ভালোবাসার রংধনু,১৭ (১৮+অ্যালার্ট)

0
1047

১৮+অ্যালার্ট
ভালোবাসার রংধনু
১৭
______________
২৯.
ফ্রেশ হয়ে বেরুতেই দেখলাম আপা বিছানার ওপর বসে আছে। হাতে কতগুলো গয়না। অদ্ভুত নজরে একবার গয়নার দিকে একবার আপার দিকে তাকিয়ে আপাকে উদ্দেশ্য করে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলাম,
— গয়না কিসের জন্য আপা?
আমার প্রশ্নে মুখ তুলে চাইল আপা। কাষ্ঠ হেসে বলল,
— আয় নীরদ?
ভেজা চুল বাঁধতে বাঁধতে ওর পাশে গিয়ে বসলাম আমি।
— বললে না গয়না কেন?
— ওহ এগুলো? এগুলো বিক্রি করলে লাখ খানেক টাকা হবে বুঝলি। আমার হাতে তো এই মুহুর্তে কোনো ক্যাশ নেই। তুই বরং এগুলো বেচে কোনো গার্লস হোস্টেলে ওঠ।
গয়নার পোটলাটা আমার দিকে বাড়িয়ে দিলো আপা। আমি বজ্রাহতের মতো তাকালাম ওর দিকে।
— এগুলো আমি কিছুতেই নিতে পারবো না আপা। মায়ের গয়না এগুলো। আর গয়না বেচেই বা টাকা জোগাড় করতে হবে কেন? ব্যাংকে তো টাকা আছেই। সেখান থেকে উইথড্র করলেই হয়।
আপা এবারে মাথা নিচু করে ফেলল। আমি স্পষ্ট দেখলাম ওর চোখের কোণে জল। কম্পিত স্বরে বলল,
— আ…আসলে নীরদ টাকাগুলো একটা জায়গায় আটকে রয়েছে। ব্যাংকে এই মুহুর্তে কোনো টাকা নেই। তবে তুই চিন্তা করিস না টাকা আবার এসে যাবে।
— নেই মানে? কেন নেই? তবে এতদিনের সব খরচ!
আপা একটু সংকোচ বোধ করলো কথা বলতে।
— বলো আপা? এতদিনের সব খরচ কোত্থেকে এলো?
— আমার.. আমার গয়না বিক্রি করে।
— গয়না বিক্রি করে! তুমি তোমার বিয়ের গয়না বিক্রি করে আমার খরচ চালাতে আপা?
অবাক হয়ে আপার হাতে হাত রাখলাম আমি। আপা মুখটা আরও নিচু করে ফেলল। ওর চোখ থেকে ঝরা উষ্ণ পানির ফোঁটা আমার হাতের ওপর টুপটুপ করে পড়ছে।
কিছুটা আন্দাজ করতে পারছি আমার টাকাগুলো হয়তোবা দুলাভাই-ইই..
বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো আমার। আপার চোখের পানি মুছে দিয়ে বললাম,
— থাক আপা আমি নাহয় ক’দিন পরেই যাব এই বাড়ি ছেড়ে। একটা ইউনিভার্সিটিতে উঠে নেই। তারপর তো হল পাওয়া যাবে।
— তোর পরীক্ষারও তো বেশিদিন নেই নীরদ৷ এখানে দম বন্ধ লাগলে তুই মন দিয়ে পড়বি কি করে? তারচেয়ে গয়নাটা নে। চল বিক্রি করে..
আপার মুখে হাত দিয়ে ওর কথা আটকালাম।
— মায়ের শেষ স্মৃতি এগুলো আপা। এগুলোর সাথে তার আশীর্বাদ জড়িয়ে আছে। আমি তো মা’কে পাইনি ঠিকমতো। এসব অন্তত অক্ষত থাক। মনে হবে মা আছে সাথে।
আমার কথা শুনে আপা আমায় জড়িয়ে ধরলো। আপার মায়াময় স্পর্শে গলে আমার চোখ থেকেও দু ফোঁটা অশ্রু ঝরে পড়লো। কতক্ষণ আমার কাঁধে মাথা রেখে আপা কাঁদলো আর মাফ চাইল আমানত রক্ষা করতে পারেনি বলে।
আমি ওকে সান্ত্বনা দিলাম। টাকা খোয়ালে টাকা পাওয়া যায় কিন্তু স্মৃতি হারালে কি আর স্মৃতি ফিরে পাওয়া যায় ?
অথচ ভেতরে ভেতরে লজ্জায় কুণ্ঠিত হয়ে যাচ্ছি আমি। প্রথমে দুলাভাইয়ের অপকর্ম নিজ চোখে দেখা, তারপর ইনতিসারের সাথে ওসব। এতকিছুর পরেও আবার এবাড়িতেই! কীভাবে থাকবো?
এতবড় বেহায়া হতে পারবো তো?
সেভিংস বাদে আমাদের খরচের অন্য কোনো মাধ্যম নেই। যা সম্পত্তি ছিল তা তো সব বিক্রি করেই সেভিংস করা হলো৷ আর আমাদের বোনেদের প্রাপ্যও সব ভাগ বাটোয়ারা হয়ে গেছে বহু আগে ।
আমার ভাগে বরং বেশিই পড়েছিল। আপা তখন বলেছিল একবার, ঐ টাকা দিয়ে জমিটমি কিনে রাখবে। কিন্তু পরে কেন যেন আর কিনলো না!
এখন সেই টাকাও দুলাভাই যদি হাতিয়ে নিয়ে থাকে সেখানে আমার আর কি বলবার!
অবশ্য এখানে আইনি পন্থা অবলম্বন করলে কাজ হতো। কিন্তু সমাজে আমার স্থানটা দুলাভাইয়ের তুলনায় নড়বড়ে। কেইস চালাতে হলেও টাকাপয়সার দরকার। সে টাকাপয়সা পাবো কোথায়?
— শোন আমি ভাবছি কি, বড়পা অথবা মেজোপাকে বলি। যদি কিছু ধার দিতে পারে? আমাদের টাকা ম্যানেজ হলেই আমরা ওদের ফিরিয়ে দেব।
কান্না থামিয়ে বলল আপা।
— না আপা ওসবের দরকার নেই৷ তখন মাথা গরম ছিল কি না কি বলেছি!
— নাহ্ তুই থাম। এটাই একটা ভালো উপায়। আরে আমরা ফিরিয়ে দেব তো ওদের টাকা। তুই বস তো আমি কথা বলে দেখি ওদের সাথে।
আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে আপা বেরিয়ে গেল ঘর ছেড়ে।
আমি আশাহত বসে রইলাম৷ কাজ হবেনা জানি। বড় আপা আর মেজো আপাকে বললে তারা সোজা বলে দেবে, টাকা নেই। সাথে টিপ্পনীও কাটবে। একে তো ওদের চাইতে সেজোপার শ্বশুরবাড়ির অবস্থা ভালো জন্য এক আক্রোশ আগে থেকেই আছে, তারউপর ওরা হাত খোলা টাইপ না। সারাজীবন নিয়েই গেছে কক্ষনও দিতে শেখেনি। সুবিধাবাদী বোনেরা আমার।

আমি জানতাম কাজ হবেনা। ঠিক তাই। খাওয়ার পর আপা এসে শুকনো মুখে বলল, ওদের কাছে টাকা নেই৷ নিজেরাই নাকি নানাবিধ সমস্যায় জর্জরিত।
আমি মুচকি হেসে আপাকে বললাম,
— শোনো আমি এখন ঠিক আছি। এসব নিয়ে চিন্তা করতে হবেনা আর। বাহ্যিক কিছু আমার পড়াশোনার প্রতি মনোযোগ হটাতে পারবে না দেখো তুমি৷ আল্লাহ’তায়ালা পরীক্ষা নিচ্ছেন আমাদের। জলদিই এই পরীক্ষার সময়টা কেটে যাবে।
— তাই যেন হয় রে নীরদ।
হতাশভাবে চলে গেল আপা। আমি আর শুলাম না৷ জোর করে পড়তে বসলাম। এক দু ঘণ্টা বহু কষ্টে পড়ার পর আর সম্ভব হলো না। বই বন্ধ করে শুতেই হলো।
শোবার আগে ব্যাগের ভেতর থেকে ফোনটা বের করে দেখি একটা অপরিচিত নম্বর থেকে অনেক মিসডকল। এত রাতে কে কল দিতে পারে? ভ্রু কুঁচকে কল ব্যাক করলাম আমি। ফোনটা বাজলো ঠিক কিন্তু রিসিভ হলো না। কে না কে! আমিও আর ঘাঁটালাম না।
এখন অন্য চিন্তায় মাথা খারাপ হচ্ছে। আপার কাছে যেহেতু টাকা নেই তাহলে আমার এডমিশানের যেসব যানবাহনের খরচ লাগবে ওগুলো কোথায় পাবো?
আপাকে আর গয়না বিক্রি করতে দেয়া যাবেনা। তবে? টাকা কোত্থেকে আসবে?
ভাবনার ভেতর হঠাৎ মনে পড়লো বাবা আমাকে প্রতি জন্মদিনে কিছু না কিছু ছোটখাটো স্বর্ণের জিনিস গিফট করতো। ছোটবেলাকার আংটি, কানের দুল আর গলার পাতলা চেন আছে। এগুলোর মধ্যে যেকোনো একটা বিক্রি করলে কি যানবাহনের খরচ ওঠানো সম্ভব নয়? স্বর্ণকারের দোকানে গিয়ে দেখতে হবে। তাহলে বাড়ি ছাড়ার সিদ্ধান্ত বাতিল।
তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটে উঠল ঠোঁটের কোণে।
বাবা বেঁচে থাকা অবস্থায় আমরা বোনেরা ছিলাম রাজরানির মতো৷ স্পেশালি আমি! কখনো কোনোকিছুর অভাব বোধ হয়নি বাবার সংসারে।
অথচ আজ বাবার সবচাইতে আদরের মেয়েটার কি দুর্গতি!
আমাদের বাবা বেশি শিক্ষিত ছিল না অথবা আমাদের ব্যবসাও তেমন বড় ছিল না। এই মাঝারি আকারের ব্যবসা ছিল একটা। রড, সিমেন্টের। গ্লাসের ব্যবসাও দিতে চেয়েছিল বাবা, তা তো মাঝপথে বন্ধ হয়ে গেল। সংসারে কত উত্থান-পতন এসেছে! কিন্তু কখনো তার আঁচ আমাদের গায়ে আসেনি। মেয়েদের সর্বোচ্চ সুখ নিশ্চিত করতে যা প্রয়োজন তাই করেছে বাবা।

নীরদ অর্থ বোধহয় সত্যিকারের কালো মেঘ। কেবল বিষণ্ণতায় ভরপুর৷ এক ফোঁটা আনন্দের স্থান নেই এ জীবনে।
___________
৩০.
ওসব ভাবনায় নিমজ্জিত থাকতে থাকতে কখন যে ঘুমিয়েছি! ঘুমটা হালকা হলো অদ্ভুত অনুভূতিতে। মনে হচ্ছে কেউ আমায় আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে আছে এবং এই জড়িয়ে ধরার ভঙ্গিমা খুব, খুব অশ্লীল। তার এক পা দিয়ে আমার পা চেপে ধরা আর রুক্ষ হাত আমার কামিজ গলিয়ে পুরো শরীরে বিচরণ করছে। খারাপ কিছু হচ্ছে আঁচ করতে পেয়ে চমকে উঠলাম আমি। তখনই বুঝতে পারলাম সত্যিকার অর্থে এক পুরুষ আমার সাথে ঘৃণ্যতম কাজগুলো করছে। ভয়ে থরথর কাঁপতে কাঁপতে আমি গায়ের জোরে লোকটাকে ছাড়ানোর চেষ্টা করলাম নিজের থেকে।
জেগে গেছি বুঝতে পেরে লোকটা আরও চেপে ধরলো আমায় নিজের সাথে। কেঁদে ফেললাম আমি। চিৎকার দিতে যাব ঐ মুহুর্তে এক হাতে আমার মুখ চেপে ধরে লোকটা উঠে আমার পেটের বসলো। ড্রিম লাইটের মৃদু আলোয় লোকটার চেহারা দেখে আৎকে উঠলাম আমি। দুলাভাই!
আমায় হাত পা ছুঁড়তে দেখে দুলাভাই ফিসফিসিয়ে বলল,
— শশস্। শব্দ করো না। কেউ জেগে গেলে মুশকিল হয়ে যাবে। আমি তো বোঝাপড়া করতে এসেছিলাম তোমার সাথে। কিন্তু ঘুমন্ত তোমায় দেখে…
তুমি এত সুন্দর নীরদ! এত রসালো তোমার শরীর। এই বুক, পেট, তারপর পেছন দিকটা! ইশশ এত নরম সব। গা থেকে কি নেশাতুর গন্ধ আসে তোমার! আরেহ তুমি তো সব ছেলেদের কামনা। উফফ!
বিশ্বাস করো আগে দেখলে, তোমায় ছেড়ে তোমার ঐ হারামজাদি বোনটার কাছে কক্ষনই যেতাম না আমি। কেন আগে দেখিনি তোমায় বলো তো? শুধু শুধু *গীটাকে বিয়ে করে ঠকে গেছি। জাহান্নাম বানিয়ে দিয়েছে আমার জীবনটাকে ও। যাক ওর কথা বলে মুড নষ্ট করবো না।
তুমি, তুমি আমার সাথে কো অপারেট করো নীরদ। রাজরানি করে রাখবো তোমাকে।
প্রমিস করছি বাইরের সব সম্পর্কও বাদ দিয়ে দেব। শুধু তুমি আমায় একবার..
হাত সরিয়ে আমার মুখের ওপর ঝুঁকে এলো দুলাভাই। ওর অশ্লীল কথাবার্তা আর নোংরা স্পর্শে রাগে ক্ষোভে হিতাহিতজ্ঞানশূন্য আমি গায়ের জোরে চড় মেরে দিলাম ওর গালে।
চড় দিয়ে যদিও নড়াতে পারলাম না এক চুল তবে ক্ষেপে গেল অমানুষটা। বিছানায় শক্ত করে চেপে ধরে লম্পটের মতো হেসে বলল,
— শালিকার হাতের মারও এত মধুর। না জানে শালিকা কত মধুর হবে! নাহ্ টেস্ট একবার করতেই হয়৷
হাসতে হাসতে আমার কাঁধের কাছে কামড়ে ধরলো পাষণ্ডটা। আমি যন্ত্রণায় আপার নাম ধরে জোরে চিৎকার করে উঠলাম। সর্বোচ্চ দু’বার ডাকতে পেরেছি সাথেসাথেই দুলাভাই আবার মুখ চেপে ধরলো আমার। দাঁত কটমট করতে করতে একটা নোংরা গালি পাস করে আশেপাশে কি যেন খুঁজতে খুঁজতে বলতে লাগল,
— ভালো কথার মানুষই না তোরা। ভালোভাবে বলছি আমার সাথে একবার সম্পর্ক করেই দেখ রাজরানি হয়ে থাকবি কিন্তু নাহ্ ভালো কথা শুনবি কেন তোরা? তোদের জন্মই হইছে দাসীদের মতন রেপড হওয়ার জন্য৷ ভিখিরির দল সব!
আক্রোশে আমার বুকের কাছটায় চেপে ধরলে এবারে আমিও আর থেমে থাকলাম না। একহাতে ওর মুখ খামচে ধরে আমার মুখে চেপে রাখা ওর হাতটায় সর্বশক্তি দিয়ে কামড়ে দিলাম। ব্যথায় যখন ছিঁটকে সরে গেল জানোয়ারটা তখন উঠে ডেস্ক টেবিলের ওপর থেকে ল্যাম্পশেড তুলে নিয়ে এলোপাথাড়ি আঘাত করতে লাগলাম ওর শরীরে। রক্তাক্ত হলো বোধহয়! আর্তচিৎকার করে উঠল সাথেসাথে। বাঁধা দেয়ার সুযোগ পেলো না তার পূর্বে ঘরের দরজায় একসাথে কয়েকটা হাতের থাবা আর মাউইমা, আপাসহ অনেকের গলা শোনা গেল।
আপন মানুষরা এসেছে নিশ্চিত হলে ল্যাম্পশেড ফেলে ছুটে গিয়ে দরজা খুললাম আমি। দরজা খোলা মাত্র হুড়মুড় করে ঢুকে গেল সকলে।
এতক্ষণে প্রাণে পানি এলো আমার। কোনোদিকে না তাকিয়ে ছুটে গিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম আপাকে।
বাকিরা হয়তো অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। বোঝার চেষ্টা করছে কি চলছে এখানে। তন্মধ্যে কেউ একজন গিয়ে লাইট জ্বালালো। মাউইমা আমার মাথায় হাত রেখে ভয়ার্ত কণ্ঠে বললেন,
— নীরদ মা কি হয়েছে? তোমার এই অবস্থা! তুমি কাঁদছো কেন? আর এহতেশাম এখানে?
আমি শুরুতে কোনো উত্তর দিতে পারলাম না। আপাকে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম। আপা তো আরও ব্যাকুল। কি হয়েছে আমার, দুলাভাই কেন এ ঘরে? বাকিদেরও এক প্রশ্ন। কিন্তু তাদের চিন্তা অমানুষটাকে রক্তাক্ত দেখে। ওদের কারোর এমন সন্দেহ নেই, রাত বিরেতে একটা মেয়ে মানুষের ঘরে বিবাহিত একটা পুরুষ লোক ঢুকে গেছে তারমানে খারাপ কিছু হয়েছে!
আমি মুখ ফুটে বলতেও পারছি না, ভয়ে আতঙ্কে আমার কথা জড়িয়ে আসছে। বুঝে উঠতে পারছি না কাকে কি বলব! ওদিকে আমায় চুপ থাকতে দেখে অমানুষটা সুযোগ পেয়ে গেল। কোঁকাতে কোঁকাতে সকলের সামনে খুব চতুরতার সাথে এক মিথ্যের ঝাঁপি খুলে বসলো। ওর ভাষ্যমতে,
” ওর সাথে সম্পর্ক স্থাপন করতে চেয়েছিলাম আমি। ও রাজি হয়নি, ফলস্বরূপ আমি ব্ল্যাকমেইল করেছি সবাইকে মিছেমিছি সিনক্রিয়েট করবো, ও আমাকে রেপ করার ট্রাই করেছে। আমার ব্ল্যাকমেইলে তোয়াক্কা না করে ও চলে যেতে নিলে তখন আমি ওকে আঘাত করে সত্যি সত্যি সিনক্রিয়েটের চেষ্টা করি।”
ওর মিথ্যে অ্যালিগেশনে মাউইমা আর আপা বাদ দিয়ে বাকি সবাই ফুঁসে ওঠে। ইশি আপু ঘৃণার দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,
— আমি আগেই বুঝতে পেরেছিলাম এই মেয়ে খারাপ। খাল কেটে কুমির তোমরাই বাড়িতে এনেছ। এখন বোঝো।
ইশি আপুর কথায় সমর্থন জানিয়ে তার বড় ভাই আর বাবাও সুর মেলায়। অশ্রাব্য গালিগালাজের মাধ্যমে চরিত্রহীন উপাধি দিয়ে দেয় আমাকে। তোদের নোংরা আরোপ শুনে থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে আপার বুকে লুকনোর চেষ্টা করি আমি। আমার মনে হতে থাকে আর এক সেকেন্ড এখানে দাঁড়ালে নিশ্চিত মৃত্যু ঘটবে আমার।
ওদের অশ্লীল মন্তব্যে আপাও রেগে যায়। আমায় নিজের থেকে ছাড়িয়ে সোজা দাঁড় করিয়ে প্রশ্ন করে,
— এসব কি বলছে ওরা নীরদ? কোনো প্রতিবাদ করছিস না কেন তুই? সত্যি সত্যি কি হয়েছিল এই ঘরে বল?
আমি জোর গলায় কিছু বলতে পারছি না চতুর্পাশের আক্রমণে বাক্যহারা হয়ে গেছি। মাথা নেড়ে কাঁদতে কাঁদতে বলি,
— ওই লোকটা আমাকে… আমাকে..
— হু তোকে? কথা সম্পূর্ণ কর নীরদ।
— ওই লোকটা আমার সাথে খারাপ কাজ করার চেষ্টা করেছে আপা। এখন ধরা পড়ে গিয়ে তোদের সামনে মিথ্যে বলছে। কিচ্ছু করিনি আমি৷ কোনো দোষ নেই আমার। আজ বিকেলে..
— কোনো দোষ নেই তোর? কিচ্ছু করিসনি তাই না? তাহলে এসব কি?
আমায় কথা সম্পূর্ণ করতে না দিয়ে ফুঁসতে ফুঁসতে নিজের মোবাইল ফোন বের করে নিজের ভাইবোনদের কি যেন দেখাতে শুরু করে লোকটা। আর চিৎকার করে করে বলে,
— বেশ কয়েকদিন থেকেই এসব সহ্য করছি আমি।
এই মেয়ে সময়,অসময়ে যখন-তখন কল করে, মেসেজ করে ডিস্টার্ব করতো আমাকে। শুরুতে ওকে ভালোভাবে বোঝানোর চেষ্টা করেছি, আমি ওর বোনের হাজবেন্ড বড় ভাইয়ের মতো। আমার সাথে সম্পর্ক করতে চাওয়া.. ছিঃহ্
কিন্তু এই মেয়ে কিছু বুঝতেই চায় না। নিষেধ করার পর এর পাগলামো বেড়ে যায়। দেখ নেটে আজেবাজে মেসেজ দিয়ে ভরিয়ে ফেলেছে।
ঘটনা খারাপ দিকে মোড় নিচ্ছে দেখে আমি চাইছিলাম যত দ্রুত সম্ভব বিষয়টা থেকে বেরিয়ে আসতে। ভেবেছিলাম কাউকে আগেই জানাবো না। একা একাই শর্ট আউট করতে চেষ্টা করবো। সেজন্যই চিন্তাভাবনা করে এসেছিলাম আজ।
কিন্তু ও যে আমাকেই ফাঁদে ফেলবে এভাবে, তা কি বুঝতে পেরেছিলাম!
ওদের থেকে ফোনটা নিয়ে এবার আপাকে দেখায় ও।মেসেজের স্ক্রিনশটগুলোতে এত কুরুচিপূর্ণ কথাবার্তা!
ওসব দেখাতে দেখাতে বলে বলে,
— দেখ তোমার বোনের কার্যকলাপ। আজও কল করে করে আমার মাথা খারাপ করে দিচ্ছিল ও। বিশ্বাস না হলে ওর ফোনের কল লগই দেখ।
বেডসাইড টেবিলের ওপর থেকে আমার ফোন টেনে নিয়ে মেলে ধরে সবার দিকে।
আমি অবাক হয়ে যাই। ডায়াল কলে আমার ফোন থেকে ও নম্বরে বার পঞ্চাশের মত কল করা হয়েছে।
কি অদ্ভুত! আমার কাছে তো অমানুষটার ফোন নম্বরই নেই৷ আমি ওকে কল বা মেসেজ করবো কীভাবে ? তাছাড়াও কল টাইম যেটা বলছে তখন আমি ঘুমুচ্ছিলাম। এসব ওরই ষড়যন্ত্র।
বিরোধ করে উঠি আমি। চিল্লিয়ে চিল্লিয়ে বলার চেষ্টা করি, আমার মেসেঞ্জারসহ সব যোগাযোগ মাধ্যম ঘেঁটে দেখা হোক। তাহলেই সব পরিষ্কার হয়ে যাবে। কিন্তু কেউ তা করবে, তার পূর্বে দুলাভাই মেকি রাগ দেখিয়ে ফোন মেঝেতে আঁছড়ে ফেলে ভেঙে দেয়।
— কি দেখার বাকি আছে আর? নাটক করস তুই? আমার বাড়িতে থেকে, আমার টাকায় খেয়ে আমারই সংসার ভাঙার চেষ্টায় লেগে পড়েছিস *গী!
আর এক মুহুর্ত তোরে এই বাড়িতে থাকতে দেব না আমি। এক্ষুনি বের হবি তুই, এক্ষুনি৷
তেড়ে এসে আমার হাত চেপে ধরে ও। প্রায় সাথেসাথেই হুংকার দিয়ে উঠে মাউইমা সশব্দে চড় বসান ওর গালে।
তারপর আমায় টেনে নেন নিজের বুকে। জোর গলায় ওকে উদ্দেশ্য করে বলে ওঠেন,
— তোর এতবড় স্পর্ধা এহতেশাম। আমার সামনেই আমার মেয়ের গায়ে হাত তুলিস তুই? অনেকক্ষণ যাবৎ তোর কার্যকলাপ দেখছি আমি। কিছু বলছি না এই ভেবে, আমিও দেখতে চাই একটা অসহায় মেয়েকে বাড়ি থেকে বের করতে কতটা মিথ্যে তোর মুখ থেকে বেরোয়৷ কত কথা বানিয়ে বলতে পারিস তুই! আমি কখনো স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারিনি তুই এত নিচে নেমে যাবি। বাবা-মা সহ পুরো পরিবারের সামনে এত নোংরা ভাষায় গালিগালাজ.. ছিঃহ্
তোর মতো জঘন্য ছেলেকে পেটে ধরেছিলাম ভাবলেও ঘৃণায় শরীর রি রি করছে আমার।
শুকরিয়া আদায় কর ইনতিসার বাড়িতে নেই। ও থাকলে এই মুহুর্তে কি যে করতো তোকে!
মাউইমা আমাকে সাপোর্ট করছেন দেখে সবাই ক্ষেপে যায়। আঙ্কেল ধমকে ওঠে বলে,
— নিজের ছেলেকে বিশ্বাস না করে তুমি এই চরিত্রহীন মেয়েটাকে বিশ্বাস করছো?
— করছি কারণ তোমরা সবাই উঠেপড়ে লেগেছ ওকে বাড়ি থেকে বের করতে। তাই যা মাথায় আসছে তাই করছো। আচ্ছা কি ক্ষতি করেছে বাচ্চা মেয়েটা তোমাদের?
— আমরা ওকে বের করার চেষ্টা করছি? তাহলে এসব কি এই দেখ।
ফোনটা এবার মাউইমার হাতে ধরিয়ে দেবার চেষ্টা করলে মাউইমা রেগে ছুঁড়ে মারেন ফোনটা৷ আমায় বুকে জড়িয়ে ধরে মাথায় হাত বুলোতে বুলোতে বলেন,
— একটুও কাঁদবে না মা। আমি আছি তোমার সাথে, তোমার আপা আছে। আর কেউ বিশ্বাস করুক না করুক আমরা ঠিকই বিশ্বাস করি তোমাকে।
— না মা আমি বিশ্বাস করিনা ওকে।
আচনক পাশ থেকে বলে ওঠে আপা। আমি, মাউইমা দু’জনেই অবাক হয়ে তাকাই ওর দিকে।
আপা কঠোর চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলে,
— আমি বিশ্বাস করিনা ওকে, কারণ আমি জানি ও এসব করেছে। সবাই ঠিক বলছে, চরিত্রহীন ও। বোনের নুন খেয়ে তার সাথেই বেঈমানী করেছে ও৷ নিমকহারাম। কি করিনি আমি তোর জন্য? পুরো পৃথিবীর বিরুদ্ধে লড়েছি আমি তোর জন্য। আজ তুই ই আমার এতবড় ক্ষতি করে দিচ্ছিলি? সংসার ভাঙতে চেয়েছিলি আমার?
আমায় টেনে নিয়ে আক্রোশের সাথে বলল আপা।
আমি বিস্ময়ে বিমুঢ় কাঁদতেও ভুলে গেলাম ওর আচরণে৷
মাউইমা ভীষণ রাগলেন।
— পাগল হয়ে গেছ তুমি বউমা। নিজের বোন সম্পর্কে কিসব কথাবার্তা বলছ?
— ঠিকই বলছে ও। এতগুলো প্রমাণ সামনে থাকার পরেও তুমি কেন যে চোখে পট্টি বেঁধে আছ কে জানে!
তাচ্ছিল্যের সাথে পাশ থেকে বলল কেউ। আমার ওসবে খেয়াল নেই। আমি অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে আছি চেনা মুখের অচেনা আমার বোনের দিকে।
— সবাই ঠিকই বলেছে আর এক মুহুর্ত এই কালসাপটাকে বাড়িতে রাখা যাবেনা। না চাইতে পেয়ে গেছিল এ, এখন নিজ দোষেই হারাবে।
তুই এই মুহুর্তে এ বাড়ি থেকে বের হবি নীরদ। এই মুহুর্তে।
আমায় রেখে হনহন করে হেঁটে গিয়ে আলমারি থেকে আমার ব্যাগ বের করে অবিন্যস্ত ভাবে আমার কাপড় চোপড় ভরতে লাগল আপা। মাউইমা ওকে আটকাতে ছুটে গেলেন পেছন পেছন। কিন্তু তার পূর্বেই তার হাত ধরে জোর করে টেনে ধরে আটকে দিলো কেউ একজন৷
মাউইমা আপ্রাণ চেষ্টা করতে লাগলেন ছাড়া পাওয়ার, সাথে ধমকাধমকি করে আপাকে আটকানোর। বারবার বলতে লাগলেন
“মাথা গরম করে ভুল ডিসিশান নিও না। ব্যাগ গোছাচ্ছ কেন? এতরাতে কোথায় যাবে মেয়েটা?”
আপা শুনছেনা কোনো কথা। আর আমি? আমি পাথরের মতো আপার কাজকারবার দেখছি। আপার কথাগুলো মারের চাইতেও বেশি আঘাত করেছে । মায়ের পেটের বোন হওয়া সত্ত্বেও, আমার এই হাল দেখার পরেও ও আমাকেই অবিশ্বাস করলো? আমার শেষ ভরসা ও-ই ছিল অথচ…..
ব্যাগে কাপড় ভরা হলে আপা একহাতে ব্যাগ অন্যহাতে আমাকে ধরে টানতে টানতে নিয়ে গেল সোজা বাড়ির বাইরে। ড্রইংরুম ক্রস করার সময় আমি পেছন ঘুরে খুব অদ্ভুতভাবে ইনতিসারকে খুঁজলাম। কিন্তু সে নেই। তার পরিবর্তে দেখা মিলল আমায় ঘরছাড়া করার পরিকল্পনায় সফল হওয়া সকল ব্যক্তির মুখে লেপ্টে থাকা তাচ্ছিল্য হাসি । এরকমই চেয়েছিল এরা। সহজ হয়েছে দুলাভাই নামক নরপিশাচটাকে দুপুরে অপকর্ম করতে দেখার পর। নিজে বাঁচতে আঁটঘাঁট বেঁধে নেমেছিল আমায় তাড়াতে। আহ! সফলও সে। সফল কেবলমাত্র আমার আপন বোনের জন্য। যে বোনকে আমি এই নতুন রূপে একদমই চিনতে পারছি না।
আমাকে বাঁচাতে মাউইমা একা কেবল চিৎকার করছেন। কড়া শব্দে আপাকে নির্দেশ দিচ্ছেন এতবড় অন্যায় না করতে। কিন্তু আপা এই সময়টুকুর জন্য বধির।
আক্রোশে আমায় বাইরে বের করে দিয়ে ব্যাগটা ধপ করে আমার পাশে রেখে ভেতরের দিকে পা বাড়ালো সে৷ যেতে যেতে আবার কি মনে করে দরজার মুখে একমুহূর্ত দাঁড়িয়ে বলল,
— আজ এই মুহুর্ত থেকে তোর সাথে আমার সকল সম্পর্ক শেষ নীরদ। তোর ছায়াও আর দেখতে চাইনা আমি।
কয়েক সেকেন্ড ব্যাস!সশব্দে মুখের ওপর দরজা বন্ধ হয়ে গেল। আমি ছলছল দৃষ্টিতে বন্ধ দরজার দিকে তাকিয়ে রইলাম। বিড়বিড় করে শুধালাম,
— আমার যে তুই ছাড়া কেউ নেই আপা। এই মাঝরাতে বের করে দিলি। এখন কোথায় যাব আমি?
কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলাম তবে সদুত্তর এলো না ওপাশ থেকে। শেষে চোখের পানি মুছতে মুছতে অসহায়ের মতো ব্যাগ নিয়ে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে পড়লাম অজানার উদ্দেশ্যে। কোথায় যাব জানিনা৷ তবে যেতে হবে আমায় দূর, বহুদূর।
চলবে,
sinin tasnim sara

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here