একটি বিবাহত্তোর প্রেমের গল্প,পর্ব ৫

0
1030

একটি বিবাহত্তোর প্রেমের গল্প,পর্ব ৫
তামান্না জেনিফার

বিকেল বেলায় অপার মা আর ছোট ভাই অরন্য চলে আসে অপার শ্বশুড়বাড়ি ৷ সকালে আসার কথা ছিলো কিন্তু পরে জানিয়েছে যে বিকেলে আসবে ৷ অপা জিজ্ঞেস করে “বাবা এলো না মা ?” মা বললেন তার একটু শরীরটা খারাপ ..কিন্তু অপা জানে বাবা আসলে এমনই , উচ্চবিত্ত মানুষদের এড়িয়ে চলেন ৷ এখানে বিয়ে দেবার জন্য বাবার হ্যা বা না কিছুই বলেনি ৷ তার মামার ছিলো চরম আগ্রহ ৷ অপার খুব সন্দেহ হচ্ছিলো তার মামার এত আগ্রহ কেন ! আজকে সকালে সেই কারন জেনেছে অপা ৷ তারপর থেকে সে মনের মধ্যে অসহ্য একটা আতঙ্ক নিয়ে আছে ৷ অপাকে আসলে প্রথম দেখেছে রিয়া ৷ অপার মামাতো ভাই সোহানের সাথে সাথে তার প্রেমের সম্পর্ক ৷ সে কথা আজ অপাকে নিজেই বলেছে রিয়া ৷ সোহান নাকি রিয়াকে অপার ছবি দেখিয়েছিলো এবং বলেছিলো তার বোন এ বাড়িতে আসলে ও বাড়িতে যাওয়া তার জন্য সহজ হবে ৷ কারন সোহান বেকার , গ্রাজুয়েশন শেষ করেনি , রিয়ার বাবা মা কখনোই রিয়াকে সোহানের সাথে বিয়ে দেবে না ৷ কিন্তু অপা যখন এই বাড়িতে বউ হয়ে আসবে তখন রিয়ার হয়ে অপা লড়াই করবে ৷ রিয়া অপার হাত ধরে বলেছে “সোহানকে ছাড়া আমি বাঁচবো না ভাবী .. কিছুদিন যাক , এরপর তুমি মা কে বলো , অনেক আশা করে তোমাকে এনেছি ..” রিয়াকে উত্তরে কিছুই বলেনা অপা.. শুধু মনের মধ্যে ভাংচুর চলে তার .. এটা কিভাবে সম্ভব !

সোহান অপার চেয়ে বয়সে দুই বছরের বড় ৷ বয়সন্ধীর সময় থেকেই হঠাৎ বখাটে হতে শুরু করে সোহান ৷ একটা পুরুষ মানুষের যতগুলা চারিত্রিক দোষ থাকতে পারে এই বয়সেই সোহানের মধ্যে সব আছে ৷ তার বাবার মতই অর্থলোভীও হয়েছে ৷ অপা নিশ্চিত রিয়ার সাথে এই যে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তুলেছে এর উদ্দেশ্য শুধুই রিয়ার সম্পত্তি আত্মসাৎ করা ৷ সোহান কিভাবে রিয়াকে পটালো আর রিয়ার মতো শিক্ষিত বুদ্ধিমতী মেয়ে কিভাবে পটলো তাও অপা বুঝতে পারছে না ৷ এবার সে বোঝে তার মামার এত আগ্রহের কারন ৷ তাকে ফাঁদ হিসেবে এ বাড়িতে ঢুকিয়েছে ৷ কিন্তুও অপাও লড়াই জানা মেয়ে ৷ সে সিদ্ধান্ত নেয় কিছুতেই এটা হতে দেবেনা .. যা আছে কপালে ..

মায়ের আর ভাইয়ের সাথে স্বামী আর ননদকে নিয়ে বাপের বাড়ি চলে আসে অপা ৷ রাতের খাবার আয়োজনে পুরো টেবিল ভরিয়ে ফেলে অপার মা ৷ কি নেই সেই টেবিলে ! খাসির মাংস , গরুর মাংস , কাঠালের বিচি দিয়ে কষানো মুরগীর মাংস , কচুর লতি দিয়ে চিংড়ি , মাসকলাইয়ের ডাল , দশ রকমের ভর্তা , লাউ চিংড়ি , শুকনো পাটশাকের মুচমুচে ভাজি , পাবদা মাছ ভুনা , কাঁচকি মাছের চচ্চড়ি , ডাটা দিয়ে মুশুরের ডাল ভুনা … পোলাও , সাদা ভাত..পায়েস , জর্দা , সেমাই.. সুমন টেবিলে এসে বিস্ময় মাখানো গলায় বলে “মা ! এত কিছু !!” অপার মা লজ্জা মাখানো গলায় বলে “তেমন কিছুই করতে পারিনি বাবা..” অপাও বিস্মিত , তবে ওর বিষ্ময়ের কারন এত আয়োজন করার টাকা কোথায় থেকে আসলো ৷ মা কে জিজ্ঞেস করে জানলো তার বাবার পুরোনো কলিগেরা বিয়ে উপলক্ষে কিছু টাকা দিয়েছিলো , সে টাকাতেই হয়েছে বাজার-ঘাট ৷

রাতে শোবার জন্য এসে বিছানায় একবার বসে আর উঠে পায়চারি করে সুমন ৷ অপা ভাবে বিছানাটা হয়তো আরামদায়ক লাগছে না সুমনের ৷

—কি হয়েছে ? আপনি শুইছেন না যে ! বিছানা পছন্দ হয়নি বুঝি ..

—আরে না ! তোমার মা এত কিছু আর এত বেশী খাইয়েছে যে গলা পর্যন্ত খেয়েছি ৷ এত বেশী শেষ কবে খেয়েছি মনে নেই ৷ এখন হাসফাস লাগছে ৷

—ছাদে যাবেন ? আমার কাছে ছাদের একটা চাবি আছে লুকানো , বাড়িওয়ালা চাচার মেয়ে দিয়েছিলো ৷

—এত রাতে ছাদে যাবো ! অবশ্য ছাদে গেলে ভালো লাগবে , আর তার চেয়েও বড় কথা একটা সিগারেট খাওয়া যাবে ৷

—আপনি সিগারেট খান !

—বাংলা সিনেমার নায়িকাদের মতো লুক দিচ্ছো যে ! সিগারেট খাই , তবে খুব বেশী না ৷ সারাদিনে তিনটা ৷ আজকে অবশ্য চারটা হবে ৷ কি যাবে , না কি সিগারেট খাবার অপরাধে ছাদে যাওয়া ক্যান্সেল ৷

—না ক্যান্সেল না ৷ তবে আস্তে আস্তে বাদ দেওয়া লাগবে , প্যাসিভ স্মোকিং ও ভয়াবহ খারাপ , আপনার জন্য শেষে আমার ভোগা লাগবে ৷

—ও বাবা কি ভয়ানক ! হা হা হা

—হাসবেন না তো বিশ্রী লাগছে ৷ চলেন , আস্তে আস্তে আসবেন কিন্তু ৷ মা জানলে আর রক্ষা নাই ৷

ছাদে মৃদু বাতাস বইছে ৷ আকাশে আধখানা বাঁকা চাদ ৷ সুমন বলে “জানো অপা , আমার অর্ধেক চাঁদ খুব প্রিয় ..” অপা হেসে বলে “দারুণ তো ! এতদিন সবার কাছে শুনেছি তাদের পূর্নিমা পছন্দ ৷ এই প্রথম একজনকে পেলাম যার কিনা অর্ধেক চাঁদ পছন্দ ” ..সুমন মৃদু হাসে কোন কথা বলেনা ৷ পরিবেশটা ভীষণ সুন্দর ৷ অপা গুনগুনিয়ে গান ধরে ..
আধো রাতে যদি ঘুম ভেঙে যায়
মনে পরে মোরে প্রিয়
চাঁদ হয়ে রবো আকাশের গায়
বাতায়ন খুলে দিও….

সুমন মুগ্ধ হয়ে শোনে ৷ হঠাৎ খেয়াল করে অপা চোখ মুছছে আঁচলে ৷

—কি দারুণ গান গাও তুমি , থামলে কেন ? কাঁদছো যে !

—এই দিন , এই মুহূর্ত আমার কাছে স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে ৷ আমার ভীষণ ভয় হচ্ছে সুমন , এত সুন্দর দিন আমার জীবনে আর কখনো আসবে তো ! নিজেকে বড্ড বেশী সুখী মনে হচ্ছে সুমন ! আমার ভয় হচ্ছে !

—এমন একজনের জীবনে জড়ালে যে কিনা এখনো তোমাকে পরিপূর্ন স্ত্রীর মর্যাদা দিতে পারলো না ৷ অথচ তোমার মনে হচ্ছে তুমি সুখী ?

—সুমন ! আমি কি আপনাকে তুমি বলতে পারি ?

—হুমম বলো ! আপনি তুমিতে আমার এলার্জী নাই ৷ তনুতো আমাকে রেগে গেলে তুইও বলতো ৷ সব সয়ে গেছে ৷

—আচ্ছা বলো বিয়ে কি আমার শুধু তোমার সাথেই হয়েছে ? বিয়ে মানে কি আসলে শুধু স্বামী আর স্ত্রী ? আমার তো তা মনে হয়না ৷ বিয়ের এই একটা সম্পর্কের মধ্যে দিয়ে আমি মা পেয়েছি , বাবা পেয়েছি , একটা ছোট বোন পেয়েছি …মানুষগুলো আমাকে এত আপন করে নিয়েছে , এই মানুষগুলোর কাছে স্বামী স্ত্রীর শারিরীক সম্পর্ক আমার কাছে খুব তুচ্ছ মনে হয় ৷ আর আমার তোমাকে খুব ভালো বন্ধু মনে হচ্ছে সুমন ৷ আমার তোমার জন্য কষ্ট হয় যে তুমি এত ভালোবেসেছিলে যাকে সে তোমাকে ছেড়ে চলে গেছে ৷ আমি কিন্তু কখনোই সেই জায়গাটা নিতে চাই না ৷ শুধু চাই কোন এক এমন আধখানা চাদের আলোয় তুমি আমার হাতাদুটো ধরো .. চোখের কাছে চলে আসা আমার অবাধ্য চুলগুলোকে কানের পাশে ঠিক করে গুছিয়ে দাও ! সুমন , যা পেয়েছি ঢের পেয়েছি , এরপর যদি কিছু পাই সব আমার বোনাস …

—তুমি সত্যিই আলাদা অপা ৷ সবার থেকে আলাদা ..আজ আর নিচে যেতে ইচ্ছে করছে না ৷ কিন্তু যেতে হবে চলো ৷ সকালে আমার অফিস আছে..

দুজনে মৃদু পায়ে আবার ঘরে চলে যায় ৷ বিছানায় কোলবালিশের বর্ডার বানিয়ে শুয়ে পরে ৷ কিন্তু আজ অপার খুব ইচ্ছে করে বর্ডারটা সরিয়ে সুমনের বুকে মাথা রেখে শোবে ৷ অপা জানেনা তার ইচ্ছে কি আদৌ কখনো পূরন হবে কি হবেনা … তবুও স্বপ্ন দেখতে দোষ কি.. আজ না হয় অপা স্বপ্নই দেখলো …

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here