাকে বলবে আমি আত্মহত্যা করেছি।
আমি বললাম,
—-তোমার এরকম মনে হবার কারণ কি?

রুমি বললো,
—-আপু একবার তো আমার শ্বশুর আমার চাচাকে বললো,ডাক্তার বলেছে আমার বাচ্চা হবে না এটাও যেমন মিথ্যা কথা ছিলো তেমনি আমার আর এক চাচার কাছে বলেছে আমি নাকি মানসিক প্রতিবন্ধী। যে কোন মূহুর্তে আত্মহত্যা করতে পারি। সেই চাচার সাথে উনি বাইরে দেখা করে এই কথাগুলো বলেছে।
আমি বললাম,
—তখনি আমাকে তোমার ডিটেইল বলা উচিত ছিলো।
রুমি বললো,
—-আপু আপনি বলেছিলেন ভাবনা চিন্তা করে সিদ্ধান্ত নিতে।
আমি বললাম,
—-আমিতো তোমার জীবনের এই ঘটনাগুলোর কথা জানতাম না। তোমার এতো দেরী না করে আরোও আগে এসে ডিভোর্স ফাইল রেডী করা উচিত ছিলো।
রুমি বললো,
—-আসতে চেয়েছিলাম। আম্মুর জন্য আসতে পারিনি। তার এক কথা একটু মানিয়ে নিলেই পারতি। আর আবীরকে চিকিৎসা করালে ও সুস্থ হয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারতো। আম্মুকে বোঝাতে পারছিলাম না যে ওরা মানুষ হিসাবে খুব জঘন্য প্রকৃতির। আম্মুর কথা হচ্ছে ওদের ছেলের যদি এতোই সমস্যা থাকে তাহলে বিয়ে দেওয়া তো দরকার ছিলো না। যেঁচে ছেলের বিয়ে দিয়ে কেন এই ঝামেলায় ওরা নিজেদের জড়াবে। আর আম্মুর একটা মাইল্ড অ্যাটাক হয়। আম্মুকে নিয়ে কিছুদিন ব্যস্ত ছিলাম। এদিকটায় মাথা ঘামাতে পারিনি। আসলে আমার শাশুড়ী তার এই ছেলেকে বিয়ে দিয়ে প্রমান করতে চেয়েছিলেন উনার ছেলে সুস্থ স্বাভাবিক।উনি সন্তান স্নেহে এক ক্রেজি ভয়ঙ্কর মহিলা।
আমি বললাম,
—-তুমি আর ও আগে এসে মামলা করলে এতোদিনে সবকিছুর সুরাহা হতো। আর ওদেরও শাস্তি পাওয়া দরকার।
রুমি বললো,
—-আমাদের আত্মীয়স্বজন বললো আমি ডিভোর্স দিয়ে দিলে দেনমোহর থেকে শুরু করে কোনকিছু পাওয়ার সম্ভাবনা থাকবে না। আর আমরা মধ্যবিত্ত মানুষ। এখনও আমার বিয়ের দেনাগুলো রয়ে গেছে।আমি যদি আমার গয়না আর দেনমোহরের টাকাগুলো পাই ওগুলো দিয়ে ঋণ গুলো শোধ করে দিবো। আর না পেলে আম্মু আরও অসুস্থ হয়ে পড়বে। আমার জীবনের যা ক্ষতি হয়ে গেলো তাতো আর কোনভাবে পূরণ হবার নয়।
আমি বললাম,
—-এটা ভুল ধারণা। তুমি ভিকটিম। অবশ্যই তুমি আইনের আশ্রয় নিতে পারতে।
রুমি বললো,
—-আমি চলে আসার পরে আমার শ্বশুরশাশুড়ী সবার কাছে বলে বেড়াতে লাগলো, আমার পরকীয়া ছিলো তাই আমি তার হাত ধরে পালিয়েছি। আমার এই খবর পেয়ে আমার ভাইও চলে আসে। আমার চাচা ভাইয়া থেকে শুরু করে আত্মীয় স্বজনের প্রতিবাদে ওরা একটু নিজেদের সামলে নেয়।কিন্তু এক সপ্তাহ আগে আমার নামে অভিযোগ দায়ের করে ডিভোর্স লেটার পাঠিয়ে দেয়।

চলবে

#ধারাবাহিকগল্প
#বৃহন্নলার ডিভোর্স
পর্ব-সাত
মাহাবুবা বিথী

আমি রুমিকে জিজ্ঞাসা করলাম,
—-অভিযোগ গুলো কি কি?
রুমি বললো,
—-ওদের করা অপরাধগুলো আমার উপর চাপিয়ে দিয়েছে। আমি নাকি পরকীয়াকরি, চরিত্রহীন, স্বামীর হক আদায় করিনি আর অনর্থক স্বামীকে সন্দেহ করে তাকে মানসিক এবং শারীরিক ভাবে অপদস্ত করি। আপু দেখেছেন কি অবলীলায় আমার চরিত্রে দাগ লাগিয়ে দিলো।
আমি রুমিকে বললাম,
—-তোমার কাছে ওদের সম্পর্কে যতটুকু শুনলাম ওদের কাছ থেকে এটাই স্বাভাবিক। বরঞ্চ তোমাকে চুরির অপবাদ দেয়নি এটাই তোমার ভাগ্য ভাল বলতে হবে। তুমি ডিভোর্স লেটারটা রেখে যাও। আর কাউকে বলো না তুমি যে ডিভোর্স লেটার হাতে পেয়েছো। তুমিই বরং তোমার প্রতি অন্যায় আচরনের প্রতিকার চেয়ে ডিভোর্স ফাইল রেডী করবে।
রুমি আমাকে বললো,
—-আপু আপনার পেমেন্টের ব্যাপারটা জানতে চাই
আমি বললাম,
—-ওটা নিয়ে তোমাকে চিন্তা করতে হবে না। আগে কালপ্রিট গুলিকে শায়েস্তা করে নেই। আর তোমাকে কিছু কথা বলি,এই যে এখন তোমার এই সময়ে আত্মীয় স্বজন বন্ধু বান্ধব সবার মিষ্টি কথার ছুরিতে তোমায় প্রতিনিয়ত আঘাত করে ক্ষত বিক্ষত করবে।তাই সেখান থেকে নিজেকে রক্ষা করতে হলে ব্যস্ততার সাগরে ডুবে থাকতে হবে যাতে সব দুঃখ যন্ত্রণা গুলো ভুলে থাকা যায়। অতিসত্বর তোমাকে একটা চাকরি যোগাড় করতে হবে। নয়ত আবার পড়াশোনা কর। ল,তে ভর্তি হয়ে যাও।
রুমি আমাকে বলে
—আপু চাকরির চেষ্টা করছি। আর পড়াশোনাটা করতে গেলে অর্থের দরকার। ওবাড়ি থেকে আমার গয়নাগাটি ফেরত পেলে তখন ও গুলো বিক্রি করে
আম্মার লোন শোধ করবো আর বাকিটা দিয়ে পড়াশোনা চালিয়ে যাবো।

আমি রুমিকে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়ে ওর কেসটা স্টাডি করতে বসলাম।আর ভাবতে লাগলাম যদি কোন মেয়ে শারীরিকভাবে সন্তান জন্মদানে অক্ষম হতো কবে মেয়েটাকে ডিভোর্স দেওয়া হতো। অথচ এখানে আবীর পুরুষ বলে ওকে কোন কষ্টই পেতে হলো না। ভিকটিম হয়েও রুমি মানিয়ে নেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করেছে। অথচ ওর এই ভাল মানসিকতাকে ওরা প্রতিনিয়ত অসম্মান করেছে।ওদের শাস্তি হওয়া দরকার। অনেকে হয়ত ব্যাতিক্রম আছে তবে তাদের সংখ্যা খুব কম। এইটুকু বয়সেই মেয়েটা জীবনের চরম বাস্তবতার মুখোমুখি হয়েছে। ভিতরটা দুমড়ে মুচড়ে শেষ হয়ে যাচ্ছে। অথচ বাইরে শক্ত খোলসের আবরণে নিজেকে মুড়িয়ে রেখেছে।

এমন সময় দরজায় টোকা পড়লো। দরজা খুলে দেখি আমার কর্তা ব্যাক্তিটি দাঁড়িয়ে আছে। প্রতিদিন স্বামীর দ্বারা নিগৃহীত এতো নারীদের নিয়ে কাজ করতে হয় মাঝে মাঝে নিজের কর্তা ব্যাক্তিটির জন্য আল্লাহপাকের কাছে দোয়া করি ও যেন সারাজীবন আমার পাশে থেকে এভাবেই কাজে আমাকে সহযোগিতা করে যায়। রাহাত আমাকে বললো,
—-আজ ছুটির দিন। তোমার জন্য একজন পথ চেয়ে বসে থাকে তার কথা কি ভুলেই গেছো?
আমি বললাম,
—–তার কথা কি ভোলা যায় যে আমার অস্তিত্বের সাথে মিশে রয়েছে। আসলেই আজ তো ছুটির দিন। আমার পরিবারকে সময় দেওয়া উচিত। আমি রাহাতের সাথে চেম্বার থেকে বের হয়ে আসলাম।

_________________

রুমি বাড়ি যেতে যেতে ভাবতে লাগলো নারীদের জীবন ঘাত প্রতিঘাতের দেয়ালে বন্দী থাকে।যারা এই দেয়াল ভাঙ্গতে পারে তারাই মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকার সাধ অনুভব করতে পারে।
রুমির বাসায় ফিরতে একটু রাত হয়ে যায়। ঘরে এসে দেখে ওর মার প্রেসারটা বেড়ে গেছে। ও রুম্মানকে মার কাছে থাকতে বলে বাসায় ডাক্তার ডেকে আনে। ডাক্তার রুমির মাকে দেখে ওষুধ দেয় এবং সাথে ঘুমের ট্যাবলেট দিয়ে দেয়। ডিনার সেরে ঘুমের ওষুধ খেয়ে রুমির মা ঘুমিয়ে পড়ে।

রুমি রুম্মানকে রাতের খাবার খেতে বলে ফ্রেস হয়ে বারান্দায় বসে থাকে। রুম্মান রুমিকে বলে,
—আপু তুমি খাবে না।
রুমি বলে,
—আমার ক্ষিদে নেই। তুই খেয়ে শুয়ে পড়। কাল আবার তোর ক্লাস আছে। অনেক সকালে উঠতে হবে। আমাকে এক কাপ চা বানিয়ে দিস।
রুম্মান রুমিকে এক কাপ চা বানিয়ে দিয়ে রাতের খাবার খেয়ে শুয়ে পড়ে। অনেক সকালে বের হতে না পারলে রাস্তায় জ্যামে পড়তে হয়। অনেক সময় ক্লাস মিস হয়। রুম্মান দ্রুত ঘুমিয়ে পড়ে।

শীতের রাত। ডিসেম্বর মাস। একটু শীত পড়েছে। ডিসেম্বর মাস থেকে শুরু করে জানুয়ারীর মাঝামাঝি
ঢাকায় একটু শীত থাকে। আজ ভরা পূর্ণিমা। রুমি বারান্দায় বসে কুয়াশার চাদরে মোড়ানো পূর্ণিমার আলো উপভোগ করছে। যদিও মনটা ভাল নেই তারপরও ও ভাবছে এরকম দুঃসহ যন্ত্রণার জীবন থেকে তো মুক্তি পেয়েছে। সাহস আর একাগ্রতার জোরে ওর দুষ্ট অতীতকে ভুলে যেতে হবে। সেখান থেকে শিক্ষা নিয়ে লড়াই করে নিজের ভাগ্যকে নিজেই গড়ে নিতে হবে। ও এই পৃথিবীতে সম্পুর্ণ একা। মাথায় হাত রেখে সান্তনা দেওয়ার মতো ওর পাশে কেউ নেই। মায়ের সামনে ও নিজের দুর্বলতা প্রকাশ করে না। যদি মা আরও ভেঙ্গে পড়ে তাই মায়ের সামনে যতটা সম্ভব নিজেকে শক্ত রাখার
চেষ্টা করে। মোবাইলে টুংটাং শব্দ হয়। রুমি তাকিয়ে দেখে, রায়হান মেসেজ পাঠিয়েছে।
—এখনও জেগে আছেন
রুমি বলে,
—–ঘুম আসছে না। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
রায়হান বলে,
—-কি কারনে বুঝতে পারলাম না
রুমি বলে,
—-ল,ইয়ারের জন্য
রায়হান বলে,
—-এ আর এমন কি
রুমি বলে,
—-বর্তমান দুনিয়ায় এইটুকুও কেউ করতে চায় না।
আমার ঘুম পাচ্ছে।
রায়হান বলে,
—-আপনি খুব সরল তাই এই সামান্য উপকারে আপনার কৃতজ্ঞতার স্বীকারোক্তি। যাদের ভিতরে কৃতজ্ঞতাবোধ থাকে তারাই মানুষকে ভালবাসতে পারে।
রুমি আর কথা বাড়াতে চায় না তাই এড়িয়ে যাবার ছলে রায়হানকে বলে,
—–আমার ভীষণ ঘুম পাচ্ছে। গুড নাইট।
রুমির আসলে কারো সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। একা থাকতেই ভাল লাগছে। রায়হানকে ওর বরাবরই ভাল লাগে। উনি যদি বিদেশে গিয়ে বিয়ে না করতেন তাহলে রুমির জীবনটা অন্যরকম হতে পারতো। বিজ্ঞজনেরা বলে,
—-যাকে ভালবাসো তাকে বিয়ে করো না। কারণ ভালবাসাকে যত্ন করে ন্যাপথেলিন দিয়ে আলমারিতে তুলে রাখতে হয়। ওকে আটপৌরে ভাবে ব্যবহার করলে কর্পূরের মতো নিঃশেষ হয়ে যায়। তাই রুমির ভালবাসতে বড্ড ভয় হয়।
অংকের মতো হিসেব কষে জীবন চলে না। তাই কল্পনার সঙ্গে বাস্তব জীবনের কোন মিল হয় না। রুমি ওর এইটুকু বয়সে বুঝে গেছে অন্য সবার মতো একই সরল রেখায় ওর জীবন চলে না। ওর জীবনের পথ একটু কঠিন হয়। ওরা তিন ভাইবোন। বড়ভাইটা আহসানউল্লাহ্ থেকে ইন্জিনিয়ারিং পাশ করে ক্যারিয়ারটা আস্তে আস্তে সুন্দর করে গড়ে নিয়েছে। তেমনি ছোটো বোনটাও একটা প্রাইভেট ভার্সিটি থেকে ইন্জিনিয়ারিং পাশ করার পর ওর সুন্দর ক্যারিয়ার হবে অথচ রুমি একটা সরকারি কলেজ থেকে পড়াশোনাটা শেষ করেছে। যার কারনে ওর চাকরি পেতে বেগ পেতে হচ্ছে। আবার বিয়ের আগে বাবা নামক মাথার উপরের ছাদটাও ভেঙ্গে পড়লো ফলে সত্যিকারের বিয়ে না হয়ে অসহায় হওয়ার কারনে ও বিয়ে নামক পরিহাসের স্বীকার হয়।

এইসব নানা ভাবনায় রুমি একসময় ঘুমিয়ে পড়ে। পরদিন একটু বেলা করে রুমির ঘুম ভাঙ্গে। একটু শীত লাগছিলো। গায়ের উপর থেকে কম্বলটা সরে গিয়েছে। কম্বলটা টেনে নিয়ে দেয়াল ঘড়ির দিকে রুমি তাকিয়ে দেখলো বেলা এগারোটা বাজে। তাড়াতাড়ি শোয়া থেকে রুমি উঠে পড়লো। ওয়াশরুম থেকে ফ্রেস হয়ে এসে দেখে টেবিলে ওর জন্য নাস্তা ঢেকে রাখা হয়েছে। ফ্লাক্স চা বানিয়ে রেখে রুম্মান ভার্সিটিতে চলে গেছে। ওর বিয়ে হওয়ার কারনে এই ক,মাসে রুম্মান বেশ দায়িত্বশীল হয়েছে।
পাউরুটি, ডিম পোচ আর চা দিয়ে ব্রেকফাস্ট করে রুমি ওর মায়ের রুমে গিয়ে দেখে, ওর মা আধোঘুম আধো জাগরনে আছে। ঘুমের ওষুধের প্রভাব এখনও রয়েছে। রুমি দুপুরের রান্না করতে কিচেনে চলে গেলো।

_________
কয়েকদিন পর রুম্মান ভার্সিটিতে আসলো। আসিফ খেয়াল করলো রুম্মান ইদানিং বেশ মনমরা হয়ে থাকে। আগে আসিফকে দেখলে ওর চোখে মুখে আনন্দ ঝিলিক মারত। এখন খুব উদাসীন থাকে। আসিফ রুম্মানকে বললো,
—–রুম্মান তোমার কি শরীর খারাপ?
রুম্মান বলে,
—-নাতো,আমি একদম ঠিক আছি।
এমন সময় আয়েশা এসে জিজ্ঞাসা করলো,
—–এই কয়দিন আসিসনি কেন? এর মাঝে দুটো ল্যাব হয়ে গেছে। তুই স্যারের কাছে ডেট নিয়ে ল্যাব কমপ্লিট করে ফেল।
রুম্মান বললো,
—-আমিও তাই ভাবছি।
রিফাত আর তরী বললো চল ক্লাস শেষ করে মাওয়া ঘাটে গিয়ে ইলিশ খেয়ে আসি। এতে রুম্মানের মন ভাল হয়ে যাবে।
রুম্মান বললো,
—-তোরা ঘুরে আয়। আমি যাবো না। আম্মুর শরীরটা ভাল না। তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরতে হবে।
আসিফ বললো,
—-রুম্মান যেহেতু যেতে চাচ্ছে না তাহলে এই প্রোগ্রাম অন্যকোনদিন হবে। আর আন্টির শরীর ভাল না রুমি আপুও এখন শ্বশুর বাড়িতে থাকে রুম্মানের দ্রুত বাসায় যাওয়া উচিত।
ক্লাস শেষ করে রুম্মান বাসার দিকে রওয়ানা হলো। রুম্মানের আসলে ভয় হচ্ছে আসিফের পরিবার আপুর বিষয়টা কিভাবে নিবে। আসিফের আর্থিক অবস্থা রুম্মানদের থেকে বেশ ভাল। আসিফ ওর বাবা মার একমাত্র সন্তান। আসিফ লেখাপড়ায় অনেক মেধাবী। গ্রাজুয়েশন করে ও হয়ত স্কলারশীপ নিয়ে বিদেশে চলে যাবে। রুম্মানেরও রেজাল্ট ভাল। কিন্তু আপু আর আম্মুকে রেখে স্বার্থপরের মতো ওই বা কিভাবে বিদেশে যাবে?
এই সব ভাবতে ভাবতে রিকশা বাসার কাছে চলে আসলো। মাগরিবের আজান শোনা যাচ্ছে। ভাড়া মিটিয়ে ডোর বেল বাজালো। রুমি দরজা খুলে দিয়ে বললো,
—-এতো দেরী হলো কেনরে?
রুম্মান বললো,
—-ল্যাব ছিলো আপু।
রুমি বললো,
—-ফ্রেস হয়ে এসে ভাত খেয়ে নে। দুপুরে কিছু খেয়েছিস?
রুম্মান বললো
—-না তেমন কিছু খাওয়া হয়নি।
রুমি বললো,
—-এরকম দেরী হলে হালকা কিছু খেয়ে নিবি। তা না হলে গ্যাসট্রিকের সমস্যা হবে।
রুমির মা এসে ওদের দুবোনকে বললো,
—-তোরা নামাজ পড়ে নে। মাগরিবের সময় দ্রুত শেষ হয়।
ওর মায়ের সাথে রুমি রুম্মান দুজনেই নামাজ পড়ে নিলো। রুমি কিচেনে গিয়ে চা বানালো। সবাই মিলে একসাথে মুড়ি মাখা আর চা খেলো ।এমন সময় রুমির মোবাইল বেজে উঠলো। স্ক্রীনে ব্যারিষ্টার রাবেয়ার নাম ভেসে উঠলো।
—-হ্যালো রুমি কেমন আছো। তোমার কেসের ফাইল অনেকদূর এগিয়েছে। দুটো কেস করেছি। একটা কেস ডিভোর্সের জন্য আর একটা তোমার জিনিস পত্র গয়নাগাটি দেনমোহরের টাকা ফেরত চেয়ে মামলা করেছি। আর একটা নারী নির্যাতনের মামলা আবীর আর ওর বাবা মার নামে করতে চাচ্ছিলাম। তাই তোমার মতামত জানতে চাচ্ছি।
রুমি বললো,
—-আপু আমার জীবনে যা ক্ষতি হয়েছে তাতো পূরণ হবার নয়। তাই নারী নির্যাতনের মামলা দেওয়ার দরকার নেই। মানুষের কিছু কিছু অপরাধের শাস্তি আল্লাহপাকের উপর ছেড়ে দিতে হয়। আমি তাড়াতাড়ি এই পরিস্থিতি থেকে বের হতে চাচ্ছি।
ব্যারিষ্টার রাবেয়া বললো,
—-তোমার উপর ওরা যা অন্যায় করেছে ওদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া দরকার। যাতে ভবিষ্যতে কেউ এরকম অপরাধ করার সাহস না পায়।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here