মায়াপ্রপঞ্চ,২৮,২৯

0
714

#মায়াপ্রপঞ্চ,২৮,২৯
#পলি_আনান
[পর্ব সংখ্যা ২৮]
________________
সালেহার বাড়িতে মানুষ জনের ভীড় জমে গেছে ইতোমধ্যে।সালেহার জ্ঞান ফিরে আর মাথা তুলে বসতে পারলো না।এখনো শুয়ে আছে সে।মেঝেতে হেলান দিয়ে বসে আছে আরমিন আর রিহানা।কাঁদতে কাঁদতে দু’চোখ ললচে আভায় ফুলে আছে।আমীনা সালেহার মাথায় তেল পানি মালিশ করছে।নাহার বেগম তদারকি করছেন জাবিরের সঙ্গে,কাফন,দাফনের ব্যবস্থার আলোচনা’ই চলছে তাদের মাঝে।কায়িমের মৃতদেহ পাশের রুমে মেঝেতে বিছানা করে রাখা হয়েছে।বাড়ির বাচ্চা সদস্যগুলোর মাঝে ভয় আতঙ্কক বিরাজমান।মণিরা পিটপিট চোখে দেখছে সবটা।প্লাবন তাকে সরিয়ে আনে পাশের রুমে।পবনের চাচা আছিম বাইরে থেকে ছুটে এসে দাঁড়ায় জাবিরের সামনে,

– ভাইজান মাতবর বাড়ির পারিবারিক করবস্থানেই দাফন করার ব্যবস্থা করেন।ওনাদের তো কবরস্থানের জমি নাই।

– সেটা নিয়েই আলোচনা করছিলাম তোর ভাবীর সঙ্গে।সব ব্যবস্থা কর আগামীকাল সকাল নয়টায় জানাজা হবে।মসজিদের মাইকে জানিয়ে দিতে বল হুজুরকে।

– ঠিক আছে।

কিয়ৎক্ষণের মধ্যেই সালেহা উঠে বসে।চোখ মুখ স্বাভাবিক রেখে ঘুরে তাকায় আরমিনের দিকে,

– তোরা এখানে বসে কাঁদছিস!তোর আব্বার কাছে কে?

আরমিন সহ বাকিরা চমকে তাকালো।আরমিন কি বলবে হঠাৎ প্রশ্নে বুঝে উঠতে পারলো না।

– কিরে কি জিজ্ঞেস করি তোরে আমি?

সালেহার ধমকে থতমত খেয়ে গেলো আরমিন।রিহানা কান্না বন্ধ করে চকিতে তাকায় মায়ের দিকে।আচরণটা একদম অদ্ভুত ঠিক আগের মতো।আমীনা সালেহার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,

– পবন,প্লাবন,জাবির ভাই সহ অনেকেই আছে।

– ওনারা কি কুরআন শরিফ পড়তেছে?

– না।পড়বে একটু পর।

– আরমিন,রিহানা তুই যা ওজু করে কুরআন শরীফ পড়।

আরমিন উঠে দাঁড়ালো।আমীনা প্রমাকেও ইশারা করে সে যেন কুরআন শরীফ পড়ে।

ধীরে ধীরে মানুষের আনাগোনা বাড়লো।এলাকার কিছু মহিলা সালেহার পাশে বসেই তসবি জপ করেন।আরমিন,রিহানা,প্রমা কুরআন শরীফ পড়তে শুরু করে।পবন আগরবাতি এনে একটা কাপে চাল দিয়ে কাঠি গুলো রেখে জ্বালিয়ে দিলো।মুহূর্তে পরিবেশটায় আগরবাতির সুভাস ছড়িয়ে গেলো।
.
শেষ রাতে সবাই সবার কাজে ব্যস্ত।সালেহা, আমীনা,নাহার সহ অনেকেই তসবি জপছেন।আরমিনের চোখের পানি গড়িয়ে নাক বেয়ে থুতনিতে পড়ার আগেই হাতের তালু দিয়ে অবহেলিত ভাবে মুছে নিলো।বুকটা ভারি হয়ে এসেছে চিৎকার দিয়ে কাঁদার মতো সুযোগো নেই।যতটুকু পারছে ঠোঁট কামড়ে দমন করে নেয় কান্না।বাড়ির বাইরে মাইক্রোবাসের শব্দে চকিতে তাকায়।নিস্তব্ধতায় গাড়িটির শব্দ সবারি কানে এসেছে।এই মুহূর্তে কে আসতে পারে ভাবতেই আরমিনের মনে এলো সুহাইলের নাম।

গাড়ি থেকে নেমে ফারজানা ছুটে আসে বাড়ির ভেতর।আশেপাশে কিছু মানুষকে দেখা যাচ্ছে কিন্তু তাদের দিকে তিনি বিশেষ গুরুত্ব চোখে তাকালেন না।ঘরের ভেতরে ডুকতে প্রথম চোখে পড়লো কায়িমের মৃত দেহ চাদরের সাহায্য ঢেকে রাখা হয়েছে।ফারজানা নিজেকে সামলাতে পারলেন না কায়িমের পায়ের কাছে বসে হাউমাউ করে কেঁদে উঠে।তার কান্নার শব্দে পাশের রুম থেকে সবাই দৌড়ে আসেন।আমীনা,নাহার বেগম অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে আছেন চেনার জন্য এই মহিলা কে?আরমিন ভালোভাবেই পরখ করতেই বুঝেতে পারে মহিলাটি কে।ফারজানার কান্নায় ভারী হয়ে উঠলো পরিবেশটা সুহাইল দ্রুত এসে সরিয়ে নেয় তার মাকে।কায়িমের পা ধরে কপাল ঠুকছিলেন তিনি।আশেপাশে সকলেই সুহাইলকে ইশারা করে ফারজানাকে সরিয়ে দিতে।
সুহাইল তাকালো আরমিনের দিকে।মেয়েটার চোখ মুখ ফুলে আছে,বোঝায় যাচ্ছে ঠিক কতটা কেঁদেছে।

– মামি কোথায়?

আরমিন উত্তর দিলো না।ভারী কোন অভিমান যেন ভর করেছে তার উপর।রিহানা বোনকে চুপ থাকতে দেখেই নিজেই ইশারা করে বললো সুহাইলকে সালেহা পাশের রুমে।ফারজানা দাঁড়িয়ে থাকলেন না সালেহার কাছে গিয়ে পা জড়িয়ে মাফ চাইতে থাকেন।

– ভাবীগো আমি যা করছি ক্ষমার অযোগ্য।তবুও আমারে মাফ করে দেন।আমি এই শোক ভুলবো কেমনে ভাবী।

সালেহার মাঝে কোন প্রতিক্রিয়া দেখা গেলো না।সে নির্বাক ভঙ্গিতে পা সরিয়ে নিলো।আশেপাশে সকলেই সন্দিহান দৃষ্টিয়ে চেয়ে আছেন।এই পরিস্থিতি তাদের বুঝে আসছে না।
এভাবে ব্যয়িত সময় অগন্য।ফারজানা সালেহার পায়ের কাছেই বসে ছিল।সুহাইল বাকিদের বুঝিয়ে বলে যা বলার পরে বলবে।ফজরের আযানের ধ্বনিতে আরেকবার মুখোরিত হলো চারিদিক।সালেহা নামায পড়বে বলে উদ্যত হয় কিন্তু ফারজানা তার পা ছাড়ছে না।

– পা ছাড়ো।

– ভাবীগো আমারে মাফ করে দেন।জীবনে সবচেয়ে বড় পাপ করছি রক্তের সম্পর্ক ছিন্ন করে।

– যার সাথে যা হবার তা হবে।যার ভাগ্য যা আছে তাই হয়েছে,হবে।আমার এই পা সারাজীবন ধরে রাখলেও তোমার উপর যে আমার রূহের বদদোয়া,আমার সন্তান,স্বামীর রূহের বদদোয়া লেগেছে তা মাফ হবে না।রণক্ষেত্রের মতো পরিস্থিতিতে যখন ছিলাম তখন রূহের বদদোয়া আপনা আপনি বর্ষিত হয়েছে।আমি মাফ করার কে?মাফ সে করবে যে এতদিন মৃ’ত্যুর যন্ত্র’ণা নিয়ে ছটফটিয়ে মরেছে।মাফ তারা করবে যাদের বাবা জীবিত থেকেও বাবা নামক ছাউনি ছিল না।আর আমার কথা বাদি দিলাম, স্বামি সংসারের ভোগ,আয়েশ আমি এই এক জীবনে করতে পারিনি।আমার এক, জীবন যৌবন কাটিয়েছি স্বামীর শুশ্রূষায়।

সালেহার চোখ থেকে গড়িয়ে পড়লো এক ফোটা অশ্রু।তার স্থির কন্ঠে কেঁদে দিলেন আমীনা এবং নাহার বেগম।সালেহার কষ্টটা তারা কাছ থেকে দেখেছেন বলেই আজ অনুভব করতে পারছে কতটা কষ্ট এই মানুষটার মনে জমা।সালেহা পা ছাড়িয়ে উঠে দাঁড়ালো উদ্দেশ্য ওজু করবে।ফারজানা মুখে কাপড় দিয়ে কেঁদে উঠলেন আবারো,

– আল্লাহ আমার ভাইটারে এত তাড়াতাড়ি কেন নিলা!একটু মাফ চাইবার সুযোগো দিলা না।

সালেহা ঘুরে তাকালো।ফারজানার দিকে তাকালো ধাঁরালো চাহনীতে,

– এই কথা খবরদার বইলো না।তোমার ভাই যে কতটা কষ্টে দিন কাটিয়েছে সেটা আমি জানি।তার মৃত্যুতে আমার বিন্দুমাত্র আফসোস নাই।বরং বেঁচে থাকতে যে শারীরিক,মানসিক কষ্ট ভোগ করেছে তার থেকে মুক্তি মেলেছে।আরেকটা কথা আমি তোমারে মাফ করে দিয়েছি আমার মনে কোন কষ্ট নাই।তবে একটা কথা কি জানো তোমার মতো মেয়ে আর বারেক দুলাভাইয়ের মতো ছেলের ঘরে কী করে দুজন সু-পুত্র আল্লাহ পাঠালেন সেটা তোমাদের ঢের ভাগ্য।ছেলেগুলো মাশাল্লাহ বাবা মায়ের মন্দ চোখ থেকেও অন্ধ হয়নি বরং অল্প বয়সে বিচার বুদ্ধি তীক্ষ্ম,ধারালো।

সালেহা চলে গেলেন।স্থির কন্ঠে যেন ধিক্কার ছুড়ে দিলেন ফারজানাকে।পাশের রুম থেকে বারেক,সুহাইল,সিয়াম তিন জনেই প্রতিটা কথা শুনেছে।মৃত কায়িমের সামনে দাঁড়িয়ে থেকে বারেক নিজের ভুলটা বুঝতে পারলেন।এই ভুলের মাশুল কী করে দিবেন তিনি!
.
সকালে শুরু হলো মৃতদেহ গোসল করানোর কার্যক্রম।মৃত ব্যাক্তিকে গোসল করানো ফরজ কিফায়া।যার মৃত ব্যাক্তিকে গোসল করাতে পারদর্শী তারাই গোসল করাবে।তাই দক্ষ কিছু লোক কায়িমকে গোসল করানোর অনুমতি পেলো।কুসুম গরম পানিতে বরই পাতার মিশ্রণে মৃত ব্যাক্তির গোসল কাজ চলতে থাকে।
অপর দিকে কবর খননের কাজ চলমান।কিছুক্ষণ পরেই এখানে শায়িত হবেন কায়িম।তার চিরস্থায়ী ঠিকানা হবে এই কবর।
.
বাড়িতে ছড়িয়ে আছে আগরবাতি,কর্পূর আর গোলাপজলের সুভাস।এই সুভাসি যেন ইঙ্গিতে দিচ্ছে আপনজন হারানোর।সকল কাজ শেষে জানাজার উদ্দেশ্য কায়িমকে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নেওয়া হয়।মসজিদের সামনে জানাজা সেরে সেখান থেকে কবরস্থানের সামনে নেওয়া হবে।খাটিয়া তুলে নেওয়ার জন্য সবাই উদ্যত হলে আরমিন দৌড়ে বেরিয়ে আসে ঘর থেকে।মেয়েটা কাঁদতে কাঁদতে বেশামাল অবস্থা।সালেহাকে সাদা কাপড় পরানোর পর থেকেই সে যেন উ-ম্মাদ হয়ে গেছে।নিজেকে স্থির রাখতে পারছেনা।মায়ের জীবনের রঙটাই নিয়ে যাচ্ছে তার বাবা।এর আগেও তো দুঃখ দুর্দশা কম সহ্য করেনি তার মা।একটু সুখের ছোঁয়া কি পাবেন না তিনি।বাবাকে ছেড়ে মা থাকবে কী করে।আজ থেকে দু’বোন অনাথ হয়ে গেছে।একটু পর পর রুমে এসে বাবাকে দেখা হবে না।বাবার হাতে হাত রেখে কত শত কথা বলেছিলো,পূরণ হবে না জেনেও কত চাওয়া-পাওয়া আবদার করেছিলো তবে কী সেসব আর হবে না।আরমিন ছুটে চলে খাটিয়ার পিছু পিছু।তার চিৎকারে সবাই ঘুরে তাকায়,

– আমার আব্বারে নিও না।আমার আব্বা একা থাকবো কেমনে।

সবার মাঝ থেকে আরমিনকে বাঁধা দেয় প্লাবন।আরমিনের হাত টেনে ধরতেই আমীনা এসেও আরমিনকে টেনে হিঁচড়ে নিতে থাকে।ততক্ষণে তার চোখের সামনে সাদৃশ্যমান তার বাবার খাটিয়া নিয়ে গেটের বাইরে চলে গেছে সবাই।বাড়ির গলি পেরিয়ে মসজিদ সেখানে গিয়ে থামবে সবাই।

#চলবে

#মায়াপ্রপঞ্চ
#পলি_আনান
[পর্ব সংখ্যা ২৯]
________________
চায়ের দোকানে বেঞ্চিতে মাছি,মশার উড়ো উড়ি নির্বাক ভঙ্গিতে দেখছে সুহাইল।গলির রাস্তায় শেষে এই চায়ের দোকানটি।তাই ভীড় একটু বেশি।আশেপাশে মানুষের কোলাহল তার যেনো কানেই ডুকছে না।দোকানে অপর পাশে কবরস্থান।সুহাইল ঘুরে তাকালো পেছনে, চার দেয়ালের বিশাল একটি পারিবারিক কবরস্থান।সদ্য কবরখানা দূর থেকেই দেখা যাচ্ছে।চিকন বাশের কঞ্চি কেটে বেড়া দেওয়া হয়েছে।ফর্সা চেহারাটা ফুলে রক্তিম ভাব ধারন করেছে ছেলেটার।ঈষৎ রক্তিম চোখ যুগল থেকে গড়িয়ে পড়লো এক ফোঁটা অশ্রু।চোখের জল আড়াল করতে বাম হাতের উলটো পিঠ দিয়ে অলস ভঙ্গিতে মুছে নিলো।মাথাটা ঘুরিয়ে পাশে তাকাতে চোখে পড়লো জাবির মাতবরকে।তিনি এতক্ষণ চুপচাপ পর্যবেক্ষণ করছিলো সুহাইলকে।ছেলেটা একদমি ভেঙ্গে পড়েছে।এমন বাচ্চা সুলভ ফ্যালফ্যাল চেয়ে থাকা কান্না সুহাইলের কাছ থেকে আশা করেননি জাবির।তিনি ভেবেইছিলেন সুহাইল শক্ত থাকবে।

– এভাবে কাঁদলে কি তোমার মামা ফিরে আসবে?

সুহাইল নেতিবাচক মাথা নাড়লো।জাবির তার দিকে চায়ের কাপটা এগিয়ে দিতে দু’চুমুক মুখে তুললো।

– আমার সবটা ব্যবস্থা হয়ে গেছিলো একদম সবটা।শুধু রাত পোহালেই চিকিৎসা শুরু কিন্তুু….

– আল্লাহ যাকে নিবেন তাকে সুস্থ অবস্থায়ও নিয়ে যান।আর কায়িম তো অসুস্থ ছিল।আমাদের বাড়ির দক্ষিনে যে বাড়িটি আছে সেই বাড়ির কর্তা ভালো মানুষ আমার সাথে বেশ ভালো সম্পর্ক।কয়েকমাস আগে দোকানে বসে দু’জনে জম্পেশ একটা আড্ডা দিলাম।আমার সাথে রসিকতা করে বাড়ি ফিরলেন আমি গেলাম বাজারে।বাজার থেকে আসতে মাঝ রাস্তায় একজন খবর দিলো তিনি আর নেই আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন।এবার বলো আমার তখন কেমন লেগেছিলো?বাস্তবতা মেনে নাও,আল্লার উপর ভরসা রাখো দেখো কষ্টটা লাঘব হবে।

সুহাইল প্রত্যুত্তর করলো না।আরেকবার ঘুরে তাকালো কবরের দিকে।শেষ বারের মতো আর মামার সাথে হাসি মুখে কথা বলা হলো না।
_

পেরিয়ে গেছে বেশ কয়েকদিন। সবাই সবার ব্যাক্তিগত জীবনের তাড়না নিয়ে ব্যস্ত।ফারজানা সালেহার কাছে রয়ে গেছেন।মাতবর বাড়ির সকলেই সবটা জেনেছে,যা হবার হয়ে গেছে যদিও এখন আর কিছু বলার নেই।বারেক ব্যবসায়িক কাজে কানাডায় ফিরে গেছেন।সালেহার সাথে ফারজানার সম্পর্ক খুব স্বাভাবিক,যেন অতীতে তাদের কোন বৈরিতা ছিল না।জাবির এবং সুহাইল নিজ তত্ত্বাবধানে সালেহার বাড়ির কাজ অর্ধেকটা শেষ করতে সক্ষম হয়।এ সাপ্তাহে সালেহার ইদ্দত শেষ হয়েছে।তাই নিজেকে বেশ স্বাভাবিক ভাবে গুছিয়ে নিচ্ছেন তিনি।আরমিন,রিহানার পড়াশোনা দেখভাল করছেন।যা হবার হয়েছে মেয়ে দুটোকে এবার সাবলম্বি করতে হবে।
.
স্বাভাবিক ভাবে সব কিছু আগের মতো হয়ে গেছে।ফারজানা দীর্ঘদিন যাবৎ কেশবপুরে থেকে এবার একটু ইতস্তবোধ করছেন।সুহাইল এবং আরমিনের বিয়ের বিষয়ে জাবিরের সাথে আলোচনা করেন তিনি।জাবির শুধু একটাই কথা বলেছে বিয়ের ব্যাপারে আলাপচারিতা আমি করতেই পারি তবে যদি সেখানে সালেহার মতামত থাকে।সালেহা বিয়েতে সম্মতি না দিলে জাবিরের কিছু করার থাকবে না।

সকাল এগারোটায় জাবির এলেন সালেহার কাছে সেখানে উপস্থিত ছিল ফারজানা।সূর্য তখন সবে দাপট দেখাতে শুরু করেছে।কড়া রোদের দরুনে ঘেমে নেয়ে একাকার সে।ফারজানার সাথে জাবিরকে দেখে অজানা ভয়ে আঁতকে ওঠে মন।

– জাবির ভাইজান কিছু কি বলবেন?

– হ্যাঁ।গুরুত্বপূর্ণ কথা বলার ছিলো।দেখো তোমরা আমাকে মান্য করো শ্রদ্ধা করো আমি সেটা জানি।আরমিন, রিহানা তাদের বলতে গেলে আমার নিজের চোখের সামনেই বড় করেছি তাই তাদের ভালো আমি নিশ্চই চাইবো।সালেহা অভয় দিলে একটা প্রস্তাব রাখতাম।

– বলুন ভাইজান।

– সুহাইলের পরিবারের সাথে তোমাদের যা হয়েছে সেটা অতীত।উনারা ওনাদের ভুল বুঝতে পেরেছেন তারা লজ্জিত।এখন কি সব মিটমাট করা যায় না?

– সব তো স্বাভাবিক আছে ভাইজান!আমি আর বিশেষ ভাবে কি মিটমাট কর‍তে পারি?

– সুহাইল ছেলেটা নম্র,ভদ্র,বিচক্ষণ,দায়িত্বশীল সেটা তুমিও জানো।তোমার মেয়েকে সে অসুখী করবেনা।আমার উপর বিশ্বাস রেখে সুহাইল আর আরমিনের বিয়ের ব্যবস্থা কী করা যায় না?

সালেহা এতক্ষণ এই ভয়টা পাচ্ছিলেন।জাবিরের কাছে তিনি চিরো ঋনি কখনো তার কথা অমান্য করার সাহস তার নেই।তাছাড়া সুহাইল একবার যখন আরমিনের পিছনে লেগেছে নিশ্চই বিয়ে করেই ছাড়বে তখন জল অনেক দূর গড়িয়ে যাবে।সাহেলা ভেবে চিনতে সিদ্ধান্তয় আসলেন।

– আপনার কথা আমি কখনো অমান্য করিনি ভাইজান।আপনি যেহেতু চাইছেন তাহলে আমিও সম্মোতি দিলাম।কিন্তু আমার যে একটা শর্ত আছে।

– নির্দ্বিধায় বলো।

– আরমিনের পরিক্ষা চলছে।এই মাস শেষ হতে তো বেশি দিন নেই।আর ষোল/সতেরো দিন আছে।আরমিনের পরিক্ষা শেষ হলে আগামী মাসের শুরুতেই শুক্রবার দেখে বিয়ের আয়োজন করা যায়।

ফারজানা আবেগে আপ্লুত হয়ে জড়িয়ে ধরলেন সালেহাকে।দু’চোখের জল তার চিকচিক করছে।

– ভাবী তোমার মেয়েকে কোন দিন অযত্ন করবো না।আমার বাড়ির রানী হবে সে।তুমি শুধু এই অধমকে একটি সুযোগ দাও।

ফারজানার কথা মিহি হাসলেন সালেহা।পর্দার অপর পাশে সবটাই শুনলো রিহানা আর আরমিন।আরমিন যতটা অবাক হয়েছে রিহানা ততটা অবাক হলোনা।সে একদম স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বিছানায় বসে পা দোলাতে থাকে,

– তোর বোনের বিয়ে হয়ে যাচ্ছে তোর কোন কোন প্রতিক্রিয়া নেই অদ্ভুত।

– আমি তো জানি তোমার সুহাইল ভাইয়ের সাথে বিয়ে হবে।তাই অবাক হলাম না।আম্মাকে সুহাইল ভাই যেভাবে ঠান্ডা মাথায় তোমাকে পাওয়ার আপদার করে গেছিলেন আমি তো ভেবেই নিয়েছিলাম জিতটা তারি হবে।তুমি দেখেছো সুহাইল ভাইকে সবাই কি করে মান্য করে সম্মান করে সেই ছেলেকে বাড়ির জামাই করতে সকলেই উঠে পড়ে লাগার কথা।

আরমিন নিশ্চুপ বসে রইলো।মাথার ভেতরে সব খালি খালি লাগছে।সালেহা কি সত্যি তবে বিয়েটা দিয়ে ছাড়বে!
_

সুহাইলরা ঢাকার উদ্দেশ্য বিকালেই রওনা হয়েছে।আমীনার কথার যুক্তি নিয়ে পবন একটি কোচিং সেন্টার খোলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।তারই প্রস্তুতে বর্তমানে ব্যস্ত সময় পার হচ্ছে তার।সেই কোচিং তার পরিচিত এলাকার কিছু ছেলেমেয়েকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেবে।সব কিছুতে তাকে সাহায্য করেছে দু বন্ধু রিজু এবং সায়মন।সন্ধ্যার সময় গলির মোড়ে প্লাবনের সাথে পবনের দেখা হয় তখন জানতে পারে আরমিনের নাকি বিয়ে ঠিক হয়েছে তার ফুফাতো ভাই সুহাইলের সাথে বিষয়টি প্লাবনকে নিশ্চিত করেছে রিহানা।
পবন দাঁড়ালো না ছুটে গেলো বাড়িতে।বসার ঘরে উপস্থিত ছিলো সকলেই প্রত্যকে আরমিনের বিয়ের বিষয়টা নিয়েই আলোচনা করছিলো।পবনকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে চমকে তাকায় আমীনা।জাবির তাকে দেখেও না দেখার ভান করে চুপচাপ কথায় ব্যস্ত।

– আব্বু আমাকে না জানিয়ে এত বড় সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলে?

পবনের কথায় সবাই ঘুরে তাকায়।নাহার বেগম মুখটা কুচকে বলেন,

– তোকে আর কি বলবে ভালো ছেলে পেয়েছে বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

পবন এগিয়ে গেলো আমীনার কাছে।আমীনা তখন দ্বিধাদন্দে পড়ে যায় আজ নিশ্চই হেরফের কিছু একটা হবে এই বাড়িতে।

– চাচী ওনাদের বলো ওনাদের ছেলে এই বিয়ে মানবে না।ওনাদের ছেলে ম-রে যাবে একদম শেষ হয়ে যাবে।

জাবির এগিয়ে এলো,পবনের কাঁধে হাত রেখে আশ্বাসের স্বরে বলে,

– তোর জন্য আরো ভালো মেয়ে পড়ে আছে।এসব ছেলেমানুষী করিস না পবন।

নাহার সবটা চুপচাপ দেখছিলো বাপ ছেলের কান্ড।এসব কিছু তার মাথায় ডুকছে না।

– পবনের আব্বা কি হয়েছে আমাকে বুঝাই বলো।

– তোমার ছেলে তুমি যেটা চাইছো না সেটাই চাইছে।আরমিনকে এই বাড়ির বউ করতে চাইছে।

নাহার বেগম চুপ হয়ে গেলেন।পবন তাকিয়ে থাকলো তার মায়ের দিকে।নিশ্চই তার মা তাকে ফিরিয়ে দেবে না।পবন এগিয়ে এলো হাটু মুড়ে বসে পড়লো নাহার বেগমের সামনে,

– আম্মা তুমি যা বলবে তাই শুনবো একদম তোমার সব কথা।তুমি শুধু আরমিনের বিয়ে আটকাও আমি নিজেও প্রতিষ্ঠিত হবো আরমিনকেও পড়াশোনা করাবো এর পর বিয়ে।তোমার ছেলে ম-রে যাবে আম্মা বিয়েটা আটকাও।

নাহার বেগম স্থির হয়ে গেলেন।পবনের মুখের দিকে তাকিয়ে ভীষণ মায়া লাগলো।ঠিক ছোট বেলায় এমন ভাবে বায়না করতো সে আজ বড় হয়েও ছেলেটা যেন বাচ্চা হয়ে গেছে।

– সত্যি তুই তোর আম্মার কথা শুনবি?

– সব শুনবো সব।

– আমার মাথা ছুঁয়ে কথা দে!

নাহার পবনের হাত টেনে নিজের মাথায় ঠেকায় ছেলেটাও এতটাই ভালোবাসায় অন্ধ হয়ে আছে কালবিলম্ব না করেই কথা দিয়ে বসলো,

– কথা দিলাম আম্মা তোমার সব কথাই শুনবো।

– আরমিনের বিয়েতে বাঁধা দিস মা বাপ।সুহাইলের সাথে বিয়েটা হতে দে।এই নিয়ে আর যেন কোন বাড়াবাড়ি না দেখি আমি।এটাই আমার শেষ কথা।

পবন তড়িৎ গতিতে তাকালো নাহার বেগমের দিকে।বোধ বুদ্ধি যেন লোপ পেয়েছে তার।বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে তার মা তাকে এমন একটা কথা বলবে,এখন কী করবে সে!প্রমত্ত মনটা ভেঙ্গে গুড়িয়ে গেলো।বসার ঘরে চলছে পিনপিনে নিরবতা।জাবির মাথা নিচু করে আছে।যদি নাহার বেগম সম্মোতি দিতেন তবে আরমিনকেই বাড়ির বউ হিসেবে মর্যাদা দিতেন।কিন্তু বাড়ির কর্তীর উপর কোন কথা বলবেন না তিনি এতে বাড়ির শান্তি যেমন খোয়া যাবে তেমনি সালেহার দূর্দশা নেমে আসবে।পবন আজ বাদে কাল হয়তো নিজেকে সামলে নিবে, না হয় আবেগের দরুনে নিরিক্ত হবে সব কিছু।

– তোমার কথাগুলো হয়তো বেশ মধুর ছিল আম্মা।তবে আমার জন্য বিষ।একদিন আফসোস করবে!

পবন ছুটে চলে যায় নিজের রুমে।পবনের এমন রাগান্বিত থমথমে মুখ আগে কখনো দেখেনি কেউ।স্বভাব সলুভ ভাবে সে অনেক হাস্যরসের ছেলে আরমিন ছাড়া কারো সাথেই খুব একটা তর্কে জড়ায় না।আমীনা সহ সবাই সন্দিহান চোখে তাকালো উপরের তলায় হঠাৎ কানে আসে ভাঙ্গচুরের শব্দ।পবন নিজের রুমের সব ভে-ঙ্গে গুড়িয়ে দিচ্ছে।জাবির চিন্তিত মুখ নিয়ে নাহার বেগমকে ধমকে বলেন,

– আমি জানি তুমি ছেলের ভালো চাইছো এই বাড়ির সম্মান চাইছো কিন্তু তাই বলে ছেলের চাওয়া পাওয়া ফেলনা ধরে নেবে!

– এসব বয়সের দোষ পবনের আব্বা।এত নরম হইয়ো না তোমার ছেলের জন্য মেয়ে দেখো,পাশের এলাকার সুরুজ ভাইয়ের মেয়েটা আরমিনের বয়সের তাদের একটাই মেয়ে নামদামো অনেক।প্রস্তাব পাঠানোর ব্যবস্থা করো।মেয়েটা আরমিনের থেকেও রূপবতী।পবনের এক দেখাতেই পছন্দ হবে।

নাহার বেগমের কথায় মুখ খুললো আমীনা,তড়বড়িয়ে বলে,

– পবন তো সৌন্দর্য দেখে বিয়ে করতে চায়নি ভাবী।পবন আরমিনকে ভা…..

– তুই চুপ কর আমীনা।বেশি বুঝিস না।তুই যে পবনের মাথায় আড়ালে নিড়ালে বুদ্ধি ঢালিস সেটা আমিও জানি।আর যেন এসব না দেখি আমার ছেলের ভালো আমি বুঝি।তোকে বোনের চোখে দেখি এমন কোন কান্ড করিস না তোর আর আমার সম্পর্কে তিক্ততা চলে আসে।

আমীনা চুপসে গেলো।জাবির মাতবরের পিছু পিছু সে নিজেও ছুটলো পবনের রুমের দিকে।

#চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here