তুমি কেন এলে জানিনা এখনও,সূচনা_পর্ব

0
1606

#তুমি কেন এলে জানিনা এখনও,সূচনা_পর্ব
#লেখনীতে_সুহানা_সুলতানা

বহুদিনের চেনা পরিচিত নিজের সখের বশে সাজানো ছোট্ট ঘরটাকে শেষ বারের মতো চোখ বুলিয়ে দেখে নিতেই নীচ থেকে মায়ের ডাক পড়লো,

মেঘা, তাড়াতাড়ি নেমে আয়, এবার গাড়ি ছাড়তে হবে এমনিতেই অনেকটা লেট হয়ে গেছে।

এইতো মা আসছি।

মেঘা তাড়াতাড়ি করে ওর ডায়রি ভর্তি ব্যাগটা হাতে নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নীচে নেমে এলো। গাড়ির সামনের দরজা খুলে ড্রাইভারের পাশের সিটে বসে পড়লো। আর ডায়রি ভর্তি ব্যাগটা ওর মায়ের কাছে দিয়ে দিলো। ওর ক্লাস থ্রী থেকে শুরু করে ক্লাস টুয়েলভ, প্রত্যেকটা ক্লাসেরই ডায়রি আছে। অব্যাক্ত কত অনুভুতি বোবা ডায়রির পাতায় মুখ বুজে রয়ে গেছে। কত সুখ দুঃখের আলাপ আছে এই ডায়রিগুলোর সাথে। মাথাটা গাড়ির সিটে হেলিয়ে দিয়ে চোখ দুটো বন্ধ করলো মেঘা। আজকে পার্মানেন্টলি ওর বাবার বিজনেসের জন্য ওরা এই এরিয়া ছেড়ে অন্য একটা নতুন জায়গা, নতুন পরিবেশে শিফট হচ্ছে। বাবার বিজনেসের জন্য দেশবিদেশের প্রচুর জায়গায় ঘুরেছে মেঘা। কতবার যে স্কুল চেঞ্জ করেছে তার ইয়ত্তা নেই। কিন্তু এইবার পার্মানেন্টলি সেটেল হবে সেখানে। ওদের বাড়িটা পরিষ্কার করা হয়ে গেছে, নতুন ফার্নিচারও আনা হয়ে গেছে শুধুমাত্র ওদের যাওয়ায় বাকি রয়েছে।

দীর্ঘ দশ ঘণ্টার জার্নি করে অবশেষে ওরা ওদের নতুন ঠিকানায় পৌঁছে গেলো। প্রায় পুরোটা রাস্তায়ই মেঘা ঘুমিয়েছে। গাড়িটা ওদের বাড়ির সামনে থামতেই গাড়ি থেকে নেমে একটা লম্বা শ্বাস নিলো মেঘা। তারপর দৌড়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকে গেল।

ইশ, আসতে যা। পড়ে যাবি তো।

কিছু হবে না মা।

থাক না। বাচ্চা মেয়ে আমার।

হ্যাঁ কালকে কলেজে ভর্তি হবে আঠেরো পেরিয়ে আর কয়েকমাস পর ঊনিশ বছরের হবে এই মেয়ে আর তুমি তাকে বাচ্চা বলছো?

আহা, রাগ করছো কেন মেহের। চলো ভেতরে চলো।

মেঘার বাবা রোহান চৌধুরী আর মা মেহের চৌধুরীও ভেতরে ঢুকলেন।

দোতলায় গিয়ে নীল রঙের একটা দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো মেঘা। তিন তলার বাড়িটাতে সবচেয়ে আলাদা দরজা বিশিষ্ট ঘরটাই যে ওর সেটা বুঝতে তার একটুও দেরী হলো না। ডানহাতের তর্জনী আঙুল দিয়ে আলতো করে ধাক্কা দিয়ে দরজাটা খুলে ফেললো মেঘা। রুমটা দেখে ওর মনটা প্রশান্তিতে ভরে গেল। সাদা আর নীলের কম্বিনেশনে রুমটাকে দেখে মনে হচ্ছে কেউ যেনো এক টুকরো আকাশ এনে দিয়েছে তার সামনে। আস্তে আস্তে এক পা এক পা করে এগিয়ে গিয়ে রুমে ঢুকলো মেঘা। ভেতরে ঢুকতেই মেঘার মুখটা হাঁ হয়ে গেল। রুমের মাঝখানে একটা গোল বেড তার ওপর নীল বেডশিট বিছানো আর সেখান থেকে একটু দূরে রয়েছে ব্যালকনি যেখান থেকে দেখা যাচ্ছে অস্তমিত সূর্যের আলোয় আলোকিত কমলা রঙের আকাশ আর ব্যালকনিতে বিভিন্ন ইনডোর প্লান্টসও রয়েছে। বেডের সামনের বড় বড় জানালা দুটো বন্ধ আছে তাই এগিয়ে গিয়ে জানালা দুটো খুলে দিলো মেঘা তারপর ওয়াশরুমে গিয়ে দশ মিনিটের মধ্যেই ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে এলো। ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এসেই বেডে এলোমেলো হয়ে শুয়ে পড়ল। ততক্ষণে সন্ধ্যা নেমে এসেছে। হঠাৎ কিছুর আওয়াজে চোখ খুলে গেল মেঘার মোবাইলটা হাতে নিয়ে দেখলো আটটা বাজছে।

ওহ্ শিট আমি ছয়টায় শুয়েছিলাম কখন যে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে এতটা সময় পেরিয়ে গেল বুঝতেও পারিনি।

ওর চোখের দৃষ্টি ওর ঘরের দুটো জানালা ভেদ করে সামনের বাড়িটার জানালার দিকে পড়লো। সুঠাম দেহের অধিকারী একটা যুবকের উন্মুক্ত পিঠ ওর চোখে পড়লো। সাদা আলোয় ফর্সা পিঠটা চকচক করছে। মেঘা তাড়াতাড়ি করে বালিশ দিয়ে ওর মুখ ঢেকে নিলো আর তারপরই বালিশটা একটু সরিয়ে দিয়ে একটা চোখ দিয়ে দেখলো যুবকটি সামনে এগিয়ে গিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকলো। মেঘার জানালা থেকে এক হাতের একটু বেশি দূরত্বে ওপর বাড়িটির জানালা অবস্থিত। তাই অনায়াসেই মেঘা সবকিছু প্রত্যক্ষ করতে পারলো।

আমাদের বাড়ীর পাশের বাড়ীতে এমন একটা হ্যান্ডসাম ছেলে থাকে!! ধ্যাত মুখটাই তো দেখতে পেলাম না।

এসব ভাবনার মাঝেই ওর পেটে ব্যাথা করতে শুরু করলো। তাই ভাবনার জগৎ থেকে বেরিয়ে ও নীচে নেমে এলো।

মা খেতে দাও।

সবই আছে বেড়ে খেয়ে নে। আমি এখন যেতে পারবো না।

দেখবে তো মোবাইল আর সামান্য খাবারটুকুও বেড়ে দিতে পারবে না। যত্তোসব।

কথাগুলো বলেই মেঘা ভাত বেড়ে নিয়ে খেয়ে নিলো। খাওয়া শেষ হতেই আবার ঘরে চলে গেল। গিয়ে দেখলো সামনের রুমে লাইট অফ হয়ে গেছে। ও নিজের নীল ডায়েরিটা নিয়ে বসলো। আজকের সবকিছু দিনলিপি আকারে ডায়েরির পাতায় সঁপে দিলো। তারপর নরম তুলতুলে বিছানায় গা এলিয়ে দিল। কিন্তু দু’ঘণ্টা ঘুমানোর জন্য ওর চোখে আর ঘুম ধরা দিল না। এখন ওর সেই ফর্সা পিঠের মালিকের মুখশ্রী দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে। আর ইচ্ছে হলেও বা কি সব ইচ্ছে তো আর পূরণ হয় না। ঘরের আলোটা নিভিয়ে দিয়ে হালকা নীলাভ বর্ণের আলোয় ধীরে ধীরে ব্যালকনির দিকে এগিয়ে গিয়ে ছোট্ট ক্যাকটাস গাছটা ঘরে নিয়ে চলে এলো।

আচ্ছা তোর নিজের আত্মরক্ষার জন্য যে গায়ে কাঁটা বানিয়েছিস, তো যারা তোকে ভালোবাসতে চাইবে তারাও তো আঘাত পাবে। যেমন ধর এখন আমার তোকে ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছে করছে কিন্তু হাতে কাঁটা ফুঁটে যাবে তাই ইচ্ছেটার প্রাধান্য দিতে পারছি না।

এরকম আরো হাজারো কল্পনার কথা বলতে বলতেই ঘুমের রাজ্যে পাড়ি দিলো মেঘা।

সকালবেলা,,,,,

ব্রেকফাস্ট করে বাবার সঙ্গে কলেজে অ্যাডমিশন হতে গেলো মেঘা। ফেরার পথে গেটের সামনে মেঘাকে গাড়ি থেকে নামিয়ে দিয়ে উনি অফিসে চলে গেলেন। গাড়িটা যাওয়ার দিলে কিছুক্ষন তাকিয়ে রইলো মেঘা। পেছনে ঘুরতেই পায়ে নরম কিছুর স্পর্শ অনুভূত হলো। ভয় পেয়ে কয়েক পা পিছিয়ে গিয়ে দেখলো একটা সাদা রঙের লোমশ কুকুর ওর পায়ের কাছে দাঁড়িয়ে ছিল। একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে কুকুরটাকে নিয়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকে গেল মেঘা। ওর মা কুকুরটাকে দেখেই বকাবকি শুরু করলো।

কার না কার কুকুর, যেখান থেকে এনেছিস সেখানেই রেখে আয়।

যার কুকুর সে খোঁজ করতে এলেই দিয়ে দেবো।

বলেই নিজের রুমে চলে গেল মেঘা। নেমপ্লেটে ‘জেনি ‘ নামটা দেখে মেঘা বললো,,,

জেনি চুপটি করে এখানেই বসে থাকবি, আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি।

ফ্রেশ হয়ে এসে লাঞ্চ করে জেনির সঙ্গে খেলতে খেলতে কখন যে সন্ধ্যা পেরিয়ে গেছে মেঘা তার সম্পর্কে অবগত হয়নি। যখনই পাশের বাড়ির রুমটাতে আলো জ্বলে উঠলো তখনই জেনি ঘেউ ঘেউ করে ডাকতে আরম্ভ করলো।

আরে আরে এভাবে চ্যাচাস না উনি চোর না।

কুকুরের ডাক শুনে সেই মানুষটি জানালা দিয়ে তাকিয়ে জেনিকে বেডের ওপর দাঁড়িয়ে লেজ নাড়তে দেখলো। আর তাকেই কিনা খুঁজে খুঁজে এতো হয়রান হয়েছে সে।

জেনি, বলে যুবকটি ডাক দিতেই মেঘা এবার পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালো যুবকটির দিকে। যুবকটির সঙ্গে চোখাচোখি হতেই মেঘা বলে উঠলো,,,

এটা কি আপনার কুকুর?

কুকুর শুনে যুবকটা ভ্রু জোড়া কুঁচকে নিলো।

ও আমার জেনি।

আমি কি ওকে আজকের রাতটা আমার কাছে রাখতে পারি?

জেনির ভাবভঙ্গি লক্ষ্য করে যুবকটি অনুমতি দিয়ে গম্ভীর স্বরে বলে উঠলো,,,

সকাল আটটার আগে নিজে স্বশরীরে উপস্থিত থেকে ওকে আমার কাছে দিয়ে যাবে।

আচ্ছা।

যুবকটি ওয়াশরুমে ঢুকলো।

অবশেষে সেই ফর্সা পিঠের অধিকারী ব্যাক্তির মুখটাও দেখা হয়ে গেল।

কথাটা বলেই মেঘা ডাইরি নিয়ে বসলো। ওর লেখার মাঝেই যুবকটি রুমের লাইট অফ করে দিলো। লেখা শেষ করে মেঘাও লাইট অফ করে শুয়ে পড়লো। পরেরদিন সকাল সাতটায় ঘুম থেকে উঠে পড়লো মেঘা। জেনিকে কোলে তুলে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে ডাইনিং টেবিল পেরিয়ে যাওয়ার সময় ওর মা বলে উঠলো,,

কি রে আজ এতো তাড়াতাড়ি উঠলি যে আর তাড়াহুড়ো করে কোথায় যাচ্ছিস?

মা এটা যার কুকুর তাকে ফিরিয়ে দিতে যাচ্ছি। আটটা বাজার আগে পৌঁছে দিতে হবে।

খাবারটাতো খেয়ে যা।

গেটের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বলল,,

এসে একদম স্নান করে খেয়ে কলেজে যাব এখন একদমই সময় নেই।

ওর মাও আর কথা বাড়ালো না। ওর বাবা ব্রেকফাস্ট করে অফিসের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লো।

কাকে চান?

বাড়ির সামনে ও ভেতরে এতো এতো বডিগার্ড দেখে শুকনো ঢোক গিললো মেঘা। গম্ভীর স্বরের প্রশ্নের উত্তরে জবাব দিলো

জেনির মালিককে চাই।

বিশালদেহী লোকটা পকেট থেকে মোবাইল বের করে কাকে যেনো কল করলো।

আচ্ছা স্যার, আমি পাঠিয়ে দিচ্ছি ভেতরে।

মেঘা যখন সবকিছুর ওপরে চোখ বোলাতে ব্যাস্ত তখনই আবারও সেই স্বরটি কানে এলো মেঘার তবে অনেকটাই নমনীয় কণ্ঠে।

ম্যাম মেইন দরজা দিয়ে ঢুকে বামদিকে যে সিঁড়ি পড়বে সেটা বেয়ে ওপরে উঠবেন বামদিকে কালো দরজা দেওয়া যে ঘরটি পড়বে সেটাই স্যারের ঘর।

মেঘা সামনের দিকে এগিয়ে গেল আর ওই লোকটির কথা অনুসরণ করে কালো দরজা বিশিষ্ট ঘরটার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। কয়েক মুহূর্তের জন্য নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে দরজায় দুটো টোকা দিল। সঙ্গে সঙ্গেই ভেতর থেকে গুরুগম্ভীর আওয়াজ ভেসে এলো,,,

ইয়েস, কাম ইন।

দরজাটা হালকা করে ঠেলে দিয়ে ভেতরে ঢুকলো মেঘা। জেনি ওর কোল থেকে নেমে সেই যুবকটির পায়ের কাছে গিয়ে ঘেউ ঘেউ করে চিৎকার দিচ্ছে আর লেজ নাড়াচ্ছে। যুবকটিও হাসি মুখে জেনিকে কোলে তুলে নিলো আর মেঘার উদ্দেশ্যে বলে উঠল,,,

সোফায় বসো।

মেঘার একটু অস্বস্তি হচ্ছিলো। যুবকটি ওকে প্রশ্ন করলো,,,

কি নাম তোমার?

মেঘা চৌধুরী।

কোন ক্লাসে পড়ো?

কলেজে ভর্তি হয়েছি। আজকে ফার্স্ট ডে।

ওহ্। সায়েন্স না আর্টস না কমার্সের স্টুডেন্ট?

সায়েন্স।

তুমি কি ব্রেকফাস্ট করে এসেছো?

না। বাড়িতে গিয়ে করবো। মা অপেক্ষা করছে আমার জন্য।

আমিও এখন ব্রেকফাস্ট করবো। আর আমার বাড়িতে এলে কেউ খালিমুখে ফিরে যায়না। তাই তুমিও আমার সঙ্গেই ব্রেকফাস্ট করবে।

এই কথার পরিপ্রেক্ষিতে আর কোনো কথা বলতে পারলো না মেঘা। তাই বাধ্য হয়েই ডাইনিং টেবিলে বসতে হলো তাকে। কিন্তু খাওয়া নিয়ে বেশ লজ্জায় পড়লো মেঘা। যুবকটি ওকে সব জিনিসই বেশি বেশি করে তুলে দিয়েছে প্লেটে। বার বার বারন করা সত্ত্বেও শোনে নি। এতো খাবার একসঙ্গে কোনোদিনই খাইনা ও। আবার খাবার নষ্ট করাও পছন্দ করেনা মেঘা তবুও অনেকটাই খাবার নষ্ট করে ফেলেছে ও। দুজনে একসঙ্গে বাড়ি থেকে বেরোলো। যুবকটি গাড়িতে উঠলো আর মেঘা নিজের বাড়িতে ফিরে এলো।

কি রে এতো দেরী হলো কেনো আসতে?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here