তুমি_কেনো_এলে_জানিনা_এখনও #নবম_পর্ব

0
782

#তুমি_কেনো_এলে_জানিনা_এখনও
#নবম_পর্ব
#লেখনীতে_সুহানা_সুলতানা

একটাও কথা বলবেন না। চুপচাপ যেমন শুয়ে আছেন তেমন থাকুন।

কিছুক্ষণের মধ্যেই পরম আবেশে চোখ জোড়া বন্ধ হয়ে এলো ইয়াসিরের। মেঘা ওর কপালে ঠোঁট ছুঁয়ে দিয়ে সাবধানে ইয়াসিরের মাথাটা বালিশে রাখলো যাতে ওর ঘুম না ভেঙে যায়। তারপর ইয়াসিরের পাশে শুয়ে পড়লো।

ইয়াসির সাহেব?

বল মেঘ।

আমাকে আমার মায়ের কবরের কাছে নিয়ে যেতে পারবেন। মাকে তো আমার স্মৃতিতে ঠাঁই দিতে পারিনি। ছোটবেলার মস্তিষ্কও আমার মায়ের চেহারা, স্মৃতিগুলো ধরে রাখতে পারেনি। নিয়ে যাবেন আমাকে?

চটপট রেডী হয়ে নাও। আমি গাড়িতে ওয়েট করছি।

কথাটা বলেই মেঘার চোখের জল মুছিয়ে দিলো ইয়াসির। তারপর নীচে চলে গেল।

মেঘা ওর মায়ের কবরের ওপর ডান হাতটা স্পর্শ করালো। ওর দুই চোখ বেয়ে অশ্রুবিন্দু গড়িয়ে পড়ছে। বেশ কিছুক্ষণ সময় ওখানে থেকে ওরা ফিরে এলো।

মাঝে অতিবাহিত হয়ে গেছে ছয়টি মাস। সময় যেন জলের মতো প্রবাহিত হচ্ছে। ইয়াসির আর মেঘার খুনশুটিময় ভালোবাসার দিনগুলোও খুব তাড়াতাড়ি কেটে যাচ্ছে।

অসময়ের বৃষ্টির পড়ে আজকের সকালটা হাজির হয়েছে মেঘা আর ইয়াসির ব্রেকফাস্ট করতে বসেছে। হঠাৎই মেঘা ডাইনিং থেকে কিছুটা দূরে থাকা বেসিনে গিয়ে বমি করে দিলো। ইয়াসির দ্রুত ওর কাছে গেলো। বমি করার পর মেঘার শরীরটা নেতিয়ে পড়ল। ইয়াসিরের ওপর নিজের সমস্ত শরীরটা এলিয়ে দিলো মেঘা। ইয়াসির ওকে কোলে তুলে নিয়ে সোফায় এসে বসলো। মেঘা মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো,,,

খুব বেশি খারাপ লাগছে মেঘ?

মেঘা দুই পাশে মাথা নাড়িয়ে না বোঝালো।

হসপিটালে যেতে হবে।

মেঘা দূর্বল স্বরে বলে উঠলো,,,

কেনো?

তোমার চেকাপের জন্য।

কথাটা বলেই ইয়াসির মেঘাকে কোলে তুলে নিয়ে গাড়িতে বসিয়ে দিল।

রিপোর্ট কার্ড হাতে পেয়ে মেঘার চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ল। ইয়াসিরের চোখ জোড়াও ছলছল করে উঠলো। দিকবিদিক খেয়াল না করেই ইয়াসির মেঘাকে কোলে তুলে নিলো। মেঘাও অশ্রুসজল চোখে ইয়াসিরের গলা জড়িয়ে ধরলো।

তুমি পৃথিবীর সমস্ত খুশি আমার কাছে এনে দিয়েছো মেঘ। আমাকে বাবা হওয়ার সুখবর দিয়েছো।

মেঘা ইয়াসিরের বুকে মুখ গুঁজলো। বাড়িতে এসে মেঘাকে কোনো কাজ করতে দিলো না ইয়াসির। অফিস ও গেলো না। সায়নকে সামলে নিতে বললো। সন্ধ্যেবেলা ইয়াসির একটা গোল্ডেন পাড় সাদা শাড়ি মেঘার হাতে দিয়ে বললো,,,

শুভ্রতায় ঘেরা মেঘকে দেখতে চাই।

মেঘা মুচকি হেসে শাড়িটা পড়ে তৈরী হয়ে গেলো। ইয়াসিরও গোল্ডেন কারুকার্যের সাদা পাঞ্জাবি জড়িয়েছে গায়ে। ধীর পায়ে ঘরে ঢুকে মেঘাকে দেখে থমকে গেল ইয়াসির। তারপর মেঘাকে কোলে তুলে নিয়ে ছাদে গেলো। চারিদিকে ব্লু ডেকোরেশন করা হয়েছে। নীলের মাঝে ওদের দুজনকে সাদা মেঘের টুকরোর মতো দেখাচ্ছে। ইয়াসিরের কোম্পানির লোকজন উপস্থিত রয়েছেন। মেঘা ওদেরকে দেখে ইয়াসির কোল থেকে নেমে যেতে চাইলো কিন্তু ইয়াসির পাত্তা দিলো না।

মাইকে অ্যানাউন্স করে দিলো সবাইকে পার্টি এনজয় করার জন্য।

মাঝে অতিবাহিত হয়েছে আরও কয়েকমাস। মেঘার আটমাস চলছে। প্রতিদিন ইয়াসিরের কাছে হাজারো নতুন বায়না করে। ইয়াসিরও হাসিমুখে ওর সব বায়না পূরণ করে।

এই শোননা।

কি হয়েছে মেঘ?

ইয়াসির কিছুক্ষন আগেই ঘুমিয়ে পড়েছিলো। এখন রাত্রি দুটো বাজে। তাই ঘুম ঘুম কণ্ঠেই বলে উঠলো।

আইসক্রিম খেতে ইচ্ছে করছে। বাটারস্কচ ফ্লেভারের। দাওনা এনে।

এতো রাতে আইসক্রিম খাওয়া ঠিক হবে না। কালকে দেবো। এখন ঘুমাও।

তুমি এনে দেবে না তাই তো?

আচ্ছা আমি নিয়ে আসছি। এখানেই বসে থাকবে।

ইয়াসির খুবই অল্প পরিমাণ আইসক্রিম নিয়ে এলো। মেঘা মাঝে মাঝেই এটা সেটার বায়না করে তার মধ্যে আইসক্রিমটাও বাতিক্রম নয়। তাই ফ্রীজে রাখা ছিল। আইসক্রিম নিয়ে আসা বাটিটা ইয়াসির মেঘার হাতে দিলো। মেঘা একচামচ মুখে দিয়েই বললো,,,

তুমি খাবে একটু?

নাহ্ তুমিই খাও।

এইবার ঘুমাবে তো?

হ্যাঁ ঘুম পাচ্ছে এবার। মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দাও না।

ইয়াসির মেঘার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। মেঘা চোখদুটো বন্ধ করে নিলো পরম আবেশে। ইয়াসির ভাবলো হয়তো মেঘা ঘুমিয়ে গেছে। তাই ও পাশে শুয়ে পড়তে গেলো এমন সময় মেঘা চোখ খুলে তাকিয়ে বললো,,,

এই তোমার মোবাইলটা দাও তো।

তুমি ঘুমোওনি?

আরে ঘুম চলে এসেছিল কিন্তু আমার এখন ফটো তুলতে ইচ্ছে করছে।

ইয়াসির ওর মোবাইলটা মেঘার হাতে দিলো। মেঘা ভিন্ন ভিন্ন ভঙ্গিমায় ইয়াসিরের সঙ্গে কাপল পিক তুললো। কিছুক্ষন পর ক্লান্ত হয়ে বেডে এসে শুয়ে পড়লো। এবার কিছুক্ষণের মধ্যে ঘুমিয়েও গেলো। ইয়াসিরও ওর পাশে শুয়ে পড়লো।

স্যার ডক্টরের অপয়েনমেন্ট কনফার্ম হয়ে গেছে স্যার। আজকে দুপুর তিনটের সময় ডক্টরের চেম্বারে নিয়ে যাবেন।

ধন্যবাদ।

ইয়াসির কল রেখে দিলো।

মেঘ আজকে ডক্টরের কাছে যেতে হবে চেকআপের জন্য।

কখন?

মিষ্টি খেতে খেতে বলে উঠলো মেঘা।

তিনটের সময়।

ওহ। এইদিকে এসো আমার কাছে।

ইয়াসির মেঘার কাছে এগিয়ে গেলো।

চোখদুটো বন্ধ করো।

কেনো?

আরে করোই না ইয়াসির সাহেব।

ইয়াসির মেঘার কথামতো চোখ বন্ধ করলো। মেঘাও সেই সুযোগে ইয়াসিরের মুখে মিষ্টি ঢুকিয়ে দিলো। মুখে মিষ্টির অস্তিত্ব টের পেতেই ইয়াসিরের মুখটা বিকৃত হয়ে গেলো। মেঘা শব্দ করে হেসে উঠলো।

তুমি খাবে। খেতেই হবে তোমাকে। একদম ফেলবে না মুখ থেকে।

ইয়াসির কোনো রকমে গিলে নিলো। এক গ্লাস জল এক নিঃশ্বাসে গলাধঃকরণ করলো।

তুমি দিনদিন বদমাইশ হচ্ছো মেঘ। তুমি জানো আমি মিষ্টি পছন্দ করি না তাই খাওয়াও ছেড়ে দিয়েছি আর তুমি এইভাবে খাওয়াবে?

আমার ভালো লেগেছে খেতে। তাই তোমাকেও টেস্ট করাতে চাইলাম। তুমি কি রাগ করলে?

না না রাগ করিনি আমি।

ইয়াসির মেঘার কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিয়ে বলে উঠলো,,,

তোমার ওপর রাগ করার ক্ষমতা আমার নেই মেঘ। তবে তোমার জায়গায় অন্য কেউ থাকলে তার অবস্থা দেখার মতো থাকতো না। চলো রেডি হয়ে নাও। ডক্টরের কাছে যেতে হবে।

মেঘা দোলনায় বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। সূর্য অস্ত যাবো যাবো করছে। পুরো আকাশটা লালচে কমলা আবরণে ছেয়ে আছে। প্রকৃতি নিজের রূপে সেজে উঠেছে। রিপোর্টও ভালোই এসেছে। মেঘাকে বাড়ীতে রেখে ইয়াসির অফিসের গুরুত্বপূর্ণ কাজে গেছে। মেঘা মনোযোগ সহকারে প্রকৃতি অনুধাবনে ব্যাস্ত ছিলো তখনই ওর মুখের সামনে কিছুর অস্তিত্ব টের পেল। পাশে তাকিয়ে দেখলো ইয়াসির ওর সামনে একহাতে ফলের প্লেট আর অন্য হাতে চামচে ফল নিয়ে মেঘার মুখের সামনে ধরে রেখেছে। মেঘা আলতো হেসে ফলের টুকরোটা মুখে নিয়ে দুই হাত দিয়ে ইয়াসিরের কোমড় জড়িয়ে ধরে মাথা এলিয়ে দিল। ইয়াসির ওর কাজে মুচকি হাসলো।

এতো তাড়াতাড়ি চলে এলেন যে?

আমার বউটা একা ছিলো তাই তাড়াতাড়ি চলে এসেছি।

ইয়াসির ফলের প্লেটটা পাশের ছোটো টেবিলে রেখে মেঘার হাত ছাড়িয়ে মেঘার সামনে হাঁটু মুড়ে বসে পড়লো। মেঘার ফুলে যাওয়া পেটের অংশে পরম আদরে হাত বুলিয়ে দিয়ে বেশ সময় নিয়ে ঠোঁট ছুঁইয়ে রাখলো। মেঘা খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো।

বোকার মতো হাসছো কেনো?

সুড়সুড়ি লাগছে।

আবারও হেসে উঠলো মেঘা।

আজকে কি নতুন নাকি?

না। তবুও হাসি পাচ্ছে।

ইয়াসির ফলের প্লেটটা ওর হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল,,,

মিসেস মেঘ তাড়াতাড়ি এইগুলো শেষ করুন।

ইয়াসির ওর পাশে বসে আছে। মেঘা ওর বুকে মাথা রেখে ফলগুলো খাচ্ছে।

চলো মাথায় তেল দিয়ে দেবো।

আর একটু থাকি না এখানে। দেখো কি সুন্দর লাগছে আকাশটা।

আর একটুও না। তাড়াতাড়ি চলো মেঘ।

ইয়াসির মেঘার মাথায় তেল দিয়ে দিচ্ছে। আরাম পাওয়ায় মেঘার চোখদুটো বন্ধ হয়ে আসছে। তেল দেওয়ার পর চুলগুলো বেণী করে দিলো ইয়াসির। মেঘার কাছ থেকে শিখে নিয়েছিল কিভাবে করতে হয়। প্রথম প্রথম না করতে পারলেও এখন পারফেক্টভাবে করতে পারে। বেণী করার পর ইয়াসির মেঘার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলো মেঘা চোখদুটি খোলা রাখতে পারছে না। তাই বালিশে শুইয়ে দিলো। মেঘার পাশে বসে মেঘার ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। মেঘার কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিয়ে ল্যাপটপ নিয়ে বসলো। অফিসের বেশ কিছু মেইল পেন্ডিং অবস্থায় আছে সেগুলোই চেক করতে শুরু করলো আর সার্ভেন্টকে উইদাউট সুগার এক কাপ কফি দিয়ে যেতে বললো। এর মধ্যে বেবী শাওয়ারেরও প্ল্যানিং করে ফেললো।

রুমসংলগ্ন ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে একদৃষ্টে মেঘলা বর্ষণরত আকাশের দিকে চেয়ে আছে ইয়াসির। পেছন থেকে দুটো হাত এসে ওকে আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরলো।

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here