পয়মন্তী,পর্ব ১

0
1114

পয়মন্তী,পর্ব ১
তামান্না জেনিফার

আষাঢ় মাসের এক ঝুম বৃষ্টির দিনে আমার জন্ম হলো ৷ আমার বাবা মতিউর রহমান গ্রামের চেয়ারম্যান এবং সম্পদশালী ব্যক্তি ৷ আমার জন্মটা বাবার জন্য আনন্দদায়ক ছিলোনা ৷ কারন আমার আগেও আরো তিনটা কন্যা আছে তার ৷ শুনেছি আমার জন্মের পর বাবা আমাকে সহ মাকে বৃষ্টির মধ্যে বের করে দিয়ে মেয়ে হবার অপরাধে ৷ রান্নাঘরের পাশে থাকা কাঁঠাল গাছের নিচে বৃষ্টির ছাট থেকে আমাকে বাঁচিয়ে নিয়ে বসে ছিলো মা , সারাটা দিন ৷ সন্ধ্যায় বাবার দূরসম্পর্কের বড়ভাই আনোয়ার চাচা এসে বাবাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে মা আর আমাকে ঘরে নিয়ে আসে ৷ আনোয়ার চাচা এই গল্পটা বলতে খুব মজা পায় ৷ আমার সাথে তার যতবার দেখা হয় ততবারই বলে ৷ “মারে , তোর বাপ একটা গোয়ার ৷ কোন মতেই তোগোরে ঘরে তুলবোই না ৷ আমি না পারতে বানায়া বানায়া কইলাম , বাদলা দিনে মাইয়্যা হইলে পয়মন্তী হয়রে মইত্যা , যা বউডারে ঘরে লইয়া আয় ৷ কাঁচা পোয়াতী , এরাম বাদলার মইদ্যে ভিজলে মাইয়্যা বাঁচবোনি ! যা রে মইত্যা , যা , বউডারে ঘরে লইয়া আয় …

তোর বাপে আমারে গরম দেখায়া কইলো , আনবার পারুম না , ভিজ্যা মইরা যাক মায়ে ছায়ে দুইডাই ৷ দফায় দফায় মাইয়্যা বিয়াইবো আর ওরে আমি ঘরে রাখুম ! নয়া বিয়া কইরা বউ আনুম ঘরে ৷ পোলার বাপ না হইলে সমাজে ইজ্জত থাকেনি !

তারপর এদিক সেদিক দেইখা তোর বাপের পাওখান শক্ত কইরা ধইরা বইসা পড়লাম ৷ বড় ভাই হইয়া পাও ধরছে , হ্যায় পাইলো শরম ! আমারে কয় ভাইজান , পাও ছাড়েন ! আপনি আমার বড় ভাই , পাও ছাড়েন পাও ছাড়েন …

আমার কথা একটাই , বউ আর মাইয়্যারে ঘরে তোল , পাও ছাইড়া দিমু ৷ শেষে না পাড়তে তোর মা আর তোরে ঘরে তুইলা নিলো ৷”

আনোয়ার চাচা যতটা তৃপ্তি নিয়ে বলে আমি ততটাই তৃপ্তি নিয়ে শুনি ৷ আমারও ভালো লাগে শুনতে ৷ গল্পটাতে প্রত্যেকবার নতুন নতুন ডালপালা যোগ হয় ৷ শুনতে ভালো লাগে ৷ আমি অপেক্ষা করি এবার কি নতুন লাইন আসবে ৷ যেমন পা ধরার ব্যাপারটা গল্পে আগে ছিলো না ৷ এটা নতুন যোগ হয়েছে ৷

যাই হোক , নিজের কথা বলি ৷ আমার নাম পয়মন্তী ৷ এত বড় নাম ডাকতে কষ্ট হয় জন্য সবাই আমাকে ডাকে পয়া ৷ সবার ধারনা আমি মেয়েটা ভাগ্যবতী , আমার নিজের অবশ্য এমন কোন ধারনা নেই ৷ তবে সবার কথার সাথে তাল মিলিয়ে রহস্যময় হাসি হাসতে আমার খুব ভালো লাগে ৷

আমরা পাঁচ বোন ৷ আমার জন্মের পর বাবা আরেকটা বিয়ে করেছিলো পুত্র সন্তানের আশায় ৷ বাবার কপাল খারাপ আমার ছোটমার ঘরেও মেয়েই হলো ৷ আতুর ঘরে ঢুকে বাবা ছোটমাকে দিলো মাইর ৷ ছোটমা কিন্তু আমার মায়ের মতো আলাভোলা বোকা ছিলো না ৷ দিলো বাবার নামে কেস করে ৷ হাজত থেকে বাবা দাড়ি আর নামাজ পড়ে কপালে হওয়া কালো দাগ নিয়ে ফিরলেন ৷ ছোট মা বাবাকে তালাক দিয়ে মোহরানার টাকা নিয়ে চলে গিয়েছিলো ৷ বাচ্চাটাকে নেয়নি ৷ কালসাপের বাচ্চা কালসাপই হবে , এমনটাই ধারণা ছিলো তার , সেজন্যই বাচ্চা ফেলে যাওয়া ..

আমার সেই ছোট্ট বোনটিকে মা বুকে তুলে নিলেন ৷ আমার নামের সাথে নাম মিলিয়ে রাখলে সেমন্তী ৷ আমার বড় তিন বোনের নামও মিলিয়ে রাখা , বকুল , পারুল , শিমুল .. আমার সময়ে এই মিলিয়ে রাখার ব্যাপারটা বাদ দেয়া হয় , তাই আমার নাম পয়মন্তী ৷

এই যে গল্পগুলো বললাম , এগুলো অনেক আগের কথা ৷ আমার বয়স এখন সতেরো , সেমন্তীর পনেরো ৷ বাবা এখন আর আগের মতো নেই ৷ তিনি এখন সারাদিন নামাজ কালাম পড়েন আর চুপচাপ নিজের ঘরে থাকেন ৷ শুধু শব্দ বেশি হলে মাঝে মধ্যে হুংকার দেন , আমরা পাঁচবোন তখন একদম চুপ হয়ে যাই ৷

আজ বাড়িতে খুব হৈচৈ হচ্ছে ৷ কিন্তু বাবা চুপচাপ আছেন ৷ কাউকেই মানা করছেন না , হুংকারও দিচ্ছেন না ৷ কারন কি জানেন ? আপনারা কিভাবে জানবেন আমি তো বলিইনি ৷ আগামীকাল আমার সবচেয়ে বড় বোন বকুল আপার বিয়ে ৷ আমরা সবগুলো বোন মোটামুটি সুশ্রী , শুধু বকুল আপা একটু কালো ৷ বকুল আপা কালো জন্য তাকে বিয়ে দিতে বাবার খুব কষ্ট হচ্ছে ৷ মোটামুটি বিশাল মাপের যৌতুক দেওয়া হচ্ছে বকুল আপার বিয়েতে ৷ আসলে বকুল আপার বিয়ে আঁটকে যাওয়া মানে আমাদের বাকি বোনদের বিয়ে আঁটকে যাওয়া ৷ এ কারনেই বাবা অস্থির হয়ে গেছিলেন ৷ আবার বকুল আপার বিয়ে খারাপ হওয়া মানে বাকি বোনদেরও ভালো ঘর পাওয়া মুশকিল হবে ৷ তাই যেন তেন ঘরেও বিয়ে দিতে পারছিলেন না ৷ অবশেষে ঘরে বরে মিললো ৷ যদিও যৌতুকের পরিমান বেশি তবুও বাবার কোন আপত্তি নেই ৷ মেয়েদের বিয়ে দিতে যৌতুক তো লাগবেই , আর তার সম্পদেরও অভাব নেই ৷

ছোটবেলা থেকেই দেখে আসছি তিনি চেয়ারম্যান ৷ ইলেকশনে তিনি কখনোই হারেননি ৷ আমাদের বাড়ির নামই হয়ে গেছে চেয়ারম্যান বাড়ি ৷

এবার একটু আমার মায়ের কথা বলি ৷ আমার মা সুফিয়া বেগম এই পৃথিবীর সবচেয়ে সরল এবং বোকা মহিলা ৷ অসম্ভব রূপবতীদের বুদ্ধি নাকি কম থাকে এই কথাটা মাকে দেখলে আমার বিশ্বাস হয় ৷ আবার সেমন্তীকে দেখলে অবিশ্বাস হয় ৷ ওর কথা পরে বলবো , আগে মায়ের কথা বলি ৷ মায়ের যখন বিয়ে হয়েছিলো তখনও নাকি মা হাফপ্যান্ট পরে ঘোরেন ৷ কত ছোট ছিলেন তিনি বুঝে নেন সবাই ৷ বুদ্ধি হবার আগেই তিনি গর্ভবতী হন ৷ পরপর তিনবার মৃত সন্তান জন্ম দেবার পর বকুল আপার জন্ম হয় ৷ বকুল আপার জন্য মায়ের টান তাই সবচেয়ে বেশি ৷ আমার ধারনা মা আমাদের বাকি চারজনকে যতটুকু ভালোবাসেন , বকুল আপাকে একাই তার দশগুন বেশি ভালোবাসেন ৷ অবশ্য বকুল আপা এমনই , ভালোবাসা পাবার যোগ্য ৷ তাকে ভালো না বেসে থাকা যায় না ৷ আচ্ছা মায়ের কথা বলছিলাম ৷ মা মানুষটা কত বোকা বলি , ধরেন কেউ একজন এসে মিথ্যা মিথ্যাই বললো “আমার কাপড় নাই , খাওন নাই ..” মা বিশ্বাস করে ফেলবে ৷ তারপর তাকে সব দিবে ৷ পরে যখন বুঝবে সে মিথ্যা বলেছিলো তখন সারাদিন কাঁদবে ৷ কেউ তাকে ঠকাতে পারে এটা সে বিশ্বাসই করতে পারে না ৷ তবে ঠকে যায় জন্য তাকে বোকা বলছি ব্যাপারটা এমন না ৷ বোকা বলছি কারন এই একই কাজ সে বারবার করবে ৷ আবার বাবা তাকে যাই বলবে এটাকে মা ভেবে নেবে ফরজ কাজ ৷ ধরা যাক , বাবা মা কে বললো ” সুফিয়া , আইজ নাকি শুভ দিন , আইজ সারাদিন পুস্কনিতে গলা পর্যন্ত ডুইবা থাকলে সংসারের মঙ্গল হইবো ৷ এইটা আমি স্বপ্নে পাইছি ৷ তুমি কাম কাইজ বাদ দেও , যাও পুস্কনিতে গিয়া গলা ডুবায়া বইসা থাকো ” মা সাথে সাথে হাতের কাজ ফেলে পুকুরে চলে যাবে ৷ ভাবছেন বানিয়ে বানিয়ে বলছি ? মোটেই না ! বাবা এসব করে ৷ অদ্ভুত অদ্ভুত জিনিস তিনি স্বপ্নে পান , আর সেসবের বাস্তব রূপ দেয় আমার বোকা মা …. বাবা মানুষটা অদ্ভুত , ভীষণ অদ্ভুত !

বকুল আপাকে গায়ে হলুদ দেওয়া হয়েছে আজ ৷ আমাদের বাড়িতে এর আগে কোন বিয়ে আমি দেখিনি ৷ বিয়ের প্রত্যেকটা অনুষঙ্গ আমি খুব মনোযোগ দিয়ে দেখছি ৷ আমার ভীষণ ভালো লাগছে এসব দেখতে ৷

গ্রামের আরো সব এয়ো বউ ঝি রা মিলে উঠানের মাঝখানে একটা জলচৌকি পাতলো ৷ সেমন্তী আর পারুল আপা মিলে সেই জলচৌকি আর তার আশে পাশে আঁকলো আলপনা ৷ কি সুন্দর যে সেই আলপনা .. আমি মুগ্ধ হয়ে দেখলাম ৷ আলপনা দিতে পারিনা আমি ৷ তবে রঙের কৌটা এগিয়ে দেওয়ার কাজটা আমিই করেছিলাম ৷ জলচৌকির কাজ শেষ হলে আমার দুজন গ্রাম সম্পর্কের ভাবী গীত গেয়ে গেয়ে শিলপাটার উল্টো পিঠে কাঁচা হলুদ বাঁটলো ৷ আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম “ভাবী উল্টা পিঠে বাটতাছো ক্যান ?” ভাবী হেসে বললো ” এই মাইয়্যা কি কয় ! সোজা পিঠে মরিচ বাটা হয় , ঐ পিঠে বাঁটলে বকুল গায়ে হলুদ মাখলে হ্যায় চেঁচাইবো ঝালে ” .. অবাক হয়ে ভাবলাম ঠিকই তো ! সেই হলুদ বাটা তিনটি আলাদা মাটির সরায় রাখা হলো ৷ একটা কুলায় নেওয়া হলো হলুদের বাটিগুলো , এক মুঠি ধান , এক মুঠি ভাত , এক মুঠি দূর্বা ঘাস আর এক মুঠি ছাই ! আমি অবাক হয়ে ভাবতে লাগলাম এই জিনিসগুলো কেন রাখা হচ্ছে ! কাউকে জিজ্ঞেস করার মতো পেলাম না , পরে একসময় নিশ্চয় কারো কাছে জেনে নেবো ৷

বকুল আপাকে যখন গোসল করানো শুরু হবে তখন রোদ উঠে গেছে একদম মাথার উপরে ৷ রোদের মধ্যেই আপার সারা গায়ে হলুদ ডলাডলি করা হলো ৷ ও বলতে ভুলে গেছি , হলুদ দেওয়া শুরু করার আগে আরেকটা কাজ করলো মা ৷ মা তার মাথাটা বকুল আপার মাথার উপরে দিলো ৷ একজন এসে তেল ঢালতে লাগলো মায়ের মাথায় , সেই তেল গড়িয়ে পড়তে লাগলো বকুল আপার মাথায় ৷ দৃশ্যটা এত সুন্দর ছিলো ! আমি মুগ্ধ হয়ে দেখলাম ..

রোদের মধ্যে হলুদ ডলাডলির কারনে বকুল আপাকে আরও কালো দেখাতে লাগলো ! সেমন্তী আমাকে ফিসফিসিয়ে বললো “ছোটপা , বড়পাকে আরো কালো লাগে ..” আমি ওকে ইশারায় চুপ করালাম ৷ বকুল আপা শুনলে কাঁদবে ৷ এমনেই বেচারীর গায়ের রঙ নিয়ে দুঃখের সীমা নেই ৷ আমি বুঝিনা চামড়ার রঙ এত গুরুত্বপূর্ন কেন ! বকুল আপাকে বেশ কয়েকবার বোঝাতে চেয়েছিলাম ব্যাপারটা ৷ আপা প্রত্যেকবার হেসে বলেছে ” পয়ারে , তুই এইগুলান বুঝবি না , আল্লায় তোরে গোরা রঙ দিছে , কালা মাইয়্যার মনের বেদনা তুই বুঝবি না ”

পুরো বাড়িটার উচ্ছ্বাস উল্লাস কমে আসে রাত বাড়ার সাথে সাথে ৷ আমি আর সেমন্তী বকুল আপার সাথে ঘুমাই ৷ পারুল আপা আর শিমুল আপা অন্য ঘরে ঘুমায় ৷ সবাই তখন গভীর ঘুমে , আমারও চোখ লেগে এসেছে ৷ হঠাৎ শুনলাম কেউ একজন কাঁদছে ৷

খেয়াল করে দেখলাম , কেউ একজনটা বকুল আপা ৷ ভাবলাম , কাল বিয়ে সবাইকে ছেড়ে চলে যাবে তাই বোধহয় এমন আকুল হয়ে কাঁদছে বকুল আপা ৷ সান্ত্বনা দিয়ে কি বলবো বুঝতে পারছিলাম না তাই পাশ ফিরে শুয়ে পড়লাম ৷ গুনগুন কান্নার আওয়াজেই ঘুমিয়ে পড়লাম কিছুক্ষনের মধ্যেই ৷

সকালে উঠতে একটু দেরী হলো আমার ৷ পুরো বাড়িতে মরা বাড়ির মতো কান্নাকাটি চলছে .. কিছু বুঝতে না পেরে সেমন্তীর দিকে তাকাতেই ও গলা একদম খাঁদে নামিয়ে ফিশফিশিয়ে বললো ” বড়পা পলাইছে … কুনোখানে নাই বড়পা ”

আমি হতভম্ব হয়ে তাঁকিয়ে রইলাম !

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here