পয়মন্তী,০৮,০৯

0
430

পয়মন্তী,০৮,০৯
তামান্না জেনিফার
পর্ব ৮
_________________

এটা বের করতে আমার শার্লক হোমস হতে হলো না , যে সেমন্তী কার সাথে কথা বলে ৷ ছেলেটার নাম অপূর্ব , ঢাকায় থাকে , কলেজে পড়ে ৷ রং নাম্বারে তাদের পরিচয় হয়েছে এক সপ্তাহ আগেই ৷ প্রেম পর্যায়ে যায়নি , বন্ধুর মতো সম্পর্ক ৷ সেমন্তীকে জিজ্ঞেস করতেই সে নিজেই গড়গড় করে সব বলে দিলো ৷

আমি সেমন্তীকে বললাম

—বন্ধু সম্পর্কটা খুবই পবিত্র জানিস ? এই সম্পর্কের ভিত্রে তুই যদি প্রেম পিরীতি ঢুকাস সেইটা হয় বন্ধুত্বের অপমান ৷ বন্ধু হইবো বন্ধু , কোন চাওয়া পাওয়ার হিসাব এইখানে থাকবো না ৷ তয় যহন প্রেম পিরীতির সম্পর্ক হইবো তখন এর ভিত্রে নানান ফ্যাসাদ ঢুকবো ৷

—আপা , এগলা কি কও ? প্রেম করুম কোন দুঃখে ?

—দুঃখ সুখ বুঝি না ৷ যা বুঝি হেইডাই কইলাম ৷ বাকিডা তোর মর্জি ৷ আর একটা পোলারে চিনিস না জানিস না তার লগে এমুন আলাপ পাড়তাসোস , তর কি মনে হয় কামডা কি ঠিক হইতাছে ?

—তুমি ভুল বুঝতাছো আপা , আমার মনে সেইরাম কিছু থাকলে তোমারে কি কইতাম ?

—আরে পাগল বইনরে আমার ! আমি তো তরে চিনি ৷ আমি জানি তুই আমার কাছে কিছুই গোপন করবি না ৷ আর তুই আমরার মইধ্যে সবচেয়ে বুদ্ধিমতী ৷ তোর বুদ্ধি দেইখা আমি নিজেই অবাক হইয়া যাই ৷ আমি জানি ভুল হইবো এমন কিছুই তুই করবি না ৷

—যদি ভুল কইরা ফেলি ?

—সেই জন্যেই তো আমি আছি তোর লগে ৷ অামারে সব কইবি , যেই সময় মনে হইবো পোলার মতলব ভালা না আমি তোরে কমু ৷ এইটুক বিশ্বাস কি আছে না ?

—আছে আপা ৷

—তুই যদি এই পোলার লগে বন্ধুত্ব রাখতে চাস রাখবি ! আমি কি তোরে মানা করছি একবারও ? আর আমি মানা করুম ক্যান , মাইনষের বন্ধু থাকতেই পারে ৷ তয় সেমন্তী , একবারে যারে বন্ধু কইছোস , হ্যায় বন্ধুই ৷ আগে কইলি বন্ধু , পরে তার লগে পিরীত , আমার নিজের কাছে এইডা খুবি নোংরা লাগে ৷ মনে হয় সম্পর্কের অপমান ৷ আমার এমন লাগে জন্যে যে তোরও এমন লাগতে হইবো , তাও না ৷ তুই আমরার বাড়ির সব কাহিনীই জানিস ৷ এক বকুল আপার ভুলের মাসুল পারুল আপা , শিমুল আপা দিতাছে ৷ তোর যদি ভুল হয় সেই ভুলের মাসুল কত ভয়ঙ্কর হইবো এইডা খালি ভাবিস ৷ বাপ মা এমুন জিনিস বইন , এরার মনে আঘাত দিয়া কেউ কুনোদিন সুখী হইবার পারে না ৷ বকুল আপা যে ভালো নাই তা তো তুই বুঝোস তাই না ক ?

—আপা , তুমি কি কইতে চাইতাছো আমি বুচ্ছি ৷ এইরাম কিছুই হইবো না ৷

—পুরুষ মানুষ খুঁজে শরীর আর মাইয়্যা মানুষ খুঁজে মন ৷ মাইয়্যা মানুষরে দুইখান ভালো কথা কইলেই হ্যারা মনে করে এই পোলার মতো ভালা কেউ নাই ৷ মাইয়্যা মানুষ যহন চন্দ্র তারা আর গফসফ ভাবে , পুরুষ মানুষ ভাবে মাইয়্যা মানুষের শরীরের ভাজ ৷ জগতে ভালো পুরুষ নাই ব্যাপারটা কইলাম এমন না ৷ তয় বয়স কম থাকলে এই ভুলগুলা হয় বেশি ৷ একবস্তা চাউলের মদ্দে থেকে একখান ধান বাইর করতে যোগ্যতা লাগে ৷ আবেগ দিয়া সঠিক মানুষ বাইর করা যায় না ৷ কম বয়সে মনে যে পোলারে দেইখা তোর মনে হইবো এর মদ্দেই তোর আসমান জমিন , বয়সকালে নিজেই যহন বুঝবি আসমান জমিন না বরং হ্যার মন নোংরা ড্রেনের মতো তহন কিন্তু কাউরে কিছু কওনের থাকবো না ৷

—বাপ মাও বিয়া দিলেই কি তাইলে সঠিক পুরুষ বাইছা দিবো ? তাইলে পারুল আপারে তো আব্বা নিজে বিয়া দিলো , দুলাভাইয়ের মতো ধান আমি চাই না , এরচে মরা চাউল ভালা ৷

—বাপ মাও দিলেই যে ভালা হইবো এইডাও না ৷ তয় বাপ মাও দিলে সুবিধা কি জানিস , অন্যায় হইলে অন্তত বাপের বাড়ি আসার রাস্তা থাকে ৷ তুই তহন কইতে পারবি আমি তো নিজে নিজে বিয়া করিনি , তোমরা দিছো ৷ এহন বিপদে পড়ছি উদ্ধার তোমরা করবা ৷ আর , বাপ মায়ের আশীর্বাদ অনেক বড় জিনিস , এই আশীর্বাদ ছাড়া সুখী হওয়া যায় না রে বইন ৷

—তুমি কি জীবনেও প্রেম করবা না ? এই যে ঢাকায় যাইবা পড়তে , যদি ঐহানে কাউরে মনে ধরে ? মন কি শাষন বারন বোঝে ?

—যদি সেই দিন আমার আসেই কুনোদিন আমি চেষ্টা নিমু দুই বাড়িরে বুঝায়া আপোশে সব মিটমাট করতে ৷ জীবনে প্রেম করমু না এই কথা আমি তোরে কইতে পারমু না , তয় জীবনে কোন পোলার হাত ধইরা বাপ মায়ের মুখে চুনকালি মাইখা আমি পলামু না এই কথা আমি কইলাম ৷ আর যাই করি আব্বার অবাধ্য হয়া পলামু না আমি ৷

—আপা কখন বুঝমু অপূর্ব আমারে বন্ধু না অন্য কিছূ ভাবতাছে ? কেমনে বুঝমু এই পোলা ভালা না ?

—জগতের সবচাইতে কঠিন কাজ মানুষ চেনা ৷ মানুষ চেনার বুদ্ধি নাই বইন ৷ তয় যহন দেখবি অপূর্ব তোর লগে শরীর ইঙ্গিত কইরা কথা কইতাছে বুঝবি এর মনে নোংরা ড্রেন ৷ যহন দেখবি হ্যায় তোরে এমন কথা কইতাছে যা শুনে তোর মনে হইতাছে এগুলান ক্যান কয় , বুঝবি এর মনে নোংরা ড্রেন ৷ তোরে কইরো তোমার নেংটা ছবি দেও , বুঝবি হ্যার মনে নোংরা ড্রেন ৷ মোদ্দা কথা , তোর যদি মন পরিষ্কার থাকে , হ্যায় নোংরামি করতে আইলেই বুইঝা ফালাইবি ৷

—আপা অপূর্ব আমারে জিগাইছিলো একদিন আমার শইল্যের মাপ কত ? আমি রাগ হইছিলাম , তহন কইছে বন্ধু মানুষের সাথে এইগুলা ফাইজলামি করা যায় ৷

—বান্ধবীর লগে অনেক ফাইজলামি করা যায় , বন্ধুর লগে না ৷ যে পোলা দুইদিনের পরিচয়ে তোর কাছে শইল্যের মাপ জিগায় , তারে যদি তোর ভালা পোলা , ভালা বন্ধু মনে হয় আমি নিষেধ করমু না ৷ তুই কারে বন্ধু বানাবি তোর ইচ্ছা পুরাটাই ৷ তয় একখান কথাই কমু , আমার বিচারে কয় এই পোলার মন ভর্তি পায়খানার হাউজ , ড্রেনের চাইতেও নোংরা ৷ এহন তোর বিচার বিবেচনা কি কয় তুই সেইটাই করবি ৷ ভালো করে ভাব , একবার না হাজার বার ৷ ভাবার পরে যদি মনে হয় অপূর্ব আসলেই অপূর্ব তহন কথা কইস , বাকিটা তোর বিবেচনা …

সেমন্তী আর কথা বলে না ৷ সে খুবই দ্বিধায় পড়েছে ৷ এই বয়সে হরমোনাল কারনেই মেয়েদের ছেলেদের সাথে কথা বলতে ভালো লাগে ৷ সেমন্তীরও ভালো লাগছে অপূর্বের সাথে কথা বলতে আমি বুঝি ৷ কিন্তু ওর ভালোটা ওকেই বুঝে নিতে হবে ৷ পাশে থেকে পথ দেখাতে পারি কিন্তু জোর জবরদস্তি করতে পারি না ৷ আমার বিশ্বাস জোর জবরদস্তি করে কখনোই ভালো ফল পাওয়া যায় না ৷ আমাদের বাবা মা এই জিনিসটা বোঝে না ৷ এমন ক্ষেত্রে তারা ছেলে মেয়েকে শাস্তি দেয় , মারধোর করে , অথচ মারধোর না করে পাশে নিয়ে বোঝালেও হয়তো অনেক ভুল শুদ্ধ করা যেতো সহজেই ৷

আমি পড়তে বসলাম ৷ আমার আর সময় নেই , পরীক্ষার দিন ঘনিয়ে এসেছে ৷ অবশ্য আমার মনে হয় না বইয়ে এমন কিছু আছে যা আমি পড়িনি ৷ পুরো বই মাথার ভিতর , এখন সময় মতো সঠিক উত্তর দিতে পারলে হয় ৷ সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারা দুনিয়ার সবচেয়ে কঠিন কাজ ৷ আমি জানি না আমি পারবো কি না ৷ তবে না পারলেও আমার মনে আফসোস থাকবে না , কারন আমি জানি আমি সততার সাথে আমার সময়টাকে কাজে লাগিয়েছি ৷ কখনো নিজের কাছে অসৎ হইনি ৷ সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি সময়ের সঠিক ব্যবহারের ৷ এখন করুনাময়ের হাতেই সবটা ৷ তিনি ভাগ্য আমাদের গলায় ঝুলিয়ে দিয়েছেন , ভাগ্যকে তো বিশ্বাস করতেই হবে ৷

সিলেটে পরীক্ষা সবার আগে ৷ আমি শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় , ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় , জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় আর জাহাঙ্গীর নগরের ফর্ম তুলেছি ৷ আমার শখ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার , বাকী সবগুলোই সাপোর্ট হিসেবে তোলা ৷ শাহজালালের ফর্ম তোলা ভিন্ন কারনে ৷

শিমুল আপা দুলাভাইকে রাজী করিয়ে ফেলেছেন ৷ জয়নাল দুলাভাই এক কথায় শিমুল আপাকে বলেছে ” বউ তুমি কইলে তোমার হাত ধইরা আমি হাবিয়া দোজখে যামু , ডাক্তরখানা আর এমুন কি ! ” আমার তাদের এই আত্মার বন্ধন দেখে মনটা ঠান্ডা হয়ে যায় ৷ আমি ভীষণভাবে চাই তাদের অপূর্নতাগুলো সব পূর্ণ হয়ে যাক ৷ করুনাময় তার করুনা বর্ষন করুক এই হংস মিথুনের উপর ৷

সময়ের পায়ে চাকা লাগানো থাকে ৷ সময় তাই সবার আগে আগে দৌড়ায় সবসময় ৷ আমার পরীক্ষার দিন চলে এলো ৷ ভোর বেলা বাড়ি থেকে রওনা দিলাম আমরা তিনজন ৷ সাড়ে দশটায় আমার পরীক্ষা ৷ বাবাকে বলা আছে আমরা ফিরবো পরের দিন ৷ পরীক্ষার পর আমরা একটু ঘোরাঘুরি করবো ৷ যেহেতু সাথে জয়নাল দুলাভাই আছে বাবা আপত্তি করেনি ৷ অনুমতি দিয়েছেন সহজেই ৷

আমার পরীক্ষা বেশ ভালো হলো ৷ জানা গেলো এই সময়ে দুলাভাই খোঁজ নিয়েছে ডাক্তারের ৷ ডাঃ অমিত লাল সাহা , এ শহরের সবচেয়ে ভালো চিকিৎসক এই সেক্টরের ৷ রাত নয়টায় তার সিরিয়াল পাওয়া গেছে ৷ এখন বাজে বারোটা , আমরা একটা হোটেলে আছি ৷ রাত নয়টি বাজতে ঢের দেরী ৷ আমার সাথে বকুল আপার ঠিকানাটা , আমি কথাটা শিমুল আপাকে বলতে খুব ভয় পাচ্ছি ৷ আপা আমাকে ভুল বুঝবে না তো !

তবুও সাহস করে বলেই ফেললাম ৷ ধীরেস্বরে আপাকে বললাম ” আপা , বকুল আপার ঠিকানা আমার কাছে আছে ৷ যাইবা তারে দ্যাখতে ? ”

শিমুল আপা অবাক হয়ে আমার দিকে তাঁকিয়ে রইলো ৷ আমি কোন এক অজানা দ্বিধায় মাথা নিচু করে ফেললাম ৷

চলবে

পয়মন্তী
তামান্না জেনিফার
পর্ব ৯
_________________

বস্তিমতো একটা এলাকা ৷ চারদিকে ছোট ছোট বাচ্চারা খেলছে ৷ কারো গায়ে জামা নেই ৷ আদুল গায়ে বাচ্চাগুলো মনের সুখে পাথর দিয়ে খেলছে ৷ একটা ঘরের দরজায় বসে একজন কুলোয় চাল নিছে বাছছিলো ৷ আমার মনে হলো মেয়েটা বোধহয় বকুল আপা ৷ কাছে যেতেই বকুল আপার মুখ স্পষ্ট হলো ৷ আপার মুখটা যেন আরো কালচে হয়ে গেছে ৷ পেটটা অনেক বড় ৷

আমাদের দেখে বকুল আপা দরজায় ভর দিয়ে উঠে দাড়ালেন ৷ আপার চোখে বিষ্ময় ৷ কথা বলতে পারছে না সে ৷ দুই তিনবার আমার আর শিমুল আপার গায়ে মুখে হাত বুলালেন তিনি ৷ জয়নাল দুলাভাইকে বার কয়েক দেখলেন আড়চোখে ৷ শিমুল আপা বকুল আপাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করলো ৷ শিমুল আপার কান্না থামাতে গিয়ে বকুল আপা নিজেও কাঁদতে শুরু করলেন ৷

আমার মনে হলো তারা কাঁদুক , এই কান্নার দরকার আছে ৷ কান্নায় নাকি শোক কমে ৷ সাত মাস ! সাতটা মাস আমরা বকুল আপাকে দেখিনি , আপাও আমাদের দেখেনি ৷ আমাদের মনের মধ্যে যেমন তুফান হয়েছে , আপার মনেও বোধহয় তেমনটাই হয়েছে ৷ আপা কাঁদতে কাঁদতেই আমাদের ঘরের মধ্যে ডেকে বসালেন ৷

ছোট্ট একটা ঘর ৷ একটা চৌকি পাতা ঘরের এক কোনে ৷ খুবঈ অগোছালো , মশারীটা বিছানার উপরে পড়ে আছে ৷ বকুল আপা তো এত অগোছালো ছিলো না , আঙিনায় একটা পাতা পড়লেও আপা সেটা তুলে ফেলতো , অথচ এই ঘরে ঢুকেই একটা বোটকা গন্ধ পেলাম ৷ যেন বহুদিন ঘরটা ঠিক মতো পরিষ্কার করা হয়নি ৷ আমি বিছানার উপর থেকে মশারি আর কাঁথা সরিয়ে হাত দিয়ে একটু ঝেড়ে দুলাভাইকে বসতে দিলাম ৷ দুলাভাইকে বসিয়ে বকুল আপার সাথে তার পরিচয় করিয়ে দিলাম ৷

বকুল আপা দুলাভাইয়ের দিকে তাঁকিয়ে লজ্জিত গলায় বললো “ভাই , শইলডা ভারি হইয়া গেছে , ঘরের কাম ঠিক মতো করবার পারি না ৷ জঙ্গল হইয়া রইছে , কিছু মনে কইরো না ভাই ৷ ”

দুলাভাই লাজুক গলায় বললেন ” কুনো সমিস্যা নাই আপা , আমরা কি অপর মানুষ যে বুঝমু না ৷ ”

দুলাভাইয়ের কথায় বকুল আপা শান্ত হলেন না ৷ চিন্তার রেখা তার কপালে ফুঁটে উঠলো ৷ আমি আপাকে একটু আড়ালে ডেকে নিলাম ৷

—আপা , এইরাম চিন্তা করতাছো কি নিয়া ?

—পয়ারে , নয়া মেহমান আইছে ৷ তার সামনে যে খাইতে দিমু আমার ঘরে এমুন কিছু নাই ৷

—আমরা খাইয়াই বাইর হইছি ৷ তুমি এইগুলা নিয়া ভাইবো না ৷

—পরথমবার আইলো মানুষটা..

—লতিফ ভাই কই ?

—জানি না

—মানে কি ?

—দশদিন আইজদিয়া , হ্যায় বাড়ি ফেরেনি ৷

—তুমি ক্যামনে আছো তাইলে ?

—এর ওর কাছে চায়া খাইতাছি ৷

—তুমি তৈয়ার হও , আমরা তোমারে লইয়া যামু

—আব্বায় পাঠাইছে ?

আমি উত্তর দিলাম না ৷ বাবা এসবের কিছুই জানে না এ কথা তাকে আমি কিভাবে বলি ৷ আমার চুপ থাকা দেখেই বকুল আপা বুঝলেন সব ৷ আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন

—এমনে যাওন ঠিক হইবো না ৷ বাড়িত অশান্তি হইবো

—অশান্তি হইলে হইবো , সবাই মিলা সামাল দিমু ৷ তোমার শইল্যের যে অবস্থা , তোমারে একলা ফালায়া যামু না আমি ৷

—বইন না ভালা , জিদ করিস না ৷ এই যে তোরা আইসোস , এইডাই আমার কাছে অনেক ৷পারলে কয়ডা টেকা দিয়া যাইস ৷ খাওনের কষ্ট বইন ৷ সারাদিন ভুখ লাগে , মনে হয় কলাগাছ ফাইরা খাই ৷

বকুল আপার কথা শুনে আমার আর সহ্য হলো না ৷ একছুটে ঘরের বাইরে চলে আসলাম ৷ এতক্ষন আমি কাঁদিনি , এবার আমি কাঁদতে শুরু করলাম ফুঁফিয়ে ৷

আমি ভেঙে পড়ার মেয়ে নই , তবে মুহূর্তটা এতটাই বিষাদের আমি নিজেকে সামলাতে পারছিলাম না কিছুতেই ৷ আমাকে কাঁদতে দেখে জয়নাল দুলাভাই এগিয়ে আসলেন আমার দিকে ৷ প্রথমবার আমার মাথায় হাত রেখে তিনি বললেন “বইন মন শক্ত করো ” … কি ছিলো তার কথায় জানিনা ৷ আমি চোখ মুছে ফেললাম ৷ মুহূর্তের মধ্যে ঠিক করলাম আমার পরবর্তী পদক্ষেপ কি হবে ৷ আমি কিছুতেই বকুল আপাকে এখানে ফেলে যাবো না ৷ কিছুতেই না ৷

জয়নাল দুলাভাইয়ের মোবাইলটা নিয়ে আব্বাকে কল দিলাম ৷ আব্বা হ্যালো বলার সাথে সাথেই আমার বুক ফেঁটে কান্না এলো ৷ এবার আমি আর কান্না থামাতে চেষ্টা করলাম না ৷ তিনি আমার বাবা , আমাদের বাবা ৷ সন্তানের চোখের পানি বাবার কাছে সবচেয়ে কষ্টের আমি জানি ৷ তবুও ফোনটা কানের কাছে নিয়ে আমি কাঁদতেই থাকলাম ৷

—কি হইছে মা , ও শিমুল মা , তুমি কান্দো ক্যান , কেডায় কান্দে ? আমার পয়া মা ? কি হইছে মা ? আমারে কও … ও মা , আমারে কও মা ..

—আব্বা …

—পয়া .. পয়া মা আমার , কি হইছে মা ? কান্দন থামাও মা , আমারে কও কি হইছে ? পরীক্ষা খারাপ হইছে ? না হয় , আরো পরীক্ষা বাকি আছে ৷ তুমি মেলা পড়ছো , একখানে না একখানে টিকবাই ৷

—আব্বা ….

—মা গো , আমি অক্ষন আইতাছি ৷ আমি অক্ষন সিলেট রওনা দিতাছি ৷ তুমি কাইন্দো মা ৷ জয়নাল রে ফোন দেও ৷

আমি দুলাভাইকে ফোন দিলাম ৷ বাবা তার কাছে ঠিকানা শুনলেন শুধু ,আর কিছুই জিজ্ঞেস করলেন না ৷ আমার বাবা খুবই শক্ত ধরনের মানুষ ৷ অথচ আজ আমার চোখের পানি বাবাকে দূর্বল করে দিয়েছে ৷ আমি দেখতে পাচ্ছি বাবা দ্রুত পায়জামা পাঞ্জাবী পরছেন , তিনি দ্রুত ছুটছেন সিলেটের পথে ৷ তার চোখে মুখে উৎকন্ঠা , চিন্তায় তার কপালে ভাজ পড়েছে ৷ তার মেয়ে কাঁদছে , দুনিয়ার সকল চিন্তার কাছে এই চিন্তা তুচ্ছ ৷

বাবা আসলেন সন্ধ্যা সাতটায় ৷ এসেই খানিকটা গম্ভীর হয়ে গেলেন ৷ কিন্তু সেই গম্ভীর ভাবটা কেটেগুলো খুব দ্রুত ৷ বাবার সামনে নিয়ে আসলাম বকুল আপাকে ৷ এরপর আর আমার কিচ্ছু করতে হলো না ৷

বকুল আপা যে কি না হাঁটতেই হাফিয়ে উঠে , বাবাকে দেখে দৌড়ে গিয়ে ঝাপিয়ে পড়লো ৷ বাবা খানিকক্ষন তার হাত গুটিয়ে রাখলো , এরপর শক্ত করে বকুল আপাকে ধরে কাঁদতে শুরু করলো বাবাও ৷

বাবা কাঁদতে কাঁদতেই বললো “হারামজাদা লতিফ্যা আমার সোনার টুকরা মায়ের কি অবস্থা করছে ! আমার আদরের ধনরে এই বস্তিত আইনা তুলছে , ওরে পাইলে ওর ঠ্যাং আমি ভাইঙা দিমু ”

বকুল আপা শুধু কাঁদছে , আকুল হয়ে কাঁদছে ৷

বাবা চাইলেন আমরা যেন রাতেই ফিরি ৷ শিমুল আপার কথা আমার মাথা থেকে চলে গিয়েছিলো ৷ হঠাৎ মনে পড়লো ৷ আমি বাবাকে বললাম , আজ রাতে না যাই , কাল ভোরে যাবো ৷ বাবা লম্বা জার্নিতে ক্লান্ত ছিলেন ৷ রাজী হয়ে গেলেন ৷

আমি আর বাবা বকুল আপাকে নিয়ে হোটেলে ফিরলাম ৷ বাড়িওয়ালাকে ঘরের চাবি আর বাকি ভাড়া দিয়ে দিলেন বাবা ৷ ভদ্রলোক বললো , সে আপার ঘরের জিনিস সাবধানে রাখবে , লতিফ ভাই আসলেই ফেরত দেবে ৷ ঘরের জিনিসের ব্যাপারে বকুল আপা বা বাবা কারো কোন আগ্রহ দেখা গেলো না ৷ ঘরে আছেই বা কি !

শিমুল আপা আর দুলাভাই হাসিহাসি মুখে ফিরলেন ৷ ডাক্তার তাদের আশ্বাস দিয়েছেন , ঔষধ পত্র শুরু করেছেন ৷ পনেরো দিন ঔষধ খাবার পর একটা পরীক্ষা করে দেখবেন বলেছেন ৷

দুটো রুম নেওয়া ছিলো , কিন্তু আমরা সবাই একঘরেই রয়ে গেলাম ৷ বকুল আপা কোন কথা বলছে না ৷ সে বাবার বুকের মধ্যে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে আছে , বোধহয় ঘুমিয়ে পরেছে ৷ বাবারও ঘুম পেয়েছে , কিন্তু বাবা নড়ছেন না ৷ হয়তো তার মনে হচ্ছে নড়লেই বকুল আপার ঘুম ভেঙে যাবে ৷ তার আদরের ধন ঘুমাচ্ছে , ঘুমাক ৷ বাবারা কষ্ট সহ্য করতে জানে ৷ সন্তানকে আরামে রাখতে বাবারা সব কষ্টই সহ্য করতে পারে ৷

আমি কখনোই ভাবিনি বাবা এত সহজে বকুল আপাকে মাফ করে দেবেন ৷ সব হয়েছে করুণাময়ের ইচ্ছায় ৷ বাবা মাঝে মাঝে বকুল আপার মাথায় আলতো করে হাত রাখছে , আমার যে কি ভালো লাগছে দেখতে আমি বলে বোঝাতে পারবো না ৷

আমরা বাড়ি ফিরলাম সকাল এগারোটায় ৷ বাবা বাড়ির ভেতরে পা রেখেই জোরে হাক ছাড়লেন “বকুলের মাও …”

মা প্রায় ছুটে এলো সাথে সাথেই ৷ আমার বোকা মা বকুল আপাকে দেখেই এক মুহূর্ত সেখানে দাঁড়ালেন না ৷ ছুটে গেলেন কলঘরে অজু করতে ৷ ঘরে এসে জায়নামাজ বিছিয়ে নামাজ পড়া শুরু করলেন ৷ তার একশ রাকাত নামাজ মানত করা আছে ৷ তিনি আল্লাহর দরবারে কেঁদে কেঁদে বলেছিলেন “ইয়া মাবুদ , আমার বকুলরে ফিরাই দেও , আল্লাহ মাবুদ আমার বকুল আবার এই বাড়িতে পাও রাখলে আমি একশ রাকাত নফল নামাজ পড়মু এক বৈঠকে ”

মা দীর্ঘ সময় নিয়ে নামাজ পড়ছেন ৷ শিমুল আপা রাঁধতে চলে গেলো ৷ সেমন্তী বকুল আপার হাত ছাড়ছে না ৷ হয়তো ওর মনে হচ্ছে হাত ছাড়লেই বকুল আপা আবার হারিয়ে যাবে ৷

পুরো বাড়িতে অদ্ভুত প্রানচাঞ্চল্য ৷ আমি এই আনন্দের ভিড়ে মিশলাম না ৷ ঘরে গিয়ে পড়তে বসলাম ৷ আমাকে অনেক পড়তে হবে ৷ আমার আসল পরীক্ষা সামনে ৷ আর মাত্র এক সপ্তাহ !

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here