একটি বিবাহত্তোর প্রেমের গল্প,শেষ পর্ব

0
1129

একটি বিবাহত্তোর প্রেমের গল্প,শেষ পর্ব
তামান্না জেনিফার

সকাল বেলায় সোহান আর তার বাবা চলে আসে অপাদের বাড়িতে ৷ ততক্ষনে সুমন অফিস চলে গেছে ৷ রিয়া তখনো গভীর ঘুমে ৷ রোজ রোজ সকালে তাড়াতাড়ি উঠতে হয় ৷ আজকে সকালে ঘুমাবার সুযোগ পেয়ে রিয়াকে যেন গভীর আলস্যে পেয়েছে ৷ সোহান একবার উঁকি দিয়ে দেখে ৷ তারপর বারান্দায় গিয়ে কাকে যেন ফোন দেয় ৷ অপার মনে হয় সোহানের সাথে খোলাখুলি কথা বলা দরকার ৷ তাই সে পিছু নেয় সোহানের ৷ এরপর যা শোনে তার জন্য সে প্রস্তুত ছিলো না ৷ সোহানকে সে যা ভেবেছিলো , সে তেমনি আছে ৷ সে মোবাইলে সম্ভবত কোন মেয়ের সাথে কথা বলছে ৷ এক দুই মিনিট চুপচাপ আড়ালে দাড়িয়ে শোনার পর ওর সম্বিত ফিরে আসে ৷ ওর মনে হয় করুনাময় এই সুযোগটা ওকে নিজের হাতে দিয়েছে ৷ এ সুযোগ নস্ট করা যাবে না ৷ সে দ্রুতপায়ে সেই ঘরে যায় যেখানে রিয়া ঘুমিয়েছে ৷ সেখানে গিয়ে সে রিয়াকে ঝাকুনি দিয়ে তোলে ৷ হাঠাৎ ঘুম থেকে উঠে রিয়া কিচ্ছু বুঝতে পারে না ৷ কিন্তু এতটুকু বোঝে যে অপা তাকে কিছু দেখাতে চায় ৷ রিয়া অপার পিছু নেয় ৷

বারান্দায় যেখানে সোহান ফোনে কথা বলছে , তার একটু পাশেই চুপি চুপি নিঃশ্বাস বন্ধ করে দাড়ায় দুজনে ৷ সোহান কোন মেয়েকে সে সময় বলছিলো “আরে জান , আমার পাখিসোনা .. এই তো আর কিছুদিন , তারপর আমরা বিয়ে করে নেবো .. আজ বিকেলে আমি আসবো সোনা , আমার জন্য লাল শাড়ী পরে অপেক্ষা করবে তো ! ” রিয়া এ কথা শোনার পর ধপাস করে মাটিতে বসে পরে ৷ হঠাৎ শব্দ হওয়ায় সোহানও বুঝতে পারে কেউ তার কথা শুনেছে.. সে দ্রুত এসে রিয়াকে দেখে ঘাবরিয়ে যায়..তবে পরিস্থিতি সামাল দেয়ার চেষ্টা করে সে রিয়াকে বলে “আরে পাখি , এসব কিছু না ..আমি তোমাকে সব বুঝিয়ে বলছি ..একটু সময় দাও আমাকে , তুমি ভুল শুনেছো..” .. রিয়া ওর হাতে থাকা ফোনটা কেড়ে নিয়ে লাস্ট ডায়াল করা নাম্বারে ফোন দেয় ..ওপার থেকে নারী কন্ঠ ভেসে আসে ” হ্যা জানু ! হঠাৎ ফোন কেটে দিলে কেন ?” .. রিয়া কল কেটে দিয়ে সোহানের হাতে ফোন দিয়ে অপাকে বলে “ভাবী আমাকে ঘরে নিয়ে যাও …এই বিশ্বাসঘাতক জানোয়ারের মুখ দেখতে চাইনা..এই ইতরের ভালোবাসায় আমি অন্ধ হয়ে ছিলাম , আমি ভাবিওনি এই বিশ্বাসঘাতক এভাবে আমাকে ধোকা”

এরপর সোহান বলে “এই এসব চ্যাটাং চ্যাটাং কথা আমার সাথে বলবি না তো ৷ অনেক সহ্য করছি তোর নখরা ..যে পাখিটা এবার আমি হাত করেছি সে তোর চেয়েও সুন্দরী , তোর চেয়েও বড়লোকের মেয়ে ..ভালোই হয়েছে তুই সব জেনে ফেলেছিস ৷ এবার তোকে আমি ছাড়লাম ..জাহান্নামে যা !”

অপাকে রিয়াকে ছেড়ে একটা সজোরে চড় দেয় সোহানের গালে .. সোহান কথা না বাড়িয়ে সেখান থেকে চলে যায় ..

সন্ধ্যায় সুমন তাদের নিতে আসলে দুজনে তার সাথে চলে যায় ৷ এই বিষয়ে কেউ কারো সাথে কথা বলেনা ৷

বাড়ি ফিরে অপা দেখে শ্বাশুড়ি সুজলা রহমান একগাদা খাবার তৈরী করে রেখেছেন ৷ অপাকে দেখেই বলে “মা রে খালি একটা দিন ছিলিনা আমার মনে হলো কতদিন তোকে দেখিনি ..” অপা প্রথমবারের মতো জড়িয়ে ধরে শ্বাশুড়িকে ৷ শ্বাশুড়ির শরীরে অপা মায়ের শরীরের মতই গন্ধ পায় , অপার মনে হয় সে যেন তার মাকেই জড়িয়ে ধরে আছে ৷ সে রাতেই অপা প্রথমবারের মতো দেখে কেমন করে জীবনের জন্য লড়াই করতে হয় ৷

সবকিছুই ঠিক মতো চলিছিলো ৷ হঠাৎ করে মাথা ঘুড়ে পরে যায় সুজলা ৷ অপা আর সুজলা তখন তার বাবার বাড়ি নিয়ে গল্প করছিলো ৷ বাড়িতে তখন সে আর মাজেদা খালা ছাড়া আর কেউ নেই ৷ অপার মাথা যেন মুহূর্তের মধ্যে ফাঁকা হয়ে যায় ৷ সে বুঝে উঠতে পারেনা কি করবে , তার কি করা উচিৎ ৷ প্রথমে সে ফোন দেয় সুমনকেই , সুমনের পি এ বলে স্যার তো মিটিং এ ৷ এরপর ফোন দেয় রিয়াকে , রিয়ার ফোন বেজে যায় সে ফোন ধরে না .. আর অপার শ্বশুড়ের ফোন বন্ধ পায় ৷ এদিকে মাজেদা খালা সমানে কান্না করে যাচ্ছে ৷ অপা বোঝে , এখন তার ভেঙ্গে পরার সময় নয় ৷ সে সুজলার ডাক্তারের ফাইল বের করে নাম্বার খুজে ফোন দেয় হাসপাতালে আর দ্রুত পাঠাতে বলে এম্বুলেন্স ৷ ততক্ষনে শ্বাশুড়ির মাথায় পানি দেয় , পায়ের নিচে বালিস দেয় .. সুজলা রহমানের তখন একটু একটু জ্ঞান ফিরতে থাকে ৷ ততক্ষনে এম্বুলেন্স চলে আসে ৷ মাজেদা খালাকে বাসায় রেখে অপা একাই শ্বাশুড়িকে নিয়ে রওনা হয় ৷ অপার কাছে টাকাও নাই , আর এ বাড়ির টাকা কোথায় থাকে সে তাও জানে না ৷ কিন্তু টাকা তো লাগবে ! সে বারবার সুমনের ফোনে কল দিতে থাকে ৷ অনেক সময় পর সুমন ফোন ধরলে অপা জানায় মা কে নিয়ে সে হাসপাতালে , আর তার কাছে একটা টাকাও নেই ! সুমন দ্রুত হাসপাতালে চলে আসে ৷ একে একে চলে আসে সুমনের বাবা আর রিয়াও ৷ সারাটা রাত চার জোড়া চোখ জেগে থাকে ৷ ভোরের দিকে ডাক্তার জানায় সুজলা এখন স্টেবল , তবে তার আরো চিকিৎসা দরকার ..

শ্বাশুড়িকে নিয়ে বাসায় ফেরে অপা ৷ সারাদিন সবাই চুপচাপ , রিয়া সেই ঘটনার পর থেকে একদম চুপ হয়ে গেছে , তারউপর মায়ের এমন অসুস্থতায় সে একেবারেই চুপসে গেছে ৷ এদিকে অপা একদিনের মধ্যেই সংসারের সব দায়িত্ব বুঝে নিয়েছে , শক্ত হাতে হাল ধরেছে পরিবারের ৷ সবাই বিকেল বেলা বারান্দার খোলা জায়গায় বসে ছিলো ৷ অপা নিজের পাসপোর্ট হাতে সেখানে আসে ৷ টেবিলের উপর নিজের পাসপোর্ট রেখে বলে “এই আমার পাসপোর্ট ৷ সবাই যার যার টা নিয়ে এসে টেবিলে রাখেন ৷ সুমন তুমি মায়েরটাও সাথে এনো ” .. অপার গলায় অদ্ভুত একটা বিষয় ছিলো যে কেউ মানা করতে পারেনা ৷ একে একে সবাই তাদের পাসপোর্ট নিয়ে এসে টেবিলে রাখে ৷ মাজেদা খালা এসে বলে “আমার তো পাসফোট নাই নয়া বউ ” .. অপা বলে “খালা আমার খুব ইচ্ছে ছিলো আপনাকেও সাথে নিবো ৷ কিন্তু এখন নতুন পাসপোর্ট করানোর সময় আসলে নেই …তবে কথা দিচ্ছি , বেঁচে থাকলে আমি আপনাকে বিদেশ দেখাবো…” মাজেদা অপার কাছে এসে তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে “মা গো , তুমি যে কইছো এটাই আমার অনেক..সবাই যুদি যাই , তাইলে বাড়ি দেখবো কেডা ? আপনেরা আফারে সুস্থ কইরা আনেন ৷ আমি আছি , বাড়ি আমি দেখুম…” অপা এ কথা শুনে জড়িয়ে ধরে মাজেদা খালাকে ..তারপর বলে , “সুমন কাল সকালে তোমার প্রথম কাজ ভিসা অফিসে যাওয়া ৷ আমরা ইন্ডিয়া যাচ্ছি ..” সুমন কোন কথা বলতে পারেনা .. কি যেন তার গলার কাছে জমে থাকে .. শুধু মৃদুস্বরে কষ্ট করে বলে “আচ্ছা” ..

*****

হাসপাতালের সাদা বিছানায় শুয়ে আছে সুজলা রহমান ৷ অপার যত্নআত্তি আর চিকিৎসায় সুজলা এখন আগের চেয়েও বেশ সুস্থ ৷ অপাকে কাছে ডেকে বলে “তোরা বাচ্চারা কোথাও যা না , রিয়াটা সারাদিন মনমরা হয়ে থাকে আমার ভালো লাগে না মা ..” অপা বলে “ঠিক আছে মা , তুমি ভেবো না..”

মুম্বাইয়ের সমুদ্রপাড়ে বসে আছে অপা , রিয়া আর সুমন ৷ অপা সুমনকে বলে “কিছু খাবো আনো তো..” ৷ সুমন চলে যায় খাবারের সন্ধানে ৷ অপা আসলে একা কথা বলতে চাচ্ছিলো রিয়ার সাথে ৷

—রিয়া , সারাদিন এমন মনমরা হয়ে কেন থাকো ?

—ভাবী , আমার ভালো লাগে না ৷ মরে যেতে ইচ্ছে করে ৷ আমার সাথে কেন এমন হলো ? কেন সোহান এইভাবে আমাকে ঠকালো ৷ আমার কি অপরাধ ছিলো বলো ?

—পাগল মেয়ে , তোমার কোন অপরাধ ছিলো না ৷ অপরাধ ছিলো না বলেই বেঁচে গেছো তুমি ৷ আল্লাহ তোমাকে বাঁচিয়ে দিয়েছে ৷

—আর কই বাঁচলাম ভাবী ! আমি প্রতিদিন নতুন করে মরছি ..

—তুমি যেদিন প্রথমবার আমাকে সোহানের কথা বললে , আমি ভীষণ অবাক হয়ে গেছিলাম ৷ একটা শিক্ষিত মেয়ে হয়ে তুমি কিভাবে এমন ভুলটা করলে শুধু এটাই ভেবেছি ৷ আমি চাইলে তখনি বলতে পারতাম ও কেমন ৷ কিন্তু রিয়া , সত্যি কথা জানো কি , আমি যদি বলতাম তুমি আমাকেই ভুল বুঝতে ৷ আমি শুধু শোনার পর থেকে আল্লাহকে বলেছি আল্লাহ এ বিপদ থেকে রিয়াকে বাঁচাও ৷ এজন্যই বোধহয় করুনাময় সময় থাকতে তোমাকে সবটা দেখিয়েছে ৷

—ভাবী আমার আর বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করেনা ৷ আমি সোহানকে হারিয়ে ফেললাম ..

—ধরো , তুমি সোহানকে পেতে ৷ বিয়ে হতো , তারপর জানতে তার চরিত্র কি ! তারপর কি হতো বলো ? তারপর তোমাকে হয়তো ডিভোর্সী ট্যাগ নিয়ে বাঁচতে হতো ৷ সমাজে পুরুষের পাপের সাজাও নারীরাই পায় ৷ যত অপরাধই হোক আর দোষ যারই হোক , দোষী শুধু নারীরাই .. এরচেয়ে ভাবো , তুমি কতটা ভাগ্যবতী যে সময় থাকতেই জানতে পেরেছো সবটা ..

—ভাবী , তুমি ঠিক বলছো ৷ এভাবে ভেবে দেখিনি ৷

—তাহলে এবার সিদ্ধান্ত তোমার ৷ এভাবে মুখ কালো করে ঘুরে সবাইকে কষ্ট দিবে নাকি জলন্ত অঙ্গার থেকে ফিনিক্স পাখির মতো নতুন করে জন্ম নেবে ?

—আমি আবার বাঁচবো ভাবী ৷ কথা দিলাম তোমাকে ৷

সুমন খাবার নিয়ে ফিরলে সবাই মিলে খেয়েদেয়ে হাসপাতালে চলে যায় ৷ আজ দীর্ঘদিন পর রিয়া হাসিমুখে বলে সে রাত্রে মায়ের সাথে থাকতে চায় ৷ এখানে আসবার পর এই প্রথমবারের মতো অপা আর সুমন একা ৷

অপা বিছানার মাঝখানে কোলবালিসের বর্ডার দিয়ে সুমনকে ডাকে ৷ সুমন বিছানায় বসে অপাকে বলে

—আজ আঁধখানা চাঁদের রাত .. ছাদে যাওয়া তো সম্ভব না , বারান্দায় যাবে অপা ?

অপা হেসে বলে “তুমি যাও আমি কফি নিয়ে আসি ..”

কফিতে চুমুক দিতে দিতে নিঃশব্দে হাজার কথা বলতে থাকে দুটি প্রাণ ৷ হঠাৎ সুমন আলতো করে ধরে অপার হাত .. বলে “অপা ! এই ক্ষয়ে যাওয়া মানুষটাকে আবার একটু বাঁচতে সাহায্য করবে বলো..” অপা হাতের উপর হাতটা পরম ভালোবাসায় রাখতেই হেঁচকা টানে তাকে বুকের মধ্যে নেয় সুমন …গাঢ় স্বরে বলে “ভালোবাসি ..ভালোবাসো ?”

উত্তরে অপা বুকের গভীরে মুখ লুকিয়ে বলে “এখনো বলতে হবে ? বোঝোনা তুমি ? ভালোবাসি , অনেকে…অনেক..

একটি বিবাহত্তোর প্রেমের সূচনা ঘটে অবশেষে ..

সমাপ্ত

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here