ভালোবাসার রংধনু,৩১,৩২

0
829

ভালোবাসার রংধনু,৩১,৩২
Sinin Tasnim Sara
৩১
___________________
৫৭.
রোজকার মতো সে রাতেও ইনতিসার ফিরল দুটো কি আড়াইটেতে। আমি তখনও জেগে। এরকম নয় যে ওর জন্যই অপেক্ষা করছিলাম। আসলে আমার ঘুমই আসছিল না। ততদিনে সে দরজার লক ঠিক করে নিয়েছে। এক্সট্রা চাবি সাথে রাখে। দরজা খোলা-বন্ধের শব্দেই বুঝতে পারলাম ওর আগমন। ভাবছিলাম আমার কি এখন গিয়ে ওকে থ্যাংক্সটা দেয়া উচিৎ, নাকি সকালবেলা? না, না এখন যাওয়ার দরকার নেই। এত রাত অবধি জেগে আছি যদি ভুলভাল ধারণা করে? কোনো রিস্ক নেবার দরকার নেই। দাঁতে নখ কাটতে কাটতে মন আর মস্তিষ্কের এক প্রকার লড়াইয়ে নেমেছিলাম যেন। ঠিক তখুনি আমার ঘরের দরজায় আলতো হাতের নক পড়ল। চট করে উঠে বসে শুনতে পেলাম ইনতিসারের জড়ানো গলা,
— নীরদ ঘুমাও? এ্যাই নীরদ।
ওর কথা বলার ভঙ্গি বলে দিলো ও ড্রাংক। আশ্চর্য প্রত্যেকদিন এই ছেলে ম/দ পায় কোথায়?
ভীষণ বিরক্তির সাথে উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিলাম। রিস্ক নেয়া তো ঠিক নয়। এত রাতে দরজা না খুললে যদি চেঁচামেচি করে? মান ইজ্জত কিচ্ছু থাকবে না আর।
দরজা খোলা মাত্র হুড়মুড় করে ভেতরে ঢুকে গেল ও। ডিম লাইট জ্বালানো ঘরে। আমি সবই দেখতে পারছি। এক হাতে ব্যাগ আরেক হাতে পাখির খাঁচার মতো কিছু একটা নিয়ে ও টলমল করছে। চোখে বোধহয় ঝাপ্সাও দেখছে৷ বারবার চোখ পিটপিট করে আমায় ডাকছে। আমি জবাব দিয়ে লাইটটা জ্বেলে দিলাম। সে পাখির খাঁচা আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে আলতো হেসে বলল,
— নাও এবার পাখিও এসে গেছে তোমার। দুটো পাখির জন্য কাঁদছিলে আমি চারটা নিয়ে এসেছি। নাও ধরো, নাও-নাও৷
জোর করে পাখির খাঁচা আমার হাতে ধরিয়ে দিলো সে৷ আমি হতভম্ব হয়ে দেখলাম সত্যই ৪ টা পাখি। প্রিমাদের মতোই দুটো আকাশি-টিয়া আর দুটো হালকা বেগুনি রঙা। কিন্তু এগুলো প্যারাকিট নয় অন্য পাখি। কি পাখি ঠিক চিনতে পারলাম না। চারটে পাখি এক খাঁচায় কি ভীষণ ডাকাডাকি আর ওড়াউড়ি করছে!
হতভম্ব ভাবটা বজায় রেখে ইনতিসারকে প্রশ্ন করলাম,
— এখানে কি প্রতিযোগিতা হচ্ছে? আপনি কেন এরকম করছেন? দিনের বেলা কতগুলো গাছ এনে দিলেন৷ এখন আবার পাখি।
— তুমিই তো এগুলোর জন্য মরে যাচ্ছিলে। কাল সারারাত ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ করে কাঁদলে। তোমার ফ্যাঁচফ্যাঁচানির জন্য আমার কত সমস্যা হয়েছে জানো! সারারাত ঘুমাতে পারিনি৷
— শুধুমাত্র আপনার ঘুমের সমস্যা হয়েছে জন্য আপনি এতগুলো টাকা অযথা উড়িয়ে দিয়ে আসবেন?
— হ্যাঁ আসব। আমার টাকা আমি উড়িয়েছি তোমার কি?
— আমার কিছুই না। কিন্তু আমি এসব আর নিতে পারব না।
কড়া গলায় বলে খাঁচাটা তার দিকে বাড়িয়ে দিলাম আমি।
সে সরু চোখে তাকিয়ে বলল,
— কেন পারবে না? অবশ্যই নিতে হবে তোমাকে৷ আমি এনে দিয়েছি তারমানে নিবেই৷
— না আমি নেবো না৷ জোরজবরদস্তি করবেন না ইনতিসার৷ নিন আপনার পাখির খাঁচা ধরুন আর ফিরিয়ে দিয়ে আসুন যেখান থেকে পেয়েছেন৷
— পারব না আমি৷
মুখ ফিরিয়ে বলল সে৷
— আরে অদ্ভুত! পারবেন না মানে।আমি কিছুতেই এসব রাখব না৷ পাখি মোটেই পছন্দ নয় আমার৷
অস্থির হয়ে বললাম আমি৷
— পছন্দ নয় তো পাখির জন্য কাঁদছিলে কেন?
সেও গোঁয়ারের মতো পাল্টা প্রশ্ন করল।
— আপনাকে কে বলেছে আমি পাখির জন্য কান্নাকাটি করেছি? নিজ মনে কিছু একটা ভেবে নিলে তো হবে না৷
— দেখো কথা বাড়াতে চাইছি না আমি৷ পাখি এনে দিয়েছি চুপচাপ নিয়ে নাও৷
— আমি একবার বলেছি নেবো না, তো নেবো না৷ শেষ৷
— তাহলে ফেলে দাও যাও৷
রাগত স্বরে বলে বেরিয়ে যেতে চাইলো ইনতিসার৷ আমি ছুটে গিয়ে হাত টেনে ধরলাম ওর৷
— পারব না এসব করতে। আপনার পাখি আপনিই ফেলে দিবেন নাকি উড়িয়ে দিবেন দিন৷
— বেশি বেশি হচ্ছে কিন্তু নীরদ৷
চোখ কটমট করে তাকালো ইনতিসার৷ আমি দেখেও না দেখার ভান করে বললাম,
— বেশি বেশি কে করছে বুঝতেই পারা যাচ্ছে। কথায় কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। আপনার পাখি আপনিই ধরুন তারপর যা মন চায় করে ফেলুন।
জোর করে তার খাঁচা তাকেই ধরিয়ে দিলাম আবারও৷ সে চোখ পাকিয়ে কতক্ষণ তাকিয়ে থাকলো আমার দিকে৷ তারপর গটগট করে হেঁটে ঘরের সাথে লাগোয়া বারান্দায় চলে গেল। কৌতূহলবশত আমিও দাঁড়াতে না পেরে ছুটে গেলাম তার পিছুপিছু। আমায় দেখে সে কাঁধ থেকে ব্যাগ নামিয়ে মেঝেতে ছুঁড়ে ফেলল। ক্রুর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বিড়বিড় করে বলে উঠল,
— দিলাম কিন্তু পাখি উড়িয়ে।
আমি কোনো রা করলাম না৷ চুপচাপ তার দিকে তাকিয়ে থাকলাম। আমায় একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে সে ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে ঠিকঠিক খাঁচা খুলে পাখিগুলোকে মুক্ত করে দিলো। একে একে চারটা পাখি ছাড়া পেয়ে ব্যালকনিতে একবার পাক খেয়ে ছোট্ট গ্রীল দিয়ে বেরিয়ে গেল আমাদের চোখের সামনে। ইনতিসার আমার চোখে চোখ রেখে দাঁত কিড়মিড় করে বলল,
— খুশি?
ওর বাচ্চাদের মতো কাজকারবারে আমার হাসি পেয়ে গেল। বহুকষ্টে হাসি চেপে মাথা নেড়ে বললাম,
— খুউব৷
জবাবে ইনতিসার কিছু বলল না কেবল খাঁচাটা ছুঁড়ে মারল মেঝেতে৷ নিস্তব্ধ রাতে লোহার খাঁচা মোজাইকের মেঝেতে পড়ার শব্দ কি ভয়ানক শোনালো কানে, বোঝানোর মতো নয়৷ কি আশ্চর্য রাত বিরেতে এসব পাগলামির কোনো মানে আছে! আপা পাশের ঘরেই ঘুমানো। সে জেগে গেলে কি হবে?
রাগ লাগল আমার৷ গম্ভীরভাবে বললাম,
— নিজের ঘরে যান ইনতিসার।
— তোমার এখানে থাকার কোনো শখ আমার নেই।
ঠান্ডা দৃষ্টি নিক্ষেপ করে চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো সে। এক কদমও গিয়েছে ঠিক সেই মুহুর্তে হঠাৎ বিদ্যুৎ চলে গেল। রাস্তায় হ্যালোজেন বাতিও জ্বালানো ছিল না ফলে মুহুর্তে চারপাশ অন্ধকারে ডুবে গেল। আকাশও খারাপ করছিল বহুক্ষণ। থেকে থেকে ডাকাডাকি করছিল, বাতাস উঠছিল। বুঝতে পারিনি এই অসময়ে বিদ্যুৎ চলে যাবে। আশেপাশে তাকালে অন্ধকার ছাড়া কিচ্ছু নজরে আসছিল না। ভয়ে ভেতর কাঁপতে লাগল আমার। ইনতিসার কি অন্ধকারের মধ্যেই চলে গেছে? মৃদু করুন স্বরে আমি ডাকলাম,
— ইনতিসার আছেন?
ওপাশ থেকে কোনো জবাব এলো না৷ আমি আবারও ডাকলাম তার নাম ধরে। উঁহু কোনো উত্তর নেই। এই এতবড় ব্যালকনিতে মাঝরাত্তিরে আমি একা একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে ভাবতেই গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল আমার৷ দোয়া দরুদ যা মনে ছিল আওড়াতে আওড়াতে ঘরের ভেতরে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালাম৷ সাথেসাথে ওপাশ থেকে ভারী স্বর ভেসে এলো,
— সাবধানে।
অকস্মাৎ পুরুষালী স্বরে বিচলিত হয়ে আমি মৃদু স্বরে চিৎকার করে দাঁড়িয়ে পড়লাম।
— এ্যাই মেয়ে চিল্লাফাল্লা করছো কেন?
আবারও হুংকার ভেসে এলো ওপাশ থেকে। আমি বুঝতে পারলাম ইনতিসার এখনও যায়নি। কত্তবড় বদ/মাশ তখন ডাকলাম জবাবই দিলো না।
দাঁতে দাঁত চেপে বললাম,
— আপনি এখানেই ছিলেন জবাব দিলেন না কেন তখন?
— আমার ইচ্ছে।
সংক্ষেপে উত্তর। তার এমন বাঁকা বাঁকা কথা শুনে আমার গায়ের রক্ত টগবগ করতে লাগল। মনে মনে দুটো গালি দিয়ে আমি এগোতে চাইলাম তার দিকে। কিন্তু নীচে যে তার ফেলে রাখা ব্যাগটা আছে মনেই ছিল না। ফলাফল, দ্রুত হাঁটতে গিয়ে ঐ ব্যাগে পা জড়িয়ে একদম উপুড় হয়ে পড়ে যাচ্ছিলাম মেঝেতে। আমার সামনে দাঁড়ানো ভদ্রলোক এমনকিছু আন্দাজ করেছিল বোধহয়। সেও এগিয়ে এসেছিল। এরপর তাকে নিয়েই দুম করে পড়লাম। লম্বু ছেলের চিবুক এত শক্ত! ঠাস করে আমার মুখে এসে লাগল। ব্যথায় ভয়ানক চিৎকার করে উঠলাম আমি। সে চমকে উঠে সাথে সাথে আমার মুখ চেপে ধরলো। জড়ানো গলায় মৃদু ধমকের সাথে বলল,
— মাথা খারাপ নাকি? বারবার চেঁচাচ্ছ কেন পাগল।
রাগে আমার চোখে পানি চলে এলো। দাঁতে দাঁত চেপে বলতে চাইলাম,
–নিজের মুখে এমন ব্যথা পেলে বুঝতি।
কিন্তু বলা হলো না মুখে হাত থাকায়৷
বাইরে ঝিরিঝিরি বাতাস বইতে শুরু করেছে। ওপাশের ঘর থেকে আপা আমার নাম ধরে ডাকছে। নিশ্চয়ই তার কিছু প্রয়োজন। তড়িঘড়ি করে মুখ থেকে ইনতিসারের হাতটা সরিয়ে দিলাম আমি। ব্যস্ত হয়ে বললাম,
— ফোন কই আপনার? দেখি আলো জ্বালান তো।
সে চাপা স্বরে বলল,
— ফোন কই আছে মনে নেই। এভাবেই যাও তুমি।
— এভাবে কীভাবে যাব? অন্ধকারে কিছু দেখতে পাচ্ছি নাকি!
— তাহলে আমার গায়ের ওপর থেকে ওঠো। পকেট চেক করতে হবে।
— আপনি আমার কোমর জড়িয়ে ধরে আছেন কেন? উঠব কীভাবে আমি?
— ইন্টেনশনালি ধরিনি। পড়ে যাচ্ছিলে তাই…
— ঠিকাছে বুঝতে পেরেছি।
মুখ বাঁকিয়ে সরে গেলাম আমি৷ সরে যাওয়ার সময় স্পষ্ট কানে এলো তার স্বগতোক্তি,
“লোকে দেখলে তো বলবে শরীরে ওজনই নেই৷ তুলোর বস্তা। কিন্তু সত্যিটা হলো হাজার টনের চালের বস্তা এই মেয়ে। এত ভারী উফফ! আর একটু হলেই আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল। ডা/কা/ত কোথাকার।”
এতবড় কথা! এই মুহুর্তে চাইলেই আমি এর প্রতিবাদ করতে পারতাম। কিন্তু সময় স্বল্পতা। ওদিকে আপা ডেকেই যাচ্ছে। কোনোরকমে জবাব দিয়ে ইনতিসারকে তাড়া দিলাম ফোন বের করার জন্য। ও ফোন বের করতে করতে বিদ্যুৎ চলে এলো। এরপর কালক্ষেপণ না করে চটজলদি উঠে আপার ঘরের দিকে চলে গেলাম আমি।
__________________
৫৮.
গিয়ে দেখি বিছানায় শুয়ে ছটফট করছে আপা। অনর্গল চোখ দিয়ে পানি পড়ছে ওর। ভয়ে অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল আমার। ছুটে ওর পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। আপা আমার দিকে হাত বাড়িয়ে ক্রন্দনরত গলায় বলল,
— ব্যথায় ম/রে যাচ্ছি আমি নীরদ। আমাকে বাঁচা।
আপাকে অস্থির হতে দেখে আমি চিল্লিয়ে ইনতিসারকে ডাকলাম। একবার ডাকতেই সেও ছুটে এলো। আপাকে ছটফট করতে দেখে মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেল তার। ফোনে কারোর নাম্বার ডায়াল করতে করতে আমাকে উদ্দেশ্য করে বলল,
— নীরদ চট করে আমার জন্য একগ্লাস লেবুর শরবত নিয়ে এসো তো। কিছুই স্পষ্ট দেখতে পারছি না আমি।
— যাচ্ছি কিন্তু আপার কি হয়েছে?
ভয়ার্ত গলায় শুধালাম আমি।
— শুনবে। আগে যাও।
সময় নষ্ট না করে ছুটে বেরিয়ে গেলাম আমি। কোনোরকমে লেবুপানি বানিয়ে ফিরে এসে দেখি অস্থিরচিত্তে আপার ঔষধের বক্সে কিছু খুঁজছে ইনতিসার আর বারবার আপাকে উদ্দেশ্য করে বলছে,
— ঔষধ শেষ হয়ে গেছে আমাকে বলবে না ভাবি? এখন কি করব আমি! ডক্টর ফোন তুলছে না।
আপা তো কোনো কথাই বলতে পারছে না অনবরত কেঁদেই যাচ্ছে শুধু৷ এদিকে আমিও কিছুই বুঝতে পারছি না। বোকার মতো একবার আপাকে, একবার ইনতিসারকে জিজ্ঞেস করছি কি হয়েছে। কিন্তু কেউই আমার কথার সঠিক জবাব দিচ্ছে না৷ এক পর্যায়ে ইনতিসার ঔষধের বক্সটা ফেলে লেবুপানির গ্লাস টেনে নিয়ে এক চুমুকে শেষ করে বলল,
— আমি যানবাহনের ব্যবস্থা করছি নীরদ। ভাবিকে হসপিটালে নিতে হবে দ্রুত। তুমি একটু তার কাপড়টা পাল্টে দিয়ে তৈরি হও।
এতটুকু বলে ছুটে বেরিয়ে গেল সে। ওদিকে আমাদের চিৎকার চেঁচামেচিতে ইঊশা উঠে গেছে। মায়ের যন্ত্রণা দেখে সে শুকনো মুখে জড়সড়ভাবে বসে আছে পাশে।
আমি ওর ভয়টা আন্দাজ করে বড় করে শ্বাস নিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করলাম। বাচ্চাটাকে সাহস দিতে হবে। আমার এই মুহুর্তে স্ট্রং থাকা চাই। সস্নেহে ওর মাথায় হাত রেখে বললাম,
— চিন্তা করে না মাফিন। চাচ্চু, খালামনি দু’জনেই আছি পাশে। কিচ্ছু হবে না আপার। তুমি শুধু প্রে করো মায়ের জন্য ঠিকাছে?
আমার কথা শুনে ইঊশা মুখ তুলে চাইলো। তারপর আস্তে করে বিছানা থেকে নেমে বাইরে চলে গেল। ওর গমন পথে তাকিয়ে আমি দীর্ঘশ্বাস গোপন করলাম।
আপাকে তৈরি করাতে করাতে ইনতিসার এসে হাজির। আমায় ইঊশাকে সাথে করে নিয়ে যেতে বলে সে আপাকে ধরে দ্রুত পায়ে নীচে নেমে গেল।
আমি প্রয়োজনীয় সবকিছু গুছিয়ে ইঊশার কাছে গেলাম। দেখলাম চেয়ারে বসে মাথানিচু করে ও কাঁদছে। আলতো করে ওর হাত চেপে ধরলাম। বললাম,
— দেখি বাবা চোখ মোছো তো। এখন কান্নাকাটির সময় নয়৷ তুমি তো স্ট্রং ছেলে। মায়ের পাশে থাকতে হবে তাই না?
ও উঠে দাঁড়িয়ে ঝটকা মেরে আমার হাত সরিয়ে দিলো। রাগে চিৎকার করে বলে উঠল,
— ছোঁবে না তুমি আমাকে। এসবকিছু তোমার জন্য হয়েছে। তোমার জন্য আমার বাবা ম/রে গেছে। আর আজ মায়েরও….
তুমি খারাপ। তুমি আমার খালামনি নও। কেউ নও তুমি আমার। আই হেইট ইউ। আই জাস্ট হেইট ইউ।
চোখ মুছতে মুছতে ছুটে বেরিয়ে গেল ইঊশা। আমি চলনশক্তি হারিয়ে নির্বাক মূর্তিমান দাঁড়িয়ে রইলাম ওখানে। এই মাত্র কি বলে গেল বাচ্চাটা? ওর বাবা আর নেই! আপার এই অবস্থার জন্যও আমি দায়ী? মাথা ঘুরতে শুরু করলো আমার। সব যেন ঝাপ্সা দেখছি। পড়তে পড়তে দেয়াল ধরে নিজেকে সামলালাম। নীচ থেকে ইনতিসার ডাকছে। কাঁধের ব্যাগটা শক্ত করে চেপে ধরে ধীরপায়ে এগিয়ে গেলাম সদর দরজার দিকে। আপা তো সবটা বলেনি আমাকে। কিন্তু এখন আমার সব জানা চাই। আপা শুধু সুস্থ হয়ে নিক। ও না বললেও ইনতিসারকে বলতেই হবে। বলতেই হবে আর কি কি হয়েছে ওদের সাথে ওই চার বছরে।

চলবে,
Sinin Tasnim Sara

ভালোবাসার রংধনু
৩২
_________________
৫৯.
ঘড়িতে সময় ঠিক সাড়ে ছয়টা। বাইরে তুমুল বজ্রপাতের সাথে বৃষ্টি। হসপিটালের করিডোরে রাখা ভিজিটর সিটে বসে আমি চুপচাপ বৃষ্টি দেখছি। পাশে ইনতিসার আমার কাঁধে মাথা রেখে ঘুমোচ্ছে। বেশিক্ষণ নয় ঘণ্টা দেড়েক হবে আমরা এভাবে বসা। চেয়েও আমি ইনতিসারকে সরাতে পারছি না। সেই মধ্যরাত থেকে দেড় ঘণ্টা আগে অবধি ওর অমানুষিক পরিশ্রম নিজ চোখে দেখার পর আমার বিবেকে বাঁধছে। থাকুক এভাবে কিছুক্ষণ। রেস্ট নিক। কে কি ভাবছে তাতে নাহয় নাইবা খেয়াল করলাম।
আপাতত আমি আমার মনোযোগটা বাঁধভাঙা শ্রাবণধারার দিকে নিয়ে যেতে চাইছি। একটুখানি স্বস্তি দরকার আমার ভেতরে। কতগুলো দুঃসংবাদ প্রতি মুহুর্ত যেভাবে নিউরনে আঘাত করছে, এটা তো নিতে পারছি না আমি। আমার আপা, পৃথিবীতে আমার একমাত্র অভিভাবক, সে আমাদের মাঝে আর কয়েকদিনের অতিথি মাত্র। কথাটা আমি একদমই মানতে পারছি না। ইনতিসার বলেছিল অবশ্য সেই রাতে। যা শুনেই মূলত দ্বিতীয়বার আমার ফিরে আসা।
আপাকে এতদিন সুস্থ দেখে ভেবেছিলাম আমায় ফিরিয়ে আনার জন্য বোধহয় ইনতিসার মিথ্যে বলেছিল। কিন্তু নাহ্। মিথ্যে তো সে বলেনি। দুর্ভাগ্যবশত সত্যই বলেছে।
আপার বোন ক্যান্সার। ক্যান্সারটা মেটাস্ট্যাটিস স্টেজে ধরা পড়েছিল । চিকিৎসা দিয়ে এখন আর সুস্থ করা সম্ভব নয়। প্রত্যেকটা ঘণ্টা, প্রত্যেকটা মিনিট অতিবাহিত হচ্ছে আর অল্প অল্প করে সে মৃ/ত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। গতকাল গাড়িটা যখন এসে হসপিটালের সামনে থামলো, প্রবেশমুখে গোটা অক্ষরে “জাতীয় ক্যান্সার হাসপাতাল” লেখাটা দেখে আমার সমস্ত শরীর কেঁপে উঠেছিল। হতবাক হয়ে আমি বারবার যন্ত্রণায় ছটফট করতে থাকা আপার দিকে আর ইনতিসারের দিকে তাকাচ্ছিলাম। বিশ্বাসই হচ্ছিল না এরকম কোনো রোগে আপা আক্রান্ত হতে পারে। সব থেরাপিগুলো চোখে দেখার পরও বিশ্বাস হচ্ছে না। সবকিছু দুঃস্বপ্ন মনে হচ্ছে আমার কাছে। আমি খুব করে চাইছি যত দ্রুত সম্ভব এই দুঃস্বপ্নটা কেটে যাক। আচ্ছা কি করলে এই দুঃস্বপ্ন কাটবে?
— বৃষ্টি কমলে তুমি বরং বাসায় চলে যেও নীরদ৷ সারারাত তো দুচোখের পাতা এক করোনি। ইঊশারও এই মুহুর্তে হসপিটালে থাকা উচিৎ নয়। কদিন বাদেই ওর পরীক্ষা।
কাঁধে মাথা রেখেই ঘুম জড়ানো গলায় বলল ইনতিসার। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আমি বললাম,
— এ বৃষ্টি এখন থামার নয়৷
কি মনে করে ইনতিসার উঠে সোজা হয়ে বসল৷ জিজ্ঞেস করলো,
— নীরদ গতকাল হসপিটালে আসার সময় ইঊশা কি তোমাকে কিছু বলেছে?
আমি ওর দিকে ঘুরে তাকালাম৷ ধীর গলায় বললাম,
— বলেছে ওর বাবার মৃ/ত্যুর জন্য আমি দায়ী৷ ওর মায়েরও এমন অবস্থা হয়েছে আমার জন্য।
ইনতিসার আমার কথা শুনে কপাল চাপড়ে চ-কারান্ত একটা শব্দ বের করে মুখ নামিয়ে নিলো। দু’হাতে নিজের চুলগুলো খামচে ধরে বড় করে শ্বাস ফেলে আবারও সোজা হয়ে বসে বলল,
— ওর মাথায় এসব ঢুকিয়েছে মেজো ভাই। বাস্টা/র্ডটা ম/রার আগে অবধি বিষোদগার করেই গেছে।
— আমি সবটা শুনতে চাই ইনতিসার। কি হয়েছিল আমার চলে যাওয়ার পর। প্লিজ আমাকে বলুন? আই বেগ অফ ইউ৷
হাতজোড় করে অনুনয় করলাম আমি। সে আমার দিকে চুপচাপ কতক্ষণ তাকিয়ে থাকলো। তারপর শান্ত গলায় বলে উঠল,
— তুমি চলে যাওয়ার পর ঠিক কি কি হয়েছে সঠিক বলতে পারব না আমি নীরদ৷ আমি তখন জে/লে ছিলাম।
— জে/লে ছিলেন!
বিস্ময়ে চোখ বড় বড় হয়ে গেল আমার। সে মাথা নেড়ে বলল,
— হ্যাঁ। ফিরে এসে শুধু একে একে মৃ/ত্যুর খেলা দেখেছি। আমার পরিবারের ধ্বংস দেখেছি ব্যাস৷
এতটুকু বলে আবারও চুপ হয়ে গেল ইনতিসার৷
আমি ভাবতে লাগলাম আর কত শকিং নিউজ শোনা বাকি আমার?
এরপর আরও বেশ কিছুটা সময় নীরবে বসেছিলাম আমরা পাশাপাশি। দুজনের হৃদয়ে বোধহয় রক্তক্ষরণ হচ্ছিল নীরবেই।
একসময় এই নীরবতা ভাঙল একটা পুরুষালি কণ্ঠস্বর। কেউ একজন ইনতিসারের নাম ধরে ডেকে উঠল হঠাৎ। আমরা দু’জনে একসঙ্গে তাকিয়ে দেখতে পেলাম গতরাতের ছেলেটা, যে তার গাড়ি দিয়ে আমাদের সাহায্য করেছিল। ছেলেটাকে দেখেই ইনতিসার হেসে দাঁড়িয়ে গেল৷ হাত মিলিয়ে মৃদু হেসে বলল,
— কোথায় ছিলি? কতক্ষণ থেকে অপেক্ষা করছি।
ওপাশ থেকে জবাব এলো,
— কাজ পড়ে গেছিল। তাই তোকে বলে যেতে পারিনি৷
— নো প্রবলেম।
— আচ্ছা তোরা ব্রেকফাস্ট করেছিস? না করে থাকলে করে নে৷ আম্মা খাবার পাঠিয়েছে তোদের জন্য।
হাতে ধরে রাখা খাবারের ব্যাগ উঁচিয়ে দেখালো ছেলেটা।
— এসব ওর কাছে দে। ও রাত থেকে না খাওয়া।
আমার দিকে ইশারা করে বলল ইনতিসার। ইনতিসারের দৃষ্টি অনুসরণ করে ছেলেটা আমায় দেখে আলতো হাসলো৷ কিছুটা এগিয়ে এসে বলল,
— নীরদ রাইট?
আমি মাথা নেড়ে হ্যাঁ বললাম। এই ছেলে আমাকে চেনে?
সে তার হাতে ধরে থাকা ব্যাগটা আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
— আমাকে চিনতে পারোনি রাইট?
আমি ব্যাগটা হাতে নিতে নিতে আবারও মাথা নাড়লাম।
— আমি তানজিম। ইনতিসারের বন্ধু। পাশেই আমার বাসা৷
— গতকাল আমাদের হেল্প করার জন্য অনেক ধন্যবাদ।
কৃতজ্ঞতার সাথে বললাম আমি। প্রতুত্তরে তানজিম নামক ছেলেটি মৃদু হেসে বলল,
— ধন্যবাদ দিতে হবে না। এটা আমার দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে।

এরপর ইনতিসারের সাথে আমার আর কথা হলো না। ফ্রেশ হয়ে সে ডাক্তারের সাথে কথা বলতে চলে গেল৷ সেখান থেকে ফিরে দুটো খেয়ে বৃষ্টি মাথায় নিয়েই অফিসে বেরিয়ে গেল। ওর বন্ধুর কাছে জানতে পারলাম একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে লজিস্টিকস অফিসার হিসেবে কাজ করছে দুবছর যাবৎ। লজিস্টিক অফিসারের স্যালারি সম্পর্কে মোটামুটি ধারণা আমার আছে। আমি জানি ফুলটাইম চাকরি হলেও ঐ স্যালারি দিয়ে এতটা চলা যায় না। নিশ্চয়ই অ্যাডিশনাল আরও কিছুর সাথে যুক্ত আছে। প্রথমে তানজিম ভাই বলতে চাইছিলেন না। একটু জোর করায় শেষে বললেন হ্যাঁ সে আরও কাজের সাথে যুক্ত ইনতিসার । কিন্তু কাজটা কি সেটা আর বললেন না৷ আমিও জোর করলাম না৷ সকলের একটা প্রাইভেসি থাকে। যেটা ভাঙা উচিৎ নয়।
___________________
৬০.
ইনতিসার চলে যাওয়ার খানিক পর ইশি আপু তার হাসবেন্ডসহ এলো হসপিটালে। আমি একটু দূরে দূরেই সরে থাকলাম। সামনে পেলে কি না কি বলে! আপা তখন ঔষধের প্রতিক্রিয়ায় ঘুমোচ্ছে। ইঊশাও ঘুমোচ্ছিল। ইশি আপুরা আসার পর উঠে গেল। আমি ভাবলাম ওকে ফ্রেশ করিয়ে খাইয়ে দিই৷ ভাবনানুযায়ী ওর কাছে গেলাম। ওকে ডাকব, কিন্তু তার আগেই ও চিল্লিয়ে উঠল আমার ওপর। কেন এখন পর্যন্ত এখানে আছি প্রশ্ন করল। কেবিনের ভেতর আপা একদিকে ঘুমোচ্ছে, অন্যদিকে ইশি আপুর হাসবেন্ড দাঁড়িয়ে। সকলের সামনে ইঊশার এরকম ব্যবহার মেনে নিতে পারলাম না আমি। রাগ জন্মালো ঠিক ভেতরে, কিন্তু নিজেকে কন্ট্রোল করে বাইরে বেরিয়ে যেতে উদ্যত হলাম। সেই মুহুর্তে অপ্রত্যাশিতভাবে চাপা কণ্ঠে ইশি আপু ডেকে উঠল,
— দাঁড়াও। কোত্থাও যাবে না তুমি।
তার কথায় দাঁড়িয়ে পড়লে সে ইঊশার হাত ধরে আমার সামনে নিয়ে এসে কড়া স্বরে ওকে বলল,
— বড়দের সাথে এসব কেমন ব্যবহার করছিস তুই? স্যরি বল। এক্ষুনি স্যরি বল তোর খালামনিকে।
আমি বাঁধা দিতে চাইলাম ইশি আপুকে। ফলে আমার দিকে তাকিয়েও চোখ রাঙানি দিলো সে। ওদিকে ইঊশা মাথা নীচু করে ফুঁপিয়ে উঠল। বলতে লাগল,
— কেন স্যরি বলব আমি? এসবকিছু ওর জন্য হচ্ছে। ও ভালো না।
— তুই বেশি জানিস? কে তোকে বলেছে এসব? এতটুকু বাচ্চা হয়ে এতবড় কথা কোথায় শিখেছিস তুই ইঊশা।
ইশি আপুর গলায় রাগের সাথে বিস্ময়ভাব ফুটে উঠল।
ফুপির রাগ দেখে ইঊশা মাথাটা আরও নীচু করে ফেলল। বিড়বিড় করে বলল,
— আমি জানি। বাবা বলেছিল আমাকে।
— মেজো ভাই!
বিস্ময়ে কথা বলতেই যেন ভুলে গেল ইশি আপু।
পাশে থেকে ওনার হাসবেন্ড এগিয়ে এলেন এবার৷ ইঊশাকে টেনে নিতে নিতে নরম গলায় বললেন,
— আহ্ ইশিতা। এটা হসপিটাল। এখানে এসব না করলেই নয়?
ওনার কথায় আপু স্বাভাবিক হলো। কিন্তু ইঊশার হাত ছাড়ল না৷ ওকে বাধ্য করলো স্যরি বলতে৷
আমি আর দাঁড়ালাম না। পুনরায় করিডোরে দিকে চলে গেলাম। আপার জ্ঞান না ফেরা পর্যন্ত ওখানেই বসে থাকার সিদ্ধান্ত নিলাম।

কিছুটা সময় অতিবাহিত হলো ওভাবেই বসে বসে৷ একসময় ইশি আপু আমার পাশে এসে বসলো। তার উপস্থিতি অনুভব করে আমি উঠে যেতে চাইছিলাম। তন্মধ্যে হঠাৎ তার কথা শুনে থেমে গেলাম।
— মেয়ে তুমি এসেছিলে কেন আমাদের জীবনে? এসেছিলেই যখন তারপর হুট করে হারিয়ে গেলে কেন? তুমি কি জানো তোমার হারিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে আমার ভাইয়ের জীবনের সমস্ত রঙও হারিয়ে গেছে।
আমি প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে ইশি আপুর পানে চাইলাম। সেও মুখ ফিরিয়ে আমার দিকে তাকালো৷ মিনিটখানেক তাকিয়ে থাকলো। এরপর কিছু না বলে, না শুনে উঠে চলে গেল।
আমি বোকার মতো তার গমন পথে তাকিয়ে অনুধাবন করার চেষ্টা করলাম তার কথাটা।
___________________
৬১.
দুপুরের একটু পরে জ্ঞান ফিরলো আপার। ইশি আপুরা ওর সাথে দেখা করে ইঊশাকে নিয়ে চলে গেল। আমি একা রইলাম আপার কাছে। এর মাঝে ইনতিসার তানজিম ভাইয়ের দ্বারা ফোন পাঠালো আমার কাছে। কিছুক্ষণ পরপর কল করছিল আর আপডেট নিচ্ছিল।
থেরাপি নেয়ার পর আপা বেশ দুর্বল হয়ে গেছিল। কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে ওর চেহারা কেমন ফ্যাকাশে হয়ে গেল।চোখমুখ শুকিয়ে যা-তা অবস্থা। আমি আপার পাশে বসে ধীরগলায় গল্প করছিলাম ওর সাথে। আমাদের শৈশবের স্মৃতি রোমন্থন করে ওর মনটা ভালো করার চেষ্টা করছিলাম। কথা বলতে বলতে ও সত্যি সত্যি প্রফুল্ল হয়ে গেল। একসময় নিজেই ওর ছোটোবেলাকার গল্প শোনাতে লাগল। গল্পের এক পর্যায়ে আমি জিজ্ঞেস করলাম,
— তোমার যে এতবড় অসুখ করেছে আমাকে জানাওনি আপা। একটাবার জানালে কি হতো?
— তোকে যে জানাব৷ খুঁজে পেতাম কোথায়?
— আমি জানি আপা তোমরা টাইম টু টাইম আমার খবর রাখতে৷
আমার কথা শুনে আপা হাসলো৷ কি যেন চিন্তা করে বলল,
— আমার হাতে সময় অনেক কম নীরদ৷ জানি না কতদিন আর আছি তোদের মাঝে। তবে আজ একটা অনুরোধ করবো তোকে। আমার ছেলেটাকে তুই দেখে রাখিস নীরদ৷ ওকে মায়ের আদরে বড় করিস৷ ওকে ওর বাবার মতো অমানুষ হতে দিস না৷ কথা দে আমার ছেলের দায়িত্ব তুই নিবি?
আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিলো আপা।
আমি দু’হাতের মুঠোয় ওর হাতটা আগলে ধরে বললাম,
— কথা দিলাম আপা। নিজের সবটা দিয়ে আগলে রাখব ওকে। ওর মা হয়ে উঠব আমি।
আপা মৃদু হাসলো।
বললাম তো ইঊশার মা হয়ে উঠব কিন্তু আমি ধারণাও করতে পারছি না কাজটা কতখানি কঠিন হতে পারে।
— আমি আজ খুব খুশি নীরদ৷ আমার জীবনে আর কোনো অপ্রাপ্তি নেই। এই স্বল্প সময়ের জীবনে আমি একটা বিরাট বড় কাজ করেছি। কি করেছি জানতে চাস?
আমি প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে চাইলাম৷ মুখের হাসি বজায় রেখে আপা বলল,
— এক নরপিশাচকে ওর প্রাপ্য শাস্তিটা দিয়েছি। যে একদিন আমার জীবনটাকে পৃথিবীর বুকে নরকসম করে তুলেছিল, আমার বেঁচে থাকা দুঃসহনীয় করে দিয়েছিল, আমার মেয়েসম বোনের গায়ে ওর নোংরা হাতগুলো দিয়ে স্পর্শ করেছিল। ওই জানোয়ারটাকে একদিন আমি নিজ হাতে শাস্তি দিতে পেরেছি। এই মুহুর্তে জীবনের সবচাইতে বড় প্রাপ্তি আমার এটাই।
— আপা..
— নীরদ কখনো তরল নাইট্রোজেন দেখেছিস?
খুব আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইলো আপা। আমি দুদিকে মাথা নেড়ে না বোঝালাম৷
ওর চোখজোড়া চকচক করছে। বিজ্ঞের মতো বলে উঠল,
— আমি দেখেছি। একদম পানির মতো টলটলে৷ পানি আর নাইট্রোজেন পাশাপাশি রাখলে তুই চিনতেই পারবি না কোনটা কি।
— তুমি কি নাইট্রোজেন দিয়ে দুলাভাইকে….
আমি কথা সম্পূর্ণ করলাম না। আপার হাসি গাঢ় হলো।
— আমাকে মা/রার জন্য নিয়ে এসেছিল। কিন্তু তার আগেই ওর পরিকল্পনা জেনে গেছিলাম আমি। কি অদ্ভুত না? মা/রার অস্ত্র এক, পরিকল্পনাও এক শুধু মৃ/ত্যুটা অন্য কারো। প্রচলিত একটা কথা আছে না? “অন্যের জন্য গর্ত খুঁড়লে নিজেকেই পড়তে হয়”
দেখ কথাটা সত্যি হলো।
— কীভাবে করলে এটা আপা?
— বেশি কষ্ট করতে হয়নি রে আমাকে। অস্ত্র তো ও এনেই রেখেছিল। আমি শুধু কোনো এক বাহানায় ওর শরীরে ছুঁইয়ে দিয়েছি ব্যাস। বুঝতেও পারেনি।
— এতবড় অপরাধ কেন করলে তুমি?
— অপরাধ! কোনো অপরাধ নয় নীরদ৷ এটাই প্রাপ্য ছিল ওর। আমি ছাড়া এত যন্ত্রণাদায়ক মৃ/ত্যু কেউ দিতে পারতো না ঐ নরপিশাচটাকে। কি করতে বাকি রেখেছিল ও বলতে পারিস? আমাদের জীবনটা তো নরক বানিয়েই ছেড়েছিল। ওদিকে ওর আপন ভাই ইনতিসার৷ ওর সাথেও তো অন্যায় করেছিল। মিথ্যে কেসে ফাঁসিয়ে জে/লে পাঠিয়েছিল ওকে। শুধুমাত্র ওর এই গর্হিত কাজের জন্যই আম্মা স্ট্রোক করে মা/রা গেলেন। আমরা একা হয়ে গেলাম।
চোখমুখে ঘৃণা ফুটিয়ে আপা বলল।
— এহতেশামের অপরাধের আসলে কোনো শেষ নেই নীরদ। এত বেশি অপরাধ ও করে ফেলেছিল! আমি আটকাতে পারিনি নিজেকে। অনেক অন্যায় তো সহ্য করেছি। সময় যখন এলো অন্যায়কে সমূলে বিনাশ করার, তখন পিছ পা হবো কেন?
— কেউ কি জানে তুমিই দুলাভাইকে…
ভীত তটস্থ হয়ে জিজ্ঞেস করলাম আমি। আপা আমার মুখের দিকে তাকালো।
— ভয় পাচ্ছিস? ভয়ের কিছু নেই। কেউই জানে না। এহতেশামের মৃ/ত্যুর কারণ শুধু ও একাই জানতো। কাউকে জানানোর সুযোগ পায়নি। তার আগেই…
শব্দ করে হাসতে লাগল আপা। একমনে হাসতে হাসতে কখন ওর চোখ দিয়ে ঝরঝর করে পানি পড়তে শুরু করেছে বুঝতে পারল না। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখতে লাগলাম আপাকে। ভালোবাসা খুব অদ্ভুত জিনিস না? সহজ-সরল মানুষের মনটাকে কখন কঠিন পাথরে পরিণত করে দেয় কেউ বলতেই পারে না। আমার আপা। নরম সরম নিরীহ। তার কখনো এই পর্যায়ে আসার কথা ছিল? সে কি স্বপ্নেও কল্পনা করেছিল যাকে জীবনের সর্বস্বটা দিয়ে ভালোবাসে, সেই ভালোবাসার মানুষটাকে কখনো নিজ হাতে খু/ন করতে হবে?
চলবে,
Sinin Tasnim Sara

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here