অভিমানী_ঝরা_পাতা,সূচনা_পর্ব

0
1635

#অভিমানী_ঝরা_পাতা,সূচনা_পর্ব
#ফাতেমা_তুজ

রাত একটা কি দুটো। হঠাৎ ঘুম ভেঙে যেতেই নিজের পাশে একটি ছেলের দেহ দেখে চমকে উঠলো ঝরা। নিভু নিভু আলো তে মুখ টা স্পষ্ট নয়। অবিবাহিত মেয়ের ঘরে কোনো ছেলে কি করে থাকবে?
চিৎকার করতে যেতেই মুখ চেপে ধরলো ছেলেটি। ঝরার কপাল বেয়ে ঘামের স্রোত নেমেছে। অজানা ভয়ে বুকের ভেতর ধিম ধিম আওয়াজ হতে লাগলো। এই বুঝি কাল খবরের কাগজে নিজের ছবি দেখা যাবে। নিউজ চ্যানেল গুলোর হেডলাইন হবে ঝরার নামে। কি সাংঘাতিক আর বিভর্ষ কল্পনা! চেঁচানোর চেষ্টা করতেই মুখ দিয়ে উমম উমম শব্দ বের হলো শুধু।ছেলেটি ফিস ফিস কন্ঠে বলল
_ঝরা আমি, আমি রনি।

এতোক্ষন পর যেন শান্ত হলো ঝরা। জোড়া জুড়ি ছেড়ে দিতেই রনি আলগা করে দিলো হাত। লম্বা লম্বা শ্বাস নিলো মেয়েটি। কয়েক সেকেন্ড পর ফিস ফিস কন্ঠে বলল
_তুমি! তুমি এখানে কি করে? আর আপু ই বা কোথায়। আমার সাথেই তো ঘুমাবে বলেছিলো।

_আমি তো সেটা জানি না। যাই হোক তোমাকে দেখার জন্য চলে এসেছি।

_পাগল হয়ে গেছো তুমি! এই মধ্য রাত্রি বেলা তে দশ কিলোমিটার পথ পেরিয়ে এতো রিক্স নিয়ে আমার সাথে দেখা করতে, কে আসতে বলেছে তোমায়?

_আমার ভালো লাগছিলো না। তোমায় না দেখলে বোধহয় আমি মরেই যেতাম ঝরা পাতা।

রনির চোখের দিকে তাকিয়ে রইলো ঝরা। বুকের ভেতর টা এখনো কেমন যেন করছে। আজ কতো গুলো দিন পর দুজনের দেখা হলো। মাস খানেক পূর্বে ফোনে কথা হয়েছিল। এখন তো ওর কাছে ফোন ও নেই। তাই কথা ও হয় না।

হঠাৎ করেই ঝরা কে জাপটে ধরলো রনি। মেয়েটির অন্তর আত্মা বেরিয়ে আসার উপক্রম। সহসা এমন কাজ করে না ছেলেটা। আজকাল বড্ড বেশি আবেগী হয়ে যাচ্ছে। হবে নাই বা কেন? ভালোবাসার মানুষ কে হারানোর ভয়ে ছেলেটি যেন কেমন হয়ে গেছে। চোখের নিচে গাঢ় কালির দাগ,ভরাট মুখ টা ভেঙে গেছে, শরীর
শুকিয়ে গেছে বেশ অনেক খানি। আলগোছে রনির পিঠে হাত রাখলো ঝরা।
ছেলেটার খোঁচা খোঁচা দাড়ি তে ঘাড়ের দিকে হালকা ব্যথা অনুভব হলো। তবু ও কিছু বললো না মেয়েটি। দুজনের নিঃশ্বাসের শব্দে কেমন ভারী হয়ে আছে নির্জন রাত্রীর পরিবেশ। ঝরা বুঝতে পারলো অনেক টা সময় অতিবাহিত হয়ে গেছে। এবার কোনো অঘটন ঘটে যেতে পারে। যথাসম্ভব সর্তক হয়ে বলল
_রনি, আপু এসে পরবে। জানি না কোথায় গেছে তবে এসে পরবে যখন তখন। প্লিজ তুমি চলে যাও।

_আমার যেতে ইচ্ছে করছে না ঝরা পাতা।

_এমন টা হয় না। প্লিজ রনি, দ্রুত যাও।

_ঝরা প্লিজ আর একটু।

_এক সেকেন্ড ও নয়। প্লিজ রনি কেউ দেখে নিলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। তুমি প্লিজ এখন যাও।

_কিন্তু

ঠিক তখনি দরজায় খট খট আওয়াজ হতে লাগলো। ঝরার মন কু গাইছে। ওপাশ থেকে ঝরার বড় বোন ঝুম ডেকে চলেছে বিরতহীন। রনি ব্যথিত হলো।দীর্ঘ চার মাস পর এক পলকের দেখা হয়েছে। সুখের সময় এতো দ্রুত যায় কেন?

বারান্দায় এসে আরেক বার ঝরা কে জাপটে ধরলো রনি। ছেলেটার চোখের কোনে পানি জমে আছে। অন্য দিকে ঝুম পাগল কুকুরের মতো ঘেউ ঘেউ করে যাচ্ছে। রনির চোখে মুখে বিরক্তি। একটি ভয়ঙ্কর গালি প্রদান করলো ঝুম কে। ঝরা চোখ পাকিয়ে বলল
_আমার বড় বোন হয়।

_রাখো তো তোমার বোন। ইচ্ছে করছে ওর গলা টা টিপে মেরে দেই। যত্তসব

_আহ, কথা বলো না আর যাও তো এখন।

_আরে যাচ্ছি তো।

_হুম। আর শোনো সাবধানে যেও।

হতাশার দৃষ্টি মেলে এক পলক তাকালো রনি। ছেলেটার জীবনে আর কোনো সাবধানতার অবকাশ নেই। এক মন কষ্ট নিয়ে নিচে নেমে আসলো রনি। গেট দিয়ে বের হবার সময় আবার উপরে তাকালো। ঝরা নিষ্পলক তাকিয়ে আছে। আঁধারে মেয়েটির চোখের কোনে লেগে থাকা স্বচ্ছ পানির ফোঁটা ঝলমল করছে। পরিবার এমন হয় কেন। ভালোবাসা মেনে নিলে খুব কি ক্ষতি হয়ে যাবে?

দরজা খুলতেই তড়িৎ গতিতে রুমে প্রবেশ করলো ঝুম। ঝরা এক পাশে দাঁড়িয়ে মাথা নিচু করে আছে। চার দিকে চোখ বুলিয়ে ঝুম বলল
_দরজা খুলতে এতো সময় লাগে?

_ঘুমিয়ে ছিলাম আপু। মাথার ব্যথা টা প্রচুর বেড়েছে। তাই উঠতে এতো সময় লাগলো।

মেয়েটির কথা বিশ্বাস করলো কি না জানা নেই। তবে বিনা বাক্য ব্যয়ে বেডে চলে গেল ঝুম। ঝরার বুক চিরে আসা এক ফালি দীর্ঘশ্বাস ঘরময় ছড়িয়ে গেল মুহূর্তেই। পায়ের স্লিপার টা মেঝে তে ফেলে দরজা লাগিয়ে ঝুমের পাশে শুইয়ে পরলো। আজ রাতে ঘুম হবে না আর। রনি কে প্রচন্ড ভালোবাসে ওহ। তবে পরিবার নামক একটি দেয়াল ওদের এই ভালোবাসা কে মাটি তে পিষে ফেলতে ব্যস্ত।

**

একটু আগে শাহরিয়ার রনি নামের একটি আইডি থেকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট এসেছে। বান্ধবীর সাথে অভিমান করে একাই বাড়ি ফিরছিলো ঝরা। ঠিক তখনি নোটিফিকেশন টা চোখে পরে ওর। সহসা ওর ফ্রেন্ড লিস্টে অপরিচিত কোনো মানুষ নেই। তবে রাগে দুঃখে আজ অপরিচিত মানুষের রিকোয়েস্ট এক্সসেপ্ট করেই নিলো। মাথায় একটা বুদ্ধি ও খেলে গেল। এই ছেলের সাথে বন্ধুত্ব করে বেস্ট ফ্রেন্ড বলে পোস্ট করবে। তখন আয়না বুঝবে দু দিনের পরিচিত এক ছেলে কে পেয়ে প্রিয় বান্ধবী কে কষ্ট দেওয়ার ব্যথা। চট জলদি একটা স্যাড পোস্ট করলো ঝরা। আয়নার প্রতি ভীষন ক্ষোভ আর অভিমান হয়েছে। বয়ফ্রেন্ড পেয়ে ওকে ভুলে গেল। কি ফাজিল মেয়ে!

বাসায় ফিরে প্রচন্ড ক্লান্তি তে ঘুমিয়ে পরলো ঝরা।সচরাচর গোসল না করে ঘুমায় না ওহ। তবে আজকাল রোদ্দুর মাথায় লাগলেই মাথা টা কেমন ঝিম ধরে যায় সাথে প্রচন্ড ব্যথা ও শুরু হয়। ইদানিং চোখের সমস্যা টা ও বেড়েছে। চার পাশে শুধু সমস্যা আর সমস্যা।

মরিয়ম বেগম ভীষন খিটখিটে স্বভাবের। নোংরা কাপড়ে বিছানায় কেউ এক পা রাখলেই তেলে বেগুনে জ্বলে উঠেন। ঝরা কে দেখেই কর্কশ কন্ঠে বললেন
_ঝরা উঠ, কতো বার বলবো ময়লা কাপড়ে বিছানায় যাবি না। আরে এই ঝরা উঠ, না হলে খুন্তির আঘাত এক টা ও মেঝে তে যাবে না। উঠ বলছি

পিট পিট করে তাকালো ঝরা। চশমা টা টেবিলে খুলে রেখেছিলো। চোখে সব ঝাঁপসা ঝাঁপসা লাগছে। কোনো মতে উঠে বসলো। ঘুম জড়ানো কন্ঠে বলল
_কি হয়েছে আম্মু?

_কতো বার বলেছি কলেজের জামা না বদলিয়ে খাটে উঠবি না।

_মাথা ব্যথা করছিলো।

_যাহ এখন উঠে গোসল করে নে।

_হুম।

ধীর পায়ে বাথরুমে গিয়ে গোসল শেষ করলো মেয়েটি। গোসল শেষে চোখে বেশি করে পানির ছিটে দিলো। বড্ড অসহ্যকর বস্তু এই চশমা। আবার এটা ছাড়া চোখে দেখা ও মুশকিল। তোয়ালে দিয়ে চুল পেঁচিয়ে ঘরে প্রবেশ করা মাত্র নোটিফিকেশন এর ঝড় বয়ে গেল। ভ্রু কুঞ্চিত করে তাকিয়ে রইলো বেশ কিছু টা সময়।তোয়ালে রেখে ফোন টা তুলে নিলো। রনি নামক ছেলের নামের পাশে সাতাশ টা ম্যাসেজ। ভারী চমকিত হলো ওহ। তাঁর সাথে সাথে কিছু টা কৌতুহল জাগল। ম্যাসেজ গুলো সিন করে লিখলো
_ না তো আমার কিছু হয় নি। বান্ধবীর সাথে অভিমান করে ঐ পোস্ট দিয়েছিলাম।

পরমুহূর্তেই রনির রিপলে এলো
_অভিমানী ঝরা পাতা এভাবে অভিমান মিশ্রিত স্যাড
পোস্ট দিবেন না। অনেকেই সত্যি ভেবে চিন্তিত হতে পারে।

ফিক করে হেসে উঠলো ঝরা। আজকাল এই সোশ্যাল মিডিয়া তে এমন কেউ আছে যে সাধারন একটি পোস্ট দেখে অচেনা কারো জন্য চিন্তিত হয়ে যাবে?

**
মৃদু হেসে উঠলো ঝরা। ঝুম চোখ তুলে তাকিয়ে বলল
_পাগলা কুত্তায় কামড় দিছে তরে? রাত দুপুরে ভূতের মতো হাসছিস যে।

_না এমনি।

_ঘুমা।কাল সকাল সকাল বের হবো আমি।

_কোথায় যাবে আপু?

ঝরার আগ্রহ দেখে বিরক্ত হলো ঝুম। মেয়েটা ফুটো বেলুনের মতো চুপসে গেল। চাঁদর টেনে বলল
_এমনি বললাম।

_ভারসিটি তে যাবো।

_ভারসিটি তে কেন? তোমার তো ফাইনাল এক্সাম শেষ।

_কাজ আছে।

_ওহ।

ঝুম ফোন নিয়ে ওপাশ ফিরে রইলো। প্রচন্ড কষ্ট হচ্ছে ওর। ভালোবাসা টা কি খুব অন্যায়। ফেসবুক থেকে কি সত্যি কারের ভালোবাসা হতে পারে না? এই যে এতো খানি রিক্স নিয়ে রনি চলে এসেছিল এগুলো কি সব মিথ্যে বনায়েট নাটক!
দীর্ঘশ্বাস বের হতে চাইলে ও দীর্ঘশ্বাস বের হতে দেয় না মেয়েটা। বুকের ভেতর চাঁপা অভিমান আর দীর্ঘশ্বাস লুকিয়ে ঘাপটি মেরে শুয়ে পরে। মাথার উপর ভন ভন করে ফ্যান ঘুরছে। কড়া শীতের মাঝে ও ফ্যান চালিয়ে ঘুমানোর বদ অভ্যাস কোনো দিন ই যাবে না। আচ্ছা রনি ঠিক ঠাক পৌছে গেছে তো? কি জানি কোথায় আছে ছেলে টা। অসহায় মুখ টা তৃষ্ণার্থ হয়ে জানালা গলিয়ে চাঁদের দিকে তাকিয়ে রইলো। চাঁদের আলো তে ও ওর কষ্ট গুলো ম্লান হলো না। বরং একটু একটু করে বাড়তে লাগলো। প্রচন্ড অভিমান হলো মেয়েটির। থরমরিয়ে উঠে গিয়ে জানালায় পর্দা মেলে দিলো। অভিমান হয়েছে চাঁদের উপর। এ চাঁদ কে আর দেখবে না ঝরা।

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here