আফিম_বড্ড_নেশালো_০২,৪২,৪৩

0
1217

#আফিম_বড্ড_নেশালো_০২,৪২,৪৩
#লেখিকা_মাহযাবীন
#পর্বঃ৪২

“আফিম সমাজে পরিবর্তন আনা কি সম্ভব কোনো ভাবে?”
উৎসুক কন্ঠে প্রশ্নটি করে নাফিয়া।আফিম সম্মতি দিয়ে বলে ওঠে,
-সম্ভব।
হাসি ফোটে নাফিয়ার ঠোঁটে।সে দ্বিগুণ আগ্রহ নিয়ে প্রশ্ন করে ওঠে,
-কিভাবে?
আফিম সময় নেয় কয়েক সেকেন্ড।অতঃপর বলে ওঠে,
-সমাজে পরিবর্তন তখন আসবে যখন সমাজে বসবাসরত মানুষের মানসিকতায় পরিবর্তন আসবে।আর মানুষের মানসিকতায় পরিবর্তন তখনই আসবে যখন তারা কোনো ইতিবাচক কিছুর দ্বারা প্রভাবিত হবে এবং কোনটা সঠিক ও কোনটা ভুল তা উপলব্ধি করতে পারবে।
কথাগুলো বলে থামে আফিম।নাফিয়া ভাবুক কন্ঠে বলে ওঠে,
-প্রভাবিত করা,উপলব্ধি করানো এগুলো তো অনেক কঠিন আফিম।তাই না?
-উম, কঠিন আবার কঠিন না।
এবার ব্রু কুঁচকায় নাফিয়া। জিজ্ঞেস করে ওঠে,
-মানে?
-মানুষকে অনেকভাবে প্রভাবিত করা যায়।যেমন তুমি যার সাথে বেশি মিশবে তার চিন্তা-চেতনা তোমাকে প্রভাবিত করবেই।সময়ের সাথে দেখা যাবে,তুমিও অনেক ক্ষেত্রে তার মতো করে ভাবতে শুরু করেছো।এটা খুবই স্বাভাবিক।মানুষের ন্যাচার টাই এমন।
তারপর মানুষকে সবথেকে বেশি প্রভাবিত করে উপন্যাস,নাটক,সিনেমা,পত্রিকা ইত্যাদি।যেমন, একজন লেখক খুব সহজেই পারেন তার লেখনীর মাধ্যমে তার পাঠকদের ম্যাসেজ দিতে।লেখক যখন নেতিবাচক কিছুকে পাঠকের কাছে ইতিবাচক বলে উপস্থাপন করে তখন অনেক পাঠকই ঐ নেতিবাচক জিনিসটাকে ইতিবাচক ভেবে গ্রহণ করে,সেই লেখনী দ্বারা প্রভাবিত হয় তারা।একই ভাবে নাটক,সিনেমা এবং পত্রিকার ক্ষেত্রেও।একজন স্ক্রিপ্ট রাইটার, প্রতিবেদক,লেখক চাইলেই পারেন সমাজে ইতিবাচকতা ছড়িয়ে দিতে।একজন লেখক তার কল্পনার জগতে একটা সুন্দর সমাজের চিত্র অঙ্কন করতে পারেন এবং পারেন লেখনীর মাধ্যমে সেই সুন্দর সমাজ পাঠকদের সামনে উপস্থাপন করতে।তার লেখনী পড়ে পাঠকরাও সেই সুন্দর সমাজের চিত্র নিজের মস্তিষ্কে ধারণ করবে,উপলব্ধি করবে এবং সেখান থেকেই শুরু হবে ধীরে ধীরে পরিবর্তন। কিন্তু আজকাল বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই লেখক-লেখিকারা বাস্তবতা ফুটিয়ে তুলতে সমাজের নানান কুৎসিত ও নেতিবাচক দিক নিয়ে লেখেন এতে পাঠক সমাজে নেতিবাচকতার ছড়াছড়ি লক্ষ্য করা যায়।আবার অনেকের কাছে খারাপ জিনিস টাও জাস্টিফাইড হয়ে যায়।লেখক-লেখিকারা যেখানে চাইলেই পারেন সৌন্দর্যের ছড়াছড়ি করতে সেখানে কেনো সমাজের কুৎসিত দিক গুলোর ছড়াছড়ি করেন তা বুঝি না।তবে কেউ কেউ আছে কুৎসিত দিক তুলে ধরার সাথে সাথে আবার বিপরীত তাও তুলে ধরেন।যেমন একই জিনিস বাস্তবতা এবং কল্পনা দু’টোই লেখেন ফলে পাঠকরা কল্পনার সৌন্দর্য টা অনুভব করে, উপলব্ধি করতে পারে এবং তাদের মাঝে সৃষ্টি হয় পরিবর্তনের সূক্ষ্ম এক বীজ।

!!
বাসা হতে নিজের গাড়ি খানা নিয়ে বেরিয়েছেন আরহান সাহেব।উদ্দেশ্য বড় ভাইয়ের বাড়ি।বেশ ক’দিন ধরে তার বড় ভাই বারংবার কল করে তাকে দেখা করবার জন্য নিজের বাসায় দাওয়াত দিয়ে চলছেন। অতঃপর বড় ভাইয়ের সাথে সাক্ষাৎ করবার উদ্দেশ্যে নিজেই গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন তিনি।ড্রাইভারকেও আজ সাথে নিলেন না, বডিগার্ডদেরও ছুটি দিয়ে দেয়েছেন।সবসময় কি ভালো লাগে বডিগার্ড সাথে নিয়ে ঘুরতে?মানুষ কেবল অভাবে হাঁপায় না বরং অতি বিলাসিতাতেও হাঁপিয়ে ওঠে।
ড্রাইভিং করে বেশ খানিকটা পথ পাড় করেছেন আরহান সাহেব।এখন আছেন হাই ওয়েতে।ড্রাইভিং এর মাঝেই গাড়ির লুকিং গ্লাসের মাধ্যমে হটাৎ তিনি লক্ষ্য করেন দু’টো গাড়ি তাকে ফলো করছে তাও অনেকটা সময় ধরে।
মনে হটাৎ ভয় উৎপন্ন হয় আরহান সাহেবের।কারা তাকে ফলো করছে এবং কেনো? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পায় না সে।
গাড়ি চালিয়ে যাওয়ার মাঝেই তিনি তড়িঘড়ি করে কল করেন রিয়াদকে।
-আসসালামু আলাইকুম স্যার।
-রিয়াদ দু’টো গাড়ি ফলো করছে আমাকে।শীঘ্রই কিছু করো।
নিশ্চিন্ত স্বরে রিয়াদ বলে ওঠে,
-দু’টো না চারটা গাড়ি স্যার।
-মানে?
-মানে দু’টো গাড়ি আপনার শত্রু পক্ষের আর দু’টো গাড়ি আমাদের যা লুকিয়ে আপনাদের ফলো করছে। তারা আপনার গাড়ির উপর অ্যাটাক করলে তাদের উপর দ্বিগুণ পাল্টা অ্যাটাক হবে।
এবার স্বস্তির নিঃশ্বাস নিজের মাঝে টেনে নেন আরহান সাহেব।ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে বলে ওঠে,
-কিন্তু তুমি জানলে কি করে আমি বেরিয়েছি আর বিনা অনুমতিতে আমার পেছনে লোক পাঠিয়েছোও বা কেনো?
-এসব আফিম স্যারের আদেশ,স্যার।তিনিই ফোন করে বলেছেন আপনার উপর অ্যাটাক হবে তাই যেনো কড়া সিকিউরিটির ব্যবস্থা করি।
ব্রু কুঁচকায় আরহান সাহেব।ভাবে, আফিম কি করে জানলো তার উপর অ্যাটাক হবে!এসব ভাবার মাঝেই কিছু একটার শব্দ কানে আসলো আরহান সাহেবের।সামনে লক্ষ্য করতেই দেখলেন একটি ট্রাক হাই স্পিডে এগিয়ে আসছে তার দিকে।তৎক্ষনাৎ সে কি করবে তা বুঝতে পারলেন না তিনি।কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে এক বিকট শব্দ ছড়িয়ে পড়লো আশেপাশে।রক্তে মাখামাখি আরহান সাহেবের শরীর খানা নিস্তেজ হয়ে পড়লো মুহূর্তেই।

!!
“স্যার খবর এসেছে যে, আরহানের গাড়ির এক্সিডেন্ট হয়েছে ট্রাকের সাথে।”
কথাখানা বলে থামে ইরফান।তার সামনে পায়ের উপর পা তুলে বসে থাকা লোকটা মৃদু হাসে।বলে ওঠে,
-তোমার মনে হয় এটা এক্সিডেন্ট?
মাথা নিচু করে ইরফান বলে ওঠে,
-নো স্যার।আপনি করিয়েছেন তা বুঝতে পারছি।কিন্তু স্যার এ কাজটা তো আমাকে দিয়েছিলেন তাহলে আপনি নিজে কেনো শুধু শুধু কষ্ট করলেন?
-কারণ আছে ইরফান।ব্যাটা আফিম ইবনানকে তুমি এখনো ঠিক ঠাক চেনো না তাই এই কাজ তুমি করতে গেলে আরো সময় নষ্ট হতো।তুমি কি জানো আরহানের গাড়ির পেছনে তুমি যে দু’টো গাড়ি পাঠিয়েছিলে তাদের অ্যাটাকের পাল্টা অ্যাটাক আফিম রেডি করে রেখেছিলো?
বিস্ফোরিত চোখে নিজের বসের দিকে তাকিয়ে ইরফান বলে ওঠে,
-না স্যার।
হাসে লোকটা।বলে ওঠে,
-খেলা তো সবে শুরু হলো ইরফান।জঙ্গলে বসে সিংহের সাথে যুদ্ধ ঘোষণা করেছি।নিশ্চয়ই তোমার মতো এতো কাঁচা খেলোয়াড় হলে টিকতে পারতাম না।আফিমের সাথে জিততে হলে শক্তি না বুদ্ধির ব্যবহার করতে হবে।
বসের কথায় মাথা নাড়ে ইরফান।জিজ্ঞেস করে ওঠে,
-পরবর্তী প্ল্যানটা কি স্যার?
-তা অলরেডি শুরু হয়ে গেছে।এসময় নাফিয়া টিউশনিতে ব্যস্ত থাকে আর আফিম গাড়িতে বসে ল্যাপটপে নিজের কাজ করে।প্রতিদিনের একই নিয়ম।ভেবেছিলাম এটাকে কাজে লাগাই।নাফিয়া যে বাসায় পড়াতে গিয়েছে তার চারিপাশে আমার লোকেরা এখন ঘেরাও করে আছে।আরহানের এক্সিডেন্টের খবর আফিমের কাছে পৌঁছাতেই ছেলে বাপকে দেখার জন্য ছুটবে।সেসময় নাফিয়ার জন্য অপেক্ষা করার প্রশ্নই উঠে না।আফিম নাফিয়াকে রেখে আরহানের কাছে যাওয়ার জন্য রওয়ানা হতেই আমার লোকেরা নাফিয়াকে কিডন্যাপ করে নেবে।আর তার আধ ঘন্টার মধ্যেই নিজের প্লেনে চড়ে নাফিয়াসহ দেশ ছাড়বো আমি।আফিম নাফিয়াকে খোঁজার চেষ্টায় কোনো কমতি রাখবে না জানি।তাই কোনো দেশে বেশি দিন থাকবো না আমি।লাগলে পুরো ওয়ার্ল্ড ট্যুর দিবো যাতে আফিম কোনো ভাবেই আমি পর্যন্ত পৌঁছাতে না পারে।আর দেশে থেকে তোমার প্রধান কাজ হবে আফিমকে এটা বিশ্বাস করানো যে নাফিয়া আর বেঁচে নেই।গট ইট?

উত্তরে শুকনো ঢোক গিলে মাথা নাড়ে ইরফান।

!!
“স্যার,আরহান স্যারের এক্সিডেন্ট হয়েছে।”
আফিম কল রিসিভ করতেই ফোনের অপর পাশ হতে উক্ত বাক্যটি বলে ওঠে রিয়াদ।মুহূর্তেই চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে আফিমের।হাত মুষ্টিবদ্ধ করে সে দাঁতে দাঁত চেপে বলে ওঠে,
-হাও?
আফিমের রাগের পরিমাণ অনুমান করতে ব্যর্থ হয় না রিয়াদ।সে জানে তার ভুলের জন্যই আজ এ পরিস্থিতি।আফিম তো আগেই সর্তক করেছিলো তাকে,নিজের বাবার সুরক্ষার দায়িত্ব সঁপে ছিলো তার কাঁধে।আরহান সাহেবের দায়িত্ব তার কাঁধে থাকার পরও লোকটার এক্সিডেন্ট হওয়া অবশ্যই রিয়াদের দায়িত্ব পালনে খুঁত থাকাটাকেই নির্দেশ করছে।
অপরাধবোধে উত্তর দিতে পারছিলো না রিয়াদ।রিয়াদের নিরবতা রাগ বৃদ্ধি করলো আফিমের।সে এবার চেচিয়ে বলে উঠলো,
-বাবার এক্সিডেন্ট কিভাবে হলো রিয়াদ?হাও?আর এটাকে এক্সিডেন্ট বলছো তুমি?এটা এক্সিডেন্ট?পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী কারো উপর অ্যাটাক করানো এক্সিডেন্ট?তোমাকে আগে থেকে বলে রাখার পরও বাবার এই অবস্থা কেন রিয়াদ?
এবারও উত্তর দেয় না রিয়াদ।অপরাধবোধ ভেতরে ভেতরে ভীষণ পীড়া দিচ্ছে তাকে।তার উপর আফিমের প্রশ্নগুলো ঠিক যেনো কাটা গায়ে নুনের ছিটা।

এক পর্যায়ে নিজের চোখজোড়া বুঁজে নিলো আফিম।নিজেকে শান্ত করার যথাসাধ্য চেষ্টা করে সে নিন্ম কন্ঠে জিজ্ঞেস করে উঠলো,
-বাবা কোথায় রিয়াদ?
রিয়াদ নিন্ম স্বরে থেমে থেমে উত্তর দেয়,
-হসপিটালে স্যার,আরহান স্যারের ট্রিটমেন্ট অলরেডি শুরু হয়ে গিয়েছে।
-তুমি কোথায়?
-রাস্তায় আছি,আরহান স্যারের কাছেই যাচ্ছি।
-যত দ্রুত সম্ভব বাবার কাছে পৌঁছাও।বাবার উপর আবার হামলা হতে পারে যেহেতু মার্ডার করা ওদের প্ল্যান ছিলো আর সেই প্ল্যানে ওরা এখনো সাকসেস হয়নি।আর এবার যেনো কোনো ভুল না হয় রিয়াদ। আমি আমার বাবাকে সুরক্ষিত চাই এট এনি কোস্ট।

কথাগুলো বলেই কল কাটে আফিম।গাড়ি হতে বেরিয়ে এগিয়ে যায় নাফিয়ার শিক্ষার্থীদের বাড়ির দিকে।দ্রুত কদম ফেলে দরজা অব্দি এসে কলিং বেল চাপে সে।দরজা খোলেন এক মহিলা।আফিমকে চিনতে না পেরে প্রশ্ন করবার উদ্দেশ্যে মুখ খোলেন তিনি তবে তার কিছু বলে উঠার পূর্বেই বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করে আফিম।প্রবেশ করতেই দেখা পায় নাফিয়ার।সোফায় বসে শিক্ষার্থীদের পাঠদানে ব্যস্ত মেয়েটা।
আফিম কোনো শব্দ না করেই দ্রুত কদম ফেলে নাফিয়ার কাছে এগিয়ে গিয়ে তার ডান হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে হাঁটতে আরম্ভ করে।হটাৎ আফিমের এমন কান্ডে অবাকের চরম শীর্ষে পৌঁছে যায় মেয়েটা।তবে মুখ ফুটে প্রশ্ন করে না একটিও।কিছু না জানলেও সে আন্দাজ করতে পারছে বড়সড় কিছুটা একটা ঘটেছে আর আফিম ঠিক নেই, ভেতর থেকে একটুও ঠিক নেই ছেলেটা।

চলবে।

#আফিম_বড্ড_নেশালো_০২
#লেখিকা_মাহযাবীন
#পর্বঃ৪৩

“স্যার,নাফিয়া ম্যাম ইজ ইন অ্যা ডেনজার”
রিয়াদকে উদ্দেশ্য করে উক্ত বাক্যখানা বলে ওঠে ইরফান।রিয়াদ ব্রু কুঁচকে বলে ওঠে,
-মানে?
-স্যার আসলে আফিম স্যারকে কল করেছিলাম অনেকবার কিন্তু কল ঢুকছে না তাই আপনাকে কল করলাম।
কথাগুলো বলে একটু থামে ইরফান।অতঃপর বলতে আরম্ভ করে তার বসের বানানো প্ল্যানের কথা।ইরফানের পুরো কথাগুলো শুনে নিয়ে মৃদু হাসে রিয়াদ।বলে ওঠে,
-হৃৎপিণ্ড ছাড়া শরীর কি বাঁচে? বা জীবিত শরীর হতে হৃৎপিণ্ডটাকে আলাদা থাকতে দেখেছো কখনো?আফিম স্যার যদি শরীর হোন তাহলে সেই শরীরের হৃৎপিণ্ড টা হচ্ছে নাফিয়া ভাবী।চিন্তা করো না, শরীর তার হৃৎপিণ্ডটাকে নিজের বক্ষমাঝারে যত্নে রেখে তাকে সাথে নিয়েই হসপিটালে আসবে।
রিয়াদের কথায় মনের ভয় ও চিন্তা দূরীভূত হয় ইরফানের।সে স্বস্তির নিঃশ্বাস টেনে কল খানা কাটে।

!!
আফিম, নাফিয়াসহ গাড়ি নিয়ে পার্কিং স্পট হতে রাস্তা অব্দি আসতেই তাদের পেছনে এক এক করে ৫-৬ টা গাড়ি পিছু নেয়।সব লাল রঙা প্রাইভেট কারগুলো দৃষ্টি এড়ায় না আফিমের।চোয়াল শক্ত হয় তার।বুঝতে সক্ষম হয় তার উপরও অ্যাটাক হবে তবে এ অ্যাটাক তার ক্ষতি করার জন্য নয় বরং তার পাশে বসে থাকা নির্দোষ এই মানবীর ক্ষতি করার জন্য।অবশ্য সম্পূর্ণ নির্দোষ নয় মেয়েটি।তার দোষ এটিই যে সে আফিম ইবনানের হৃৎহরণী,প্রেয়সী ও সচল হৃদয়ের স্পন্দন।
নিজের সুরক্ষা নিয়ে চিন্তে নেই আফিমের।সে নিজের আত্মরক্ষা করতে জানে।কিন্তু তবুও ঘামছে সে।গলা-বুক শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে তার।মনে শুধু একটাই ভয়, তার প্রেয়সীকে সম্পূর্ণ সুরক্ষা দিতে পারবে তো সে?
আফিম গাড়ি চালানোর মাঝেই নিজের ফোন হাতে নিলো।খুব অল্প সময়ে কিছু একটা করে আবার ফোনটা রেখে দিলো।স্পীড বাড়ালো নিজের গাড়ির।পেছনের গাড়িগুলো আফিমের সামনে গিয়ে আফিমের গাড়ি থামানোর পরিকল্পনা করে সে অনুযায়ী বারংবার আফিমের গাড়ির সামনে যাওয়ার চেষ্টা করে চলছে।কিন্তু পেরে উঠছে না।আফিম তাদের সেই সুযোগ টাই দিচ্ছে না।তার গাড়ির স্পীড যেমন হাই তেমনই বারংবার ডান দিকে, বাম দিকে গাড়ি সরিয়ে পেছনের গাড়িগুলোকে তার পাশ কাটিয়ে সামনে যাওয়া থেকে আটকাচ্ছে।
এভাবে অনেকটা পথ পাড় হতেই দেখা পাওয়া যায় প্রায় ১৫-২০ টা বাইকের। প্রতিটা বাইকে ২ জন করে সদস্য।শরীরে লাইফ জ্যাকেট জড়ানো ও হাতে বন্দুক।
আফিমের গাড়ির সামনের দিক থেকে আসছে তারা।গাড়ির কিছুটা কাছে আসতেই গুলির বর্ষণ করতে আরম্ভ করে দেয় প্রত্যেকে।বাইকের লোকেরা গুলি ছোঁড়ে আফিমের গাড়ির পেছনে থাকা গাড়ি গুলোর টায়ারে এবং যারাই গাড়ির জানালা খুলে গুলি ছোঁড়ার চেষ্টা করছে তাদের উপরও তৎক্ষনাৎ হামলা করছে তারা।শত্রু পক্ষের কেউকে হামলা করার এক বিন্দু পরিমাণ সুযোগ দিচ্ছে না তারা।বরং নিজেরাই শত্রু পক্ষের উপর একের পর এক হামলা করে যাচ্ছে।
সবটা দেখে বাঁকা হাসে আফিম।মনে মনে বলে ওঠে,
“আফিম ইবনান টাকা দিয়ে বাঘ পালে আর এই বাঘেদের সামনে বিড়াল বাহিনী নিয়ে যুদ্ধে নামছো মিঃমনির হাসান!দয়া হওয়া উচিৎ তোমার নিজের উপর।”

!!
আর সামান্য পথ বাকি,জনমানবশূন্য পথ ছেড়ে লোকালয়ে পৌঁছাবে তারা কয়েক মিনিটের মাঝেই।আফিমের পাশের সিটে স্তব্ধ হয়ে বসে আছে নাফিয়া।মুখে কোনো শব্দ নেই তার।গত ১৫-২০ মিনিটের মধ্যে যা যা ঘটে গেলো তাতে খুব বাজে প্রভাব পড়েছে মেয়েটার উপর।কেমন থমকে আছে সে,চোখমুখে স্পষ্ট ভয় ফুটে আছে তার।তবে মুখ ফুটে কিচ্ছুটি বলছে না সে,কোনো প্রতিক্রিয়াও দেখাচ্ছে না।নিজের মনের উপর যতই বাজে প্রভাব পড়ুক তা সে এই মুহুর্তে আফিমকে বুঝতে দিতে চাইছে না।কারণ এমন পরিস্থিতিতে ছেলেটা এমনিও মানসিক চাপে আছে তাকে আর বাড়তি চাপ দিতে চায় না নাফিয়া।
ড্রাইভিং এর মাঝেই আফিম তাকায় নাফিয়ার দিকে।বুঝতে পারে মেয়েটার মনের হাল তবে এখন পরিস্থিতি তেমন অনুকূলে নেই যে নাফিয়াকে কিছু বুঝাবে সে।
এসব ভেবে নাফিয়ার থেকে চোখ সরিয়ে সামনে তাকাতেই অপ্রস্তুত হয়ে পরে আফিম।তৎক্ষনাৎ গাড়ির ব্রেক কষে সে।তার সামনে চার খানা গাড়ি পথ আঁটকে দাঁড়িয়ে আছে।সব ক’টা গাড়ি লাল রঙের।আফিমের বুঝতে অসুবিধে হয় না এ গাড়িগুলো আসলে কার!
সাথে সাথেই কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায় না সে।চুপচাপ চোখ বুলিয়ে নেয় নিজের চারিপাশটায়।পরিস্থিতি কি হতে পারে তা আন্দাজ করার চেষ্টা করছে ছেলেটা।ক’সেকেন্ড তাতে ব্যয় করে নিজের ফোনখানা হাতে নেয় সে।আবারও কিছু একটা করে ফোন পূর্বের জায়গায় রেখে দিয়ে দৃষ্টি আবদ্ধ করে নিজের সামনের দিকে।এক প্রকার শত্রু পক্ষের তরফ থেকে হামলা আসার অপেক্ষা করছে সে।নিজে থেকে হামলা করার মতো পরিস্থিতিতে এখন নেই আফিম।শত্রু পক্ষ হামলা করলে এখন সে শুধু মাত্র প্রতিরোধের চেষ্টা করতে সক্ষম কিন্তু পাল্টা হামলা করতে নয়।

উভয় পক্ষের মাঝে নিরবতা বিরাজ করছে বেশ কিছুক্ষণ ধরে।না আফিমের তরফ থেকে কোনো প্রতিক্রিয়ার দেখা মিলছে আর না শত্রু পক্ষের তরফ থেকে।উভয় দিকই শান্ত।এ যেনো ঝড় আসবার আগ মুহুর্তের নিস্তব্ধতা।

এভাবেই কয়েক মিনিট পাড় হবার পর হুট করে চারটি গাড়িরই দরজা খুলে যায়।একে একে ১২-১৫ জন লাল পোশাক পরিহিত লোকেরা বেরিয়ে আসে গাড়ি হতে।সারিবদ্ধ হয়ে সকলে দাঁড়িয়ে পড়তেই সর্বশেষ একজন কালো পোশাক পরিহিত ব্যক্তি বেরিয়ে আসেন গাড়ি হতে।

কালো পোশাকে আবৃত লোকটিকে দেখা মাত্রই চমকে যায় নাফিয়া।বিস্ফোরিত চোখে লোকটির দিকে তাকিয়ে থেকে সে বলে ওঠে,
-আফিম ইনিই তো আমার খালুর বন্ধু যিনি আমাকে বিয়ে করতে চেয়েছিলেন।
আফিম শান্ত কন্ঠে বলে ওঠে,
-জানি মিস.শেখ।ও হচ্ছে মনির হাসান ইরফান।
-হ্যাঁ, আর আর আফিম দেখেন ঐ লোকের পেছনেই আপনার বডিগার্ডের মাঝে একজন যার নামও মনে হয় ইরফান সে দাঁড়িয়ে আছে।মানে ধোঁকা দিয়েছে আপনাকে?
এবার আফিম তাকায় নাফিয়ার দিকে।দু’হাতে আঁকড়ে ধরে মেয়েটির গাল।চোখে চোখ রেখে শান্ত কন্ঠে বলে ওঠে,
-শান্ত হও মিস.শেখ,এতো ভয় এতো অস্থিরতার কিচ্ছু হয়নি।আমি আছি তো সাথে।আফিম থাকতে নাফিয়ার গায়ে একটা ফুলের টোকাও লাগবে না।ভয় পেয়ো না।মনে আছে কি বলেছিলাম?দুনিয়া শক্তের ভক্ত নরমের জম।ভয় পেয়ে দমে না গিয়ে সাহস নিয়ে পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হবে, ঠিক আছে?
মাথা নাড়ে নাফিয়া।নিজের মনকে শক্ত করার চেষ্টায় লেগে পরে সে।
আফিম-নাফিয়ার কথপোকথনের মাঝেই একজন লাল পোশাকধারী লোক এগিয়ে আসতে লাগে গাড়ির ধারে।সেদিকে চোখ যায় আফিমের।তৎক্ষনাৎ বেরিয়ে আসে সে গাড়ি হতে।আত্মরক্ষার জন্যে মা*র*পিট শিখাসহ বিভিন্ন অ*স্ত্র চালানোর প্রশিক্ষণও নেওয়া আছে তার।আজ সেসব প্রয়োগের সময় এসেছে।গাড়ির দিকে অগ্রসর হওয়া শত্রু দলের প্রতিটা সদস্যকে মাটিতে লুটোপুটি খাওয়াতে বেশি বেগ পেতে হচ্ছে না আফিমের।এ যেনো তার বাম হাতের কাজ।
গাড়ির ভেতরে বসে আফিমকে দেখে চলছে নাফিয়া।ছেলেটার সুরক্ষা নিয়ে একরাশ ভয় মনে বাসা বেঁধেছে তার।কি করবে বুঝে উঠতে পারছে না সে।হটাৎ রিয়াদের কথা মাথায় আসে নাফিয়ার।সঙ্গে সঙ্গে আফিমের ফোন দিয়ে ডায়াল করে রিয়াদের নাম্বার।কল রিসিভ হতেই নাফিয়া বলে ওঠে,
-রিয়াদ ভাইয়া,আফিমের সাহায্য প্রয়োজন।
অতঃপর সংক্ষেপে এখনের পরিস্থিতি বক্ত্য করে নাফিয়া।রিয়াদ সবটা শুনে বলে ওঠে,
-ভয় পাবেন না ভাবী আমি এখনই আসছি।
উক্ত বাক্যটি বলেই ওমনি কল কাটে রিয়াদ।

আফিমের সামনে মাটিতে লুটোপুটি খাওয়া নিজের চামচাদের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসে মনির হাসান।নিজের ভুঁড়ির উপর হাত বুলোতে বুলোতে ইশারা করেন তার অন্যান্য কিছু চামচাদের দিকে।বসের ইশারা বুঝে নিয়ে এবার একই সাথে ৪ জন হামলে পড়ে আফিমের উপর আর আফিম ব্যস্ত তাদের প্রতিহত করতে।এরই মাঝে পঞ্চম কেউ একজন পেছন থেকে এসে আঘাত করে আফিমের মাথায়।সাথে সাথে হাঁটু ভেঙে বসে পরে আফিম।প্রায় সাথে সাথে আবারও তার মাথায় আঘাত করা হয়।মাটিতে লুটিয়ে পরে আফিমের দেহ।
এ দৃশ্য দেখে নাফিয়ার মস্তিষ্ক প্রতিক্রিয়া দেখাতে বিলম্ব করে কয়েক সেকেন্ড।ক’সেকেন্ড থমকে থেকে এবার চেচিয়ে ওঠে মেয়েটা।গাড়ির দরজা খুলে তড়িৎ গতিতে অগ্রসর হয় আফিমের দিকে।তার দু’চোখ বেয়ে সমানে গড়িয়ে পড়ছে অশ্রুকণা।মেঘকন্যার অশ্রু সদাসর্বদার ন্যায় এবারও সহ্য হলো না ঐ অম্বরের।অম্বরের বুকে জমে থাকা সকল মেঘমালা বৃষ্টি হয়ে নামতে আরম্ভ করলো ধরণীর বুকে।

আফিমের মাথায় কয়েক সেকেন্ডের মাঝেই দু-দুবার আঘাত হতে দেখেই নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারায় ইরফান।উচ্চ স্বরে “স্যার” বলে চেচিয়ে ওঠে সে।আশেপাশের কোনো কিছুর পরোয়া না করে ছুটে যায় আফিমের দিকে।যে আফিমের মাথায় আঘাত করেছে তাকে শুধু মাত্র হাতে ব্যবহার করেই দুনিয়া দিয়ে বিদায় দেয় ইরফান।অতঃপর তাকায় আফিমের দিকে।আফিমের কাছে গিয়ে হাঁটু ভেঙে বসে ডাকতে আরম্ভ করে,
“স্যার, চোখ খুলুন স্যার।স্যার?”
এদিকে আফিমের মাথার কাছে বসে নাফিয়াও ক্রন্দনরত অবস্থায় ডাকতে থাকে তাকে।আফিম আধো আধো চোখ খুলে নিন্ম স্বরে বলে ওঠে,
-সেভ নাফিয়া,ইরফান।শি ইজ মা মাই লাইফ।সেভ হার।
আফিম এতো টুকু বলে শেষ করতে না করতেই একজন লোক এসে নাফিয়ার হাত ধরে টেনে তাকে নিজের বসের কাছে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে।অপর দিকে আফিম শক্ত করে ধরে রেখেছে নাফিয়ার হাত।ছেলেটার মাথা হতে সমানে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে যা বৃষ্টির পানিতে ধুয়ে যাচ্ছে বারংবার।ছেলেটা জ্ঞান হারাবে হারাবে অবস্থাতেও নাফিয়ার হাত এমন ভাবে ধরে রেখেছে যেনো তার প্রাণ চলে গেলেও এই হাতের বাঁধন ছুটানো অসম্ভব।

ইরফান আফিমের আদেশ পেয়ে উঠে দাঁড়ায়।যে লোকটা নাফিয়ার হাত ধরেছে তার উপর প্রহার করবার উদ্দেশ্যে হাত উঠাতেই বন্দুকের এক গুলি তার মস্তিষ্ককে ছেদ করে চলে যায় ক’সেকেন্ডের ব্যবধানে।মুহূর্তেই মাটিতে লুটিয়ে পরে তার দেহ।রক্তে ভেসে যেতে আরম্ভ করে বৃষ্টির পানিতে ভেজা মাটি।মনির হাসান নিজ হাতে বন্দুক চালিয়ে প্রাণ নিলো ইরফানের। বলে উঠলো,
“আমাকে ধোঁকা দেওয়া উচিৎ হয়নি তোমার ইরফান,একদমই উচিৎ হয়নি।”

ইরফানের মৃত্যু আফিমকে ভেতর থেকে আরো ভেঙে দিলো।নিজের একজন নির্দোষ সঙ্গীর মৃত্যু যেমন পীড়া দিচ্ছে আফিমকে ঠিক তেমনই নিজের চোখের সামনে নিজের শেষ আশাটাকে শেষ হতে দেখে নিজেকে ভীষণ অসহায় অনুভব করছে সে।মাথায় হওয়া অসহ্য যন্ত্রণায় উঠে দাঁড়াতে পারছে না সে।কিভাবে বাঁচাবে নিজের প্রেয়সীকে?

এদিকে আফিমের হাত থেকে নাফিয়ার হাত ছাড়াতে ব্যর্থ হওয়ায় এক ব্যক্তি আবারও ইট তুলে নেয় নিজের হাতে।আবারও প্রহর করতে উদ্ভূত হয় আফিমের মাথায় কিন্তু তার আগেই রাস্তার এক প্রান্ত হতে ঝড়ের বেগে এসে উপস্থিত হয় ১৫-২০ টা বাইক এবং অপর প্রান্ত হতে ৪-৫ টা প্রাইভেট কার।যার মাঝে একটি প্রাইভেট কারে আছে রিয়াদ।

চলবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here