ভালোবাসার রংধনু,২৭,২৮

0
1166

ভালোবাসার রংধনু,২৭,২৮

২৭
_____________
৪৯.
মৃ/ত্যু সন্নিকটে বুঝতে পেরে চোখ বন্ধ করে আমি জীবনের সবচেয়ে ভালো কোনো স্মৃতি মনে করার চেষ্টা করলাম। কয়েক সেকেন্ডের জন্য ধূসর ছায়া হয়ে ভেসে উঠল মেয়েবেলায় আমার বাবার সাথে কিছু মিষ্টি স্মৃতি;বাবার নির্মল নিষ্পাপ হাসি। বাবার কথা মনে পড়তেই আমার মুখে হাসি ফুটে উঠলো। এবার তবে বাবার সাথে তার সবচেয়ে আদরের মেয়েটার দেখা হবে৷ বাবা, আমার বাবা, কতদিন দেখি না তোমায়! আমার জন্য অপেক্ষা করো বাবা, আমি দ্রুত আসছি তোমার কাছে। খুব দ্রুত। আমি বুঝতে পারছিলাম দৈত্যসম বাসটার সাথে দু অথবা তিন সেকেন্ডের দূরত্ব আমার৷ চোখ খিঁচে, দাঁতে দাঁত চেপে আমি নিজেকে প্রস্তুতই করে ফেলেছিলাম এর পরের দুর্ঘটনাটার জন্য কিন্তু বেশ কিছুক্ষণ হয়ে গেলেও যখন কোনো দুর্ঘটনার সম্মুখীন হলাম না তখন চোখ খুলে তাকিয়ে দেখলাম বাসটা তো বাঁ পাশের রাস্তা দিয়ে ঢুকে যাচ্ছে। ওহ্, তাহলে আজও আমার কপালে মৃ/ত্যু লেখা নেই!
হতাশার নিঃশ্বাসই বেরুলো বুক চিরে। ওড়নার একপ্রান্ত দিয়ে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে আমি ভাবতে লাগলাম, আচ্ছা আমি কি সত্যি ম/রে যেতে চাইছিলাম? মৃ/ত্যু কি সহজ বিষয়!
— ম/রার আগেও বিনুনি করতে ভুলোনি দেখছি। ভাবনার মাঝেই পাশে এক পুরুষালী কণ্ঠ শুনে আমি চমকে দু পা সরে গেলাম। বড় বড় চোখে তাকিয়ে দেখলাম ইনতিসার ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে। অবাকই লাগল আমার। এই এত রাতে শুনশান রাস্তায় ও কি করছে?
— মানুষ সু/সাইড করতে যায় এত পরিপাটি হয়ে চুল আঁচড়ে? দুঃখ নিয়ে সু/সাইড করলে দুঃখী ভাব ফুটিয়ে তুলতে হবে চেহারায়। চুল থাকবে অগোছালো পাখির বাসার মতো, চোখ ভরা জল থাকবে। তুমি তো এরকম কিছুই করোনি দেখছি। আবার বাসটাও ওদিকে চলে গেল। বুঝেশুনে তো দাঁড়াবে না রাস্তায়? কমপক্ষে দশ হাত দূরে ছিল বাস। ঐ দেখেই চোখ বন্ধ করে ফেললে। অদ্ভুত। ওপাশে যে একটা পথ আছে, গাড়ি ওপাশেও যেতে পারে এটা খেয়াল করবে না? গবেটের গবেট।
কণ্ঠ থেকে আক্ষেপ ঝরে পড়লো ওর।
অদ্ভুত! ও কি এখানেই ছিল আশেপাশে? তাহলে তো শুরু থেকে সবটা দেখেছে। কই আমাকে বাঁচাতে আসেনি তো! এখন আবার সুই/সাইডের নিয়ম বাতলে দিচ্ছে। কষ্টে আমার চোখে তৎক্ষণাৎ পানি এসে গেল। আমার চোখে পানি দেখে ও বিরক্তির সুরে বলল,
— টাইমিং না বুঝে কাজ করতে গেলে এমন ফাঁকা হাতেই ফিরতে হবে। এখন আর কেঁদে কি লাভ? আজকে পারলে না তো কি হয়েছে কাল আবার চেষ্টা করবে। কাল নিশ্চয়ই সফল হবে সু/সাইড করতে।
এতক্ষণ আমি চুপচাপ ওর কথা শুনছিলাম। এবার মনে হলো কিছু বলা উচিৎ। চোখের পানি মুছতে মুছতে বললাম,
— আর করবো না আমি সুই/সাইডের ট্রাই।
— কেন করবে না কেন? অফকোর্স করবে, অফকোর্স। একদিন মিস গেল তো কি হলো? পরেরদিন আটঘাট বেঁধে নামবে।
ব্যাগ থেকে কিসের যেন একটা বোতল বের করে ওতে চুমুক দিতে দিতে বিড়বিড় করল ও।
— মানে আপনি চাইছেন আমি ম/রে যাই?
— আমার চাওয়া না চাওয়াতে কি এসে যায়। তুমি এদেশের একজন স্বাধীন নাগরিক। সংবিধানই বলে তোমার কাছে তুমি স্বতন্ত্র। তোমার যদি মনে হয় আর বেঁচে থাকতে ভাল্লাগছে না ম/রা উচিৎ। তাহলে তাই করবে। এখানে আটকানোর কি আছে?
— হু। ঠিক।
চোখ মুছে হালকা গলায় বললাম আমি৷
সে সরু চোখে চুপচাপ আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলো খানিক। তারপর পকেট থেকে সিগারেট বের করে দু ঠোঁটের মাঝে নিয়ে অস্পষ্ট গলায় কিছু একটা বলল। শুনতে পাইনি আমি তাই চুপ করেই ছিলাম। খানিক পর তার হঠাৎ কি হলো, সিগারেট না ধরিয়ে বরং সেটা ছুঁড়ে ফেলে দিলো নীচে।
আমার দিকে তেড়ে এসে রাগে অস্থির হয়ে বলল,
— মিথ্যে দম্ভ এবং অহংকারে অন্ধ গবেট মেয়েটা, এতবড় ধিঙি হয়েছ অথচ মানুষ চেনার ক্ষমতা হয়নি? বড়লোকের ছেলে মানেই খারাপ- চরিত্রহীন৷ তাহলে ঐ দু’টাকার ফাইন আর্টসে পড়া ক্ষ্যাত ছেলেটা তোমায় ডাম্প করলো কেন? সেটাও শুধু একবার নয় বারবার। শুরুতেই বুঝতে পারোনি ওর মতলব? পাগল-ছাগল।
তার জন্য আবার সেজেগুজে বিনুনি দোলাতে দোলাতে মরতেও এসেছো। আমি না থাকলে তো আজ রাস্তায় পিষেই মরে যেতে। কই গেল তোমার ভালোবাসা হ্যাঁ? ভালোবাসা এত সস্তা? যা চার বছর হতে না হতেই কর্পূরের মতো উবে যায়।
কথা বলার এক পর্যায়ে সে আমার দু বাহু শক্ত করে চেপে ধরলো।
— তুমি কি জানো তুমি একটা রামগাধা? গাধার সর্দারনী। সবসময় আমাকে নিজের রাইভাল ভেবে এসেছো। প্রথম দেখায় গ্লুমি ওয়েদার ডেকেছিলাম তাই দেখতে পাও না। অথচ খোঁচাটা মেরেছিলামই যেন নিজেকে একটুখানি পরিবর্তন করো।
এতটুকু একটা মেয়ে সবসময় মুখ গোমড়া করে থাকতে । বাচ্চা মেয়ে তুমি হবে পাহাড়ি ঝর্ণার মতো চঞ্চল, প্রজাপতির মতো ডানা মেলে ঘুরে বেড়াবে এদিক সেদিক। নাহ্ তুমি থাকতে ঘরের এক কোনে বইয়ে মুখ গুঁজে। সারাদিন চশমা নাকের ডগা থেকে টেনে ওপরে তুলবে। আর লুকোবে সবকিছু থেকে। কেন?
একটা কোচিং করতে সেটাও বাদ দিয়ে দিলে হুজুগে। আমি মাথা খাটিয়ে কত শ্রম দিয়ে আবারও কোচিংয়ে নিয়ে যেতে উদ্যত হলাম। তোমার নজরে এটা পড়ল না। কেবল দেখলে আমার টাকার খোঁটা। আমি তোমার শত্রু!
তারপর প্রপোজ করলাম। প্রত্যাখান করে দিলে। অসভ্য, লম্পট বলে তাড়িয়ে দিলে। আমি খারাপ, আমি বখাটে। আমি সব। তোমাকে কাছে না পেলে মরে যাচ্ছিলাম যে। অন্যকারো হয়ে যাবে এই ভয়ে পাগল পাগল লাগতো নিজেকে। তাই পাগলামি করতাম। তোমার পছন্দ ছিল না আমার পাগলামি। সরিয়ে দিতে বারবার। সরেও গেলাম। কিন্তু এখন, এখন কাকে বেছে নিলে নীরদ? সে তোমাকে এই অবধি নামিয়ে আনলো! এই অবধি..
শেষের কথাটা ভীষণ আক্ষেপের সাথে বলল ও।
আমি কেবল অবাক নয়নে ওর দিকে তাকিয়ে। ওর গা কাঁপছে কেন? কথাবার্তাও ভীষণ অসংলগ্ন। সন্দেহের বশে আমি একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম ওর দিকে।
আমার এমন দৃষ্টি দেখে চট করে সেও স্বাভাবিক রূপে ফেরার চেষ্টা করলো। বাহু ছেড়ে দিয়ে ছোট্ট শ্বাস ফেলে সরে দাঁড়িয়ে নরম গলায় বলল,
— আ’ম স্যরি। প্রয়োজনের চাইতে বেশি কথা বলে ফেললাম বোধহয়।
ওর কথাবার্তা শুনে আমার সন্দেহ গাঢ় হতে লাগল। ঠিক-ভুল যাচাই করার জন্য আগ্রহী হয়ে কিছুটা এগিয়ে গেলাম ওর কাঁধে ঝোলানো ব্যাগের দিকে। ওই ব্যাগটায় কিছু একটা আছে। ও পাশ ফিরে আমায় এগুতে দেখে ভ্রু কুঁচকে ঝুঁকে এলো আমার মুখের ওপর। জিজ্ঞেস করলো,
— কাছে আসো কেন?
ওর কথা বলা মাত্র একটা বাজে গন্ধ নাকে এলো আমার। আমার ধারণাই তবে ঠিক। সরে গিয়ে দুর্বল কণ্ঠে শুধলাম,
— আপনি ড্রাংক?
আমার প্রশ্নে ও প্রথমে হাসলো। তারপর মাথা দুলিয়ে বলল,
— বুঝলে কীভাবে? খুব বেশি খাইনি তো আজ। অল্প খেয়েছি। এই এত্তটুকুন। বুড়ো আর তর্জনী আঙুল দিয়ে পরিমাপও দেখালো সে। আমি হতাশার শ্বাস ছেড়ে বললাম,
— আপনি বেশ অদ্ভুত কিসেমের নেশাখোর। নেশাও করেন আবার চোখকানও খোলা রাখেন৷ স্ট্রেঞ্জ।
— আমি স্ট্রেঞ্জ জন্যই আমার নাম ইনতিসার। দ্য গ্রেট ইনতিসার ইলহাম। পুরো পৃথিবীতে শুধু এক পিস-ই আছে।
হাসতে হাসতে সাইড হয়ে পূর্বের মতো ব্যাগ থেকে সেই বোতলটা বের করে তাতে চুমুক দিলো ইনতিসার। বুঝতে পারলাম ওটাতেই মদ আছে। একবার মনে হলো জিজ্ঞেস করি, শুনেছি মদ খেলে নাকি জীবনের সব দুঃখ পালিয়ে যায়৷ আপনার কি দুঃখগুলো পালাচ্ছে? পালালে আমাকেও না-হয় দিন আমি একটু দুঃখকে ছুটি দেই।
কিন্তু কি মনে করে জিজ্ঞেস করলাম না। জিজ্ঞেস করলাম অন্যকিছু,
— এতরাতে আপনি এখানে কেন?
— হু?
না শুনতে পেয়ে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাল সে।
— বললাম এতরাতে এখানে কেন?
— তোমাকে বাঁচাতে এসেছি।
— আমাকে বাঁচাতে! বিস্মিত হলাম আমি।
আমায় বিস্মিত হতে দেখে ও হেসে উঠল।
— জাস্ট কিডিং। আমার অফিস তো ওদিকে।
— ওদিকে কোন দিকে?
— ঐ তো।
আঙুলে ইশারা করে পেছনে দেখালো ও। আমি ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলাম সারি সারি দোকানপাট ছাড়া আর কিছুই নেই ত্রিসীমানায়।
— কিন্তু এখানে তো কোনো অফিস টাইপ কিছু নেই।
— আরে পাগল এখানে থাকবে কেন? আমার অফিস তো আরও দু কিলো দূরে।
— দু কিলো! আপনি কি হেঁটে হেঁটে এতদূর এলেন?
— হু।
— কিন্তু আপনার বাসাটা তো এই রোডে নয়।
জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালাম আমি। সে কিছু বলল না, কেবল হাসলো।
— আচরণ নীরদ একটা প্রশ্ন করি?
— হু করুন।
— ভাবির ওপর এখনও রাগ?
ওর প্রশ্ন শুনে আমি মাথা নীচু করে ফেললাম। ছোট্ট শ্বাস ফেলে বললাম,
— নাহ্।
সেও উদাস হয়ে বলল,
— রাগ করে থেকো না। মৃত্যু পথযাত্রী কারো ওপর রাগ করে থাকতে নেই।
চমকাবার পালা এখন আমার। আপা মৃত্যু পথযাত্রী? এসব কি বলছে ও! হতভম্ব হয়ে আমি প্রশ্ন করলাম,
— কিসব বলছেন আপনি? আপা মৃত্যু পথযাত্রী?
— হু।
— এদিকে তাকান প্লিজ। কি হয়েছে আমার আপার বলুন?
হাত ধরে আমার দিকে ফেরালাম তাকে। চোখ দিয়ে অবিরাম জল গড়াচ্ছে আমার। ইনতিসার আমার প্রশ্নের উত্তর দিলো না। পাল্টা প্রশ্ন করলো,
— তুমি যাবে তাকে দেখতে?
— যাব অবশ্যই যাব। এক্ষুণি নিয়ে চলুন আমায় প্লিজ৷
— নিয়ে যাব৷ কিন্তু একটা শর্ত, ওখানে গিয়ে কোনো কান্নাকাটি করা যাবে না। ইঊশা ভয় পেতে পারে।
— ঠিকাছে কাঁদব না। একটুও কাঁদব না।
চোখ মুছতে মুছতে বললাম আমি।
— পথে কোনো যানবাহন দেখতে পারছি না৷ তাছাড়া আমার কাছে টাকাও নেই। তুমি হেঁটে যেতে পারবে আমার সাথে?
আমি মাথা নেড়ে বোঝালাম পারব৷
___________________________
৫০.
প্রায় দেড় দু ঘণ্টা হাঁটার পর ইনতিসার আমাকে একটা তিনতলা বাড়ির সামনে নিয়ে এলো। রাতের অন্ধকারে আশেপাশে চোখ বুলিয়ে মনে হলো এখানকার সব বাড়িই এমন ছোটোখাটো আকৃতির। পথের ওপাশে বোধহয় একটা বস্তিও আছে। ও আমাকে এরকম একটা জায়গায় নিয়ে এলো কেন? ওদের বাড়ি তো এখানে নয়। তাহলে?
হাজার খানেক প্রশ্ন মাথায় নিয়ে আমি ওর পেছনে দাঁড়িয়ে। ও বোধহয় বুঝতে পারলো আমার সংশয়। কলাপসিবল গেইটটা খুলতে খুলতে ঘাড় ফিরিয়ে খুব শান্ত স্বরে বলল,
— তোমার মনে এখন অনেক প্রশ্ন জানি। সব প্রশ্নের উত্তর পাবে ধীরে ধীরে। এখন এতটুকু জেনে রাখো এখানে আমরা থাকি।
ইনতিসারের এবারের কণ্ঠস্বর আমার কাছে অপরিচিত ঠেকলো। এই মুহুর্তে ওকে আবারও স্বাভাবিক লাগছে। কিছুক্ষণ পূর্বের অসংলগ্ন ছেলেটা এ নয়। অদ্ভুত। ছেলেটা কি দ্বৈতসত্তার অধিকারী হয়ে গেছে?

তিনতলা বাড়িটার দোতলায় থাকে ইনতিসার। বাড়িটা যে বেশ পুরনো এর উঁচু উঁচু সিঁড়ি ভাঙতে গিয়েই বোঝা গেল। সদর দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ইনতিসার আমায় আরেকবার সতর্ক করে দিলো কোনো কান্নাকাটি নয়। আমি সুবোধের মতো মাথা নেড় তাকে আশ্বস্ত করলাম কাঁদবো না, সমস্যা নেই৷ কিন্তু শুধু মুখে বললেই হবে? আমার তো সেই কখন থেকে বুকের ভেতর ভাঙচুর হচ্ছে। গুমরে মরছি আমি। কে জানে আপাকে কোন অবস্থায় দেখবো!
ওদের কলিংবেলটা বোধহয় নষ্ট। সোজা দরজাতেই নক করে ডাকল ইনতিসার। দু’বার নক হতেই ভারী ছিটকিনি নামার শব্দ হলো। আমি আড়ালেই দাঁড়িয়ে রইলাম। কে জানে ওপাশে কাকে দেখবো!
তবে ভয়ংকর কাউকে দেখা গেল না। দেখলাম ইশি আপু এসে দরজা খুলেছে। সেও এখানেই থাকে?
ঘর থেকে মৃদু আলো আসায় আমাকে খানিক দেখা যাচ্ছিল। কিন্তু সে বোধহয় খেয়াল করেনি। কোমরে হাত রেখে ইনতিসারকে জেরা করতে শুরু করলো।
— আজও দেরি করে ফিরলি তুই? রাজপুত্র তোর জন্য মানুষ ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করবে?
ইনতিসার হালকা হেসে বলল,
— তুই তো জানিস আমার দেরি হয় তাহলে জেগে বসে থাকিস কেন?
— আমি না জাগলে এত রাতে এসে তোকে দরজাটা কে খুলে দেবে হু?
— দাঁড়া। এ মাসের বেতনটা হাতে এলেই লকটা ঠিক করে নেব। তখন এক্সট্রা চাবি রাখলেই চলবে।
— তাই করবি। রোজ রোজ এভাবে রাত জেগে বসে থাকতে ভালো লাগে না।
— আচ্ছা ঠিকাছে তাই করবো। এখন দেখি ঢুকতে দে আমাকে।
— দেব। আগে দেখে নেই তুই ড্রিংকস করেছিস নাকি?
দেখি এদিকে আয় তো। ইনতিসারের হাত ধরে টানলো ইশি আপু। আমি যেহেতু ওর পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলাম তাই চট করে আমার দিকে নজর চলে এলো তার। অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো,
— ইনতু তুই কি কাউকে নিয়ে এসেছিস? তোর পাশে ওটা কে?
ইনতিসার আমার দিকে একবার তাকালো। বলল,
— নিজেই দেখে নে কে।
আমার সামনে থেকে সরে গিয়ে ইশি আপুকে দেখার সুযোগ করে দিলো ও। মৃদু আলোয় আমার মুখখানা দেখতেই ইশি আপু রূঢ় স্বরে চেঁচিয়ে উঠল,
— ইনতিসার, ও এখানে কেন?
তার স্বর এত ভয়ানক ছিল! শুনে আমার অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল। আমি মাথা নীচু করে ভাবতে লাগলাম একজন দেখেই এই অবস্থা। বাকিদের আরো কি হবে। আমায় বোধহয় আস্তই রাখবে না।
ইশি আপুর চিৎকারে ইনতিসার ক্ষেপে গেল। আমার হাত ধরে ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বলল,
— ছিঃহ্ মাঝরাতে চেঁচামেচি করছিস কেন? লোকে কি বলবে!
— কি বলে বলুক। আই ডোন্ট কেয়ার। তুই বল এই মেয়েটাকে নিয়ে এসেছিস কেন এই বাসায়। তোর সাহস কি করে হয়?
রাগে কাঁপতে কাঁপতে বলল ইশি আপু।
ইনতিসার সে প্রশ্নের জবাব না দিয়ে আমার হাত ধরে টেনে একটা ঘরের সামনে নিয়ে গেল। বলল,
— এখানে ভাবি আছে। ভাবির রুমে গিয়ে চুপচাপ শুয়ে পড়ো। যা কথা হওয়ার কাল হবে।
আমি বোবার ন্যায় মাথা নেড়ে চাপিয়ে রাখা দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে গেলাম।
ডিম লাইটের মৃদু আলোয় খাটের ওপর ঘুমন্ত আপা আর ইঊশাকে দেখে চেপে রাখা কান্না সব বাঁধা ঠেলে সবেগে বাইরে আসতে চাইলো। আমি ছুটে গিয়ে আপাকে পেছন থেকে জাপ্টে ধরলাম। ঘুমের ব্যাঘাত ঘটায় আপা খানিক নড়ে উঠলো। আমার হাতের ওপর হাত রেখে ঘুমের ঘোরে অস্পষ্ট গলায় বলল,
— কে এসেছে? আমার নীরদ এসেছে? বাবু তুই এসেছিস? আমার মেয়ে।
আমি আর আটকাতে পারলাম না নিজেকে। ঠোঁট কামড়ে নিঃশব্দে কাঁদতে কাঁদতে বললাম,
— এসেছে আপা। তোমার নীরদ এসেছে। পাশ ফিরে আমাকে একটু জড়িয়ে ধরো আপা। আমার ভেতরটা যে জ্বলে যাচ্ছে। আমি পুড়ছি আপা, ভয়ানকভাবে পুড়ছি। দহন জ্বালায় নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছি।

দরজার বাইরে থেকে ভাঙচুরের আওয়াজ আসছে সাথে দু ভাইবোনের কথা-কাটাকাটি।মনে হচ্ছে মাঝরাত্তিরে মহা প্রলয় নেমে এসেছে ধরনীর বুকে। কে জানে এই মহাপ্রলয় আমাদের কোথায় ভাসিয়ে নিয়ে যায়!

চলবে,
Sinin Tasnim Sara

ভালোবাসার রংধনু
২৮
________________
৫১.
সাত সকালে মিঠেল রোদের অবাধ্য স্পর্শে ঘুম ভেঙে গেল আমার। তাকিয়ে দেখলাম বিছানার ধারেই জানালাটা। পুরনো জং ধরা লোহার গ্রীল। ওতে নরম রঙের পর্দা আঁটা থাকলেও সে পর্দা ভেদ করে রোদেরা ভীড় জমিয়েছে ছোট্ট কামরায়। পিটপিট করে ঘরের চারদিকে নজর বোলাতে ইচ্ছে করলো আমার। আসবাব বলতে বেশিকিছু নেই ঘরটায়। ঘরের এক কোনে জানালার পাশে খাট। একটা কাঠের আলমারি, ছোট্ট একখানা টেবিল যাতে হাতে গোনা কয়েকটা বই আর রাজ্যের ঔষধপত্রে ভরা আর দেয়ালে গোলাকৃতির ছোট্ট দেয়ালঘড়ি ব্যাস।
চারিদিকে চোখ বুলিয়ে মনে করার চেষ্টা করলাম এই মুহুর্তে কোথায় আছি! উঠে বসতে বসতে মনে পড়লো আমি তো আপার কাছে এসেছি। ইতিউতি তাকিয়ে আপাকে খোঁজার চেষ্টা করলাম। কিন্তু সে ঘরে নেই। বাড়িটা নিস্তব্ধ। কারোর কথা শোনা যাচ্ছে না। কেউ নেই নাকি বাড়িতে?
অবিন্যস্ত চুলগুলো মুঠোয় পেঁচিয়ে রাবারে আটকাতে আটকাতে ভাবছিলাম আমি। এমন সময় মৃদু ধাক্কায় দরজা খুলে গেল। তাকিয়ে দেখলাম হুইল চেয়ারে বসে এগিয়ে আসছে আপা। আমায় দেখেই হাস্যোজ্জ্বল মুখে বলে উঠল,
— সোনামানিক আমার। উঠে গেছিস ঘুম থেকে?
হতভম্ব আমি ছুটে গেলাম আপার কাছে। অস্থির হয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
— কি হয়েছে তোমার আপা? তুমি হুইলচেয়ারে!
আমার প্রশ্নে আপার চেহারা ফ্যাকাশে হয়ে গেল। তবে তা ক্ষণিকের জন্য। পুনরায় সে মুখে হাসি ফিরিয়ে এনে সস্নেহে আমার চুল গুছিয়ে দিতে দিতে বলল,
— সে অনেক কথা বাবু। পরে শুনিস। এখন ফ্রেশ হয়ে আয় তো। কিছু খাবি। আমি নিজ হাতে আজ খাইয়ে দেব তোকে।
— কিন্তু আপা..
— কোনো কিন্তু নয়। সব প্রশ্নের উত্তর পাবি। আগে ফ্রেশ হয়ে আয় যা। বাথরুমে সব দেয়া আছে। আর আলমারিতে দেখবি তোর জামাগুলো আছে। একটুও মোটা হসনি তো। সব গায়ে লাগবে।
— আমার কাপড় এখনও রেখে দিয়েছো তুমি?
— তোর স্মৃতি বলতে তো শুধু ওগুলোই ছিল।
গালে হাত বুলিয়ে আলতো করে চুমু খেয়ে ছলছল চোখে বলল আপা। আমি পাল্টা তার হাতে হালকা ঠোঁটস্পর্শ করে উঠে পড়লাম।
আলমারিতে সত্যিই আমার পুরনো সব কাপড় রাখা আছে ভাঁজ করে। কাপড়গুলোতে হাত বোলাতেই পূর্বের সকল কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল। ঘরকুনো নীরদ যার আপনজন বলতে এক আপা আর দুই বই ছিল। মা হারা অনাথ একটা মেয়ে বোনের বাড়িতে সকলের অবহেলায় থাকতো। অবশ্য আর সবার কাছে অবহেলা পেলেও বোন ছাড়া আরেকজন ব্যক্তির প্রত্যক্ষভাবে সাপোর্ট পেত সে সবসময়। মায়ের স্নেহও পেত। সে মানুষটা হলো মাউইমা। আজকে নিশ্চয়ই তাঁর সাথেও দেখা হবে? আমি যেন আর অপেক্ষাই করতে পারছি না। আচ্ছা মাঝখানে এতটা বছর যে কেটে গেল, ওনার হৃদয়ে আমার জন্য ভালোবাসা অক্ষত আছে তো? নাকি…
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে কাপড় হাতে বাথরুমের দিকে পা বাড়ালাম আমি।
_____
বেশ সময় লাগিয়ে শাওয়ার নিয়ে বেরুবার মুহুর্তে বেখেয়ালে নজর পড়ে গেল বাথরুমের ছোট্ট আয়নাটায়। গুটি গুটি পায়ে সামনে গিয়ে ঝাপসা আয়নাটা আলতো হাতে মুছে নিতেই বিধ্বস্ত একটা প্রতিচ্ছবি ভেসে উঠল। আলতো হাতে প্রতিচ্ছবি ছুঁয়ে ভাবতে লাগলাম ঠিক কতদিন পর আয়নায় নিজেকে দেখছি? শেষ কবে দেখেছিলাম মনে পড়ে কি!
এই গর্তে ঢোকা কালি পড়ে যাওয়া চোখজোড়া, ব্রণে ভরা মুখ, শুষ্ক ঠোঁটজোড়া এরকম আমি ছিলাম না। এটা আমি নই। এটা অন্যকেউ৷ নামটা শুধু এক কিন্তু ভেতরের মানুষটা ভিন্ন, বাইরের প্রতিচ্ছবি ভিন্ন, জীবনধারা ভিন্ন। সব ভিন্ন সব। আমি আর রক্তমাংসের নীরদ নই। আমি কেবল ভাঙাচোরা একটা মাটির পুতুল। একটা অনুভূতিহীন জড়। আজ আমার আর কান্না আসছে না। আমি চেষ্টা করছি চোখে পানি নিয়ে আসার। পারছি না। এই যে মাত্র বললাম জড় পদার্থ হয়ে গেছি। তাই বোধহয় চোখের পানি পাথর হয়ে গেছে।

আপা বাইরে থেকে ডাকছে। সময় নষ্ট করা উচিৎ নয়। খানিকটা পানি হাতে নিয়ে আয়নাটায় ছুঁড়ে দিয়ে বেরিয়ে এলাম আমি। আজকের পর থেকে আয়না দেখাও আমার জন্য বন্ধ।

বেরিয়ে দেখি আপা কি সুন্দর প্লেট ভরে খাবার নিয়ে এসেছে। সে জানে আমি এতটা খাবার খেতে পারব না। তবুও এনেছে। বোনপ্রীতি।
— এতটা খাবার নিয়ে এলে যে? আমি কি এত খাই?
— খাস না কি হয়েছে। আজ খাবি। শুকিয়ে পাটকাঠি হচ্ছিস দিনদিন। নিজেকে একবার দেখেছিস আয়নায়?
আমি মৃদু হাসলাম। খাটে বসতে বসতে বললাম,
— যত্ন করার কেউ ছিল না যে। কতবেলা না খেয়ে পার করেছি কেউ জানতে চায়নি কখনো। কাজের চাপে নিজেরও মনে থাকেনি। তাই তো এমন অবস্থা হয়ে গেছে।
আমার কথা শুনে আপা কাতর দৃষ্টিতে তাকাল।
— এসব আমার জন্য হয়েছে তাই না রে নীরদ? পারলে আমাকে ক্ষমা করে দিস রে।
— এমা ছিঃ ছিঃ। ক্ষমার কথা আসছে কোত্থেকে! আমার তো তোমায় ধন্যবাদ জানানো উচিৎ আপা। সে রাতটা জীবনে না এলে জীবন যে আসলে কি! আমি জানতে পারতাম না।
যদিওবা কাঁটা বিছানো জীবনের পথটা আমি ঠিকঠাক মাড়াতে পারিনি, ব্যর্থ হয়েছি। তবুও আমি তোমার কাছে কৃতজ্ঞ।
আমার কথা শুনে আপা মুখ ঘুরিয়ে কেঁদে ফেলল। আপার কান্না দেখে আমার বেশ খারাপই লাগল। ওর কাছে আরেকটু সরে গিয়ে হাতের ওপর হাত রেখে বললাম,
— কেঁদো না তো। কাঁদলে কোনোকিছুর সমাধান হয় না আপা। যা গেছে, গেছে। ওগুলো মনে না রাখি আমরা। বরং তুমি আমাকে খাইয়ে দাও। কত ক্ষুধা লেগেছে জানো?
— হ্যাঁ খাইয়ে দিচ্ছি। তুই পা তুলে আরাম করে বোস তো।
— তোমাকেও খাটে বসিয়ে দিই? ওখান থেকে কষ্ট হবে তো।
— দিবি? আচ্ছা দে।
প্লেট রেখে আপাকে ধরে খাটে বসিয়ে দিলাম।
ওর দুটো পা-ই প্যারালাইজড৷ আমি চলে যাওয়ার পর নিশ্চয়ই কিছু হয়েছে। খারাপ কিছু। কিন্তু কি হয়েছে ধরতে পারছি না। সবটা আপার মুখেই শুনতে হবে। দ্রুত।
__________________
৫২.
খাওয়ার ফাঁকে কথাগুলো কীভাবে তুলব বুঝতে পারছিলাম না আমি। উশখুশ করে বারবার এটাসেটা বলছিলাম। কিন্তু কোনো কিছুই জমছিল না ঠিক। তারপর মনে হলো যা জানতে চাই সরাসরি জিজ্ঞেস করা উচিৎ। বড় করে নিঃশ্বাস নিয়ে একবার জিজ্ঞেস করেই ফেললাম,
— তোমরা এই বাড়িতে কেন আপা? আগের বাড়িটা কি হলো?
— ওটা তো নিলামে উঠেছে।
— নিলামে হঠাৎ! কেন? আর তোমারই বা এই অবস্থা হলো কি করে? আমি আর থাকতে পারছি না আপা। এত এত প্রশ্নের ভীড় মাথায়!
অসহায়ভাবে বললাম আমি। আপা আমার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। মৃদু কণ্ঠে বলল,
— এসবের শুরুটা হয়েছে সেদিনের পর থেকে।
— মানে যে রাতে আমাকে বাড়ি থেকে..
কথা সম্পূর্ণ করলাম না আমি। আপা না সূচক মাথা নেড়ে বলল,
— উঁহু। তারও আগে। আমার ওই বাড়িতে বউ হয়ে যাওয়ার পর থেকে, তোকে ওই বাড়িতে নিয়ে তোলার পর থেকে। আর ইনতিসারের তোর প্রতি অনুভূতি আসার পর থেকে। দুর্ভাগ্যবশত এসবের কেন্দ্রবিন্দু তুই আর ইনতিসার বনে গেছিস নীরদ। তোদের দুজনকে আবর্তন করেই সবটা। তবে প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ কোনোভাবেই তুই কিংবা ইনতিসার এসবের জন্য দোষী নোস।
— একটু খোলাসা করে বলবে সবটা?
— প্লেটটা রেখে আয়। বলছি।
আপার কথামতো চট করে প্লেটটা সিঙ্কের ওপর রেখে চলে এলাম আমি। আসার সময় ওপাশে দুটো রুম চোখে পড়ল যেগুলোর দরজা আটকানো। মনে তো হচ্ছে আমরা দু বোন ছাড়া বাড়িতে আর কেউ নেই। অবশ্য থাকলেও হয়তোবা দরজা বন্ধ করে বসে আছে।
ঘরে ঢুকে আমিও দরজাটা চাপিয়ে আপার পাশে গিয়ে বসলাম। আপা আমার হাত ধরে বলল,
— সবটা ধৈর্য ধরে শুনবি নীরদ। কেমন?
আমি মাথা নেড়ে বোঝালাম “শুনব”
ছোট্ট শ্বাস ফেলে আপা বলতে শুরু করলো,
— আমার আর তোর দুলাভাইয়ের বিয়েটা হয়েছিল পরিবারের অমতে। এরা কেউই আমাকে এ বাড়ির বউ হিসেবে মেনে নিতে রাজি ছিল না। অনেকে নেয়ও নি। সবাই মনে করেছিল গরীব ঘরের মেয়ে প্রতিপত্তির লোভে ছেলে ফাঁসিয়েছে। অথচ কথাটা কিন্তু সঠিক নয়৷ শুরুতে আমি তোর দুলাভাইয়ের প্রেমে পড়িনি। সে-ই পড়েছিল। আমার পেছনে লেগেছিল পাগল কুকুরের মতো। তার সেসময়কার পাগলামির ব্যাখ্যা দেয়া সম্ভবই নয়৷ সে কোনো চেষ্টা বাদ রাখেনি আমাকে তার দিকে আকৃষ্ট করার। ওদিকে বড়পা, মেজোপার হঠাৎ করে চলে যাওয়ার পর আমারও বাবার বাড়িতে মন টিকছিল না। কেন যেন তোর থেকে আর বাবার থেকে পালাতে চাইছিলাম। এজন্যই এহতেশাম আমাকে সহজেই ওর প্রতি আকৃষ্ট করতে পেরেছিল। প্রেমের মতো বিয়ের প্রতিও আগ্রহটা আমার থেকে ওরই বেশি ছিল। তুই জানিস না তবে আমরা কিন্তু পারিবারিকভাবে বিয়ের আগেও একা একা বিয়ে করেছিলাম। বিয়েতে ওর পরিবারের অনেকেই উপস্থিত ছিল না৷
বাবা হয়তো বুঝতে পেরেছিল কিছু। বিদায়ের সময় আমার হাত ধরে বলেছিল, “সামলে থেকো মা। এই সংসারে তোমাকে অনেক কিছু সহ্য করতে হবে। নিজেকে শক্ত করে যাও”
আমি প্রথমে আমলে নেইনি বিষয়টা। কিন্তু ভাগ্য!
সংসারে পা রাখার প্রথম দিন থেকেই বাবার কথা অক্ষরে অক্ষরে ফলে গেছে। শুধুমাত্র শ্বাশুড়ি আর স্বামী ছাড়া আর কাউকেই পাশে পাইনি আমি। কত মন যুগিয়ে চলার চেষ্টা করেছি সবার! বারবার শুধু ব্যর্থই হয়েছি।
আমার সকল প্রচেষ্টা বিফলে যেতে দেখে একদিন আম্মা বুদ্ধি দিলেন, বাচ্চাকাচ্চা নাও। বংশে আলো এলে তোমার শ্বশুর, ননদের মন গলবে। আমি ভাবলাম সত্যি বোধহয়। তারপর কিছু চিন্তা না করেই নিয়ে নিলাম বাচ্চা। তোর দুলাভাই এত তাড়াতাড়ি বাবু চায়নি। কতবার বলেছে অ্যাবোর্শন করাতে। আমি রাজি হইনি। একপ্রকার ওর মতের বিরুদ্ধে গিয়ে বাবুকে পৃথিবীতে এনেছি। আমার মাথায় তখন একটা চিন্তা এ বাড়ির বউ হয়ে উঠতে হবে। যেকোনো উপায়ে।
অবশ্য আমার চেষ্টা বিফলে যায়নি। বাবু হওয়ার পর ননদ, জা-দের ভালোবাসা ফিরেছিল আমার দিকে। কিন্তু শ্বশুরের মন তখনও গলেনি। শুরু শুরুতে ইঊশাকেও সে পছন্দ করতো না। তারপর একদিন কি হলো হঠাৎ করেই ইঊশাকে নাতি হিসেবে মেনে নিলো । ভাবলাম হয়তোবা শাশুড়ি মা বুঝিয়েছেন তাকে। কিন্তু অদ্ভুতভাবে লক্ষ করলাম আর সবার মন যুগিয়ে চলতে গিয়ে আসল মানুষটা, মানে তোর দুলাভাইকেই কবে যেন হারিয়ে ফেলেছি আমি। বাবু হওয়ার দু-মাসের মাথায় খুব তুচ্ছ কারণ নিয়ে তার গায়ে হাত তোলাটাই বুঝিয়ে দিয়েছিল আমাকে।
আমি চেষ্টা করলে সে সংগ্রামের পথ ছেড়ে বেরিয়ে আসতে পারতাম। কিন্তু নিরুপায় ছিলাম নীরদ। আর্থিকভাবে পরনির্ভরশীল মানুষ চাইলেই চট করে একটা শক্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারে না।
কথা বলার এক পর্যায়ে চোখ দিয়ে পানি গড়াতে শুরু করলো আপার। এক হাতে সে চোখের পানি মুছে নিয়ে বলে গেল,
— যতদিন তোর দুলাভাই আমার পাশে ছিল ততদিন কিছু মনে হয়নি। কিন্তু সে সরে যাওয়ার পর আমার পায়ের নীচ থেকে যেন মাটিটাই সরে গেছিল। ঝলমলে আলোকসজ্জার বাড়ি, বাড়ি ভর্তি লোক অথচ আমি হয়ে পড়েছিলাম একা। সম্পূর্ণ একা। আপনজন বলতে আমার কেউই ছিল না সেখানে । আমি আর পারছিলাম না ওভাবে।
তারপর একদিন হুট করে তোর দায়িত্ব দিয়ে দিলেন সৃষ্টিকর্তা। আমার একমাত্র ছোটো বোন। তোকে কতই না অবহেলা করেছি এক জীবনে। কিন্তু এই খারাপ সময়টায় এসে দেখলাম আমার আপনজন বলতে একমাত্র তুই ই আছিস পৃথিবীতে। আমি তোকে হারাতে রাজি ছিলাম না। হাজার গঞ্জনা সইতে হবে জেনেও তোকে নিয়ে এলাম আমার কাছে। তুই জানিস না নীরদ, তোকে যেদিন নিয়ে এলাম বাড়িটাতে সেদিন রাতে শ্বশুর মশাই আমায় ডেকে পাঠালেন। কঠিন গলায় বললেন “নিজে আমার এক ছেলেকে ফাঁসিয়ে শখ মেটেনি? এখন আবার বোনকে এনে ফেলেছ বাড়িতে! শোনো মেয়ে আমি কিন্তু বেশ বুঝতে পারছি তোমার উদ্দেশ্য। বংশধর দিয়েছ বলেই যদি মনে করো তোমায় মেনে নিয়েছি। তাহলে ভুল ভাববে। তুমি এখন পর্যন্ত আমার চোখে বাইরের মানুষ, সহজ কথায় আশ্রিতাই। এক আশ্রিতা আরেক আশ্রিতাকে নিয়ে তো এলে। ওর কারণে যদি আমার সংসারে কোনোরূপ অশান্তি হয় তারপর বুঝবে। মনে রাখবে, আমি লোকটা বিশেষ ভালো নই”
বাবা হারিয়ে একসময় যাকে বাবার আসনে বসিয়েছিলাম তার মুখে এরকম কটূ কথা শোনার পর আমার ভেতরে যে কি ঝড় বইছিল তোকে বোঝাতে পারব না নীরদ। তবুও আমি তোকে ছাড়ার কথা ভাবতে পারিনি। জানতাম আমি যদি তোকে সরিয়ে দিই নিজের থেকে, তাহলে তোর অস্তিত্বই আর থাকবে না পৃথিবীর বুকে। এই পৃথিবীর মানুষ খুব খারাপ। তুই পেরে উঠতি না কারোর সাথে।
— আপা৷
আমি কাতর গলায় ডাকলাম আপাকে। কিন্তু তার খেয়াল এদিকে নেই। সে তার মনে বলে গেল,
— তারপর শোন নীরদ। তোর হয়তোবা রাগ আমার ওপর। আমি সবসময় কড়া শাসনে রেখেছি তোকে। বাইরের কারো সাথে মিশতে দেইনি। এমনকি পরিবারের লোকগুলোর সাথেও তেমন মিশতে দেইনি। এর একটাই কারণ তোর সম্পর্কে যেন কোনো খারাপ রিপোর্ট না আসে। আমি জানতাম এহতেশামের বাবা সবসময় তক্কে তক্কে থাকতেন তোর ক্ষতি করার জন্য। ওই নোংরা লোকটার হাত থেকে তোকে বাঁচাতেই একপ্রকার বন্দী জীবন করে দিয়েছিলাম আমি তোর৷ আমার বিশ্বাস ছিল একদিন মেধার জোরে এই শেকল ভেঙে বেরিয়ে যেতে পারবি তুই। আমি খুব করে অপেক্ষা করছিলাম সেই দিনটার জন্য। কিন্তু সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছে যে অন্যকিছু। আমাদের পরিকল্পনার উর্ধ্বে তাঁর পরিকল্পনা। তিনি হয়তোবা তোকে নিয়ে অন্যকিছু ভেবে রেখেছিলেন। তাই তো একসময় ইনতিসার এলো তোর জীবনে।
— কিন্তু আমি তো তাকে কখনোই চাইনি আপা।
অস্থির হয়ে বললাম আমি। আমার দিকে ভরসার চোখে তাকিয়ে আপা বলল,
— আমি জানি নীরদ। তোর মনে ইনতিসারকে নিয়ে কিছু ছিল না। যদি কখনো এসেও থাকে, আমার কথা ভেবেই হয়তো নিজ হাতে সে অনুভূতিটাকে মে/রে ফেলেছিস তুই৷

আমি মাথা নীচু করে ফেললাম। নিরেট সত্যই বলেছে আপা। কিশোরী বয়সের আবেগে ভেসে ইনতিসারকে নিয়ে ভাবনা আমার মনেও এসেছিল ঠিক। কিন্তু নিজের অবস্থান স্মরণ করে আর আপার ভয়ে নগন্য সে ভাবনাকে ধমকে মনবাক্সে বন্দি করতে দেরি করিনি। যদি ইনতিসারের পাগলামিতে সাড়া দিতাম তাহলেও কি দুর্ভাগ্যকে আটকানো যেত! তখন তো অন্য উপায়ে আসতো দুর্ভাগ্যটা।
নিজ ভাবনায় মশগুল আমার ধ্যান ভাঙলো আপার কথায়।
— শক্ত বাঁধনে তোকে আটকাতে পারলেও শত চেষ্টা করেও ইনতিসারকে আমি আটকাতে পারিনি নীরদ। ও জেদি,বেপরোয়া ছেলে। আমি হাজারবার ওকে সতর্ক করেছি, রাগ দেখিয়েছি, ধমকেছি;ভয়ও দেখিয়েছি তোকে দূরে কোথাও রেখে আসব এসব বলে। কিন্তু ও আমার কথা শোনেনি। বরং একসময় আমায় অনুনয় করে বলেছে একটাবার যেন ওকে সুযোগ দেই।
তোর ব্যাপারে সিরিয়াস ও। সারাজীবন কাটাতে চায়। তোকে ভালোবেসে আপন করতে চায় ৷ আমি ওর অনুভূতিকে নিছক ছেলেমানুষি মনে করেছিলাম৷ কিন্তু একদিন সবার অগোচরে ও তোর ঘরে গিয়ে বিয়ের প্রস্তাব যে দিল! আমি ভাবতেও পারিনি বেপরোয়া ছেলেটা কখনো এতদূর অবধি চিন্তা করবে। ওকে তোর ঘরে দেখে সেদিন আমার অন্তরাত্মা কেঁপে উঠেছিল নীরদ। আমার মনে হয়েছিল একসময় ওর ভাইয়ের পাগলামিতে যেমন আমি ভেসে গেছিলাম, তুইও ওর পাগলামিতে ভেসে যাবি। নিজেকে আটকাতে পারবি না। এবং এই ভাবনা থেকে আমি একটা অপরাধ করে ফেলি।
— কি অপরাধ আপা?
বিস্মিত হয়ে জানতে চাইলাম আমি।
— শ্বশুর মশাইকে ডেকে এনে সেই ঘটনা দেখিয়ে দিই। উনি সেদিন তাড়াতাড়িই ফিরেছিলেন। ওপরের ঘরে ছিলেন। তোরা কেউ বুঝতে পারিসনি আমার পাশে উনিও দাঁড়িয়ে দেখেছেন সবটা। শুধু উনি নয় আমি আম্মাকেও ডেকে এনেছিলাম।
নিজের ছেলের কর্মকাণ্ড দেখে ওনাদের মুখে যেন গ্রহণ লেগেছিল।
যেই সম্মান হারানোর অপবাদ উনি আমাকে দিতে চাইছিলেন, সেটা যে ওনার ছেলের মাধ্যমেই হারাবে এটা বোঝাতে চেয়েছিলাম তাকে।
ওসব দেখে ক্রোধে অন্ধ হয়ে উনি তৎক্ষণাত ভেতরে যেতে চাইছিলেন। আম্মা জোর করে তাকে আটকে ওপরে নিয়ে গেলেন । যাওয়ার সময় বলে গেলেন আমায় সবটা সামলাতে। আমি সামলে নিতে পারলেও কিছু সময় পর উপলব্ধি করলাম, রাগের মাথায় আমি বোধহয় ভুল করে ফেলেছি। এর প্রভাব যদি কোনোভাবে তোর ওপর আসে তখন কি হবে!
চিন্তায় অস্থির হয়ে যাচ্ছিলাম আমি।

শ্বশুর মশাই খুব চালাক মানুষ। তিনি কিন্তু তাই করতে চেয়েছিলেন। সব দোষ তোর ওপর চাপিয়ে তোকে বাড়ি থেকে বের করে দেয়ার ফন্দি এঁটেছিলেন। কিন্তু সফল হননি কেবলমাত্র ইনতিসারের জন্যে। তোকে নিয়ে মিথ্যে অপবাদ শুনে ও এতটা রেগে গেল! সে রাতেই বাবা ছেলের ভয়ানক ঝগড়া লাগল ৷ তোর বিরুদ্ধে কোনো কথা শুনলে ও যেভাবে হুংকার দিচ্ছিল, ওর সে রাতের আচরণগুলো সবাইকে অবাক করে ফেলেছিল । আমি বুঝতে পেরেছিলাম ও তোকে নিয়ে কতখানি সিরিয়াস। শ্বশুর মশাইও জেদি ছেলের সাথে সুবিধা করতে পারছিলেন না। উনিও ভীষণ রাগারাগি করছিলেন। এক পর্যায়ে গায়ে হাত পর্যন্ত তুলতে গেছিলেন। তখনও আম্মাই তাকে সামলে নেন। সংসারে অশান্তি এড়াতে চট করে বলে ওঠেন,
“নীরদ তো তোকে চায় না ইনতিসার। আমরা নিজ চোখে দেখেছি, নিজ কানে শুনেছি ও তোকে নিয়ে ওরকম কোনো চিন্তা করে না। সে মেয়েকে জোর করে কীভাবে বাঁধব তোর সাথে বল?”
মায়ের কথা শুনে ইনতিসার এরপর নীরব হয়ে গেল। খানিক্ষণ মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে থেকে আর্দ্র গলায় বলল, “আমি যে ওকে ছাড়া কিছু ভাবতে পারছি না মা। চেষ্টার তো ত্রুটি রাখছি না ওকে আপন করার। কিন্তু কিছুতেই ও আমাকে চাইছে না। কেন চাইছে না মা? কেন? আমার মধ্যে কিসের কমতি”
ইনতিসার ভেঙে পড়ছিল আস্তে আস্তে। আমি ওর আচরণ দেখে দ্বিধায় পড়ে যাচ্ছিলাম জানিস? একবার মনে হচ্ছিল ও এহতেশামের ভাই। দু’ভাই আলাদা হতে পারে না। আবার মনে হচ্ছিল নাহ্ ওরা আলাদাই। ইনতিসারের চোখে ভাষাই বাতলে দিচ্ছিল ও আর এহতেশাম এক নয়। আমিই ভুল করেছি। আমিই।

ছেলেকে ভেঙে পড়তে দেখে আম্মাও কেঁদে ফেললেন। ওকে দু’হাতে আগলে নিয়ে বললেন, “ওকে আপন করে পেতে হলে সময় দিতে হবে বাবা। তোকে যোগ্য হতে হবে ওর। মুখে বলে নয় কাজের মাধ্যমে বোঝাতে হবে তোর ভালোবাসা। তুই বরং ওকে কিছুটা সময় দে। নিজেও সময় নে৷ এখনও তোর চিন্তাভাবনা অনেকটা অপরিণত। কিছুটা সময় যাক। ধৈর্য ধারণ করে থাক ততদিন”

ইনতিসারের মতো জেদি মানুষদের রাগ, জেদ দিয়ে শান্ত করা যায় না। তাদের ঠান্ডা মাথায় বোঝাতে হয়। আম্মাও সেটাই করেছিলেন৷ ইনতিসার হয়তো বুঝেও গিয়েছিল সবটা।
আমিও দেখতে চাইছিলাম তার পরিবর্তন। ঠিক করেছিলাম ও যদি সত্যিই পরিবর্তন হতে পারে তাহলে তোর আর ওর ব্যাপারটা নিয়ে কিছু ভাবব। যে তোকে সকল বিপদ থেকে আগলে রাখতে সবসময় তোর ঢাল হয়ে সামনে দাঁড়াবে অমন ছেলেকে আমি মনে মনে চাইতাম তোর জন্য । সে যদি ইনতিসারও হয় তাহলেও আমার আর কোনো সমস্যা থাকবে না । এমনটাই ভেবেছিলাম। কিন্তু পরদিন সকালে উঠে জানতে পারি যে ইনতিসারের পরিবর্তন দেখবার জন্য আমি অধীর আগ্রহে বসে, সে ইনতিসারই বাড়িতে নেই। বাড়িতে কি, দেশেই নেই। শেষ রাতে তাকে সকলের অগোচরে বাইরের দেশে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। কে, কীভাবে ইনতিসারকে সে রাতে বাড়ি ছাড়ার জন্য রাজি করতে পেরেছিল আমি জানি না। তবে এসবের পেছনে শ্বশুর মশাইয়ের ভূমিকা আছে খুব ভাল করে বুঝতে পেরেছিলাম।
চলবে,
Sinin Tasnim Sara

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here