নীল_আকাশের_শুকতারা,১৩,১৪

0
1112

#নীল_আকাশের_শুকতারা,১৩,১৪
(১৩তম পর্ব)

তারা প্যাকেটটা হাতে নিয়ে খুলে ফেললো একটা বড় চকলেট বক্স।তারা খেয়াল করলো ফুলের সাথে একটা চিরকুটও রয়েছে।সে দ্রুত চিরকুটটা হাতে নিলো।যেটাতে লেখা “আর কোনোদিন শাড়ি পরবে না।শুভ জন্মদিন।”
তারা খুব অবাক হয়ে গেল কে এই ফুল,চকলেট আর চিরকুট কে রেখেছে।আকাশ তো শাড়ি পরায় ওর অনেক প্রশংসা করেছে তবে সে এই চিরকুট লেখার কথাও না।তারার যে সাদা গোলাপ আর চকলেট পছন্দ সেটা নীরা ছাড়া আর কেউ জানে না কিন্তু নীরা তো একটা গিফট দিয়েছেই, আবার গিফট দিয়ে এভাবে একটা চিরকুট নিশ্চয়ই লিখবে না।
তবে কী নীল? কিন্তু তারা আগে নীলের হাতের লেখা পড়েছে এই লেখাটা সম্পূর্ণ আলাদা।আর নীল ওকে এভাবে চকলেট আর ফুল দিবে ব্যপারটা অবিশ্বাস্য।
তারা কিছু বুঝতে পারছে না মনে মনে ভাবলো,নীলকে একবার জিজ্ঞেস করা যায়।পরমুহূর্তেই মনে হলো,নীল যে স্বভাবের মানুষ যদি ফুল, চকলেট না দিয়ে থাকে তবে জিজ্ঞেস করলে রেগে যেতে পারে।তাই আজকের চিরকুটের লেখাটার সাথে নীলের লেখা ভালো করে মিলিয়ে দেখলেই হয় যখন সে ঘরে থাকবে না তার ঘরে গেলে নিশ্চয়ই হাতের লেখা পাওয়া যাবে।সেদিন নীলের হাতের লেখা দেখেছে তবুও আরেকবার মিলিয়ে নিলেই হয়। পছন্দের উপহার গুলো যে দিয়েছে তাকে না চিনলে মনে স্বস্তি আসবে না।
তারা শাড়ি ছেড়ে ফ্রেশ হয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিলো।মুহুর্তেই দু-চোখ বুজে এলো ঘুমে।
তারার ঘুম ভাঙলো প্রচন্ড পানি পিপাসায়।ঘুম ভেঙে মাথার ভিতরটা ফাঁকা ফাঁকা লাগলো।কী জানি একটা অদ্ভুত স্বপ্ন দেখেছে মনে করার চেষ্টা করলো,হ্যাঁ মনে পড়েছে।তারা দেখলো কোথাও একটা প্রচন্ড বিপদে পড়েছে সে চিৎকার করে কাঁদছে কেউ তার কান্না শুনছে না।তারার সামনে দিয়েই ওর বাবা -মা চলে যাচ্ছেন কিন্তু ফিরে তাকাচ্ছেন না সেই মুহুর্তে আরাফাত সাহেব সেখানে হাজির হলেন।তারাকে টেনে তুলে নিয়ে আসলেন তারপর কাকে যেন একটা ডেকে এনে তার কাছে তারাকে রেখে আরাফাত সাহেব আবছা ধুয়ায় হারিয়ে গেলেন।
তারার স্পষ্ট মনে পড়লো,যার কাছে রেখে গেলেন সেই মানুষটা প্রচন্ড শক্ত করে তারার হাত ধরে রেখেছিল।এখনও যেন সেই স্পর্শ তারার হাতে লেগে আছে।সেই স্পর্শে যেন ছিল ভরসা,সাহস।
তারা বিছানার কাছেই রাখা পানির জগটা থেকে গ্লাসে পানি নিয়ে এক চুমুকে পুরোটা সাভার করে দিলো।গলাটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে ছিল।
এমন অদ্ভুত স্বপ্নের কারণ তারা বুঝতে পারলো না।কানে ভেসে এলো ফজরের আযান।সে উঠে অযু করে ফজরের নামাজ আদায় করলো।
প্রতিদিনের মতোই নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে সিড়ি বেয়ে নিচে নেমে আসতে গিয়ে থেমে গেল,এতো সকাল কেউ হয়তো জাগেনি এখনই রান্নাঘরে যাওয়া উচিৎ না যদি আবার আকাশের সাথে দেখা হয় সেদিনের মতো একটা কান্ড হবে।তারা নিজের ঘরে ফিরে গেল অপেক্ষা করতে লাগলো কেউ জাগার।

সকাল বেলা হালিমা বেগম রান্নাঘরে আসার পর তারা এলো।ওনার বাতের ব্যথা বেড়েছে তারাকে অনুরোধ করে বললেন কিছু একটা নাস্তা বানাও আমি নীলকে ডেকে বলছি বাইরে থেকে কিছু নিয়ে আসতে।তারা হালিমা বেগমকে নিষেধ করে বললো, আমি নাস্তা বানাতে পারবো আন্টি বাইরে থেকে কিছু আনার দরকার নেই রান্নাটাও আমি করবো।
হালিমা একটা সুস্থির নিশ্বাস ছেড়ে বললেন,আচ্ছা বানাও আমি এখানেই একটা চেয়ার এনে বসি।
তারা একটা চেয়ার এনে দিলো হালিমা বেগমকে।
উনি বসে বসে তারার কাজ দেখছেন।ও লুচি, আলুর দম রান্না করছে।হালুয়া বানিয়েছে।হালিমা মনে মনে বললেন,মেয়েটা শুধু লক্ষ্মী না অনেক গুণবতীও বটে।
নাস্তার টেবিলে সবাই খাবারের খুব প্রশংসা করলো।এমনকি আতিয়াও পছন্দ করলেন।ব্যপারটা তারার অনেক ভালো লাগলো।

আতিয়া আকাশ আর মেঘকে নিয়ে বেরিয়েছেন। নীরা আর নীলকেও ওনাদের সাথে নিয়ে গেছেন কোনো একটা দরকারে। তারা ভাবলো এই ফাঁকে নীলের ঘরে গিয়ে চিরকুটের লেখাটার সাথে নীলের হাতের লেখা মিলিয়ে নিবে।তারা পা টিপে টিপে নীলের ঘরে গিয়ে ওর বইপত্র ঘাটতে লাগলো।উদ্দেশ্য কোথাও হাতের লেখা পায় কী না।তারা আনমনে হাতের লেখা খুঁজতে ব্যস্ত তখনই ঘরে কারোর উপস্থিতি টের পেল।ও কেঁপে উঠে দ্রুত পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখলো নীল এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তারার দিকে।
আচমকা নীলকে এভাবে চলে আসতে দেখে তারার হৃদ স্পন্দন তড়িৎ বেগে ছুটছে।দ্রুত হাতের চিরকুট পেছনে লুকিয়ে ভয়ে ভয়ে নীলের দিকে তাকালো।
নীল স্থির গতিতে তারার কাছে এসে দাঁড়ালো,তারপর বললো,কী করছো তুমি আমার ঘরে?
তারা ঢোক গিলে মাথা নাড়ালো।
নীল তারার লুকিয়ে রাখা হাতের দিকে দৃষ্টি দিয়ে বললো,হাতে ওটা কী দেখি,কী লুকালে।
তাঁরা আবারও কেঁপে উঠলো,কিছুতেই চিরকুট নীলকে দেখানো যাবে না।তারা কাঁপা গলায় বললো,কিছু না আমি এখন যাবো।
কথাটা বলে তারা চলে যেতে লাগলো নীল পেছন থেকে ওর হাত টেনে ধরলো।
তারা হিংস্র দৃষ্টিতে নীলের দিকে তাকিয়ে বললো,কথায় কথায় আপনি আমার হাত ধরবেন না এসব আমার পছন্দ না।
নীল মুহুর্তে তারার হাত ছেড়ে দিয়ে বললো,ও আচ্ছা হাত ধরা পছন্দ করো না কিন্তু কারোর গায়ে পড়ে গল্প করতে পছন্দ করো তাই না?
তারা কপাল কুচকে বললো,মানে?
–মানেটা খুব সহজ তুমি তোমার ব্যক্তিগত জিনিস,ব্যক্তিগত কথা সবার সাথে শেয়ার করতে পারো কিন্তু আমি আমার ঘরে ঢুকে অন্যকেউ আমার ব্যক্তিগত জিনিস পত্র ঘাটাঘাটি করুক এটা পছন্দ করি না।কথাটা মাথায় ঢুকিয়ে নাও, যখন তখন আমার ঘরে ঢুকে এটা ওটা ঘাটাঘাটি করার আগে আরেকবার ভেবে নিবে আমি আকাশ না।
–কী বলতে চাইছেন আপনি আমি আমার ব্যক্তিগত জিনিস,ব্যক্তিগত কথা কার সাথে শেয়ার করেছি?
–সেটা তুমি ভেবে দেখো।
–আপনি যা বলছেন সরাসরি বলুন।
–থাকছো আমাদের বাসায় অথচ গতকাল তোমার জন্মদিন ছিল সেই কথাটা আকাশকেই বলতে হলো কেন?আমাদের বলা যেতো না, এতো যদি ঘটা করে জন্মদিন পালন করার শখ।আমাকে না বলো অন্তত নীরাকে বলতে পারতে কিন্তু তুমি সেটা না করে আকাশকে গিয়ে বললে।
নীলের কথাগুলো শুনে তারা ভিষণ অবাক হয়েছে সাথে কষ্টও হচ্ছে ভিষণ।তারা ভাঙা গলায় বললো,আমি ওনাকে আমার জন্মদিনের কথা কেন বলতে যাবো?আর আপনাদেরই বা কেন বলবো আমি তো চাইনি আপনারা আমার জন্য এতসব করবেন।
নীল তারার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে বললো,কী যে চাও সেটা আমি ভালো করেই বুঝে গেছি।আমি আকাশের মতো এতো ভালো মানুষ না যে তোমার মিষ্টি মিষ্টি কথা শুনে গলে জল হয়ে যাবো।
এখন বিদেয় হও আমার ঘর থেকে।
তারার আর নীলের সাথে একটা কথাও বলতে ইচ্ছে হলো না দ্রুত পায়ে বেরিয়ে গেল ওর ঘর থেকে। চিরকুটটা হাতে দলা পাকাচ্ছিল, নীলের কথাগুলো শুনে বেরিয়ে যাওয়ার সময় কখন হাত থেকে পড়ে গেছে খেয়ালই করেনি।
তারা চলে যেতেই নীল মেঝেতে পড়ে থাকা চিরকুটটা তুলে নিলো,একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মনে মনে বললো,মুখের কথার পরেও একটা কথা থাকে সেই কথার গভীরতা সবাইকে স্পর্শ করে না।

তারা মনে মনে নিজেকে অসংখ্যবার বকলো, ফুল আর চকলেট নীল দিয়েছে এমন একটা অদ্ভুত চিন্তা করার জন্য।তারা ভেবে পাচ্ছে না এরকম একটা বোকা বোকা চিন্তা সে করে আবার নিলের ঘরে চলে গেল কোন আক্কেলে।নীল একটা দানব, শুধু দানব না রাগী দানব আর একটা দানব কখনও কাউকে ফুল উপহার দিতেই পারে না।দানবের তো সেরকম মনই থাকে না।কিন্তু উপহারটা কে দিয়েছে সেটা তো জানা দরকার তারা মনে মনে ফন্দি আটলো..
চলবে..
লিখা: উম্মেহানি মিম

★#নীল_আকাশের_শুকতারা★
————————(১৪তম পর্ব)

তারা মনে মনে ফন্দি আটলো।
দুপুরের খাওয়া দাওয়া শেষে বিকেলে নীরা এসে তারাকে নিয়ে গেল ছাদে দুজনেই গল্প করছিল।নীরা হঠাৎ বললো,তারা আমরা অনেক গল্প করি কিন্তু কখনও নিজেদের বিষয়ে কেউ কাউকে প্রশ্ন করিনি।তুমি কী কখনও কারোর প্রেমে পড়েছো?
তারা নীরার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো, তারপর বললো না আপু।তুমি?
নীরা বললো, প্রেম কী না জানি না কিন্তু একজনকে বড্ড ভালোবাসি।
তারা আগ্রহ নিয়ে বললো,আর সে?
নীরা হেসে বললো,আমাদের মধ্যে সেরকম কোনো সম্পর্ক নেই কারণ আমি যে তাকে ভালোবাসি সে জানেই না।
–সে বুঝতে পারে না?
–হয়তো পারে আবার হয়তো পারে না।
–তুমি বলে দাও না কেন আপু?
–সব কথা বলা যায় না তারা।আমার মনে হয় সে সবটা বুঝেই না বুঝার ভান করে থাকে।
–সেই ভাগ্যবান মানুষটা কে যাকে আমার আপু এতো ভালোবাসে, আমাদের কলেজের কেউ?
–হতে পারে ।
–হতে পারে কী আপু?
নীরা হেসে কিছু একটা বলতে যাবে খেয়াল করলো
আকাশ আর নীল ছাদে এসে হাজির হয়েছে।যদিও ওরা জানতো না তারা আর নীরা ছাদে।
নীল নেমে আসতে চাইলে আকাশ ওকে আটকে বললো, এলাম যখন কিছুক্ষণ থেকে যাই।
আকাশ এগিয়ে এসে বললো,নীরা, শুকতারা কী গল্প করা হচ্ছে এতো?
নীরা বললো,তেমন কিছু না।
তারপর তারাকে উদ্দেশ্য করে বললো আচ্ছা তারা তুমি বলছিলে খুব চকলেট খেতে ইচ্ছে করছে, এই ভাইয়া কয়েকটা চকলেট নিয়ে আয় না তারার জন্য।
নীল ভ্রু কুচকে তারার দিকে তাকালো।তারা দ্রুত চোখ সরিয়ে নিলো।
নীরা আবার বললো, ভাইয়া কী বলেছি শুনেছিস তো?
আকাশ এবার বললো,শুকতারার চকলেট খেতে ইচ্ছে করছে আমাকে বললেই হয় আমার কাছে অনেক চকলেট আছে আমি নিয়ে আসছি।
নীল আকাশকে থামিয়ে বললো,তোর আনতে হবে না আমি নিয়ে আসছি।
আকাশ মুচকি হেসে বললো, তুই বাইরে থেকে আনবি আর আমার কাছে তো চকলেট আছেই আমি দুই মিনিটে নিয়ে আসবো।তোকে কষ্ট করে যেতে হবে না।
কথাটা বলে আকাশ চলে গেল।
আকাশ চলে যেতেই নীরা বললো আমি কফি বানিয়ে আনি এখানে বসে খাওয়া যাবে।
তারা নীরার পেছন পেছন যেতে লেগেছে তখনই নীল পেছন থেকে ডাকলো, তারা দাঁড়াও কথা আছে।তারা দাঁড়ালো।
নীল তারার দিকে তাকিয়ে বললো,চকলেট খাওনি?
–কোন চকলেট
–মানে তোমার জন্মদিনে তো চকলেট উপহার পেলে।
–আমাকে জন্মদিনে কেউ তো চকলেট উপহার দেয়নি।
নীল এবার খানিকটা অবাক হয়ে বললো,তুমি এক বক্স চকলেট উপহার পেয়েছিলে সেটা না খেয়ে ফেলে রেখেছো কেন?
–কারণ আমি জানি না চকলেট গুলো কে দিয়েছে।না জেনে যার তার দেয়া চকলেট আমি খাবো কেন?
–এই বাসায় কয়টা মানুষ?
তারা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে মনে মনে হিসাব করে বললো, আট জন।
–কালকে কী বাইরের কেউ বাসায় এসেছিল?
–না।
–তাহলে যে সে কীভাবে গিফট দিয়ে যাবে?
তারা আমতা আমতা করে বললো, বাসারই কেউ দিয়েছে সেটা তো জানি কিন্তু কে দিয়েছে না জেনে কেন আমি গিফটটা নিবো?
–কারণ এই বাসার সবাই তোমার কাছের মানুষ, পরিচিত।
–যাই হোক আপনি জানলেন কী করে আমি জন্মদিনে চকলেট উপহার পেয়েছি?
নীল তারার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে বললো,আমার ঘরে গিয়ে চোরের মতো আমার বই-পত্র না ঘেটে,এতো কষ্ট করে আমার লেখার সাথে চিরকুটের লেখাটা না মিলিয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করলেই হতো এগুলো আমি দিয়েছি কী না।
তারা চোখ বড় বড় করে বললো,তার মানে এগুলো আপনি?
নীল তারার দিকে আড়চোখে এক পলক তাকিয়ে হনহন করে ছাদ থেকে নেমে চলে গেল।
তারা হা হয়েই দাঁড়িয়ে রইলো ছাদে।

আকাশ অনেক গুলো চকলেট নিয়ে গিয়ে তারার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো,নাও শুকতারা সবগুলো তোমার।
তারা আনমনে বললো,চকলেট খেতে ইচ্ছে করছে না এখন।
আকাশ অবাক হয়ে বললো, মাত্র না চকলেট খেতে চাইলে।
তারা আর কিছু না বলে নিচে নেমে এলো।

সন্ধার পরে তারা নিজের ঘরে দরজা বন্ধ করে নীলের দেয়া চকলেট আর ফুলগুলো হাতে নিয়ে বসে আছে, কিছুতেই যেন বিশ্বাস করতে পারছে না নীল এগুলো দিয়েছে তাকে।তাছাড়া নীল চিরকুটে এমন অদ্ভুত একটা কথা কেন লিখলো, তারাকে কী শাড়ি পরে বিচ্ছিরি দেখাচ্ছিল!
যদি বিচ্ছিরিই দেখায় তবে তার কী, খারাপ দেখালেও তো নীলের এতে মাথা ব্যথা থাকার কথা না। হঠাৎ দরজার বাইরে নীরার গলা শুনতে পেয়ে তারা দ্রুত হাতের জিনিস গুলো রেখে উঠে এসে দরজা খুললো,নীরার মুখটা বেশ অন্ধকার দেখাচ্ছে তারাকে বললো,একটু নিচে এসো।
তারা একটু চিন্তিত হয়েই বললো,নিচে কেন আপু কিছু হয়েছে।
নীরা বললো,আরে তেমন কিছু না, একবার এসো দেখবে।
তারা আর প্রশ্ন না করে দ্রুত নীরার সাথে নিচে গেল।
বসার ঘরে আরাফাত সাহেব,হালিমা বেগম,আতিয়া সহ নীল, মেঘ, আকাশ সবাই উপস্থিত।সবাই গল্প করছেন।তারা খানিকটা এগিয়ে যেতেই দেখলো তার মা কলিও ওনাদের সাথে বসে আছেন।
মাকে দেখতে পেয়ে সে প্রচন্ড অবাক হয়ে গেল।কলি তারাকে দেখতে পেয়ে উঠে এলেন, তারার কাছে, তারপর ওর মুখটা টেনে নিয়ে কপালে চুমু খেলেন।কলি কাঁদছেন।তারা জানে না তার মায়ের এই কান্নার পেছনের কারণ তবুও বুকটা ভিষণ ভাড় লাগছে তার।কলি তারাকে আদরমাখা গলায় বললেন,কেমন আছিস মা?
তারা ঢোক গিলে বললো,ভালো।তুমি?
কলি চোখ মুছতে মুছতে বললেন,আমার মেয়েটার খুব অভিমান তার মায়ের উপর তাই না?
তোর সাথে আমার কথা আছে।
এতোদিনে মাকে এক নজর দেখতে পেয়ে তারার যেন বুক ভেঙে কান্না বেরিয়ে আসতে চাইছে তবুও নিজেকে সামলে বললো,আমার কোনো অভিমান নেই কী কথা আছে বলো।
কলি আরাফাত সাহেবের দিকে তাকিয়ে বললেন,যদি আপনি অনুমতি দেন আমি আমার মেয়েটার সাথে একটু একা কথা বলতে চাই, আমার কিছু কথা আছে ওর সাথে।
আরাফাত সাহেব বললেন,অবশ্যই ভাবী,আপনি আপনার মেয়ের সাথে কথা বলবেন এতে আমার অনুমতি নেয়ার কোনো প্রশ্নই আসে না।
কলি তারাকে নিয়ে বসার ঘর থেকে বেরিয়ে খানিকটা দূরে নিয়ে গেলেন।
আতিয়া বিরক্ত হয়ে বললেন,এই সন্ধায় চা-টা খাই, খানিক্ষন গল্প করি এর মধ্যে এই মহিলা এসে আবার কী নাটক শুরু করলেন?মেয়ের জন্য এতো ভালোবাসা তো সাথে নিয়ে গেলেই পারেন।
বসার ঘরে বসা আর একটা মানুষও আতিয়ার কথার প্রতিউত্তরে কিছু বললো না।

কলি অঝোরে কাঁদছেন,তারা মায়ের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।সেও কাঁদছে কিন্তু নিঃশব্দে,আর সেই কান্না চোখ পেরিয়ে গাল বেয়ে নেমে আসছে না।কয়েক মিনিট এভাবেই নিঃশব্দে কাটলো।নীরাবতা ভেঙে কলি বললেন,তারা তোর এই অপরাধী মা কে ক্ষমা করে দেয়া যায় না?
আমি যা করেছি পরিস্থিতি আমাকে করতে বাধ্য করেছে রে মা।তোর মামারা চাইতেন যদি সংসার ভেঙে যায় আমি যেন তোর দায়িত্ব না নেই।এতে করে তোর বাবা ছাড় পেয়ে যাবে।আর আমি তোর দায়িত্ব না নিলে সে তার দায়িত্ব পালন করতে বাধ্য হবে।তোর মামা-মামীরা আমাকে এসব বুঝায়।আর একটা সময় আমারও প্রচন্ড কষ্ট,রাগ,জেদ সব মিলিয়ে তোকে ছেড়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত আমি নিয়ে নেই।আর এই সিদ্ধান্তের পেছনে শুধু ছিল তোর বাবার উপর ঘৃণা।
কিন্তু তোকে ছাড়া এই কতগুলো দিন আমি কীভাবে কাটিয়েছি তুই জানিস না,প্রতিদিন, প্রতিনিয়ত আমি ভেতরে ভেতরে শেষ হয়ে যাচ্ছিলাম।যখনই তোর কথা তোর মামাদের বলতাম ওনারা বলতেন আমার দায়িত্ব নিয়েছেন এটাই বেশি,তোর দায়িত্ব ওনারা নিবেন না।তোকে কাছে নিয়ে যেতে হবে সেই ভয়ে ফোন পর্যন্ত করে খোঁজ নিতাম না তোর।
কিন্তু এভাবে আমি বাঁচতে পারবো না রে মা।তুই আমার অস্তিত্ব, আমার বেঁচে থাকার একটাই অবলম্বন তোকে ছাড়া আমি বাঁচবো কী নিয়ে মা?
তোর মামারা আমাকে বিয়ে দিতে চেয়েছেন নতুন করে আমাকে সংসারী বানিয়ে ওনাদের ঘাড়ের উপর থেকে বোঝা নামাতে চাইছিলেন, জেদের বসে হয়তো আমি প্রথমে বারণ করিনি ওনাদের কিন্তু একটা সময় আমি ভেবে দেখেছি এভাবে নতুন করে আর কিছুই শুরু করা সম্ভব না আমার পক্ষে।সিদ্ধান্ত নিলাম যদি বেঁচে থাকি তোকে নিয়ে বাঁচবো।কিন্তু বাঁচতে হলে তো নিজের আর তোর দায়িত্ব নেয়ার জন্য আমার কিছু করার দরকার তাই পাগলের মতো চাকরি খুঁজতে লাগলাম একটা স্কুলের চাকরি হয়েও গেল।আর সেই চাকরিটা পেয়েই ছুটে এসেছি তোর কাছে।এখন আমি তোর দায়িত্ব নিতে পারবো মা হয়তো তোর বাবার মতো তোকে অনেক কিছু দিতে পারবো না কিন্তু মা মেয়েতে চলে যাবে দেখিস।আমাকে ফিরিয়ে দিস না মা, ফিরে চল আমার সাথে।
কথাগুলো বলে কলি কান্নায় ভেঙে পড়লেন।তারা আর নিজেকে সামলাতে না পেরে মায়ের বুকে ঝাপিয়ে পড়ে হাউমাউ করে কান্না শুরু করলো।
ফুপিয়ে ফুপিয়ে বললো,আমি তো তোমাদের কাছে অনেক কিছু চাইনি মা, শুধু চেয়েছি তোমাদের নিয়ে থাকতে।কিন্তু তোমরা আমাকেই ছেড়ে চলে গেলে।
কলি ভাঙা গলায় বললেন,আর ছাড়বো না মা ক্ষমা করে দে আমায়।
মা মেয়ের কান্নার শব্দ মিলেমিশে এক করুণ সুরের সৃষ্টি হলো পুরো ঘর জোরে।

আরাফাত সাহেব উসখুস করছেন তারার মায়ের সাথে কী কথা হচ্ছে সেই ভেবে।মেয়েটাকে বড্ড ভালোবেসে ফেলেছেন এই কয়দিনে।অবশ্য এতো ভালো একটাও মেয়েকে ভালো না বেসে তো আর পারা যায় না।
তারার কান্নার শব্দ খানিকটা এ ঘরেও আসছে।
নীলের বুকের ভেতরটা কেমন ছটফট করছে।কেন জানি তারার কান্না সে সহ্য করতে পারে না।এর কারণ নীলের অজানা নয় তবুও যেন জেনেও না জানার ভান করে থাকে সে।বার বার হৃদয়টাকে পুড়ানোর কোনো মানে হয় না।তবুও মন যে বড্ড অবাধ্য। কখন কার প্রতি মায়ার তৈরি করে ফেলে বুঝাই যায় না।

কলি তারাকে নিয়ে বসার ঘরে প্রবেশ করলেন।উনি তারার হাতটা বেশ শক্ত করে ধরে রেখেছেন।
নীরার বানানো চা আতিয়া বেশ আয়েস করেই খাচ্ছিলেন।তারা আর তার মাকে দেখতে পেয়ে খট করে চায়ের কাপটা টেবিলে রাখলেন।
আরাফাত সাহেব উঠে কলিকে বসতে বললেন।নীরাকে ডেকে বললেন ওনাকে চা দিতে।কলি তারাকে ওনার পাশে বসিয়ে নিজেও বসলেন।তারপর বললেন,আরাফাত ভাই আমি চা -টা কিছু খাবো না আসলে আমার কিছু কথা বলার ছিল।
আরাফাত সাহেব সম্মতি জানালেন।
কলি তারার দিকে এক পলক তাকিয়ে বললেন,ভাই আর ভাবী আপনারা আমার মেয়ের জন্য যা করলেন তার ঋণ আমি কোনদিন শোধ করতে পারবো না।কিন্তু এবার আমি আমার মেয়েটাকে আমার কাছে নিয়ে যেতে চাই।আপনারা অনুমতি দিলে আমি মেয়েটাকে আমার কাছে নিয়ে যাবো।
কলির কথা শুনে আরাফাত সাহেব দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন।হালিমা বেগনের মনেও যেন আধার নেমে এলো।
নীরা মুখ গোমড়া করে দ্রুত বললো, তার মানে তারা চলে যাবে?
তারা চলে যাবে কথাটা যেন নীলের বুকে সুচের মতো বিধলো।বুকে চিনচিনে ব্যথা শুরু হলো।
আরাফাত সাহেব নীরার দিকে তাকিয়ে বললেন,তারা হচ্ছে কলি আর সাহেদের মেয়ে যদিও আমিও ওকে আমার মেয়ে করেই এ বাসায় নিয়ে এসেছিলাম কিন্তু সত্যি হলো তারার মা-বাবা চাইলে তাকে আমাদের ফিরিয়ে দিতেই হবে।এই কয়দিনে মেয়েটা বড্ড আপন হয়ে গিয়েছে তা সত্যি কিন্তু তার মায়ের কাছে ফিরে গেলে মেয়েটা হয়তো অনেক খুশি থাকবে তাই ওর চলে যাওয়ায় মন খারাপ করাটা অর্থহীন মা।
আরাফাত সাহেব এবার তারার দিকে তাকিয়ে বললেন,কিন্তু আমার তারা মা যেতে চায় তো?তুমি যেটা চাও সেটাই বলবে কিন্তু মা। মনে রেখো তুমি চাইলে সারা জীবন আমার মেয়ের মতো আমার বাসায় থাকতে পারো আমার কোনো অসুবিধা নেই।
তারা ভাঙা গলায় বললো,আমি মায়ের সাথে যেতে চাই আংকেল।
আরাফাত সাহেব দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে কলিকে উদ্দেশ্য করে বললেন,তা কবে মেয়েকে নিয়ে যেতে চাইছেন?
কলি মুচকি হেসে বললেন,এই তো আপনি অনুমতি দিলে আজই।
তারার মায়ের কথা শুনে নীল এবার আচমকা বলে উঠলো,তারা এভাবে হঠাৎ করে চলে যেতে পারে না।
উপস্থিত সবাই নীলের দিকে উৎসুক চোখে তাকালেন।
নীল নিজের বলা কথাটায় নিজেই চমকে উঠলো।তারার চলে যাওয়ার কথা শুনে কখন আনমনে মনের কথাটা মুখ ফুসকে বাইরে বেরিয়ে এসেছে বুঝতেই পারে নি।সে আমতা আমতা করে বললো..
চলবে….
লিখা: উম্মেহানি মিম

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here