অভিমানী_ঝরা_পাতা,part_5

0
598

#অভিমানী_ঝরা_পাতা,part_5
#ফাতেমা_তুজ

মাস তিনেক হলো যোগাযোগ নেই রনির সাথে। ফোন আছে, মন ও টানে তবে সুযোগ নেই। সোশ্যাল মিডিয়া সহ সিম কার্ড নট রিচেবল বলছে। ঝরা চোখের পানি ফেললো শুধু। সিয়ামের সাথে বিয়ের তারিখ বদলে গেছে। কোনো বিশেষ কারনে ছেলে টা বিদেশ যাত্রী হয়েছে। ঝরার অবশ্য মাথা ব্যথা নেই। মন প্রান থেকে তো একটাই চাওয়া বিয়ে টা যেন না হয়। এতো চোখের পানি ফেলে ও কোনো কাজ হলো না। এবার যেন ওকে বিদেয় করেই ছাড়বেন সকলে। তাচ্ছিল্যের রেখা ফুটলো অধরে। ম্নিয়মান আলো তে চোখে থাকা পানি মুক্ত হয়ে ঝরছে। রাত্রী যতো গভীর হয় ব্যথা ততো সুচালো হয়ে বুকে বিঁধে। পাশেই বেঘোরে ঘুমাচ্ছে ঝুম। ইচ্ছে করছে মেয়েটার গলা টিপে দিতে। শুধু মাত্র ঝুমের জন্য ওদের ভালোবাসা কে আলাদা হতে হচ্ছে। একটা ভুল প্রেমের জন্য আলাদা হলো দুটো হৃদয়। বড্ড আফসোস হয় ঝরার। ইচ্ছে হয় সব ছেড়ে দিয়ে ঝরে যেতে। তবে ঝরে যাওয়া ওর কপালে নেই বোধহয়।
” কি রে ঘুমোচ্ছিস না কেন? ”

ঝুমের কটাক্ষ করে কথা বলা এক বিন্দু ও সহ্য হলো না ঝরার।কয়েক টা কড়া কথা বলার জন্য প্রস্তুত হলো তবে কি মনে করে যেন বললো না। হয়তো বুঝে গেছে এদের বলে লাভ নেই আর। গুটি গুটি পায়ে ঝুমের পাশে এসে ঘুমিয়ে পরলো। চোখের পাতা বন্ধ করতেই চোখ ফেঁটে ব্যথা ঝরতে লাগলো। তবু ব্যথা লাঘব হলো না।

প্রথম বর্ষের পরীক্ষা চলছে, মোটামুটি পরীক্ষা হচ্ছে ঝরার। পড়াশোনাতে মন নেই একদম ই। ভেতর থেকে ভেঙে গেছে কি না। পরীক্ষা দিয়ে বের হতেই বান্ধবীরা বলল
” চল ফুচকার আড্ডা দেওয়া যাক। ”

” তোরা যা। আমি যাবো না। ”

” ঝরা প্লিজ, দোস্ত আয় না। ”

” আমার ভালো লাগছে না। তোরা যাহ, ইনজয় ইউর টাইম। ”

মলিন হাসি টা আরেকটু প্রশস্ত করে সবাই কে বিদেয় জানালো ঝরা। সিয়ামের কল এসেছিলো প্রভাতে। খুব তাড়াতাড়ি দেশে ফিরবে জানিয়েছে। কথা টা শুনেই ঝরার বুকে শূন্যতা অনুভব হলো। তবে মুখ বুঁজে সব সহ্য করে নিতে হলো। অশান্তি তে ভরপুর সময় টা এতো টা ব্যথার তা এক বছর আগে ও অনুভব হয় নি।

বাসায় কলিং চাপতেই দরজা খুলে দিলো ঝুম। দ্রুত গিয়ে সোফা তে বসলো। একটা ভিডিও দেখছে। উঁকি দিয়ে সেটা দেখলো ঝরা। ঝুম আফসোস এর কন্ঠে বলল
” ইস কি একটা অবস্থা। এতো সুন্দর জুটি কে মেনে নিচ্ছে না পরিবার। ”

ঝুমের কন্ঠ শুনে হেসে ফেললো ঝরা। ভ্রু বাঁকিয়ে প্রশ্ন করলো ঝুম
” হাসছিস কেন? ”

” হাসার কথা বলেছো তাই হাসছি। ”

” আশ্চর্য হচ্ছি আমি। ”

” স্বাভাবিক। ধ্যান জ্ঞান সব লোপ পেয়েছে কি না। টিক টক এর দুই প্রেমিক প্রেমিকা যুগল এর বিচ্ছেদে কাঁপিয়ে দিচ্ছো সোশ্যাল মিডায়া ক্যাপশনে লম্বা করে আফসোস টানা অথচ নিজ হাতে বোনের ভালোবাসা মাটি তে পুঁতে দিচ্ছো। ”

ঝরার স্বাভাবিক, কন্ঠ টা প্রচন্ড অস্বাভাবিক শোনালো। টেবিল থেকে পানি নিয়ে চলে গেল। ঝুম কয়েক মুহূর্ত চুপ করে রইলো। ওর চোখ মুখ কেমন যেন ভাষাহীন আর নির্বিকার। ছন্নছাড়া অনুভূতি খেলছে হৃদপিন্ড।
.

রনির কল টা দেখেই ঝরার চোখ ভিজে গেল। ওপাশ থেকে শান্ত তবে অতীব গম্ভীর কন্ঠ শুনতে পেল ঝরা।
” ভালো যাচ্ছে সময়কাল? ”

গলায় শব্দ আটকে যাচ্ছে ঝরার। কোনো মতে উত্তর করলো মেয়েটি। রনি অভিযোগ করলো না, অভিমান ও করলো না শুধু দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল
” চাকরি টা হলো না এবার ওহ। গত কয়েক মাসে রাস্তার অলি গলি তে পাগলা কুকুরের মতো ঘুরেছি। সব স্থানে সাপোর্ট আর টাকা চাই। যা আমার নেই। আজ বুঝতে পারলাম টাকা আর একটা চাকরি জীবনে ঠিক কতো টা গুরুত্বপূর্ণ। ”

” রনি। আমরা এতো অসহায় কেন? ”

দুজনেই নিশ্চুপ বসে রইলো। চোখের সামনে এক টাই আকাশ, এক টাই পৃথিবী। সেই এক স্থানে থেকে ও দুজনের মাঝে বহু দূরত্ব। এতো ব্যথা এতো কষ্ট কেন প্রেমে?

কেউ সুখে ঘন্টার পর ঘন্টা কথা বলে আর কেউ দুঃখে কথা বলে। তবে রনি আর ঝরা দ্বিতীয় টা তথা দুঃখেই সারা রাত কথা বললো। ফোন চার্জে রেখে নিশ্বাস গুলো শুনতে লাগলো। হয়তো এমন সুযোগ আর হবে না কখনো।

” একটা আবদার করবো রাখবে? ”

আকুতি ভরা কন্ঠ রনির। ঝরা এবার ঠিক ঠাক হয়ে বসলো। কানের কাছে ফোন নিয়ে নাক টেনে বলল
” হুম বলো। ”

” একটু ভিডিও কল দিবে? অনেক ইচ্ছে করছে দেখতে। কতো দিন হলো দেখি না। ”

নিরুত্তর ঝরা। নীরবতা যেন অন্ধকারের মতো জাপটে ধরছে ওকে।সব কিছুই যেন প্রানহীন স্থবির। আবারো আকুতি করলো রনি। ঝরা এবার উত্তর করলো।

দুজনে একে অপরের দিকে তাকিয়ে রইলো অনেক টা সময়। ঝরার নিষ্প্রাণ চোখ দুটো ছল ছল করে উঠলো। চশমার ফাঁকে ও সেই মুক্ত দানা অশ্রু কনা লক্ষ্য হলো ছেলেটার। ঝরার ছল ছল চোখের দিকে তাকিয়ে অবিলম্বে চার লাইনের ছন্দ একে ফেলবো। ঝরার চোখের দিকে ইশারা করে বোঝালো চোখ মুছতে। চোখ মুছলো না ঝরা। শুধুই তাকিয়ে রইলো এক দৃষ্টি তে। রনি বলল

” শোনো জল ছল ছল কাজল,
চোখের কন্যা সর্বনাশী
আমি তোমার ঐ চোখে
আমার সর্বনাশ দেখেছি ” [ সংগৃহীত ]

ভোরের আলো চোখে মুখে লাগতেই চোখ দুটো স্থির করে তাকালো ঝরা। চোখের জল শুকিয়ে গেছে গালেই। মাত্র ই ভোর হয়েছে, ঘড়ির কাঁটায় তাকিয়ে বুঝলো ফজরের আযান পরেছে কিছু সময় হলো। চশমা টা মুছে নিয়ে চোখে পরে নিলো। এক রাশ হতাশা নিয়ে এগিয়ে গেল ওযু করতে। নামাজ শেষ করে বের হলো বাগানে। ভালোই লাগছে সকাল টা। তবে কেমন এলোমেলো শুষ্ক পরিবেশ। গাছের কচি পাতা গুলো নেতিয়ে গেছে। তাঁরা ও বোধহয় ঝরে যাবে অভিমান হয়ে। হাসলো ঝরা, অভিমান টা প্রচুর। সবার প্রতি অভিমান জমেছে ওর। পরিবার, পরিজন অথবা প্রেমিক পুরুষ রনি। হবেই না কেন রনি কি পারতো না একবার বলতে চলো পালিয়ে যাই। যদি ও ঝরা সম্মতি জানাতো না। তবে পারতো তো একবার বলতে। কাল সারা রাত অপেক্ষা করেছিলো, আবেগ থেকে হলে ও রনি একবার বলুক ‘ ঝরা চলো পালিয়ে যাই। ‘

কিন্তু রনি এমন টা বলে নি। হয়তো বাস্তব সত্য মেনে নিতে শিখেছে।

ফ্রেস হয়ে আসতেই হামিনার আগমন। বরাবর ই ছেলে কে না খাইয়ে খাবার মুখে তুলেন না তিনি। আজকাল খাবার খাওয়া যেন বিষের মতো লাগে রনির কাছে। শুধু মাত্র হামিনার মুখ চেয়ে খাবার মুখে তুলে। কখনো বা অগোচরে ফেলে দেয় খাবার। যদি ও সব টা বুঝতে পারেন হামিনা। তবে এমন আচারন করেন যেন কিছুই দেখেন নি তিনি। এসব দেখে রনির খারাপ লাগে। প্রচন্ড মায়া হয়। মাঝে মাঝে ইচ্ছে হয় নেশা করতে। তবে সিগারেট এর নেশা ব্যতীত আর কোনো নেশা ওকে টানে না। সিগারেট নিয়ে ও ঝরার অভিযোগ ছিলো প্রচুর। রনি অবশ্য চেষ্টা করতো তবে পারতো না।
” আর কতো দিন এমন করবি বাবা? ”

” আমি ঠিক আছি মা। ”

” কোথায় ঠিক আছিস? দেখ কেমন শুকিয়ে গেছিস। জামা ঢিলে হয়ে গেছে।”

সত্যিই শুকিয়ে গেছে রনি। আরশি তে শরীরের হাড় গুলো দেখা যাচ্ছে স্পষ্ট। রনি মিথ্যে কথার ঝুলি নিয়ে বসলো। মা কে নানা ভাবে বোঝানোর চেষ্টা চালালো। তবে কোনো টাই মানলেন না হামিনা। শেষে কাঁদতে কাঁদতে চলে গেলেন কক্ষের বাইরে। রনি হতাশার নিশ্বাস ফেলে এগিয়ে গেল জানালায়। খুব সম্ভবত কিছু দিন পর ই বসন্ত। গাছের বৃদ্ধ পাতা গুলো ঝরতে শুরু করেছে। এমন অবস্থায় নিজেকে বৃদ্ধ পাতা বলেই মনে হলো। হয়তো ঝরা পাতা ঝরবে না তবে রনি ঝরে যাবে ঠিক ই। শুষ্ক ঠোঁট টা ভিজিয়ে নিলো রনি। আকাশের পানে তাকিয়ে কিছু বাক্য উচ্চারণ করলো। হয়তো অভিযোগ আর অভিমানের সমন্বয় করেই অবিনশ্বর এর কাছে বার্তা উপস্থাপন করে চলেছে।

বি : দ্র : ভুল ত্রুটি মাফ করবেন।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here