পয়মন্তী,পর্ব ৩

0
558

পয়মন্তী,পর্ব ৩
তামান্না জেনিফার

নতুন দুলাভাইয়ের সম্মানে বিরাট আয়োজন করলেন বাবা ৷ কিন্তু দুলাভাইয়ের সেই আয়োজন পছন্দ হলো না ৷ সামনে খাসীর রোস্ট , আস্ত মোরগের রোস্ট , গরুর মাংস , পোলাও , মাছ ভাজা , ডাল সবজি , দই মিষ্টি রেখে তিনি বারবার পারুল আপাকে বলতে লাগলেন “শুনছিলাম তোমার বাপের বলে বিরাট আত্মা ! এই হইলো আত্মার পরিচয় তাই না বউ ? জামাইয়ের জন্যে এত কম আয়োজন কেউ করে ! ”
দুলাভাই যখন এসব বলছিলেন খানিক দূরে থেকে বাবা সব শুনছিলেন , লজ্জায় তার মুখ লাল হয়ে এসেছিলো ৷ জীবনে যিনি কোনদিন কারো সামনে মাথা নিচু করেননি তিনি আড়ালে একা একা মাথা নিচু করে রইলেন ৷

আমার দুলাভাইয়ের আচরণ তেমন খারাপ লাগলো না ৷ তার কাছ থেকে এরচেয়ে ভালো ব্যবহার আমি আশা করিনা ৷ আমার মন খারাপ হলো পারুল আপার আচরণে ৷ একদিনে সে আমুলে বদলে গেছে ৷ দুলাভাই যা বলছে তাতেই সে সম্মতি জানাচ্ছে ৷ বিকেল বেলা মা বসে বসে পিঠা ভাজছিলো দুলাভাইয়ের জন্য ৷ আমি আর সেমন্তী মা কে সাহায্য করছিলাম ৷ শিমুল আপা ঘর থেকে বের হয় না ৷ এমন সময় পারুল আপা আসলো ৷ একটা পিড়ি নিয়ে মায়ের পাশে বসলো ৷

—কামডা কি তোমরা ঠিক করছো মা !

—কোন কামডা মা ?

—এই যে তোমারা জামাইরে এমনভাবে অসম্মান করলা ! হ্যায় বড় ঘরের পোলা ৷ আর হ্যার সামনে খাবার দিলা কি কি ! এত সামান্য আয়োজন কেমনে করলা তোমরা ? আমার মান সম্মান শ্যাষ হইয়া গেলো !

আমার মা চুপ করে রইলেন ৷ আমার সহ্যের বাঁধ ভেঙে গিয়েছিলো ৷ নিজেকে সামলাতে না পেরে বলে বসলাম

—আপা , কোন আয়োজনডা কম লাগছে তোমার ? দুলাভাইয়ের সামনে কোন খাবারডা আছিলো না ?

—চ্যাটাং চ্যাটাং কথা কইবি না পয়া ৷

—আপা , তুমি বদলায়া গেছো ৷ তুমি দুলাভাইয়ের চোখ দিয়া দুনিয়া দেখতাছো ৷ আব্বা যথেষ্ট আয়োজন করছে ৷ সব দেইখাও তুমি এইসব বলতাছো ! আমি মনে বড় কষ্ট পাইছি তোমার চাল চলন দেইখা ৷ আব্বায় সব শুনছে দুলাভাইয়ের কথা , মাথা নিচু কইরা দাঁড়ায়া আছিলো !

—জীবনে শুনছিস , জামাইয়ের সামনে একখান মুরুগ দেয় ? আর ডিম ঘরে আছিলো না , ডিম দেয়নি কেন ? রুই মাছের পিস গুলান তো আঙ্গুলের সমান আছিলো ৷ বড় বড় ইঁচা আব্বা চোক্ষে দেখে নাই ? উচিত কথা কইলেই পারুল খারাপ ! তোর লগে আমি কিছু কইছি ৷ মা রে কইতাছি ৷ তুই চুপ থাক ৷ মা , তোমার জামাইয়ের হাতে দশ হাজার টেকা দিবা ৷ এমনেই তো খাওন ঠিক মতো দেওনি , আবার এইটা যেন ভুল না হয় ৷

পারুল আপা কাউকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে হনহন করে চলে যায় ৷ মা কিছুই হয়নি এমন ভাবে পিঠা ভাজতে থাকে ৷ পারুল আপা ঘরে গিয়েই দরজা লাগিয়ে দিলো ৷ খানিকক্ষন পর বের হলো যখন তখন তাকে আরোও সুখী সুখী মনে হচ্ছিলো ৷ বারান্দা থেকেই আপা ডাক দিলো “সেমন্তী , তোর দুলাভাইরে চা নাস্তা দে ৷ ”

মা তাড়াতাড়ি একটা ট্রেতে করে ফলমূল , পিঠা , আর চা পাঠালেন সেমন্তীর হাত দিয়ে ৷ পারুল আপা সেমন্তীকে ঘরে ঢোকালো না ৷ ওর হাত থেকে ট্রেটা নিয়ে ঘরে ঢুকে আবার দরজা বন্ধ বন্ধ করে দিলো ৷ সেমন্তী ফিরে এসে মুখ ভার করে মা কে বললো “এরপর খাবার দিয়ে আমারে আর পাঠাইবা না মা , মেজপা কেমন কেমন করে , আমার ভাল্লাগে না ”

মা সেমন্তীর মাথায় হাত দিয়ে বললো ” ও মা সেমন্তী , আমার ভালা মা , পারুলের উপর রাগ করিস না মা ৷ নয়া বিয়া হইছে তো , অহন স্বামী ছাড়া হ্যায় চোক্ষে কিছু দেখতাছে না ৷ স্বামীর আদর সোহাগে সব ভুইলা গেছে গো মা ৷ তুই মনে কষ্ট নিস না ”

সেমন্তী আর কথা বলে না ৷ আমাদের বোনগুলোর মধ্যে সেমন্তীর রাগ , জেদ সবচেয়ে বেশি ৷ প্রতিবাদীও সবচেয়ে বেশি ও ৷ কিন্তু এখনকার পরিবেশটা এমন থমথমে , এখানে প্রতিবাদের জায়গা নেই কোন ৷

পরদিন সকালে দুলাভাই পারুল আপাকে নিয়ে চলে গেলো ৷ এবার আপা গেলো আটদিনের জন্য ৷ আপার সাথে এ বাড়ি থেকে কেউ গেলো না , তবে দুলাভাইকে নতুন কাপড় চোপর , জুতা দেওয়া হলো ৷ আর সাথে মা আপার বলে রাখা দশ হাজার টাকাও দিলেন দুলাভাইয়ের হাতে ৷ উনি এমন একটা ভাব দেখালেন যেন নিতেই চাচ্ছেন না , মা অনেক অনুরোধ করে দিলো টাকাটা ৷ টাকাটা পাবার পর আপা আর দুলাভাই দুজনকেই বেশ খুশি খুশি মনে হলো ৷ হাসতে হাসতে চলে গেলো এবার আপা ৷

***************

দেখতে দেখতে তিন মাস পার হয়ে গেলো ৷ আমরা সবাই বকুল আপাকে ভুলতে বসেছি ৷ আমাদের জীবনে নানান রকম সমস্যা , এসব সমস্যার ভিড়ে বকুল আপার কথা মনে রাখার উপায় নেই , আর ইচ্ছেও নেই ৷ এই তিন মাসে পারুল আপা আরো দুই তিনবার এসেছিলো , প্রত্যেকবার তার লম্বা ফর্দ বাবা হাসিমুখেই পূরণ করেছে ৷ শেষবার আপা যখন এলো তখন তার মুখের হাসি অনেকটাই কমে গেছে ৷ স্বামী সঙ্গের সুখ তার কমতে শুরু করেছে , আপা মোহ থেকে বের হয়ে আসতে শুরু করেছে ৷ কেমন যেন নিষ্প্রান হয়ে গেছে সে ৷ জিজ্ঞেস করায় বলেছিলো তার নাকি সন্তান হচ্ছে না ৷ এ নিয়ে বাড়িতে অশান্তি হচ্ছে ৷ আমি অবাক হয়ে বলেছিলাম , সবে তিনটা মোটে মাস গেলো , এখনি এত অস্থির হবার কি আছে ! আপা আমার কথার কোন জবাব দেয়নি ৷ চুপ করে আকাশের দিকে তাঁকিয়ে ছিলো ৷ হয়তো উত্তরটা আপা আকাশেই খুঁজছিলো ৷

আমার পরীক্ষা এগিয়ে আসে ৷ পড়াশোনা সারা বছর করিনি ঠিকমতো ৷ পরীক্ষার রুটিন হাতে পেয়ে তাই সব ভুলে পড়া শুরু করলাম ৷ সারাদিন পড়ি ৷ রাতে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে যাই , আবার উঠি ফজরের নামাজের সময় ৷ নামাজ পড়ে পড়তে শুরু করি ৷

এখন আমরা তিন বোন একঘরেই থাকি ৷ পারুল আপা আর শিমুল আপা আগে যে ঘরে থাকতো সেই ঘরে এখন থাকে মলিদা দাদী ৷ বাবার দূর সম্পর্কের ফুফু তিনি ৷ স্বামী নেই , একটা ছেলে ছিলো অনেক আগেই পুকুরে ডুবে মারা গেছেন ৷ শেষ বয়সে তাকে দেখার কেউ নেই জন্য বাবা গিয়ে তাকে নিয়ে এসেছেন ৷

এই মলিদা দাদী সূচ হয়ে এ বাড়িতে ঢুকে ফাল হবার চেষ্টায় আছেন ৷ প্রথম প্রথম যখন এলেন সারাক্ষন মাথায় এক হাত লম্বা ঘোমটা টেনে সারাদিন নামাজ পড়তেন আর মোনাজাতে জোরে জোরে বাবার জন্য দোয়া করতেন ৷ এক মাস পার হতেই এখন তিনি মায়ের শ্বাশুড়ির আসনে বসার চেষ্টা শুরু করেছেন ৷

আমরা ব্যাপারটা আসলে বুঝিনি ৷ প্রথমে বুঝলো সেমন্তী ৷ ও একদিন রাতে বললো

—ছোটপা , মলিদা দাদী মা রে কেমুন হুকুম করে দেখছো ?

—না তো ,ক্যান কি হইছে ?

—সেইদিন শুনি , পাকঘরে বইসা মা রে কইতাছে এইডার লগে এইডা রানবা , ঐডার লগে ঐডা !

—আহা , হ্যার মনে হয় খাইবার মন চাইছে , তাই কইছে

‘—ছোটপা , আমার মন কইতাছে এই বুড়ির মতলব ভালা না ৷ আব্বার লগে সুযোগ পাইলেই গুটুর গুটুর করে দেখছো !

—তুই খালি নাই ঠেকার চিন্তা করতিছিস ৷ বাদ দে , এরাম কিছুই না ৷

সেমন্তী ঠিক ছিলো ৷ দাদী ধীরে ধীরে তার শাখা প্রশাখা বিস্তার করছিলো আমাদের বাড়িতে ৷ একদম হুট করেই একদিন শুনলাম শুক্রবারে শিমুল আপার বিয়ে ৷ পাত্র মলিদা দাদীর ভাতিজার ছেলে ৷ শনিবার আমার ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা শুরু , আর শুক্রবার শিমুল আপার বিয়ে !

আমি আর সেমন্তী সাহস করে বাবার কাছে গিয়ে ডেট পিছাতে বললাম ৷ লাভ হলো না ৷

কোন রকম আয়োজন ছাড়া শিমুল আপার বিয়ে হয়ে গেলো ৷ বলতে গেলে বিয়েটা হলো খুব গোপনে ৷ মলিদা দাদী বাবাকে বুঝিয়েছিলো গ্রামের মানুষ ভালো না , বিয়ের কথা শুনলে ভাঙানি দিবে ৷ বকুল আপার প্রসঙ্গ আসলে শিমুল আপার বিয়ে হবে না ৷ বাবা তার ফুফুর কথা ফেলেনি ৷ তাই করেছে ৷

বিয়ের পর পারুল আপা শ্বশুড় বাড়ি চলে গিয়েছিলো ৷ কিন্তু শিমুল আপা গেলো না ৷ বরং আমার নতুন দুলাভাই যার নাম জয়নাল এসে উঠলো আমাদের বাড়িতে ৷

শিমুল আপা যখন বুঝলো , তার স্বামী এই বাড়িতে ঘর জামাই থাকবে তখন বেশ ভেঙে পরলো ৷ অনেক কান্নাকাটি করে বাবাকে বললো , ঘরজামাইয়ের সংসার সে করবে না ৷ উত্তরে বাবা শুধু বললো ” একখান পোলা তো বিয়াইতে পারেনি থোর মায় ৷ আমার এত সম্পত্তি বারো ভূতে খাইবো ৷ তারচে জয়নাল পোলা হইয়া আমার লগে থাকবো ৷ সয় সম্পত্তি দেখবো ৷ তাতে সবারই ভালো হইবো ৷”

এত সব ঝড় তুফানের মধ্যেই আমার পরীক্ষা চলতে থাকলো ৷ আমি সারাদিন পড়ি কান বন্ধ করে ৷ আমি শিমুল আপার মন খারাপ দেখিনা , মলিদা দাদী মায়ের সাথে চিৎকার করে এসব দেখিনা , আমি শুধু পড়ি ৷ আর মনে মনে ছক কাটি , আর কয়টা দিন , পরীক্ষাটা শেষ হোক ! তারপর আমি সব দেখবো ৷ আমি পয়া , আমি পয়মন্তী ! অনেক কিছু দেখার আছে আমার …

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here