মায়াপ্রপঞ্চ,১০,১১

0
871

#মায়াপ্রপঞ্চ,১০,১১
#পলি_আনান
[পর্ব সংখ্যা ১০]
________________
প্রায় সাত/আটদিন পার হয়ে গেলো আরমিন ভয়ে পবনের মুখোমুখি হয়নি।হবেই বা কি করে?সেদিন যা কান্ড গেলো এরপর তো দেখা হলে গলা টিপে তাকে মে/রেই ফেলবে।
অপর দিকে সুহাইল পড়েছে বড্ড বিপাকে সালেহার সাথে কথা বলার নানান বাহানা সাজিয়েও সালেহার সাথে তার একটি বাক্য আদান প্রদান হলো না।সবসময় তার থেকে পালিয়ে লুকিয়ে থাকেন তিনি।তাই প্লাবনের কাছে সাহায্য চাইলো সুহাইল।বেশ কৌশল খাটিয়ে কথার ভাজে আরমিনদের বাড়ির ঠিকানাটা জেনে নেয়।অলস দুপুরে যখন সবাই খাওয়া দাওয়া সেরে বিশ্রামে ব্যস্ত ঠিক সেই সময় সুহাইল আরমিনদের বাড়ির উদ্দেশ্য রওয়না হয়।

বেশ পুরোনো একটি টিনের ঘর।কোনায় কোনায় মরিচা পড়ে গেছে।টিনের ঘরটির সম্মুখে আরেকটি ছোট টিনের ঘর।সম্ভবত এটি পাকঘর।বাড়ির চারিপাশে বেশ বড় বড় কয়েকটি আম,কাঠাল গাছ।পাকঘরের পাশেই ছোট একটি পুকুর সাদৃশ্যমান।পুকুরের চারিপাশে কিছু লেবু গাছ দেখা যাচ্ছে।বেশ কয়েকটি লেবু গাছে ধরে ঝুলে আছে।উঠনে ছিটানো ভাত গুলো মুরগী সহ মুরগীর বাচ্চারা মুখে পুরছে।পুকুরে লেজ নাচিয়ে চলছে চারটে হাঁস।বাড়িটির সীমানা দেওয়া টিনের বেড়া দিয়ে।
সুহাইল মুগ্ধ হয়ে পরিবেশটা উপভোগ করছে।
মফস্‌সলে এমন বাড়ি অহরহ হলেও মাতবর বাড়ির চিত্রটি ভিন্ন।সেখানে আভিজাত্যর ছোঁয়া,অবশ্য বড় বাড়ি কী না!সুহাইল যেহেতু এই মফস্‌সলে মাতবর বাড়ি ছাড়া কোথাও তেমন যায়নি তাই দীর্ঘ বছর পর কিছুটা হলেও যেন গ্রামের স্বাদ গ্রহণ করতে সক্ষম হচ্ছে।পরিষ্কার উঠান,মৃদুমন্দ বাতাস পাখিদের কিচিরমিচির সব মিলিয়ে মুগ্ধতা ছড়িয়ে আছে এখানে।

সুহাইল এগিয়ে গেলো টিনের ঘরটার রোয়াকে।রোয়াকের ছাউনিতে কিছু লতা ফুলগাছ ঝুলে আছে।দেখতে বেশ দারুন লাগছে।আচ্ছা এই ফুলগাছ গুলো কে লাগিয়েছে?নিশ্চই আরমিন।ভেবেই একটু হাসলো সুহাইল।এগিয়ে গেলো খানিকটা।সকল দ্বিধা ভুলে দরজায় করাঘাত করলো দু’বার।তৃতীয় বারের সময় দরজা খুললো রিহানা।মেয়েটা সুহাইলকে দেখে প্রথমে অবাক হলেও কিছুক্ষণের মধ্যেই স্মিথ হাসে।

– সুহাইল ভাইয়া আপনি?

– কেমন আছিস রিহু?

– ভালো ভাইয়া।ভিতরে আসেন।

– মামি কই?

– আব্বার গায়ে তেল মালিশ করতাছে।আপনি আসেন ভাইয়া।

সুহাইল এগিয়ে গেলো দরজার দিকে।সিমসাম ভাবে সাজানো ঘরটি।সামনের রুমটাতে একটি খাট আরেকটি টেবিল।ছোট একটা আলমারিও আছে কোনায়।রিহানার পিছু পিছু ডানের রুমটাতে প্রবেশ করলো সে।সেখানে শুয়ে আছেন কায়িক রহমান এবং পাশে সালেহা।রিহানা কিছু বলার আগেই সুহাইল ডেকে উঠলো সালেহাকে।

– মামি!

ডাক শুনে চমকে তাকায় সাহেলা।সুহাইলকে এই ঘরে দেখে তার ভূত দেখার মতো অবস্থা হয়েছে।দাঁত কিড়মিড় করে তাকালো প্রথমে রিহানার দিকে।এর অর্থ এই রুমে সুহাইলকে কেন প্রবেশ করতে দিলো।সুহাইল তার মামির মুখো ভঙ্গি দেখে হাসলো।এগিয়ে গেলো কায়িমের কাছে।মাথার পাশে বসে মুঠোয় নিলো কায়িমের হাত জোড়া।আগের থেকেও মানুষটা বেশ শুকিয়ে গেছে চোখ জোড়া কোটরে ডুকে গেছে।যেন খুব কাছেই মৃত্যু তার জন্য অপেক্ষা করছে।

– তুমি এখানে আসতে গেলে কেন?তোমার আব্বা দেখলে আমার বর্তমান সুখটুকুও কেড়ে নেবেন।

সুহাইল সালেহার হাত টেনে সামনের রুমে নিয়ে যায়।সালেহাকে বিছানায় বসিয়ে মাটিতে উবু হয়ে বসে সে।সালেহার দু’হাত নিজের হাতে নিয়ে মাথাটা কোলে ফেলে দেয়।সেই ছোট্ট সুহাইলের আগের মতো কান্ড দেখে সালেহার চোখে নেত্রবারি গড়ি পড়ে।

– আল্লার ওয়াস্তে আমাদের একটু শান্তি দাও তোমরা।আমার স্বামী মৃত্যুর পথযাত্রী।ঘরে দুটো মেয়ে কোন ছেলে নেই আমার।আমার জীবনটা অর্থহীন তার মাঝে তোমার পরিবার আমাদের পুড়িয়ে মা*রবে যদি যানে আমাদের সাথে তুমি একান্ত দেখা করেছো।

– ভয় পেওনা মামি।সেদিন যে বাবা তোমায় রান্না ঘরে হু/ম/কি দিয়েছে সবটা আমি শুনেছি।তাই তো পালিয়ে বাঁচো আমার থেকে তাই না?

সুহাইলের কথায় সালেহা কেঁপে উঠে।এই ভয়টাই পাচ্ছিলো সে।শান্ত রূপের অধিকারি এই ছেলেটি যদি জানতে পারে তার মামি কেন তাকে আড়াল করে চলছে তাকে তবে কোন তান্ডব লিলা সৃষ্টি হতে সময় লাগবে না।

সেদিন রান্না ঘরে সালেহাকে একা পেয়ে বারেক তাকে নানান কথা শুনিয়ে যান।তবে শেষে একটি হুমকিও দিয়ে যান।যদি বারেক খন্দকারের সাথে সালেহার আত্মীয়তার সম্পর্ক এটা কেউ জানে তবে সালেহার একবার ভেবে দেখা উচিত বিবাহ যোগ্য মেয়ে তার ঘরে যেকোন সময় যেকোন বিপদ ঘটে যেতে পারে।এছাড়াও সুহাইলের থেকে দূরত্ব বজায় রাখতে সাফ সাফ জানিয়ে দেন তিনি।

সালেহার নিরবতায় আবারো মুখ খুলে সুহাইল।
– আমার কাছ থেকে পালিয়ে বেঁচে লাভ নেই মামি।তুমি জানো আমি আমার মামাকে কতটা ভালোবাসি।ঠিক তার পরে তোমাকে ভালোবেসেছি তোমার পরিবারকে ভালোবেসেছি। তবে তোমাদের আমি উপযুক্ত নিষ্পত্তি দিতে পারিনি।আমি তখন ছোট ছিলাম।কিন্তু এখন আমি বড় হয়েছি ভালো মন্দ সব বিচারের উপযুক্ত হয়েছি কথা দিলাম সব ফিরিয়ে দিবো।শুধু তুমি তোমার দুটো হাত আমার মাথা থেকে সরাবে না।

– আমার কিছু চাই না বাবা।আমার যা আছে যেভাবে আছে তা নিয়ে আমি সন্তুষ্ট।

– কিন্তু আমি সন্তুষ্ট নই।আমি যখন জানতে পেরেছি বাবা দেশে আসবে তখন থেকেই ছক কষে গেছি কীভাবে কি করবো।প্রথম কাজ ছিলো তোমাদের খুঁজে বের করা।এবং সবচেয়ে বড় কঠিন সিদ্ধান্ত ছিল এটি।আল্লার রহমতে যেন মিরাকল ঘটিয়েই পেলাম তোমাদের।তবে যখন পেয়েছি সব ঠিক করে দিবো একটু দৈর্য্য রাখো তোমরা।আর মামার চিকিৎসার ব্যবস্থা করাবো খুব দ্রুত।

সালেহা উত্তর দিলো না।সে নিশব্দে কেঁদেই যাচ্ছে।ছুঁয়ে দিচ্ছে সুহাইলের মুখ।কত বছর পর যেন আবার আপন মানুষের ভরসার হাত পেলেন তিনি।সুহাইল এবার মুখ তুলে তাকালো সালেহার দিকে।সালেহার চোখের পানি মুছে বলে,

– ছোট বেলার সেই আবদার এখনো যে অপূর্ণ রয়ে গেছে মামি।আমি ছোট বেলার মতো আবারো সেই আবদার করতে চাই তোমার কাছে।

– কী আবদার সুহাইল বাবা?

– তোমার বড় মেয়েটাকে আমায় দিয়ে দেবে মামি?যত্ন করে রেখে দেবো।

কর্ণকুহুরে বাক্যটা পৌঁছাতেই পিলে চমকে উঠেন সালেহা।ছোট বেলায় সুহাইল বার বার এমন আবদার করতো।”তোমার পুতুল মেয়েটাকে আমায় দিয়ে দিবে মামি?আমার কাছে রেখে দেবো।” কিন্তু তখন হেসে কথাটা উড়িয়ে দিতেন সালেহা।এত বছর পরেও সুহাইলের মাথা থেকে এই চাওয়া মুছলো না।অন্তঃশত্রুর মুখে কিছুতেই তিনি ছাড়বেন না আরমিনকে।যে আগুনে তিনি পু-ড়ে মরেছেন সেই আগুনে মেয়েকে কখনোই পুড়িয়ে মারতে চান না তিনি।সালেহা ভালো করেই জানেন সুহাইলের সাথে বিয়ে হলে তার মেয়ের সুখ তিরোহিত হবে।তাই জীবিত থাকতে এই আবদার কখনোই পূর্ণ হতে দিবেন না তিনি।

– আমার কিচ্ছু চাই না সুহাইল।যা আমি হারিয়েছি তা আমার ভাগ্যর কারনেই হারিয়েছি।আমার যা আছে তা নিয়ে আমি আলহামদুলিল্লাহ সন্তুষ্ট।আমার মেয়েকে জেনে শুনে জাহান্নামের আগুনে আমি ছুড়বো না।তাই তোমার আবদার আমি রাখতে পারলাম না।অন্তত এই আবদার করে আর কখনোই আমার কাছে এসো না তুমি।

সুহাইল পিলে চমকে তাকালো।তবে সে জানে সালেহা কিছুতেই মানবে না আরমিনের সঙ্গে তার বিয়ে।তাই তার মাঝে খুব একটা আশাহত ভাব দেখা গেলো না।বরং সালেহার কপালে শব্দ করে চুমু খেলো সে।

– তোমাদের জীবন থেকে খুব শীঘ্রই দুঃখ ঘুচে যাবে দেখে নিও।আর আমি আমার আবদার পূরণ করবো।আমি দেশের মাটিতে পা রেখেছি নিজেকে নিজে দুটো ওয়াদা করে।আমি আমার মামার সব কিছু ফিরিয়ে দেবো আমার বাকি জীবনের অর্ধাঙ্গিনী হিসেবে মরিয়মকে পাবো।আশা করি আমি আমার ওয়াদা পূর্ণ করবো।

সুহাইল পাশের রুমে প্রবেশ করে কায়িমকে একবার দেখে নিলো।তার মাথায় হাত রেখে বুলিয়ে দিলো কিছুক্ষণ।তার প্রাণ প্রিয় প্রফুল্ল মামার এমন অবস্থা দেখে বুকের ভেতরটায় কেউ যেন চাকুর আঘাত দিচ্ছে।দ্রুত রুম থেকে বেরিয়ে রিহানার দিকে একবার তাকিয়ে মিষ্টি হেসে চলে গেলো।

রিহানা সালেহার দিকে তাকিয়ে আফসোস সুরে বললো,

– ভাইয়ারে এক কাপ চায়ের কথাও বলতে পারতা!

সহসা মেয়েটার গালে পড়লো এক ঘা।নরম মাংসপিন্ডের গালটা ব্যাথায় টনটন করে উঠলো।সালেহা ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে শুধালো।

– তুই দরজা খোলার আগে কেন বললি না সুহাইল আসছে?আমি তাহলে জীবনেও দরজা খুলতাম না।এখন যদি তোর ফুফা জানে সুহাইল এখানে এসেছে তোর বোনের জান নিয়ে টানাটানি পড়ে যাবে।ইজ্জতে হাত পড়বে না তার কি নিশ্চয়তা আছে।আমার কিচ্ছু চাই না আমি শুধু আমার পরিবারকে ভালো রাখতে চাই।

– সুহাইল ভাই যদি সত্যি আপুকে বিয়ে করে নেয় সমস্যা কোথায়?আপু হয়তো সুখী হবে।আপুকে সম্পূর্ণ কথাটা তো জানানো উচিত।

সালেহার সব রাগ জেদ যেন আজ রিহানার উপরেই ঝারলেন।মুহূর্তে কষিয়ে আরেকটি চ-ড় মারলো মেয়েটার গালে।তিরতির করে কাঁপছে সালেহার শরীর।ভেতরটা ভয়ে কুঁকড়ে যাচ্ছে বার বার।

– খবরদার আরমিন যদি এইসবের তিলার্ধেক জানে তোর কপালে শনি ঘুরবে বলে দিলাম।সামনে থেকে এখন যা।

রিহানার গাল বেয়ে নোনা জল গড়িয়ে পড়ছে।ধীরে ধীরে তা হেঁচকিতে পরিনত হয়।রোয়াকে বসে বিড়বিড় করে বলে,

– আমার কী দোষ?মা শুধু আমারেই মার‍তে পারে।
#চলবে….

#মায়াপ্রপঞ্চ
#পলি_আনান
[পর্ব সংখ্যা ১১]
____________
কেশবপুরের নামি-দামি একটি রেস্টুরেন্টে বসে আছে শাওন।তার ঠিক মুখোমুখি সুহাইল।এখানে এসেছে প্রায় দশ মিনিট হতে চললো আসার পরেই সুহাইলের একটা গুরুত্বপূর্ণ কল এসেছে আর তার সাথে কোন একটা বিষয়ে ডিল করছে সে।শাওন চুপচাপ ছেলেটাকে পরখ করছে,হাতে সিলভার রঙের দামি ঘড়ি,শার্টের স্লিভটা কোনুই পর্যন্ত গোটানো।হালকা গোলাপি শার্টে ছেলেটাকে মারাত্মক সুন্দর লাগছে।শাওনের মনে হচ্ছে তার সামনে যেন সিনেমার কোন হিরো বসে আছে।মোবাইলে অনর্গল ইংরেজিতে কথা বলে যাচ্ছে ছেলেটি।হাতে চকচক করছে আইফোন।মোবাইলের দিকে তাকিয়ে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো শাওন।ছেলেটা তবে আসলেই বড়লোক।তবে এই বড়লোক ছেলে তাকে ডাকলো কেন?প্রথমে তাকে দেখছিলো আরমিনের সাথে তাহলে কী আরমিনে বিষয়ে কথা বলতেই তাকে ডেকেছে?

– সরি ফোনে ব্যস্ত হয়ে গেছিলাম।আসলে ইনপটেন্ট কল ছিল।

সুহাইলের কথায় স্মিথ হাসলো সে।সৌজন্যর খাতিরে হেসে বলে,

– সমস্যা নেই।এবার বলুন কেন আমায় এত জরুরি তলব করেছেন।

– কিছু অর্ডার করি কফি চলবে?

– হ্যা অবশ্যই।

সুহাইল দুটো কফির অর্ডার করলো কিছুক্ষণের মধ্যেই কফি চলে এসেছে।এক চুমুক কফি মুখে নিয়ে শাওনের দিকে তাকালো সুহাইল।

– আমি ভণিতা ছাড়া কথা বলতে পছন্দ করি শাওন।তাই যা বলবো স্টেইট ফরয়ার্ড বলবো।

– আপনি শুরু করুন আমি শুনছি।

– তুমি এই ভার্সিটির কাছে একটা মেসেই থাকো।তোমার বাবা একজন কৃষক।যা আয় করেন সংসারের পেছনেই চলে যায় তুমি তোমার পড়াশোনা এগিয়ে নিচ্ছো নিজের পরিবারো সামলে রাখছো।বড় বোনের বিয়েতে ছয় লক্ষ টাকা যৌতুক দিয়েছিলে।এবং সেটা বাড়ি বন্ধক রেখে আর কিছু ধার দেনা।এখন তোমাদের পরিবার বড্ড হিমশিমের মধ্যে আছে।এদিকে আরো টাকার জন্য তোমার বোনকে চাপ দিচ্ছে তার শশুড় বাড়ির লোকজন।পুলিশ কেস করতে তোমাদের সাহসে কুলাচ্ছে না।কারন সেখানেও টাকার ব্যাপার-স্যাপার জড়িয়ে আছে।তাছাড়া নিম্নবিত্ত ফ্যামিলির পুলিশ দেখলেই রূহ কাঁপে।বরাবরি পুলিশের প্রতি ভয়টা তাদের থাকেই।

শাওন ঘামছে।শ্যাম বর্ণের কপালটায় চামড়া ভেদ করে নোনতা পানি গড়িয়ে পড়ছে।গলা শুকিয়ে গেছে মূহুর্তে।সামনে থাকা পানির বোতলের ছিপি খুলে ঢকঢক করে পানি পান করে সে নিজেকে স্থির করে নেয়।

– আ…আপনি কে?আপনি এত সব জানলেন কী করে?

– আমি যে হই সেসব বাদ।আগে এটা বলো তুমি কি তোমার পরিবারের পাশে দাড়াতে চাও?তোমার বোনের সুখ চাও?

– অবশ্যই চাই কেন চাইবো না আমি তাদের সুখ।

– আমি তোমায় সাহায্য করবো।প্রমিস তোমার বোনের ঝা-মে-লা মিটিয়ে দেবো তোমার পরিবারের স্বচ্ছলতা ফিরিয়ে দেবো।

– কিন্তু এতসব আপনি করতে চান কেন?

– আমি আরমিনের কেউ একজন হই।বলতে গেলে খুব কাছের।সেদিক থেকে আমি তোমাকে সাহায্য করতে চাই।

মুহুর্তে মত পালটে গেলো শাওনের।স্থির নয়নে এবার রোষ নিয়ে বলে,

– আমার কারো দয়ার প্রয়োজন নেই।যেভাবে আছি ভালো আছি।

– তাই নাকি?কত কাল ভালো থাকবে?পড়াশোনা করে চাকরি করবে?এই দেশে চাকরি পাওয়া বুঝি এত সহজ।আচ্ছা ধরেই নিলাম তুমি চাকরি পেলে।মাইনে কত ১৫/২০ হাজার।এতে তোমার ধার দেনা মিটিয়ে সংসার চলবে না।আমি তোমায় একটা প্রস্তাব দিচ্ছি যদি তুমি রাজি থাকো।

– কী প্রস্তাব?

– কানাডায় যাবে?আমার অফিসে চাকরি করবে।মাসে সেলারি যা থাকবে তাতে তুমি,তোমার পরিবার বেশ ভালোই চলবে।চলবে না দৌড়াবে।আরমিনের পরিচিত হিসেবে তোমায় আমি একটা ফ্লাট উপহার দেবো।এতে তোমার থাকার জায়গাও হবে।এক কথায় বলতে গেলে তুমি সুখী থাকবে।

– আপনি আমাকে এত কিছু দিবেন নিশ্চই আপনারো কিছু পাওয়ার আছে?

সুহাইল হাসলো।তবে হাসিটা কি তাচ্ছিল্যর নাকি খুশীর তা বোঝা গেলো না।গা দুলিয়ে হেসে কফিতে আরেক চুমুক দিলো সে।

– জাস্ট তুমি আরমিনের সাথে সম্পর্ক ভেঙ্গে দাও আর দেশের বাইরে চলে যাও।আর যা যা ডিল হবে এসব কিছু আরমিন জানবে না।শুধু আরমিন নয় একটা কাক পক্ষিও জানতে পারবে না।

– বিষয়টা একটু সিনেমার মতো হয়ে গেলো না মিস্টার সুহাইল!আপনি আমায় সব দিবেন তাও একটা ঠুনকো প্রেমের সম্পর্ক ভাঙ্গার জন্য স্টেইঞ্জ!

– হলে হোক তাতে কী?তোমার লাভ আমার লাভ।দেখো এখানে থেকে তুমি আরমিনকে বিয়ে করতে পারবে না।কারন মাতবর আঙ্কেল তোমার মতো ছেলের সাথে বিয়ে দেবেন না।আর আরমিনো সুখী হবে না।তাই যা বলছি মেনে নাও।সেদিন পবন তোমার সাথে কি রিয়েক্ট করলো হোটেলে ভুলে গেলে?আমি সব জানি।অন্তত তোমাদের মাঝে পবন তো বাধা দেবেই।এসব ছাড়ো টাকা রোজগারে নামো, দেখবে সুন্দর সুন্দর রমনীরা আশে পাশে ঘুরঘুর করবে।সব বাদ এবার নিষ্পত্তিতে আসি।ডু ইউ এগ্রি উইথ মাই প্রপোজাল?

– ইয়েস!

সুহাইল এবার প্রফুল্ল হাসলো।তার হাসিতে তাল মেলালো শাওন।সুহাইলের সাথে হাত মিলিয়ে উঠে দাড়ালো।

– তুমি খুব ব্রিলিয়ান্ট শাওন।আশা করি আমার অফিসে তোমার সাথে কাজ করে আমার বাকি ইপ্লয়রা খুশি থাকবে।

– ইনশাআল্লাহ আমি চেষ্টা করবো।
_

দুপুর গড়িয়ে শেষ বিকেল।পশ্চিম দিকে হেলে পড়া সূর্যটা লাল কমলা রঙের মিশ্রনে আলো ছড়াচ্ছে চারিদিকে।সাহেলা পুকুড় পাড়ে বসে তাকিয়ে আছে গেটের দিকে।আরমিন আসার কোন নাম নেই।কলেজ তো আরো আগেই ছুটি তবে মেয়েটা কোথায় গেলো?বেশ চিন্তায় ডুবে আছেন তিনি।টিনের গেটটা বেশ জোরে শব্দ হতে, ঘুরে তাকান তিনি।আরমিন বাড়িতে ডুকেছে চোখ,মুখ ফোলা মাথার হিজাব ওড়নাটা খুলে গলায় ঝুলিয়ে নিয়েছে।এলোমেলো পায়ে হেঁটে ঘরের ভেতর চলে যায় সে।তার অবস্থা দেখে সালেহার চিন্তা আরো বেড়ে গেছে।মেয়ের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতে দ্রুত পুকুর ঘাট ছেড়ে রুমে ঘরে যান তিনি।

– আরমিন মা তোর কী হইছে?

– কিছুনা আম্মা।আমার ভালো লাগছে না সরো।একটু বিশ্রামের প্রয়োজন।

– তো জামা কাপড় ছেড়ে নে।পুকুর পাড় থেকে গোসল করে আয় শরীর হালকা হবে আমি ভাত বাড়ছি।

– আমি গোসলো করবো না ভাতো খাবো না।তুমি যাও আমি দরজা বন্ধ করে ঘুমাতে চাই।

সালেহা নির্বাক হয়ে চলে গেলেন।অপরদিকে রুমের দরজা বন্ধ করে মুখে হাত দিয়ে ফুঁফিয়ে কেঁদে উঠে আরমিন।আজ শাওন হঠাৎ করেই তার সাথে সব সম্পর্ক ছিন্ন করেছে আর যাওয়ার আগে এটাও বলে গেছে সে এবার রোজগারে নামবে দেশের বাইরে চলে যাবে।আরমিনের সাথে কোন যোগাযোগ কিংবা সম্পর্ক রাখতে চায় না।
লাহমায় মেয়েটার শরীরে কাঁটা দিয়ে উঠেছে।কান্না ভেঙ্গে পড়েছিলো সে।কিন্তু তাকে কোন পাত্তা দিলো না শাওন।একবার হাত ছুঁয়ে বিদায় নিলো না।বরং হাজার খানেক জ্ঞান দিয়ে গেছে তাকে।
.
চলমান সময়টা পেরিয়ে গেলো খুব দ্রুত।সবাই সবার জীবন নিয়ে ব্যস্ত থাকলেও থমকে গেছে আরমিন।বোকা মেয়েটা শাওনের শোকে নাওয়া খাওয়া ছেড়ে গত চারদিন রুম বন্দি হয়ে আছে।বিষয়টি সালেহা সন্দেহের কাতারে পড়লেও গুরুত্ব দিলেন না তিনি।
দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে চললো।উঠনে বসে লাউ শাকের পাতা কাটছেন তিনি।তখনি বাড়িতে প্রবেশ করে আরমিনের বান্ধুবি মনি, তাসমিন।

– আসসালামু আলাইকুম আন্টি।ভালো আছেন?

মনি’র কথায় চমকে তাকায় সালেহা।সালাম নিয়ে দ্রুত ঘর থেকে দুটো পিরি এগিয়ে দেয় তাদের।

– বসো তোমরা।কেমন আছো?

– আলহামদুলিল্লাহ ভালো আন্টি।আরমিনের কি শরীর খারাপ?

– জ্বর নেই।সারাদিন শুয়ে থাকে।নাওয়া খাওয়া ছেড়ে শরীরটাও দূর্বল হয়ে গেছে।

মনি এবং তাসনিম দুজন দুজনের দিকে একবার তাকায়।দুজনেই জানে আরমিনের এই উদাসীনতার কারন কী!
তাসনিম গলাটা ঝেরে বলে,

– আন্টি সামনে পরিক্ষা আছে আপনি আরমিনকে একটু বুঝান এই সময়টাতে হ্যালাফ্যালা ভাবে চললে হবে না।আমরা পবন ভাইকে জিজ্ঞেস করলাম সে নাকি পড়তেও যায় না।আমরা এখন যাই আন্টি।

মনি,তাসনিম দুজনেই চলে গেলো।সাহেলা উঠে গিয়ে আরমিনের রুমের দরজা জোরে জোরে করাঘাত করতে থাকে।বিপুল শব্দে ছুটে আসে রিনানা।আরমিন দরজা খুলতে তার দিকে তাকিয়ে আতঁকে উঠে সালেহা।

– একি দশা তোর?তোর কি হয়েছে আমাকে বল আমি ঠিক করে দেবো।

– আমার কিছু হয় নাই আম্মা।আমি ঠিক আছি।তোমরা যাও আমাকে বিরক্ত করো না।

আরমিনের কথায় বেশ ক্ষোভ নিয়ে তাকিয়ে রইলেন সালেহা।রিহানা পাশে থেকে দাঁড়িয়ে মা মেয়ের কান্ড দেখছিলো।তার হাতে একটা অর্ধ খাওয়া পেয়ারা।মাতবর বাড়ি থেকে পেরে এনেছিলো কিছুক্ষণ আগে।পেয়ারায় কামড় বসিয়ে সে সালেহাকে উদ্দেশ্য করে বলে,

– জানো আম্মা আমি শুনছিলাম যারা প্রেমে পড়ে তাদের নাকি এমন হয়।আল্লাহ ভুল বলছি যারা প্রেমে ছ্যাকা খায় তাদের এমন হয়।আমাদের ক্লাসের কত মেয়েরে দেখতাম ক্লাসে বসে ভ্যা ভ্যা করে কান্দে আর বান্ধবিরা পাশে বইসা শান্তনা দেয়।আরমিন আপুরো কি এমন হইছে?

রিহানা কথা শেষ করলো।প্রশ্নের উত্তরের আশায় তাকালো আরমিনের দিকে।তৎক্ষনাৎ তার গালে এক ঘা বসিয়ে দিলো আরমিন।রিহানার দিকে দাঁতে দাঁত চেপে তাকিয়ে আছে সে।রিহানাকে আরেক চ-ড় মা*রতে নিলে সালেহা আরমিনের গালে ঠাটিয়ে চ-ড় বসিয়ে দেয়।

– আমার জবানের কসম আরমিন,তোরে আমি একদিন সময় দিলাম।তার মধ্যে তুই যদি আগের মতো প্রফুল্ল না থাকিস,বাইরে যে বটি রাইখা আসছি সেই বটি দিয়া এক কো/পে তোর কল্লা নিয়া নিমু।এই সালেহা আগুনে পুইড়া বড় হইছে আগুন নিয়া সংসার করতাছে।নিজেরে পু*ড়া*ইয়া তোদের সুখ দিতাছে তার পরেও যদি তোদের এমন বেহায়াপনা দেখি তাইলে আমার গর্ভের সন্তান বাঁচাই রাখনের কোন ইচ্ছা নাই।তোদের বিষ দিয়া মা*ইরা আমি নিজেও ম*ইরা যামু।কথাডা মাথায় রাখিস।

সালেহা হিসহিসিয়ে চলে গেলেন।আরমিন মাটিতে বসেই কেঁদে উঠলো শব্দ করে।এতদিনে আঘাতটা যেন আজ লাগামহীন ভাবে বাইরে আসছে।বোনের কান্নায় কষ্ট লাগছে রিহানার তাই সে এগিয়ে গেলো আরমিনের কাছে বোনের হাতটা টেনে বলে,

– আপু উঠো কাইন্দো না।তোমার জন্য পেয়ারা আনছি খাইবা?লবন মরিচ আনমু?

আরমিনের রাগটা এবার উড়িয়ে দিলো রিহানার উপর।রিহানার চুলের মুঠি ধরে পিঠে বেশ জোরে কয়েক ঘা লাগিয়ে দেয়।আরমিন দরজা বন্ধ করে আবারো ফুঁপিয়ে উঠে।
অপরদিকে রিহানার চোখের পানি গড়িয়ে পড়ছে অবাধে।ঘুমন্ত কায়েমের পাশে বসে মাথাটা ঠেকিয়ে দেয় কায়েমের হাতে।

– আব্বা আমার তো আম্মার কষ্ট সহ্য হয় না।আপুর কষ্টও সহ্য হয় না। সবাই সবার রাগে আমার উপর ঝারে কেন?আমার কি কষ্ট নাই?নাকি দুঃখ পাইবার অধিকার নাই?

#চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here