নীল_আকাশের_শুকতারা (১ম পর্ব)

0
2285

#নীল_আকাশের_শুকতারা
(১ম পর্ব)
লিখা: উম্মেহানি মিম

তারার বাবা মায়ের মধ্যে ডিভোর্স হয়েছে কিছুক্ষণ আগে।কোর্টের বাইরে দাঁড়িয়ে সাহেদ সাহেব আর মিসেস কলি আবারও ঝগড়া করছেন তারা কার কাছে থাকবে সেটা নিয়ে।
কয়েক হাত দূর থেকে দাঁড়িয়ে ও বাবা,মায়ের ঝগড়া দেখছে এবং শুনছে।একমাত্র মেয়েকে নিয়ে আজকে হয়তো কাড়াকাড়ি ঝগড়া হওয়ার কথা ছিল।কিন্তু না! আজ সাহেদ সাহেব আর মিসেস কলির ঝগড়া হচ্ছে তারাকে কেউ নিজের কাছে রাখতে চান না এটা নিয়ে।সাহেদ সাহেব বলছেন,উনি কিছুতেই তারাকে কাছে রাখবেন না।ওনার ভবিষ্যৎ জীবনে তারার আর কোনো জায়গা নেই।আর কলি বলছেন, তারাকে নিয়ে ওনার কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই।উনি নিজে নিজের দায়িত্ব নিবেন কিন্তু তারার দায়িত্ব ওর বাবার।
তারা এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে বাবা মায়ের দিকে।বাবা মায়ের কথা শুনে ও মোটেও অবাক হচ্ছে না।এক বিন্দু কষ্টও হচ্ছে না ওর।কারণ তারা তার জন্মের পর থেকেই বাবা মায়ের এই ঝগড়াটা দেখে এসেছে।ওনারা দুজনই ওকে গলার কাঁটা মনে করেন। তারার জন্য বিগত সতেরো বছর ওনারা একসাথে থেকেছেন এটাই তো অনেক।সতেরো বছর বয়সের মেয়ে তারা আজ বড্ড অসহায়।কেন যে বাবা মা ওর নাম শুকতারা রেখে ছিলেন ভেবে পায় না ও।কারণ ওর জীবনে সুখের ছিটেফোঁটাও নেই।অবশ্য ওর বয়স পাঁচ বছর পেরোতেই সুখ শব্দটা মুছে গিয়ে হয়ে গেল শুধু তারা।এখন বাবা মা তারা নামেই ডাকেন।
তারা বাবার কাছেও যেতে চায় না আর মায়ের কাছেও না।বাবা মায়ের থেকে চোখ সরিয়ে ও এক দৃষ্টিতে আকাশের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বললো,এতো বড় পৃথিবীতে আমার কী কোথাও কেউ নেই যে আমাকে নিজের করে রাখবে।যার কাছে আমার এক বিন্দু পরিমাণ হলেও গুরুত্ব আছে।আর কত বাবা মায়ের মাথার বোঝা,ওদের সুখের জীবনে আপদ হয়ে থাকবো আমি!
কেউ একজন পেছন থেকে ডাকলেন,তারা?
তারা দ্রুত পেছন ফিরে তাকালো।ওর বাবার বন্ধু আরাফাত সাহেব যাকে তারা আরাফাত আংকেল বলে ডাকে তিনি দাঁড়িয়ে আছেন।উনি একজন উকিল, আর আজকে সাহেদ সাহেব আর মিসেস কলির ডিভোর্স করিয়ে দিয়েছেন।
তারা দ্রুত চোখ মুছে বললো,আরাফাত আংকেল বলুন।
আরাফাত দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন,তোমার বাবা মা কী নিয়ে ঝগড়া করছে জানো?
তারা মাথা নিচু করে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ায়।
আরাফাত তারার বিড়বিড় করে বলা কথা গুলো স্পষ্ট শুনে ছিলেন তবুও ওকে জিজ্ঞেস করলেন,কার কাছে থাকতে চাও তুমি?
তারা চুপ করে রইলো।
আরাফাত খানিকক্ষণ নিশ্চুপ থেকে বললেন,তারা তোমাকে যদি বাবা,মা কারোর কাছেই না থাকতে হয় কেমন বোধ করবে তুমি?
তারার চোখ দুটো চকচক করে উঠলো,কাঁপা গলায় বললো,পৃথিবীর যে কোনো প্রান্তে আমি থাকতে রাজি কিন্তু আমার বাবা মায়ের কাছে আপদ হয়ে থাকতে চাই না।
কথাটা বলে ও আবার আকাশের দিকে এক মনে তাকিয়ে রইলো।
আরাফাত সাহেবের মায়া হয় মেয়েটার জন্য।
এতটুকু একটা মেয়ে।ওনার মেয়ের থেকে বয়সে অনেক ছোটই হবে। আরাফাত সাহেবের দুই ছেলে মেয়ে।কত আদর যত্নে বড় হচ্ছে ওরা।তারাও বিলাসবহুল জীবনে বড় হয়েছে বাবা,মায়ের টাকা ছিল বলে।
না চাইতেও প্রয়োজনীয় সবকিছু পেয়েছে কিন্তু বাবা মায়ের ভালোবাসা পায়নি।আজ মেয়েটার চোখের সামনে ওর নিজের বাবা, মা ওকে দূরে সরিয়ে দেয়ার জন্য ঝগড়া করছে।মেয়েটা এতকিছু দেখেও শান্ত আছে হয়তো ভিতরে ভিতরে শেষ হয়ে যাচ্ছে।
আরাফাত সাহেব নিজের মতো সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলেন।মেয়েটাকে নিজের কাছে নিয়ে যাবেন।আজকে থেকে ওনার দুই ছেলে মেয়ের সাথে যুক্ত হবে এই মেয়েটিও।আজকে থেকে উনি হবেন তিন সন্তানের বাবা।আরাফাত সাহেব প্রাণভরে নিশ্বাস নেন তারপর বলেন, মা তুমি আমার কাছে থাকবে?যদি তোমার কোনো আপত্তি না থাকে আমি তোমাকে আমার কাছে নিয়ে যাবো।তারা আকাশ থেকে চোখ নামিয়ে আরাফাত সাহেবের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকালো।ওনার চোখ ছলছল করছে।চোখের চাহনি যেন অদ্ভুত মায়াভরা।
তারাকে এর আগে কখনও কেউ মা বলে ডাকেনি।এই ডাকে যে এতো মায়া সত্যিই ওর অজানা ছিল।
তারার বুক ভেঙে কান্না বেরিয়ে আসতে চায়।নিজেকে সামলে নিয়ে বললো,আমি আপনার সাথে যাবো আংকেল।আমার কোনো আপত্তি নেই।
আরাফাত তৃপ্তির হাসি হাসলেন।

তারাকে নিয়ে আরাফাত ওনার বাসার দরজায় দাঁড়িয়ে আছেন।সাহেদ এবং কলি যখনই শুনলেন তারাকে আরাফাত নিজের কাছে নিতে চান দুজনেই খুশিমনে আপদ বিদেয় করে দিলেন।
তারা শেষবারও ভাবছিল হয়তো বাবা বা মা কেউ একজন আপত্তি জানাবেন।হয়তো কেউ একজন বলবেন আমার মেয়েটা আমার কাছেই থাকবে কিন্তু সেটা হয়নি।সম্পূর্ণ অচেনা একটা জায়গায় এসে সে অনেকটা ঘাবড়ে আছে।আরাফাত আংকেল ছাড়া এই বাসার একটা মানুষকেও চিনে না ও।জানে না সবাই কেমন তবুও আশা রাখছে হয়তো আরাফাত আংকেলের মতোই হবেন ওনারা।
আরাফাত তারাকে নিয়ে এসেছেন ঠিকই তবুও অজানা আশংকা বাসা বেধেছে ওনার মনে।তারাকে ওনার স্ত্রী বা ছেলে মেয়েরা এতোটা স্বাভাবিক ভাবে মেনে নিবেন তো!
আরাফাত সাহেব এসব ভাবতে ভাবতেই কলিংবেল চাপলেন।দরজা খুলে দিলো ওনার ছোট মেয়ে নীরা।তারা এক পলক তাকিয়ে দেখলো ফর্সা লম্বা বেশ ফুটফুটে চেহারার দেখতে একটা মেয়ে নীরা।
বাবার সাথে অচেনা একটা মেয়েকে দেখে নীরা খানিকটা অবাক হয়েই প্রশ্ন করলো,এটা কে বাবা?
আরাফাত সাহেব ভিতরে প্রবেশ করে বললেন,আগে ভিতরে যাই পরে পরিচয় করে দিচ্ছি।নীল বাসায় আছে?
নীরা তারার দিকে এক পলক তাকালো,
উজ্জল শ্যামলা গায়ের রঙে একটা মেয়েকে এতোটা রূপবতী মনে হয় এর আগে কখনও কল্পনাও করতে পারেনি।কোনো সাজসজ্জা নেই পরনে সাধারণ সেলোয়ার-কামিজ।উড়না দিয়ে মাথায় আধ ঘোমটা টানা।
অসম্ভব সুন্দর চোখদুটি, চেহারায় অদ্ভুত এক মায়া আছে মেয়েটার।
তারার দিকে তাকিয়েই বাবার প্রশ্নের জবাব দিলো,ভাইয়া তো কলেজে।
–ও আচ্ছা তোমার মাকে ডাকো।
নীরা রান্নাঘরে দিকে দ্রুত পায়ে হেটে গিয়ে হালিমা বেগমকে ডেকে নিয়ে এলো।
হালিমা এসে তারাকে দেখে চোখ বড় বড় করে তাকালেন।
আরাফাত তারাকে সোফায় বসতে বলে নিজেও বসলেন।তারা বসবে না দাঁড়াবে বুঝতে না পেরে দাঁড়িয়ে রইলো।
আরাফাত এবার বলা শুরু করলেন,এটা হচ্ছে সাহেদের মেয়ে তারা..
হালিমা কথার মাঝখানেই ওনাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন,সাহেদ ভাইয়ের না আজ ডিভোর্স হওয়ার কথা তো ওনাদের মেয়ে এখানে কেন?
আরাফাত সাহেব গম্ভীরভাবে বললেন,আগে আমার বলা শেষ হোক তারপর কথা বলবে।
হালিমা এবার আর কিছু বললেন না।নীরা বেশ আগ্রহ নিয়েই শুনছে।
আরাফাত সাহেব গলা পরিষ্কার করে বললেন, আজ থেকে ও আর সাহেদের মেয়ে না আমার মেয়ে।সাহেদ আর কলি কেউ ওকে..
আরাফাত থেমে গেলেন।বাবা, মা মেয়েকে নিজের কাছে রাখতে চায়নি এটা একটা মেয়ের সামনে বার বার বলার কোনো মানে নেই।উনি কথা কাটিয়ে বললেন,যাই হোক আজ থেকে তারা আমাদের সাথেই থাকবে।
তারপর তারাকে উদ্দেশ্য করে বললেন,তারা মা এটা আমার ছোট মেয়ে নীরা, অনার্স প্রথম বর্ষের ছাত্রী।
আর আমার বড় ছেলে নীল।অনার্স শেষ বর্ষে পড়ছে।
ও এখন বাসায় নেই বাসায় এলে তোমার সাথে পরিচয় হবে।আর ইনি হলেন নীলের মা। তুমি আন্টি বলে ডেকো।
হালিমা আর এক মুহুর্ত এখানে না দাঁড়িয়ে হনহন করে বসার ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।
তারা স্পষ্ট বুঝতে পারলো হালিমা আন্টি ওকে দেখে অখুশি।আরাফাত সাহেব তারার ভাবনাটা বুঝতে পেরে বললেন,তুমি কিছু মনে করো না মা নীলের মা মনে হয় তারকারি চুলোয় বসিয়ে এসেছে তাই চলে গেছে।আমি আসছি তুমি নীরার সাথে গল্প করো।
তারপর নীরাকে উদ্দেশ্য করে বললেন,নীরা মা তুই ওর ঘরটা দেখিয়ে দিস।
তারা নিজের অজান্তেই সোফায় ধপাস করে বসে পড়লো।
নীরা এগিয়ে এসে তারার কাছাকাছি বসলো,তারপর ফিসফিস করে বললো,তোমার নাম একদম তোমার চেহারার মতোই সুন্দর।আকাশের তারাকে এক পলক দেখলেই যেমন মন ভালো হয়ে যায় তুমিও ঠিক তেমনই।
তোমাকে আমার বেশ পছন্দ হয়েছে।মায়ের কিন্তু তোমাকে মোটেও পছন্দ হয়নি তাই চলে গেছে।কিন্তু তুমি চিন্তা করো না, এ বাসায় মায়ের পছন্দ না হলেও বাবা যদি কাউকে রাখতে চায় সে সারা জীবন থাকতে পারবে।
ভয় ভাইয়াকে নিয়ে, ও এলে তোমাকে দেখে কী রিয়েক্ট করে কে জানে।
তারা নীরার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো।
বুঝতে পারছে এ বাসায় সহজে জায়গা হবে না ওর।আর যদি হয়ও সেই বাবা মায়ের গলার কাঁটার মতোই এ বাসায়ও কাঁটা হয়ে থাকতে হবে ।
অজানা ভয় আর আশংকা চেপে ধরলো ওকে।

চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here