শহরজুড়ে_প্রেম_নামুক #পর্বঃ১১,১২,১৩

0
1322

#শহরজুড়ে_প্রেম_নামুক
#পর্বঃ১১,১২,১৩
#Arshi_Ayat
১১
তারপর কেটে গেলো কিছুদিন।এরমধ্যে বেশ কয়েকটা ইন্টারভিউ দিয়েছে স্বর্ণ।এখনো কোনোটাতেই ডাক আসে নি।চাকরি হোক বা না হোক সামনের মাসেই অন্য একটা বাসা খুঁজবে।টিউশনির টাকায় হয়ে যাবে কোনোমতে।সবকিছু ভেবেই এখনো কাউকে কিছু বলে নি স্বর্ণ।সুমনকেও না আর ওর ভাই-ভাবীকেও না।আলাদা হয়ে যাওয়ার পর বলবে।এখন বলবে বাসাটাকে নরক করে ফেলবে।মা,মেয়ে কাউকেই শান্তি দেবে না দু’দন্ড।বেশ কিছু কারণ ভেবেই স্বর্ণ চুপচাপ তবে আরব বলেছিলো সবাইকে সবটা জানিয়ে দিতে,ওর সিদ্ধান্তের কথা জানাতে।ও একজন প্রাপ্তবয়স্ক মেয়ে এভাবে তো অন্যায় কিছু চাপাতে পারে না।স্বর্ণ তখন সায় দিয়ে বলেছিলো জানাবে কিন্তু বাসায় এসে চিন্তা ভাবনা করার পর মনে হলো না কাজটা করা ঠিক হবে তাই চেপে গেলো তবে আরব জিজ্ঞেস করতেই মিথ্যা বলে দিলো।মাঝেমধ্যে অপরাধ বোধ হয় স্বর্ণের।ও নিরীহ একটা ছেলেকে দিনের পর দিন ঠকাচ্ছে।মিথ্যে বলছে আর ছেলেটাও বিনাবাক্যে বিশ্বাস করছে।কেন এই মানুষগুলো দেরিতে আসে জীবনে?ভেঙেচুরে যাবার পরই কেনো আসে?দীর্ঘশ্বাস ফেলে স্বর্ণ।

লাস্ট টিউশনি’টা করিয়ে বের হতে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হলো।ছাত্রীর বাসা থেকে বেরিয়ে হাঁটতে লাগলো স্বর্ণ।দু-তিন মিনিট হাঁটলেই বাস স্টপ।কিন্তু কিছুটাদূর হাঁটতেই অদূরে সুমনকে দেখতে পেলো।ওর দিকেই আসছে।স্বর্ণ হাঁটা থামিয়ে দিলো।সুমন ওর সামনাসামনি এসে দাঁড়ালো।রুষিত স্বরে বলল,’তোমার ফোন বন্ধ কেন?কতবার কল করেছি আইডিয়া আছে?’
স্বর্ণ ইতঃস্তত স্বরে বলল,’চার্জ ছিলো না।’
‘চার্জ ছিলো না নাকি ইচ্ছে করে বন্ধ করে রাখো?’
স্বর্ণ অন্যদিকে চেয়ে বলল,’চার্জ ছিলো না আসলেই।’
এবার থমথমে মুখশ্রী ফুটিয়ে তুলে বলল,’চলো,এক জায়গায় যেতে হবে এখন আমাদের।’
‘কোথায়?’
‘অফিস পার্টি।’
‘হ্যাঁ তো আপনি যান।আমি কেন যাব?’
‘পুরো অফিস জানে আমার বিয়ে ঠিক হয়ে আছে।তাই আমার কলিগরা চাইছে হবু বউয়ের সাথে দেখা করতে।’
‘কিন্তু আমার যেতে মন চাইছে না।’
‘তোমার মতামত শুনতে চাই নি আমি।তুমি এখন যাবে মানে যাবেই।’
স্বর্ণ ভ্রু কুঁচকে অদ্ভুত নয়নে তাকালো সুমনের দিকে।এমন অধিকার ফলাচ্ছে কেন লোকটা?যেতে ইচ্ছে করছে না তাও নাকি যেতে হবে।স্বর্ণ বেশ শান্ত গলায় উত্তর দিলো,’দেখুন,সারাদিন ক্লাস করে প্রাইভেট পড়িয়ে আমার আর এতটুকুও শরীর কুলচ্ছে না।আমি যেতে পারবো না,সরি।’
কথাটা বলে স্বর্ণ দাঁড়ালো না।পাশ কেটে চলে যেতেই নিচ্ছিলো কিন্তু সুমন শক্তকরে ওর হাত ধরে ফেললো।কটমটিয়ে বলল,’তুমি যাবে।’
স্বর্ণ নিজের হাতটা ওর হাতের মুঠো থেকে ছিনিয়ে নিলো একপ্রকার।অতঃপর একরাশ ঘৃণার দৃষ্টি নিক্ষেপ করে জোর কদমে চলে গেলো বাস কাউন্টারে।লোকটা এত অসভ্য!কবে যে মুক্তি পাবে এর থেকে!

বাড়িতে এসেই শুনলো ভাইয়া,ভাবি পার্টি এটেন্ড করতে গেছে।আর আজমাইনকে নিহারিকা খানমের কাছে রেখে গেছেন।প্রায় সময়ই ওরা বাইরে কোথাও গেলে আজামাইনকে বাসায় রেখে যায়।ছেলেটা প্রথম প্রথম কাঁদত,মন খারাপ করতো কিন্তু এখন কিছু বলে না চুপচাপ থাকে।এই ছোটো বয়সেই বুঝে গেছে কেঁদেকেটে লাভ নেই।

স্বর্ণ ফ্রেশ হয়ে খেয়ে ঘুমিয়ে নিলো ঘন্টাখানেক।ঘুম থেকে উঠে রাতের জন্য খিচুড়ি রান্না করলো আর ইলিশ ভাজলো।ভাই-ভাবী তো খেয়েই আসবে।শুধু ওদের তিনজনের জন্যই রাঁধবে।রান্না,খাওয়া শেষে আজমাইনকে ঘুম পাড়িয়ে ঘরে আসতেই দেখলো রাত সাড়ে এগারোটা বাজে।সবকিছু গুছিয়ে নিজের ঘরে এসে বসলো ক্লাসের নোটগুলো নিয়ে।নিহারিকা খানমের শরীরটা আজকে ভালো না বেশি তাই তিনি খেয়েই শুয়ে পড়েছেন।

নোটসগুলো দেখতে দেখতেই শুনতে পেলো ফোন বাজছে।স্ক্রিনে আরবের নাম।স্বর্ণ রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে আরব বলল,’খেয়েছো?’
‘হ্যাঁ,তুমি?’
‘হ্যাঁ একটু আগেই।কি করছো?’
‘নোটসগুলো দেখছিলাম।’
‘বাহ!জানো আমি কি করছিলাম?’
‘কি?’
‘ভাবছিলাম সংসার করতে কি কি লাগে!কারণ আমরাও তো করবো তাই আর কি আগেই ভাবা উচিত।’
আরবের এমন ছেলেমানুষী কথা শুনে স্বর্ণ হেসে ফেললো।বলল,’তো ভবেছো কি কি লাগবে?’
‘হ্যাঁ ভেবেছি তো!আসলে সংসার করতে তেমন কিছুই লাগবে না।শুধু তুমি’টা লাগবে।’
স্বর্ণ হাসলো।বিষন্ন হাসি!ছেলেটা কত স্বপ্ন দেখছে,আশা বুনছে!কিন্তু স্বর্ণ ওকে কিছুই দিতে পারবে না।ওর স্বপ্নগুলোর সঙ্গী হতে পারবে না।ছেলেটা এত পাগল কেন?কখনো কখনো ছেলেটার জন্য এত মায়া হয়!কেন ভালোবাসতে গেলো ওর মত মেয়েকে?
এরপর!এরপর আর কি?ছেলেটা স্বপ্নালু চোখে বুনতে লাগলো স্বপ্নদের ইন্দ্রজাল।আর মেয়েটা ওপর প্রান্তে দীর্ঘশ্বাস ফেলছে আর বারবার উদাস হচ্ছে।

একমুঠো নরম রোদের আলো মুখে পড়তেই ঘুমটা আলগা হয়ে এলো স্বর্ণের।কাল রাতে কথা বলতে বলতে ঘুমিয়ে গিয়েছিলো।এরপর আর কেউই কল কাটে নি!অপরপ্রান্ত হতে আরবের শ্বাস-প্রশ্বাসের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে।কথা বলতে বলতে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে ছেলেটা।স্বর্ণ ফোন’টা কেটে দিয়ে ফ্রেশ হতে চলে গেলো।ওয়াশরুম থেকে বের হতেই দেখলো ফোন বাজছে।স্ক্রিনে ভাইয়ার নাম্বার।রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে ভাইয়া ক্লান্ত গলায় বলল,’আমরা হাসপাতালে।সুমনকে কে যেনো প্রচুর মেরেছে কাল রাতে।রাস্তায় পড়েছিলো।’

১২।

প্রথমে আশ্চর্য হলেও পরে খুশিই হলো স্বর্ণ।সুমনকে যে মেরেছে তারজন্য দোয়া করে দিলো।এখন কিছুদিন অন্তত শান্তি পাওয়া যাবে।স্বর্ণ দ্রুত পায়ে গিয়ে মা’কে জানালো খবরটা কিন্তু এতে নিহারিকা খনমের কোনো ভাবাবেগ হলো না।যেন তিনি আগেই জানতেন।স্বর্ণকে আশ্চর্যন্বিত চেহারায় তাকিয়ে থাকতে দেখে তিনি বললেন,’মার’টা আমিই খাইয়েছি।’
স্বর্ণ বিষ্মিত স্বরে বলল,’কেনো?’
‘কারণ সুমনের বোন বিদেশ থেকে এ মাসেই আসবে।বোধহয় সপ্তাহখানেকের মধ্যে।ওরা তোকে মিথ্যে বলেছে।যেন তুই অন্যকোনো প্ল্যান না ভাবতে পারিস।আমি কাল ওদের ঘরের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় সব শুনেছি।এখন যেন বিয়েটা কয়েকমাসের জন্য আটকে রাখা তাই এটা করেছি এছাড়া আর পথ ছিলো না।ওরা তোকে ধরে বেঁধে বিয়ে দিতে চাইতো।’
সবশুনে স্বর্ণ মাথায় হাত দিয়ে সোফায় বসে পড়লো।নিজেকে চূড়ান্ত নির্বোধ মনে হচ্ছে।এত সহজে কিভাবে ও ভাই-ভাবীর কথা বিশ্বাস করলো!যদি মা ব্যাপারটা না জানতো তাহলে তো সর্বনাশ হতো।পিঠপিছনে এত বড় ষড়যন্ত্র!
নিহারিকা খানম স্বর্ণ’র পাশে বসে মাথায় হাত রেখে বলল,’চিন্তা করিস না।তিন/চার মাসের আগে বিছানা থেকে উঠতে পারবে না।আর এর মধ্যেই তোর স্কলারশিপ হয়ে যাবে।’
স্বর্ণ মলিন হেসে মায়ের দিকে তাকালো।সে যে প্রজেক্ট’টা ছেড়ে দিয়েছে এটা এখনো মা’কে জানায় নি।জানলো মানুষ’টা ভিষণ কষ্ট পাবে কিন্তু স্বর্ণ মা’কে ছেড়ে ভিনদেশে কিভাবে থাকবে!একটা ভালো চাকরি পেয়েই মা’কে সব বলবে দরকার হলে রাত-দিন মায়ের পায়ের কাছে পড়ে থাকবে।মা নিশ্চয়ই মাফ করে দেবে।এই রঙহীন ধূসর জীবনে এই মানুষ’টা ছাড়া আর কেউ নেই ওর।

স্বর্ণ নাস্তা করে ভার্সিটিতে চলে গেলো আর নিহারিকা খানম নাতিকে নিয়ে হাসপাতালে এলো।সুমনের বাবা-মা এসে পড়েছে ইতিমধ্যেই।নিহারিকা খানমকে একা দেখে আশরাফ প্রশ্ন করলো,’মা,স্বর্ণ আসে নি?’
‘না,ক্লাস আছে ওর।ক্লাস শেষে বিকেলে আসবে।’
আশরাফের মুহুর্তেই মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো।গলা খাদে নামিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,’একদিন কি ক্লাস মিস দেওয়া যেত না?ওর শ্বশুরবাড়ির লোকেরা কি বলবে?’
নিহারিকা খানম ছেলের কথা শুনে শান্ত কন্ঠে বললেন,’এখনো বিয়ে হয় নি।তাই কিছু বলার প্রশ্নই আসে না।আর এখানে এত মানুষ আছে তবুও স্বর্ণকে লাগবে কেন?ও আসলেই সুমন ভালো হয়ে যাবে?উঠে দৌড়াতে পারবে?’
শ্বাশুড়ির কথা শুনে সিমা বলল,’এই আপনার জন্য স্বর্ণের এত বাড়।মেয়েকে এত আস্কারা দিয়েন না।শেষে দেখবেন আপনারই মান-ইজ্জত ডুবাবে।’
নিহারিকা খানম মৃদু হেসে বললেন,’আমার মেয়ে আমি বুঝবো!তোমাকে এত চিন্তা করতে বলি নি।এখন আশরাফকে নিয়ে বাসায় যাও।ফ্রেশ হও,রেস্ট নাও।’
আশরাফ আর সিমা কটমট করতে করতে চলে গেলো।যাওয়ার সময় আজমাইনকেও নিয়ে গেলো সাথে।ওরা যাওয়ার পর সুমনকে একবার দেখে এলেন তিনি।যাক ভালোই মার খেয়েছে।মেয়ের স্বার্থে এতটুকু করতেই হলো তাকে।সন্তানের স্বার্থের জন্য মায়েরা সবসময়ই স্বার্থপর।অতঃপর সুমনের বাবা মায়ের সাথে স্বল্প আলাপ সেরে তিনি বেরিয়ে পড়লেন।

স্বর্ণ ভার্সিটিতে ঢুকে সোজা ক্লাসে চলে গেলো।আজকে একটু লেট হয়ে গেছে।রাস্তায় জ্যাম ছিলো প্রচুর।কিন্তু ক্লাসরুমের সামনে এসে দেখলো প্রফেসর জামাল উদ্দীন ক্লাস নিচ্ছেন।ভার্সিটিতে এই একটা লোক’কে স্টুডেন্ট’রা ভীষণ ভশ পায়।এত স্ট্রিক্ট।যতই ভালো স্টুডেন্ট হয় না কেন রুলস ব্রেক করলে শাস্তি পেতেই হবে।ক্লাস লেট করে আসলে সেদিনের ক্লাস আর স্টুডেন্ট এর কপালে নেই।তবুও স্বর্ণ দরজা থেকে প্রথম এবং শেষ একটা চেষ্টা করলো।বিনীত ভঙ্গিতে স্যারকে ডেকে বলল,’স্যার,আসবো?’
‘না।ক্লাস শেষ হওয়ার পর আসবে।এখন ক্লাস করাচ্ছি।ডিস্টার্ব করবে না।’
এরপর আর কথা থাকে না।স্বর্ণ দরজা থেকে ফিরে যাচ্ছিলো হঠাৎ করে চোখ পড়লো ক্লাসের মঝে বসে হাত দিয়ে ইশারা দেওয়া আরবকে।ও ইশারায় ক্যান্টিনে বসতে বলছে।পাঁচ মিনিটের মধ্যেই আসছে।স্বর্ণ চোখ রাঙানি দিয়ে আসতে মানা করলো।এরপর সেখান থেকে সরে লাইব্রেরিতে গেলো।কারণ আরব যখন বলেছে ও আসবে তখন আসবেই।তাই ক্যান্টিনে যায় নি স্বর্ণ।

লাইব্রেরির এক কোণায় বসে বই পড়তে শুরু করলো স্বর্ণ।হঠাৎ ধপ করে পাশের চেয়ারে কেউ বসতেই স্বর্ণ চমকে উঠলো।তবে ধারণা করলো আরব এসেছে কিন্তু চোখ ফিরিয়ে দেখলো উচ্ছ্বাস বসে আছে।স্বর্ণ ভ্রু কুঁচকে কঠিন গলায় বলল,’তুমি!’
‘হ্যাঁ,আমি।কেনো ওই আরব না কি যেন নাম ওই ছেলেটাকে আশা করেছিলে নাকি!’
‘যাকেই আশাকরি তোমাকে তো কখনোই নয়।’
‘আমি জানি!তখন কি নাটকটাই না করলে এবোরশন করবে না!কিন্তু এখন দেখো এবোরশন করে আরেক ছেলের সাথে ঢলাঢলি করছো।এইজন্যই আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাইনি।আমার সাথে শোয়ার পর তুমি যে আর কারো সাথে শুবে না তার কি গ্যারান্টি?হয়তো আমার আগেও কারো সাথে শু…’
পুরোটা শেষ করার আগেই সজোরে একটা থাপ্পড় পড়লো উচ্ছ্বাসের গালে।স্বর্ণ অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ওর দিকে।উচ্ছ্বাস রাগে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেললো।নিজের বলিষ্ঠ হাত দিয়ে স্বর্ণ হাত চেপে ধরেছে শক্ত করে যেন ভেঙে ফেলবে।কিন্তু কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই কেউ একজন উচ্ছ্বাসের শার্টের কলার ধরে বসা থেকে সোজা দাঁড় করিয়ে ফেললো।উচ্ছ্বাসের হাত বাঁধন আলগা হতেই স্বর্ণ নিজের হাত ছাড়িয়ে নিলো ওর থেকে।সামনে আরব উচ্ছ্বাসের কলার ধরে দাঁড়িয়ে আছে।উচ্ছ্বাস গর্জে উঠে বলল,’হাউ ডেয়ার ইউ।জুনিয়র হয়ে সিনিয়রের গায়ে হাত তুলিস!তোকে আজকে ক্যাম্পাসে পুঁতে ফেলবো।’
আরব শান্ত অথচ দৃঢ় স্বরে বলল,’চুপ!একদম চুপ।সিনিয়র হয়ে যদি নিজের সম্মান নিজে না রাখতে পারিস তাহলে কেউ সম্মান দিবে না।আর তুই আমাকে কি পুঁতে ফেলবি।আমি চাইলে তোকে এখুনি ভার্সিটি থেকে বহিস্কার করাতে পারি।’
কথাটা বলেই আরব একটু আগে স্বর্ণের সাথে করা অসভ্যতামির ভিডিওটা উচ্ছ্বাসের সামনে তুলে ধরলো।উচ্ছ্বাস ভয়ে চুপসে গেলো যেন।আরব হাসতে হাসতে বলল,’কি সিনিয়র ভাইয়া?ভালো আছেন তো?আরও ভালো থাকতে চাইলে নাক বরাবর দরজা দিয়ে হেঁটে চলে যান।পেছনে তাকাবেন না।তাকালেই…’
কথাটা বলে আরব হাসলো।উচ্ছ্বাস ওর দিকে অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে সেখান থেকে চলে গেলো।

১৩।

স্বর্ণ ভেতরে ভেতরে ভয় পাচ্ছে।আরব কি তবে সব জেনে গেলো?ভূল বুঝলো ওকে?ঠিক হয় নি এটা।অন্তত এভাবে জেনে যাওয়াটা একদম ঠিক হয় নি।ভালোবাসার মানুষ না হোক বন্ধু হিসেবে ছেলেটাকে পছন্দ করে স্বর্ণ।এখন ওর চোখে ঘৃণা দেখতে ভালো লাগবে না একটুও।তারচেয়েও বড় কথা কি বলবে আরব কে?ও তো এখন প্রতারক ভাববে স্বর্ণকে।এসব ভাবতে ভাবতেই আরবের কন্ঠস্বর শুনলো।সে উত্তপ্ত স্বরে বলল,’ওই বাস্টার্ড’টা তোমার হাত মুচড়ে ধরলো আর তুমি কিছু বললে না কেন?’
‘বলতে দিলে কোথায়?তার আগেই তো তুমি এসে তুফান উঠিয়ে দিলে।’
‘তো কি করবো?আমি এসেই দেখি হা*রা*মি’র বাচ্চাটা তোমার হাত মোচড়াচ্ছে।আমার তো দেখেই মাথায় আগুন ধরে গেলে।’আরব রাগে ফোঁস ফোঁস করছে।স্বর্ণ এতক্ষণে স্বস্তি পেলো একটু তারমানে আরব কথাগুলো শোনে না।এমনকি থাপ্পড় মারাটাও দেখে নি।যাক ভালো হলো।বুকের ওপর থেকে এক মণের একটা পাথর সরে গেলো।এমন নয় যে স্বর্ণ আরবকে এসব লুকিয়ে যাবে,কিন্তু বলার একটা সময় আছে।হুট করেই সবকিছু বলা যায় না।কিছুক্ষণ আগের ঘটনার রেশ কাটিয়ে আরব হুট করেই বলল,’চা খাবে?’
‘চা?এখন?’
‘হ্যাঁ চলো।আনোয়ার কাকার দোকান থেকে খেয়ে আসি।এরমধ্যে ক্লাস শেষ হয়ে যাবে এরপর নেক্সট ক্লাস ধরবো।’
স্বর্ণ হাতঘড়িতে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে বলল,’চলো।’

ভার্সিটি এরিয়া থেকে অল্পদূরেই আনোয়ার কাকার দোকান।পায়ে হাঁটা পথ দশমিনিট।যাওয়ার পথেই দেখলো একঝাঁক পর্তুলিকার সমাহার।আরব নিরবেই স্বর্ণের পাশ থেকে সরে একগুচ্ছ পর্তুলিকা নিয়ে এলো।পাশ আসতেই স্বর্ণ খেয়াল করে বলল,’এতগুলো দিয়ে কি করবে?
‘দেখো কি করি।আগে হাত দাও।’
স্বর্ণ আলতো হেসে হাত বাড়ালো।দেখা যাক ছেলেটা কেমন পাগলামি করে।
আরব স্বর্ণের বাঁ হাতের অনামিকার মাপ নিয়ে একটা রিং বানিয়ে সেখানে পরিয়ে দিলো।আর বাকিগুলোর মধ্যে কয়েকটা খোঁপা আর কয়েকটা দিয়ে ব্রেসলেট বানিয়ে হাত পরিয়ে দিলো।অতঃপর মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে বলল,’আমার ফুলকুমারি।’
স্বর্ণ হাসলো।সেই হাসিতে ছেলেটা আরেকদফা মুগ্ধতার মোহজালে জড়িয়ে গেলো।এতোটা মায়াময়ী কিভাবে হয় একটা মেয়ে?নাকি ভালোবাসে বলেই এত মায়াবী লাগে!আরব বুঝতে পারে না।দিনে দিনে মেয়েটার প্রতি মুগ্ধতা,স্নিগ্ধতা,ভালোবাসা, সব যেন বেড়েই চলছে।

সকাল বেলা চায়ের দোকানে তেমন একটা খদ্দের থাকে না।সবাই কাজকর্মে ব্যস্ত থাকে।তেমন আজও নেই।ওরা যেতেই আনোয়ার কাকা খুশি হয়ে বলল,’মামা,চা দিমু আপনাগো?’
‘হ,মামা।আমার’টায় চিনি কম দিয়ে আর আপনার মামীর’টা বেশি।’
আরবের কথা শুনে স্বর্ণ বিস্মিত হলো।ছেলেটা জানলো কি করে যে ও চা’য়ে চিনি বেশি খায়।এত খেয়াল করে?

ওরা চা খেয়ে ক্যাম্পাসে আসলো।ক্লাসে যাওয়ার পথে আরবের বন্ধু সাইফুলের সাথে দেখা হওয়ায় ও দাঁড়িয়ে পড়লো।আর স্বর্ণকে ইশারায় বলল দাঁড়াতে কিন্তু স্বর্ণ দাঁড়ালো না ক্লাসে চলে গেলো।স্বর্ণ যাওয়ার পরই সাইফুল বলল,’তোদের মধ্যে কি চলে রে?’
‘অনেক কিছু।’
‘তোরা রিলেশনে আছিস?’
‘হ্যাঁ।’
‘তুই জানিস না উচ্ছ্বাস ভাইয়ার সাথে স্বর্ণ’র রিলেশন ছিলো।’
‘হ্যাঁ থাকুক।এখন তো নেই।’
‘বুঝতে পারছিস না তুই।ওদের গভীর সম্পর্ক ছিলো।একসাথে ঘুরতে যাওয়া,সিনেমা দেখা,হাতে হাত রেখে হাঁটা আ…’
সম্পূর্ণ কথা শেষ করার আগেই আরব ওকে থামিয়ে দিয়ে বলল,’দেখ ভাই!আর আগে কি ছিলো না ছিলো এসব নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই।আমি ওকে ভালোবাসি এটাই সত্য।এখন এটার চেয়ে বড় সত্য আর নেই।’
সইফুলের আর কিছু বলার নেই।ও বন্ধুর পিঠে চাপড় মেরে বলল,’ক্যারি অন ব্রো।’
আরব হেসে মাথা নেড়ে ক্লাসের দিকে চলে গেলো।
ক্লাস শেষে স্বর্ণ আগে বেরিয়ে গেলো।আরবও ওর পিছু নিচ্ছিলো কিন্তু কিছু জুনিয়র এসে ঝামেলা পাকিয়ে দিলো।ওদেরকে একটা টপিক বুঝিয়ে দিতে হবে।কিন্তু কোনমতে কাটিয়ে কালকে বোঝাবে বলে বেরিয়ে এলো।স্বর্ণ এখনো ভার্সিটি থেকে বেরুতে পারে নি।আরব এক দৌড়ে ওর পাশে চলে গেলো।হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,’নিষ্ঠুর মেয়ে!একটু দাঁড়ালে কি হতো?’
‘দাঁড়াবো কেন?’
‘কারণ একসাথে যাবো।’
‘আমি এখন টিউশনে যাবো আরব।তুমি আমার সাথে আসবে কেন?’
‘এমনিই!’আরব মাথা চুলকে বলল।
স্বর্ণ কঠোরভাবে বলল,’একদম না।এক্ষুণি বাসায় যাবে।’
আরব মুখ কালো করে বলল,’আচ্ছা যাবো না কিন্তু এই ছাতা’টা নাও।প্রচুর রোদ।’
নিজের ব্যাগ থেকে ছাতা বের করে দিয়ে বলল।স্বর্ণ বলল,’আমার লাগবে না তুমি রাখো।’
‘না,তোমাকে নিতে বলেছি তুমি নিবে।’
একপ্রকার জোর করেই হাতে ধরিয়ে দিয়ে সামনের দিকে দৌড় দিলো আরব।অজান্তেই হেসে ফেললো স্বর্ণ।এত ছেলেমানুষী করে ছেলেটা।আসলেই আজকে রোদের তাপ’টা বেশি।স্বর্ণ ছাতা’টা খুললো।আজকে বাসায় ফিরতে একটু দেরি হতে পারে।টিউশনি গুলো করিয়ে সুমনকে দেখতে যেতে হবে।নাহলে ভাই-ভাবী প্রশ্নবাণে জর্জরিত করে ফেলবে।হয়তো সকালে না যাওয়ার কারণেও মা’কে অনেক কথা শুনিয়েছে।

টিউশনি শেষ করে হাসপাতালে গেলো স্বর্ণ।হাত,পা চারটাতেই ব্যান্ডেজ।ভালোই মা’র খাইয়েছে মা।সুমন ওকে দেখে ন্যাকা অভিমানী কন্ঠে বলল,’এই তোমার আসার সময় হলো?আমি সারাদিন অপেক্ষা করেছি তোমার জন্য।’
‘ক্লাস ছিলো আমার।’কাটকাট স্বরে বলল স্বর্ণ।এই লোকটার জন্য বিরক্তি আর ঘৃণা ছাড়া কিছুই আসে না ওর এই যে হাত,পা ভেঙে বিছানায় শুয়ে আছে তবুও একবিন্দু সমবেদনা আসছে না।সুমন বায়না ধরেছিলো আজকে রাতে ওর সাথে থাকতে।স্বর্ণ বিভিন্ন অজুহাত দিয়ে আধঘন্টার মধ্যে বেরিয়ে এলো।

বাসায় ফিরে প্রতিদিনের মত ফ্রেশ হয়ে বসতেই সিমা এসে বলল,’তোমার কি মায়াদয়া নেই স্বর্ণ?তোমার হবু বর মার খেয়ে হাসপাতালে পড়ে আছে আর তুমি সকালে তাকে দেখতে গেলে না।সুমন ভাইয়ের বাবা-মা কি ভাবছে বলো তো!আমার তো লজ্জায় মাথাকাটা যাচ্ছে।’
স্বর্ণ চা’য়ে চুমুক দিয়ে শান্ত স্বরে বলল,’আমি আসার সময় ওনার সাথে দেখা করে এসেছি আর কে কি ভাবলো না ভাবলো তাতে আমার কিছু যায় আসে না।আমার ব্যাপার আমি খুব ভালো করেই বুঝি তোমাকে নাক গলাতে হবে না অতো।’
‘হ্যাঁ তা তো দেখছিই।’
সিমা তাচ্ছিল্যের সুরে এটা বলেই চলে গেলো।তাতে ভাবান্তর হলো না স্বর্ণের।ও শান্ত ভঙ্গিতে চা’টা শেষ করলো।কিছুক্ষণ ক্লাসের নোটগুলো দেখে।রাতের খাবার তৈরি করতে গেলো।খাওয়া শেষ করে এসে আবার কিছুক্ষণ পড়লো এরমধ্যেই আরব ফোন করলো।আজ বেশিক্ষণ কথা বলতে পারলো না স্বর্ণ।ঘুম পাচ্ছে ভিষণ!ফোন রাখতেই দেখলো নতুন নাম্বার থেকে একটা মেসেজ এসেছে।মেসেজটা দেখে খুশিতে হাত-পা কাঁপা শুরু হয়ে গেছে স্বর্ণের।তাতে লেখা’,
Dear shorno mehbub, congratulations!you are selected on our company.please collect your appointment latter.

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here