শখের_সাদা_শাড়ি_২,১১,১২

0
388

#শখের_সাদা_শাড়ি_২,১১,১২
কলমে ~ ফাতেমা তুজ
১১.
সৌমেন কে ডাক্তারের কাছে নিয়ে এসেছিল উর্মি।হঠাৎ ই ফোন করে সমীর। জানায় আর্জেন্ট প্রয়োজন। উর্মি কয়েক বার বললো যে একটু পর আসছি। তবে সমীর শুনলো না। সে বেশ জোড়ালো কন্ঠে বলল ” তুমি অনেক পরিবর্তন হয়ে গেছো উর্মি। হয়তো মেনে নেওয়ার চেষ্টা করছো। তুমি চাইলে…। ”

উর্মির ভেতর টা দুমড়ে মুচড়ে এলো। এক বুক কষ্ট নিয়ে বলল ” আমার মনে হয় তুমিই চাইছো না এই সম্পর্ক টা। ”

” যদি তেমনি হতো তাহলে এখনো বসে থাকতাম না। তোমার পিছু পরে থাকতাম না পাগলের মতো। ”

” হয়তো এটা কেবল দায়িত্ব বোধ ভাবছো। মুক্তি চাইছো ঠিক ই। ”

” সেটাই। এতো কিছুর পর ও আমায় এটা শুনতে হলো। বুঝতে পেরেছি আমি। সব টা আমার ভুল। আমিই পাগল। শুধু শুধু একটা বিবাহিত মেয়ের পেছনে পরে আছি। হোক সে আমার প্রেমিকা সে তো এখন অন্যের স্ত্রী। আমিই ভুল। ক্ষমা চাই আর কখনো এমন ভুল হবে না। ”

উর্মি প্রায় রেগে উঠলো। ” আজ মনে হচ্ছে আমি বিবাহিত। আগেই বলে দিতে পারতে। এটা আমি আগেই বুঝে ছিলাম। আসলে কেউ চাইবে না একটা বিবাহিত মেয়ে…” শব্দহীন কেঁদে উঠলো উর্মি। দু চোখ বেয়ে জল গড়ায়। ” সব কিছুর জন্য আমি ক্ষমা চাইছি সমীর। আমিই ভুল। আর এটা ও ঠিক আমি স্বার্থপর। স্বার্থে ব্যবহার করেছি তোমায়। সিয়াম হয়তো মিথ্যে বলে নি। ”

কল কেটে দিলো উর্মি। ওয়েটিং চেয়ারে ধপাস করে বসে পরলো। জীবনে প্রথম বার সমীর এর সাথে মতের অমিল ঘটেছে। সাথে হয়েছে মনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। হয়তো এখানেই শেষ হয়ে যাবে সম্পর্ক টা। স্বার্থপর হয়েই বেঁচে থাকবে উর্মি।

সৌমেন কে চেকাপ করলেন ডাক্তার। আগের রিপোর্ট গুলো দেখে বললেন ” রোগ টা খুব ই কমপ্লিকেটেড। দেশের সেরা হসপিটাল থেকে রিপোর্ট করা সেহেতু এই বিষয়ে মতামত দেওয়া টা ও যুক্তিহীন। আমাদের সিস্টেম এতো টা এডভান্স নয়। তবে এতো দিনে ও যখন পরিবর্তন হয় নি তেমন সেহেতু আমার মনে বিদেশ থেকে ট্রিটমেন্ট করানো টা উচিত হবে। ”

” আপাতত বিদেশ যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। সেই জন্যেই এখানে আসা। আমি শুনেছি আপনার পরিচিত এক ডাক্তার আছেন। বিদেশী ডাক্তার। তিনি নাকি আসবেন খুব দ্রুত।সেই জন্যেই আসা। ”

” হুম। তবে নেক্সট সপ্তাহে আসবেন। ”

চিন্তিত কন্ঠে উর্মি বলল ” কত দিন থাকবেন? ”

” খুব সম্ভবত এক সপ্তাহ। ”

” অহ। ঠিক আছে। থ্যাংকস ডক্টর। ”

হতাশ হয়ে ফিরে এলো উর্মি। সামনের সপ্তাহে মেঘনার বিয়ের অনুষ্ঠান। সেটা সামনে রেখে অনেক কাজ। সেহেতু এটা হচ্ছে না। উর্মি দ্বিধান্বিত হয়ে পরলো। সৌমেন বসে ছিল। উর্মি কে দেখে বলল “কথা বললে?”

” হু। ”

” কি বলল ডাক্তার। আমার রোগ যাবে না তাই না? ”

” উহু। ডাক্তার বলেছেন প্রপার ট্রিটমেন্ট করলেই আপনি আগের মতো হয়ে যাবেন। তাছাড়া স্বনামধন্য হসপিটলে চিকিৎসায় আছেন। সেহেতু সব টা ঠিক হয়েই যাবে। ”

” আমার ভালো লাগে না মাইশা। আমি কিছু মিলাতে পারি না। ইদানিং কিছু একটা ঘোলা ঘোলা ভাসে। মনে হচ্ছে কিছু স্মৃতি আমার স্মরণে নেই। ”

অন্যমনস্ক ছিল উর্মি। সৌমেন এর কথায় ধ্যান ফিরে এলো। ” কোন স্মৃতি? ”

” জানি না। তবে কিছু ঘটনা আমি মিলাতে পারি না। গত এক বছরের ঘটনা আমার কাছে এলোমেলো লাগে। মনে হয় কোনো টার সাথে কোনো টা মিল নেই। ”

” অফিসের ঘটনা মনে আছে? ”

” হ্যাঁ। তবু ও কিছু জিনিস ঘোলা ভাসে। ”

উর্মি হতাশ হলো। ভেবেছিল ওকে মনে করতে পারবে ছেলেটা। কিন্তু পারছে না। এমন কি অফিসে আসা নতুন কোনো এমপ্লয়ি কেই চিন্তে পারে না। মাঝে সাঝে কিছু লোকের নাম গুলিয়ে ফেলছে। আবার কিছু সময় বাচ্চা দের মতো খেলা করছে। যেন শৈশব টা কে খুব বেশি মনে পরে। উর্মি আতঙ্কিত হয়। কিছু একটা ঘটনা ওর শরীর মনে বিঘ্ন ঘটায়। তবে কি সৌমেন এর শৈশবে এমন কিছু আছে যা ওকে ভোগায় কিংবা আনন্দ দেয়!

সাগরিকা কে বুকে টেনে নিয়ে অদ্ভুত ভাবে কেঁপে উঠলো আলিদ। বাচ্চা টা কে ধরলেই মনে হয় ওর নিজের অংশ। সত্যিই যদি এমন হতো খুব কি ক্ষতি হতো? এই যে সাগরিকার জন্য এতো মায়া হয় তখন কি এর থেকে ও বেশি মায়া হতো?
বহু ভেবে ও কুল পেল না আলিদ। ঘুম ভাঙতেই সামান্য শব্দ করলো সাগরিকা। আলিদ চকিত হয়। ” হোয়াট হ্যাপেন মাই প্রিন্সেস? ”

সাগরিকা কি বুঝলো কে জানে সে ইষৎ হাসলো। বাচ্চা টার বয়স কত? এই মাস দুয়েক এর আশ পাশ। চোখ দুটো ছোট, পিট পিট করে তাকায়। মাথায় সামান্য চুল। তবে চোখের পাপড়ি বেশ বড়। শুভ্র সকালে বাচ্চা টি যেন বিড়াল ছানার মতো আলিদের বুকে নেমে যেতে যায়। আলিদ হাসলো। কি এক সুন্দর অনুভূতি। ভাবতেই অবাক লাগে এই টুকু প্রাণ কিছু দিন পর ই বড় হয়ে যাবে। হেঁটে হেঁটে এধার ওধার ঘুরবে। আলিদ নিশ্চয়ই তখন তাকিয়ে থাকবে ফ্যালফ্যাল করে। বাচ্চা টি পা ছিটকে পরে যেতে চাইলেই সুপার ম্যানের মতো আগলে নিবে। আর সাগরিকা পাপা, পাপা বলে ডাকবে। এক সুন্দর ভাবনায় বুদ হয়েছে আলিদ। ওমন সময় ছাঁদে এলো জোৎস্না। বালতি ভর্তি কাপড়।
” সকাল সকাল জ্বালাতন করেছে তাই না? ”

” না ভাবি। জ্বালাতন করবে কেন। দেখেন না কেমন ঘুমিয়ে আছে। ”

” সে ঠিক ই বলেছো। তবে প্রথম কয়েক দিন বেশ কান্না কাটি করেছে। ” জোৎস্নার মুখ ম্লান হয়ে এলো। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল ” অতো বড় অপারেশন টা গেল। একটু আধটু তো জ্বালাতন করবেই। এই ছোট বয়সেই কি একটা ফাঁরা গেল। ”

বুঝতে পারলো না আলিদ। বেশ উতলা সুরে বলল
” অপারেশন মানে? ”

” সাগরিকার অপারেশন এর কথা বলছি। উর্মির বিয়ের দিন ই তো অপারেশন হলো। সমস্ত খরচ ই তো দিলো….। ”

মেঘনা এসেছে। ক্লান্ত দেখাচ্ছে ওকে। জোৎস্না বলল
” শরীর খারাপ? ”

” জানি না ভাবি। কেমন যেন ঘুরছে মাথা। শরীরে বল নেই যেন। ”

আলিদ এগিয়ে এলো। উর্মির কপালে হাত রেখে বলল
” শরীরের তাপমাত্রা বেড়েছে। ঔষধ খাও নি? ”

” সেরে যাবে। ”

” উহু যাবে না। অবহেলা করলেই বিপদ ঘটে। ”

” ঠিক বলেছো। কাবাডে ঔষধ রাখা আছে। না পেলে অন্তু কে বলিস। ”

” হুম। সাগরিকা উঠেছিল? ”

” উঠে আবার ঘুমিয়ে পরেছে। ”

সাগরিকা কে কোলে নিলো মেঘনা। ঠিক তখনি মাথা ঘুরিয়ে পরে যাচ্ছিলো। জোৎস্না দু হাতে আগলে নিয়েছে। বাচ্চা টি কে জোৎস্নার কোলে দিয়ে মেঘনা কে ধরলো আলিদ। নিয়ে এলো ঘরে। রাতে এলো কাঁপুনি দিয়ে জ্বর। তাপমাত্রা বেড়ে যাচ্ছে হু হু করে।

মন খারাপ নিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে উর্মি। চোখ দুটো জলে ভরে আছে। চাঁদের আলো ছিটকে পরেছে সামনের গাছ টায়। চকচক করছে পাতা গুলো। দুটো পাখি এসে ডানা ঝাপটালো। কয়েক বার শব্দ করলো। উর্মির হেলদোল নেই। একটা পাখি ততক্ষণে উড়ে গেছে। কষ্ট হলো উর্মির। নিজের জীবন টা কে যেন দেখতে পেয়েছে সে। সমীর এর সাথে পথ চলেছে,আজ সেই পথ চিনেছে আরেক পথ। একটা পথ মাঝ খান থেকে বিভক্ত হয়ে হদিশ করেছে আর ও দুটো পথ। গন্তব্য এখন আলাদা। তড়িঘড়ি করে রুমে ডুকলেন লতিফা। উদ্বিগ্ন তাঁর কন্ঠে ” লায়লা কোথায় গেছে তুমি কি জানো উর্মি? ”

” না আন্টি। লায়লা আপু কে তো কাল রাতে দেখেছিলাম। এর পর আজ সারাদিনে দেখি নি। এখন তো প্রায় মধ্য রাত্রি।”

” হুম। সেটা নিয়েই চিন্তিত। ফোন বন্ধ কোথাও খুঁজে পাচ্ছি না। ”

চিন্তিত বোধ করলো উর্মি। সৌমেন স্যার এর কথা টা মাথায় এলো। অন্য ঘরে ঘুমোতে এসেছিল আজ। ঝটপট এলো সৌমেন এর কক্ষে। ছেলেটা ঘুমিয়ে আছে দেখে স্বস্তি পেল। লতিফা বেগম চিন্তায় অস্থির হয়ে পরলেন। হাজার হোক,বোনের মেয়ে তো। আর বোনের মেয়ে নিজ সন্তানের থেকে কম কী?

লায়লা কে পাওয়া গেল না সেদিন। মিছিং ডায়েরী করা হলো। এদিকে খবর এলো মেঘনার জ্বর করেছে।উর্মি ছুটলো সেথায়। বাড়ি গিয়ে দেখলো ক্লান্তি তে চোখ ডেবে গেছে মেঘনার। পাশে বসে আছে আলিদ সহ সকলে। অমর উর্মি কে দেখে বসতে বললো। পাশে বসলো উর্মি। ডাক্তার নিয়ে এসেছে সৌজন্য। চেকাপ চললো। ডাক্তার জানালেন সাধারণ জ্বর। খুব সম্ভবত ঠান্ডা লেগে হয়েছে। উর্মি বোনের পাশে বসলো। মাথায় হাত বুলাচ্ছে। ” কি হয়েছে আপা? নিজের প্রতি এতো অযত্নশীল কেন হচ্ছিস? ”

মেঘনা নিশ্চুপ। যেন কিছু লুকাতে চায়। চোখ দুটো আতঙ্কিত। একে একে সকলে চলে গেল। হাউ মাউ করে কেঁদে উঠে মেঘনা। উর্মির অস্থির দৃষ্টি। ” কি হলো আপা। হঠাৎ কাদঁছিস কেন? ”

” নয়ন ফোন করেছিল। বললো আলিদ এর ক্ষতি করে দিবে। আর এখন নাকি সাগরিকা কে ও ওর চাই। তুলির বাচ্চা হবে না কখনো।আমি দিবো না আমার মেয়ে কে। মরে যাবো আমি। ”

” কি বলছিস! আমাকে জানালি না কেন? জানো’য়ার টার শান্তি হয় নি। আমাদের সবার জীবন ধ্বংস করে ও শান্তি তে নেই হা’ রামির বাচ্চা। ”

” সাগরিকা কে আমি দিবো না বোন। আমি দিবো না ওকে। ”

” বললেই হলো? আমাদের মেয়ে কি নিবে এতো সোজা! তুই চিন্তা করিস না আপা।”

উর্মির বুক থেকে মাথা তুলে মেঘনা। চোখ মুছে বলে
” বিয়ে টা ক্যানসেল করে দে। ”

” পাগল হলি? ”

” আমি চাই না আমার জন্য আলিদের ক্ষতি হোক। আমি পারব না নিজেকে ক্ষমা করতে। এমনি তেই ওর জীবন টা তছনছ হয়ে আছে। ”

উত্তর করলো না উর্মি। মেঘনা কে বুকে টেনে নিলো আর ও একবার। বাচ্চাদের মতো গুটিয়ে রইলো মেঘনা। চোখে লেগে আছে আতঙ্ক!

চলবে…..
কলমে ~ ফাতেমা তুজ

#শখের_সাদা_শাড়ি_২
১২.
মেঘনার বিয়ে টা প্রায় ভেঙে যাচ্ছিলো। এই নিয়ে চার দেয়ালে কতো অশান্তিই না গেল। উর্মি বুঝালো,বুঝালো বড় ভাবি, তবু ক্ষান্ত হচ্ছিল না মেঘনা। নিজের জন্য আলিদ এর ক্ষতি মেনে নিতে পারবে না। সেই জন্যেই পাগলামি শুরু করেছিল। তবে অদ্ভুত ভাবে আজ সকালেই খবর এসেছে নয়ন আর তুলি পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হয়েছে।এ যেন এক রহস্য। দুজন একি সঙ্গে এমন রোগে আক্রান্ত হলো কি করে এ নিয়ে বেশ কথা উঠলো। নয়ন এর মা ফোন করে মেঘনা কে কথা শুনালো। বলল অভাগী,সর্বনাশী আমার ছেলের জীবনের কাল। আমার মেয়ে টা কে খেয়েছিস তোরা। কখনো ভালো হবে না। কতো শত অভিযোগ। এসবের জবার দিতে ইচ্ছে করছিল না মেঘনার। তবে কেন যেন মেয়েটা নিজেকে সংবরণ করতে পারলো না। বেশ চেচিয়ে বলল
” মা আপনার ছেলে এখন আমার স্বামী নয়। তাছাড়া আমি বা আমার পরিবার আপনাদের সর্বনাশের জন্য দায়ী ও নয়। সব টা কর্মফল।আপনারা যেমন করেছেন তেমনি ফল পেয়েছেন। আর আপনাদের নষ্ট মনের অভিশাপে আমার যায় আসে না। আমি ভালো আছি,অন্তত এখন থেকে ভালো থাকবো কারন পাপী রা শাস্তি পেল অবশেষে। আল্লাহ ইনসাফ দিয়েছেন। ”

কল কেঁটে গুমোট কান্নায় ভেঙে পরলো মেঘনা। আর তারপর পর ই চিৎকার করে কাঁদলো। হাউ মাউ করে কাঁদছে আজ। আলিদ কিছু দরকারে এসেছিল। এসব দেখে প্রায় থমকে গেছে। বুকের ভেতর ভাঙচুর হচ্ছে। তবে কি নয়নের প্রতি জমে থাকা ভালোবাসা এখনো রয়ে গেছে?
কষ্ট হচ্ছিল খুব। আলিদের মুখের ভঙ্গিমা বুঝিয়ে দিচ্ছিলো হৃদয়ে কত ব্যথা। তবে মুহুর্তেই সব টা বদলে গেল। মেঘনা প্রায় ছুটে এসে জড়িয়ে ধরলো ওকে। আলিদ প্রথমে চুপ থাকলে ও একটু পরেই মেয়ে টি কে আগলে নিলো। আলতো হাতে পিঠ চাপড়ে দিলো। বেশ কিছু সময় পর শান্ত হলো মেঘনা। বিড়াল ছানার মতো ঢুকে যেতে চাইলো আলিদের ভেতর। আলিদ অবশ্য পরে এ বিষয় নিয়ে কথা বলে নি। কারন মেঘনার নিস্তব্ধতা বুঝিয়ে দিয়েছে এক আত্মতৃপ্তি পেয়েছে আজ। হৃদয়ে থাকা সব ভালোবাসা পানসে হয়েছে বহু পূর্বেই। আজ বুকের ভেতরে থাকা আগুন গুলো কেবল প্রশমিত হয়েছে।

আয়োজন চলছে। ধুম ধাম আয়োজন করে বিয়ের অনুষ্ঠান হবে। সিগারেট ফুকছে সৌজন্য। চোখ টা নিষ্পলক ভাবে বাহিরে নিবদ্ধ। মাত্র কয়েক মাসে জীবন কতো টা বদলে গেছে। তুলির রোগের কথা কানে এসেছে ঠিক। তবে খুব যে পাত্তা দিয়েছে এমন নয়। ওর অনুভূতি গুলো কেমন ফ্যাকাশে। রঙহীন জীবন!
বাড়ি তে হৈ হুল্লোড় পরে গেছে। মেঘনা কে ও বেশ সুখী দেখাচ্ছে। হাল্কা করে হলুদ এর আয়োজন হবে। ঘরোয়া আয়োজন।
” আর কত সিগারেট ফুরাবি? ”

অমরের কন্ঠ। নড়লো না সৌজন্য। নির্বোধ অভদ্র লোকের মতো বড় ভাইয়ের নিকটে বসেই সিগারেট ফুকতে লাগলো। কোনো হোলদোল না দেখে বসলো অমর। দু ভাই আজ বহু বছর পর এক সঙ্গে। নির্জন হয়ে এলো আশ পাশ। চার পাশের গানের সুর গুলো কেমন যেন গুটিয়ে এসেছে। অমর সিগারেট খায় না। মাঝে সাঝে দু একবার নেওয়া হতো হুট হাট। আজ দুই ভাই মিলে সিগারেট খাচ্ছে। ভোটকা গন্ধ টা বেশ অদ্ভুত ভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে। অমর কথা বলল ” ভালো একটা চাকরি হয়েছে। মেঘনার বিয়ে হবে।উর্মি ও আছে ভালো। তুই এবার নিজেকে নিয়ে ভাব। ”

উত্তরহীন সৌজন্য। অমরের হাত টা কাধে এসে খামচে ধরলো। বয়সে খুব বেশি বড় নয় অমর। ঐ তো বছর ছয়েক। তবে দুই ভাইয়ের মাঝে খুব একটা মিল ছিল না কখনোই। দুজন দু প্রান্তের মানুষ। অবশ্য উর্মির সাথে বেশ ভাব ছিলো এক কালে। তুলির সান্নিধ্যে এসে সব কেমন করে যেন হারিয়ে গেল। জীবনের প্রথম প্রেম,প্রেয়সী তুলি। সৌজন্য কে যেদিন প্রেম নিবেদন করলো তুলি সেদিন বাসায় এসে সব টা বললো উর্মি কে। দুই ভাই বোনের বয়সের ফারাক প্রায় আট বছর। অথচ কি মিল দুজনার। উর্মি খুব হেসেছিল। সহসা এমন ঘটে না,মেয়েরা প্রেম নিবেদন করে!তবে সৌজন্যের ক্ষেত্রে এসব ভিন্ন। অধিক সুন্দর হওয়া তে মেয়েরা নিজ থেকেই আসতো প্রপোজ নিয়ে। কোথাও আকর্ষণ পেতো না সৌজন্য। তবে তুলির ক্ষেত্রে কেমন যেন গলে গেল। ভালোবাসায় ডুবে গেল। প্রেম হলো, আর তারপর বিয়ে। সব টা দারুণ ছিলো। স্বপ্নের মতো। কিংবা রূপকথার গল্পের ন্যায়।
সৌজন্য বোধহীন। আলতো করে ঝাকায় অমর। নড়েচড়ে বসে সে। ” আমার জীবন জীবনের মতোই চলতে থাকুক ভাইয়া। ”

” উহু এমন টা বলতে তো হবে না। বয়স কত তোর? জীবনের আরও অনেক বাকি। এভাবে তো চলে না। একজন সঙ্গী তো প্রয়োজন। ”

” প্রয়োজন হলে দেখা যাবে। ”

অনুভূতি নেই। ঠিকরে পরছে যেন তুচ্ছ এ জীবন। অমর কি বলবে বুঝলো না। ভাই টার সাথে খুব বেশি মেলামেশা থাকলে হয়তো আরও কিছু বুঝাতে পারতো। আলগোছে উঠে গেল অমর। সৌজন্য দেখে ও না দেখার মতো করে রইলো। ওর মাঝের সমস্ত কিছু যেন কোথাও হারিয়ে গেছে। সব ফ্যাকাশে হয়ে আছে। জীবন যেন জীবন নেই। যা আছে তা কেবল মৃত্যু কে কাছে টানার প্রার্থনা!

লায়লা কে পাওয়া গেল না। সবাই বেশ চিন্তিত। এর ই মাঝে উপস্থিত হলেন লুবনা।মেয়ের চিন্তায় পাগল প্রায় অবস্থা। এক পর্যায় এসে লতিফার পা ধরে বসে পরলেন। মেয়ের বাহনা কে প্রশ্রয় দিয়ে বড় ভুল হয়ে গেছে। এ ভুল শুধরানোর কোনো উপায় তিনি পেলেন না। লতিফা বেগম ছটফট করছেন। ক্রন্দনরত হয়ে লুবনা বললেন ” বুবু আমারে মাফ করে দে। আমি পিশাচ! আমি বড় জালিম। বড় ভুল হলো আমার। খুব ভুল করলাম আমি। ”

লুবনা বেগমের কান্নায় সবাই হতবাক। কি বলতে চাইছেন পরিষ্কার নয়। মেয়ের শোকে কাতরাচ্ছেন।
” খালামনি আপনি কি বলছেন? আপনি এসব কেন বলছেন এখন। ”

” আমার ভুল মা। আমি যদি প্রথম থেকেই সব টা বলে দিতাম তাহলে এমন কিছু হতো না। ”

” কি লুকিয়েছিস? ” লতিফা বেগমের উৎকণ্ঠতা। লুবনা বেগম প্রায় হাউমাউ করে বললেন ” লায়লা শুরু থেকেই সৌমেন কে পছন্দ করতো এটা তো সবাই জানো। মেয়েটার স্বভাব অন্য রকম ছিল আর ওর বাবার পেশাগত কারনেই তোমরা যে অপছন্দ করতা সেসব আমি ও জানি। তবে আমার মেয়ে টা তো ভীষণ জেদি। সৌমেন কেই লাগবে। অনেক চেষ্টা করে ও তো লাভ হলো না। সব শেষে হাল ছেড়ে দিয়েছিল লায়লা। অস্ট্রেলিয়ার এক ছেলের সাথে লায়লার পরিচয় হয়। আর সেখানেই বছর খানেক আগে বিয়ে করে। সব ঠিক ই ছিল। হুট করেই একদিন খবর এলো সৌমেন বিয়ে করেছে। আর সেসব শুনেই পাগলের মতো চলে এলো লায়লা। আমি জানি না মেয়েটার কি হলো। ”

ভেঙে পরলেন লুবনা। অবাক হয়ে গেল উর্মি। সব টা কেমন যেন লাগছে। লায়লা যে উদ্দেশ্য নিয়ে এসেছে এ বিষয়ে আর সন্দেহ রইলো না। নিজের প্রতি ক্ষোভ জন্মালো। শুধু মাত্র লায়লার প্রবোঞ্চনায় সৌমেন কে আজ ও শতভাগ বিশ্বাস করতে পারে নি উর্মি। বার বার যুক্তি দিয়ে হারিয়ে দিয়েছে। এক একটা কথা মনে হতে লাগলো উর্মির। গা ঘিন ঘিন করছে। না জানি কতো বড় ক্ষতি হতে পারতো সৌমেন এর!

সব কিছু সামলিয়ে বাড়ি এসেছে উর্মি। হলুদের অনুষ্ঠানে সৌমেন এর বাড়ির কেউ ই আসতে পারবে না। হয়তো বিয়ে তে ও সামিল হতে পারবে না। লুবনা কে রেখে আসা টা সম্ভব না। তাছাড়া হুট করে লায়লার কি হলো এটা ও বেশ চিন্তার। টুকটাক হলুদের আয়োজন টা যেন বেশ বড় ই হয়ে গেল। সমীরের সাথে দু একবার কথা হয়েছে। খুব ই সামান্য কথা! যেন কেউ কাউ কে আমলে নিচ্ছে না। সমীর এলো প্রায় রাত আট টায়। উর্মির ছটফট বেড়ে গেল হঠাৎ। চোখ দুটো কেমন ছল ছল করে উঠলো। অন্তুর হাতে মিষ্টির থালা দিয়ে চুপিসারে বলল ” সমীর আঙ্কেল কে দিয়ে আয়। ”

মিষ্টি দিয়ে আসে অন্তু। সমীর এর মুখ টা কেমন ফ্যাকাশে ঠেকে। উর্মি কে খুঁজছে বোধহয়। অন্তু কে জিজ্ঞাসা করলে ও হদিশ দিতে পারলো না ঠিক। হলুদের প্রায় শেষে সমীর আর উর্মি মুখোমুখি হলো। দুজনের চোখ অনেক কিছু বলতে চায়। তবে হুট করেই কেউ কথা খুঁজে পায় না। তীব্র সংকোচ জাগে। এক পর্যায়ে দুজন ই এক সাথে বলে উঠে ” স্যরি।”

চলবে……
কলমে ~ ফাতেমা তুজ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here