কলা_পাতায়_বাঁধিব_ঘর,পর্ব_০২

0
601

#কলা_পাতায়_বাঁধিব_ঘর,পর্ব_০২
#জিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা

রাউফুন ওয়াশরুম থেকে এসে খুঁটি গেঁড়ে বসে রইলো। বাড়ির জামাই রাতটুকু থাকবে বলে সবাই রান্নার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। রাউফুনকে বসে থাকতে দেখে পুষ্প বলল,

-” আমার জ্বর শুনে এসেছেন। আমাকে দেখা শেষ, তাহলে এখনো বসে আছেন কেনো? নিজের বাসায় যান। আপনার ডিউটি নেই? রোগীরা আপনার জন্য বসে আছে যান।”

রাউফুন চোখমুখ কুঁচকে নিলো। কথাটি তার মোটেও পছন্দ হয়নি। অবাক হওয়ার সুর তুলে বলল,
-“আমাকে দেখে তোমার এতই দায়িত্ব জ্ঞানহীন মনে হয়? আমার বউ জ্বরে ম’রে যাচ্ছে। তাকে ফেলে আমি কিভাবে হসপিটালে যাবো? আমি প্রথমবার তোমাকে বুদ্ধিমতী ভাবলেও এখন মনে হচ্ছে তুমি মাথামোটা।”

তেতে উঠলো পুষ্প। এই মানসিক রোগী বলে কী? সে নাকি মাথামোটা। দাঁত কিড়মিড় করে বলল,
-“আপনি এখানে থেকে কোন রাজকার্য উদ্ধার করে ফেলবেন শুনি? আপনি এমন ভাব ধরছেন যেন আপনি থাকলেই আমি সুস্থ হয়ে যাবো।”

রাউফুন জবাব দিলোনা। ঘর ছেড়ে বের হলো। পুষ্প স্বস্তির শ্বাস ফেললো। আপদটা বিদেয় হয়েছে।

নাবিলের ক্ষত শুকিয়ে গিয়েছে। এখন সে হাঁটাচলা, দৌঁড়ঝাপ করতে পারছে। নতুন দুলাভাই পেয়ে সে অনেক খুশি। রাউফের গলায় ঝুলে পড়ে এখন আর নামতে চাইছেনা। নাবিল বলল,

-“আচ্ছা দুলাভাইয়া, তোমারও কি আমার মতো মুসলমানি হয়েছে?”

রাউফুন যেনো বিষম খেলো। তবুও হে হে করে হেসে বলল,
-“শালাবাবু মুসলমানি সবারই হয়।”

নাবিল কৌতুহল দেখিয়ে বলল,
-“কই দেখি দেখি?”

রাউফুনের এবার ইচ্ছে করলো এই কৌতুহলের বাচ্চাটাকে তুলে আছাড় মা’রতে। কিন্তু মনের ইচ্ছেকে মনেই চাপা দিয়ে রাখলো। নয়তো এরা তার নামে কে’স করবে। বউ হয়তো আর তার ঘরেই উঠবেনা। নাকের উপর ডিভোর্স পেপার ছুঁড়ে বলবে “নে রাজাকারের বাচ্চা সাইন করে দে”
রাউফুন ওয়াশরুমের নাম দিয়ে কোনোমতে উঠে গেলো। খাবার টেবিলে সবাই বসলেও পুষ্প আসলোনা। তার খাবার ঘরে দিয়ে আসা হলো। এদিকে নাবিল ধরে ধরে সবাইকে বলছে,
“জানো আমার মতো দুলাভাইয়ার ও মুসলমানি হয়েছে।”

খাবার টেবিলে রাউফুনকে লজ্জায় পড়তে হলো। সবাই মিটিমিটি হাসলেও নাবিলের বাবা ব্যাপারটাকে ধামাচাপা দিতে কথা অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিলো। রেহানা খালা এক দৌঁড়ে পুষ্পর ঘরে আসলো কথাটি চালান করতে। পুষ্প মাত্র মুখে খাবার তুললো। হন্তদন্ত হয়ে রেহানা খালাকে ঢুকতে দেখে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো।
রেহানা খালা গড়গড় করে বলতে লাগলেন,
-“আম্মাজান তোমার জামাই নাবিলকে বলেছে তার ও নাকি মুসলমানি হইছে।”

পুষ্পর গলায় খাবার আটকে গেলো। লোকটাকে মানসিক রোগী ভাবলেও এখন মনে হচ্ছে চূড়ান্ত লেভের অস’ভ্য, লুই’চ্চা। ছোট মানুষকে এসব কি বলছে? পুষ্প পানি পান করে ঝাঁঝালো কন্ঠে বলল,
-“খালা তুমি আমাকে এসব শোনাতে এসেছো? কাজ নেই তোমার?”

ধমক খেয়ে সুড়সুড় করে রেহানা খালা বেরিয়ে গেলো। প্রথম প্রথম পুষ্প উনাকে আপা ডাকলেও রেহানা ঘোর আপত্তি জানিয়ে বললেন,
-“আম্মাজান আমার কোনো বইন নাই। তাই খালা ডাকনের কেউ নাই। তুমি আমাকে খালা ডাকিও।”

ব্যাপারটা বয়স অনুযায়ী বেখাপ্পা হলেও রেহানার পিড়াপিড়িতে খালাই ডাকতে হয়। খাবার শেষ করেই রাউফুন ঘুমানোর জন্য পুষ্পর ঘরে চলে আসলো৷ এসেই পুষ্পর পাশে সটান হয়ে শুয়ে পড়লো।
পুষ্প রেগে গিয়ে বলল,
-“আপনি এখনো যাননি? এখানে শুয়ে আছেন কেন?”

রাউফুন চোখ বন্ধ রেখেই বলল,
-“তোমাদের সবাই এত এত রিকোয়েস্ট করলো যে না থেকে পারলামনা৷ জামাই মানুষের এত ভাব দেখানো খাটেনা।”

রাউফুন বড় একটা মিথ্যা বললো পুষ্পকে। কেউ তাকে থাকার জন্য জোরাজোরি করেনি। দু’একবার অবশ্য বলেছিলো। তাই সে থেকে গেছে। তার আজ যেতে ইচ্ছে করছেনা। তার মিথ্যেটা পুষ্প ধরতে পারলেও কিছুই বললোনা। একে কিছু বলেও লাভ হবেনা।
পুষ্প ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে একপাশে শুয়ে রইলো। তার ঘুম আসছেনা। পাশে আস্ত এক আপদ থাকলে ঘুম আসে কিভাবে? ছটফট করতে করতে একসময় ঘুমিয়ে পড়লো। সকালে ঘুম ভাঙতেই পাশ ফাঁকা পেলো। রাউফুন নেই। তাহলে কি ওয়াশরুমে গিয়েছে? পুষ্প ওয়াশরুম চেইক করে দেখলো দরজা খোলা। তাই আর মাথা ঘামালোনা। শরীরটা মোটামুটি ভালোলাগছে। ঠিক করলো আজ ভার্সিটি যাবে। নাস্তা করতে গিয়ে টেবিলে ও রাউফুনকে দেখলোনা। নাবিলের বাবা মানে পুষ্পর ছোট চাচা জিজ্ঞেস করলেন,

-“কি ব্যাপার? জামাই কোথায়?”

পুষ্পর মা বললেন,
-“জামাইকে দেখলাম সকাল সকাল বেরিয়ে যাচ্ছে। আমি চলে যাওয়ার কারণ জিজ্ঞেস করতেই বলল হসপিটাল থেকে জরুরি কল এসেছে।”

পুষ্পর কোনো হেলদোল নেই। সে একমনে খেয়ে যাচ্ছে। ভার্সিটি গিয়ে ক্লাস শেষে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিলো। মনে হচ্ছে কতদিন পর তাদের দেখা। একপর্যায়ে জুঁই বলল,

-“হ্যাঁ রে পুষ্প তোর ডাক্তারকে তো দেখালিনা।”

পুষ্প বিরক্ত হয়ে বলল,
-“আমি কি ডাক্তারকে সারাদিন সাথে নিয়ে ঘুরি?”

ইমরান বলল,
-“ডাক্তারকে নিয়ে ঘুরতে গেলে ডাক্তারি করবে কে? ছবি দেখা। বল’দ কোথাকার।”
পুষ্প এবারও সবার আশায় পানি ঢেলে দিয়ে বলল,
-“ছবিও নেই।”

সবাই হতাশ হলো। প্রিয়া বলল,
-“কি বলিস? ছবিও নেই? এটা বিশ্বাস করা যায়?”

পুষ্প গাল ফুলিয়ে বসে রইলো। অসহায়, থমথমে গলায় রাউফুনের ব্যাপারটা খুলে বলল।
সবাই অট্টহাসিতে মেতে উঠতেই রিয়াদ বলল,
-“তোর ডাক্তার দেখছি হেব্বি রোমান্টিক, বউ সোহাগী। তাহলে তো এই পাগল ডাক্তারকে দেখতেই হচ্ছে।”

সবাই সাথে সুর মেলালো। পুষ্প বিরক্ত হয়ে আড্ডার আসর ছেড়ে উঠে পড়লো। পিছুপিছু রিয়াদ, ইমরান, প্রিয়া, জুঁই উঠে আসলো। তারা বলল,
-“একটু তোর মানসিক রোগীকে কল দিয়ে আসতে বল। আমরা একটু দেখি, ট্রিট ফিট নেবো না?”

পুষ্প কল দিলোনা। তার ইচ্ছে হলোনা। শুধু মনে হচ্ছে এই লোক আজ তার সাথে দেখা করলে সারাদিন তার সাথে চিপকে থাকতে চাইবে। তার যদি লেজ থাকতো? তবে এই ডাক্তার তার লেজ ধরে ঝুলে পড়তো। সবাইকে দমিয়ে রাখতে পুষ্প বলল,
-“চল, আজ আমার পক্ষ থেকে ট্রিট দেবো সবাইকে। ডাক্তারের কাছ থেকে অন্যদিন নিয়ে নিস।”

আজ রোগী দেখায় মন বসছেনা রাউফুনের। বুকের ভেতর দ্রিমদ্রিম হাতুড়ি পে’টার শব্দ হচ্ছে। মনে হচ্ছে ডানা ভাঙা পাখির মতো ছটফট করতে করতে ম’রে যাবে। জ্বর জ্বর অনুভূতি হচ্ছে। জিহবা তিক্ত স্বাদে বিষাদে পূর্ণ। তবুও নিজেকে ঠিক রেখে রোগী দেখে যাচ্ছে। বাড়ি ফিরে ভাবলো একটু ঘুম দিলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। গতরাতে সে ঘুমাতে পারেনি। শুধু ঘুমিয়ে থাকার ভান ধরেছিলো। পুষ্প ও যে অর্ধেক রাত পর্যন্ত বিনা ঘুমে ছটফট করেছে সে সবই টের পেয়েছে সে। কিন্তু কিছুই বুঝতে দেয়নি৷ তাইতো সকাল সকাল পুষ্পকে না জানিয়ে হসপিটালের বাহানা দিয়ে চলে এসেছিলো। বাড়ি ফিরে ফ্রেশ হয়ে ঘুম দিলো রাউফুন। ঘুম পুরোপুরি হলেও তার ভেতরের উত্তাল ঢেউ কমলোনা। হার্টবিট কি বেড়ে যাচ্ছে? সাংঘাতিক কাজকারবার। এসব কী হচ্ছে? কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করেও শান্তি মিলছেনা। জ্বর জ্বর অনুভূতি হতেই গলায়, কপালে হাত দিয়ে চেইক করলো। নাহ সব তো ঠিকই আছে। শরীরে জ্বর নেই, তবে কি তার অন্তরে জ্বর হয়েছে?

বারান্দার গ্রিল চেপে রাতের ব্যস্ত নগরীর দিকে দৃষ্টি ফেরালো পুষ্প। মানুষের জীবনটা ছোট্ট, আবার অনেক বড়। যারা সুখী মানুষ তারা ভাবে জীবন এত ছোট কেনো? আর যারা দুঃখী? দুঃখ যাদের নিত্যকার সঙ্গী তারা ভাবে জীবনটা কত বড়। আসলে সুখের মুহূর্তে গুলো খুব সহজেই চোখের পলকে কে’টে যায়, আর দুঃখের সময়টা যেনো যেতেই চায়না। পুষ্প নিজেকে সুখী মানুষ দাবী করলেও ভেতরে ভেতরে কোথাওনা কোথাও আস্ত এক বিষাদ পুষে রেখে অভিমানের পাহাড় তুলে বেঁচে আছে মেয়েটা।
পুষ্পর ভাবনার ছেদ পড়লো মোবাইল ফোনের শব্দে। বারান্দা থেকে সরে এসে ফোন হাতে নিলো৷ আননোন নাম্বার। রিসিভ করেই সালাম দিলো পুষ্প।

ওপাশ থেকে সালামের উত্তর দিয়েই ঝটপট কথা শুরু করলো রাউফুন। অস্থির কন্ঠে বলল,

-“পুষ্প আমি বোধহয় তোমাদের বাড়িতে আমার জ্বরের ঔষধ ফেলে এসেছি। একটু খুঁজে দেখবে?”

পুষ্প রাউফুনকে চিনতে পেরে অবাক হয়ে বলল,
-“জ্বরের ঔষধ? কিন্তু আপনি আমাদের বাড়িতে জ্বরের ঔষধ আনলেন কখন?”

রাউফুন একই রকম অস্থির কন্ঠে বলল,
-“আমি কোনো ঔষধ নেই নি তো? কিন্তু তোমাদের বাড়িতেই আমার জ্বরের ঔষধ আছে। আমি নিশ্চিত।”

পুষ্পকে উত্তর দেওয়ার সুযোগ না দিয়ে লাইন কে’টে দিলো রাউফুন। আশ্চর্য হলো পুষ্প। রাউফুনের ফোন করার আগামাথা খুঁজে পেলোনা। এরপর তিনদিন কে’টে গেলো। রাউফুনের কোনো কল, মেসেজ বা তার দেখা পেলোনা। হুট করে চতুর্থদিন রাউফ এসে হাজির হয় পুষ্পদের বাড়ি।

#চলবে…….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here