#শখের_সাদা_শাড়ি_২,১৩,১৪
কলমে ~ ফাতেমা তুজ
১৩.
একটি সুন্দর সময় কাটালো উর্মি। মূলত ভুল বুঝাবুঝি জীবনের সব থেকে সুন্দর সময় গুলো কে কেড়ে নেয়। ধ্বংস করে দেয় সুখ শান্তি কে। গত কয়েক দিনের যন্ত্রণা অবিসহ্যনীয় ছিল। আজ সব কিছু ধুয়ে মুছে পরিষ্কার। সমীর কে বিদায় জানানোর সময় ছেলেটার কাছাকাছি হলো উর্মি। চোখ দুটো প্রায় ছলছল।
” কি হলো? ”
” কিছু না। ”
” এভাবে তাকাচ্ছো যে। ”
” মনে হচ্ছে আমি সব টা হারিয়ে ফেলবো। আমার সব টা হারিয়ে যাবে।”
” বোকার মতো কথা বলো কেন। আর তো মাত্র কিছু সময়। সব ঠিক হয়ে যাবে। ”
মাথায় হাত রাখলো উর্মি। সমীর যখন মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় উর্মির মনে হয় পরম যত্নে কেউ সাজিয়ে দিচ্ছে ওকে। ওর সাদা কালো জীবনে সত্যিই রঙের বর্ষণ নেমেছে। সময় টা খুব দ্রুত কেটে গেল। পরদিন ধুমধাম আয়োজনে মেঘনার বিয়ে টা ও হয়ে গেল। মেঘনার কান্নার কথা থাকলে ও মেঘনা কাঁদলো না। বরং নিয়ম এর বেড়াজাল ভেঙে গুড়িয়ে কাঁদলো দুই ভাই,বোন, ভাবি, ভাতিজা। এদের সামলে উঠতে বেশ কসরত করতে হচ্ছে। একটা সময় মেঘনা বলল “আমি তাহলে এখানেই থেকে যাচ্ছি। ”
কথা টা কাজে দিলো। সবাই সামলালো নিজেকে। মেঘনা হাসি মুখে বিদায় নিলো। জীবনে অনেক টা সময় কেঁদেছে। এখন থেকে আর কাঁদবে না,সব সময় হাসি খুশি থাকবে। অগোছালো জীবন টা কে এবার গুছিয়ে নেওয়ার পালা।
রাত্রি করেই বাড়ি ফিরলো উর্মি। সৌমেন তখন স্টাডি রুমে বসে আছে। আজকাল ওর স্বভাব আচারণে বদল ঘটেছে। আগে বাচ্চা বাচ্চা একটা স্বভাব কাজ করতো। এখন সে স্বভাবের বদলে ঘটে গম্ভীরতা আকড়ে ধরেছে। উর্মি বাসায় এলো ঠিক তবে সৌমেন এর খোঁজ নিতে ভুলে গেল। পুরো রাত্রি ঘুমালো বেঘোরে। হয়তো কিছু চিন্তার অবসান ঘটার কারনেই এমন করে ঘুমালো। তবে দেখা গেল এই নিয়ে বেশ বিরোধ জেগেছে সৌমেন এর অন্তকর্নে। ছেলেটা সারা রাত ঘুমায় নি। নির্ঘুম গেল রাত। চোখ দুটো লাল টকটকে। সকালে বেলা করে উঠলো উর্মি। হাই তুলে যখন ঘর থেকে বের হলো তখন সৌমেন দাঁড়িয়ে আছে দরজার বাহির।বেশ অবাক ই হলো উর্মি। ” আপনি! এভাবে এখানে দাঁড়ানো। ”
কথা বললো না সৌমেন। উর্মি আবার ও একি প্রশ্ন করলো। অথচ সৌমেন নিশ্চুপ বাকহীন! কয়েক সেকেন্ড পর ঘরে ঢুকে গেল। উর্মি ও এলো পেছন পেছন। মাথা নিচু করে কাউচে বসলো সৌমেন। পায়ের আঙুল আর মেঝের মাঝে এক প্রকার সংঘর্ষ তৈরি করে খেলতে লাগলো। উর্মি অনেক টা সময় ভেবে ও কিছু পেলো না। প্রায় বিরক্তি চলে এসেছে মেয়েটির মুখে।
” বসো। ”
বসলো না উর্মি। স্থির হয়ে রইলো দাঁড়িয়ে।
কিছু টা ধমকের সুরেই সৌমেন বলল
” বসতে বলেছি না? ”
ভয় পেয়ে বসলো উর্মি। ধমক টা আশা করে নি বোধহয়।দুজনের মাঝে অদৃশ্য কিছু বিরাজ করছে। সৌমেন শুধালো
” ভালোবাসো আমায়? ”
অদ্ভুত প্রশ্ন! উর্মির হৃদয়ে ছ্যত করে উঠলো। কেমন প্রশ্ন এটা! উত্তরের অপেক্ষা করে সৌমেন। অথচ উর্মির মাঝে উত্তর দেওয়ার মতো কিছু লক্ষ্য করা গেল না। সৌমেন হতাশ হলো। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে বলল ” তোমার আমার মাঝের দূরত্ব টা অস্বাভাবিক নয় কি? ”
” হঠাৎ এমন কেন মনে হলো? ”
” জানি না। ”
কথা খুজে পাচ্ছে না উর্মি। জানালার বাহিরে তাকালো সৌমেন। আকাশে মেঘ করেছে। বোধহয় বৃষ্টি হবে। সে বৃষ্টি তে সিক্ত হবে তপ্ত রোদে পুড়ে যাওয়া গাছ পালা। তবে ওর ভেতর টা বড্ড অশান্ত। পুড়ে ছাই! সেসব সিক্ত হবার উপায় কি?
দুপুরে খাওয়ার সময় উর্মি লক্ষ্য করলো সৌমেন এর মাঝে চঞ্চলতা এসেছে। যা ওর মন কে পুলকিত করলো ঠিক তবে পরক্ষণেই ভেঙে দিলো কাঁচের মতো। সকালের সেই প্রশ্ন টা উর্মির ভেতরে দহন জ্বালিয়েছে। ভেতর টা যে বেশ ভালোই ক্ষত হয়েছে সেসব অজানা নয়। খাবার মাঝেই উর্মির ফোন টা রিং হলো। সমীর এর কল। সৌমেন অবশ্য তাকালো না কোনো দিকেই। অবিলম্বে খাচ্ছে!
দেশের বাহিরে যাচ্ছে সমীর। পারিবারিক কিছু প্রয়োজনেই যাওয়া। সমীর এর বাবা সওলাত খানের দ্বিতীয় স্ত্রীর সাথে কিছু বোঝাপোড়া রয়েছে। ভদ্র মহিলার একটি সন্তান রয়েছে। কন্যা সন্তান। সে সন্তান নিয়ম অনুযায়ী সম্পত্তির ভাগ পাবে। সওলাত খান তিন সন্তান কে সমান সম্পত্তি ভাগ করে দিয়েছেন। তবে ভদ্র মহিলার দাবি মোট সম্পত্তির অর্ধেক। এই নিয়েই কিছু ঝামেলা চলছিল। তবে সেই ঝামেলার অবসান ঘটাবেন মিষ্টি মৃধা। অনেক হিসেব চুকানোর আছে। সওলাত খান প্রথম বারের মতো মিষ্টি মৃধার বাড়ি এসেছেন। ভদ্রলোকের মাঝে কেমন যেন অস্বস্তি। অথচ খুব স্বাভাবিক ভাবেই এলেন মিষ্টি। চা নাস্তা রেখে বললেন
” আপনার প্রিয় খাবার ছিলো পুডিং। সেটাই তৈরি করেছি। জানি না সময়ের সাথে সাথে মুখের স্বাদ বদল ঘটেছে কি না। আপনি তো আবার এই বিষয়ে বেশ সচেতন। ”
মিষ্টির কটাক্ষ কথা গুলো হজম করে নিলেন সওলাত। বিশেষ কিছু কি বলা যায় এখন? উহু! সেসব বলার মতো মুখ নেই ওনার। জীবনের ভুল গুলো যদি কোনো ভাবে মুছে দেওয়া যেতো তবে চোখ বুজে তিনি মিষ্টির উপর করা অন্যায় অনাদার গুলো অদৃশ্য করে দিতেন। তবে সেসবের উপায় নেই।
সিয়াম বেশ রেগেই ঘর থেকে বের হলো। সমীর বার বার বলল যাতে কোনো রকম বেয়াদবি না করে। সিয়াম শুনলো ভাই এর কথা। তবে বেয়াদবি যেমন করে নি ঠিক তেমনি দেখা গেল না আদব এর লেশ মাত্র। সমীর অগোচরে দীর্ঘ নিশ্বাস লুকালো। বহু বছর পূর্বে মা ভাই কে নিয়ে নিজ ইচ্ছে তেই বাড়ি ছেড়েছিল সে। বড্ড ঘৃনা হয়েছিল বাবার প্রতি। আজ সেই ছেলেটাই চাইছে ঘটনা স্বাভাবিক হোক। মা বাবার মাঝে সম্পর্ক ঠিক না হলে ও অন্তত বন্ধুত্ব থাকুক। অন্য দিকে বেকেছে সিয়াম। বয়স টাই এমন। এই বয়সের সব ছেলে মেয়েরাই হুট করে সিদ্ধান্ত নেয়। কখনো সেটা ঠিক আবার কখনো ভুল। সিয়ামের করা আচারণ গুলো কে ঠিক ভুল কোনো টা তেই ফেলা যায় না। এক একটা পরিস্থিতি এতো টাই জটিল করে তুলেছে সম্পর্ক!
সমীর বসলো বাবার পাশে। ” মিষ্টি মা কিন্তু পুডিং খুব ভালো বানায়। ”
ছেলের কথায় হাসলেন সওলাত। ভদ্র মহিলা কে অবহেলা করলে ও জীবনের অনেক গুলো বছর এক ছাদের নিচে কাটিয়েছেন। পরিস্থিতি আজ ছেলের মুখ থেকে মায়ের হাতের রান্নার প্রশংসা শোনায়। সমীর আবার বলল ” সিয়াম ও তোমার মতো পুডিং খেতে ভালোবাসে। ”
প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ছেলের পানে তাকালেন সওলাত। সিয়ামের মুখের অভিব্যক্তি দৃঢ়। ছোট সময়ে পুডিং খেতে চাইতো না সিয়াম। ডিমের গন্ধ বলে চেচাতো। সেই ছেলের প্রিয় খাবার নাকি পুডিং!
সিয়াম প্রায় উঠেই যাচ্ছিল। মিষ্টি হাত ধরে ফেললেন।
” আমার শিক্ষায় কোনো বেয়াদবি ছিল কি সিয়াম? ”
লজ্জিত বোধ করলো সিয়াম। মাথা নিচু করে বলল
” দুঃখিত মা। ”
” ঠিক আছে। বসো তুমি। খাবার খেয়ে তৈরি হয়ে নাও। আমরা ফ্লান্স যাচ্ছি। ”
অবাক হলো সিয়াম। মিষ্টি চলে গেলেন সেখান থেকে। স্নেহার সাথে দেখা করা প্রয়োজন। সেদিন মেয়ে টি কে খুব বকে দিয়েছিল। হতাশ হলো সিয়াম। নিজের রাগ গুলো আজকাল তীর তীর করে বেড়ে যায়।
ঘন্টা খানেক এর ব্যবধানে স্নেহার সাথে দেখা করলো সিয়াম। মেয়েটি ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে। কখনো এভাবে কান্না করে না। আজ খুব কষ্ট হচ্ছে। পাশে বসে থেকে সিয়াম ও যে ভেতরে ভেতরে ভেঙে পরেছে। হয়তো সেসব জানে না স্নেহা। মেয়েটির হাত দুটো বুকের মাঝ খান টায় রাখলো সিয়াম। ” স্যরি জান। আমি যে কি করি আজকাল। শুধু শুধু সেদিন বকে দিয়েছি। আর তারপর খোঁজ ও নেই নি। ”
স্নেহার একটি সমস্যা রয়েছে। সমস্যা টি হচ্ছে কান্না করলে কান্না থামাতে পারে না। এই সহজাত সম্পর্কে অবগত ছিলো সিয়াম। সেই জন্যেই মেয়েটি কে বুকে চেপে ধরে মাথায় হাত বুলাতে লাগলো। অনেক টা সময় ওভাবে পাড় হলো। শেষে শান্ত হলো স্নেহা। চোখ ফুলে গেছে। নাক টা লাল বর্ণ!
” কান্না করলে তোমায় এতো সুন্দর লাগে জানতাম না তো। ”
” বাজে কথা। ”
” সত্যি বলছি। আমার মনে হচ্ছে তোমাকে আবার কাঁদাই। আর তারপর চেয়ে থাকি লাল টুকটুকে মুখের পানে। ”
মেয়েটির তুলতুলে হাত টা সিয়ামের বুকে গিয়ে ঠেকলো। ব্যথা পাওয়ার অভিনয় করে আহ করে উঠলো সিয়াম। স্নেহার হঠাৎ বিচলিত হয়ে যাওয়া টা ভালো লাগলো সিয়াম এর। মেয়েটি যখন বুঝলো তখন ধাম করে কিল বসিয়ে দিলো। নরম তুলতুলে হাতের জোরে এবার বেশ ভালো ব্যথা পেয়েছে সিয়াম। তবে স্নেহা এলো না আদর দিতে। বরং মুখ ঘুরিয়ে রইলো।
কল বাজলো। ভাইয়ার কল। সিয়াম বুঝলো সময় হয়ে এসেছে। বাসায় ফেরা দরকার। স্নেহা কে পেছন থেকে জড়িয়ে নিলো। হাতের মধ্য হাত গলিয়ে দিয়ে ঘাড়ে ঠোঁট ছোয়ালো। স্নেহা ভেসে যাচ্ছে সিয়ামের ভালোবাসায়। চোখ বন্ধ করে অনুভব করছে উত্তেজনা। ঠিক তখনি সিয়াম জানালো ” মাস ছয়েক এর জন্য ফ্রান্সে যাচ্ছি। নিজের খেয়াল রেখো। ”
চলবে……
কলমে ~ ফাতেমা তুজ
#শখের_সাদা_শাড়ি_২
১৪.
সৌমেনের সাথে সম্পর্ক টা জটিল হয়ে যাচ্ছে ক্রমশ। উর্মি পারছে না হুট হাট, করে বসা সাধারণ প্রশ্নের উত্তর দিতে।ছেলেটার কথার বেশির ভাগ অংশ জুড়েই প্রেম ভালোবাসা।সেসবের উত্তর দিবে কি করে উর্মি?
এদিকে মেঘনাকে ও কিছু বলা হয় না আজকাল। নতুন জায়গা, নতুন স্থান,নতুন জীবন। সব মিলিয়ে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টায় আছে মেয়েটি। তাকে এসবের মাঝে কি করে আনবে উর্মি?
সমীর ফ্রান্সে যাওয়ার পর থেকে আর কথা হয় নি। এক টা সপ্তাহ কেঁটে গেল। ফোন করলে ও বা এসব কথা জানাবে না উর্মি। এগুলো শুনলে সমীর এর মন খারাপ হবে। সে মন খারাপ এক সময়ে দ্বিধার দেয়াল গড়বে। আর তারপর ই হবে মনমালিন্য। এতো কিছু সহ্য করার ক্ষমতা এখন আর নেই উর্মির। মেয়ে টি প্রায় উন্মাদ হয়ে যায়। সব কিছু মিলিয়ে জীবনের বাজে সময় যাচ্ছে। এসব পাত্তা না দেওয়ার কোনো উপায় নেই। যা আছে তা হলো সহ্য করে নেওয়া। সেটাই করে উর্মি। নানান ভেজালের মধ্য দিয়ে বিদেশী ডাক্তার দেখানো হলো। সেখানে ও খুব বেশি রেসপন্স নেই। সকলেই বলে ধীর স্থির হতে। এটি একটি দীর্ঘ মেয়াদী রোগ। সারতে সময় লাগবে। ধৈর্য্য ধরুন। অথচ উর্মি একদম ই পারছে না ধৈর্য্য ধরতে। চা বানাতে বানাতে এসব ই ভাবছে উর্মি। অন্য মনস্ক স্বরূপ হাতে ছ্যাকা খেল। কিছু সেকেন্ডেই লাল হয়ে গেল হাত টা। আর তারপর ই পরলো ফোসকা। উর্মির আর্তনাদ! সৌমেন ওর পাশেই ছিলো। শুনতে পেল আর্তনাদ টা। ছুটে এলো। উর্মি মেঝে তে বসে পরেছে হাত চেপে। সৌমেন তখনো বুঝে নি কি হয়েছে। ” কি হলো তোমার। হাত চেপে আছো কেন? ”
কথা বলতে পরছে না যন্ত্রণায়। উর্মির হাত লক্ষ্য করলো সৌমেন। আঁতকে উঠলো ছেলেটা। কাদঁছে উর্মি। না চাইতে ও কান্না আসছে দু চোখ বেয়ে। সৌমেন উঠালো ওকে। ধীরে স্বস্তে নিয়ে বসালো সোফা তে। হেলে রইল মাথা। ঠোঁট কামড়ে আর্তনাদ সামলানোর চেষ্টা! সৌমেন তড়িঘড়ি করে মলম নিয়ে এসেছে। খুব ধীর হাতে লাগাচ্ছে। তবু আর্তনাদ করলো উর্মি ” ধীরে করুণ। ”
” হু। ”
” ব্যথা পাই তো। ”
” একটু ব্যথা তো লাগবেই। হাতের অবস্থা টা একেবারে নাজেহাল। ”
” অনেক টা পুড়েছে? ”
” বেশ ভালোই। তবে হলো টা কি করে। চুলোতেই চা বসানো। তবু হাতে…! ”
” অন্য মনস্ক ছিলাম। সে জন্যেই ভুল করে হাত টা চলে গেছে গরম পানি তে। ”
” অদ্ভুত! মনোযোগ হারাচ্ছো আজকাল। আগে তো এমন ছিলে না। গোছানো স্বভাব টা কোথায় হারিয়ে গেল? ”
উর্মি চুপ। সৌমেন আর ও কিছু সময় বকবক করলো। এক পর্যায়ে গম্ভীর হয়ে উঠলো। উর্মি বুঝতে পেরেছে সৌমেনের মুড চেঞ্জ হয়েছে। এক রাশ কালো মেঘে এসে ভর করেছে মুখে। সৌমেন এর মুখে বিরক্তি। একটু আগের করা বকবক গুলো কোথায় যেন হারিয়ে গেল। ধবধব পা ফেলে চলে গেল লাইব্রেরি। দিনের বেশ কিছু সময় বই বোঝাই করা ঘরেই থাকে সৌমেন। বাসা থেকে একা বের হতে পারে না। প্রথম প্রথম খুব চটলে ও ধীরে ধীরে বুঝতে পেরেছে সত্যিই কোনো অসুখ করেছে ওর। যে অসুখের মেয়াদ দীর্ঘ আর প্রখর যন্ত্রণার!
মেয়ের খোঁজ না পেয়ে আজ চলে যাচ্ছেন লুবনা। কোনো লাভ হলো না খুঁজে। কোথায় যেন হারিয়ে গেল মেয়েটা। খোঁজ নেই কোনো। যাওয়ার আগে হাউ মাউ করে কাঁদলেন। ওনার ধারণা কৃতকাজের ফল পাচ্ছে লায়লা। মেয়ের হাজার ভুল হলে ও মেয়ে কে ফিরে পেতে চান তিনি। এবার বেঁধে রাখবেন ঘরে। তবু ফিরে চান গর্ভের সন্তান টি কে। উর্মির খারাপ লেগেছে আজ। মা কে হারিয়েছে বহু বছর। তাই মা জিনিস টা বহু অচেনা ওর নিকট। যদি ও লতিফার আচরণ সুন্দর। তবু ও একটা নিজস্ব মায়ের অভাব অন্তর কে পুড়াচ্ছে।
দীর্ঘ মাস গুলো তে বাড়ির সবাই এই টুকু তো অনুভব করেছে উর্মি আর সৌমেন স্বাভাবিকতায় নেই। কোথাও একটা ভয় সংকোচ! তাই প্রথম দিকে সৌমেন এর ঘরে না ঘুমানোর জন্য কথা হলে ও আজকাল কেউ আর প্রশ্ন করে না। সৌমেন ও যেন মেনে নিতে শিখেছে। তবে হুটহাট আজকাল তাচ্ছিল্য করে। বলে তুমি বদলে গেছো মাইসা। কখনো বা বলে প্রেম ভালোবাসার কথা। আবার কখনো কাছে আসার বাহানা। তবে কোনো কিছু তেই বিশেষ জোড় নেই। যদি সৌমেন সুস্থ থাকতো তাহলে হয়তো ঘটনা এমন হতো না। সৌমেন আজ আচানাক বায়না করলো ” আজ পূর্নিমা। বড় করে চাঁদ উঠেছে আকাশে। চাঁদ দেখবে আমার সাথে? ”
জানালা দিয়ে চাঁদ টা এক পলক দেখলো উর্মি। দারুণ সুন্দর! মানা করার মতো কারণ পেল না খুঁজে। কিছু খাবার নিয়ে সৌমেন এর সাথে চাঁদ দেখতে বসলো। ছাঁদ টা বিশাল হলে ও এর এক পাশ টা ফুলে ভরপুর। যেন একটুকরো ফুল কে বসানো হয়েছে। মাঁদুর পেতেছে সৌমেন। ছোট সময়ে গ্রামের বাড়ি তে এভাবে মাঁদুর পাততো ওরা। সেই সব স্মৃতি স্মরণ করেই হয়তো এই আয়োজন। উর্মি আর সৌমেন পাশাপাশি বসে। দমকা হাওয়ায় উড়ে যাচ্ছে চুল। শাড়ির আঁচল উড়ে যাচ্ছে এধার ওধার। উন্মুক্ত কোমর খানা ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। সৌমেন এর চোখ ছিল আকাশের দিকে। ঐ সুন্দর চাঁদকে দেখতে দেখতে বেমালুম ভুলে বসলো পাশে থাকা চাঁদের কথা। মনোযোগের ব্যঘাত ঘটে যখন পাশে তাকায়। তখন উর্মি চোখ বুজে আছে। অশান্ত বাতাসে উর্মির নারী সৌন্দর্য্য উন্মুক্ত। কয়েক বার নিজেকে শাসন করলো বোধহয়। তবে বেশি সময় নিজেকে স্থির রাখতে পারে নি সৌমেন। অনেক টা কাছাকাছি চলে এসেছে। উর্মির তখন ধ্যান নেই। মেয়েটি বোধহয় কল্প লোকে আহরণে ব্যস্ত। হুট করেই সৌমেন এর হাত উর্মি কে আঁকড়ে ধরেছে। উথাল পাথাল স্পর্শে উর্মি নিজে ও কুল হারিয়েছে। উর্মি ঘোরে আছে। সেই ঘোর থেকেই আরেকটু স্পর্শ পাওয়ার আকুলতা দেখা গেল। সৌমেন নিজে ও দ্বিধাহীন ভাবে ছুঁয়ে চলেছে। এক সময় মেয়েটির শুষ্ক অধরের দখল নিয়ে নিলো। খামচে ধরলো উর্মি। যখন খেয়াল হলো দুজনেই অনেক খানি এলোমেলো। উর্মির চোখ দিয়ে পানি পরছে। সৌমেন এর থেকে ছিটকে সরে এলো। প্রকৃতির সাথে এতো টাই মিশে গিয়েছিল যে সামনে থাকা মানুষ টি যে সৌমেন সেটাই ভুলে বসেছিল। নিজের প্রতি ঘৃনা কাজ করছে খুব। ছুটে চলে গেল মেয়েটি। সৌমেন ও প্রায় অবাক! ওর মস্তিষ্কে বুঝতে পারে না কোনো কিছুই। সাধারণ বিষয় টি কে উর্মি যেন অনেক টা জটিল করে তুললো!
” স্যার আপনি দয়া করে সৌমেন স্যার কে বিদেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করুণ। ”
এখন মাঝ রাত্রি। মাহফুজ সাহেব ড্রয়িং রুমে বসে খবরের কাগজ পড়ছিলেন। এটা ওনার স্বভাবের একটি। রাত্রি বেলা সংবাদ পত্র পড়া। উর্মি এসেই হুট করে এমন কথা বলে দিলো যে মাহফুজ সাহেব স্থির থাকতে পারলেন না। উঠে এলেন কাছে। ” কি হয়েছে উর্মি? তোমাকে এমন অশান্ত লাগে কেন? সব ঠিক তো?”
” কিছু ঠিক নেই স্যার। এভাবে আর কতো দিন? সকলে জানে আমি এ বাড়ির বউ। সৌমেন স্যার আমাকে নিজের স্ত্রী ভেবে বসে আছেন। বুঝতে পারছেন দিন কে দিন ঘটনা কতো টা কঠিন হয়ে উঠেছে।”
” তোমার কথা মিথ্যে নয় উর্মি। তবে দেখো এখনি সব টা করা সম্ভব নয়। ডাক্তার তো বললেন একটু সময় লাগবে। দেখছো না ছেলেটা আগের থেকে পরিবর্তন হয়ে এসেছে। ”
” সেটাই প্রবলেম স্যার। ওনার পরিবর্তন আমার উপর প্রভাব ফেলছে। ”
শেষ কথা টা বলতে গিয়ে উর্মির গলা ধরে এলো। উর্মি শেষ করতে পারলো না কথা গুলো। মাহফুজ সাহেব চিন্তায় পরলেন। নিজ কক্ষে এসে মেঝে তে মাথা ঠেকিয়ে বেডে শুয়ে রইলো উর্মি। তখনি দরজায় নক করলো সৌমেন। উর্মি উঠে বসলো। সৌমেন কাছাকাছি এসে বসতেই উর্মির হৃদয়ে ঝড় এলো। স্বাভাবিক থাকতে হবে ওকে। না হলে সৌমেন স্যার অস্বাভাবিক হয়ে উঠবেন। আর উর্মি নিজের কথার খেলাপ করবে না। কোনো কিছুর বিনিময়েই নিজের কথা ফেলবে না উর্মি। অন্তত আর ও কিছু সময় হলে ও সব টা সহ্য করে যেতে হবে। যতো কষ্ট ই হোক না কেন মেনে নিতে হবে সব টুকু।
**আমি একটা সামাজিক উপন্যাস লিখছি।সামাজিক উপন্যাসে আপনি ঘনিষ্ঠতা কম পাবেন। খুব ই সহজ সরল প্রেম পাবেন। তাই যারা রোমান্টিকতার জন্য অস্থির হোন না তাদের জন্য ই এই উপন্যাস।সমস্ত রহস্য খোলসা হবে ২১ পর্বে। গল্পের সমালোচনা, আলোচনা উন্মুক্ত।শুধু ভাষার ব্যবহার টা সুন্দর করার অনুরোধ।**
চলবে….