মেঘের_পালক,১০,১১

0
905

#মেঘের_পালক,১০,১১
সুমাইয়া আমান নিতু
পর্ব-১০

অরিনকে দেখার পর থেকেই প্লাবনের মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। কী দারুণ লাগছে অরিনকে! এতটা দিন কত চেষ্টা করেছে মেয়েটাকে ভুলতে, কিন্তু ভুলতে পারেনি। কোনো না কোনোভাবে ঠিকই মনে পড়ে গেছে। পৃথিবীটা সত্যিই গোল। তাই জন্যই আবার দেখা হলো তাদের। আর আজ দেখার পর থেকে চোখ ফেরাতে ইচ্ছে করছে না প্লাবনের। অরিন খুব সুন্দর হয়েছে। নাকি এতদিন পর দেখায় সুন্দর লাগছে কে জানে!

প্লাবনের মা বলে রেখেছিল বিয়েতে এসে কোনো মেয়েকে পছন্দ হলে বলতে। প্লাবন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল সে অরিনের কথা বলবে মাকে। এতদিন পর আসলে আগের কথা তেমন কিছু মনে নেই। সেসব যেন মিঠে স্মৃতিতে পরিণত হয়েছে৷ সে মায়ের খোঁজে এদিক ওদিক হাঁটতে শুরু করল। কিন্তু মাকে খুঁজে পেল না। দেখা হয়ে গেল অরিনের সাথে।

দু’জন সামনাসামনি পড়ে প্রথমটায় অস্বস্তিতে পড়ে গেল। প্লাবনই আগে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, “কেমন আছ অরু?”

“অরু মানে? আমার নাম অরিন। নামটাও মনে নাই?”

“আছে তো। আরও অনেক কিছু মনে আছে। ওটা তো আদর করে ডাকলাম।”

“আপনার সাথে আমার আদর করে ডাকার সম্পর্ক?”

“না, তবে হতেও পারে।”

“ইম্পসিবল!”

বলে চলে গেল অরিন৷ প্লাবনের মজাই লাগল৷ অরিনকে বিয়ে করতে পারলে সারাজীবন মিষ্টি ঝগড়া করে কাটবে৷ ব্যাপারটা খারাপ হবে না একেবারেই!

সে আবার মাকে খুঁজতে শুরু করল।

মানুষের মধ্যে একটা বয়সে আপনা থেকেই পরিণত চিন্তাভাবনা আসে। অরিনেরও এসেছে৷ এক বছরেই সে অনেকটা বড় হয়ে গেছে। তার একটা কারন বোধহয় অর্থনৈতিক সমস্যায় পড়া। জীবনযুদ্ধে নেমে পড়ায় আগেকার ফ্যান্টাসি এখন আর নেই। তবু মনটা এত অস্থির লাগছে ক’দিন ধরে প্লাবনকে দেখার পর থেকে! কী সমস্যা কে জানে! এমন তো কখনো কারো জন্য হয় না।

ভোরে সে বের হয়েছে ক্লাসে যাবে বলে। বৃষ্টি পড়ছে টিপটিপ করে। রিকশা না পেয়ে হেঁটেই বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছুল সে। বাস আসছে সব ভর্তি হয়ে। তিল ঠাঁই নেই অবস্থা। কোনো একটায় উঠে পড়লে হয়, কিন্তু ধাক্কাধাক্কি অসহ্য লাগে অরিনের। সে দাঁড়িয়েই রইল।

আচমকা একটা পরিচিত কন্ঠের ডাক শুনে পাশ ফিরল। প্লাবন! সমস্যা কী এর? পরপর দুদিন দেখা পাওয়া গেল মহাশয়ের! ওকে ফলো করছে নাকি?

“তোমার আজকে ক্লাসে যাওয়া জরুরি অরু?”

অরিন মুখ শক্ত করে বলল, “আমার নাম অরিন।”

“আমি জিজ্ঞেস করেছি ক্লাসে যাওয়া জরুরি কি না!”

অরিনের গলা শুকিয়ে এলো। প্লাবনের কন্ঠে অধিকারবোধ জড়িয়ে আছে। এমন করে কথা বলছে কেন? অরিন শক্ত থাকতে পারছে না। ভেতরে ভেতরে গলে যাচ্ছে। তবু চেষ্টা করল কঠিন হয়ে থাকার। বলল, “অবশ্যই। ক্লাসে না গেলে ফাইন কে দিয়ে দেবে? আপনি?”

“নাহয় একদিনের ফাইন দেব। চলো যাই কোথাও বসি।”

“আমার ইম্পর্টেন্ট ক্লাস আছে।”

“মিথ্যে বলছ কেন? আজকে কোনো জরুরি ক্লাস নেই। অর্নবের কাছেই শুনলাম।”

কথাটা সত্যি। তাই ফিরতি আরেকটা মিথ্যে বলতে ইচ্ছে হলো না অরিনের। সে বলল, “আমার কোথাও বসার সময় নেই। বাস পেলে ক্লাসে যাব, নয়তো বাসায়।”

“জাস্ট একটু। অল্প কথা শোনার মতো মানসিকতা তোমার নিশ্চয়ই আছে। আমি এত খারাপ লোক নই।”

“ঠিক আছে।”

“বসবে?”

“না। আপনি যে খারাপ লোক নন সেটা মেনে নিলাম।”

“তাহলে বসতে কী সমস্যা?”

“ইচ্ছে নেই।”

প্লাবন চুপ করে গেল। বাস পাওয়া গেল না একটাও। এদিকে বৃষ্টি নেমে গেল জোরেশোরে। দুজনার কাছেই ছাতা আছে, তবে এই তুমুল বৃষ্টিতে সেই ছাতা কাজে দেবে না। অরিন ছাউনির নিচে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়াল। সে আর প্লাবন ছাড়া কাছাকাছি একটা মানুষও নেই।

প্লাবন জিজ্ঞেস করল, “তোমার বৃষ্টি দেখতে কেমন লাগে?”

অরিন যথাসম্ভব গম্ভীর হয়ে উত্তর দিল, “ভালো।”

“আমার কিন্তু ভীষণ ভালো লাগে। ইচ্ছে করে মুগ্ধ হয়ে দেখতেই থাকি। এইযে প্রকৃতির প্রতি প্রেম, এটা কেন হয় বলতে পারো?”

“জানি না।”

“ধরো তুমি খুব বিশাল এক সবুজে ঘেরা পাহাড়ের সামনে দাঁড়িয়ে আছ, যার গায়ে জন্মে আছে অগণিত গাছপালা, পথে বুনোফুল, পাহাড়ের বুক ফেটে বেরিয়ে আসা স্বচ্ছ ঝর্ণা! কিংবা ধরো সমূদ্র, প্রথমবার দেখলেই তার সাথে প্রেম হয়ে যায়। কেন হয়? শুধু সুন্দর বলেই? না, তারা আমাদের চোখের সাথে সাথে তাদের বিশালতা আর গভীরতা আমাদের ভেতরের শান্তি যোগায়। ঠিক তেমনটা আমরা কেন মানুষের ক্ষেত্রে ভাবি না বলো তো? আমি যখন তোমাকে প্রথমবার ভালোবাসি বলেছিলাম তখন তোমার চোখে আমি সেই অজস্র আনন্দের ধারা দেখতে পেয়েছিলাম। তোমার মুখ দেখে এতটা শান্তি লাগছিল যে বলে বোঝাতে পারব না। হ্যাঁ, প্রপোজটা মিথ্যে ছিল, কিন্তু তারপরের পুরোটা সত্যি ছিল অরু!”

অরিন তাকে অরু বলার জন্য এবার কিছুই বলল না। কথাগুলো তার মাথায় প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। প্লাবনও তাকে সময় দিল একটু বুঝতে।

অরিন কিছুক্ষণ পর প্রশ্ন করল, “আর চিঠিটা?”

“ওহ! ওটার জন্য স্যরি। আমি নিজে চিঠিফিঠি কখনো লিখিনি। ইঞ্জিনিয়ারিং পড়েছি বলে মনে সেরকম রসকসও নেই যে রাগ ভাঙানোর জন্য সুন্দর করে চিঠি লিখব৷ তাই অন্যের সাহায্য নেয়া। আমি স্বীকার করছি কাজটা উচিত হয়নি।”

“তাই বলে অর্নবের লেখা চিঠি….”

“অর্নবের হবে কেন? আরেক বন্ধু আছে৷ আমার আর অর্নবের কমন ফ্রেন্ড। নাম উদাস। খুবই ইন্টারেস্টিং ক্যারেক্টার। তোমাকে দেখা করিয়ে দেব তার সাথে।”

“আচ্ছা।”

চিঠিটা অর্নবের লেখা না হওয়ায় অরিন একটু স্বস্তি পেল। তার এখন শীত শীত লাগছে। বৃষ্টি কমে আসছে। প্রচন্ড বাতাস বইছে। বাতাসের সাথে গায়ে ঠান্ডা পানির টুকরো ছিটিয়ে দিয়ে যাচ্ছে।

প্লাবন বলল, “খুব রোমান্টিক ওয়েদার না?”

“হুম।”

“একটা কথা বলব অরু?”

“বলুন।”

“তার আগে বলো তুমি আমাকে আপনি বলছ কেন? তুমি করে বলবে।”

“কী কথা সেটা বললে ভালো হয়।”

“ওহ! কথাটা হলো, তুমি কি সত্যিই খুব গালাগালি করতে পারো? সেদিন যা সব লিখেছিলে! ওসব মুখেও বলো? আমার আবার গালাগালি সহ্য হয় না একেবারেই। তুমি যদি…”

অরিন রেগে গিয়ে বলল, “আপনি যেমন চাইবেন আমি তেমন হয়ে দেখাব? এত ঠেকা কেন আমার? গালি দিতে চাইলে একশো বার দেব৷ আপনি না করার কে?”

অরিনের গাল দুটো ফুলে উঠেছে। প্লাবন রাগ করতে গিয়েও করতে পারল না। তার হাসি পেয়ে গেল। অরিনকে বাচ্চা মেয়েদের মতো লাগছে। সে কাছে গিয়ে অরিনের গালদুটো টেনে দিল।

ঝটকা দিয়ে সরে গেল অরিন। চেঁচিয়ে বলল, “আপনি আমার গায়ে হাত দিচ্ছেন কেন?”

প্লাবন একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল। তাদের সম্পর্কটা আসলে গোলমেলে। বাজে রকমের ভুলভাল কাজকর্ম তারা শুরু থেকে করে সেটাকে আরও জটিল পর্যায়ে নিয়ে গেছে। প্লাবন ভেবেছিল আজ কোনো ভুল করবে না। কিন্তু হয়েই গেল।

অরিনের গালদুটো আরও ফুলেছে। সাথে লাল হয়ে আছে মুখ। রাগে নাকি লজ্জায় বোঝা যাচ্ছে না।

প্লাবন দুই হাত ওপরে তুলে বলল, “আচ্ছা স্যরি! তুমি বোঝার চেষ্টা করো অরু, আমি তো তোমাকে সব বললাম।”

“আমি কিছু বুঝতে চাই না। আপনার ওপর আমার কোনো ইন্টারেস্ট নেই। বাংলাদেশে আরও অনেক মেয়ে আছে। আপনি শুধু আমাকেই চোখে দেখেন? আপনার পেছনেও তো কত মেয়ের লাইন! আমাকে জ্বালাবেন না প্লিজ।”

প্লাবন হতাশ হয়ে কিছু একটা বলতে যাবে, তার আগেই একটা বাস এসে থামল। মোটামুটি ফাঁকা বাসটা। অরিন চোখের পলকে উঠে বসল সেটাতে। বাসটাও হাওয়া হয়ে গেল দেখতে দেখতে। প্লাবনের খুব খারাপ লাগতে লাগল।

এদিকে অরিন বাসে উঠে একটা খালি সিটে বসে কেঁদে ফেলল। সে জানে না বাড়াবাড়ি করে এসেছে কি না। কিন্তু মনে বড্ড বেশি অভিমান জমে গেছে। এতই যখন প্লাবনের প্রেম, তাহলে এই এক বছর সে ছিল কোথায়? এতদিন পর এসে এত অধিকার দেখায় কেমন করে?

(চলবে)

সুমাইয়া আমান নিতু

#মেঘের_পালক
পর্ব-১১

“এটা কী নিলি? এই শার্ট তুই পরিস?” বিরক্ত হয়ে বললেন প্লাবনের মা।

“ওহ তাই তো! ভুল করে নিয়েছি।”

“তোর কী হয়েছে বলবি?”

“কিছুই না মা!”

প্লাবনের মা চিন্তায় পড়ে যান৷ এই ছেলে এক বছর ধরেই পাগল হয়ে আছে বিয়ের জন্য। অসংখ্য মেয়ে দেখেও পছন্দ হয়নি। তিনি জানেন এর পছন্দ আটকে আছে অন্য কোথাও। কিন্তু সেই মেয়ের কথা হাজার চেষ্টা করেও পেট থেকে বের করা যায়নি৷ কী আর করার! তার ওপর সেদিন বিয়েবাড়ি থেকে ফেরার পর থেকেই আরও আনমনা হয়ে গেছে। কী সমস্যা কে জানে!

আজ তারা রওনা দিচ্ছে ট্যুরের জন্য। পাহাড় দেখতে যাওয়া হবে। প্লাবনের মা ও তার কিছু বান্ধবী একত্রে ট্যুর প্ল্যান করেছে। শুধু নিজেরা যাবে না, ছেলেমেয়েও নিয়ে যাবে। একেবারে ফ্যামিলি ট্যুর। বড় একটা বাংলো পাওয়া গেছে৷ সেখানেই থাকবে৷ দিনে ঘুরবে, তাতে আগুন জ্বালিয়ে আড্ডা দেবে, কত পরিকল্পনা! প্লাবনের খুব একটা ইচ্ছে ছিল না এই মহিলাদের ভিড়ে। মা তাকে একপ্রকার জোর করে নিয়ে যাচ্ছে। তার প্লাবনকে নিয়ে অন্যরকম পরিকল্পনা আছে কি না!

মালপত্র টেনে বাস পর্যন্ত যেতে যেতে হাঁপিয়ে উঠল অরিন। মা বোধহয় বাড়ির সব নিয়ে এসেছে ব্যাগে। চারদিনের ট্যুরে এতকিছু নিয়ে কী করবে? আজব!

সে হাত থেকে ভারী কাপড়ের ব্যাগটা রেখে কোমরে হাত দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল। জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিচ্ছে। তার মায়ের বান্ধবীদের সে ঠিকঠাকমতো চেনে না। অনেকে তার দিকে তাকিয়ে আছে। সে কী করবে? সালাম দেবে? কাকে দেবে? একেকজন একেক দিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অতঃপর যার সাথেই চোখাচোখি হলো, হাসি বিনিময় করে এ যাত্রায় সৌজন্য রক্ষা করল।

বাস যেখানে দাঁড়িয়ে আছে তার সামনে একটা ছোট্ট চা পানের দোকান। এখন ভোর। অল্প কিছু খদ্দের দোকানে। সকালের মৃদু বাতাসে ভেসে যাচ্ছে চায়ের কেটলি থেকে ওঠা ধোঁয়া। এক বুড়ো নামাজ পড়ে এসে বোধহয় চা খেতে বসেছে৷ একজন ভোরবেলাতেই পান মুখে দিয়ে বসেছে। পিক ফেলছে ফুটপাতের সিমেন্টের কিনারা থেকে গজিয়ে ওঠা বটগাছের পাতার ওপর। দৃশ্যটা মন দিয়ে দেখল অরিন। একটা আর্টিস্টিক ব্যাপার আছে৷

“হাই অরিন!”

চেনা গলায় চমকে উঠে তাকাল অরিন৷ এ কি দেখছে সে! এই ছেলে এখানে আসবে কেমন করে?

“আপনি এখানে?”

“চলে এলাম।”

অরিন রেগে গিয়ে বলল, “আমার পিছু নিচ্ছেন?”

“মোটেও না। আমি কেন তোমার পিছু নেব?”

“তাহলে?”

“ট্যুরে যাব তাই এসেছি।”

অরিনের মেজাজ বিগড়ে গেল। যদিও মনের একপাশ বলছে, সকালটা আরও সুন্দর করে দিল এই সুন্দর মানুষটা৷ আর অন্যপাশ বলছে, অসহ্য ছেলেটার সাথে তার কপাল বুঝি আঠা দিয়ে জোড়া দেয়া। কিছুতেই পিছ ছাড়বে না!

অরিন আর কিছু বলল না। মুখ ইচ্ছে করে গোমড়া করে রাখল। বাসে ওঠার সময় হলে উঠে বসল। আরও অনেকে এসেছে। মায়েদের বয়স অনুযায়ী ছেলেমেয়েরাও বড় বড়। অরিন একটা বান্ধবী জুটিয়ে ফেলল। নাম হুমায়রা। প্লাবনের সাথে যে ছেলে দুটোর কথা হলো তারা জমজ। নাম নয়ন, নবীন৷ আরও একটা মেয়ে এসেছে, নাম ইনায়া। এই সকালবেলাতেও যা সাজগোজ করে এসেছে তাতে অনেকেরই মুখ হা হয়ে গেছে৷ ইনায়া গিয়ে বসল স্বাধীনের পাশে। স্বাধীন ছেলেমেয়েদের মধ্যে সবার বড়। বেশ ভালো চাকরি করছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই পরিবেশ জমে উঠল। হাসি, গানে শুরু হলো যাত্রা।

অর্ধেক রাস্তায় যাত্রাবিরতির সময় অরিন বাস থেকে নামল হাত পা একটু সচল করে নেবার জন্য। জার্নিটা তার ভালোই কেটেছে, তবে বারবার চোখ চলে যাচ্ছিল প্লাবনের দিকে, এই যা সমস্যা। আর প্লাবন তো বোধহয় তার দিকেই আঠার মতো তাকিয়ে ছিল পুরোটা সময়। অবশ্য আরেকটা ইচ্ছে আছে অরিনের বাস থেকে নামার। সে একটু দূরে চলে যাবে এটা দেখতে যে প্লাবন আসে কি না। কেন যেন একটু কথা বলতে ইচ্ছে করছে।

প্লাবন এলো না৷ এলো প্লাবনের মা। ওকে দূরে যেতে দেখে ডেকে বলল, “অ্যাই অরিন, এদিকে এসো তো মা।”

মহিলা এত মিষ্টি যে এই ডাক উপেক্ষা করা যায় না। অরিন গেল। তার দুই হাতে দুটো আইসক্রিম। একটা চকোলেট, একটা ভ্যানিলা। বললেন, “দেখো না, ছেলেটা কোথায় চলে গেল! ওর জন্য চকোলেট আইসক্রিম কিনলাম, এখন হাওয়া! তুমি খাও এটা প্লিজ। নইলে শুধু শুধু নষ্ট হবে।”

অরিন একটু অপ্রস্তুত হয়ে গেলেও আইসক্রিমটা নিল। প্লাবনরে মা গল্প জুড়ে দিলেন। রাজ্যের গল্প! সবটা সংসার আর প্লাবনকে নিয়ে। অরিনের পছন্দ হয়ে গেল তাকে। বেশ গুছিয়ে কথা বলেন। আর খুবই খোলা মনের। সে এটাও ভেবে ফেলল, এই মহিলা তার শ্বাশুড়ি হলে খারাপ হতো না!

একটু পরেই উপস্থিত প্লাবন। এগিয়ে এসে ভুরু কুঁচকে বলল, “মা আমার আইস…”

“ওকে দিয়ে দিয়েছি। আইসক্রিম তোর জন্য বসে থাকবে নাকি? গলে পানি হয়ে যেত এতক্ষণে। ছিলি কোথায় তুই? একটা বারও…” বলতে বলতে চেঁচামেচি শুনে থেমে গেলেন৷ তাদের দলের এক মহিলা খুব চিৎকার করছেন এক পাগল তাকে ভেঙচি কেটে বুড়ি বলেছে বলে। সবাই সেদিকে চলে গেল।

এদিকে অরিনের প্রায় শেষ হয়ে আসা আইসক্রিমটা ছোঁ মেরে নিয়ে গেল প্লাবন। বলল, “আমার জন্য ছিল এটা।”

বাকি আইসক্রিমটুকু খেয়ে শেষ করে কাঠিটা দূর থেকে ডাস্টবিনের দিকে নিশানা করে ভেতরে ফেলতে পেরে বেশ তৃপ্ত হয়ে কোথায় চলে গেল! অরিন বেশ কিছুক্ষণ ঠিকমতো বুঝল না ঘটনা কী ঘটল!

বাস চলতে শুরু করল আবার৷ এবার সবাই একটু ঝিমিয়ে পড়েছে। একেবারে গন্তব্যে পৌঁছে দুপুরের খাবার খাবে বলে একটু যেন অস্থিরও হয়ে আছে সবাই, যদিও টুকটাক কিছু খাওয়া হয়েছে।

রুনা নামের খুব ফর্সা এক মহিলা দারুণ গান জানেন। তিনি শুধু গান গেয়ে যাচ্ছেন একটার পর একটা। এখন চলছে, “সে এক রূপকথারই দেশ..ফাগুন যেথা হয় না কভু শেষ…”

পৌঁছুতে প্রায় বিকেল হয়ে এলো। রোদ পড়ে আসছে। সূর্যের হলুদে কমলার ছটা লেগে গেছে। তারা যখন বাংলোতে ঢুকল তখন সবারই ক্লান্তিতে চোখ বুজে আসার অবস্থা। সবাই সার বেঁধে ঢুকছে, এমন সময় স্বাধীন অরিনের পাশে চলে এলো। তাদের বাসে পরিচয় হয়েছে শুধু। স্বাধীন বলল, “একদম মহিলা নিয়ে আমি ট্যুরে আসব কোনোদিন ভাবি নাই। এত অদ্ভূত ট্যুর কেউ দেয়?”

অরিনের কথাটা ঠিক ভালো লাগল না। সে বলল, “আপনি ওনাদের নিয়ে আসেননি, বরং সাথে এসেছেন।”

কথাটা শুনে স্বাধীন অরিনের দিকে চোখ তুলে ভালো করে তাকাল। ঠোঁটে মৃদু হাসি। কেন যেন অরিনেরও হাসি পেল। সে হাসিটা ফেরত দিল। তারপর ঢুকে গেল বাংলোর ভেতর। বিশাল বাংলো। একতলার দুটো ভাগ। যার যার প্রয়োজনমতো একটা বা দুটো ঘর নিয়ে নিল। বেয়ারা জানাল খাবার তৈরি আছে, ফ্রেশ হয়ে এসে খেয়ে নিতে পারে।

অরিন ঘরে ঢুকে ধপাস করে শুয়ে পড়ে চোখ বুজে ফেলল। তার মা তার তুলনায় ভালো অবস্থায় আছে। তিনি বসে বললেন, “অ্যাই, শুবি না। ওঠ! গোসলে যা। তারপর আবার আমি যাব। খেতে হবে। ক্ষুধা লাগে নাই তোর?”

অরিন শুয়েই রইল। নড়তে ইচ্ছে করছে না।

প্লাবন ঘরে ঢোকেনি। সে নয়ন আর নবীনের সাথে রুম শেয়ার করবে। ওরা ঢুকে জিনিসপত্র গোছগাছ করছে। প্লাবনের কিছু ইচ্ছে করছে না। অরিন তখন স্বাধীনের সাথে এত কী কথা বলছিল? কত সুন্দর হাসল! তার সাথে তো কোনোদিন এভাবে হেসে কথা বলল না! গা জ্বলে যাচ্ছে কেন যেন।

ইনায়াকে দেখা গেল লনে হাঁটছে। সবুজ লনের একধারে ছোট্ট গোলাকার ছাউনি দেয়া বসার জায়গা। সেখানে গিয়ে বসল ইনায়া। সেলফি তুলছে। প্লাবনও নেমে গেল। এগিয়ে গেল ইনায়ার কাছে।

ইনায়া তাকে দেখে বলল, “আপনি প্লিজ আমার কিছু ছবি তুলে দিতে পারবেন?”

“অবশ্যই।”

ইনায়া কয়েক রকমের পোজে ছবি তুলল। হাসিমুখে, গোমড়ামুখে, আকাশের দিকে তাকিয়ে, কোমরে হাত দিয়ে, ইত্যাদি।

অরিন গোসল শেষে রুম থেকে বের হয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়াতেই দৃশ্যটা দেখতে পেল৷ প্লাবন হাসিমুখে ইনায়ার নানা রকমের ছবি তুলে দিচ্ছে বাধ্য ফটোগ্রাফারের মতো পেছন পেছন ঘুরছে। আস্ত নির্লজ্জ ছেলে তো! মেজাজ গরম হয়ে গেল অরিনের।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here