ভালোবাসার রংধনু,১২,১৩

0
972

ভালোবাসার রংধনু,১২,১৩
sinin tasnim sara
১২
______________
(২০)
রাতের ঐ মুহুর্তটার পর থেকে আমার মনের অনুভূতি সব ভোঁতা হয়ে গেল। কিছুই ভাবতে পারছিলাম না আমি। ইনতিসারের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে ছিলাম। ওর মুখে অন্যরকম এক ব্যথার ছাপ ভেসে উঠছিল। এর সঠিক কারণ জানা নেই আমার। আমায় ওরকম মাটির পুতুলের মতো রেখে ও কখন যে চলে গেল টেরই পেলাম না৷
সম্বিত ফিরল প্রিতম সাহেবের গলা খাঁকারিতে। খুব আয়েশ করে সিগারেট খেতে খেতে উনি আমার পাশে এসে দাঁড়ালেন। সিগারেটের তীব্র গন্ধে খুব অস্বস্তি হলো আমার। শাড়ির আঁচল টেনে নাক চেপে ধরে একটু দূরে সরে দাঁড়ালাম। হাসলেন উনি।
— তাহলে তুমিই নীরদ? তোমার সাথে আমার বিয়ের কথা ভাবছে মা!
আমি কোনো রা করলাম না। উনিই বললেন আবার,
— দেখে তো মনেই হয়না বিয়ের বয়স হয়েছে তোমার ।এ্যাই স্কুল গোয়িং নাকি তুমি?
— এডমিশান প্রিপারেশন নিচ্ছি।
শক্ত গলায় বললাম।
— বাব্বাহ্ এত কঠিন গলা! নিশ্চয়ই বিয়েতে মত নেই তোমার?
ভ্রু নাচালেন উনি। কিছু বলতে চাইলাম, থামিয়ে দিলেন।
— মত অবশ্য আমারও নেই। জাস্ট দেখতে চাচ্ছিলাম তোমায়। কোন গুপ্ত সৌন্দর্যের খোঁজ পেয়ে আমার মা পাগলপারা হয়ে গেছে তা দেখবার খুব আগ্রহ ছিল ।
মৃদু হাসির সাথে বললেন উনি। আমি অবাক হলাম। তাহলে ওনার বিয়েতে মত নেই? সত্যি শুনছি তো?
অবিশ্বাস্য চোখে তাকালাম। উনি আমার প্রশ্নসূচক দৃষ্টি বুঝতে পারলেন। একটানে সিগারেটের অর্ধেকটা শেষ করে বাকি অংশ পায়ের নিচে ফেলে নিভিয়ে দিলেন।
— একজনের সাথে কমিটেড আমি। সাড়ে আট বছরের প্রেম। বাংলাদেশি এক ফ্রেন্ডের কাজিন হয়। যোগাযোগ ওর মাধ্যমেই। ওদিকে এখন না যাই। হাইটে তোমার চাইতে ইঞ্চি পাঁচ লম্বা হবে। তবে গায়ের রঙের দিক দিয়ে তুমি এগিয়ে। ওরটা তোমার মতো এত শুভ্র নয়, একটুখানি চাপা। ভীষণ মায়াবী। আমাদের ক্লাসে বিলং করেনা। নিম্ন মধ্যবিত্ত ফ্যামিলির মেয়ে। অহরহ যা হয়! জাত-পাত বিচার করতে গিয়ে মা তাকে মেনে নিলো না। অনেক বোঝানোর চেষ্টা করেছি মা’কে। বুঝলোই না৷ পরে ভয় দেখালাম সব ত্যাগ করে চলে যাব একদিকে। আমার মা ভীষণ ডেঞ্জারাস। ভয় দেখালে মেনে নেয়ার প্রিটেন্ড করলো। দেখা করতে চাইলো ওর সাথে। দিনক্ষণ দেখে ওদের দেখা করানোর প্রিপারেশন নিলাম। কিন্তু লাস্ট মোমেন্টে একটা ফ্লাইট পড়ে গেল আমার। মায়ের সাথে দেশে আসতে পারলাম না। সুযোগের সদ্ব্যবহার করলো মা। আমার প্রেয়সীকে একা পেয়ে আমার থেকে আলাদা করবার সব বন্দোবস্ত করে ফেললো। বাঙালি মেয়ে তো ভীতুর ডিম হয়। মায়ের ভয়ে সে চুপচাপ সব অন্যায় কথা মেনে নিলো। তারপর হুট করে হারিয়ে গেল আমার জীবন থেকে।
— এখন যোগাযোগ নেই?
— উঁহু বাট খুঁজে পেয়েছি তাকে। তাকে খোঁজার বাহানায়ই তো দেশে আসা। আসা হতো না যদি তোমায় দেখে মায়ের বাড়ির বউ বানানোর শখ না হতো! আমি সুযোগই পাচ্ছিলাম না আসার। তারপর তুমি মাধ্যম হলে। চলে এলাম আর তাকে খুঁজে পেলাম। ইউ নো? আই ক্যান ক্রস ওশন’স অফ টাইম টু ফাইন্ড হার। শী অলসো নোজ্ ইট ভেরি ওয়েল। তাই তো এমন জায়গায় গিয়ে ঘাপটি মেরে বসেছিল যেন আমি কল্পনাও করতে না পারি সে ওখানে থাকতে পারে! এটাই তার ফল্ট ছিল। তার থটস কিরকম হতে পারে মুখস্থ আমার। যতই চেষ্টা করুক আমার থেকে লুকোতে সে পারবে না।
— এখন উনি কোথায়?
— আমার ফ্রেন্ডের বাসায়৷ একপ্রকার আটকে রেখে এসেছি। সপ্তাহখানেক বাদেই বিয়ে করবো।
— বিয়ে!
খানিক বিস্মিত হলাম আমি।
— হু বিয়ে। মা’কে জানাবো না, ইনফ্যাক্ট তুমি এবং কয়েকজন ফ্রেন্ড ছাড়া আর কেউই জানবে না। জানবে একেবারে বিয়ের পর।
— একদম বউ নিয়ে আন্টির সামনে উপস্থিত হবেন তাহলে?
— হু। তবে সব সম্পর্ক কাট করার জন্য৷ জানি ওই বাড়িটা আমার বউয়ের জন্য জাহান্নাম হবে। আমার চোখের আড়াল হলেই ওর বিপদ হয়ে যাবে। তাই ওকে নিয়ে হারিয়ে যাব কোথাও একটা।
— দেশান্তরি হবেন?
— ঠিক ধরেছো।
হাসিটা প্রসারিত হলো ওনার।
— তাহলে আমাদের বিয়ের কথাবার্তা এখানেই বন্ধ!
অস্থিরতা লুকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম আমি। এই প্রশ্নটা করবো বলে কতক্ষণ থেকে অপেক্ষা করছিলাম। আমার প্রশ্নে উনি সরাসরি তাকালেন আমার দিকে। খনিক চুপ করে থেকে বললেন,
— উঁহু। বিয়ের কথা তো চলবে। বিয়ের ডেইটও ফাইনাল হবে কিন্তু বউ বদলে যাবে।
— কি করতে চাইছেন আপনি!
আৎকে উঠলাম আমি।
— কিছুই না শুধু মায়ের সাথে একটা দ্বন্দ্বে নেমেছি। যে দ্বন্দ্বে বিজয় আমারই হবে। তোমাকে শুধু চাইছি পার্টনার হিসেবে। কো-অপারেট করো। অবশ্য না করলেও সমস্যা নেই, তুমি না হলেও অন্য কাউকে ঠিক মা ম্যানেজ করে ফেলবে। তার সাথেই মিলে নাহয় গেইমটা চললো।
তোমার কিন্তু পূর্ণ স্বাধীনতা আছে, এখন নেমেই তুমি বিয়ের জন্য না করে দিতে পারো।
যত যাই হোক মায়ের সাথে বোঝাপড়াটা আমি চালিয়ে যাবই।
চোয়াল শক্ত করে বললেন উনি। আমি ভাবনায় পড়ে গেলাম। আমি “না” করলে তা কতটা কার্যকরী হবে জানা নেই। আপাও মনে মনে ডেস্পারেট হয়ে গেছে আমায় এ বাড়ি থেকে দূরে পাঠাতে। সহজ পন্থা হিসেবে হোস্টেলে দিতে পারতো কিন্তু তার মনে ভয়ের উদয় হয়েছে ইনতিসারের সাথে সম্পর্ক আছে আমার। দূরে পাঠালেও আমরা এক থাকবো। তাই আজীবনের জন্য ওর থেকে দূরে সরাতে বিয়ে করাতে চাইছে। সে মানুষটা আজ প্রিতম না হলেও অন্য কেউ হবে অবশ্যই। সেক্ষেত্রে প্রিতম সেফ জোন।
অনেক ভেবেচিন্তে বললাম,
— তাহলে আমাদের বিয়ের কথাবার্তা চলমান থাকুক।
— ব্রিলিয়ান্ট ডিসিশন।
— কিন্তু প্লিজ আপনার মাকে বোঝাবেন বিষয়টা এখন সিক্রেট রাখতে। ইশি আপুর বিয়ে না হওয়া অবধি কেউ যেন জানতে না পারে।
— শিওর। তুমি আমার সাথে কো অপারেট করতে পারলে আমিও পারবো।
— থ্যাঙ্কিউ সো মাচ্
— ডোন্ট বি। জাস্ট বি প্রিপেয়ার্ড তোমায় আমার বিয়ের সাক্ষী বানাবো। আঠারো হয়েছে তো?
— ঊনিশ চলছে।
— ভেরি গুড। বাকি কথা তাহলে কলে হবে। কলে কথা বলতে প্রবলেম নেই তো? ফ্লার্টিং কিন্তু করবো না আমি, নিশ্চিতে থাকো।
— প্রবলেম নেই।
— ওকে দ্যান। ভালো থেকো। আর হ্যাঁ তোমায় কিন্তু ভীষণ প্রিটি লাগছে।
চমৎকার হেসে উনি প্রস্থানের জন্য পা বাড়ালেন। আমিও ভদ্রতাসূচক হাসলাম একটু।
কয়েক কদম যাওয়ার পর কি মনে করে ফের দাঁড়িয়ে পড়লেন প্রীতম।
— ওহ হ্যাঁ, ইনতিসার। বয়ফ্রেন্ড তোমার? তাকে জানাতে চাও না আমাদের ডিলের ব্যাপারে?
ওনার হঠাৎ প্রশ্নে চমকে উঠলাম আমি। ভেবেছিলাম এই অপ্রীতিকর প্রসঙ্গ তুলবেন না হয়তো। কিন্তু তুলে ফেললেন। তড়িঘড়ি করে বললাম,
— নাহ্ না।
— কোনো প্রবলেম হবেনা?
মাথা নেড়ে না বোঝালাম।
— কিন্তু…
কথাটা সম্পূর্ণ করলেন না আর। তার পরিবর্তে বললেন,
— ইনতিসারও কিন্তু আমার পরিচিত। স্কুল লাইফে জুনিয়র ছিল। তাছাড়াও ফ্যামিলি ফ্রেন্ড হিসেবে চিনতাম। অল্প বয়স থেকে দূরন্ত ছেলেটা। স্থির থাকতো না এক মুহুর্তের জন্য৷ ওকে নিয়ে অন্যরকম ভাবনা ছিল আমাদের মাঝে। আমরা ভেবেছিলাম লাইফের প্রতি সিরিয়াসনেস আসবে না ওর, কখনো কারোর ওপর স্থির হতে পারবে না। কিন্তু আমাদের ভাবনাকে ভুল প্রমাণিত করলো শেষ পর্যন্ত। স্থির হয়ে গেল তোমাতে! একজনকে ভালোবাসে শুনেছিলাম। সে যে তুমি তা তো জানতাম না। তোমার জন্য অসীম ভালোবাসা ওর চোখে দেখেছি। বেঁধে রেখো যত্নে। তোমাদের একসাথে কিন্তু মানাবে দারুণ।
স্বভাবসুলভ হাসিটা দিয়ে পকেট থেকে আরেকটা সিগারেট বের করতে করতে নেমে গেলেন উনি। আমি দাঁড়িয়ে রইলাম একবুক হতাশা নিয়ে। যত্নে আগলে রাখবো! ওকে তো আমি চাই ই না। বরং দূরে যেতে চাই ওর থেকে। চিরজীবনের জন্য।
বড্ড ভুল করে ফেললাম৷ একটা হঠকারী সিদ্ধান্তের ফলে ক্ষনিকের জন্য ওর কাছে যাওয়াটা উচিৎ হয়নি। অল্প সময়ের স্মৃতিটা ওকে পোড়াবে আর আমাকেও…
__________________
(২১)
বিয়েতে মত দেয়ায় আপা একটু হলেও চিন্তামুক্ত হলো। প্রীতম সাহেবের মা বললেন দ্রুতই ফ্যামিলি নিয়ে আসবেন বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক করতে। প্রীতম সাহেব কথামতো বিয়ের ব্যাপারটা আপাতত গোপন রাখতে বললেন। ছেলে বিয়েতে রাজি হয়েছে এতেই আন্টি খুশি। খুশিমনে মেনে নিলেন শর্তও।
তারপর দু’টোদিন কাটলো যাচ্ছেতাই অবস্থায়। প্রিতম সাহেবের সাথে কথা হলো টুকটাক। কোচিং-এ পরীক্ষা ছিল দুটো। পড়াশোনায় মন না বসার ফলে দুটোই জঘন্যতম হলো। ইনতিসারের সাথে দেখাদেখি, চোখাচোখি হলো অসংখ্যবার। কি যে অস্বস্তিতে পড়েছিলাম আমি! অথচ ও পুরনো ফর্মে ফিরে গেছে। কখনো চার বছর আগের পাগলাটে ইনতিসার হয়ে যাচ্ছে কখনোবা চার বছর পরের গুরুগম্ভীর। এতটা বছর পর আবারও ওর মুখে গ্লুমি ওয়েদার ডাক শুরু হলো। সেদিন বিয়ের প্রোগ্রামে খাবার খেতে বসেছি তখন কোত্থেকে রোস্টের ডিশ নিয়ে হাজির ও। আমার পাতে দু’টো লেগপিস তুলে দিতে দিতে ফিসফিসিয়ে বলল,
— গ্লুমি ওয়েদার আমার ভাগেরটাও খেয়ে ফেলো। লেগপিসে কামড় দেয়ার সময় মনে করবা তোমার আমার আবারও ঠোকাঠুকি হচ্ছে। ঠোকাঠুকি বুঝলে তো?
অসভ্যের মতো ঠোঁট কামড়ে হাসলো। এত লজ্জা লাগলো আমার!
ওর “ঠোকাঠুকি” যে কোন ইঙ্গিত দিচ্ছিল বুঝতে একটুও কষ্ট হয়নি। রাগে শরীর জ্বলতে শুরু করলো। এই ছেলেটা আসলেই আনপ্রেডিক্টেবল। আমি যে ভাবছিলাম, সেদিনের স্মৃতিটুকু ওকে পোড়াবে। কোথায় পোড়াচ্ছে। জ্বালানো, পোড়ানো, ভোগানো সব তো আমার কপালেই। আমি বরং উস্কে দিয়েছি ওকে। বদমাইশি রূপটা ফিরিয়ে এনেছে। ছিঃ এই ছেলেটাকে আমি সবচাইতে বেশি হেইট করি।

ইশি আপুর সাথে তার বাচ্চা বাচ্চা কাজিনগুলো হৈ হুল্লোড় করতে করতে বোনের শ্বশুরবাড়ি চলে গেল। আমি যদি শুধু পরীক্ষার্থী না হতাম, মাউইমা বোধহয় আমাকেও জোর করে পাঠিয়ে দিতেন। কতবার যে হা হুতাশ করলেন!
ইশশ এই মানুষটা আমায় এত স্নেহ করে কেন? কেন এত ভালোবাসে? বাড়িটা ছেড়ে চলে যাওয়ার সময় বোধহয় সবচাইতে বেশি খারাপ লাগবে এই মানুষটার জন্যই।
মাঝরাতে ব্যালকনিতে শুয়ে এগুলোই ভাবছি এমন সময় পেটের ওপর ফোনটা ভাইব্রেট করে উঠলো। বিরক্তির সাথে হাতে তুলে নিয়ে দেখলাম মেসেজ এসেছে। এই অসময়ে মেসেজ? নম্বরটাতে আরেকবার চোখ বুলালাম। পরিচিত লাগছে কেন! ইনতিসার নয়তো?
মেসেজ ওপেন করে দেখি ঠিক, ও-ই। লিখেছে,
” এ্যাই গ্লুমি ওয়েদার রাত বিরেতে ব্যালকনিতে কি? তোমার প্রিতম বাইরে আসবে না দেখা করতে। আমাদের ঠোকাঠুকি দেখে নিশ্চয়ই ওর বিয়ের শখ মিটে গেছে। তোমার বিয়ে ভাঙতে হেল্প করলাম একটা থ্যাংক্সও দিলে না? তুমি তো আজীবনই এরকম। আনগ্রেটফুল।
আচ্ছা মিস আনগ্রেটফুল এখন আসো তো, ছাদে আসো। কত ইম্পর্ট্যান্ট কথা আছে তোমার সাথে। টাইম ওয়েস্ট না করে জলদি আসো।
হ্যাঁ নিশ্চিন্তে থাকতে পারো চুমু টুমু খেতে ডাকছি না। আমার আবার ওসব ব্যাপারে খুব লজ্জা।”
লজ্জা! এই বেহায়া ছেলেটার আবার লজ্জা! আকাশ থেকে পড়লাম আমি। দাঁত কিড়মিড় করে জঘন্যতম একটা গালি দিয়ে ফোন অফ করে দিলাম সাথেসাথে। কতবড় ছ্যাঁচড়া আর নির্লজ্জ এই ছেলে। দেখলে বোঝা যায়?

চলতে থাক,
sinin tasnim sara

ভালোবাসার রংধনু
১৩
_______________________
২২.
বেশ কয়েকদিন পরের ঘটনা।
এডমিশন টেস্টের আর বেশিদিন নেই। ব্যস্ততা বেড়েছে ভীষণ। প্রীতমের মা বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসবেন জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন। আপাও তো এক পায়ে রাজি। একপ্রকার হাতেপায়ে ধরে আটকেছি তাঁদের। ওদিকে ভদ্রলোকের খোঁজ ছিলোনা এতদিন। আজ সাত সকালে কোত্থেকে ফোন করলো। ভূমিকা-সূচনা ছাড়া বলে দিলো বারোটার দিকে যেন স্থানীয় যে কাজি অফিসটা ওখানে উপস্থিত হই। প্রশ্ন করলাম কেন যাব? উত্তরে বলল, সাক্ষী হওয়ার সময় এসেছে। দ্বিধান্বিত হয়ে ব্যস্ততা দেখাতে চাইলাম। একটা মানুষের ওপর এভাবে চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করা যায় নাকি!
লোকটা ভীষণ চালাক। বুঝে গেল আমি দ্বিধায় পড়ে যেতে চাইছিনা। হাসতে হাসতে বলল,
— কিডন্যাপ করবো না তোমাকে। বিশ্বাস না হলে কোনো ফ্রেন্ডকে নিয়ে এসো। ওরাও নাহয় আমার বিয়েতে সাক্ষী হবে। সবচাইতে ভালো হয় ইনতিসারকে ডাকলে।
আমি তড়িঘড়ি করে বলে উঠলাম,
— না না ওকে ডাকবার কোনো প্রয়োজন নেই।
— কেন? ও এলে বরং সুবিধা হয়। ছোটভাই ঝামেলা হলে হেল্প করতে পারবে। তাছাড়া আমাদের বিয়ের কথাবার্তা চলছে এই খবর নিশ্চয়ই ওর কানেও গেছে? বুঝিয়ে বলবো সবটা যেন মিসআন্ডার্স্ট্যান্ডিং না হয় তোমাদের মাঝে।
— না প্লিজ। ও এলে বরং ঝামেলা বাড়বে। ওকে ডাকবার দরকার নেই।
— আমি তো তোমায় হেল্প করতে চাইছিলাম।
— কোনোই প্রয়োজন নেই। আমি হ্যান্ডেল করে নিতে পারবো।
— সত্যি পারবে তো?
— হু পারবো।
— ওকে। আমার না হওয়া লিটল ব্রাইড আগামীকাল তাহলে দেখা হচ্ছে?
— এই এক মিনিট, কি বলে ডাকলেন আপনি আমাকে?
খানিক বিস্ময়, খানিক রাগ মিশ্রিত গলায় বললাম। বিনিময়ে উনি গাঢ় করে হাসলেন।
— না হওয়া লিটল ব্রাইড। কীভাবে যেন এসে গেল ডাকটা। তুমি মাইন্ড করেছ?
— অবশ্যই করেছি। এসব নামে ডাকবেন না আমাকে প্লিজ।
— কেন সন্দেহ হয়? গার্লফ্রেন্ডের কথা বানিয়ে বলেছি মনে হয়?
এ প্রশ্নের উত্তরে কিছু বললাম না আমি। উনি বোধহয় আবারও হাসলেন। বললেন,
— ওকে ফাইন। রেগে যাওয়ার কিছু নেই। তোমার ভালো না লাগলে আর ডাকবো না এভাবে। লিটল ফ্রেন্ড বলে ডাকবো। খুশি?
— হু।
মৃদু শব্দে উচ্চারণ করলাম আমি। উনি তাড়া দিয়ে বললেন,
— আবারও বলছি কাল জলদি চলে এসো। সম্ভবত কালই তোমার সাথে আমার শেষ দেখা।
— আসবো।

ফোন রেখে ব্যালকনির দিকে পা বাড়ালাম । লাইফ আসলেই আনপ্রেডিক্টেবল। একটা নতুন দিনে কত নতুন মুখের সাথে পরিচয় ঘটতে পারে, কতশত নতুন ঘটনার সম্মুখীন হতে পারি তা কখনোই আগে থেকে চিন্তা করা যায়না।
এই যে প্রিতম সাহেব! কখনো স্বপ্নেও কল্পনা করেছিলাম এমন একটা অদ্ভুত মানুষের সাথে একসময় দেখা হবে!খুব অদ্ভুতুড়ে একটা ঘটনা স্মৃতির পাতায় উঠে যাবে! হয়তোবা আগামীকালকের পর আর কখনো দেখা হবেনা, কথা হবেনা। কিন্তু তার সাথে ক্ষণিকের রোমাঞ্চকর এক ঘটনার এই স্মৃতি মনের খাতায় লেখা থাকবে সারাটা জীবন।
___________
২৩.
খুব ইম্পর্ট্যান্ট একটা শিট নেয়ার জন্য জিনিয়ার বাসায় যেতে হয়েছিল একবার। আন্টি ছিলেন বাসায়। আমায় দেখে তাঁর কি যে ব্যস্ততা! খাবার না খেয়ে আসতে দেবেন না। ইম্পর্ট্যান্ট কাজের কথা বললেও মানানো গেল না। অগত্যা বসে যেতে হলো ওখানে। খেতে গিয়ে হয়ে গেল দেরি। খাওয়ার মাঝেই প্রীতম সাহেবের কল পেলাম তিনবার। ভালোই বিরক্ত হয়েছেন উনি। জ্যামের দোহাই দিয়ে বাঁচতে চেষ্টা করলাম।
একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, “এক্সকিউজ দিতে হবেনা লিটল ফ্রেন্ড। যত দ্রুত সম্ভব এসে পড়ো। ওয়েট করছি”
রিকশায় উঠতে উঠতে লজ্জায় জিভে কামড় দিলাম দু’বার। মন পড়ে ফেলার বিশেষ ক্ষমতা আছে কি এই লোকের? যাই বলি তাতেই আটকে দেয়।
যেতে যেতে একবার মনে হলো আচ্ছা এই লোক আমাকে এত তাড়া দিচ্ছে কেন? এমন তো নয় আমি ছাড়া তার আর কোনো ফ্রেন্ড নেই! বরং এতবড় মানুষটার ফ্রেন্ড সার্কেল বিরাট। তাহলে আমাকে এত তাড়া দেয়ার কি আছে? যাব নাকি যাবনা! গিয়ে কোনো বিপদে পড়লে!
দ্বিধার মাঝেই কখন কাজি অফিসের সামনে এসে পড়েছি বুঝতে পারিনি। ধ্যান ভাঙলো রিকশাওয়ালার ডাকে। ভদ্রলোক একবার কাজি অফিসের সাইনবোর্ডটার দিকে তাকাচ্ছেন একবার আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছেন। খুব বিরক্ত হলাম আমি। বিয়ে তো আমার না, মানুষের বিয়েতে সাক্ষী হতে এসেছি। না জেনেই ভুলভাল ধারণা করে কেন মানুষ আজব!
তড়িঘড়ি করে রিকশা থেকে নেমে ভাড়া মিটিয়ে গেইট দিয়ে ঢুকে গেলাম ভেতরে। একটা পুরাতন টাইপ পাঁচ তলা ভবনের নিচ তলায় কাজি অফিস। একটু এগিয়ে যেতেই প্রিতম সাহেবকে দেখা গেল পায়চারী করা অবস্থায় । ওনাকে দেখার পর তাড়াহুড়ো আপনা থেকেই কমে এলো আমার। খুব ধীরেসুস্থে হেলেদুলে এগিয়ে গেলাম।
— আর কেউ নেই? আপনি একা কেন?
চারিদিকে নজর বুলাতে বুলাতে প্রশ্ন করলাম। দ্রুত পায়ে এ মাথা-ওমাথা পায়চারী করার দরুণ উনি আমার প্রশ্নটা শুনতে পেলেন না। গলায় জোর বাড়িয়ে ডাকলাম,
— এই যে?
এবারে শুনতে পেলেন। পায়চারী থামিয়ে অল্প করে হাসলেন। হাসিতে নার্ভাসনেস। বাপরে চোখেমুখে চালাক লোকটা আজ এত নার্ভাস! খানিক অবাক হলাম আমি ।
— তুমি এসেছ?
— এসেছি তো। কিন্তু আপনি একা কেন? আর কেউ নেই?
— আছে ভেতরে। এসো?
— আপনি বাইরে দাঁড়িয়ে কেন?
ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে শুধলাম আমি। উনি প্রতুত্তর করলেন না।

মাঝারি সাইজের একটা ঘর কাঠের আসবাবে ভরা। আসবাব গুলোতে কাগজের ছড়াছড়ি। একটা মাঝারি মতো টেবিল বসানো ঘরের মাঝখানে। তার সামনে বসে রিমলেস চশমা পরা বৃদ্ধ কাজি সাহেব কাগজে ঘসঘস করে লিখছেন কিছু।
ঘরটায় একটা কাঠের বেঞ্চও পাতা আছে। সেখানে প্রীতম সাহেবের ছোট বোন বসে। ভাইয়ের বিয়েতে এই মেয়েরও সাপোর্ট আছে?
ভীষণ অবাক হয়ে আমি প্রীতম সাহেবের দিকে তাকালাম। উনি আবারও নার্ভাস হেসে মাথা নাড়লেন। তার মানে হ্যাঁ, বোনও ভাইয়ের বিয়েতে সাক্ষী হতে এসেছে।
প্রীতম সাহেব বেঞ্চটার দিকে ইশারা করে বোঝালেন, বসো।
বসলাম না আমি। চুপচাপ দাঁড়িয়ে ঘরটায় আরেকবার চোখ বুলালাম। আচ্ছা কাজি অফিস তাহলে এরকম হয়? এ তো কাজি অফিস কম উকিলদের কাচারিঘর মনে হচ্ছে বেশি ।
— এ-ই তাহলে কনে?
কাজি সাহেবের গমগমে আওয়াজ শুনে চমকে তাকালাম আমি । চশমার ফাঁক দিয়ে চোখ ছোট ছোট করে আমার দিকেই তাকিয়ে আছে লোকটা। দৃষ্টিতে পাহাড় সমান বিরক্তি। আরেহ্ ভুল বুঝছে তো । ভ্রু কুঁচকে প্রীতম সাহেবের দিকে তাকালাম। উনি তড়িঘড়ি করে এগিয়ে গিয়ে বললেন,
— না, না। ও তো আমার ফ্রেন্ড। কনে আসছে।
— আরে ভাই আসছে আসছে বলছেন কখন থেকে। পুরো আড়াই ঘণ্টা হয়ে গেল । কনে এখনও আসেনা? দৃষ্টির বিরক্তি সারা মুখে ছড়িয়ে পড়লো লোকটার৷ প্রীতম সাহেব নার্ভাসভাবে ঘড়ি দেখলেন। মিনমিন করে বললেন,
— এখনই এসে পড়বে।
আমি ভাবনায় পড়ে গেলাম। মেয়েকে নাকি বন্ধুর হেফাজতে রেখে এসেছিল? মেয়ে আবার সুযোগ বুঝে ফুড়ুৎ হয়েছে নাকি!
প্রশ্নবিদ্ধ চোখে বেঞ্চটার দিকে এগিয়ে গেলাম। বসার খানিক পর প্রিতমের বোন ফোনের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বলল,
— সেই কখন পার্লারে গেছে এখনও আসছে না। মানুষ তো ভুল ধারণা করে বসবে বউ পালিয়েছে কি না!
বিড়বিড় করে বললেও খুব স্পষ্টভাবে কথাগুলো শুনতে পেলাম আমি। আঁড়চোখে একবার তাকালাম মেয়েটার দিকে। ও কি আমাকে উদ্দেশ্য করে বলল এই কথা? আমার মনে উত্থিত প্রশ্ন ও কীভাবে বুঝলো? এরা সবাই কি অন্তর্যামী!

রোবটের মতো বসে থাকতে হলো আরও আধ ঘণ্টা। তারপর হোন্ডা পিটিয়ে হই হই করতে করতে একদল ছেলেমেয়ে এলো। তার সাথে এলো প্রীতম সাহেবের প্রেয়সী। টুকটুকে লাল স্বর্ণ কাতান জড়িয়ে একদম নতুন বউ। আমি মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে দেখতে লাগলাম এক অপার সৌন্দর্যের মূর্ত প্রতীককে। খানিক লম্বাটে মুখ, ধারালো নাক, ভীষণ ঘন ভ্রু-যুগল, টানা টানা চোখ আর ঘনকালো চোখের পাপড়ি৷ ঠোঁটের ভাঁজটাও ভীষণ সুন্দর। স্নিগ্ধতা মাখানো তার সৌন্দর্য আরও কয়েকগুণ বেড়ে গেছে প্রসাধনীর হালকা ছোঁয়ায়। চুলগুলো বোধহয় অনেক বড়। খোঁপাটা কতবড় হয়েছে! সিঁথি কেটে দেয়ায় বউ বউ ভাবটা ফুঁটে উঠেছে বেশ । লোকে দেখলেই চট করে বুঝে ফেলবে এ নতুন বউ।
তবে উপচে পড়া সৌন্দর্যের মাঝেও কিসের একটা শূন্যতা হঠাৎ দৃষ্টি আকর্ষণ করলো আমার। ব্যতিব্যস্ত হয়ে খুঁজতে লাগলাম সেই শূন্যতার উৎস। এক নিবেশে তাকিয়ে থাকবার পর মনে হলো মেয়েটার মুখে হাসি নেই এক ফোঁটা। বিষণ্নভাবে দাঁড়িয়ে আছে প্রীতম সাহেবের পাশে। এটাই তার সৌন্দর্যটাকে ফিঁকে করতে চাইছে। তবে যাকে যত্নে আগলে দাঁড়িয়ে আছে চিরচেনা প্রেমিক পুরুষটা, যেকোনো পরিস্থিতিতেই তার সৌন্দর্য ফিঁকে হতে সে দেবে কেন?
দেখলাম প্রেয়সীকে সাহস যোগাতে প্রিতম সাহেব আলতো করে তাঁর আঙুলের ভাঁজে আঙুল গুঁজে দিলেন। প্রেমিকের আলতো স্পর্শে চোখ তুলে তাকাল সে। সাথেসাথে মুক্তোর দানার মতো দু ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল তাঁর চোখ থেকে। প্রিতম সাহেব ইশারায় কাঁদতে নিষেধ করলেন ওকে। একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করে আলগোছে মাথা নাড়লো ও। সম্মতি পেয়ে হাসলেন প্রিতম সাহেব। বিনিময়ে মেয়েটাও হাসল অল্প করে। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখলাম ওদের দু’জনকে। পাশাপাশি এদের এতটা মানায়! ভালোবাসা জিনিসটাকে সবসময়ই নানা বাহানায় এড়িয়ে গেছি আমি। কখনো কাউকে নিয়ে কল্পনা আসেনি। নিজের ক্ষেত্রে না হোক অন্যদের দেখলেও ভালোলাগার কোনো অনুভূতি হয়নি কখনো।
আজ পর্যন্ত অনেক কাপল দেখা পড়েছে রাস্তায়, অধিকাংশ সময় বিরক্তির সাথে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছি। আজও, ক্ষণিক পূর্বেও ভীষণ বিরক্ত লাগছিলো এদের বিয়ের ঝামেলা। বারবার মনে হচ্ছিল কেন আসতে গেলাম এখানে! এসব নাটক দেখতে আর ভালো লাগছে না। কতখানি সময় নষ্ট হচ্ছে আমার!
কিন্তু এক মুহুর্তে কি হয়ে গেল! চোখের সামনে একটা ভালোবাসা পূর্ণতা পেতে দেখে খুব আনন্দ হলো আমার। এতক্ষণ যেটাকে সময় নষ্ট মনে হচ্ছিল সেটাকেই এখন জীবনের সবচাইতে আনন্দঘন মুহুর্ত মনে হচ্ছে।
ভালোবাসা জিনিসটা এত মধুর! অল্প অল্প করে গড়ে ওঠা একটা সম্পর্ককে সামাজিক স্বীকৃতি পেতে দেখতে এত ভালোলাগে,তাহলে ভালোবাসাকে আপন করতে না জানি কতটা সুখ অনুভূত হয়!
আজ মন থেকে প্রার্থনা আসছে পৃথিবীর সব ভালোবাসায় সিক্ত মানুষগুলোর জন্য৷ এক জীবনে ভালোবাসাকে আপন করার শক্তি পাক তারা। প্রিয় মানুষটার হাতে হাত রেখে কাটিয়ে দিক সহ-সহস্র বছর। এক পৃথিবী সুখ নেমে আসুক তাদের জীবনে।
__________________
২৪.
প্রিতম সাহেবের বিয়ের ঝামেলা শেষ হলে তার বন্ধুবান্ধবসহ আমায় ট্রিট দেবেন বলে নিয়ে যেতে চাইলেন। কিন্তু এতক্ষণে অনেক সময় নষ্ট হয়ে গেছে বলে আর দেরি করতে চাইলাম না আমি। উনি আক্ষেপ করে বললেন,
— আমার লাইফের একটা ইম্পর্ট্যান্ট দিন আজ, যেটা তোমার কারণেই এলো। কোথায় তুমি আমার আনন্দে সামিল হবে, তা না পালাই পালাই করছো? আজই তো শেষ। আর কখনো আমাদের দেখা হবে কি না সন্দেহ। আর অল্প কিছুক্ষণ নাহয় সঙ্গ দিলে আমাদের।
আমি খুব স্যরি হয়ে বললাম,
— দেখুন আমার তো পরীক্ষা। এখন একটা মিনিট নষ্ট করলেও ভোগান্তি আমার৷ সেখানে কতটা দেরি হয়ে গেছে। প্লিজ না করবেন না। যেতে দিন আমাকে। আমি মন থেকে দুআ করি আপনাদের জন্য। খাওয়াদাওয়া এসব তো ফর্মাল।
পরীক্ষার কথা বললে উনি একটু দমে গেলেন৷
— লিটল ফ্রেন্ড তুমি এত পড়কুট!পড়ালেখার কথা বলে আটকে দিলে তো আমায়। ওকে নো প্রবলেম৷ জানিনা আর কখনো তোমার সাথে দেখা হবে কি না তবে মনে রাখবো তোমায় আজীবন।
— আমিও আপনাদের কখনো ভুলতে পারবো না।
আলতো হেসে বললাম আমি।
— খাওয়াতে তো দিলে না। তাহলে একটা রিকশা ঠিক করে দিই?
— তা দিন।
রিকশা ঠিক করে দেয়ার পাশাপাশি ভাড়াটাও দিয়ে দিলেন উনি রিকশাওয়ালাকে। এত না করলাম কোনো কাজ হলো না। আমায় বিদায় জানিয়ে ওনারা চলে গেল বাইকে করে। আমি রওয়ানা হলাম বাড়ি পথে। দু মিনিটও হয়নি, চৌরাস্তা পার হয়ে একটা গলিতে ঢুকেছি হঠাৎ এক কালো রঙের বাইক এসে পথ আগলে দাঁড়ালো আমাদের । প্রথমে ভয়ে চোখ বড় বড় করে ফেললাম আমি। তবে ভয়টা বেশিক্ষণ থাকলো না যখন বাইক আরোহী তার মাথার হেলমেটটা খুললো । অবাক হয়ে দেখলাম সেদিন জিনিয়াদের বাড়িতে যে ছেলেটার সাথে দু’বার ধাক্কা খেয়েছিলাম সে। ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলাম,
— আপনি আমার পথ আটকে দাঁড়ালেন কেন?
সে তড়িঘড়ি করে বলল,
— এই ভুল বুঝবেন না প্লিজ। আপনার সাথে খুব ইম্পর্ট্যান্ট কথা আছে আমার। তাই মাঝরাস্তায় এভাবে আটকাতে হলো।
— আমার সাথে!
— হু আপনার সাথে। দু’টো মিনিট দিন শুধু। এ্যাই মামা রিকশাটা একটু সাইডে চাপাও তো।
রিকশাওয়ালাকে অনুরোধ করলো ছেলেটা। ওর অনুরোধ শুনে রিকশাওয়ালা আমার মুখের দিকে তাকালো পারমিশনের আশায়। আমি আশেপাশে ভালো করে দেখে নিলাম, অদূরে একটা জাম রঙা গাড়ি পার্ক করা। তাছাড়া আশেপাশে তেমন লোকজন নেই। ছেলেটা আমার ভয় আঁচ করতে পেরে বলল,
— আমি জিনিয়ার আপন জ্যাঠাতো ভাই। প্লিজ খারাপ ভাববেন না আমাকে। শুধু দু মিনিট নেবো আপনার।
ছেলেটার এত রিকোয়েস্ট ফেলতে পারলাম না আর, আগ্রহও হলো খানিক। আমার সাথে এই ছেলের কি এমন কথা থাকতে পারে? মূলত আগ্রহ দমন করতে না পেরে রিকশাওয়ালাকে নির্দেশ দিলাম রিকশাটা সাইড করতে।
ছেলেটা নরম করে হাসলো এবার। বাইকের ওপর হেলমেট রেখে এসে আমার সামনে দাঁড়ালো। আমি ব্যস্ত ভঙ্গিতে ঘড়ির দিকে তাকাতে তাকাতে বললাম,
— তাড়াতাড়ি বলে ফেলুন যা বলার। ঘড়ি দেখে দু মিনিট সময় দেবো। এর এক সেকেন্ড বেশি না।
— হ্যাঁ হ্যাঁ। দু মিনিটে হয়ে যাবে।
— তো বলুন জলদি!
— ইয়ে মানে। মিস কবিতা, আপনি আমার বউ হবেন?
দ্বিধাহীন বলল ছেলেটা। ওর কথা শুনে আমি চমকে তাকালাম। ঠিক শুনছি তো? কি বলল ও? হতভম্ব হয়ে প্রশ্ন করলাম,
— কি বললেন আরেকবার বলুন?
— আপনি আমার বউ হবেন?
কপালের ঘাম মুছতে মুছতে ও বোকার মতো হেসে দ্বিতীয়বার প্রশ্নটা আওড়ালো। আমি নির্বাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম ওর মুখের দিকে। একদিনের পরিচয় একটা ছেলের সাথে। নেই কথাবার্তা নেই কিছু, কেবল ধাক্কা। সেই ছেলে আজ কোত্থেকে এসে পথ আগলে ধরে আমায় বিয়ের প্রস্তাব দিচ্ছে। এরকম অদ্ভুত সিচুয়েশন কারো লাইফে কখনো এসেছে কি? এরকম সিচুয়েশনে কি বলতে বা করতে হয় জানা নেই আমার৷ হতভম্বতা কাটিয়ে একে কি উত্তর দেবো সেটাও বুঝে উঠতে পারলাম না। শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলাম ওর দিকে বোকার মতো।
চলবে,
sinin tasnim sara

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here