#সন্ধ্যায়_সন্ধি(সিজন-২),০৮,০৯
#মম_সাহা
পর্বঃ৮
পুষ্প চিৎকার দিয়ে কেঁদে দেয়।আহানের পরিবারের উদ্দেশ্য করে বলে উঠে
–“জানেন আপনারা পুরো দেড় টা বছর লেগেছে আমার, ভেঙে দেওয়া চাঁদকে জোড়া দিতে।কখনো গাড়ির নিচে,কখনো ছাদের উপরে,কখনো ঘুমের ঔষুধের পাতায় খুঁজেছে মৃত্যুর উপায়। কোথায় ছিলেন তখন আপানারা।এই যে এই পরিবারে একমাত্র আমি ভেঙে যাওয়া চাঁদকে আবারও জুড়তে দেখে নিশ্চিত হয়ে ছিলাম কিন্তু আজ আবারও আপনাদের উপস্থিতি আমার চাঁদকে এই পরিবার থেকেও আলাদা করে দিয়েছে।আর এই যে নিলীমা আন্টি খুব না বলেছেন চাঁদ অলক্ষী আসলে অলক্ষী আপানারা তাই তো আপানারা যেখানেই যান আমার চাঁদের শান্তি কেড়ে নেন।আপনাদের আঘাত তো সয়ে নিয়েছে মেয়েটা।চঞ্চল মেয়েটা ঠান্ডা হয়ে গিয়েছিল।যে মেয়েটাকে মেরে ফেললেও হাসিমুখে থাকতো সে মেয়েটা মেপে মেপে হাসে।হাসে না বললেই চলে।আবার কি করতে ফিরে এসেছিলেন?”
উপস্থিত সবাই হতবাক পুষ্পের কথা শুনে। জাহানারা বেগম আল্লাহ বলে বসে পড়লো।চাঁদের পরিবারের সবাই মাথা নিচু করে ফেলল।তেজ ছুটে আসলো পুষ্পের দিকে।আকুতির সুরে বলল
–“প্লিজ পুষ্প সবটা বলো চাঁদ সম্পর্কে। চাঁদের সাথে কী করেছে ওর পরিবার আমরা জানতে চাই বলো প্লিজ।”
হৃদিও ছুটে আসে।যতই হোক চাঁদ তার প্রাণপ্রিয় বান্ধবী আর সেই বান্ধবীর ভয়ঙ্কর অতীত জানতেই হবে।হৃদি এসেই পুষ্পকে জাপটে ধরে সোফায় বসায়।পুষ্পের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে
–“আর কিছু লুকাবি না পুষ্প।সব বল। চাঁদের সাথে কি হয়েছিলো?”
“চাঁদ একজনকে পাগলের মতন ভালোবেসে ছিলো আর সেই ভালোবাসায় চাঁদের কাল হয়ে দাঁড়ায়।”–কাঁদতে কাঁদতে বলল পুষ্প।
তেজের বুকটা হাতুড়ি পিটা করছে।চাঁদ তাহলে কাউকে ভালোবাসতো? কাকে ভালোবাসতো? চাঁদ কি তাহলে তার হবে না?
এর মাঝেই আব্রাহাম পুষ্পকে পরিষ্কার করে সব বলতে বলল।
পুষ্প কান্না থামিয়ে বলা শুরু করলো,
****
চাঁদ খুলনার এক ব্যবসায়ীর মেয়ে ছিলো।আমি,নীল আর চাঁদ এক সাথেই স্কুল কলেজ পড়েছি। সেই সুবাধে চাঁদদের বাড়িতে আসা যাওয়া ছিল প্রচুর।স্কুলে থাকাকালীন আমার বাবা মা মারা যায়। কোনো আত্মীয় স্বজন ছিলো না এই এতিম আমিটার।চাঁদ হোস্টেল ঠিক করে দেয়।মেয়েটা বড্ড চঞ্চল ছিলো।খালি হাসতো।বকা দিলেও হাসতো মার দিলেও হাসতো।এই যে প্রহেলিকা এটা চাঁদের খালাতো বোন ছিল।চাঁদ সবার বড্ড আদরের ছিলো।ভাবতে পারি নি এই আদর লোক দেখানো আদর। –বলেই দীর্ঘশ্বাস ফেলল পুষ্প। তারপর নতুন উদ্যমে আবার বলা শুরু করল।
চাঁদ আর আহান ভাই ছিলো নিলীমা আন্টি আর মহসিন আঙ্কেলের ছেলে মেয়ে। চাঁদ আহান ভাইয়ার আর পরিবারের ছোট মেয়ে ছিলো বলে আদরও পেতো খুব।চাঁদ প্রচন্ড ইমোশনাল ছিলো বটে।রাস্তার পাড়ার সামান্য প্রাণীর কিছু হলেও সে ব্যাথীত হতো।চাঁদের বন্ধুর সংখ্যা অনেক ছিলো কারণ ও মিশুক ছিলো প্রচুর।এখনকার মতন গম্ভীর কখনোই ছিলো না।প্রহু আপু বলতে পাগল ছিলো চাঁদ।প্রহু মানে প্রহেলিকা। দিনে রাতে যা হতো সব এসে প্রহেলিকাকে বলতো।
তখন সময়টা বসন্তের মাঝামাঝি। কলেজ থেকে ফেরার পথে এক ছেলের বাইকের সাথে ধাক্কা লেগে চাঁদের হাতের বেশখানিকটা অংশ কেটে যায়। আমি তো প্রচুর রেগে গিয়েছিলাম। ছেলেটা বাইক থামিয়ে নামার সাথে সাথে আমি কলার ধরে ইচ্ছা মতন বকছি।চাঁদ দৌড়ে এসে তাড়াতাড়ি আমার হাতটা ছাড়িয়ে নিলো।ছেলেটা ছাড়া পেয়ে চাঁদের দিকে তাকিয়ে বলল
–“সরি মেম আমি বুঝি নি।একটু কাজ ছিলো তাই তাড়াতাড়ি চালাচ্ছিলাম।আপনার কত ক্ষতি করে দিলাম।দুঃখিত আমি।
সূর্যের আলো আর গরমে লাল হয়ে যাওয়া চাঁদের ছোট্ট মুখটাই হাসি ফুটে উঠলো।মিষ্টি হাসি দিয়ে বলল
–“না না ভাইয়া আমি বুঝতে পেরেছি আপনি ইচ্ছে করে এমন করেন নি।আমাকে আপনব আগে থেকে চেনেনও না যে শত্রুতার জন্য এমন করেছেন।ভুল মানুষ মাত্রই তবে ভবিষ্যতে খেয়াল রাখবেন।আমার জায়গায় কোনো বৃদ্ধ মানুষ হলে কি হতো বলুন।আর সরি আমার সই উগ্র ব্যবহার করেছে তাই।”
আমি চাঁদের ভালো মানুষি দেখে আরও তেতে উঠলাম।আমাকে কিছু বলতে না দিয়েই ছেলেটা মুগ্ধ স্বরে বলল–“অসাধারণ”
আমি আর চাঁদ দাঁড়ালাম না।বাড়ির পথে রওনা দিলাম।ছেলেটাও বাইক নিয়ে পিছু পিছু আসলো।পাত্তা দিলাম দুজনে।কাউকে জানালাম শুধু প্রহেলিকা আপু বাদে।চাঁদ তো ওনাকে সবই বলে।
তারপর থেকে রোজ ছেলেটা পিছু নিতো। একদিন দুদিন তিনদিন।চিঠিও দিতো চাঁদকে।আমি বুঝেছিলাম এ বসন্ত চাঁদের জন্য রঙ আনবে। কে জানতো বসন্তই ছিলো সর্বনাশ।দীর্ঘ ছয়মাস ঘুরার পর চাঁদের মন পেলো ছেলেটা।চাঁদ তো এসবে যাবেই না আমি আর প্রহু আপু মিলে রাজি করালাম।সময় তখন উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার মাঝামাঝি। গোটা এক বছরের বেশি সময় প্রেম করেছে দুজন।আমিও দেখতাম ছেলেটা ভালো,ভদ্র,শিক্ষিত।পরীক্ষার সময় ছেলেটার সাথে চাঁদের তেমন যোগাযোগ হচ্ছিলো না তাই মরিয়া হয়ে একদিন চাঁদদের বাড়িতে এসে উঠে ছেলেটা।
তারপর ঝামেলা হয়।কিন্তু চাঁদ আদরের মেয়ে বিধায় মেনে নেয় সবাই।ঠিক হয় ভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার পর বিয়ে করানো হবে।সব কিছুর সাক্ষী ছিলাম আমি।দেখতাম ছেলেটা বেশ ভদ্র,নম্র চাঁদকে ভালোও বাসে খুব।
ভার্সিটিতো ভর্তি হলাম।চুটিয়ে প্রেম করে দুজনে।সব আবার আমাদের কাছে এসে বলতো।ঘনিয়ে আসে চাঁদের বিয়ে। মেহেন্দি অনুষ্ঠান অব্দি সব ঠিকই ছিলো। গায়ে হলুদের দিন সকাল থেকেই চাঁদের ভীষণ পেট ব্যাথা উঠে।অতিরিক্ত পেট ব্যাথার কারণে একসময় জ্ঞান হারায় চাঁদ।তাকে হসপিটালে নেওয়া হয়। তার হবু স্বামী, শ্বাশুড়ি সবাই উপস্থিত ছিলো।তারপরই ডাক্তার যা বলল ………
এতটুকু বলে থামে পুষ্প। উত্তেজনায় সবার শরীর কাঁপছে।তেজ পুষ্পের কাছে গিয়ে হাটু মুড়ে বসে হাতজোড় করে বলে,,
–“তারপর কি হয়েছিলো চাঁদের?”
পুষ্প তাকায় প্রত্যেক টা মানুষের দিকে তারপর সোফা থেকে উঠে প্রহেলিকার কাছে যায়।প্রহেলিকার সাতমাসের পেটটাতে হাত বুলিয়ে তেজের দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্য হাসি দিয়ে বলে,
–“তারপর? তারপর আমার চাঁদের সর্বনাশ হয়ে ছিল।এমন ছোট্ট একটা প্রাণকে জন্ম দিতে পারবে না বলে আমার চাঁদের সর্বনাশ হয়ে ছিলো।”
উপস্থিত সবার বুক কামড় দিয়ে উঠে।নাবিলা খানম আহ্ আল্লাহ বলে বসে পড়ে সোফায়। চাঁদের পরম শত্রু রিয়ার চোখেও জল চিকচিক করছে।একটা মেয়ের ভিতর এত কিছু লুকানো ছিলো।তেজ শক্ত হয়ে যায়। কি শুনলো সে।চাঁদ মা হতে পারবে না।
পুষ্প চোখের জল টা মুছে আবার বলা শুরু করলো,
অবাক হচ্ছেন তো? কষ্ট লাগছে? আমরাও অবাক হয়ে ছিলাম কষ্ট হয়ে ছিলো ডাক্তার যখন জানালো চাঁদের জরায়ু তে টিউমার হয়েছে আর সেটা খুব শীঘ্রই অপারেশন করানো লাগবে না হয় চাঁদ মারা যাবে আমাদের সবার পায়ের নিচের মাটি সড়ে গিয়ে ছিলো।তারপরেটা শুনোন আমার চাঁদের জীবন যুদ্ধের কথা।
ডাক্তারের কথা শোনার পরই পাত্রের মা পাত্রকে নিয়ে বিদায় হলেন।চাঁদ ভেঙে পড়লো।আগামীকাল হওয়া বিয়েটে ভেঙে গেছে এমন মেয়ে সমাজে টিকাটা কি কষ্টের ছিলো।সমাজের বিষাক্ত কথা শুনে শুনে একদিন হঠাৎ চাঁদের মায়েরও বদল শুরু হলো।অত্যাচার শুরু করে দিলো চাঁদের উপর। প্রেমিকের খোঁজ নেই আর।
সমাজের কটুক্তি, মেয়ের অসুস্থতা, আবার বিয়ে ভেঙে যাওয়া সব মিলিয়ে অতিরিক্ত চিন্তায় স্ট্রোক করে পঙ্গু হয়ে যায় চাঁদের বাবা। চাঁদের মা এই নীলিমা আন্টি তখন চাঁদের পাশে না দাঁড়িয়ে বরং চাঁদকে অপয়া অলক্ষী বলে গালি দিয়েছে।মুখের ভাত কত ছিনিয়ে নিয়েছে।আঙেল যতদিন সুস্থ ছিলো ততদিন চাঁদ বেঁচে গেলেও তারপর থেকে গুঁমড়ে মরতো প্রতি সেকেন্ড। আন্টি তো আল্লাহর দরবারে চাঁদের মৃত্যু কামনাও করেছে।
আঙেল অসুস্থ হয়ে যাওয়ায় ব্যবসার ভার এমে পরে আহান ভাইয়ার কাঁধে।ব্যবসায়ের কাজে চলে যেতে হয় তাকে ভিনদেশে।সেদিন চাঁদের কি কান্না।বাবার পর ভাই ই ছিলো তার আশ্রয়। এখন মাথার ছাদ কেউ না।এই বিশাল দুনিয়ায় চাঁদ একা হয়ে পড়ে।আমি নীল যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি।
হঠাৎ একদিন জানতে পারলাম চাঁদের প্রেমিকের বিয়ে তাও কার সাথে জানেন? এই যে এই চাঁদের প্রাণপ্রিয় বোন প্রহেলিকার সাথে। হ্যাঁ এই আবির বেইমানই চাঁদের প্রেমিক।এই আবিরই চাঁদের সাথে বেইমানি করেছে।আমার চাঁদকে শেষ করে দিয়েছে।মেয়ে যেচে তার জীবনে যায় নি সেই ই তো এসেছিল।
চাঁদ ছুটে যায় আবিরের কাছে।সন্তান ই সব হয় না বুঝাতে।কিন্তু আবির মুখ ফিরিয়ে নেয় তার মা নাকি দিব্যি দিয়েছে। চাঁদ ছুটে খালামনির ফ্লাটে।তার বোন তো আর বিশ্বাসঘাতকার করবে না।কিন্তু খালামনি রুম অব্দি চাঁদকে আসতে দেয় নি।অপয়া অলক্ষী বলে তাড়িয়ে দিলেন। আহা সে চূর্ণবিচূর্ণ চাঁদকে আমরা দেখেছি।
প্রহেলিকার বিয়ের কয়দিন আগে চাঁদের বাবা আমাকে আর নীলকে ডাকান।আমাদের হাতে কত গুলো টাকা গুজে দিয়ে বলল,
–“আমার মেয়েটাকে বাঁচাও তোমরা।ও যে ভীতরে রোগ পালছে সবাই সেটা ভুলেই বসেছে।মেয়েটা চোখের সামনে বিয়েটাও সহ্য করতে পারবে না।এই সুযোগে ওকে নিয়ে পালাও না হয় ও মরেই যাবে।”
সেদিন এক নিরুপায় বাবার আকুতি দেখেছি।আমরাও ভাবলাম চাঁদকে বাঁচাতে হবে।প্রহেলিকার গায়ের হলুদের দিন আন্টির কাছে চাঁদকে হোস্টেলে নিয়ে যাবো বলে নিয়ে গিয়ে হসপিটালে ভর্তি করাই।চাঁদ অপারেশন থিয়েটারে মৃত্যুর সাথে যখন লড়াই করছে তখন তার ভালোবাসার মানুষটা বিয়ে করছে।আবার চাঁদের মা বোনের মেয়ের বিয়েতে গেছে।
চাঁদকে আইসিইউতে দেখতে যাওয়ার পর চাঁদের কি কান্না।একবার বিয়ের বাড়িটা দেখবে।আমি আর নীল না পেরে এই সদ্য অপারেশন হওয়া মেয়েকে নিয়ে ছুট লাগালাম বিয়ে বাড়ি।
রাত বারোটা। এক ভগ্ন হৃদয় নিয়ে বিয়ের গেইট হাত বুলিয়ে কান্না করছে মানবী। দূর থেকে আত্ম চিৎকারের সাক্ষী আমরা।কি বিভাষীকাময় রাত ছিলো সেটা বলার বাহিরে।এক নারীর আল্লাহর কাছে কি আকুতি।চাঁদ কান্না করে বলছিলো,
–“হায় আল্লাহ তোমার এই স্বার্থের পৃথিবী দুঃখিনী চাঁদদের জন্য নয়।আমার তুমি নিলে না কেন খোদা।হে প্রেমিক তুমি আজ কোন নেশায় ডুবেছো আজ তোমার চাঁদ কাঁদছে তুমি মুছবে না তার কান্না।ও প্রেমিক তুমি তো কারো না।এমন নিষ্ঠুর মানুষ কারো হতে পারে না।তবে আল্লাহর দরবারে প্রেমিক তোমার দোষ রাখলাম।আমি তুমি ক্ষমা করো তোমায় মাফ করতে পারলাম না।মা ও মা গো তুমি কি দেখছো না চাঁদ কাঁদছে আজ।এত পাষাণ কলিজা তো আল্লাহ মায়েদের দেয় না।ও দুনিয়া দুঃখিনীর বেলায় তুমি বড্ড পাষাণ।এ অভাগিনীর ঠাঁই বুঝি আপনের কাছে হলো না।তোমার রঙিন দুনিয়ায় আল্লাহ ভালোবাসা নেই।”
সেদিন হতভাগিনীর কান্না আমরা দেখিছি আর ঐ উপরওয়ালা দেখেছে।তারপর সেই রাতে শহর ছাড়ি আমরা। চাঁদ পাগলের মতন একটা কাজ করেছিলো সেদিন।ওদের বাড়ির দেওয়ালে নিজের হাত কেটে বড় বড় করে লিখে দিয়ে এসেছিলো–
প্রেমিক যারা পাষণ পুরুষ প্রেমহীন থাকুক তারা,
প্রেমিকের বেইমানীতে প্রেমিকাদের হৃদয় যায় মারা।”
~মম_সাহা
চলবে,,,,
#সন্ধ্যায়_সন্ধি (সিজন ২)
#মম_সাহা
পর্বঃ৯
ঢাকায় এসে হোস্টেলে উঠলাম।নীল উঠলো তার আত্মীয়ের বাড়ি।চারদিন পর চাঁদ যখন বিছানা থেকে উঠার মতন সুস্থ, তখন তাকে নিয়ে বাহিরে গেলাম।শারীরিক সুস্থতার সাথে মানসিক সুস্থতাও তো প্রয়োজন।আর সেদিনই আমজাদ আঙ্কেলকে চাঁদ বাঁচায় তারপর আপনাদের জোড়াজুড়িতে আপনাদের বাসায় এসে উঠে।আমি আর নীল খুলনা শহর ছাড়ার আগেই নিজেদের সব কাগজপত্র উঠিয়ে ট্রান্সফার হয়ে ঢাকার ভার্সিটিতে ভর্তি হয়ে ছিলাম।তারপর তো আপনারাই সব জানেন।–
দীর্ঘ ব্যক্তবের পর থামলো পুষ্প।ড্রয়িং রুমে নিরবতা ছেয়ে আছে।কারো মুখ দিয়ে কথা বের হচ্ছে না বা কথা বলার ইচ্ছা কারো হচ্ছে না।একটা শক্ত খোলেশের আড়ালে এমন ভগ্ন মন আছে কেউ বুঝতেও পারে নি।
জাহানারা বেগম সোফা থেকে উঠে তার ছোটজা মানে তুহার মায়ের কাছে গেলো তারপর কতক্ষণ শক্ত চোখে তাকিয়ে ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কেঁদে দিলো আর ছোটজা এর দুহাত ধরে বলে উঠলো
–“এ তুই কি ভুল করলি ছোট।আমিও বা তখন কেনো দাঁড়ালাম না মেয়েটার পাশে।এমন হবে জানে দেখেই মেয়েটা নিচে আসতে চায় নি।আমিই সর্বনাশ টা ডেকে আনলাম।আমরা ভাঙা মানুষটাকে আবার ভেঙে দিলাম।কি করলাম আমরা।”
তুহার মা জাহানারা বেগমের পা জড়িয়ে ধরে কেঁদে বলল
–“ভাবি গো আমি আমার মেয়ের বিয়ে নিয়ে আতঙ্কে মেয়েটাকে সবার সামনে কেমন অপমান করে বসলাম।আমায় তুমি ক্ষমা করো ভাবি।”
এতকিছুর মাঝে তুহা এক বিরাট কাজ করে বসলো।নিজের অনামিকা হাতের আংন্টি যা সদ্য শ্বশুর বাড়ি থেকে পাওয়া, সেটা খুলে ছুড়ে মারল।আহান আর তার পরিবারের দিকে তাকিয়ে চিল্লিয়ে বলে উঠল
–“এক্ষুনি এ বাড়ি থেকে বের হয়ে যান।আপনাদের মতন বেইমানদের পরিবারে এ তুহা পা রাখবে না। যান বেরিয়ে যান।”
উপস্থিত কেউ এমনকি তুহার বাবা মাও তুহাকে আটকাচ্ছে না।এর মাঝেই আব্রাহাম কৌতুক সুরে বলল
–“আমরা সবটা তো এক পাক্ষিক শুনলাম।বাকিটাও শুনান আপনারা।আপনারা কি এতই নিষ্ঠুর যে চাঁদ যাওয়ার পর একটুও খোঁজেনও নি!!”
আবির আব্রাহামের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলল
–“খুঁজেছিলাম আমরা।বিয়ের পরেরদিনও যখন চাঁদ বাড়ি ফিরছিলো না চাঁদের মা তখন চাঁদকে কল দেয় কিন্তু নাম্বার বন্ধ তাই তার বন্ধুদেরকেও কল দেয় ফলাফল শূন্য অতঃপর তখর হোস্টেলের নাম্বারে কল দেয়। হোস্টেল থেকে জানানো হয় তিনদিন যাবত পুষ্প হোস্টেলে নেই।চাঁদ নাকি তার কোন কাজিনের বিয়েতে নিমন্ত্রণ দিছে সেখানেই গেছে।
তারপর থেকেই খোঁজাখুঁজি শুরু হয়।সারাদিন আত্মীয় স্বজনের বাড়ি খুঁজে রাতে এক ভয়ংকর খবর পেলাম। চাঁদকে নাকি গতকাল রাতে বাস স্টেশনে দেখে ছিলো একজন।দৌড়ে যাই স্টেশন। গতকাল রাতের বাস নাকি যাওয়ার সময় এক্সিডেন্ট করে।ব্রীজ ভেঙে নদীতে পড়ে যায়। যত যাত্রী ছিলো সব মারা গেছে।তারপর কি আমাদের কান্নার রোল নেমে আসে। সেদিন আমারও আফসোস লেগেছিল খুব।জানিনা প্রহেলিকা আর আমার মা কি জাদু করেছিলো আমি এত বছরের ভালোবাসা ভুলে কয়দিনের মোহে পরে গেলাম।আর এত ভালো একজন মানুষের আত্মাকে মেরে ফেললাম।সত্যি বলতে চাঁদের মৃত্যু বেশি টলাতে পারেনি কাউকে শুধু আঙ্কেল বাদে।আঙ্কেল আরও অসুস্থ হয়ে যায়।
আন্টি আহান ভাইয়াকে জানান না কিছু। বরং বলে চাঁদ অন্য ছেলের সাথে পালিয়ে গেছে”
ড্রয়িং রুমের প্রত্যেকটা মানুষ বিষ্ময়ে হতবাক
এমন পরিবারও হয়।রিয়া তাদের সামনে এসে হাত তালি দিয়ে বলে
–“বাহ্ রে পরিবার বাহ্।জানেন তো আমি চাঁদাে বারবার বলতাম কোন পরিবার থেকে উঠে আসছে আজ তার পরিবারের নমুনা দেখে আমি স্পিচলেস।চাঁদকে আমি বরাবরই অপছন্দ করতাম ওর গম্ভীর মুডটার জন্য। ভাবতাম মেয়েটা অতিরিক্ত ভাব নেয়।কিন্তু বুঝতেও পারি এত সুন্দর একটা ফুলকে তার নিজেরই পরিবার পা দিয়ে পিষে ফেলেছে।ধিক্কার জানাই আপনাদের।আর তেজ তোর পরিবার আর তুই কতটা ভালো তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আমার আছে।যা করলি। আমি না হয় ওর চরম শত্রু কিন্তু তোরা।ছিঃ
এতক্ষণ আহান চুপ করে থাকলেও এখন আর পারলো না।ঠাস করে আবিরের গালে চড় লাগায়।আর তার মায়ের দিকে ঘৃণার দৃষ্টিতে চেয়ে বলে,
–“তুমি মা না ডাইনী।মা নামের কলঙ্ক তুমি।কীভাবে আমাকে মিথ্যে বলে এত গুলো বছর বিদেশ রাখলে।তাও আমি সেখান থেকে চাঁদকে খোঁজার বেশ চেষ্টা করেছি।আর কি বলেছিলে আমার বোন আবিরকে ঠকিয়েছে তাই প্রহেলিকার সাথে ওর বিয়ে দিয়েছো।বাহ্ মা বাহ্ এই না হলে মা।”
আহান তুহার পুরো পরিবারের দিকে ফিরে হাত জোড় করে বলল,
–“পারলে আমাকে ক্ষমা করবেন।এ বিয়েটা আমিও করতে চাইছি না।যে একজন দায়িত্ববান ভাই হয়ে বোনকে আগলে রাখতো পারলো না সে আর কারো যোগ্য না।”
চলে গেলো আহান।আস্তে আস্তে প্রহেলিকারাও চলে গেলো।
শুনেছি ছেলেদের নাকি কান্না করা বারণ তবে আজ তেজ কাঁদছে।তার করা চরম ভুলের জন্য কাঁদছে।এতদিন নিজের ভালোবাসার মানুষকে বুঝতে না পারার ব্যর্থতায় কাঁদছে।
_____________________
পেরিয়ে গেছে দুদিন।এ বাড়ির লোক চাঁদের সাথে যোগাযোগ করতে পারে নি। পুষ্প আর নীল দেয় নি সে সুযোগ।
আজ দুদিন পর ভার্সিটির গেইটে পা রাখল চাঁদ।সে দুইদিন রুমেই ছিলো।নিজেকে আবার সামলিয়েছে।কারণ গত বারের ধাক্কার পর সে বেশ শক্ত হয়ে গিয়েছিল। এবারের ধাক্কা তাকে তেমন টলাতে পারেনি।
চাঁদ আর পুষ্প একটা ফ্লাট ভাড়া নিয়েছে। এখন একসাথেই থাকবে তারা।
নীল আর পুষ্প ভার্সিটিতে আগেই চলে এসেছে। ভেবেছিলো চাঁদ আসবে না।কিন্তু চাঁদ হাসিমুখে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সবাই অবাক।বন্ধু সার্কেল ঘিরে ধরলো তাকে।চাঁদ দেখে আজ বন্ধু সার্কেলে একজন অনুপস্থিত। দূরে অন্য একটা টেবিলে বসে আছে।চাঁদ পুষ্পের দিকে কিছু ইশারা করতেই পুষ্প বলল,
–“আমরা কেউ ওর সাথে কথা বলি না।ওর পরিবার তোর সাথে যা করলো।”
চাঁদ কপালে ভাজ ফেলে বেশ বিরক্তের সুরে বলল
–“আহা পুষ্প তুই বেশি হিংসামি করিস।ওর পরিবার কি করেছে না করেছে তার দায় ও নিবে কেনো? তাহলে আমার পরিবার যা করেছে তার দায় কি আমারও?”
পুষ্প মাথা নিচু করে ফেলে।চাঁদ তো ভুল কিছু বলে নি।এই মেয়েটা সত্যি যেভাবে ভাবে সেভাবে কেউ ভাবতে পারে না।
চাঁদ নিজের টেবিল ছেড়ে দূরে বসা হৃদির কাছে গিয়ে বসলো।হৃদি মন খারাপ করে মাথা নিচু করে ছিলো বিধায় খেয়াল করে নি।হঠাৎ কেউ পাশে বসেছে ফিল করে ফিরে তাকিয়ে দেখে চাঁদ।হৃদিতো আশ্চর্যের সপ্তম পর্যায়ে চলে গেছে।সে ভাবতে পারিনি চাঁদ নিজে ধেকে তার কাছে আসবে।আর তারও চক্ষুলজ্জায় কুলায় নি চাঁদের সাথে নিজে গিয়ে কথা বলার।
হৃদি চাঁদকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে দিয়ে বলে
–“সরি আমি সত্যিই সরি।আমিতো আটকাতে চেয়ে ছিলাম চাচীমা এমন কিছু করবে ভাবি নি।মাফ করে আমায়।”
চাঁদ হৃদির মাথায় হাত বুলিয়ে বলল
–“আরে বোকা মেয়ে কাঁদছিস কেনো।আমি কিছু বলেছি তোকে? যা হয়েছে তা শেষ। সবার আগে তুই আমার ফ্রেন্ড। তোর পরিবার আমাকে অনেক ভালোবাসা দিয়েছে সেটাই অনেক।আর কখনো বন্ধুত্বে কেউ পরিবার টানবি না কেমন?”
সবাই মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ জানায়।পুষ্প এসে হৃদিকে জড়িয়ে ধরে।জমে উঠে বন্ধুত্বের আড্ডা।এ রমনীর আপন বলতে তো বন্ধু গুলাই আছে।হৃদি আড্ডায় ব্যস্ত থাকা চাঁদের দিকে নিষ্পলক চেয়ে রয়।এই মেয়েটার ভিতরে এত কষ্ট পোষা আছে?
___________
সন্ধি ভিলায় রাত দশটা। ডাইনিং টেবিলে চামচের টুংটাং শব্দ ছাড়া কিছুই হচ্ছে না।সবাই নিশ্চুপ।চাঁদ বিদেয় নিয়েছে আজ দুদিন।বাড়িটা কেমন প্রাণ হারিয়েছে। খাওয়া থামিয়ে হৃদি সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলল
–“আমি হোস্টেলে উঠতে চাই।”
সবার খাবার অটোমেটিকলি থেমে গেছে।জাহানারা বেগম মেয়ের পাশে এসে ধমকের সুরে বলল,
–“কেনো তোমার বাড়িঘর নেই?
–“আমি স্বার্থপর বাড়িতে থাকতে চাই না?”
সবাই মাথা নিচু করে ফেলে।তুহার মা হৃদির পাশে দাঁড়িয়ে তড়িঘড়ি করে বলল,
–“আমি জানতাম না চাঁদের ভাই আহান।আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। সেই তো বিয়েটা ভাঙ্গলোই।আমি চাঁদের অতীত ও যানতাম না।তবে দোষ করেছি ক্ষমা আমি চেয়ে নিবো।
হৃদি বেশ ক্ষেপে গেলো।চাচী বড্ড ভালো মানুষ তবে আজ চাচীর উপরও রাগ উঠছে।সে খাবার ছেড়ে উঠে চিল্লিয়ে বলল,
–“তোমাদের ড্রামা তোমাদের কাছে রাখো।আর ক্ষমা চাওয়ার নাটক করতে হবে না।তোমাদের মিথ্যে মায়া থেকে মেয়েটা মুক্তি পেয়েছে। শুধু তুমি কেনো আমার মাও তো বলেছিলো আবার আজ পুষ্পের কাছে শুনলাম আমার ভাইও নাকি বহুত কিছু বলেছে।তোমরা তো বলেই গেলে। থাক এবার মেয়েটাকে মুক্তি দেও।”
–“হৃদি তুই কার সাথে কীভাবে কথা বলছিস বুঝে বল।হ্যাঁ মানছি আমার মা ভুল করেছে তাই বলে তোর মতন ছোট একটা মেয়ে মাকে এগুলো বলতে পারে না।” বেশ তেতেঁ উঠে বলল তুহা।
–“হ্যাঁ হ্যাঁ আপু, মা মেয়ের পক্ষ ধরে একজনকে চড় মারবে, মেয়ে মায়ের পক্ষ ধরে একজনকে কথা শুনাবে বাহ্ কি বন্ডিং।
ঠাস করে চড় পড়লো হৃদির গালে।তাকিয়ে দেখে তার মা জাহানারা বেগম লাল চোখ করে তাকিয়ে আছে আর বলছে,
–“এই শিক্ষা দিলাম আমি তোকে এই শিক্ষা?”
–“আজ বেশ হাত নড়ছে তোমার মা যেদিন ভাইয়া ঐ মেয়েটাকে এত কথা বলেছিলো তখন তোমার হাতে কি হয়েছিলো? ওহ চাঁদ পরের মেয়ে ছিলো বলে নিজের ছেলেকে কিছু বলো নি তাই না? এই স্বার্থপর বাড়িতে আমি আর থাকছি না।থাকো তোমরা।”
হনহনিয়ে নিজের রুমে চলে গেলো হৃদি।তুহার মা আর নাবিলা খানম জাহানারাকে বুঝাচ্ছে এত বড় মেয়ের গায়ে হাত তোলা উচিত হয়নি।তেজ নিরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছে কারণ তার মনের অন্য কিছু চলছে।আগামীকাল হবে নতুন কিছুর সূচনা। কিন্তু হবেটা কি?
চলবে,,