ভালোবাসার রংধনু ১৮

0
931

ভালোবাসার রংধনু
১৮
_______________________
৩১.
হাঁটতে হাঁটতে কতদূরে চলে এসেছি জানিনা। হাঁপিয়ে গেলে বসে পড়লাম ফুটপাতে। হাপুস নয়নে কাঁদতে কাঁদতে মেলাতে পারলাম না জীবনের জটিল সমীকরণটা। আপার কথাগুলো কানে বাজছে ঘণ্টার মতো। আপা আমার ছায়াটাও দেখতে চায়না আর? কয়েকঘন্টার ব্যবধানে আমি ওর কাছে এতটা ঘৃণিত হয়ে গেলাম। ও কি চেনেনা আমাকে? জানেনা আমার স্বভাব? অমানুষটার ওসব ভিত্তিহীন প্রমাণ ওর কাছে বড় হয়ে গেল! কখনও ভাবতেও পারিনি জীবনে এরকম একটা সময় আসবে নিজের বোনের দ্বারাই গলাধাক্কা খেয়ে বাড়িছাড়া হতে হবে আমায়। স্রেফ একটা ফলস্ অ্যালিগেশন আর সব শেষ।
খানিক বাদে কারোর উপস্থিতি টের পেলাম পাশে। ভীরু চোখে তাকালে দেখলাম ইনতিসার বসে আছে। নিয়ন আলোতে ঝাপসা ওর চোখমুখ বিধ্বস্ত। মনে হচ্ছে মারপিট করেছে। সারা মুখে জায়গায় জায়গায় ক্ষত। ঠোঁট কেটে রক্ত ঝরছে টুপটুপ করে । যদিওবা কিছুটা মুছেছে তবুও তা ছড়িয়ে আছে ঠোঁটের আশেপাশে।
চোখ সরিয়ে নিলাম ওর থেকে। এসব কিছু দেখতে চাইনা। ওই বাড়ির কারোর সাথে সম্পর্ক রাখতে চাইনা আর। আমি চোখ সরালেই ও কাঁধের কাছে ওড়নায় হাত রাখল। চমকে সরে যাওয়ার চেষ্টা করলে এক হাতে টেনে ধরল আমাকে। গমগমে স্বরে বলল,
— মানুষের দাঁতের আঘাত বিষধর সাপের কামড়ের মতো ভয়ানক। যে জায়গায় পড়ে পঁচে যায় একদম।
আমি ওর কথা শুনেও না শোনার ভান করে নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়ার চেষ্টা চালিয়ে গেলাম। কিন্তু ওর শক্তির সাথেই বা পেরে উঠব কেন? জোর করে ও ওড়না সরিয়ে নিজের রুমাল বের করে কামড়ের জায়গাটায় আলতো হাতে চেপে চেপে রক্তগুলো মুছে দিতে থাকল।
কি অদ্ভুত! ওড়না পরিহিতা আমার লুকনো ক্ষত এই ছেলেটার চোখ এড়াল না,অথচ চকচকে লাইটের আলোয় দাঁড়িয়ে থাকা বাড়িভর্তি মানুষগুলোর চোখে খুব সহজেই এড়িয়ে গেল। দাঁত কামড়ে উত্তাল কান্নাটাকে আটকাতে চেষ্টা করলাম আমি। তবুও গা কেঁপে উঠতে থাকল খানিক পরপর। ইনতিসার গাঢ় শ্বাস ফেলে রক্ত সব মুছে দিয়ে একটা ছোট্ট অয়েন্টমেন্টের টিউব বের করল। তারপর নরম হাতে ক্ষতের ওপর অয়েন্টমেন্ট লাগিয়ে দিতে দিতে বলল,
— খবরদার অসহায়ের মতো কাঁদবে না। অসহায় নও তুমি। শক্ত হতে শেখো। লাইফের মেইন স্ট্রাগল আজ রাত থেকে শুরু। এত সহজে ভেঙে পড়লে ভাঙতেই থাকবে সারাজীবন।
খানিক চুপ থেকে আবারও মৃদু হেসে বলল,
— সত্যিকার অর্থেই এত জলদি আমার থেকে তোমার মুক্তি নেই নীরদ। বিধাতাও মুক্তি দিতে চান না।
— কিন্তু আমি তো চাই।
ওকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিয়ে বললাম।
— অসহায় তুই ভাবছিস আমাকে। ভুল করছিস। আমি ভেঙে গুড়িয়ে যেতে পারি কিন্তু অসহায় হয়ে পড়িনি। নিজেকে নিজে সামলানোর ক্ষমতা আছে আমার। তুই চলে যা সামনে থেকে। নইলে ভালো হবেনা বলে দিচ্ছি।
— যাব না আমি। দেখি তো কি করে আমার গ্লুমি ওয়েদার। ইশশ খুব কথা শিখে গেছে ম্যাডাম একদিনেই!
মৃদু হেসে আমার ডান হাতে কবজির কাছে আলতো করে চেপে ধরল ইনতিসার। রাগে শরীর জ্বলে উঠল আমার। হাত ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললাম,
— দয়া দেখাতে আসবিনা খবরদার। তুইও তো তোর ভাইয়ের মতই লম্পট। তোদের পুরো পরিবার জঘন্য। রক্তচোষা পিশাচ গুলোর মতো জঘন্য। তোর ভাই আমার সম্মান হানি করতে চেয়েছে পারেনি, এখন তুই এসেছিস ওর অসমাপ্ত কাজ পুরো করতে?
আমার চিৎকারে ইনতিসারের চোয়াল শক্ত হয়ে গেল। কিন্তু টু শব্দটাও উচ্চারণ না করে পূর্বের ন্যায় কবজি চেপে ধরে বসে রইল চুপচাপ। ওর মৌনতা আমার রাগটাকে আরও বাড়িয়ে দিল। ছাড়া পাবার জন্য মরিয়া হয়ে উঠলাম আমি৷ কিন্তু কিছুক্ষণ ধস্তাধস্তি করতেই শরীরের সমস্ত শক্তি শেষ। পরে বাধ্য হয়ে বসে পড়তে হলো ওর পাশে। একটু শান্ত হলে ও আমার হাতটা ছেড়ে দিয়ে উঠে দাঁড়াল। নিজের প্যান্টের পকেটে হাত দিয়ে কি যেন চেক করে কাঙ্ক্ষিত বস্তু না পেলে বিরক্তিতে ‘চ-কারান্তা’ একটা শব্দ বের করে আশপাশে তাকাতে লাগল। বিরক্তিমাখা গলায় বলল,
— একটা রিকশাও তো দেখা যাচ্ছেনা৷ ইমিডিয়েটলি শেল্টারের ব্যবস্থা করা দরকার৷ এভাবে রাস্তায় আর কতক্ষণ?
বিরক্তিতে মুখ তেঁতো হয়ে উঠল আমার। নাটক শুরু করেছে।
— বলেছি না,লাগবে না তোর হেল্প। নাটক করতে আসবিনা আমার সাথে ইতর।
আমার কথা যে ইনতিসার গায়ে মাখল না তা ওর স্বাভাবিকতা দেখেই বোঝা গেল। এখনও নিজ খেয়ালে মত্ত। কি আকাশকুসুম চিন্তা করল কতক্ষণ, তারপর হঠাৎ বলল,
— এ্যাই ওঠো তো একটু৷ সামনের দিকটায় যাই হাঁটতে হাঁটতে। ওখানে রিকশা নয়তো বেবি ট্যাক্সিগুলো ঠিক পাওয়া যাবে। একটা জায়গায় যাব। এভাবে আর বাইরে থাকা চলেনা। আচ্ছা হাঁটতে পারবা তো তুমি ?
আমি ভ্রু কুঁচকে তাকালাম।
— প্রথমে কি বলেছি শুনতে পাসনি ? লাগবে না আমার তোর হেল্প। একা ছাড় আমাকে নইলে খারাপ হয়ে যাবে কিন্তু বলে দিলাম। চিল্লিয়ে লোক জড়ো করবো একদম।
— চিল্লাও। দেখ কে আসে এই অসময়ে। আসলে তো ভালোই, হেল্প হবে আমাদের।
ভাবলেশহীনভাবে বলে মুখ ফিরিয়ে নিলো ও।
কথায় যে ওর সাথে পারবো না বুঝতে পারলাম আমি । তাই একা-একাই চুপ করে গেলাম। এত শরীর খারাপ লাগছে! মনে হচ্ছে এক্ষুনি মাথা ঘুরে পড়ে যাব৷
নিজ যন্ত্রণায় কাবু হয়ে জড়োসড়ো হয়ে বসে রইলাম চুপচাপ। ওদিকে ইনতিসারের সাঁড়া নেই, কিন্তু উপস্থিতি আছে।
দীর্ঘক্ষণ কেটে গেল আমাদের নিস্তব্ধতায়।
বেশ কিছুসময় পর কোত্থেকে রিকশার বেলের টুংটুং আওয়াজ শোনা গেল। অজান্তেই সচকিত হলো মস্তিষ্ক। ইনতিসার হাত তুলে সজোরে ডেকে উঠল রিকশাটাকে। প্রথমে তো দাঁড়াবেই না। বহুকষ্টে দাঁড় করিয়ে ডাবল ভাড়ার শর্তে কোনো এক জায়গায় যাওয়ার জন্য ঠিক করা হলো। রিকশা ঠিক হলে আমার ব্যাগ তুলে নিয়ে গমগমে স্বরে ডাকলো ইনতিসার।
ডাকটা শুনলাম তবুও জিদে উপেক্ষা করে বসে রইলাম। আমার গোঁয়ার্তুমি ওর মেজাজ তুঙ্গে তুলে দিল। দ্রুত গতিতে এগিয়ে এসে খামচে ধরল আমার বাহু। তারপর চোখের পলকে নিজেকে রিকশায় আবিষ্কার করলাম।
চোখ-মুখ কুঁচকে ও উঠে বসতে বসতে বিড়বিড় করে বলল, “ধৈর্য্যের বাঁধ কখন যে ভেঙে যায়!”
কথাটা স্পষ্ট কানে এলো আমার। সাথেসাথেই রিকশা থেকে নেমে যেতে চাইলাম। কিন্তু পারলাম না, ও আবার খামচে ধরল আমার বাহু। শক্ত করে নিজের সাথে চেপে ধরে রিকশাওয়ালাকে আদেশ করল রওয়ানা হতে। আমি খুব নিচুস্বরে ওকে উদ্দেশ্য করে জঘন্য গালি দিয়ে বসলাম। গালি শুনে ওর চোখমুখ আবার শক্ত হয়ে গেল কিন্তু টু শব্দ উচ্চারণ না করে পূর্বের ন্যায় আমায় চেপে ধরে বসে রইল। আমি ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে রাখলাম।
(লেখকের ভাষায়)
দীর্ঘ পথ পাড়ি দেবার পর রিকশা যখন থামল নীরদ দেখতে পেল পুরাতন মতো একটা দোতলা বাড়ির সামনে তারা দাঁড়ানো। টুকটুক করে তাকিয়ে জায়গাটা চেনার চেষ্টা করল ও। রাতের আঁধারে আশেপাশে চিনতে না পারলেও আলোয় ঝলমল করা বাড়িটা ওর কাছে খুব পরিচিত মনে হলো। আপনমনে বিড়বিড় করলো, “কোথাও এটাকে দেখেছি আগে।” কিন্তু মনে করতে পারলো না কোথায় দেখেছে । ইনতিসার ওর বাড়ির দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকার বিষয়টা লক্ষ করে শান্ত স্বরে পাশ থেকে বলল,
— বাড়িটা আমার। দাদাভাইয়ের থেকে পাওয়া সম্পত্তি। আজ থেকে আমরা এখানেই থাকব।
ইনতিসারের কন্ঠ কানে আসতেই বাড়ি থেকে দৃষ্টি সরাল নীরদ। “আমরা এখানেই থাকব” কথাটা হিট করল ওর মাথায় । সোজা হয়ে বসে ভ্রু কোঁচকাল।
— আমরা থাকব মানে? কে থাকবে তোর সাথে? আমি মোটেও থাকব না এখানে। তোর সাথে…
আর দু’টো কথা বলতে চাইলো নীরদ কিন্তু রিকশাওয়ালা সন্দিগ্ধ চোখে ঘুরে তাকানোর ফলে বাকি কথাটাও সম্পূর্ণ করা হলো না। সাথেসাথে চুপ করে গেল ও। ওদিকে ইনতিসার হতাশভাবে শ্বাস ফেলে রিকশা থেকে নেমে ভাড়াটা মিটিয়ে দিল। রিকশাওয়ালা হয়তোবা কোনো প্রশ্ন করতো তাদের; তবে তাকে সে সুযোগ দেয়া হলো না। এর পূর্বে বাড়ির ভেতর থেকে মাঝবয়সী একটা লোক ছুটে এলো ওদের কাছে। ইনতিসারকে সালাম দিয়ে মৃদু হেসে বলল,
— আপনাদের অপেক্ষাতেই বইসা আছিলাম স্যার।
ইনতিসার দ্রুততার সাথে নীরদকে রিকশা থেকে নামিয়ে নিয়ে সংক্ষেপে জিজ্ঞেস করল,
— সবকিছু ঠিকঠাক করে রেখেছ?
— জ্বে। সব তৈয়ার। মাঝরাইতে একটু কষ্ট হইছিল বটে তয় ম্যাডাম…
কথা সম্পূর্ণ করতে পারলো না লোকটা
ইনতিসার হাতের ইশারায় থামিয়ে দিয়ে তাকে আদেশ করল,
— ব্যাগটা নিয়ে এসো ওপরে, জলদি।
তারপর কোনোদিকে না তাকিয়ে নীরদের হাত শক্ত করে চেপে ধরে হনহন করে বাড়িটার ভেতর ঢুকে গেল ।
____________
(নীরদের ভাষায়)
ইনতিসার আর বুড়ো লোকটার কথাবার্তা অসংলগ্ন মনে হলেও সেদিকে খেয়াল দিতে ইচ্ছে হলো না আমার। একটু আগের ঘটনাগুলো আবারও আঘাত করতে শুরু করল মাথায়। দলা পাকানো কান্নারা আবার ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাইল ভেতর থেকে । এই জীবন কখনোই পাওনা ছিল না আমার। কেন হলো এসব আমার সাথে?
পাগল পাগল লাগছে নিজেকে। চলতে চলতে থেমে গেলাম আমি। সবেগে ইনতিসারের থেকে হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করে বললাম,
— কোত্থাও যাব না আমি।
ইনতিসার এবারে খুব রাগল। হেঁচকা টানে নিজের সাথে মিশিয়ে নিয়ে গর্জে উঠল,
— আমার ধৈর্যের পরীক্ষা নিবে না কিন্তু নীরদ। আর একটা পাগলামি করলে ধৈর্য হারা হবো আমি। তারপর চাপকে সোজা করবো তোমায় বলে দিলাম। চুপচাপ আমার সাথে ভেতরে যাবে এই মুহুর্তে।

ওর দেখাদেখি গর্জে উঠলাম আমিও।
— তোর কথা শুনতে বাধ্য নই আমি। বলেছি তো যাব না। মরে গেলেও যাব না।
— ভালো কথায় কাজ হবেনা বুঝতে পেরেছি। এরপর যেটা হতে যাচ্ছে তার জন্য আমি মোটেও স্যরি নই বরং তুমিই আমায় এ কাজটা করার জন্য বাধ্য করলে।
কিছু বুঝে ওঠার আগে আমার ওড়না টেনে নিয়ে দু’হাত পিছমোড়া করে বেঁধে দিল ইনতিসার।
অবাকের চরম সীমায় পৌঁছে আমি একটা শব্দ উচ্চারণ করতে পারলাম না৷ এই সুযোগে পকেট থেকে রুমাল বের করে ও মুখটাও বেঁধে ফেলল আমার। তারপর এক ঝটকায় কাঁধে তুলে নিয়ে ঝড়ের বেগে বাড়ির ভেতরে ঢুকে গেল।
মিনিটখানেক পর দোতলার বিশাল একটা রুমে আবিষ্কার করলাম নিজেকে। হাতমুখ বাঁধা অবস্থায় বিছানায় ফেলে রেখে শক্ত গলায় ও বলল,
— নিজের দোষে নিজের পায়ে কুড়াল মারলে। এখন থাকো এভাবে।
আমি দু’পায়ে ছটফটিয়ে উঠলাম। ও তাকাল না, মুখ ফিরিয়ে চলে গেল।
এদিকে রাগে দুঃখে সবকিছু তছনছ করে দিতে মন চাইল আমার। আজ কোনো অনর্থ ঘটবেই আমার দ্বারা; আর এরজন্য দায়ী থাকবে ওই নোংরা ছেলেটা। ইনতিসার।

(লেখকের ভাষায়)
বেশি সময় ওভাবে হাত-মুখ বাঁধা অবস্থায় থাকতে হলো না নীরদকে । চোখেমুখে হালকা পানির ঝাপটা মেরে, দারোয়ানের সাথে টুকটাক কথা বলে নীরদের ব্যাগ হাতে জলদিই ফিরল ইনতিসার৷ তারপর একা একা টুকটাক কথাবার্তা বলতে বলতে নীরদের বাঁধন গুলো খুলে দিতে লাগল।
মুক্ত হওয়ার পর নীরদ মাথানিচু করে চুপচাপ বসে থাকতে চাইল । ইনতিসারের ওপর তার রাগ এক ফোঁটা কমেনি, উল্টো বেড়েছে । দিগ্বিদিক হারা হয়ে কখন যে খারাপ কিছু করে বসে! সেই ভয়ে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করতে লাগল। কিন্তু ক্ষোভ টা যে বহুদিনের জমানো। সম্পূর্ণটা কেবল ইনতিসারের ওপর তাও নয়৷সবার ওপরই রাগ ওর। সবচাইতে বেশি রাগ নিজের ভাগ্যের ওপর। কেন আর পাঁচটা মানুষের মতো একটা স্বাভাবিক জীবন পেল না ও? কেন জন্মের পর থেকে ওর ভাগেই সব অপ্রাপ্তি ভীড় জমালো?কেন?

ওদিকে নীরদের চিন্তায় বিভোর ইনতিসার বুঝতে পারলো না, ওর ওপর নীরদের রাগের সীমা গগন স্পর্শ করে ফেলেছে। খুব স্বাভাবিক কনসার্ন দেখিয়ে ও নীরদকে কিছুটা মেন্টাল সাপোর্ট দিতে চাইল। ব্যাগ থেকে পরার মতো কাপড়চোপড় বের করতে করতে বলল,
— নীরদ যাও ফ্রেশ হয়ে এসো। চেঞ্জ করে শুয়ে পড়বা। তোমার এখন রেস্টের প্রয়োজন।

ইনতিসারের কনসার্ন মেকি মনে হলো নীরদের কাছে। এসব নাটক দেখে ও তেলেবেগুনে জ্বলে উঠল। সামলে রাখতে চাওয়া রাগটা শেষ পর্যন্ত সামলানো সম্ভব হলো না। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে একঝাঁক তিক্ত কথার বাণ ছুঁড়ল ইনতিসারের উদ্দেশ্যে । খুব তাচ্ছিল্য করে বলল,
— তোরা পারিসও বটে! পুরো পরিবার অভিনয়কলায় হান্ড্রেড অন হান্ড্রেড। কেউ দুচোখে সহ্য করতে পারবে না, কেউ আবার ভালোবাসার ডালা নিয়ে বসবে। কেউ ঘর থেকে তাড়ানোর জন্য উঠেপড়ে লাগবে, কেউবা রাস্তা থেকে তুলে এনে মাথা গোঁজার জায়গা করে দেবে। উফফ একেকজনার অভিনয় ক্ষমতা! জাত অভিনেতা সব এক পরিবারে।
তো তোর পরিবারের সবার অভিনয় দেখা তো শেষ, তাদের যা স্বার্থ ছিল আমার সাথে সেটা হাসিল করা শেষ; বের করে দিয়েছে । এখন তুই বল তোর কোন স্বার্থ বাকি। দেখি তোর বাসনা পূর্ণ করতে পারি কি না!
ওহ্ হ্যাঁ, তোর তো আবার আমাকে চাই। তো বল কিরকম সার্ভিস পেলে তুই খুশি হবি? নাহ্ এত দয়া দেখাচ্ছিস, গেটিস তো…
কথা সম্পূর্ণ করতে পারলো না নীরদ তার পূর্বে প্রবল চপেটাঘাতে ছিঁটকে পড়ল মেঝেতে।
ইনতিসার রাগে ফোঁস ফোঁস করতে করতে নীরদের কাঁধ খামচে ধরে টেনে তুলল ওকে৷ ছেলেটার রক্তাভ চোখে এত ভয়ানক চাহনি! মনে হচ্ছে এই মুহুর্তে ভস্ম করে দেবে সবকিছু। অথচ সত্যিটা হলো নীরদের করা তিরস্কারে তোলপাড় শুরু হয়েছে ইনতিসারের বুকের ভেতর । চোখ ফেটে যেন রক্ত ঝরতে চাইছে ওর। তবে এখন বেসামাল হলে চলবে না৷ খুব দ্রুত সামলে নিলো নিজেকে। ক্রোধ এবং হতভম্বতা মেশানো গলায় বলল,
— স্বার্থ! কিসের স্বার্থের কথা বলছ তুমি নীরদ?
আমি না, আমি না টায়ার্ড হয়ে যাচ্ছি তোমার এসব আচরণে । কেন এত পাগলামি করছো তুমি? যেসব কথাবার্তা বলছ ভেবে বলছ তো? আমার ভালোবাসা এতটাই সস্তা তোমার কাছে! স্বার্থের জন্য ভালোবাসছি আমি তোমায়!
ইনতিসারের কথায় আবারও তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটে উঠল নীরদের ঠোঁটের কোণে।
— সস্তা ছাড়া আর কি! তুই তো আমাকে ঐ একটা কারণেই চাইছিস। ইগোর লড়াই!
শুরুতে সাঁড়া দেইনি বলে হাতধুয়ে লেগে পড়েছিস পেছনে। একবার সুযোগ পেলেই…
কথা সম্পূর্ণ করলো না নীরদ।
ওর ইঙ্গিত উপলব্ধি করতে পেরে থমকাল ইনতিসার। আহত দৃষ্টিতে তাকালো নীরদের দিকে । নীরদ এতটা নিম্নস্তরের ভাবে ওকে? শিরা উপশিরাগুলো দপদপ করতে শুরু করলো র। এতদিনের যত্নে গড়া ভালোবাসাটাকে এভাবে অপমানিত হতে দেখে সহ্য হলো না। দীর্ঘক্ষণের চেপে রাখা রাগ ফুটে বেরুতে শুরু করলো ভেতর থেকে।
সেও এবার সামলাতে পারলো না নিজেকে। রাগে জ্ঞানশূন্য হয়ে বলে উঠল,
— আমার ভালোবাসা সস্তা! সস্তা ভালোবাসা কেমন হয় দেখতে চাও তুমি? কি যেন বলছিলে, সার্ভিস দেবে আমাকে? ওকে ফাইন আমিও দেখতে চাই তোমার সার্ভিস কেমন!
নীরদকে দু’হাতে ঠেলে বিছানায় ফেলে দিলো ইনতিসার। দ্রুত হাতে গায়ের শার্ট খুলে দূরে ছুঁড়ে ফেলে ঝুঁকে এলো নীরদের ওপর।
ইনতিসারের মুখটা নীরদের দিকে নামতেই ভয়ে তটস্থ হয়ে গেল নীরদ। রাগে কি বিপদটাই না টেনে এনেছে নিজের!
নিজেকে বাঁচাতে ও সবেগে আঘাত করতে চাইল ইনতিসারের শরীরে, কিন্তু তার পূর্বেই ওর হাত চেপে ধরলো ইনতিসার।
অবজ্ঞার হাসি হেসে খুব ঠান্ডা গলায় বলল,
— কি? সার্ভিস দেবেনা আমাকে? এর আগেই কেন যেন…
— এটাই তোর সত্যি ইনতিসার। তুই ঠিক এতটাই নোংরা।
ইনতিসারকে কথা সম্পূর্ণ করতে না দিয়ে বলে উঠল নীরদ।
ইনতিসার আবারও হাসলো।
— হ্যাঁ ঠিক। এবং আমি আমার চূড়ান্ত নোংরা রূপটা তোমাকে দেখিয়েই ছাড়ব।
আরেকটু ঝুঁকে নীরদের সাথে সমস্ত দূরত্ব কমিয়ে নিলো ইনতিসার। অশ্রুসজল নীরদ ঘৃণায় চোখ বন্ধ করে নিলো তড়িৎ। কিন্তু দীর্ঘক্ষণ অতিবাহিত হয়ে যাওয়ার পরেও ইনতিসারের থেকে কোনোরূপ বন্য আচরণ না পেয়ে বাধ্য হলো চোখ খুলে তাকাতে।
ইনতিসারের চোখেমুখে অন্যরকম অভিব্যক্তি। এই অভিব্যক্তি সবটাই ব্যথার ছাপ নাকি অন্যকিছু তা নীরদের ঘৃণা মাখানো দৃষ্টি অবলোকন করতে পারলো না। তবে নীরদ চোখ খুলে তাকালে ইনতিসারের হাতের চাপ বাড়লো। সমস্ত রাগ দুহাতে ঢেলে নীরদকে এমনভাবে বিছানায় চেপে ধরে রাখলো, এক মুহুর্তের জন্য নীরদের মনে হলো শরীরের রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে ওর।
মুখে ফুটে উঠল বেদনার ছাপ। ইনতিসার তা খেয়াল করতে চাইল না। ঘৃণায় আচ্ছন্ন হয়ে খুব ঠান্ডা স্বরে বলল,
— নাবীহা ওয়াসীমাত নীরদ। তুমি চেয়েছিলে না আমার থেকে মুক্তি পেতে? তবে তাই হোক।
আজকের পর থেকে তোমার আমার পথ আলাদা , পুরোটাই আলাদা। আমার ভালোবাসাকে অবজ্ঞা করে যে আঘাত তুমি দিলে! এই আঘাত তোমায় আমার মন থেকেও বের করে দিলো। ইনতিসার আজ থেকে তোমায় পাওয়ার বাসনা ছেড়ে দিলো। আজ থেকে তুমি আমার জীবনের উচ্ছিষ্টাংশ, কেবল একটা উচ্ছিষ্টাংশ। না আমার ভালোবাসার স্থানে থাকবে, আর না কোনো অনুভূতি থাকবে তোমায় নিয়ে। তুমি কেবল থাকবে আমার দুঃস্বপ্ন হয়ে।
স্বার্থ স্বার্থ করছিলে না? শোনো নিজেকে এতটা প্রায়োরিটি দেয়ার কিছু নেই। কোন স্বার্থের টানে আসবে মানুষ তোমার কাছে? কি আছে তোমার? নিজেকে প্রশ্ন করো।
একটু থামলো ইনতিসার। তারপর আবার বলল,
— আমি তোমাকে এক আকাশ ভালোবাসা দিতে চেয়েছিলাম নীরদ। কিন্তু তুমি তার যোগ্য নও। তোমাকে আমি আমার বর্ণিল রংধনু ভাবতাম৷ তুমি আমাকে বোঝালে কিছু রংধনুর রঙ কালোও হয়৷ ঠিকাছে আমি চোখ বন্ধ করে এ সত্যি মেনে নিলাম। মুক্তি দিলাম তোমাকে। ইউ নো হোয়াট! ইউ ডোন্ট ডিজার্ভ লাভ।
নীরদকে ছেড়ে দিয়ে হনহন করে বেরিয়ে গেল ইনতিসার। যাওয়ার সময় সজোরে দরজায় আঘাত করতে ভুলল না সে৷
আজ নীরদ ওকে ভেঙে দিয়েছে৷ সম্পূর্ণরূপে ভেঙে দিয়েছে৷ ভীষণ যন্ত্রণায় একাকার হয়ে আজ প্রথমবারের মতো ইনতিসারের চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরতে দেখা গেল৷
ওদিকে ইনতিসার চলে যাওয়ার পর চোখ মুছে উঠে বসলো নীরদ। চিৎকার করে বলতে লাগল,
— তোর জন্যই আজকে আমার এই দুর্গতি। এই তুই-ই আমার লাইফটাকে হেল বানায় রাখছিস। তোর থেকে শুরু হয়েছে সবকিছু। আসল ঝামেলার গোড়া তুই। কেন আসতে গেলি এতবছর পর হ্যাঁ? কেন ভুলতে পারিসনি আমাকে? আজ তোর কারণেই আপার আমার ওপর থেকে বিশ্বাস উঠে গিয়েছে। আমার জীবনের সবচাইতে বড় দুর্ভাগ্যের নাম “ইনতিসার”
শুনতে পাচ্ছিস? আমার জীবনের সবচাইতে বড় দুর্ভাগ্য তুই। শুধু তুই।

একাধারে চিৎকার করতে গিয়ে কণ্ঠ ভেঙে আসতে চাইল নীরদের। চোখ দিয়ে অনর্গল পানি ঝরতে শুরু করলো। এবার আর চোখ মোছার চেষ্টা করলো না সে। ঝরুক এভাবে। চোখের পানির সাথে কষ্টগুলো গলে গলে পড়ুক ভেতর থেকে। শুধু ইনতিসার নয় সবকিছু থেকেই এখন মুক্তি চাই তার। সবকিছু থেকে।
চলবে,
sinin tasnim sara

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here