#আফিম_বড্ড_নেশালো
পর্বঃ০৮,০৯
লেখিকাঃমাহযাবীন
০৮
সন্ধ্যে নেমে এসেছে।আকাশ টা ধূসর রঙ ধারণ করেছে এবং সূর্যের তাপ জানিয়েছে বিদায়। চারিদিকে বয়ে চলছে ঠান্ডা ঠান্ডা বাতাস।
আফিমদের পুরান বাড়িটি ঠিক পুড়নো দিনের বাড়ি গুলোর মতোই,নেই কোনো আধুনিকতার ছোঁয়া।বাড়ির সামনেই এক মস্ত বড় উঠোন।সেই উঠোনের চারপাশ দিয়ে আছে বিভিন্ন গাছগাছালী।জায়গাটায় গাছগাছালী বেশি থাকায় বাতাস যেমন বেশি ঠিক তেমনই দূষণমুক্ত ও অক্সিজেন সমৃদ্ধ নির্মল নিঃশ্বাস মুগ্ধতার সাথে নিজের মাঝে টেনে নেওয়া যায়।ভুতের ভয় পাবারও সুযোগ নেই কারণ আফিমদের বাড়ির সামনেই ছোট্ট মোটামুটি পাকাপোক্ত একটি রাস্তা এবং রাস্তার ওপাশেই আরেকটি বাড়ি আছে।আফিমদের বাড়ির দুপাশেও দুটো বাড়ি আছে কিন্তু মধ্যবর্তী দুরত্ব অনেক।
রাতে মাছের বিবিকিউ খাওয়া হবে আগের থেকেই পরিকল্পিত ছিলো।তাই এ সন্ধ্যে দিয়েই প্রস্তুতি শুরু হয়ে গিয়েছে।বাড়ি থেকে মেরিনেট করা মাছ নিয়ে এসেছিলেন সানিয়া বেগম।আর যা যা প্রয়োজন তার ব্যবস্থা করছেন রবি চাচা।বিবিকিউ তৈরির সময় সবাই উঠোনে বসেই আড্ডা দিবে সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী উঠোনে ছোট্ট ছোট্ট বেশ কয়টি বসার জন্য মোড়া পাতানো হয়েছে।
আফিম একটি হাতা কাটা গেঞ্জি পরে বিবিকিউর জন্যে উঠোনে চুলা ঠিক করছে।বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে তার মুখে ও শরীরে।চুলগুলো এলোমেলো এবং কিছু অবাধ্য চুল তার কপালে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।এই মুহূর্তে আফিমকে কেউ দেখলে মুগ্ধ হতে বাধ্য।নাফিয়া আফিমের থেকে কিছুটা দূরে ঠিক সামনে বরাবরই একটি মোড়ায় বসে আছে।তার পাশেই দাদী ও সানিয়া বেগম গল্প করছে।সে গল্পে নাফিয়ার মনোযোগ নেই।সে তো তার সামনে বরাবর চুলা সেট করতে থাকা এক সুদর্শন পুরুষকে দেখতে ব্যস্ত।চুলা ঠিক করার মাঝেই আফিম হটাৎ চোখ তুলে তাকায় নাফিয়ার দিকে।দেখে নাফিয়া এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে।আফিমের চোখে চোখ পরতেই চোখ সরিয়ে নেয় নাফিয়া।আবারও এক বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পরতে হলো তাকে।নিজের উপরই রাগ হচ্ছে নাফিয়ার।কেনো সে বিনা কারণে আজকাল এতোটা দেখছে এই পুরুষ টাকে!কই সে তো ইচ্ছে করে দেখে না,অনিচ্ছাকৃতই তো বার বার চোখদুটো এই পুরুষটাতেই আঁটকে যাচ্ছে! নিজের উপরই বিরক্ত হচ্ছে সে।এদিকে,নাফিয়ার তাকিয়ে থাকাটা বেশ কিছুটা সময় ধরেই বুঝতে পারছিলো আফিম।তাই সে ইচ্ছাকৃতই হুট করে তাকায় নাফিয়ার দিকে যেনো চোর হাতেনাতে ধরা পরে।চোখে চোখ পরতেই নাফিয়ার চোখ সরিয়ে নেওয়া ও লজ্জা পাওয়ার বিষয়টি বেশ উপভোগ করে আফিম।ঠোঁটে বাঁকা হাসি ফুটিয়ে আবারও নিজের কাজে মনোনিবেশ করে সে।
আফিমরা এ বাড়িতে দীর্ঘ কয়েক বছর কাটিয়েছে বলে প্রতিবেশীদের সাথে সম্পর্ক বেশ ভালো তাদের।আফিমরা এসেছে জেনে প্রতিবেশী দু’জন মহিলা ও দু’টি মেয়ে আসে তাদের সাথে দেখা করতে।সানিয়া বেগমের অনুরোধে রাতের খাবার সেড়েই যাবেন বলে ঠিক করেন তারা।সবাই গোল করে বসে গল্পে মেতে আছে।নাফিয়াও গল্পে যোগ দিয়েছে কিন্তু আফিমের এদিকে বিন্দু পরিমাণ আগ্রহ নেই।সে ব্যস্ত রবি চাচার সাথে খাবারের ব্যবস্থা ও অন্যান্য কাজ নিয়ে।আজকের খাবার তালিকায় যা আছে তার কিছু কিছু পদ আফিম রান্না করবে।আফিমের রান্না বেশ মজা হয় তাই সানিয়া বেগম এবং দাদী উভয়ই নিশ্চিন্তে আছেন।আফিম ও নাফিয়া দু’জনে দু’জনার মতো ব্যস্ত হলেও ফাঁকে ফাঁকে আঁড়চোখে একে-অপরকে একটু একটু দেখে নিচ্ছে।ভাগ্যক্রমে এবার আর একে-অপরের চোখেচোখ পরে না।
বেশ লম্বা সময় ধরে গল্প চলার পরে ঠিক ৯ টা বাজতেই রবি চাচা আসেন সবাইকে খেতে ডাকতে।সবাইও আর দেরি না করে খাওয়ার জন্য উঠানে বিছানো বড় একটি পাটিতে যেয়ে বসে পড়ে।উঠানেই খাবার ব্যবস্থা করার কারণ হলো উঠোনের পরিবেশটা বেশ সুন্দর।ঠান্ডা বাতাস তো বইছেই সেই সাথে বেশ কয়েকটা হারিকেন জ্বালিয়ে রাখার ফলে জায়গাটি হলদে বর্ণ ধারণ করেছে এবং হারিকেনগুলো দেখতেও বেশ সুন্দর লাগছে।সেই সাথে সেকেলে একটা অনুভূতি আসছে যখন বিদ্যুৎ ছিলো না এবং মানুষ আগুন দিয়েই রাতে কাজ করতো।মাথার উপরই আছে প্রকাণ্ড আকাশ এবং তার বুকে ঝুলে আছে মস্ত বড় চাঁদ।বাতাসে গাছপালাগুলো নড়ছে এবং শব্দগুলোও মনে অন্য রকম অনুভূতি জাগাচ্ছে।মশার জন্যে রবি চাচা ধূপ ব্যবহার করেছেন ফলে মশা তেমন নেই আর ২/৪ টা যা আছে তার কামড় এই পরিবেশের মুগ্ধতার কাছে অতি নগন্য।বলে রাখা ভালো,মশা, মাছি তাড়ানোর প্রাচীন একটি পদ্ধতি হলো ধূপ। এটি সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক হওয়ায় শরীরের ক্ষতি করে না। বাংলাদেশের সিলেট ও চট্টগ্রামের পাহাড়ি অঞ্চলে ধূপগাছ জন্মে। গাছের কাণ্ড থেকে যে নির্যাস বা আঠা পড়ে,তা দিয়েই তৈরি হয় ধূপ।
এই পরিবেশে নাফিয়ার মনে হচ্ছে সে যেনো আধুনিকতার যুগ হতে অনেক পিছিয়ে প্রাচীন কালে পৌঁছে গিয়েছে।ভালোলাগা,মুগ্ধতা গ্রাস করছে তাকে।কিছুটা সময়ের মাঝেই সকলের সামনে খাবার উপস্থিত করা আরম্ভ হয়।রবি চাচা ও আফিম উভয়েই একে একে খাবার এনে পাটির মধ্যখানে রাখছে।খাবারের তালিকায় আছে,কোরাল মাছের বিবিকিউ,নান,মুরগী ঝাল করে রান্না,গরুর মাংস ভুনা,স্যালাদ সাথে সাদা ভাতও আছে।যারা নান খাবে না তারা সাদা ভাত খেতে পারবে।অতঃপর সবাই মিলে খাওয়ার পাট চুকিয়ে প্রতিবেশীরা বিদায় নেয়।প্রতিবেশীদের বিদায় দিয়ে সবাই যে যার কক্ষে ঘুমুতে চলে যায়।
এ বাড়িতেও নাফিয়াকে দাদীর পাশের রুমটি দেওয়া হয় ঘুমাবার জন্যে।কিন্তু রাত ১২ টা বাজতে চললো,নাফিয়ার বিন্দু পরিমাণ ঘুম আসছে না।তার ইচ্ছে করছে উঠোনে যেয়ে আরো কিছুক্ষণ নিস্তব্ধে বসে থাকতে।কিন্তু একা যেতে ভয়ও লাগছে তার।সে শুয়ে থাকতে থাকতে বিরক্ত হয়ে উঠে জানালার ধারে যায়।জানালা দিয়ে বাইরের উঠোন দেখা যাচ্ছে।হারিকেনের হলদে বর্ণের আলোতে একজন পুরুষকে স্পষ্ট দেখতে পায় নাফিয়া।ঠোঁটে হাসি টেনে চুল হতে কোমর অব্দি কাপড় দিয়ে আবৃত করে সে উঠোনের উদ্দেশ্য অগ্রসর হয়।
আফিম ফোনে স্লো মিউজিক ছেড়ে এক হাত মাথার নিচে ও অপর হাত বুকের উপর রেখে শুয়ে আছে।নয়ন তার চন্দ্রিমার দিকে।নাফিয়া এসে আফিমের থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করে ওঠে,
-আমিও যদি আপনার সাথে এখানে বসি তবে কি খুব বিরক্ত হবেন?
হটাৎ কারো কন্ঠস্বর কানে আসতেই উঠে বসে আফিম।নাফিয়ার দিকে একবার তাকিয়ে দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয় সে।নিজ স্থান থেকে একটু সরে নাফিয়াকে বসার জায়গা করে দিতেই নাফিয়া ঠোঁটে একটু হাসি নিয়ে আফিমের পাশে বসে পরে।নাফিয়া, আফিমকে উদ্দেশ্য করে বলে ওঠে,
-এতো রাতে এখানে?
-এ বাড়িতে এলে হয় ছাঁদে নাহয় এখানেই রাত কাটে আমার।
-বাহ!
কথার আর কিছু না পেয়ে উভয়ই কিছুটা সময় নিরব থাকে।নিরাবতা ভেঙে আফিম বলে ওঠে,
-তুমি জেগে আছো যে?
-ঘুম আসছিলো না।এই মুগ্ধতা টা মিস করছিলাম।
উত্তরে কিছু বলে না আফিম।নাফিয়া বলে ওঠে,
-এখানে আপনার কোনো বন্ধুমহল নেই?
-“বন্ধু” নামক সম্পর্কটি আমার জীবনে নেই।
অবাক হয় নাফিয়া।বিস্মিত কন্ঠেই নাফিয়া জিজ্ঞেস করে,
-কেনো?
-গম্ভীর,কথা কম বলা আর আলাদা ব্যক্তিত্বের হওয়ায়।
-তাতে কি হয়েছে?আমার তো মনে হয় আপনি অনেক ভালো বন্ধু হওয়ার যোগ্য।
এতোক্ষণ অন্য দিকে তাকিয়ে থাকলেও এ কথায় নাফিয়ার দিকে দৃষ্টিতে নিক্ষেপ করে আফিম।আফিমের চোখে চোখ রেখে নাফিয়া তার ডান হাতটি আফিমের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলে ওঠে,
-বন্ধু হতে পারি?(ঠোঁটে আলতো হাসি)
একবার নাফিয়ার হাতের দিকে তাকিয়ে দৃষ্টি সরিয়ে নাফিয়ার চোখের দিকে তাকায় আফিম।ঠোঁটে বাঁকা হাসি ফুটিয়ে নাফিয়ার বাড়িয়ে দেওয়া হাতটা ধরে এক হেঁচকা টানে নাফিয়াকে একদম নিজের কাছে নিয়ে আসে আফিম।উভয় একে-অপরের এতোটা কাছে যে উভয়ের ঠোঁটজোড়ার মধ্যবর্তি দুরত্ব ব্যাস কয়েক ইঞ্চির।আফিমের এমন কাজে নাফিয়া চমকে যায়,সেই সাথে আফিমের এতোটা কাছে আসায় তার হৃৎস্পন্দন কয়েকশো গুণ বেরে গিয়েছে।আফিম ঠোঁটে বাঁকা হাসি নিয়েই মৃদু স্বরে বলে ওঠে,
“আর কি কি হওয়ার যোগ্য আমি?”
মুহূর্তেই একরাশ লজ্জা ও অদ্ভুত অনুভূতিতে ছেয়ে গেলো নাফিয়ার হৃদয়।আফিমের দিকে তাকিয়ে থাকাটা বেশ দুষ্কর মনে হচ্ছে তার কাছে তাই চোখজোড়া নামিয়ে নেয় সে।হারিকেনের এই হলদে আলোতে নাফিয়ার লজ্জারাঙ্গা চেহারাটা এতোটাই মোহনীয় লাগছে যে আফিম নিজের অজান্তেই একটি ঘোরের মাঝে বিলীন হয়ে যেতে আরম্ভ করে।কিছু না ভেবেই আফিম একটু একটু করে এগিয়ে যেতে থাকে নাফিয়ার ঠোঁটের দিকে।আফিমের ঘন নিঃশ্বাস নিজের মুখের উপর অনুভব করতেই নাফিয়া আধো আধো চোখে আফিমের দিকে তাকায়।আফিম ঘোর লাগা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার ঠোঁটের দিকে।নাফিয়া খুব করে চাচ্ছে আফিমকে আটকাতে কিন্তু কেনোই যেনো সে অনুভব করছে তার পুরো শরীর অবশ হয়ে গিয়েছে।সে কোনোভাবেই পারছে না আফিমকে বাঁধা দিতে।তবে কি কোথাও না কোথাও সেও চায় এটি?
আফিম আর নাফিয়ার ঠোঁটজোড়ার মাঝে ঠিক ২ ইঞ্চির দূরত্ব অবশিষ্ট ঠিক এমন সময় হুট করে হারিকেনের কেরোসিন শেষ হয়ে আলো নিভে যায় এবং পুরো জায়গাটি অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে পরে।ওমনি ভয়ে আফিমকে জড়িয়ে ধরে নাফিয়া।হটাৎ ঘোর কেটে যাওয়ায় আফিম একটু অপ্রস্তুত হয়ে পরলেও নিজের বুকে নাফিয়ার অস্তিত্ব অনুভব করায় অনেকটা অন্য রকম ভালোলাগা কাজ করে তার।একহাতে নাফিয়াকে জড়িয়ে ধরে অপর হাতে ফোনের লাইটটি জ্বালায় সে।আলোর উপস্থিতি টের পেয়ে আফিমের বুক হতে আলতো করে মাথা তুলে আফিমের দিকে তাকাতেই দেখে আফিম তার দিকেই চেয়ে আছে ঠোঁটে সেই বাঁকা হাসি নিয়ে।ভীষণ লজ্জা এসে ভীর জমায় নাফিয়ার মনে সে আর দেরি না করে আফিমকে ছেড়ে নিজের কক্ষের দিকে দৌড়ে পালায়।এদিকে নাফিয়ার কাজ দেখে হেসে দেয় আফিম।
!!
সকালে আফিম,দাদী,সানিয়া বেগম,নাফিয়া সবাই প্রস্তুত হয়ে বের হয় পুরন বাড়ির আশপাশ টা ঘুরে ঘুরে দেখতে।আজ গাড়ি নিয়ে বের হয়নি তারা।সানিয়া বেগম ও দাদী তাদের পুরোনো স্মৃতিগুলো নিয়ে কথা বলতে বলতেই হাঁটছে।এদিকে তাদের পেছনেই আফিম ও নাফিয়া নিরবে হাঁটে চলছে।হাঁটার মাঝে আঁড়চোখে একে-অপরকে একটু দেখছেও।অনেকটা হাঁটার পর নাফিয়া দেখে বেশ বড় একটি খালি মাঠ এবং এর এক কিনারায় ৫/৬ টির মতো ঘোড়া বেঁধে রাখা।একজন লোক এই ঘোড়াগুলোর সাথে দাঁড়ানো।নাফিয়া ঘোড়া দেখে বেশ উত্তেজিত হয়ে দ্রুত পদে ঘোড়াগুলোর কাছে চলে যায় এবং লোকটিকে উদ্দেশ্য করে বলে ওঠে,
-এই ঘোড়া গুলো কি জন্য রাখা হয়েছে?
-এই ঘোড়া গুলো দ্বারা প্রতিদিন ঘোড়ার গাড়ি চালানো হয়।
-ওহ!আলাদাভাবে ঘোড়া চালানো যাবে?
-নাহ,এ নিয়ম নেই।
মন খারাপ হয়ে যায় নাফিয়ার।এই মন খারাপ নিয়েই বাকিদের কাছে ফিরে আসে সে।সবাই দূর থেকেই নাফিয়ার এ বিষয়টি খেয়াল করে।সানিয়া বেগম এবং দাদী উভয়ই নাফিয়াকে মন খারাপ না করার জন্য সান্তনা দিয়ে নিজেদের মতো করে আবারও হাঁটা আরম্ভ করে।আফিম এতোক্ষণে কিছু না বললেও এবার বলে ওঠে,
-ঘোড়া চড়াতে পারো?
নাফিয়া মাথা ডানে-বামে হেলিয়ে বুঝায় যে পারে না।আফিম এবার বলে ওঠে,
-তাইলে এতো মন খারাপের কি আছে ইডিয়ট!
আফিমের কথায় সাথে সাথেই মেজাজ খারাপ হয়ে যায় নাফিয়ার।সে ক্রুদ্ধ কন্ঠে বলে ওঠে,
-নিজে এতো পারলে যান না চালান,অ্যারোগেন্ট![Arrogant]
আফিম উত্তরে কিছু না বলেই উল্টো হেঁটে সেই ঘোড়ার গুলোর কাছে যায়।নাফিয়া বিষয়টি খেয়াল করে না।সে তো আছে তার মন খারাপ নিয়ে।
কিছুটা সময় পার হতেই আফিম একটি ঘোড়ায় চড়ে তা নিয়ে নাফিয়ার কাছে আসে।নাফিয়ার চোখ আফিমের উপর পরতেই তার চোখগুলো রসগোল্লার ন্যায় বড় হয়ে যায়।অবাক চাহনিতে তাকিয়ে আছে সে আফিমের দিকে।আফিম ঠোঁটে বাঁকা হাসি ঝুলিয়ে তার দিকে চেয়ে আছে।আফিম ঘোড়া চড়াতে পারে দেখে নাফিয়া বেশ খুশি হয়ে আফিমের কাছে যেয়ে বলে ওঠে,
-প্লিজ আফিম,আমার ছোটো বেলা দিয়ে সখ ঘোড়া চড়ানোর।প্লিজ আমাকেও সাথে নিন।
-নো,আই ওন্ট!
-প্লিজ,প্লিজ,প্লিজ!
-কিছুক্ষণ আগেই কেউ একজন আমাকে অ্যারোগেন্ট বলেছিলো!
-স্যরি।প্লিজ ক্ষমা করে দেন।
সানিয়া বেগম এবং দাদীও আফিমকে বলে ওঠে নাফিয়াকে ঘোড়াতে উঠাতে।অবশেষে আফিম নাফিয়াকেও উঠায় ঘোড়াতে।অসম্ভব ভালোলাগা কাজ করছে নাফিয়ার।এই প্রথম সে ঘোড়াতে উঠলো।অবশ্য একপাশেই পা রেখেছে সে,ছেলেদের মতো আর বসেনি।আফিম ঘোড়াকে নিয়ন্ত্রণে রেখে ধীরে ধীরে চালানোর মাঝেই নাফিয়ার কানের কাছে মুখ নিয়ে এসে বলে ওঠে,
-আমাকে ধন্যবাদ বলা উচিৎ তোমার মিস.শেখ!
আফিমের দুবাহুর মাঝে আবদ্ধ হয়ে আছে নাফিয়া।সেই সাথে আফিমের এতোটা কাছে এসে মৃদু স্বরে কথা বলায় কেমন যেনো আলাদা রকমের অনুভূতি হচ্ছে নাফিয়ার।এ অনুভূতিটার কোনো নাম নেই।আর অনুভূতি কিভাবে ব্যক্ত করতে হয় তাও জানা নেই নাফিয়ার।কিন্তু সে এ অনুভূতিটি বারংবার অনুভব করতে চায়!
কিছুটা কাঁপা কাঁপা স্বরে নাফিয়া বলে ওঠে,
-থ্যাংক ইউ।
-উহু,এভাবে না।
-তবে?
উত্তরে কিছু না বলে ঠোঁটে আলতো হাসি ঝুলিয়ে নেয় আফিম।
চলবে
#আফিম_বড্ড_নেশালো
পর্বঃ০৯
লেখিকাঃমাহযাবীন
দাদীকে রাতের শেষ ঔষধটি দিয়ে কাজ শেষ হতেই নিজের কক্ষে ফিরে আসে নাফিয়া।গায়ে জড়ানো ওরনাটি খুলে বিছানায় ছুড়ে ফেলে নিজেও বিছানায় গা এলিয়ে দেয়।আজ ৩ মাস ১৫ দিন পূর্ণ হলো তার এ বাড়িতে পদার্পন করার।তারপরেও মনে হয় এইতো ব্যাস কয়েকদিনই হয়েছে এ বাড়িতে সে পদার্পর করেছে।সেই সাথে এ বাড়ির মানুষগুলো এতোটাই ভালো যে এ মানুষগুলোর সাথে থাকলে নাফিয়ার মনে হয় সে তার পরিবারের সাথেই আছে।
হটাৎ নাফিয়ার পাশে পরে থাকা তার ফোনটি বেজে ওঠে।ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকাতেই দেখতে পায় “আম্মু” লিখে সেভ করা নম্বরটি দিয়ে কল আসছে।নাফিয়া ঠোঁটে হাসি টেনে কলটি রিসিভ করে।ফোনের ওপাশ হতে নয়না বেগম বলে ওঠে,
-কেমন আছো,মা?
-সকালে সেই সাথে দুপুরেও তো এই একই প্রশ্ন করেছ আম্মু।আর গত ৩ মাস ১৫ দিনে প্রতিদিন ৩ বেলা করে এই একই প্রশ্ন করে আসছো!তুমি বিরক্ত হও না?
-মোটেই না।মা হলে বুঝতে,এখনো মা হও নাই তো তাই এমন প্রশ্ন জাগে!
উত্তরে একটু হাসে নাফিয়া।অতঃপর বলে ওঠে,
-আমি আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি।তুমি কেমন আছো?
-আলহামদুলিল্লাহ।সন্তান এতোটা দিন ধরে দূরে থাকলে কোন মা ভালো থাকে?
-দূরে কোথায়!মাত্র ৪০ মিনিটের রাস্তা।
-আর এই ৪০ মিনিটের রাস্তাই তুমি গত ৩ মাসে অতিক্রম করে নিজ মায়ের সাথে দেখা করতে আসতে পারলে না!
উত্তরে চুপ থাকে নাফিয়া।নয়না বেগম আবারও বলে ওঠেন,
-নিজের মা-বাবা,বোন কারো কথাই কি তোমার মনে পরে না?একটি বারও এসে তাদের দেখে যেতে ইচ্ছে হয় না?
-উফ আম্মু,বড্ড বেশি বোঝো!এখানে আমি কাজের জন্যেই থাকি।আর মাত্র তিন মাস হলো,জয়েন করেছি।এখনই যদি ছুটি চাই তবে তারা কি ভাববে?নিশ্চয়ই এটাই যে আমি কাজে ফাঁকি দেওয়া মেয়ে?
-এতো কিছু বুঝতে চাইছি না।২/৩ দিনের মাঝেই তোমায় বাসায় দেখতে চাই।
-কিন্তু!
-নাফিয়া,এটি আদেশ।
-ঠিক আছে মা।
-রাখছি,কাল সকালেই জানাবা কখন আসছো!
-আচ্ছা।
ফোন রেখে কিছুটা চিন্তিত হয় নাফিয়া।
!!
জানালার ধারে এসে দাঁড়িয়ে আকাশ পানে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে নাফিয়া।আজ আকাশে চাঁদ নেই তবে তারার সমাবেশ দৃশ্যমান।চাঁদে যেমন মুগ্ধতা আছে, প্রশান্তি আছে তারায় তা না থাকলেও তা দেখতে বেশ লাগে।নাফিয়া নিজের গায়ে ওরনা পেঁচিয়ে চাঁদে যাওয়ার উদ্দেশ্যে নিজের কক্ষ ত্যাগ করে।
ছাঁদে আসতেই চমকে যায় নাফিয়া।ছাঁদে এসে যে তার এমন কিছু দেখতে হবে তা তার ভাবনাতিত ছিলো।ছাঁদের দরজার ধারে চুপটি করে দাঁড়িয়ে পরে সে।
আফিম কোনো একটা স্লো মিউজিকে স্লো মোশন ড্যান্সে মত্ত হয়ে আছে।বাইরের জগতের কোনো কিছুই তাকে প্রভাবিত করছে না।সে যেনো নিজের অন্য কোনো একটা দুনিয়ায় আছে এই মুহূর্তে।প্রায় ৭ মিনিট মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে আফিমের নৃত্য দেখার পর নাফিয়া অনিচ্ছাকৃতই বলে ফেলে,
“ওয়াও,অসাধারণ!”
নাফিয়ার কন্ঠস্বর কানে আসতেই তার দিকে তাকিয়ে থেমে যায় আফিম।হাঁপিয়ে যাওয়ায় নিঃশ্বাস কিছুটা ঘন হয়ে গিয়েছে তার।নাফিয়া আফিমের দিকে এগিয়ে আসতে আসতে বলে ওঠে,
-একদম ইন্ডিয়ার রাঘাব জুয়েলের মতো স্লো মোশন ড্যান্স করেন আপনি!এতোটা সুন্দর স্লো মোশন ড্যান্স কোত্থেকে শিখেছেন?
প্যান্টের পকেট হতে নিজের রুমালটি বেরিয়ে মুখ-মন্ডলে বিন্দু বিন্দু জমা হওয়া ঘাম মুছে নেয় আফিম।অতঃপর নাফিয়াকে উদ্দেশ্য করে বলে ওঠে,
-ছোট্ট বেলা থেকেই নৃত্যের প্রতি বেশ অনুরাগী ছিলাম।একা একাই নিজের মন মতো নাচতাম।এভাবেই কিছুটা বড় হবার পর আমার স্কুলে একজন নৃত্যে পন্ডিত বলা চলে এমন শিক্ষকের খোঁজ পাই।তাকে অনুরোধ করার পর তিনিই আমায় নাচ শিখিছিলেন।
এসব বলতে বলতে নাফিয়া এবং আফিম উভয়ই ছাঁদের রেলিং এর ধারে এসে দাঁড়ায়।আফিমের কথার উত্তরে নাফিয়া বলে ওঠে,
-বাহ,আপনার তো প্রফেশনাল ড্যান্সার হওয়া উচিৎ ছিলো!
উত্তরে কিছু না বলে একটু হাসি ঠোঁটে টেনে আনে আফিম।এরপর কিছুটা সময় নিরবে কাটাবার পর নাফিয়া বলে ওঠে,
-আফিম?
-হু!
-আমার কিছু দিনের ছুটি প্রয়োজন।
নাফিয়ার কথাটি শুনে তার দিকে ফিরে তাকায় আফিম।বলে ওঠে,
-কেনো?
-বাসায় যেতে চাইছি।
-যদি না দেই ছুটি?
-আম্মুর আদেশ যেতেই হবে।
উত্তরে আফিম কিছু বলে না।নিজের দৃষ্টি সরিয়ে নেয় সে।নাফিয়াও আফিম হতে নিজের দৃষ্টি সরিয়ে নেয়।বিন্দু পরিমাণ ভালো লাগছে না নাফিয়ার।বাসায় গেলে আগামী কিছু দিন এই মানুষটাকে ও আর দেখতে পারবে না।কিন্তু নাফিয়া বুঝে উঠতে পারছে না এই মানুষটাকে না দেখলেও ওর তো কিছু যায়-আসার কথা না তবে কেন খারাপ লাগা কাজ করছে?নাফিয়া কেনোই যেনো খুব করে চাইছে আফিম বলুক,”মিস.শেখ আই উইল মিস ইউ”।ঠিক ঐ মুহূর্তেই আফিম বলে ওঠে,
-উইল ইউ ড্যান্স মিস.শেখ?(চোখ মেঝের দিকে রেখে আলতো স্বরে বলে)
অবাক হয় নাফিয়া।সেই সাথে কিছুটা খুশিও হয় সে।কিন্তু সে তো নাচতে পারে না!এটি মনে হতেই মন খারাপ হয়ে যায় নাফিয়ার।সে মন খারাপ করেই বলে ওঠে,
-আমি নাচতে পারি না।
উত্তরে আলতো হেসে আফিম তার ডান হাতটি নাফিয়ার দিকে বারিয়ে দেয়।একবার আফিমের হাতের দিকে তাকিয়ে চোখ সরিয়ে আফিমের চোখের দিকে তাকায় নাফিয়া।আফিমের দৃষ্টিও নাফিয়ার দিকেই।গাঢ় খয়েরী রঙের এ চোখজোড়ায় একটা ভরসা খুঁজে পাচ্ছে নাফিয়া।নাচ পারুক বা না পারুক এই মানুষটির হাত কোনোভাবেই ফিরিয়ে দিতে পারবে না সে।আর না ভেবে আফিমের হাতের উপর হাত রাখে সে।আফিম এক হেঁচকা টানে তাকে নিজের বুকে নিয়ে আসে।এক হাতে নাফিয়ার কোমর ও অপর হাত নাফিয়ার হাতে আঙুলের মাঝে আঙুল দিয়ে ধীরে ধীরে নাফিয়াকে নিয়ে দুলছে আফিম।আগের থেকেই আফিমের ফোনে স্লো মিউজিক চালু করা ছিলো।বেশ কিছুটা সময় দুজনে এ স্লো ড্যান্সে মত্ত থাকে।আসলে ড্যান্সের কোনো স্টেপই নাফিয়ার করতে হচ্ছে না।প্রতিটি স্টেপ আফিম নিজে করছে এবং নাফিয়াকে দিয়ে করাচ্ছে।নাফিয়া খুব উপভোগ করছে বিষয়টি।সেই সাথে উভয়ই উভয়ের এতোটা কাছে থাকায় তাদের দুজনের মাঝেই এক অন্য রকম অনুভূতি কাজ করছে।এ অনুভূতিটি উভয়ই খুব করে উপভোগ করছে।অতঃপর নৃত্য শেষ হতেই আফিম ও নাফিয়া উভয়ই কিছুটা হাঁপিয়ে যাওয়ায় জোরে জোরে শ্বাস নিতে শুরু করে সেই সাথে উভয়ের ঠোঁটেই হাসি।নাফিয়া,আফিমকে উদ্দেশ্য করে বলে ওঠে,
-ধন্যবাদ আফিম।এটি আমার জীবনের ২য়তম শ্রেষ্ঠ অনুভূতি ছিলো।
ঠোঁটে আলতো হাসি নিয়েই আফিম জিজ্ঞেস করে ওঠে,
-প্রথমটি?
-ঘোড়ায় ওঠা।
এক ব্রু উঁচু করে আফিম বলে ওঠে,
-ইট মিন্স,তোমার জীবনের শ্রেষ্ঠ দু’টি অনুভূতিই আমার সাথে?
-জ্বি।
বাঁকা হেসে আফিম বলে ওঠে,
-হোয়্যার ইজ মাই রিটার্ন গিফ্ট?
-কি চাই আপনার?
-যা চাইবো তাই ই দিবে?
ঠোঁটে বাঁকা হাসি ঝুলিয়ে একটু একটু করে নাফিয়ার দিকে এগিয়ে আসতে আসতে বলে ওঠে আফিম।নাফিয়া ইতস্ততবোধ করায় একটু একটু পেছাতে থাকে।মৃদু স্বরে সে বলে ওঠে,
-চেষ্টা করবো।
-উহু।চেষ্টা করবো বললে হবে না!
-আমার ঘুম আসছে।(পালাবার উদ্দেশ্যে)
বলতে বলতেই ছাঁদের রেলিং এ গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে পরে নাফিয়া।সামনে থেকে নাফিয়ার দু’পাশ হতে দু’হাতে রেলিং চেপে ধরে আফিম বলে ওঠে,
-আগে বলো যা চাইবো তাই দেবে!
ভীত কন্ঠে নাফিয়া বলে ওঠে,
-আচ্ছা।
ঠোঁট কামড়ে একটু হেসে আফিম বলে ওঠে,
-তোলা থাকলো।
এবার যেনো হাঁপ ছেড়ে বাঁচে নাফিয়া।সে ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে বলে ওঠে,
-আচ্ছা।
-কবে যেতে চাইছো বাসায়?
-কালই।
উত্তর শুনে কিছুটা সময় নাফিয়ার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে আফিম।নাফিয়াও এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে আফিমের চোখের দিকে।উভয়ের চোখজোড়াই অবক্ত অনেক কথাই বলতে চাইছে এবং তারা উভয়ই একে-অপরের চোখের ভাষা বুঝবার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
নাফিয়ার চোখের দিকে এভাবে তাকিয়ে থাকায় আবারও আফিমের মাঝে এক ঘোর লাগা অনুভূতি কাজ করছে যা এই মুহূর্তে চাইছে না সে।ইচ্ছে না থাকা সত্ত্বেও সে নাফিয়ার থেকে চোখ সরিয়ে নাফিয়ার থেকে কিছুটা দূরে সরে দাঁড়ায়।আফিমের কাছে থাকাটা বেশ ভালো লাগছিলো নাফিয়ার।হটাৎ আফিমের এভাবে দূরে সরে যাওয়াটা ভালো লাগে না তার।সে কিছু না বলে চুপচাপ চলে যাওয়ার জন্যে পা বাড়াতেই আফিম ডেকে ওঠে,
-মিস.শেখ?
-জ্বি।
-আরো কিছুটা সময় থাকবে?
মুহূর্তেই মন ভালো হয়ে যায় নাফিয়ার।ঠোঁটে হাসি টেনে সম্মতি দিয়ে রেলিং ধরে আফিমের পাশেই দাঁড়ায় সে।আফিম,নাফিয়াকে উদ্দেশ্য করে জিজ্ঞেস করে ওঠে,
-সে সামথিং এবাউট ইউ।
-উম,কি বলবো?
কথাটি বলে কিছুটা সময় নিয়ে নাফিয়া নিজেই বলে ওঠে,
-আমি তো খুব সাধারণই।বিশেষভাবে নিজেকে উপস্থাপন করবার মতো কিছুই নেই।সাধারণ অন্য সব মেয়েদের মতোই একটি মেয়ে তবে যে সকল জিনিস অন্য সব মেয়েদের থেকে আলাদা আমায় “নাফিয়া” বানায় তা হলো আমার চিন্তাধারা।আমি কখনোই নিজেকে অন্য কারো সাথে তুলনা করি না তাই আমার মাঝে হিংসে নেই।আমি কখনো নিজেকে নিয়ে গর্ব করি না বা নিজের বুদ্ধিমত্তা বা অর্জনসমূহ নিয়ে গৌরব অনুভব করি না।সব কিছুই আল্লাহর নিয়ামত মনে করি তাই আমার মাঝে অহংকার নেই।আমার মাঝে নিরাশা বা হতাশা কাজ করে না কারণ আমি জানি আমার ভাগ্যে যা আছে তা হবেই।রাতের পরে দিন আসবেই।নিয়ত সৎ থাকলে বিপদ কাটবেই।আমি কখনো কারো ক্ষতি করার চেষ্টা করি না কারণ আমি বিশ্বাস করি “karma” বলে একটি জিনিস আছে।আমার এসব গুণাবলিই আমাকে অন্যান্য মেয়ের থেকে আলাদা “নাফিয়া” বানায়।
কিছুটা সময় এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয় আফিম নাফিয়ার দিকে।এই মুহূর্তে নাফিয়াকে,আফিমের বড্ড অসাধারণ মনে হচ্ছে।হয়তো নাফিয়া অতি সাধারণ তবে কিছু ক্ষেত্রে অতি সাধারণ হওয়াটাই অসাধারণ বিষয়।আফিম ঠোঁটে আলতো হাসি রেখে বলে ওঠে,
-তবে তোমাকে অতি সাধারণ বলা উচিৎ নাকি অসাধারণ?
-অতি সাধারণ।(ঠোঁটে হাসি রেখে বলে নাফিয়া)
আবারও দু’জন চুপ।নিরাবতা কাটিয়ে নাফিয়া বলে ওঠে,
-অনুমতি পেলে একটি ব্যক্তিগত প্রশ্ন করতে চাইছি?
-কি প্রশ্ন?
-আপনি এখনো আপনার প্রাক্তনকে মনে করেন?
-ও আমার ভালোবাসা ছিলো না।
-মানে?
-ও আমার বিজনেস পার্টনার ছিলো।ওদের কোম্পানি টা আমাদের মতো এতো বড় এবং প্রভাবশালী ছিলো না।ব্যবসায় লোস করে এবং ব্যাংক ওদের নামে কেস করে।ওদের এমন দুঃসময়ে আমি ওদের কোম্পানির প্রজেক্টে টাকা ইনভেস্ট করি এবং নিজের কর্মচারী এবং শ্রম দিয়ে প্রজেক্টটা সফল করি।ফলে ওর এবং আমার উভয়েরই ব্যবসায় লাভ হয়।হয়তো এতে ওর আমার প্রতি দূর্বলতা তৈরি হয়।তারপর ও ই আমাকে প্রথম প্রপোজ করেছিলো।রিজেক্ট করে দিয়েছিলাম।কিন্তু ও পিছু ছাড়েনি।পুরো মাস পেছনে পরে থেকে অনুরোধ করে আমি যেনো ওকে একটি সুযোগ দেই।আমার জীবনেও কেউ ছিলো না তাই ভেবে দেখলাম ওকে একটা সুযোগ দেওয়াই যায়।তারপর ওর সাথে সম্পর্ক।কথায় কথায় গায় ঢলে পরা,স্পর্শ করা, লাগাম ছাড়া কথা এসবে খুব বিরক্ত ছিলাম।ওকে সহ্য করাই কঠিন হয়ে পরেছিলো।তাই জন্যে ওকে ব্রেকআপের কথা বলি।আর সেদিনই নিজের চরিত্রের দোষ ঢাকতে আমায়…
কথাটি আর শেষ করতে পারে না আফিম।শেষ বাক্যটি বলার সময় আফিমের কন্ঠস্বরের পরিবর্তন লক্ষ্য করে নাফিয়া।এ বাক্যটি বলার সময় ভীষণ রেগে যায় আফিম।নাফিয়া প্রসঙ্গ পাল্টাতে বলে ওঠে,
-বাহ!মানুষ আপনার সাথে জোর করে প্রেম করে এদিকে আমি জন্মগত সিঙ্গেল!
ঠোঁট উল্টে কথাটি বলে নাফিয়া।আফিম নাফিয়ার দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,
-প্রেম করোনি?(শান্ত কন্ঠে)
-উহু।
-ছেলে বন্ধু ছিলো?
-একটাও না।
-কেনো?
-ছেলেদের সাথে মিশা টা আমার পরিবার পছন্দ করতো না আর আমিও ব্যক্তিগতভাবে অপছন্দ করি।
অবাক হয় আফিম তবে কিছু বলে না।
!!
সকালে দাদীকে পত্রিকার কিছু প্রতিবেদন পড়ে শুনাবার পর নাফিয়া সানিয়া বেগমের সাথে ছুটির বিষয়ে কথা বলতে তার কক্ষের দিকে অগ্রসর হয়।দরজার বাইরে হতে অনুমতি নিয়ে কক্ষে প্রবেশ করতেই সানিয়া বেগম তাকে উদ্দেশ্য করে বলে ওঠে,
-কি ব্যাপার,আজ হটাৎ আমার কক্ষে?আগে কখনোই তো এ মুখো হওনি!
ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে নাফিয়া বলে ওঠে,
-একটি বিষয়ে অনুমতি নিতে এলাম সেই সাথে একটু গল্প করতে যদি সম্মতি দেন?
-দিচ্ছি,বসো।
নাফিয়া,সানিয়া বেগমের পাশে সোফায় বসে বলে ওঠে,
-আসলে আমার কিছু দিনের জন্যে ছুটির প্রয়োজন।আম্মু খুব করে বললো কাল রাতে,তাকে না করতে ব্যর্থ হয়েছি।
-স্বাভাবিক,৩ মাসের বেশি হয়ে গেলো এসেছ আর একদিনের জন্যেও দেখা করতে যাওনি!কবে যেতে চাইছো?
-আজ অথবা কাল?
-আজই যেয়ো।
-জ্বি আচ্ছা।(ঠোঁটে হাসি নিয়ে)
-তবে ছুটি কিন্তু বেশি দিনের পাবে না বলে দিচ্ছি।এ তিন মাসেই আমাদের পরিবারের একজন সদস্যে পরিণত হয়েছো।খুবই লক্ষী একটা মেয়ে তুমি!
ঠোঁটে হাসি নিয়ে নাফিয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে কথাটি বলেন সানিয়া বেগম।নাফিয়াও ঠোঁটে হাসি টেনে নেয়।
-ধন্যবাদ আন্টি।আপনারা সবাই অতিরিক্ত ভালো হওয়ায় সবাইকেই আপন করে নেন।ভালো মানুষগুলো তাদের আশেপাশের মানুষগুলোকেও ভালো ভাবে।
ঠোঁটে হাসিটা অব্যাহত রাখেন সানিয়া বেগম।হটাৎ নাফিয়া কিছু একটা মনে হতেই বলে ওঠে,
-আন্টি,যদি কিছু মনে না করেন তবে একটি প্রশ্ন ছিলো?
-হ্যা,বলো।
-আঙ্কেলকে একবারের জন্যেও দেখলাম না।আসলে..
নাফিয়ার কথা শেষ হবার আগেই সানিয়া বেগম বলে ওঠেন,
-ইউএসএ তে আছেন উনি।নিজের বউ ও কন্যা সন্তানকে নিয়ে।
-জ্বি?
-ভালো বনিবনা না হওয়ায় আফিম ছোট থাকতেই আমরা আলাদা হয়ে যাই।কিন্তু আফিমের সাথে তার বাবার সম্পর্ক খুবই ভালো কারণ আমি কখনোই চাইনি আমার সন্তানের উপর আমার ব্যক্তিগত জীবনের কোনো প্রভাব পরুক।আফিমকে সবসময়ই তার বাবার ভালো দিকগুলো বলেছি এবং কখনো ওর বাবার প্রতি ক্ষোভ জমতে দেইনি।
-আপনার মতো এতো ভালো মানুষের সাথে কারো বনিবনা না হয়েও থাকতে পারে?
উত্তরে আলতো হেসে সানিয়া বেগম বলে ওঠে,
-তুমি যতই ভালো হও না কেনো পৃথিবীর যেকোনো মানুষের জন্যে তুমি উপযুক্ত হবে না।উনিও খুব ভালো একজন মানুষ কিন্তু তার জন্যে আমি এবং আমার জন্যে সে উপযুক্ত জীবন সঙ্গী না।
উত্তরে কিছু বলে না নাফিয়া।সানিয়া বেগমের কথায় যুক্তি খুঁজে পাচ্ছে সে।কিন্তু এ বিষয়টি নিয়ে সে গভীরভাবে ভাবতে চায়।
চলবে।