#আফিম_বড্ড_নেশালো_০২,৪০,৪১
#লেখিকা_মাহযাবীন
#পর্বঃ৪০
কেটে গিয়েছে অনেকটা সময়,অনেকগুলো দিন।তবে বদলায়নি তেমন কিছুই।যেমন সব চলছিলো ঠিক তেমনই চলছে।নাফিয়ার ক্ষেত্রে সকালে কলেজ, বিকেলে পড়াতে যাওয়া এবং সন্ধ্যায় নিজে পড়ার সময়টুকু বাদে সম্পূর্ণ সময় জুড়ে আফিমের যত্ন নেওয়া।আর আফিমের ক্ষেত্রে নাফিয়ার প্রেমিক, ড্রাইভার ও বডিগার্ড হওয়ার সময়টুকু বাদে সম্পূর্ণ সময় কাজে ও কিছুটা সময় বাবার সাথে কাটানো।এভাবেই কেটে যাচ্ছে দিন।
রোজকার মতো ক্লাসরুমের একই বেঞ্চে পাশাপাশি বসে আছে নাফিয়া ও জাফরান।জাফরানের মুখ পানে তাকিয়ে নাফিয়া খুব গভীর পর্যবেক্ষণে ব্যস্ত হয়ে আছে।
এতে অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে জাফরান।মুখ ফিরিয়ে নেয় অন্য দিকে।সময়ের সাথে নাফিয়া যদিও তার খুব কাছের বান্ধবীতে পরিণত হয়েছে তবুও কিছু কথা এখনো নিজের মাঝে লুকায়িত রেখেছে সে।বলার ইচ্ছে হলেও বলা হয়ে ওঠেনি লাজে।
জাফরান নিজের মুখ ঘুরিয়ে নিলেও নাফিয়া দমলো না।সে নিজের গোয়েন্দাগিরি অব্যাহত রাখলো।জিজ্ঞেস করে উঠলো,
-কে মারছে তোকে?ঠোঁট কাটলো কেমনে?
আমতাআমতা করলো জাফরান।কি বলবে খুঁজে পেলো না।নাফিয়া উত্তরের অপেক্ষায় তাকিয়ে আছে তার দিকে।একটু সময় নিয়ে জাফরান নিন্ম স্বরে বলে উঠলো,
-আসলে উনি…
এতোটুকু বলে থামে জাফরান।কথাটা বলতে গিয়ে কেমন যেনো এক অস্বস্তিবোধ কাজ করছে তার মাঝে।
নাফিয়া ব্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে ওঠে,
-উনি মানে তোর হাসবেন্ড?
-হু।
-খুলে বলবি?
নাফিয়ার প্রশ্নে আসেপাশে তাকালো জাফরান।চারিপাশে অন্যান্য শিক্ষার্থীরা আড্ডায় ব্যস্ত যেহেতু এখনো ক্লাস শুরু হতে আধঘন্টা সময় বাকি আছে।এমতাবস্থায় নিজের ব্যক্তিগত কথাগুলো বলতে স্বস্তি বোধ করছে না জাফরান।সে কিছু একটা ভেবে নিয়ে নিজের বেঞ্চ ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো।অতঃপর নাফিয়ার হাত শক্ত করে ধরে কোথাও যাওয়ার উদ্দেশ্যে অগ্রসর হলো।
!!
মেঝেতে রক্ত গড়াগড়ি খাচ্ছে।পরে আছে শাহীন মিঞার তাজা লাশ।তার সামনেই চেয়ারে পায়ের উপর পা তুলে বসে সুখ টান দিচ্ছেন এক ব্যক্তি।তার সামনেই কালো পোশাক পরিহিত এক সুঠাম দেহী পুরুষ দাঁড়িয়ে আছে।নাম ইরফান।
সুখ টান দিতে দিতে লোকটা বলে ওঠেন,
-বুঝলে ইরফান, শাহীন মিঞা লোকটা ভালোই ছিলেন।কিন্তু একটু ভুল করে ফেলেছেন।ভুলটা হচ্ছে, আফিম-নাফিয়ার বিয়ের খবর আমাকে জানাতে বড্ড দেরি করে ফেলেছিলেন তিনি।
আফসোসের সাথে কথাগুলো বলে থামে সে ব্যক্তি।পুনরায় বলে ওঠে,
-আমার প্রতিশোধ পূরণে আফিম-নাফিয়ার বিয়ে হওয়া টা অনেক প্রয়োজন ছিলো।এখন যখন তা হয়েই গেছে তাহলে আর দেরি করার যুক্তি নেই।ইরফান আমি তোমার উপর ভরসা করছি।আশা করি শাহীন মিঞার মতো ভুল করবে না। করলে ওর যে পরিণতি হয়েছে তার থেকেও বাজে পরিণতি তোমার হবে,মাইন্ড ইট।
কথা গুলো কানে আসতেই একশো একটা গালির উদয় হলো ইরফানের মনে।মনে মনেই সে বলে উঠলো,
“শালা ভুঁড়ি দেখছিস নিজের? এই ভুঁড়ি নিয়া তো নিজের চেয়ার দিয়াই নড়তে পারোস না আবার আমার মতো সিক্স প্যাকওয়ালারে হুমকি দেস!”
মনে গালির লম্বা লিস্ট লুকায়িত রেখে ইরফান বলে ওঠে,
-ডোন্ট ওয়ারি স্যার,আই ওন্ট মেইক এনি মিস্টেক।
মৃদু হেসে মাথা নাড়ে সে ব্যক্তি।বলে ওঠে,
-আফিমের উপর আমার প্রতিশোধের শুরু টা হবে ওর বাবার মাধ্যমে।অর্থাৎ প্রথম অ্যাটাক হবে আরহানের উপর।তারপর নাফিয়া।নাফিয়াকে অবশ্য মেরে ফেলা যাবে না কিন্তু আফিমকে জানানো হবে যে নাফিয়া মারা গেছে।বাবা ও স্ত্রী ছাড়া বেচারার আছে টাই বা কে? ব্যাস,বাবা-স্ত্রীর মৃত্যুর পর ওখানেই শেষ হয়ে যাবে আফিম ইবনান।সূর্যের মতো তেজি আফিম নিস্তেজ হয়ে যাবে মুহুর্তেই।মৃত্যু কামনা করতে থাকবে প্রতিটা ক্ষণ।তারপর বেচারাকে যখন আমি মৃত্যু দিবো তার ঠিক আগ মুহুর্তে ওকে জানানো হবে যে ওর স্ত্রী বেঁচে আছে।ঠিক তখন বাঁচার জন্য ছটফট করবে আফিম।বাঁচতে চাইবে নিজের ভালোবাসার জন্য কিন্তু সে গুড়ে বালি।ওকে মৃত্যু দিয়ে নাফিয়াকে বিয়ে করবো আমি।আর যেহেতু নাফিয়া আফিমের বিবাহিত স্ত্রী আর স্ত্রী ছাড়া আফিমের পরিবারের আর কেউ নেই সুতরাং ওর সব প্রোপার্টি নাফিয়া পাবে।আর নাফিয়ার মাধ্যমে সে সব আমার হবে।বলতে গেলে এক ঢিলে তিন পাখি মরবে।প্রথমত আমার প্রতিশোধ পূর্ণ হবে।দ্বিতীয়ত নাফিয়া আমার হবে এবং তৃতীয়টি হচ্ছে শিল্পপতি আরহান সাহেবের সম্পত্তিসহ সনামধন্য ফ্যাশন ডিজাইনার আফিম ইবনানের সম্পত্তিও আমার হবে।
কথাগুলো বলে মুচকি হাসে সে ব্যক্তি। তাকায় ইরফানের দিকে।জিজ্ঞেস করে ওঠে,
-সো আই হোপ তুমি বুঝেছো তোমার পদক্ষেপ গুলো এখন থেকে কি কি হবে?
মাথা নেড়ে ইরফান বলে ওঠে,
-জ্বি স্যার।
উপরে উপরে ‘জ্বি স্যার’ বললেও মন ঘৃনার ভরে উঠলো ইরফানের।মনে মনে ভাবলো এমন এক বুড়ো লোক কি করে নিজের সন্তানের বয়সী একটা মেয়েকে বিয়ে করার কথা চিন্তা করছে!
!!
“আমার জীবন অন্য সবার মতো স্বাভাবিক না নাফিয়া।আমি দীর্ঘ কয়েক মাস ধরে অস্বাভাবিক মানসিক চাপের মধ্যে আছি।আমি আর নিতে পারছি না।”
কথাগুলো বলেই ডুকরে কেঁদে উঠলো জাফরান।সম্পূর্ণ খালি এক ক্লাস রুমের দরজা চেপে দিয়ে একই বেঞ্চে পাশাপাশি বসেছে তারা দু’জন।বসবার পরই জাফরান উক্ত বাক্যের মাধ্যমে তার নিজের মাঝে চেপে রাখা ক্ষতগুলো বলতে আরম্ভ করলো।
জাফরানের চোখে পানি দেখে তাকে জড়িয়ে ধরলো নাফিয়া।কি বলবে বুঝে উঠতে পারছে না সে।জাফরান নিজে থেকেই আবারও বলতে আরম্ভ করলো,
-যুগ পরিবর্তন হলেও আমার পরিবারের মানুষের মানসিকতা যুগের সাথে পরিবর্তন হলো না।তারা এখনো সেকেলে ধারণা পুষে রেখেছে নিজেদের মাঝে।যেমন ধর ১৫-১৬ বছর বয়সে মেয়েদের বিয়ে না দিলে পরে আর বিয়ে দেওয়া যায় না।এমন আরো আজগুবি চিন্তাভাবনা তাদের।আর তাদের এসব মানসিকতার কবলে পরে ১৬ বছরেই বিয়ে হয় আমার।শারীরিক সম্পর্ক সমন্ধে খুব বেশি ধারণা ছিলো না আমার।ইন্ডিয়ান মুভিতে দেখা কিসিং সিন আর বইয়ের ঐ সামান্য নলেজই ছিলো।কিন্তু বিয়ের প্রথম রাতেই!
এতোটুকু বলে থামে জাফরান।জিহবা দ্বারা নিজের ওষ্ঠ ভিজিয়ে আবারও বলে ওঠে,
-ভাবিরা ইশারা ইঙ্গিতে কিছু বলেছিলো যার অর্থ তখন বুঝি নাই।কথাগুলো যে অশ্লীল তা বুঝেছিলাম কিন্তু তার অর্থগুলো কেমন গভীর ছিলো তা বুঝিনি। তারপর সেই প্রথম রাতে শরীর ব্যথা হওয়ার পর ভয় পেলাম ভীষণ।শারীরিক ও মানসিক উভয় দিকে যন্ত্রণা অনুভব করছিলাম।না পেড়ে মায়ের সাথে শেয়ার করলাম সব।মা বুঝিয়ে বলার পর মানসিক দিক থেকে একটু শান্তি মিললো।কিন্তু বিয়ের পর থেকে নিজেকে একটুও সময় দেওয়ার সময় পাইনি।শাশুড়ীর কটু কথা, সংসারের কাজ আর রাতে স্বামীর চাহিদা পূরণ করতে যেয়ে নিজের শখ পূরণ, পড়াশোনা সবকিছু থেকে কেমন জানি দূরে সরে গিয়েছি।বিশ্বাস কর নাফিয়া,যতক্ষণ কলেজে থাকি এই এতোটুকু সময়ই আমার শান্তি, আমার স্বর্গ।আর বাসায় গেলেই মনে হয় আমি মানুষ নই বরং কোনো রোবট।এই জীবন আমার আর ভালো লাগে না।
সবটা শুনলো নাফিয়া।ভাবলো, সে শারীরিক সম্পর্কের সমন্ধে অবগত সেই নবম শ্রেণি থেকে।তার মাম্মিই তাকে বুঝিয়ে বলেছিলো, সেই সাথে সাবধান করেছিলো ‘ব্যাড টাচ’ এবং প্রেমের নামে হওয়া অশ্লীলতা সমন্ধে।আর টিভি,মোবাইল ফোনসহ বান্ধবীদের কাছ থেকেও এসব সমন্ধে কম ধারণা পায়নি সে।তবে সবাই তো সমান নয়।নাফিয়া আগেভাগেই জানার সুযোগ পেলেও জাফরান পায়নি ব্যাপারটা খুব অস্বাভাবিক নয়।
আবার ভেতর থেকে খারাপ লাগা অনুভব করছে নাফিয়া।মনে মনে সে ভাবছে জাফরানের জীবনটা এভাবে নষ্ট হওয়ার মূলে কি শুধু ‘বাল্যবিবাহ’ নাকি আমাদের সমাজে আরও কিছু পরিবর্তন আনা ভিষণ প্রয়োজন?
!!
কুসুম চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে।তার সামনেই বসা রিয়াদ।রিয়াদ কিছুটা সময় তার পা হতে মাথা অব্দি চোখ বুলিয়ে বলে ওঠে,
-নতুন চাকরি খুঁজুন মিস.কুসুম।আগামী মাস হতে আপনাকে এ অফিসে দেখতে চাই না।
স্বাভাবিক স্বরে কথাগুলো বললো রিয়াদ।তার কথা শুনে মৃদু চমকালো কুসুম।অবাক কন্ঠে জিজ্ঞেস করে উঠলো,
-আমার ভুলটা কি স্যার?আমার কাজে কি কোনো বড় রকমের ভুল হয়ে গিয়েছে?
-কাজে না আপনার তো স্বভাবেই ভুল।সময়ের সাথে স্বভাবও পরিবর্তন হয় আপনার।আর এমন গিরগিটি আমাদের অফিসে থাকুক তা আমি চাই না।
এবার অপমানবোধ করলো কুসুম।বুঝলো না রিয়াদের এমন কথার অর্থ।স্বভাবে ভুল বলতে কি বুঝাচ্ছে রিয়াদ?
আবার চাকরি টা ভীষণ প্রয়োজন কুসুমের কারণ এই চাকরি গেলে আবার যদি কোনো চাকরি না পায় তাহলে বিয়ের পীড়িতে বসতে হবে তাকে।বিয়ের সম্পর্কে স্ত্রী, স্বামীর ভালোবাসার পাত্রী হয় কিন্তু তার ক্ষেত্রে সে হবে দয়ার পাত্রী যা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারবে না সে।
রিয়াদের প্রতি রাগ তৈরি হলেও কুসুম নিজেকে সংযত রেখে স্বাভাবিক কন্ঠে জিজ্ঞেস করে ওঠে,
-গিরগিটি, স্বভাবে ভুল!কি বলছেন স্যার?
কুসুমের প্রশ্নে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় রিয়াদ।মেয়েটির দিকে এক কদম এক কদম করে আগায় সে।বলতে আরম্ভ করে,
-‘কৃষ্ণকলি’ ফেসবুক আইডি যে আপনার তা অস্বীকার করতে পারবেন?ঐ আইডি থেকে আমাকে বৃষ্টি বিলাস করতে বলা,লং ড্রাইভে যেতে বলা,ট্যাভেল করতে বলা আর অফিস আওয়ারে আমার দিকে খেয়াল রাখা এসব নিজ থেকেই তো করতেন।আবার নিজে থেকেই আইডি ডিএক্টিভ করা,আমাকে ইগনোর করা।এগুলোকে কি বলবেন মিস.কুসুম?
চোখ জ্বলজ্বল করছে কুসুমের।রিয়াদ অনেকটা কাছে চলে এসেছে তার।উভয়ই একে-অপরের নিঃশ্বাস অনুভব করতে পারছে তারা।চোখে চোখ রাখা তাদের একে-অপরের।কিছুটা সময় স্তব্ধ থেকে কুসুম নিন্ম স্বরে বলে ওঠে,
-এগুলোকে কি বলে ব্যাখ্যা করবো তা জানা নেই আমার।শুধু এতোটুকু বলবো, কালো বর্ণাদের প্রেমে পড়া বারণ।
চলবে।
#আফিম_বড্ড_নেশালো_০২
#লেখিকা_মাহযাবীন
#পর্বঃ৪১
“নিজের গায়ের রং কালো হলে কেউকে ভালোবাসা যাবে না কোন গ্রন্থে লেখা আছে?”
ব্রু কুঁচকে উক্ত প্রশ্নটি করে রিয়াদ।কুসুম মাথা নুইয়ে নেয়।রিয়াদ তার এতোটাই কাছে যে ছেলেটার শরীর থেকে আসা পার্ফিউমের ঘ্রাণ নাকে এসে লাগছে তার।সেই সাথে ছেলেটার গমর নিঃশ্বাস তার চোখমুখে আছড়ে পরছে।
কেমন এক অস্বস্তি ঘিরে ধরেছে কুসুমকে।হৃৎস্পন্দন অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে।রিয়াদের এতোটা কাছে আসায় অনুভূতির তীব্রতা সামলে উঠতে পারছে না মেয়েটার হৃদয়।তবুও নিজেকে সামলে নেওয়ার চেষ্টা করলো কুসুম।এক ঢোক গিলে নিজেকে কিছুটা স্বাভাবিক করে রিয়াদের করা প্রশ্নের উত্তর হিসেবে বলে উঠলো,
-সমাজে বসবাসরত মানুষের হৃদয়ে লেখা আছে স্যার।গায়ের রং কালো মানেই অসুন্দর আর গায়ের রং ফর্সা মানেই সে সুন্দর।ফেস কাটিং কার কেমন তা নিয়ে মানুষের মাথা ব্যথা নেই।কার মন কতটা সুন্দর তা দিয়েও কারো কিচ্ছু যায় আসে না।যা ম্যাটার করে তা হলো গায়ের রং।আমি তো কালোবর্ণা,কুৎসিত আমাকে কেউ ভালোবাসবে না, শুধু দয়া দেখাবে আর আমি সে দয়া গ্রহণ করতে পারবো না স্যার।আসলেই পারবো না।
কথা কেমন আঁটকে আঁটকে যাচ্ছে কুসুমের।বহু কষ্টে কান্না আঁটকে রেখে কথাগুলো বললো সে।
রিয়াদ চুপচাপ তার চোখের দিকে তাকিয়ে আছে।ছেলেটা গভীর পর্যবেক্ষণে ব্যস্ত।কুসুম যা বলেছে তা তো শুনেছে তবে পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে বুঝার চেষ্টা করছে মেয়েটার বলতে না পারা হাজারো অনুভূতিগুলো।
রিয়াদকে চুপ থাকতে দেখে কুসুম আবারও বলে উঠলো,
-প্রথমে স্বপ্নের দুনিয়ায় বাস করছিলাম।ভেবেছিলাম, রূপকে প্রাধান্য না দিয়ে আপনি আমার মনের প্রেমে পড়বেন।কিন্তু আমার গায়ের রং টাকে তো এতো বছরে আমার মা-ই মানতে পারলো না সেখানে আপনার কাছ থেকে আশা করাটা বোকামি হয়ে যাচ্ছিলো।সে জন্যেই এগিয়ে মাঝ পথ অব্দি এসে আবার ফিরে গিয়েছি।আগানোর আর সাহস হয়নি।কারণ অন্তত আমি যাকে ভালোবাসি তার চোখে আমি আমার জন্য করুণা দেখতে পারবো না স্যার।
কথাগুলো শেষ করে কুসুম নিজের নুইয়ে রাখা মাথা উপরে তুলে রিয়াদের দিকে তাকাতেই কয়েক সেকেন্ডের মাঝে ঘটে গেলো এক সাংঘাতিক কান্ড।কুসুমের ওষ্ঠ ছোঁয়া পেলো ভালোবাসার।রিয়াদ এক হাতে কুসুমের কোমর ও অপর হাতে মেয়েটির গাল আঁকড়ে ধরে নিজের ওষ্ঠ দ্বারা শুষে নিতে আরম্ভ করলো কুসুমের দুঃখগুলোকে।এঁকে দিতে আরম্ভ করলো ভালোবাসার স্পর্শ।
প্রথমে চমকে চোখ বড় করে তাকিয়ে রিয়াদকে দূরে সরানোর চেষ্টা করলো কুসুম।কিন্তু সে যতই দূরে সরাতে চাচ্ছিলো রিয়াদ ততটাই নিবিড়ভাবে আঁকড়ে ধরছিলো তাকে।অতঃপর হাল ছেড়ে চোখ বুঁজে নিলো কুসুম।অনুভব করতে আরম্ভ করলো রিয়াদের স্পর্শে থাকা ভালোবাসাটাকে।
পুরো অফিসে এ মুহূর্তে শুধু তারা দু’জনেই আছে।সবটা রিয়াদের অবদানে।কুসুমকে আগে থেকেই বলে রেখেছিলো সে আজ ওভার ডিউটি করবার জন্যে ফলে অফিস ছুটি হওয়ায় সবাই বিদায় নিলেও থেকে গিয়েছিলো কুসুম।রিয়াদ নিজেও জানতো না পরিস্থিতি এমন হবে।সে তো শুধু জানতে চাইছিলো কুসুমের বদলে যাওয়ার কারণ।
কুসুমের তার প্রতি আগ্রহ,যত্ন নেওয়া,ফেসবুকে ম্যাসেজ দিয়ে বিরক্ত করা,জীবন উপভোগের উপদেশ দেওয়া সব মিলিয়ে রিয়াদ বুঝেছিলো মেয়েটার অনুভূতি।অনিচ্ছাকৃতই সেসবে সে নিজেও অভস্ত্য হলো।তারপর হটাৎ কুসুমের বদলে যাওয়া মানতে পারছিলো না সে।অনুভব করছিলো এই মেয়েটার যত্নগুলোই তার ব্যস্ত জীবনের এক টুকরো প্রশান্তি।
বেশ খানিকটা সময় পর কুসুমের ওষ্ঠ ছাড়লো রিয়াদ।কপালে কপাল ঠেকিয়ে জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিতে নিতে তাকালো মেয়েটার মুখ পানে।দেখলো কুসুমের চোখের এক কোণে এক বিন্দু অশ্রু কণা।
রিয়াদ আলতো হাতে বৃদ্ধাঙ্গুলি দ্বারা মুছে দিলো সে জল।বলে উঠলো,
-সমাজের সবাইকে এক ভাবা টা ঠিক মিস.কুসুম?
উক্ত প্রশ্ন ছুঁড়ে ক’সেকেন্ড নিরব রইলো রিয়াদ।পুনরায় বলতে আরম্ভ করলো,
-‘কালো’ আমার চোখে সব থেকে সুন্দর রঙ।তাই বলে শুধু জামাকাপড় আর অন্যান্য জিনিসের ক্ষেত্রেই যে কালো রঙ টা পছন্দ এমনটা নয়।গায়ের রঙের ক্ষেত্রেও।আই অ্যাম অ্যা ব্লাক লাভার মিস.কুসুম এন্ড আই লাভ ইউর স্কিন টোন।
ফ্যাল ফ্যাল চোখে রিয়াদের দিকে তাকিয়ে আছে কুসুম।থমকে গিয়েছে মেয়েটা।এই মুহুর্তটাকে স্বপ্ন বলে মনে হচ্ছে তার।নিজের চোখ,নিজের কানকে ঠিক বিশ্বাস করতে পারছে না সে।
রিয়াদ কুসুমের চোখে চোখ রেখেই আবারও বলে ওঠে,
-আমি মানুষটা ভালোবাসার কাঙ্গাল মিস.কুসুম।আমি সেই অভাগা যাকে ছোট বেলায়ই তার পরিবারের সঙ্গ হারাতে হয়েছিলো টাকা কামানোর জন্য।১২ বছর বয়সে পরিবার ছেড়ে আফিম স্যারের সঙ্গী হওয়ার দায়িত্ব ঘাড়ে নিয়েছি।যে বয়সে বাচ্চারা মায়ের কাছে এটা খাবে,ওটা খাবে বলে বায়না করে সে বয়সে নিজের অপছন্দের খাবারও চুপচাপ খেয়ে নিতে শিখেছি,সমঝোতা করতে শিখেছি,নিজের পছন্দ-অপছন্দের তোয়াক্কা না করে শুধু নিজের দায়িত্বে মনোনিবেশ করে কাটিয়ে দিয়েছি ১৫ টা বছর।আমার কাঁধে ছোট বেলা থেকেই দায়িত্বের বোঝা।কিন্তু আমার দায়িত্ব টা নেওয়ার কেউ ছিলো না,আমার খেয়াল রাখার কেউ ছিলো না,আমার যত্ন নেওয়ার কেউ ছিলো না।এদিক থেকে আমি ভীষণ অভাবী মিস.কুসুম।এতো বছরের অভাবী জীবনে আপনি আমার অভাব পূরণ হয়ে এসেছেন,আমার মনের চাহিদা পূরণ হয়ে এসেছেন।আমি চাই না আবারও অভাবে নিমজ্জিত হতে।আপনি আমার অভাব পূরণ হয়ে সারাজীবন আমার সাথে থাকবেন মিস.কুসুম?আমাকে অসীম পরিমাণ ভালোবাসতে পারবেন?যেভাবে যত্ন নিতেন সেভাবেই সারাটা জীবন আমার যত্ন নিতে পারবেন?আপনি কি হবেন আমার কৃষ্ণচূড়া ফুল?
!!
কফির কাপে এক চুমুক বসিয়ে আফিম তাকায় নাফিয়ার দিকে।মেয়েটাকে দেখে মনে হচ্ছে সে কোনো এক গভীর চিন্তায় মগ্ন।ব্রু কুঁচকায় আফিম।নিজের চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় সে।হাতে কফির কাপ খানা নিয়ে এগিয়ে যায় নাফিয়ার দিকে।
-Are you worried about something Miss. Sheikh?[তুমি কি কিছু নিয়ে চিন্তিত মিস.শেখ?]
আফিমের প্রশ্নে ধ্যান ভাঙে নাফিয়ার।তাকায় সে আফিমের দিকে।জিজ্ঞেস করে ওঠে,
-বাল্য বিবাহ নিয়ে আপনার কি ধারণা আফিম?
হটাৎ নাফিয়ার এমন প্রশ্নের কারণ বোধগম্য হয় না আফিমের।সে গিয়ে বসে নাফিয়ার পাশে।কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে ওঠে,
-হটাৎ?
আফিমের এ প্রশ্নেরই যেনো অপেক্ষায় ছিলো নাফিয়া।উৎসাহী ভঙ্গিতে আফিমের দিকে ফিরে বসে সে।বলতে আরম্ভ করে জাফরানের সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনা গুলো।আফিম মনোযোগী শ্রোতার ন্যায় শুনছে ও কফির মগে ক্ষণে ক্ষণে চুমুক বসাচ্ছে।
পুরো ঘটনাটা শোনার পর আফিমের মুখে গম্ভীরতা ফুটে ওঠে।সে নিজের হাত থেকে কফির মগ খানা রাখে টেবিলের উপর।নড়েচড়ে নাফিয়ার মুখোমুখি হয়ে বসে।বলে ওঠে,
-প্রতিটা ক্ষেত্রেরই দু’টো দিক থাকে।একটা ভালো, একটা খারাপ।এখন ‘বাল্যবিবাহ’র ক্ষেত্রেও বিষয়টা এমন।যদি তুমি খারাপ দিক বলতে বলো তাহলে তার সংখ্যা অনেক।যেমনটা জাফরান সাফার করতেছে।ব্যাখ্যা দিতে গেলে, বাল্যবিবাহ হলো মেয়েদের ক্ষেত্রে ১৮ বছরের নিচে যেকোনো বয়সে বিয়ে হওয়া।এ বয়সের মধ্যে ১০-১৫ বছর বয়সের মেয়ের যদি বিয়ে দেওয়া হয় তাহলে এখানে আসলে এক বিন্দুও ভালো কিছুর ছিটেফোঁটা নেই বরং আমার মতে এটা শিশু নির্যাতন, মানসিকভাবে একটা মানুষকে পীড়া দেওয়া আর তার পুরো ভবিষ্যৎ টা নষ্ট করে দেওয়াই এই বিয়ের ফল।
এবার আসি ১৬-১৮ বয়সের মধ্যে যদি বিয়ে দেওয়া হয় সে ব্যাপারে।এক্ষেত্রে ভালো-মন্দ দুই দিকই আছে।খারাপ দিক হলো এই বয়সে যেকারোরই জ্ঞানের পরিধি অনেক কম থাকে।সংসারের মতো বড় এক দায়িত্ব নেওয়ার জন্য সে মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকে না।সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে যে ত্যাগ বা সমঝোতা করতে হয় সেগুলোর জন্যও তারা প্রস্তুত থাকে না বা বলা যায় যে সবটা বুঝে উঠতে পারে না।ফলে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখা অনেকটা কঠিন হয়ে যায়।আবার,তাদের পড়াশোনায়ও অনেক ক্ষতি হয়।কারণ স্বামী সংসার ম্যানেজ করে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়াটা মোটেও সহজ না।তারপর,শারীরিক সম্পর্কের বিভিন্ন বিষয় সমন্ধেও তাদের খুব একটা ধারণা থাকে না।একটু উপর-নীচ কিছু হলে তারা ডিপ্রেসড হয়ে যায়।লজ্জা-জড়তার জন্য কেউকে বলতে পারে না।এক প্রকার নিজেরা ভোগে। সেই সাথে অনেকে আবার নলেজ না থাকায় অনিচ্ছাকৃত কন্সিভ করে ফেলে।নতুন সংসার তার উপর বাচ্চার রেসপনসেবলিটি একটা মেয়ের উপর অনেক চাপ সৃষ্টি করে।
আবার অনেক শাশুড়ী আছেন বিয়ে হতে না হতেই বাচ্চা নেওয়ার জন্য প্রেসার ক্রিয়েট করেন।এভাবেও অনেককে বাধ্য হয়ে বাচ্চা নিতে হয়।ফলে তাদের জন্য পড়াশোনা করাটা অনেক কষ্টসাধ্য হয়ে যায় যা তাদের ভবিষ্যৎকে প্রভাবিত করে।
এইসব ছিলো খারাপ দিক।এবার আসি ভালো দিকে।ভালো দিক হচ্ছে, বিয়ের মাধ্যমে মানুষেরা অনেক হারাম থেকে বেঁচে যেতে পারে।বয়ঃসন্ধিকালে পদার্পণের পর প্রতিটা মানুষই একটা চাহিদা অনুভব করে।সেটা শরীরের হোক বা মনের।যেমন বলা হয় প্রেমে পড়ার আদর্শ বয়স হচ্ছে ষোল। শত না চাওয়া সত্বেও এ বয়সে ৯৮% মানুষের জীবনে প্রেম আসে।এখন যদি বিয়েটা এ বয়সে হয় তাহলে প্রেমটা তো জামাইর সাথেই হবে যা হালাল।এতে শারীরিক ও মানসিক উভয় চাহিদাই মিটবে হালাল ভাবে।তখন আর হারামে জড়ানোর প্রয়োজন পড়বে না।
সবটা শুনে মনে হবে খারাপ দিকটাই বেশি।আর বাস্তবে আসলেই এ বিয়ের ক্ষেত্রে খারাপ দিকটাই বেশি।কিন্তু সব খারাপ দিকগুলোকে ভালোতে রুপান্তরিত করা সম্ভব যদি আমাদের সমাজে একটু পরিবর্তন আনা যায়।যেমন ধর বিয়ের পর যদি স্বামীসহ পরিবারের সবাই মেয়েটার মানসিক অবস্থা বুঝে তাকে সাহায্য করে, ছাড় দেওয়ার মনোভাব রাখে, তার মানসিক স্বাস্থ্যের দিকে খেয়াল রাখে এবং শারীরিক বিষয়গুলো নিয়ে তাকে স্পষ্ট ধারণা দেয় তাহলে সম্ভব বাল্যবিবাহের নেতিবাচক দিকগুলো থেকে পরিত্রাণ পাওয়া।
অবশ্য এ ক্ষেত্রে শাশুড়ী ও স্বামীর ভূমিকা অনেক।
চলবে।