#মায়াপ্রপঞ্চ,পর্ব সংখ্যা ৪৪
#পলি_আনান
_______________
পাড়া প্রতিবেশির গুঞ্জনে মুখোরিত কেশবপুর।একদলের মুখে মুখে রটে গেলো সুহাইলের মৃত্যুর সংবাদ।যদিও তারা করুন স্বরে কথা রটায়নি বরং নিন্দাসূচক বাক্যে বিশ্লেষণ করছে।তাদের মুখে একটাই কথা ‘আরমিন জামাইরে খাইছে।’ সালেহার কানে সব কথা আসছে কিন্তু মানুষের কথায় গা লাগানোর সময় এখন নয়।আমীনার কোলে আরমিনের মাথা তখন যে চেতনা হারিয়েছে এখনো চেতনা ফিরেনি মেয়েটির।ফারজানা বিছানার একপাশে গুটিয়ে শুয়ে আছে তার মাথায় তেল মালিশ করছে নাহার বেগম।সালেহা থম মেরে বসেই রইলো কি করবে,কাকে কী বলবে তার মাথায় আসছে না।নিজের জীবনটা তো নরক যন্ত্রণায় গেলো এবার বুঝি আদরের মেয়েটারো একই দশা হবে।না না একথা ভাবার আগে সালেহার শ্বাস আটকে আসে।কলিজায় ছেদন ঘটে বার বার।আমীনার কান্নার শেষ নেই অঝোরে চোখের জল পড়ছে তার।আরমিনের জীবনে এমন প্রলয়ংকারী ঝগড়ের আগমন মানতে নারাজ সে।আমীনার কান্নার মাঝেই চোখ খুলে আরমিন।নিস্তব্ধতা কাটিয়ে আমীনার হাত জড়িয়ে প্রশ্ন করলো সে,
– সুহাইল কই আন্টি?
আমীনা ভড়কালো অতি দ্রুত তাকালো আরমিনের দিকে।মেয়েটার মাথায় হাত বুলিয়ে ক্ষীণ আর্তনাদে বলে,
– সুহাইলের দাফন কাজ শেষ।
মেয়েটা উঠে বসে দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকালো এক পলক।রাত সাড়ে বারোটার বেশি বেজে গেছে।তড়িঘড়ি করে বিছানা থেকে নামতে গিয়ে উপলব্ধি করে তার গায়ে কোন গহনা নেই।
– আম্মা আমার গহনা কই?
সালেহা জবাব দিলেন না।মাথা নামিয়ে নিলেন সহসা।এই কষ্ট তার চোখে সইছে না।কি করে মেয়ের শরীরে সাদা কাপড় স্পর্শ করাবেন।
– আমার আংটি কই আম্মা?এটা সুহাইলের পছন্দের আংটি।
– এসব এখন তোর না পরাই ভালো।গায়ের শাড়িটাও খোল।
এলাকার একজন বয়স্ক মহিলার কথায় তীক্ষ্ণ চোখে তাকালো আরমিন।গায়ের হলুদ শাড়িটি জড়িয়ে নিলো ভালোভাবে।
– এই শাড়ি কখনো ছাড়বো না আমি।আমার সুহাইল বলেছিলো সে আমাকে দেখবে।তার হলদিয়া মরিয়মকে দেখবে।সে না দেখা পর্যন্ত আমি কেন গা থেকে শাড়ি ছাড়বো?
আমীনা ঠোঁট চেপে কাঁদছে কি করে বোঝাবে এই মেয়েকে।আরমিন উঠে দাঁড়ালো রুম থেকে বেরিয়ে গেলো দ্রুত।আমীনা সহ বাকিরা তার পেছন পেছন এগিয়ে আসে।উঠনে দরজার বাইরে বসা ছিলো সিয়াম,মাফী,শাওন।আরমিন দ্রুত গিয়ে সিয়ামের পা চেপে ধরে,
– তোমার ভাই আমাকে ভালোবাসেনি তাই না?ভালোবাসেনি বলেই ছেড়ে গেছে।কেন চলে গেলো তোমার ভাই আমি কি অন্যায় করেছিলাম।
– ভাবি তোমার মা আছে বোন আছে, ভাইয়া তোমার জীবনে অল্প খানিকটা সময় জুড়ে ছিলো।একটা সময় তুমি নতুন জীবন সঙ্গী পেয়ে যাবে কিন্তু আমি কি আমার ভাইকে ফিরে পাবো?কি করে পাবো আমার ভাইকে?আমার পথপ্রদর্শক আমাকে ছেড়ে চলে গেলো।
সিয়াম কেঁদে ফেললো।সে কান্নাটি ছিলো বাচ্চাদের মতো।মামার হারানো সম্পদ ফিরিয়ে দেওয়ার তাড়নায় দু’ভাইয়ের সে কি কলাকৌশল দেশে যাবে কবে,কী করে আরমিনদের খুজবে?সুহাইলের মুখে সবসময় একটা কথাই বাজতো ‘আমাদের বাবা মা যা করেছে তার খেসারত না আমাদের দিতে হয়।পিতা মাতার পাপ পূণ্য সন্তানের উপর প্রভাব ফেলে কোননা কোন ভাবে।’
দু’চোখ খিচে বন্ধ করলো সিয়াম।বাবা মায়ের উপর তীব্র ভাবে রাগ চেপে বসেছে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করা দুঃসাধ্য হয়ে পড়েছে।আরমিনের ভেজা দু’চোখ পড়লো শাওনের দিকে সন্দিহান চোখে তাকিয়ে প্রশ্ন ছুড়ে ছেলেটার দিকে,
– এদের সাথে তোমার কি সংযোগ ?তুমি এদের সাথে কি করছো?তুমি না বিদেশ যাবে।
শাওন থতমত খেয়ে গেলো মাথা নামিয়ে নিলো সহসা।পরিস্থিতি পালটে যাচ্ছে বুঝতে পেরে মাফী চুপ থাকতে ঈশারা করে শাওনকে।
– সুহাইলের অফীসে জব করছে সে।
– সুহাইলের খোঁজ সে পেলো কি করে?
– মাফী ভাই মিথ্যা বলে লাভ নেই সত্যিটা বলে দি।
শাওনের গলা কাঁপছে নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছে পুরো শরীর।
– আমাকে কানাডায় নেওয়ার ব্যবস্থা করেন সুহাইল ভাই।বলতে গেলে আমার জীবনের আশীর্বাদ হয়ে এসেছিলেন।আমাকে ভালো পদে চাকরি দিলেন।আমার পারিবারিক অর্থনৈতিক অবস্থান পালটে গেছে।আমার বোনের ভাঙন সংসারটা বাঁচিয়ে দিলেন।আব্বার চিকিৎসার খরচ বহন করলেন।এত ভালো একজন মানুষ আমাদের মাঝে নাই ভাবতেই দুনিয়া আঁধার লাগে।
শাওন কথা শেষ করার আগেই ঘরের ভেতর থেকে হট্টগোল শোনা গেলে সিয়াম বারেকের সঙ্গে তর্কাতর্কিতে জড়িয়ে পড়েছে অতীতের কার্যকলাপ নিয়ে প্রশ্ন তুলছে।কিন্তু বারেক নিশ্চুপ একে একে সবাই ঘরের ভেতর প্রবেশ করে কিন্তু প্রবেশ করলো না আরমিন।সুযোগ বুঝে বেরিয়ে যায় বাড়ির বাইরে।গলির শেষ মাথায় মাতবর বাড়ির পারিবারিক কবরস্থান।সেখানে জ্বলছে একটি সোডিয়ামের লাইট।কবরস্থান ঘেরা দেওয়া দেওয়ালটি উঁচু কম হওয়াত আরমিন সহজে পৌঁছে গেলো সুহাইলের কবরের সামনে।পাশেই তার বাবার কবরস্থান।নতুন কবরটা চিহ্ণিত করতে আরমিনের খুব একটা সময় লাগলো না।এক পলকেই ঝাপিয়ে পড়লো সুহাইলের কবরের উপর।জড়িয়ে নিলো দু’হাতে।
– আমার আব্বাকে এত ভালোবাসেন বলে আব্বার পাশেই শায়িত হলেন।সুহাইল আপনি কেন কথা দিয়ে কথা রাখেননি?আপনার বুকের বা পাশটা খালি পড়ে আছে তো আমায় নিয়ে গেলেন না কেন?একা থাকতে ভয় লাগে না আপনার?দেখেন সিয়াম কাঁদছে,ভাই ভাই করে পা/গল হয়ে যাচ্ছে আমরা কেউ কিছু চাই না আপনি ফিরে আসেন শুধু।
কবরটা জড়িয়ে ধরে নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসার মতো কাঁদলো মেয়েটা।হলুদ শাড়িটা মাটিতে মাখামাখি অবস্থা,এলোমেলো চুলে ভয়ংকর বিধ্বস্ত নারী লাগছে তাকে।
– বলেছিলেন না আমি হলুদ শাড়ি পড়বো আপনি আপনার হলদিয়া মরিয়মকে দেখবেন একটা বার দেখে যেতে পারলেন না।আমরা পাহাড়ে যাবো সুহাইল আবার সূর্য উদয় দেখবো নিস্তেজ হওয়া সূর্য অস্ত দেখবো আপনি ফিরে আসেন না সুহাইল।আমাকে কথা দিয়েছেন ঘোড়ার পিঠে লাগামহীন ছুটবো দুজনে।আপনি একটি বার ফিরে আসেন না।আপনি কেন গেলেন বিদেশ আমি তো যেতে বলিনি।আপনি রোজগারের জন্য গেছিলেন তাই না?আপনার টাকা না থাকলে মরিয়ম আপনাকে ভালোবাসবে না তাই গেছিলেন?অথচ আপনাকে ছাড়া আমি কিচ্ছু চাইনি।যেভাবে মায়ায় বাঁধতে বাধ্য করলেন সেভাবেই মায়া কাটাতে বাধ্য করছেন?আমি আপনাকে ছাড়া কোথাও যাবো না কোথাও না।অপেক্ষা করেন আমি আসছি।
সুহাইলের কবরের পাশে খালি অংশটুকু হাত দিয়ে খুড়তে শুরু করে মেয়েটা।পা/গলে মতো প্রলাপ বকছে সে।বিড়বিড় করে একটা কথাই বলছে,’আমি আসছি সুহাইল আপনার বুকের বা পাশটা খালি রইবে না।’
কান্নার চাপা আর্তনাদে ভয় পেয়ে গেলেন দোকানদার মতিন মিয়া।নতুন কবর হওয়ায় দোকান বন্ধ করে আজ দ্রুত বাড়ি ফিরে গেছেন।শত হলেও একা দোকানে থাকতে বড্ড ভয় লাগে।ব্যবহৃত মোবাইলটা দোকানে রেখে আসায় আবারো দোকানে আসেন তিনি।কিন্তু নারীর কান্নার আওয়াজে রুহ কেঁপে উঠে তার।হাতে থাকা টচ লাইট কবরের দিকে তাক করে বলেন,
– কেরে এহানে কে?
আরমিনে তালগোল নেই সে তার কাজে ব্যস্ত।মতিন মিয়া ভালোভাবে পরখ করে বুঝতে পারেন মেয়েটা আরমিন।ছুটে এসে তিনি চিৎকার চেচামেচি শুরু করেন।এদিকে বাড়ির সবাই হন্য হয়ে খুঁজছে আরমিনকে।চিৎকার শুনে সবাই দ্রুত এগিয়ে আসে গলির মুখে।
– আপনাগো মাইয়া আরমিন দেহেন কি করে।
সিয়াম তোড়জোড়ে এগিয়ে এলো।হেঁচকা টেনে নামিয়ে আনে কবরের স্থান থেকে।উন্মাদের মতো ব্যবহার করছে মেয়েটা।বার বার ছুটে যাচ্ছে কবরের দিকে।
– ছাড় আমায় তোমরা সবাই নিষ্ঠুর একা রেখে গেল কেন তোমার ভাইকে?আমাকে ছাড়া রাতে সে থাকে না।
– নিজেকে সামলে নাও ভাবী এভাবে ভেঙ্গে পড়লে চলবে না।
– ছেড়ে দাও আমাকে।
আরমিনের আহাজারি কমলো না বরং বাড়লো একে একে গলির মুখে সবাই উপস্থিত।মহিলারা ঠোঁট বাকিয়ে নিন্দার ঝড় তুলছে।
– দেখ অলক্ষি জামাইডারে মারছে এখন ঢং করে।
– এই তো কদিন নাটক এমনেই চলবো।বড় লোকের পোলারে ধরছে টাকা পয়সার ভোগে দিন কাটবো জামাইর শোক ভুইলা যাইবো আজ বাদে কাল।
– টাকা থাকলে জামাইর কাম কি?কপাল পুড়া মা তার ঝুলির কপাল পুড়া মাইয়া জন্ম হইছে।
– ঠিক কইছো ভাবি।আবার মাতবরের পোলার লগেও ঘেষাঘেষি চলে গিয়ে দেইখো আজ বাদে কাল পবইন্নারে হাতের মুঠোয় আনবো।
– হাচা কথাই কইছো।
.
ফজরের আযান কানে এলো আরমিনের এখনো থম মেরে বসে আছে মেঝেতে।সবাই গায়ে থাকা গহনা খুলতে পারলেও গায়ের শাড়িটি কেউ খুলতে পারেনি।মাতবর বাড়ির সবাই ফিরে গেছে আমীনা থাকতে চেয়েও থাকতে পারলেন না।ফারজানা,সালেহা,রিহানা সবাই জায়নামাজ বিছিয়ে নামাযে পড়তে শুরু করেছে।আরমিনের মাথায় কি চলছে কে যানে দ্রুত উঠে গেলো রান্না ঘরের দিকে একে একে তার সহ সালেহা,ফারজানার তৈরিকৃত খাবার গুলো ছুড়ে ফেললো মেঝেতে।পাতিল মেঝেতে পড়ার শব্দে বারেক তড়িঘড়ি করে রান্না ঘরে আসেন।আরমিনের কান্ড দেখে কয়েক পল তাকিয়েছে ছিলেন এই মুহূর্তে কিংকর্তব্যবিমূঢ় সে।
– মারে কি করছিস এতগুলো খাবার ফেলছিস কেন?
– থাকবে না কোন খাবারি থাকবে না।যার জন্য এত শত আয়োজন সে যেহেতু নেই এই খাবার থাকবে না।
বারেক টেনে হিঁচড়ে বের করে আনেন মেয়েটাকে।এতক্ষণ একে একে সবাই উপস্থিত কিন্তু কেউ কোন টু শব্দ করলো না।আরমিন ছুটে গেলো নিজের রুমে আলমারি ঘেটে বের করলো সুহাইলের একটি শার্ট রিহানা চুপচাপ পাশে এসে বসলো মেয়েটার।
– দেখনা তোর ভাইয়ার গায়ের গন্ধ লেগে আছে শার্টটায়।
রিহানা চুপচাপ দেখছে সবটা চোখের জল বাধ মানছে না।আরমিন একে একে কয়েকটি জিনিসপত্র বের করলো।কুয়াকাটায় কেনা সেই ফ্লোরাল টুপিটি মাথায় নিয়ে বলে,
– এই টুপিটা তোর ভাইয়া আমাকে পড়িয়ে দিয়েছিলো জানিস সে কি খুশি ছিলো তখন।এই শামুকটা দেখ আমার আর সুহাইলের নাম লিখেছিলাম।সে কি বলেছে জানিস
আরমিন ঝাপসা চোখে তাকালো রিহানার দিকে,না চাইতেও বার বার ভেসে আসে কিছু সুন্দর স্মৃতির মুহূর্ত।
– সুহাইল আমাকে ঝিনুক কিনে দিন।
– যত ইচ্ছা নাও।
– আপনার বোধহয় টাকা কাড়ি কাড়ি যে দোকানে যাই সেখানেই বলেন,যা ইচ্ছা নাও,যা ইচ্ছে নাও।
– আল্লাহর রহমতে তোমার এই ছোট খাটো শখ পূরণ করতে আমার টাকার ঘাটতি হবে না।
আরমিন প্রসন্ন হাসলো।বড় একটি শঙখর ন্যায় ঝিনুক কিনে নেয়।ঝকঝকে সাদা ঝিনুকটি দেখতে সত্যি মুগ্ধকর।আরমিন বড় একটি শামুকে তাদের দুজনের নাম লেখায়।
– এই শামুকটা সারাজীবন আমি নিজের কাছে রেখে দিবো সুহাইল।
– পুরো আমিটাকেই রেখে দিও।
স্মৃতি রোমন্থে কান্না বেড়ে গেলো মেয়েটার।সুহাইলের শার্ট বুকে জড়িয়ে আহাজারি তার থামছেই না। “আপনাকে আমি আমার কাছে রাখতে পারলাম বা সুহাইল।আপনি আমার কাছে থেকে গেলেও পারতেন।সুহাইল আপনি আমায় বলেছিলেন না একজন মেয়ের বিবাহিত জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তার স্বামী।আজ আপনি নেই তবে আমি বেঁচে আছি কেন?কেন এত মায়া জন্ম দিলেন আমার মনে।মায়ার বিস্তার বাড়িয়ে আপনি হারিয়ে গেলেন।আপনার প্রতি আমার বিন্দুমাত্র রাগ নেই,ক্ষোভ নেই,ঘৃণা নেই তবে আমি কি করে ভুলবো আপনাকে?আমার আপনার প্রতি ছিলো অসীম ভালোবাসা,দরদ,মায়া।আমি অভাগী আমার মায়ের মতো অভাগী।”
আরমিন নিস্তেজ চোখে তাকিয়ে থাকলো মেঝের দিকে সালেহা এগিয়ে এসে আঁকড়ে ধরলো মেয়েটাকে।
– লোকে ঠিকি বলে সালেহার মেয়ের জীবনটা তার মতোই হয়েছে।আল্লাহ তোর কপালে কেন সুখ দিলো না মা?কি অন্যায় ছিলো?
.
বদ্ধ রুমটায় দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে কাঁদছে পবন।আর কতদিন এভাবে কষ্ট সইবে?আরমিনের আর্তনাদ তার তালগোল পাকিয়ে দিচ্ছে।চারিপাশের সব কিছু ক্রমশ অসহ্য লাগছে।এমনটা কেন হলো?আরমিন তার হয়নি কিন্তু সুহাইলকে সে ভালোবেসেছে মাঝ রাস্তায় কেন সুহাইল চলে গেলো।অন্ধকার রুমটায় কতবার যে মাথা ঠুকেছে তার ইয়ত্তা নেই।কপালের এক দিক থেকে গলগলিয়ে পড়ছে র/ক্ত, কিন্তু তাতে তার যায় আসে না।বার বার আরমিনের ক্রন্দন মুখখানি যখনি ভেসে উঠে রোমন্থে এলোমেলো লাগে সবটা।
– আল্লাহ আমি কেন মরলাম না সুহাইল বেঁচে যেতো।সুহাইলকে ছাড়া আমার আরমিনের কষ্ট হচ্ছে ভীষণ কষ্ট।
ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে।এই মুহূর্তে কেন জানি আরমিনের সঙ্গে দেখা করার বড্ড তৃষ্ণা জেগেছে মনে কিন্তু কেন তা জানে না সে।কেউ কি দেখা করতে দিবে?হয়তো দিবে না।তবুও পবন বেরিয়ে পড়ে রুম থেকে যে করেই হোক আরমিনের সাথে দেখা করবে সে।
উঠনের এক কোনে দাঁড়িয়ে আছে রিহানা ছোট ছোট মুরগী গুলোকে খাবার দিচ্ছে সে।পবন সুযোগ বুঝে এগিয়ে যায় তার দিকে।
– আরমিন কোথায়?
রিহানা চমকে তাকায় ছেলেটার কপালে রক্ত শুকিয়ে দাগ পড়ে আছে।
– পবন ভাই কপাল কাটলো কি করে?
– সেসব ছাড়।যা জিজ্ঞেস করেছি তা বল।
– বাইরে থেকে আম্মা দরজা বদ্ধ করে রেখেছে আপু পাগ/লামি করছে কবরের কাছে যেতে চাইছে বার বার।
– কিছু খেয়েছে সে?
– না।
– আমি দেখা করবো।একবার শুধু একবার দেখা করবো।একটু কথা বলতে চাই।
রিহানা ইশারা করলো পবনকে তার পিছু আসতে।ঘরের ভেতর ডুকতেই দেখা গেলো আরমিনের রুমের বাইরে সালেহা বসে কাঁদছে বাইরে থেকে দরজাটার ছিটকিনি লাগানো।
– আমি আরমিনের সাথে দেখা করতে চাই আন্টি।
সালেহা চমকে তাকায়।দাঁত কিড়মিড়িয়ে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে রিহানার দিকে।মেয়েটা মাথা নিচু করে দ্রুত সরে যায় সেখান থেকে।
– বিধবা মেয়ের সাথে তুমি পরপুরুষ দেখা করা ঠিক হবে না।এলাকার মানুষ নানান কথা তুলছে তুমি এখন এখানে কেন এসেছো?
– আমি পাঁচটা মিনিট কথা বলবো।শুধু পাঁচ মিনিট কথা বলেই চলে যাবো।
– একদম না।চলে যাও।
পবন হাটু মুড়িয়ে বসলো সালেহার সামনে।ছেলেটার রক্তিম চোখ যুগলে টলমল করছে পানি।সালেহার চোখে চোখে রেখে দাঁতে দাঁত চেপে পবন বলে,
– মানুষের কথা শুনতে গিয়ে নিজেকে আর শেষ করতে চাই না।আমার আরমিনের সাথে কথা বলা প্রয়োজন।
পবন দ্রুত দরজা খুলে প্রবেশ করে আরমিনের রুমে।দরজাটা আটকে বসে পড়লো মেঝেতে।আরমিন মাথাটা বিছানায় রেখে মেঝেতে লেপ্টে বসে আছে।দু’চোখ বন্ধ নিশ্চই ঘুমাচ্ছে।
– আরমিন?
আরমিন ঘোরে ছিলো দু’চোখ বন্ধ করে নিয়ন্ত্রণ করছিলো নিজেকে।পবনের কন্ঠে চমকে মাথা তুলে তাকায় গলা এমনিতেই শুকিয়ে আছে পবনকে দেখে ভেতরটা সব যেন আরো শুকিয়ে গেলো কান্নাগুলো দলা পাকিয়ে বিধে যাচ্ছে গলায়।
– কাঁদিস না আরমিন।জানিস না তোর কান্না আমার সহ্য হয় না।
– আমার সাথে এমনটা কেন হলো পবন ভাই?আমি কি অন্যায় করেছিলাম?
– সবটা উপর ওয়ালার ইচ্ছে।কেউ বাধা দিতে পারবে না তাতে, ত..তুই নিজেকে সামলা।একটুখানি সামলা।
– পারবো না।পারবো না আমি।আমাদের জীবনটা এত দুঃখে ভরা কেন বলতে পারবে?
আমার আম্মা আব্বার শোকে কাটালেন,আর আমার সুখ দেখে আম্মা যখনি নিজেকে সামলে নিলো তখনি নেমে এলো এই ঝড়।আমি বাঁচতে পারবো না পারবো না সুহাইলকে ছাড়া বাঁচতে।
পবন কিয়ৎক্ষণ তাকিয়ে রইলো আরমিনের দিকে।বুকের ভেতরটায় অস্বস্তি বেড়ে গেলো।বলবে কি বলবে না ভেবে গলাটা শুকিয়ে আসছে তবুও তাকে বলতেই হবে।এভাবে আর কত?নিজে এতদিন কষ্ট পায়েছে এবার আরমিন কষ্ট পাবে তা হয় না।একটা সমঝোতা তো প্রয়োজন।পবন আরমিনের কাছে ঘেষলো না খানিকটা দূর থেকেই দেখলো তাকে।
– আরমিন যা হওয়ার হয়েছে এভাবে কদিন চলবে?আমি আছি বিশ্বাস কর আমি আছি তোর পাশে সারাজীবন বন্ধু হয়ে থাকবো।এই কেশবপুরে তোকে থাকতে হবে না তুই ঢাকায় চল তোর পড়াশোনা সেখানে হবে আমি… আমি হানিফ মামার সাথে কথা বলেছি তিনি সব ব্যবস্থা করে দেবে।প্লিজ তুই আমাকে বন্ধু ভেবে বিশ্বাস রাখ।
আরমিনের কান্না থেমে গেলো অবিশ্বাস্য চোখে তাকালো ছেলেটার দিকে।গায়ে কাদা মাখা শাড়িটি গুটিয়ে নিলো গায়ের সাথে।এলোমেলো চুল খামছে আহাজারি আর্তনাদ করলো আরো একবার।
– পবন ভাই এসব বলো না।আল্লার দোহাই বলো না।এলাকার মানুষ খারাপ বলছে এখন তুমি এসব বলে আর মুখ খুলিও না মানুষের।আমি সুহাইলকে ছাড়া কিছু ভাবতে পারবো না পারছিনা।আমার ক্ষণে ক্ষণে দম বন্ধ লাগে।মাঝে মাঝে মনে হয় ম/রে যাই চলে যাই সুহাইলের কাছে।যদি জানতাম সে ফিরবে না তবে কোনদিন ছাড়তাম না তাকে।
পবন কেঁদে দিলো ডান হাতটা দেয়ালের সাথে বারি দিয়ে রাগ সংযত করলো।খানিকটা এগিয়ে বসলো আরমিনের কাছে,
– তুই আমায় বিশ্বাস হয়তো করিস না।কিন্তু জানিস আমি বোধহয় বাঁচবো না বেশি দিন।এতদিন তোকে না পাওয়ার যন্ত্রণায় পুড়েছি কাল থেকে তোর কষ্ট দেখে পুড়ছি।আমার সইছে না আর মরেই যাবো আমি।তুই আমাকে একটুখানি ভরসা কর।সুহাইল তোর কাছে ফিরবে না এটাই মেনে নে।
– আমি সুহাইলকে ভালোবাসি এটা যেমন সত্য,তেমনি তুমি আমার জীবনে বট গাছের ছাউনি এটাও চরম সত্য।
– তবে এই মানুষটাকে আরেকবার বিশ্বাস কর।শুধু আরেকবার।
– পারবো না।ফিরে যাও পবন ভাই।
– এত অল্প বয়সে এভাবে ভেঙ্গে পড়ছিস ভবিষ্যৎ এখনো সামনে।
পবনের কথায় আরমিন তাচ্ছিল্য হাসলো।
– হাহ ভবিষ্যৎ।জানো সুহাইল কুয়াকাটায় সাগরের পাড়ে দাঁড়িয়ে আমার পেটে হাত রেখে বলেছিলো ওই স্থানে আমরা আরেকবার যাবো আমাদের সন্তানকে নিয়ে।ঘোড়ার পিঠে চড়ে বলেছিলো সিনেমায় দেখতে সেই লাগামহীন ছুটে চলা ঘোড়ার পিঠে আমাকেও চড়াবে।কয়েকদিন আগেও ফোন কলে বলেছিলো আমরা পাহাড় দেখবো দুজনের হাতে হাত রেখে কিন্তু সব এখন সেগুড়ে বালি।আমি ভবিষ্যৎ আর ভাববো না ভাবতে চাইও না।সব মিথ্যা সব।
পবন আশাহত হলো উঠে দাড়ালো কিছুক্ষণের মধ্যে।আরমিনের দিকে তাকালো আরেকবার।তার দু’চোখ থেকে অশ্রুর ধারা বইছে।
– আমার জীবনের একটা চরম সত্য কথা শুনবি?
– কী?
– আমি তোকে অত্যধিক ভালোবাসি!
আরমিন ঠোঁট চেপে কাঁদছে দম বন্ধ লাগছে চারিপাশে সব তার হাহাকার ঘিরে আছে।কোন কিছু তার এখন মাথায় আসছে না
– ভাবতে পারিস আগে বুঝলাম না কেন!আগে বুঝিনি কেন জানিস?কারন তুই আমার অভ্যাসে,মায়ায়,সত্তায় মিশে ছিলি।যখনি আমার সত্তায় টান পড়লো আমার হুশ ফিরলো।তোকে পেতে মরিয়া হয়ে গেলাম।জীবন সুন্দর।ভয়ংকর সুন্দর।আমি কাঁদি তোর জন্য,তুই কাঁদিস অন্য জনের জন্য,আমার জন্য কাঁদে হয়তো বা কেউ একজন।আমাদের চাওয়া পাওয়া ভিন্ন।কারো অবস্থান থেকে কেউ সুখী নয় সবাই অসুখী কেউ আড়ালে কেউ সম্মুখে।
পবন শব্দ করে দরজাটা খুললো আরমিনের কান্না থামছে না।মেয়েটা কেঁদেই চলেছে।কাঁপা গলায় ডেকে উঠলো পবনকে।
– পবন ভাই শুনবে?
– বল।
– না থাক ফিরে যাও আর আমাকে যত্ন করে ভুলে যেও।
#চলবে