তুমি_কেনো_এলে_জানিনা_এখনও #দ্বিতীয়_পর্ব

0
1063

#তুমি_কেনো_এলে_জানিনা_এখনও
#দ্বিতীয়_পর্ব
#লেখনীতে_সুহানা_সুলতানা

মা, কুকুরের মালিক ব্রেকফাস্ট না করিয়ে ছাড়েনি তাই এতো দেরি হলো। আমি স্নান করতে যাচ্ছি।

আচ্ছা যা।

বাড়ি ফিরে স্নান করে কলেজের উদ্দেশ্যে রওনা দিলো মেঘা। ইন্ট্রোভার্ট হওয়ার জন্য কলেজে কারোর সঙ্গে তেমন বন্ধুত্ব হয়ে ওঠেনি মেঘার আর ভাগ্যক্রমে রাগিং হাওয়ার থেকেও বেঁচে গেছে। কলেজ থেকে সেই যে বিকেলে ফিরে ফ্রেশ হয়ে ঘুমিয়েছে এখনও উঠেনি। সারাদিনের ক্লান্তি আর তার সঙ্গে বুড়ো বুড়ো টাকলু প্রফেসরদের লম্বা লম্বা লেকচার শুনে বাড়ি ফিরে আর চোখ খুলে রাখতে পারে নি মেঘা। ওর মা সাড়ে সাতটা থেকে ডেকে যাচ্ছে এখন আটটা বেজে গেছে ওর মা রুমের লাইট অন করে জানালার পর্দা সরিয়ে দিয়েছে। তবুও ওর ওঠার নাম নেই। কাঁটায় কাঁটায় আটটা বাজতেই যুবকটি নিজের রুমে পৌঁছলো আর তার দৃষ্টি জানালা ভেদ করে নীল বিছানায় বেড়ালের বাচ্চার মতো গুটিশুটি হয়ে শুয়ে থাকা মেঘার ওপর পড়ল। হঠাৎই মেঘাকে নড়তে দেখে চোখ সরিয়ে উল্টো দিকে ঘুরে দাঁড়ালো যুবকটি।

মেঘা ভ্রু কুঁচকে পিটপিট করে তাকালো আর জানালা ভেদ করে আবারও ওর নজরে পড়লো সেই সুন্দর-সুঠাম-সুগঠিত ফর্সা মসৃন পিঠটা। সেই সুগঠিত শরীরের অধিকারী ওয়াশরুমে ঢুকতেই মেঘার হুঁশ ফিরল। পেটে খিদে অনুভব হতেই ফ্রেশ হয়ে নিচে নামলো।

জানো আজকে তোমরা দুজনতো ছিলে না। আমি বাজারে গিয়েছিলাম। সার্ভেন্টদের বলিনি আমি নিজেই গিয়েছিলাম। বাজারের ব্যাগ দুটো বেশ ভারীই ছিলো আমারও কষ্ট হচ্ছিল নিয়ে আসতে। এমন সময় দেখি একটা গাড়ী আমার পাশে এসে থামলো আর দেখি যে গাড়ি চালাচ্ছে সে আমাকে বলছে, “আন্টি এই রোদে গরমে এতো ভারী ব্যাগ নিয়ে হাঁটছেন কেনো?” আমি বললাম, “গাড়ি পাইনি”। ছেলেটি আবার বলল, “আমি আপনাকে বাড়ি পৌঁছে দিচ্ছি। আমার গাড়িতে উঠুন”। আমি না করা সত্ত্বেও ছেলেটি শুনলো না। আমি ঠিকানা বলতেই সেও বললো ওরও নাকি ওখানেই বাড়ি। আমি ওর নাম জিজ্ঞ্যেস করলাম বললো ইয়াসির আরাফাত। আমাদের ডান পাশের বাড়িটা ওর। কতো করে বললাম কিছু খেয়ে যেতে কিছুতেই শুনলো না। ব্যাগ দুটো ভেতরে দিয়ে যাওয়ার সময় বললো, “আন্টি একটু ইম্পর্ট্যান্ট ফাইল নিতে বাড়িতে এসেছিলাম মিটিং আছে তাই দেরী করা ঠিক হবে না”। আমি বললাম,। “তুমি কখন বাড়ীতে ফিরবে?” সে বললো রাত্রি আটটায়। আমিও বললাম তাহলে তোমার জন্য রান্না পাঠাবো। এখনকার যুগে এমন ছেলে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। কতো মানবিক ছেলেটা। আর তোমার মেয়ে তো ঘর কুনো ব্যাঙ।

ওহ তাহলে আমার সঙ্গেও কোনো একদিন দেখা করিয়ে দিও।

মেঘা শুধুমাত্র শেষের দুটো লাইন শুনতে পেলো। “কতো মানবিক ছেলেটা। আর তোমার মেয়ে তো ঘর কুনো ব্যাঙ”।

মা খেতে দাও।

মেঘাকে খেতে দাও। আমি রুমে গেলাম।

টেবিলে বেড়ে দিয়েছি খেয়ে নে আর পাশের বাড়ীতে গিয়ে আরাফাতকে এই টিফিন বক্সগুলো দিয়ে আসবি। আমার বাতের ব্যথাটা বেড়েছে নাহলে আমিই যেতাম আর তোর বাবা রুমে চলে গেছে।

মা আমি কি তাকে চিনি?

না চিনলেও গিয়ে চিনে নিবি। ডানদিকের বাড়িটা ইয়াসির আরাফাতের।

ওই লোকটার নাম ইয়াসির আরাফাত?

হ্যাঁ। এবার তুই তাড়াতাড়ি খেয়ে ওকে খাবারগুলো দিয়ে আয়।

মেঘা মুখ ভার করে বললো, ঠিক আছে।

মেঘা তিনটে টিফিন বক্স একটা ব্যাগের ভেতরে নিয়ে ইয়াসির আরাফাতের বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালো। বডি গার্ডগুলোও ওকে কোনো বাঁধা দিলো না। ও ভেতরে ঢুকে দেখলো যুবকটি সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামছে আর একটা রক্তাত্ব মানুষকে টেনে টেনে নিয়ে আসছে। আহত লোকটির রক্তে সিঁড়িগুলোও রাঙা হয়ে যাচ্ছে। এই দৃশ্য দেখে মেঘা চিৎকার করে ওখানেই সেন্সলেস হয়ে গেল। মেঘার চিৎকারে ইয়াসিরের হুঁশ ফিরল। রাগে মুখটা লালবর্ণ ধারণ করেছে। আহত লোকটাকে ওখানে রেখে মেঘার কাছে ছুটে গেলো ও। মেঘাকে কোলে তুলে নিজের রুমে নিয়ে গেল ইয়াসির। বেডে শুইয়ে দিয়ে নীচে এসে গলা চড়িয়ে কয়েকটা গার্ডকে ডেকে পাঠালো।

একে জীবিত পুঁতে দিয়ে আয় আর বাড়িটা দশ মিনিটের মধ্যে পরিষ্কার চাই।

ওকে স্যার।

ইয়াসির নিজের রুমে গিয়ে মেঘার পাশে বসলো। বেশ কিছুক্ষন ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলো। দুধে আলতা গায়ের রঙ পাতলা গোলাপি রঙের দুটি ঠোঁট ঘন কালো চুল সবমিলিয়ে এক অনন্য সৌন্দর্যের অধিকারী। কাঁটায় কাঁটায় ঠিক দশ মিনিট পেরিয়ে গেলে মেঘার মুখে জলের ঝাপটা দিলো সে। চোখ মুখ কুঁচকে পিটপিট করে তাকালো। ইয়াসিরকে ওর পাশে বসে থাকতে দেখে হুড়মুড় করে উঠে পড়লো মেঘা।

আ আ আপপননি মা মানুষ খুখখুন ককককরেন।

কি দেখে তোমার মনে হলো।

ওই লোকটাকে

রিলাক্স। তুমি হয়তো আজকাল একটু বেশিই মুভি দেখছো তাই তো ওসব উল্টোপাল্টা চিন্তাভাবনা আসছে তোমার মাথায়।

বাজে কথা বলবেন না। আপনি একটা খুনি।

ইয়াসির ওর দিকে এগিয়ে এলো।

আপনি এগিয়ে আসছেন কেনো?

ইয়াসির ওকে কোলে তুলে নিলো। নীচে নামার জন্য হাত পা ছোড়াছুড়ি করছে মেঘা।

যখন সেন্সলেস হয়েছিলে তখন এইভাবেই কোলে তুলে নিয়ে এসেছিলাম আমার রুমে।

এখন তো সেন্সলেস নই আমি। নীচে নামান আমাকে ইয়াসির সাহেব।

ইয়াসির ওকে নীচে নামিয়ে দিল। মেঘা হাঁটতে গিয়ে পড়ে যেতে যাচ্ছিল ইয়াসির ওকে ধরে ফেললো আর আবারও কোলে তুলে নিলো। মেঘার বাড়ির সামনে গিয়ে কলিং বেল বাজালো। ওর মা এসে দরজা খুলে দেখলো মেঘা ইয়াসিরের কোলে।

কি হয়েছে ওর?

মাথা ঘুরে পড়ে গিয়ে পায়ে চোট পেয়েছে। ওর রুমটা দেখিয়ে দিন আমি রেখে আসছি। কটা দিন রেস্ট নিতে বলুন ঠিক হয়ে যাবে। আমি মেডিসিন লাগিয়ে দিয়েছি।

মেঘার মা ইয়াসিরকে মেঘার রুমটা দেখিয়ে দিলেন। ইয়াসির ওকে বেডে শুইয়ে দিয়ে বললো,,,

রেস্ট নিতে যেনো দেখি দুটো দিন।

নাহলে কি করবেন?

ইয়াসির ওর দিকে এগিয়ে এলো।

হ্যাঁ হ্যাঁ মনে থাকবে।

ইয়াসির চলে গেল। মেঘা ডায়েরি নিয়ে বসলো।

যখনই মেঘা চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর চেষ্টা করেছে তখনই ওর চোখের সামনে ইয়াসিরের ওই লোকটাকে সিঁড়ি দিয়ে টেনে টেনে নিচে নামানোর দৃশ্যটা ভেসে উঠছে।

আপনি খুব খারাপ ইয়াসির সাহেব খুব খারাপ। একটা মানুষকে মারতে আপনার হাত কাঁপে না। আপনি একটা পাষাণ হৃদয়ের অধিকারী। আমি আর কোনোদিনও আপনার মুখ দেখতে চাই না। আই হেট ইউ ইয়াসির আরাফাত।

সারারাত বহু চেষ্টা করেও ঘুমোতে পারলো না মেঘা। কোনরকমে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে জানালার কাছে গিয়ে জানলাটা লাগিয়ে দিল মেঘা।

এবার অন্তত ওই পাষাণ লোকটার মুখোমুখি হতে হবে না। উফ্ বাবা বাঁচলাম।

ইয়াসিরের পুরো ঘর মেয়েলি গন্ধে ছেয়ে আছে। প্রতিটা প্রশ্বাসে ও মেঘার শরীরের মিষ্টি গন্ধটা অনুভব করছে। সারারাত আর দুই চোখের পাতা এক করতে পারলো না ইয়াসির। সার্ভেন্টকে ডেকে এককাপ ব্ল্যাক কফি অর্ডার দিয়ে লাইব্রেরীতে চলে গেল সে।

সকাল বেলা রুমে রেডী হতে এসে দেখলো মেঘার ঘরের জানালাটা বন্ধ। চটজলদি রেডী হয়ে ব্রেকফাস্ট করে অফিসের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লো আরাফাত। মেঘা সারারাত ঘুমোতে না পারায় এখন একটু চোখ বুজলো। আজকে আর কলেজে গেলো না। পায়ের ব্যাথাটা অনেকটাই কমে গেছে মেঘার। ঘুম থেকে উঠে দেখলো বেলা বারোটা বেজে গেছে। তাই তাড়াতাড়ি উঠে ফ্রেশ হয়ে লাঞ্চ করে নিলো। আবার রুমে গিয়ে বইপত্র নিয়ে বসলো।

নিজেকে শিক্ষিত করতে চাইলে বই পড় মেঘা। তুই উজ্জ্বল ভবিষ্যতের দেখা পাবি।

নিজের মনে বিরবিরিয়ে কথাগুলো বলে পড়াশোনায় মনোযোগ দিলো। টানা পাঁচ ঘণ্টা পড়ার পর সন্ধ্যে সাড়ে সাতটায় আবারও রুমের জানালাটা লাগিয়ে দিল।

রাত্রি আটটায় বাড়ীতে এসে সকালের মত এখনও মেঘার রুমের জানালাটা বন্ধ দেখলো আরাফাত। তারওপর মেঘার শরীরের ঘ্রাণটা তীব্র ভাবে ওর মস্তিষ্কে আঘাত করছিলো। ফ্রেশ হয়ে ডিনার করে রুমে এসে পায়চারি করতে শুরু করলো আরাফাত।

মেঘা ডায়েরির পাতায় আজকের দিনের খুঁটিনাটি ঘটনাগুলো সঁপে দিলো। তারপর ঘুমিয়ে গেলো।

গভীর রাত, মেঘা ঘুমের অতল গহ্বরে তলিয়ে গেছে। ও অনুভব করলো ওর মুখের ওপর কারও গরম নিশ্বাস পড়ছে।

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here