খুঁত- শেষ পর্ব

0
1116

#খুঁত- শেষ পর্ব
#স্পৃহা_নূর

সব কিছুর পরিবর্তন এলো প্রায় দেড় মাস পর আয়েশার যখন সে জানতে পারলো সে আর একা নেই। তার মাঝে আসিফের ছোট্ট একটা অস্তিত্ব বেড়ে উঠছে।
আয়েশা কেমন চুপচাপ হয়ে গেলো। মাঝে মধ্যে অজ্ঞানও হয়ে পড়ে। সে মনে মনে আসিফকে প্রায়ই একটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে সে,
” আমাদের বেবি কোন খুঁত নিয়ে জন্মালে কি করবেন আসিফ? ওকে রাখবেন না? নাকি মেরে ফেলবেন?”

এই একটা পরিস্থিতি দুটো পরিবারের পরিস্থিতি সম্পূর্ণ বদলে দিলো। আর যাই হোক এ অবস্থায় কোন মুসলিম পরিবারে ডিভোর্স তো আর সম্ভব নয়। এদিকে আয়েশার ডিভোর্সের ব্যাপারে কী মত সে ব্যাপারেও সে মুখ ফুটে কিছু বলেও নি। আয়েশার বাবা নেই। অভিভাবক বলতে এখন মা আর বড় বোন আশা। যা সিদ্ধান্ত নেবার তাদেরই হয়ত নিতে হবেতার যে মেয়েটা বড্ড চাপা স্বভাবের। এই চাপা স্বভাবের জন্যই এত দিন আসিফের ব্যাপারে বাড়িতেও কিছু বলে নি। তবে আয়েশার মায়ের মাঝে মাঝে মনে হয় এই সমাজে মেয়েদের ‘ ডিভোর্স’ মানেই তো সব চেয়ে বড় খুঁত। কথায় কথায় শুনতে হয় ডিভোর্সি, সংসার করার মুরোদ নেই আরও কত কি! বাচ্চা সমেত ডিভোর্সি মেয়েটার না জানি আবার কত কথা শুনতে হয়। কিন্তু কথার চেয়ে মেয়ের শান্তিপূর্ণ জীবন অবশ্যই বেশি দামী। কিন্তু এসব কথা কানে এলে আয়েশা আসলেই ভালো থাকতে পারবে তো? আর বাবা ছাড়া বাচ্চাটারই বা কি হবে! এই সমাজে ছেলেদের খুঁতগুলো খুব ছোট, শিশির বিন্দুর চেয়েও ছোট কিন্তু মেয়েদের খুঁতগুলো হিমালয়ের চেয়েও বড়।

দুই পরিবার মিলে যদি কিছু একটা সুরাহা করা যায়! বড় মেয়ে আশার সাথে আলোচনা করলেন তিনি। আশার স্বামী রেদোয়ানেও এই বিষয়ে এক মত। হুটকারিতে হয়ত কোন সিদ্ধান্ত নেয়া ঠিক হবে না। সমস্যাটা যেহেতু আসিফের ওর সাথে আলাদা ভাবে কথা বলা উচিত।
তবে আয়েশা এসব শোনার পর স্পষ্ট ভাবে বলল, ” আমি চাই না,বেবি পৃথিবীতে আসার আগ পর্যন্ত৷ কারো সাথে কোন সিদ্ধান্তের ব্যাপারে কোন কথা হোক। সেটা বেবির বাবা হোক বা অন্য কেউ। ”
আয়েশা এই জেদে নাওয়া খাওয়া ছাড়ল। আসিফ যেন কিছু না জানে তার বাচ্চার ব্যাপারে।বাচ্চাটা আসিফের মনের মতো না হলে আসিফ হয়ত শেষ পর্যন্ত বাচ্চাটাকেই মেরেই ফেলবে এই ভয় আয়েশার মনের ভেতর কেমন করে যেন ঢুকে গেল। বাড়ির সবাই বাধ্য হয়ে আসিফদের বাড়িতে আপাতত কিছু জানালো না। তারা ভাবলো আয়েশা হয়ত কিছু দিন পর নিজেকে সামলে নেবে তখন বলা যাবে সব কিছু। আসিফ বেশ কিছু দিন আয়েশাকে ফিরিয়ে নেবার জন্য এলেও শেষ দিকে আয়েশা যখন রুমের দরজা পর্যন্ত খুলতো না তারপর থেকে আসিফও আসা বন্ধ করে দিলো এক সময়।
সে এতটা ছোট হয় নি কখনো। রাগের মাথায় একটা ভুল হয়েই গেছে। গায়ে একটা হাত উঠেই গেছে। তার জন্য আয়েশার এতটা করা বাড়াবাড়ি মনে হলো আসিফের। প্রচন্ড রাগ হয় তার। আয়েশাকে ছাড়া এত দিন তো দিব্যি চলত তার। তবে এখন ক্রন চলবে না? জীবন কি কারো জন্য থেমে থাকে নাকি?

কিন্তু জীবন একেবারে থেমে না গেলেও কিছুটা তো থমকে গেলো তার। প্রথম প্রথম খুব রাগ হলো আয়েশার ওপর। কিন্তু দিন যত গড়াতে থাকলো আয়েশার শূন্যতা তাকে অন্ধকারের মতো গ্রাস করতে শুরু করল। আফিস থেকে ক্লান্ত শরীরে ফেরার পর কেউ আর হাসিমুখে দরজা খোলে না, কেউ তার ফেরার অপেক্ষায় থাকে না, কেউ দিনে একবারও টেক্সট করে না, কখন ফিরবেন? দুপুরে খেয়েছেন তো? আজ একটু তাড়াতাড়ি ফিরতে পারবেন? আফিসে না খেয়ে গেলে কেউ জোরটুকু করে না অন্তত একবার খাবার মুখে তোলার জন্য।
সারাদিনের গল্পগুলো করার মতো অন্ধকার ঘরে যখন কাউকে পায় না আসিফ বেলকনিতে গিয়ে সিগারেট ধরায়। বেলকনিতে দাঁড়িয়ে রাস্তার ব্যাস্ত মানুষগুলোকে দেখে, মানুষগুলোর বাড়ি ফেরার কত তাড়া, সবার জন্যই হয়ত বাড়িতে কেউ আছে আপেক্ষা করে। কিন্তু তার আর এখন কোন তাড়া নেই। কেন তাড়া থাকবে? কেউ কি অপেক্ষা করে নাকি? ইদানিং সিগারেট একটু বেশিই খাওয়া হচ্ছে। চাকরি হবার পর এই অভ্যাসটা একদমই ছেড়ে দিয়েছিলো। কিন্তু আয়েশা চলে যাবার পর আবার কি করে যেন অভ্যাসটা আবার শুরু হলো।

মাঝে মধ্যে একেবারেই সহ্য না হলে বড় ভাইয়ার বাড়ি যায়। ভাইয়া নেই। কিন্তু ভাবি আর মা সেখানে আছে। ভাবি চাকরি করে, মা বাচ্চাদের দেখাশুনা করে। ভাইয়ের দুই মেয়ের সাথে গল্পগুজব করে যতক্ষণ, ততক্ষন বেশ ভালো সময় কাটে আসিফের। কিন্তু বাড়ি ফিরে আবার রাজ্যের নিরবতা। কেউ নেই,কোথাও নেই।
আসিফের মা ছেলেকে প্রায়ই বলে, ” আমি না হয় যাই,তোর শশুর বাড়িতে। আয়েশা শান্ত মেয়ে বোঝালে বুঝবে। ফিরে আসবে হয়ত। এভাবে কত দিন থাকবি? আর তোর সাথে একেবারেই থাকতে না চাইলে ওরা সেটাও বলুক। তুই ওই মেয়েকে ছেড়ে দিয়ে নতুন কিছু শুরু করতে চাইলে কর। ”
” সব তো শেষ, আবার কি শুরু করব? সে তার মতো ভালো থাকলে, আমিও আমার মতো ভালো আছি।” ____________
আসিফের এই আভিমান কাটল। সেদিন সন্ধ্যায় যখন হসপিটালে প্রায় মাস পাঁচেক পর আয়েশার সাথে তার দেখা হলো। আসিফের মায়ের শরীর বেশ কিছু দিন ধরে ভালো যাচ্ছিলো না। মাকে চেকআপের জন্য যখন ওয়েটিং রুমে অপেক্ষা করছিলো। হঠাৎই চোখ পড়লো আয়েশা তার বোনের সাথে পাশের ডক্টরের চেম্বার থেকে বেরোচ্ছে । ওর দিকে চোখ পড়তেই আসিফ অদ্ভুত এক মন্ত্রাবেশে উঠে দাঁড়ালো। ঘোর লেগে গেছে যেন। মনে হচ্ছে কত শত যুগ পরে জলাধারের সন্ধান পেলো চাতক।
আসিফ কিছুক্ষন ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো। পা উঠতে চাইছে না। আয়েশার তার হাতে কিছু ফাইল গোছাতে ব্যস্ত। সম্ভবত প্রেসক্রিপশন, কিছু টেস্টের রিপোর্ট এগুলো। আয়েশার বেশ পরিবর্তন এসেছে মাত্র কয়েক মাসেই৷ ওজন বাড়ার জন্য অদ্ভুত রকম সৌন্দর্যের আভা ঠিকড়ে পড়ছে যেন। বলা হয়, প্রেগন্যান্সির সময় যে কোন মেয়ের মাঝেই স্বর্গীয় এক আভা দিয়ে দেন সৃষ্টিকর্তা।
আসিফ কাঁপা কাঁপা গলায় ডাকল, ” আয়েশা।”
আয়েশা পিছু ফিরে তাকিয়ে দেখলো আসিফ দাঁড়িয়ে। আয়েশাকে দেখে সম্ভবত হালকা কাঁপছে, জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে। আয়েশা কিছু বলার আগেই আসিফ আবার বলল,
” গায়নোকলিজিস্টের কাছে কেন তুমি? কে অসুস্থ? আপা নাকি তুমি? ”
উওরের অপেক্ষা না করেই আসিফ শস্যব্যাস্ত হয়ে আয়েশার হাত থেকে ফাইলগুলো নিলো। উলটে পালটে দেখবার পর আসিফের হাত থরথর করে কাপতে শুরু করলো৷ কাপা কাপা গলায় বলল,
” আমায় জানানোর প্রয়োজনটুকু বোধ করলে না? আমি বাচ্চার বাবা আয়েশা ওর প্রতি আমার অধিকার আছে !” আসিফ মূহুর্তেই চেঁচিয়ে উঠলো। ওয়েটিং রুমে থাকা সবাই অবাক হয়ে ওদের দিকেই তাকালো।
আয়েশা শান্ত ভাবে বলল,” আস্তে কথা বলুন। বেবি ভয় পাবে। সে জানে না তার বাবা কেমন। তাকে আমি তার বাবার গল্প বলি না। ও খুব ছোট, এত চেচামেচিতে ভয় পাবে।।”
আসিফের চোখে বিন্দু বিন্দু পানি জমতে শুরু করেছে। আয়েশার হাত টেনে ধরে বলল,” বাড়ি চলো আয়েশা।”
আয়েশা উত্তর দিলো না। আয়েশার বোন আসিফকে বলল তাদের সাথে আয়েশার বাবার বাড়ি যেতে। হসপিটালে তো সব কথা সম্ভব নয়। বাড়ি গিয়ে কথা বলতে চায় তারা। দুই ফ্যামিলি এক সাথে।
সেদিন রাতেই দু ফ্যামিলি বসলো। আসিফ কেমন কয়েক মূহুর্তেই হুট করে ভীষণ রকম ভেঙে পড়েছে। ওর ভাবি আর মা দুজনেই আয়েশাকে তার ফ্যামিলির অন্যদের বোঝানোর চেষ্টা করছে আয়েশা যেন ফিরে যায়। আয়েশার ঘুরে ফিরে একটাই কথা, ” বেবি তার বাবাকে ভয় পাবে সেখানে গেলে৷ ”
তারপর বলল, “বাচ্চা যদি আসিফের পছন্দ মতো না হয় তাহলে কি আসিফ বাচ্চাকে মেরে ফেলবে? সেটা আগে ওকে বলতে বলুন।”
” আর ইউ ক্রেইজি? ” আসিফ উঠে দাঁড়িয়ে চেচাতে শুরু করল,
“আমি আমার নিজের বাচ্চাকে কেন মারবো? বাবা মায়ের কাছে নিজের সন্তান কখনো অপছন্দের হয়? আমার বেবি আমার পছন্দ হবে না কেন?”

আয়েশার দুলাভাই আসিফকে থামিয়ে বলল,” দ্যাখো আসিফ তোমার এই মাত্রাতিরিক্ত রাগের জন্যই কিন্তু আজ এ অবস্থা। আয়েশা যে নিজের সেন্সে এসব বলছে না তা বুঝতে পারছ না? মেয়েটা তোমাকে ভয় পেতে পেতে মেন্টালি ডিস্টার্ব হয়ে গেছে।একদিনে নিশ্চই এমন হয় নি৷ দিনের পর দিনেই এমন হয়েছে। নিজেকে না শোধরালে দিন হয়ত আরো খারাপ আসতে পারে।”
আয়েশা শান্ত ভাবে সোফায় বসে আছে তখনও। আসিফ ওর দিকে এক বার তাকালো। এগিয়ে গিয়ে হাটু গেড়ে বসে ওর কোলে মুখ গুজে ডুকরে কেঁদে উঠলো। বলল,” বাড়ি চলো আয়েশা। কথা দিচ্ছি বেবির কিছু করব না। আমি তো তার বাবা নাকি?আমি ওকে কেন কিছু করতে যাব? ”
আয়েশা বলল,” প্লিজ ছাড়ুন তো। বেবি ব্যাথা পাবে।”
আয়েশার বড় বোন আশা বলল,” দ্যাখো আসিফ সোজাসুজি বলি, বাচ্চাটা পেটে না আসলে আমরা অনেক আগেই তোমাদের ডিভোর্স করাতাম। ডিভোর্স এর সিদ্ধন্ত নিয়েও ফেলেছিলাম। এখন পরিস্থিতি অন্য। বাচ্চাটা হতে দাও। তারপর তুমি বা আয়েশা চাইলে ডিভোর্স করানো যাবে। আমরা আমাদের মেয়েকে আর অসুস্থ দেখতে পারব না। পাগল করে দিয়েছো, আর কি চাও?”
আসিফ রেগে গিয়ে বলল,” ডিভোর্স করানোর আপনারা কারা? আমরা দুজন নিয়েছি এমন কোন সিদ্ধান্ত? অয়েশা কিছু বলেছে এ ব্যাপারে? নাকি আমি বলেছি? আপনারা আমার সংসারটা জোড়ার বদলে ভাঙার জন্য কেন উস্কে দিচ্ছেন?”
” ভাংতে তো আপনিই চাইতেন। এখন সবাই আপনার চাওয়াটাই পূর্ণ করতে চাইছে।”আয়েশা উত্তর দিলো।
আসিফ অবাক হয়ে তাকালো। বলল,”আমি কখন এসব চেয়েছি?”
” বিয়ের দিন থেকেই।”
” তুমি আমার রাগের মাথায় বলা কথাগুলোকে সিরিয়াসলি নিয়ে ফেলেছো? তুমি জানো না রেগে গেলে আমার মাথা ঠিক থাকে না? আমি কি বলি, কি করি আমি নিজেও জানি না। কন্ট্রল থাকে না আমার নিজের ওপর।”
” রাগ খুব খারাপ জিনিস আসিফ। প্রথম প্রথম সিরিয়াসলি নিতাম না বলেই এতদূর গড়ালো সব কিছু। আপনি রাগের বশে বেবির কোন একটা ক্ষতি করে বলবেন রাগের বশে করেছি। সিরিয়াসলি নিও না? ও যখন কাঁদবে,চেঁচাবে, ঘর বাড়ি নোংরা করবে আগের মতো পরিপাটি থাকবে না সব কিছু মেনে নিতে পারবেন? নাকি কাদলে জিভ কেটে ফেলবেন কাচি দিয়ে? গলা টিপে ধরবেন? ঘর নোংরা করলে হাত কেটে ফেলবেন? আর আসল খুঁত তো আপনার মধ্যে। অতিরিক্ত রাগ একটা মানুষের সব চেয়ে বড় খুঁত। আপনি নিজের খুঁত ঢাকতে আশেপাশের সব কিছুর খুঁত খুজে বেড়ান তারপর সেগুলো জোর করে নিখুঁত করবার চেষ্টা করেন।”

আসিফ এসব শুনে কেমন যেন চুপ করে গেলো। তার শরীর থরথর করে কাপতে শুরু করেছে। নিশ্বাস ভারি হয়ে আসছে। সোফায় থাকা ফুলদানিটা আয়েশার পায়ের কাছে ছুড়ে মারলো। ভেঙে টুকরো টুকরো হলো সেটা।
আয়েশা ভয়ে আবার কেপে উঠলো। এই না বুঝি কী করে ফেলে আবার! আসিফ আর কোন কথা বাড়ালো না। আয়েশাদের বাড়ি থেকে বেড়িয়ে এলো সে।
__________
সেদিনের পর আসিফ আর কোন যোগাযোগ রাখলো না আয়েশার সাথে। তবে ওর মা বা ভাবি আয়েশাকে দেখতে গেলে তাদের কাছ থেকে ওর ব্যাপারে খোজ খবর নেয়। আয়েশার পছন্দের সব জিনিসগুলোও তাদের হাতে মাঝে মাঝে পাঠায়। আয়েশা সেগুলো নেয় নাকি ফেলে দেয় তা সে জানতেও চায় না।
নিজের ভুল বোঝার ক্ষেত্রে জীবনের কোন কোন সময় প্রচন্ড রকম একটা ধাক্কার প্রয়োজন হয়। এই ধাক্কাটা আয়েশা নিজের অজান্তেই আসিফকে বেশ ভালো ভাবেই দিয়েছিলো। আসিফের হঠাৎ কি যেন হলো। নিজের এক্সেসিভ এ্যাংগার ম্যানেজমেন্ট এর জন্য সাইকিয়াট্রিস্ট দেখানো শুরু করলো। সেই সাথে মেডিটেশন। ডক্টর বলেছে তার দুটো সমস্যা রয়েছে বর্ডার লাইন ডিজিজ যার জন্য চাইলেও রাগ কন্ট্রোল করতে পারে না সে। আর ওসিডির জন্য খুতখুতে স্বভাব থেকেও বেরোতে পারে না।
এসবের মাঝেও আয়েশায় ওপর বেশ রাগ হয় তার। আয়েশা কেন বোঝে না সে তো এমন আচরণ ইচ্ছে করে করেনি। আবার মনে হয় আয়েশা হয়ত ঠিক সিদ্ধান্তই নিয়েছে। সত্যিই যদি রাগের বশে বেবির কোন ক্ষতি হয়ে যায় তার দ্বারা!

দূরেই থাক, তবুও ভালো থাক।

আষাঢ়ের ঝুম বৃষ্টির এক দুপুরে আয়েশার লেবার পেইন উঠলো। আয়েশার দু চোখ খুব করে চাইলো মানুষটাকে দেখবার জন্য। তবে ওটিতে যাবার আগে তার সেই সাধ মিটলো। আসিফ এসেছে। ওটির সামনের দেয়ালে হেলান দিয়ে চুপচুপে কাক ভেজা হয়ে পকেটে দু হাত গুজে শূন্য চোখে তাকিয়ে আছে। কাধে আফিসের ব্যাগটা পর্যন্ত নামাতে ভুলে গেছে। ওটিতে ঢোকার আগে আয়েশা কিছু বলতে চাইলো কাছে ডাকলো। আসিফ কাছে না গিয়ে চোখের ইশারায় ভরসা দিলো,” আছি তো। ”
জ্ঞান ফেরার পর, কিছুটা সুস্থ বোধ করবার পর আয়েশা দেখলো বাচ্চা তার দাদীর কোলে। আসিফ চুপ করে কেবিনের দরজায় সেই একই ভংগীতে দাঁড়িয়ে আছে। চুল উস্কোখুস্ক, চোখে রাজ্যের অনিদ্রা নিয়ে তার মায়ের কোলে থাকা বাচ্চার দিকে তাকিয়ে আছে। আয়েশা জানে আসিফ আর আগের মতো নেই। ভাবির কাছে শুনেছে তার নাকি অনেক পরিবর্তন এসেছে। অন্তত চেষ্টাটা করে আসিফ। এত দিনের সমস্যা তো আর দুদিনেই দূর করা সম্ভব নয়। এজন্য একার চেষ্টা জরুরি আশেপাশের মানুষগুলোর পাশে থাকা সাপোর্ট করাটাও অনেক বেশি জরুরি। অর্পা ভাবি শুরু থেকেই তাদের সম্পর্কটায় সমঝোতার মাধ্যম হিসেবে থাকার চেষ্টা করে গেছে। মাঝে হয়ত আসিফ নিজের নিয়ন্ত্রণের বেশিই বাইরে চলে গিয়েছিলো।
আয়েশা তাকে কাছে ডাকলো।
আসিফ প্রথমে আসতে চাইলো না। দূর থেকে হাসিমুখে বোঝালো,” না ঠিক আছি।”

কিছু সময় পর আয়েশা বাচ্চাকে নিজের কোলে তুলে নিলো। ইচ্ছে করে কাঁদিয়ে বলল,” এই আসিফ দেখুন আপনার মতো চেঁচাচ্ছে। ছেলে একদম আপনার কার্বন কপি হয়েছে দেখুন। আপনার মতোই ভাঙা টেপ রেকর্ডার এর মতো অহেতুক চেঁচায়। ”
আসিফ এবার আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলো না। হেসে ফেললো তারপর এগিয়ে এলো। পাশে বসে বাবুকে কাছ থেকে দেখতে লাগলো।
আয়েশা বলল,” কোলে নিতে ইচ্ছে করে না?”
“আমি কোলে নিলে ব্যাথা পাবে না?”
আয়েশা অভিমান করে বলল,”ওর বয়স এক দিন হয়ে যেতে চলল। অথচ আপনি একবার কোলে তো নেয়া দূর কাছেও এলেন না।”
” তুমি তো বিশ্বাস আমি ওকে ব্যাথা দেবো,কেটেকুটে মেরে ফেলবো। কি দরকার কাছে আসার, দূর থেকেই দেখি। তবুও তো দেখার অধিকার পাচ্ছি। হঠাৎ আমি বাড়াবাড়ি কিছু করে ফেললে এই অধিকারটুকুও হয়ত আবার কেড়ে নেবে।”
আয়েশা আসিফের চুল ঠিক করে দিতে দিতে বলল, ” ওকে ভালো করে দেখুন। আমাদের ছেলেটা কি সুন্দর না?একদম নিখুঁত। ”
আসিফ ওকে কোলে নিয়ে কেঁদে ফেললো।
আয়েশা হঠাৎ হেসে বলল,” ইউ আর সো মাচ চাইল্ডিশ আসিফ। নতুন বেবির সাথে নতুন বাবাও বুঝি এভাবে কাঁদে কখনো? ”
আসিফ বাবুকে কোলে নিয়ে বলল,” বাড়ি চল আয়েশা। আমার অনেক গল্প জমা আছে। বাবুকে নিয়ে স্বপ্ন জমা আছে।”
” বাবুর নাম কি রাখা যায়?”
“স্বর্গ”
_______
সময়গুলো উড়ছিলো। সুখের সময় নাকি উড়তে থাকে, দুঃখের সময় ধীর পায়ে চলতে থাকে।এর মাঝে আসিফ আয়েশা দুজনকেই আর এক বার স্তব্ধ করে দিলো,ডাক্তারের বলা ছোট্ট একটা কথা। কিছুদিন পর তারা যখন জানতে পারলো তাদের বাচ্চা আর দশটা সাধারণ বাচ্চার মতো না, স্পেশাল চাইল্ড। আয়েশা আসিফের দিকে তাকালো। তার প্রতিক্রিয়া বোঝার চেষ্টা করলো। কিন্তু আসিফ কথাটা শোনার পর কেমন পাথরের মতো স্থির হয়ে গেল।
ডক্টরের কোন কথা না শুনেই উঠে গেলো চেম্বার থেকে। রাতে আসিফ বাবুর সাথে খেলা করছিলো। আয়েশা তখন তাকে জিজ্ঞেস করল,
” আমি আপনাকে একটা নিখুঁত, সুস্থ বাচ্চা দিতে পারলাম না তাই না? সমাজের সবার চোখে আমাদের বাচ্চাটা অবহেলা, নিগ্রহের শিকার হবে তাই না? ও অন্যরকম বলে সবাই হাসবে। ওকে নিয়ে ঠাট্টা করবে,বুলিং করবে। বুঝতে শিখলে ও এসবে অনেক কষ্ট পাবে।আমি মা হয়ে এসব কি করে সহ্য করব? আমি কি করে ওকে বোঝাবো ও আমাদের কাছে কত স্পেশাল,গড গিফটেড?”
আসিফ বাবুকে কোলে নিয়ে উঠে গেল। বেলকনিতে দাঁড়িয়ে রাস্তার ব্যাস্ত গাড়িগুলোর দিকে তাকিয়ে বলল,
” তুমি জানো না আয়েশা সৃষ্টিকর্তা স্পেশাল কিছু সবাইকে দেন না। যাদের সব চেয়ে বেশি ভালোবাসেন তাদের দেন। কারন তিনি জানেন স্পেশাল যে কোন জিনিসই সবাই যত্নে রাখতে পারে না, আগলে রাখতে পারে না। স্পেশাল কিছু লালন করতেও যোগ্যতা থাকতে হয়, তাকে পাবার সৌভাগ্য থাকতে হয়। আর সৃষ্টিকর্তার সব সৃষ্টিই নিখুঁত। খুঁত তো আমরা নিজেরা তৈরি করি। আসল খুঁত তো থাকে আমাদের মনে, আমাদের চোখে (চোখের দৃষ্টিভঙ্গিতে)। আমরা অনেক সৌভাগ্য করে আমাদের বাবাটাকে পেয়েছি আয়েশা। লোকে কি বলবে এসবে আর আমার কিছু যায় আসে না। আমরা আমাদের ছেলেকে খুব সুন্দর একটা চাইল্ডহুড গিফট করব দেখবে।”
ছেলের চিন্তায় আয়েশা ভেঙে পড়লেও আসিফ এবার ভেঙে পড়লো না। সে বুঝতে শিখেছে সংসারে দুজন একসাথে রাগ করতে নেই। কোন পরিস্থিতিতে একজন আগুন হলে অন্যজনকে যেমন জলের ভূমিকা পালন করতে হয়। তেমন বিশেষ পরিস্থিতিতে একজন ভেঙে পড়লে অপর জনকে হতে হয় মাটির মতো শক্ত কিন্তু ধারণ ক্ষমতা যোগ্য।যেন ভেঙে পড়া মানুষটি শিকড় বিছিয়ে আকড়ে ধরে বাচতে পারে।
আসিফ জানে তাকে শক্ত মাটি হতে হবে, পাহাড় হতে হবে, পাহাড়ের ঢাল হতে হবে। সব কিছুতে খুঁত ধরতে অভ্যস্ত এই সমাজে অনেক কিছু সইতে হবে, অনেক জবাব দিতে হবে।
সমাপ্ত

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here