ভালোবাসার রংধনু
৩৯
______________________
৭৫.
চেতনা যখন ফিরল তখন প্রকৃতি ভীষণ নিস্তব্ধ৷ ঘরে জ্বেলে দেয়া মৃদু আলোয় পুরো ঘরময় একবার চোখ বোলাতেই বুঝতে পারলাম আমাদের সেই ছোট্টো ঘরটায় শুয়ে আছি আমি। ইনতিসার আমার পাশে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসা। চোখজোড়া বন্ধ। ঘুমুচ্ছে নাকি জেগে বুঝতে পারলাম না। ওর থেকে চোখ সরিয়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকালাম। একটা কামিনী গাছ আছে বাড়িটার পাশে। গাছটার পাতাগুলো মৃদু বাতাসে দোল খাচ্ছে আর কি সুন্দর একটা শব্দ করছে। কামিনী ফুল তো খুব কমনীয় অল্প বাতাসেই ঝরে পড়ছে। সকালের কথা মনে পড়ছে আমার। হৃদপিণ্ডে কেউ জোর হাতে খোঁচাচ্ছে মনে হচ্ছে। কি অদ্ভুত এক জ্বালা বুক জুড়ে! আপনজন হারানোর শোক বুঝি এমনই হয়।
নিঃশব্দে কাঁদতে কাঁদতে দাঁতে ঠোঁট কামড়ে বুকের বা পাশে হাত রাখলাম আমি। রাখতেই হাতের পিঠে খুব জোর একটা আঘাত লাগল। সূঁচালো আঘাত। না চাইতেও মুখ দিয়ে মৃদু যন্ত্রণাসূচক শব্দ বেরিয়ে গেল। চোখ মেলে দেখলাম সার্জিক্যাল টেপ দিয়ে ছোট্টো একটা সূূঁচ হাতে আটকে দেয়া। স্যালাইন চলছে আমার। তখন এতখানি অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম যে স্যালাইন লেগেছে!
— উঠে পড়েছ সোনা? কোনো কষ্ট হচ্ছে কি?
মাথায় ইনতিসারের কোমল স্পর্শে ধ্যান ভাঙলো আমার। ওর দিকে তাকিয়ে মাথা দুদিকে নেড়ে না বোধক উত্তর দিলাম। চেয়ার থেকে উঠে এসে স্যালাইন চেক করলো ও। প্রায় শেষের দিকে দেখে আস্তে করে সূঁচটা খুলে দিলো হাত থেকে। তারপর সবটা গুছিয়ে প্যাকেটে পুরে সরিয়ে রেখে আবারও আমার পাশে এসে বসলো। আমি সরে গিয়ে ওর কোলে মাথা রাখলাম। চুলে আঙুল ডুবিয়ে ও ক্ষীণ গলায় বলল,
— এভাবে ভেঙে পড়লে চলবে? ভাবি কতবড় দায়িত্ব দিয়ে গেছেন আমাদের মনে আছে? তুমি যদি এরকম করো তাহলে ইঊশার কি অবস্থা হবে?
— এতবড় দায়িত্ব আমি ঠিকমতো পালন করতে পারব তো?
— অবশ্যই পারবে। আমি আছি তো পাশে। দু’জন মিলে সবটা সামলে নেবো। পারতে তো আমাদের হবেই।
— আমার মতো ওর ভাগ্য হোক একমনটা আমি চাই না।
— বেশি ভেবো না নীরদ৷ এভাবে ভেঙে পড়ো না৷
— আপার কথা খুব মনে পড়ছে। অসহায় লাগছে।
দু চোখ ছাপিয়ে অশ্রু নামল আবার। ইনতিসার টেনে ওর মুখোমুখি বসালো। চোখের পানি মুছে দিয়ে আমার একটা হাত ওর দুহাতের মুঠোয় নিয়ে হাতের পিঠে চুমু খেয়ে নরম গলায় বলল,
— নীরদ চোখের সামনে আপনজনের মৃত্যু তো আমিও দেখেছি। আমার মায়ের মৃত্যু দেখেছি। মা আমার জন্য কি ছিল তুমি ভালো করেই জানো৷ সেই মানুষটাকে যখন আমি নিজ চোখের সামনে একটু একটু করে নিঃশেষ হতে দেখলাম, সেই অনুভূতিটা কাউকে বোঝানোর মতো নয়৷ শুধু মনে হচ্ছিল আমার পুরো পৃথিবী তছনছ হয়ে গেছে। পায়ের নীচের মাটি সরে গেছে। মায়ের ঠান্ডা হাত চেপে ধরে কতক্ষণ বসে ছিলাম আমি।কেঁদেছি, খুব কেঁদেছি। তারপর মনে পড়েছে মা শেষ মুহুর্তে বলেছিল, “বাবা তোর কাঁধে এখন অনেক দায়িত্ব। দায়িত্ব থেকে পালাসনে যেন। শুরুতে হয়তো কষ্ট হবে, গোছাতে গোছাতেই মনে হবে সব এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে তবুও ভেঙে পড়বি না। মনে রাখবি মায়ের দোয়া আছে মানে মা নিজেই তোর সাথে ছায়ার মতো আছে সবসময়।”
আমি বিশ্বাস করি মা আছে আমার সাথে৷ আমাকে দেখছে। আমি খুশী হলে সে খুশী হচ্ছে, আমি কষ্ট পেলে মায়েরও কষ্ট হচ্ছে। আমার ঐ বিশ্বাসটা না আমাকে প্রতিদিন শক্তি যোগায় নতুন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে। আজ থেকে তুমিও মা হয়েছ নীরদ। জানো তো সৃষ্টিকর্তা মায়েদের বানিয়েছেন রিপ্লেসমেন্ট হিসেবে। আমরা ভেঙে পড়ি, আমাদের অসহায় লাগে, ঠিক-ভুল বুঝতে পারি না। তখন সৃষ্টিকর্তা মাকে পাঠান আমাদের সকল দ্বিধাদ্বন্দ্ব দূর করতে। আমাদের ঢাল হয়ে পাশে দাঁড়াতে। তোমাকেও ইঊশার ঢাল হতে হবে। ওকে সামলানো শিখতে হবে। সামনে আরো কঠিন চ্যালেঞ্জ আসছে। আজ যত কাঁদার কেঁদে নাও। এরপর থেকে আর কোনো কান্না নয় নিজেকে কন্ট্রোল করতে শিখতে হবে।
— যদি কোনো ভুল করে ফেলি?
কাতর হয়ে ওর চোখের দিকে তাকালাম৷
— তোমার সব ভুল শুধরে দেয়ার জন্য আমি আছি তো।
আলতো হেসে আমার কপালে চুমু খেলো ইনতিসার। আমি দীর্ঘশ্বাস চেপে ওর কাঁধে মাথা এলিয়ে দিলাম৷ কয়েক ঘণ্টা পর সূর্যোদয় হবে। একটা নতুন দিনের আগমন। নতুন দিনে আবারও নতুনভাবে শুরু করতে হবে সব। আজ রাতটা পার হলে জীবন দ্বিতীয়বারের মতো আবারও পাল্টে যাবে বোধহয়৷
_______
প্রতিদিন একটু একটু করে নিজেকে সামলে নিলেও ইঊশাকে সামলাতে গিয়ে আমার সব সাহস হাওয়ায় উড়ে যেত। ডানপিটে ইঊশা খুব চুপচাপ হয়ে গেছিল। প্রয়োজন ছাড়া কথা বলে না, সবসময় উদাস থাকে। কখনো ছাদে বসে একা একা কাঁদে। লেখাপড়া, স্কুল, খেলাধুলা কোনোকিছুর ওপরেই ওর মন ছিল না৷ হাজার চেষ্টা করেও ওকে সহজ করতে পারছিলাম না আমরা। পরবর্তীতে ইনতিসার সিদ্ধান্ত নিলো ওকে সাইকিয়াট্রিস্ট দেখানো হবে। আমিও চিন্তাভাবনা করে সম্মতি দিলাম৷ নিয়মিত কাউন্সেলিং শুরু হলো। ডাক্তার সাজেস্ট করলেন জায়গা পাল্টাতে। আপা যেই ঘরটায় ছিল ওই ঘরটা দেখলেই ওর আপার কথা মনে পড়তো। নিজেকে সামলাতে সামলাতেই ভেঙে পড়তো আবার৷ ইঊশার মেন্টাল হেল্থের কথা চিন্তা করে পরবর্তীতে ইনতিসার চিন্তা করলো ভাড়া বাসায় না উঠে বরং নিজেদের বাসাতেই ওঠা যাক। যে বাসাটা ফিরে পাওয়ার জন্য অল্প অল্প করে পুঁজি যোগাড় করছিল সেটাই পরে ফিরিয়ে আনলো লোন করে। লোন তো ব্যাংকের কাছ থেকে পাওয়া যাচ্ছিল না। লোন দিলো এবার ওর বন্ধুরা। তুহিন ভাইও কিছু দিলো। বাসা ফিরে পেলে আমরা সময়ক্ষেপণ না করে দ্রুত উঠে গেলাম ওখানে। পুরোনো স্কুল ছাড়িয়ে ইঊশাকে নতুন স্কুলে ভর্তি করানো হলো। আমার পুরো সময়টা আমি ওর পেছনে খরচ করতে লাগলাম৷ আর ইনতিসার আগের চাকরিটা ছেড়ে নতুন চাকরি নেবার কথা ভাবছিল। দূরত্ব অনেক হয়ে যাচ্ছিল। জার্নিটাতেই অনেকটা সময় নষ্ট হচ্ছিল। কিন্তু নতুন চাকরি পাওয়া কি মুখের কথা? ওর বন্ধু একজন সাজেস্ট করলো তার কোম্পানিতে জয়েন করতে। ভালো একটা পোস্ট আছে। ওখানে জয়েন করে নাহয় উন্মুক্ততে আবারও বিবিএ কোর্সে ভর্তি হয়ে যাবে৷ যতটুকু পড়াশোনা ছেড়েছিল তা এখানে পুরো করে বিজনেস শুরু করবে। ততদিনে টাকাপয়সা হয়ে যাবে কিছু। কিন্তু ইনতিসার রাজি হলো না। ওর কথা দ্বিতীয়বার কারোর সামনে মাথা নোয়াবে না। সে যোগ্যতা ছাড়া বন্ধুর কোম্পানিতে কেন যাবে! এদিকে নিত্যদিনের খরচও তো কম লাগছিল না। বেশ টানাপোড়েনেই কাটছিল আমাদের। সব খরচ সামলে লোন পরিশোধ এসব নিয়ে খুব দুশ্চিন্তায় থাকতাম আমি। কিন্তু ইনতিসারের মধ্যে কোনো দুশ্চিন্তার বালাই নেই।
বরং আমাকে দুশ্চিন্তা করতে দেখে বলতো,
— তুমি তো এরকম ছিলে না নীরদ। আগে কত স্ট্রং ছিলে। গিভ আপ থটস কখনোই আসতো না তোমার মাঝে। এখন কি হয়েছে? এত দ্রুত গিভ আপ করে ফেলো কেন?
আমি উত্তর দিতে পারতাম না, পারি না। এই জীবনে এতকিছু সহ্য করার পর সহন শক্তিটা বাড়ার পরিবর্তে কেন যেন শূন্যের কোঠায় নেমে গেছে। এখন সবকিছুতেই গিভ আপ মাইন্ড চলে এসেছে। আমার ভেতর থেকে এখন শুধু একটা কথাই আসে “আরও খারাপ দেখা বাকি”
আমি বুঝতে পারতাম ইনতিসার নিজেকে যতখানি স্ট্রং দেখানোর চেষ্টা করছে ততখানি আসলে ও হতে পারছে না। সেও এতকিছু সামলাতে সামলাতে হাঁপিয়ে উঠছে। বাসে ঝুলে ঝুলে প্রতিদিন যাওয়া আসা, স্বল্প সময়ের ঘুম আর অমানুষিক পরিশ্রম করতে করতে তার ভেঙে যাওয়া চেহারা, চোখের নীচের কালসিটে দাগ আর ক্লান্ত মুখখানা দেখলেই সব আন্দাজ করে ফেলা যাচ্ছিল। মাঝেমধ্যে কান্না পেতো আমার। নিজেকে অযোগ্য মনে হতো। আমিও তো বোঝা হয়ে আছি ওর ওপর৷ পড়াশোনাটা যদি শেষ করতে পারতাম তাহলে আজ আমিও একটা চাকরি করতে পারতাম। পারতাম না? কিন্তু এখন এসব ভেবে কি হবে! পড়াশোনার প্রতি কোনো আগ্রহ অবশিষ্ট ছিল না আমার। আমি কূলই পাচ্ছিলাম না কোথা থেকে শুরু করলে কি হবে। আদৌ কিছু হবে কি না!
হতাশা, দীর্ঘশ্বাস নিত্যদিনের সঙ্গী হয়ে উঠেছিল আমার। ইনতিসার তবুও বোঝানোর চেষ্টা করতো সব ঠিক হয়ে যাবে। আমি দিশেহারা বোধ করতাম। কীভাবে ঠিক হবে? সব আমি আরও এলোমেলো হতে দেখছি। এত মানুষের জীবনে মিরাকল হয় আমাদের জীবনে কোনো মিরাকল কেন হয় না? একটা মিরাকল, আর এলোমেলো সব যদি ঠিক হয়ে যেত! প্রতিদিন আকাশের দিকে তাকিয়ে একবার করে ভাবতাম।
ভাবতে কখনো সত্যি কখনো মিরাকল ঘটবে এমনটা আমি স্বপ্নেও ভাবিনি৷
একবছর পরের ঘটনা৷ ইয়ার লস দিয়ে ইঊশাকে আবারও ফাইভে রাখা হয়েছিল। এবার সে সিক্সে উঠেছে। ওর অন্যান্য বন্ধুদের মায়েদের সাথে আলাপ-আলোচনা করে ক্যাডেট কোচিং-এ দিতে চাচ্ছিলাম। বাসার পাশে নামকরা একটা কোচিংও ছিল। সেদিন কোচিং এ প্রথম ক্লাস৷ সকাল সাড়ে সাতটা। খুব তাড়াহুড়ো করে আমরা মা ছেলে বেরুচ্ছি। ইনতিসার গেছে রিকশা ডেকে দিতে৷ রিকশা পেয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে ও আমাদের ফোন করে দিলো। প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নিয়ে আমরাও তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে গেলাম। রাস্তায় যেতে যেতে দেখি রিকশা দাঁড় করিয়ে একজন বৃদ্ধ লোকের সাথে কথা বলছে। লোকটাকে আমি চিনি না। কৌতূহল নিয়ে এগিয়ে যেতেই বৃদ্ধ ওকে ইশারা করে বললেন,
— এই তাহলে নাতবউ?
ও ফিরে তাকিয়ে হাস্যোজ্জ্বল মুখে মাথা নেড়ে বলল,
— ইয়েস। বুড়ো বলো তো আমাদের পাশাপাশি মানিয়েছে না?
বৃদ্ধ মুচকি হেসে বললেন,
— একদম মেইড ফর ইচ আদার৷
জবাবে ইনতিসারও হাসতে হাসতে হাতের ইশারায় আমাকে আর ইঊশাকে কাছে ডেকে নিলো। বৃদ্ধকে দেখিয়ে বলল,
— নীরদ, ইঊশা হি ইজ মাই গ্র্যান্ডপা’স বেস্ট ফ্রেন্ড। আমার আরেকজন দাদু।
আমি সালাম দিয়ে কুশলাদি বিনিময় করলাম ওনার সাথে। উনি ইঊশাকে আদর করে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
— শুধু বন্ধু নয় আমি কিন্তু ওর ভাইয়ের মতো ছিলাম।
— আপনি বাড়ির ভেতর গিয়ে বসুন না।
ইনতিসার ওনাকে রাস্তায় দাঁড় করিয়ে কথা বলছো?
ইনতিসারের দিকে বিরক্ত চোখে তাকালাম আমি। দাদু হাসতে হাসতে বললেন,
— ভেতরে তো যাবো দাদু। তুমি নাকি কোথায় যাবে সেজন্য এখানে অপেক্ষা করছি। তুমি বেরিয়ে গেলেই আমরা ভেতরে যাব।
এবার আমার মনে পড়লো দেরি হয়ে যাচ্ছে। সময় দিতে পারছি না জন্য ক্ষমা চেয়ে ওনার থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে গেলাম।
ইঊশাকে ভর্তি করে ক্লাস করতে পাঠিয়ে দিয়ে মনে হলো এখানে বসে না থেকে বাসা থেকে ঘুরে আসি। আত্মীয় বাসায়। ইনতিসার একা আপ্যায়ন করতে পারবে কি না!
ভাবনানুযায়ী সময় নষ্ট না করে ইঊশাকে বলে আবারও বাসার পথ ধরলাম।
ফিরে দেখি ইনতিসার ড্রইং রুমে সোফার ওপর মাথানীচু করে চুপচাপ বসে আছে। দাদু নেই। ব্যাগগুলো একসাইডে রেখে আমি ওর পাশে গিয়ে বসলাম। ভ্রু কুঁচকে বললাম,
— দাদু চলে গেছেন?
আমার প্রশ্ন শুনে ও মুখ তুলে তাকালো। আমি দেখলাম ওর চোখ লাল। ও কি কেঁদেছে? আতঙ্কে ভেতর দুলে উঠল আমার। কাঁধে হাত রেখে ভয় জড়ানো গলায় জিজ্ঞেস করলাম,
— ইনতিসার কিছু কি হয়েছে? খারাপ কিছু?
ও আচমকা আমাকে জড়িয়ে ধরলো। আর্দ্র গলায় বলল,
— মানুষের কাজ কথা বলে নীরদ। কাজ কথা বলে৷ আমার জীবনে সবসময় আদর্শ ছিলেন আমার দাদু। উনি যখন বেঁচে ছিলেন এত মানুষের সাহায্য করেছেন! আজ সেই সাহায্য আশীর্বাদ হয়ে ফিরে এলো আমাদের জীবনে।
— মানে?
— একটু আগে যিনি এসেছিলেন? আমার দাদুর ফ্রেন্ড। এটা দিতে এসেছিলেন আমাকে।
হাতে ধরে থাকা একটা কাগজ বাড়িয়ে দিলো আমার দিকে। সংশয়াপূর্ণ ভাবে কাগজটা হাতে নিলাম আমি। খুলতেই মনে হলো একটা দলিল৷
জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকালাম।
— এখানে যে জমি দুটোর কথা লেখা আছে ওগুলো আমার দাদুর। বন্ধুর বিপদে একসময় দিয়ে দিয়েছিল। অবস্থাপন্ন হওয়ার পর ইনি জমিগুলো ফিরিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। তখন দাদু নেয়নি। বলেছে যদি কখনো জীবন মরণ সমস্যায় পড়ে সাহায্য চায় তখন নাহয় ফিরিয়ে দেবে। এতদিন আমানত হিসেবে নিজের কাছে রেখে দিয়েছিলেন।
— আজ এতদিন পর হঠাৎ ফিরিয়ে দিলেন?
— হু। কারণ এতদিন পর উনি আমাদের সম্পর্কে জানতে পারলেন। পরিবার নিয়ে বিদেশে ছিলেন। ফিরেছেন গত বছর। বাবার খোঁজে গিয়েছিলেন পুরোনো বাড়িতে।ওখানে সবটা জানার পর এতদিন আমাকে খুঁজে বেড়িয়েছেন। ফাইনালি এখানে পেলেন।
— খুব অবাক লাগছে ইনতিসার।
— আমারও। বিপদে পড়লে সৃষ্টিকর্তার সাহায্য যে কতদিক থেকে আসতে পারে আমার ধারণাতেও ছিল না।
— এই জমিগুলো আমাদের ভাগ্য পরিবর্তন করে দেবে ইনতিসার।
ছলছল চোখে তাকিয়ে বললাম আমি। ও আলতো হেসে মাথা নাড়ল।
কি অদ্ভুত! শেষ পর্যন্ত তাহলে মিরাকলই হলো আমাদের জীবনে৷
_____________________
৭৬.
এরপর আমাদের জীবন আবারও পাল্টাতে লাগল। শহরের ভেতর হওয়ায় দুটো জমিই চড়া দামে বিক্রি হলো। লোন পরিশোধ করার পরও বিরাট একটা অ্যামাউন্ট হাতে রইলো আমাদের। ফ্যামিলি, ফ্রেন্ডসদের সাথে আলোচনা করে দু’জন বন্ধুসহ পার্টনারশিপে বিজনেস করার চিন্তা করলো ইনতিসার৷কারের বিজনেস৷ ওর বন্ধুদের নেটওয়ার্ক ভালো। শুরুতে কিছুটা মন্দা দেখে গেলেও ওই নেটওয়ার্কের জোরে ভালোভাবেই দাঁড়িয়ে গেল বিজনেস। বিজনেসে ঢোকার পর ও পড়াশোনা শেষ করার তাড়না অনুভব করলো। ঠিক ঠিক উন্মুক্ততে বিবিএতে ভর্তি হয়ে গেল। সাথে আমাকেও ভর্তির তাগিদ দিতে লাগল। আমি তো আগেই বলেছি এতকিছুর পর পড়ার প্রতি আগ্রহ আমার অবশিষ্ট ছিল না। কিন্তু ও শোনবার পাত্র নয়। দেখা গেল পড়াশোনাকে কেন্দ্র করে আমাদের ডেইলি ঝগড়াঝাটি শুরু হয়ে গেল। ও লজিক্যালি বোঝায়, আদর করে বোঝায়। বুঝতে না চাইলে ভায়োলেন্ট হয়ে ভাঙচুর করে বেরিয়ে যায়। লাইটলি বিষয়টা শুরু হলেও আস্তে আস্তে তা কমপ্লেক্সের দিকে যাচ্ছে উপলব্ধি করতে পেরে আমার বিরক্তির সীমা রইলো না । কিন্তু ইনতিসারের মধ্যে বিরক্তির আভাস নেই। তা দেখে আমার রাগ বেড়ে গেল। নিত্যদিনের মতোই একদিন টুকটাক কথা কাটাকাটি হচ্ছিল আমাদের মধ্যে। হতে হতে এক পর্যায়ে আমি চিৎকার করে বলে উঠলাম,
— তোমারও বাকিদের মতো মনে হয় আমি তোমার যোগ্য নই তাইনা? এজন্য পড়াশোনা করতে এত ফোর্স করছো তুমি আমাকে। এখন তুমি ভালো পজিশনে চলে গেছ। সমাজে আর পাঁচটা বড় মাপের মানুষের সাথে মিশছো, তাদের পার্টনারদের দেখছো তাই উপলব্ধি হচ্ছে আমি তোমার পাশে আনফিট। অশিক্ষিত, বেকার মেয়েটাকে তোমার মতো বড় মাপের মানুষের পাশে আর মানাচ্ছে না। সহজ কথায় বলে দিতে পারো ইনতিসার। বেশি অযোগ্য মনে হলে ছেড়ে দিতে পারো। প্রতিদিন অশান্তি করে কোনো লাভ আছে? এক বাক্যে..
বাকি কথাটা আর সম্পূর্ণ করা হলো না আমার। তার পূর্বেই এগিয়ে এসে সশব্দে চড় বসালো ও আমার গালে। কাঁধ আঁকড়ে ধরে আহত স্বরে বলল,
— শুধু একটা কথা ভেবেই অবাক লাগে নীরদ৷ আমাকে তুমি আজও চিনতে পারলে না।
এক মুহুর্ত ব্যায় না করে দ্রুত পায়ে প্রস্থান করলো এরপর৷ গালে হাত রেখে মেঝেতে বসে পড়লাম আমি। বিন্দু বিন্দু জল চোখের কোণে জমে গেল। আমি সত্যিই ওকে চিনতে পারিনি? নাকি ও আমাকে বুঝতে পারছে না! আমার ভেতরটা বুঝতে পারছে না।
সেদিন আমার খুব অভিমান হলো। বাইরে গেলে বারবার কল করতো আমাকে। কিন্তু সেদিন করলো না। আমিও অভিমানে খোঁজ নিলাম না৷
সারাটাদিন অমনি করে কেটে গেল। সন্ধ্যেতে যখন ফিরলো সাথে দেখি ইশি আপুও মেয়ে সমেত এসেছে। এসেই তো হুলুস্থুল। একটা বিজনেস পার্টি অ্যাটেন্ড করতে হবে। আমাকে তৈরি করে দিতে এসেছে। সেও আজ আমাদের সাথে যাবে। আপুর কথা শুনে বুঝতে পারলাম এসব ভদ্রলোকেরই পরিকল্পনা। নিজেও অভিমান করে আছে। কথা তো বলা বারণ তাই বোনকে নিয়ে এসেছে। মনে মনে বুদ্ধির প্রশংসা না করে পারলাম না।
ভেতরে যত যাই থাকুক আপুর সামনে আর তা প্রকাশ করলাম না। চুপচাপ তৈরি হয়ে তাদের সাথে বেরিয়ে গেলাম।
পার্টিটা ছিল কারো বাসায়। বিশাল প্রপার্টি আর জাঁকজমকপূর্ণ অ্যারেঞ্জমেন্ট দেখে বুঝতে অসুবিধে হলো না আয়োজকের অবস্থান। শুরুতে বেশ আগ্রহবোধ করলেও মূল ফটক দিয়ে ঢোকার পর থেকে আমি একটু একটু করে মিইয়ে যেতে শুরু করলাম। কারণ বারংবার আমার মস্তিষ্ক অতীতের দুঃসহ স্মৃতিগুলোকে মনে করিয়ে দিতে শুরু করেছিল। চোখের সামনে ভেসে উঠছিল সেদিনের রাতটা। অন্তুর সাথে এরকম একটা পার্টিতে গিয়েছিলাম আমি সেদিন। তারপর..
— নীরু?
যেতে যেতে আচমকা পেছন থেকে আমার হাত টেনে ধরলো কেউ। কন্ঠটা শুনে শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল রক্তের স্রোত নেমে গেল একটা৷ মনে মনে প্রার্থনা করছিলাম যাকে মনে করছি সে যেন না হয়৷ কিন্তু আমার প্রার্থনা কবুল হলো না। হাত ধরে থাকা ব্যক্তি এক টানে আমাকে তার দিকে ফিরিয়ে নিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো৷ কান্নাভেজা গলায় ফিসফিসিয়ে বলে উঠল,
— মিসড ইউ সো মাচ। আমি ভাবতেও পারিনি তোমাকে এতদিন পর এভাবে দেখতে পারবো।
আমি থরথর কাঁপতে কাঁপতে ক্ষীণ গলায় উচ্চারণ করলাম,
— অন্তু?
ও আমাকে ছেড়ে দিয়ে গালে হাত রেখে মাথা নাড়লো।
— হ্যাঁ আমি। তোমার অন্তু।
“তোমার অন্তু” কথাটা শুনে কেন যেন আমার ভেতরটাতে অদ্ভুত একটা অনুভূতি হলো। সমস্ত শরীর জ্বলতে শুরু করলো। পুরোনো এক ইচ্ছেকে বাস্তবায়ন করার তাড়না অনুভব করলাম ভেতরে। তারপর কোনোদিকে না তাকিয়ে সমস্ত শক্তি দিয়ে চপেটাঘাত করে বসলাম ওর গালে। সেই চপেটাঘাতের শব্দ বোধহয় খুব জোরে প্রতিধ্বনিত হলো। একমুহূর্তের জন্য সবকিছু যেন থেমে গেল। আমার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে ও বিড়বিড় করে বলল,
— তুমি আমায় মারলে?
বিপরীতে কোনো উত্তর আমার ভেতর থেকে এলো না। জলন্ত দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে উপলব্ধি হলো এই একটা মানুষের ওপর আমার অসীম ঘৃণা । একদিন যেমন পৃথিবীসমান ভালোবাসা ওর জন্য জমিয়ে রেখেছিলাম আজ তারচেয়ে কয়েকগুণ বেশি ঘৃণা এই মনে জমে গেছে। এতখানি ঘৃণা যে এই মুহুর্তে ওর বুকে ছুরি চালাতেও বাঁধবে না আমার৷
চলবে,
Sinin Tasnim Sara