হৃদয়গ্রাহী #পর্ব_১৬,১৭ শেষ

0
899

#হৃদয়গ্রাহী
#পর্ব_১৬,১৭ শেষ
#সারিফা_তাহরিম
১৬

‘আমার হৃদয়াক্ষীকে পাওয়ার জন্য কত কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে তা প্রকাশ করা সম্ভব না। প্রতিটি মুহূর্ত আতঙ্কে থাকতাম, এই বুঝি হারিয়ে ফেলেছি তাকে! মাকে জানিয়েছিলাম আমি। মা বাবা প্রায় সময় স্যারের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন। অবশেষে একসময় বিয়ের প্রস্তাব আর অনেক অনুরোধের পর আমার শ্বশুরকে বুঝিয়ে তাঁর মেয়েকে বিয়ে করেছি। আমার হৃদয়াক্ষীকে পেয়েছি আমি। কিন্তু তার হৃদয়ে জায়গা করতে গিয়ে প্রচুর রাগের স্বীকার হতে হয়েছে। ইশ! পূর্ণতা, কি বাঘিনী ছিলে তুমি! আমার মতো অবলা পুরুষটার উপর কত নির্যাতনই না করতে তুমি!’

অরিত্রের কথায় পূর্ণতা বাঁকা চোখে তাকিয়ে বাহুতে একটা চাপড় দিয়ে বলল,

‘কি বললেন? আমি বাঘিনী! আমি তো খুব শান্ত আর ভালো একটা মেয়ে। আর আপনি অবলা কি করে হন? যে লোক আমার মতো ঐ পিচ্চি মেয়েকে দেখে এত এত চিন্তা করতে পারে সে কি করে অবলা হয়?’

অরিত্র বাহুতে হাত বুলিয়ে বাচ্চাদের মতো অসহায় চেহারা করে বলল,

‘পিচ্চি মেয়েকে ভালোবাসার সাইড ইফেক্ট হিসেবে এখন মার খেতে হচ্ছে!’

অরিত্রের কথায় পূর্ণতা হেসে দিল। অরিত্রও হাসলো। গৌধুলিবেলা সাক্ষী হলো তাদের কিছু রঙিন মুহূর্তের।

____

সন্ধ্যা নামতেই কুয়াশার বহরেরা হানা দিল ধরণীতে। হাসনাহেনা ফুলের সূক্ষ্ম একটা ঘ্রাণ ভেসে বেড়াচ্ছে। কুয়াশারা কাঁচের জানালাকে ঝাপসা করে দিচ্ছে, তাদেরকে ছুঁয়ে দিলেই পানি হয়ে গড়িয়ে পড়ছে। দিনা বারবার ছুঁয়ে দিচ্ছে ঝাপসা জানালার কুয়াশাদেরকে। বিচিত্র সব আঁকা আঁকি করছে সে। দৃষ্টি কাঁচের জানালায় হলেও মনটা বহুদূরে বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে। ছাব্বিশ বছরের কোনো দায়িত্বশীল নারীর এমন কাণ্ড আসলেই অনর্থক। আসলে আমাদের জীবনে অনেক কিছুই অনর্থক হওয়া সত্বেও ঘটনাটা সত্যে উপনীত হয়। কখনো কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত জিনিস এসে হানা দেয়, আবার কখনো অনাকাঙ্ক্ষিত বিরহ এসে জড়িয়ে ধরে বিনা বাঁধায়। কিন্তু মানুষের সেই সকল অনর্থক জিনিসের সাথে নিজেকে মানিয়ে নিয়ে শেষ প্রহরের অপেক্ষা করতে হয়।

দিনার জীবনেও এমন অনাকাঙ্ক্ষিত অধ্যায় ছিল ইরাফ। ইরাফ নামক অধ্যায়টা দিনার জীবনে এমন এক অনুভূতি এবং এমন এক বিরহ যা সে কখনোই চায়নি। কিন্তু ভাগ্য তো আর কারোর চাওয়া বা না চাওয়ার উপর ভিত্তি করে আসে না। দিনার ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। ইরাফের দেওয়া ধোঁকা তাকে এখনো পোড়ায়। কিন্তু সবশেষে সে এটা মনে করার চেষ্টা করে, আল্লাহ নিশ্চয়ই তার জন্য ভালো কিছু ঠিক করে রেখেছেন। বারবার তার মনে পড়ে কুরআনের সেই চার আয়াত,

‘ কষ্টের সাথে স্বস্তি আছে। নিশ্চয়ই কষ্টের সাথে স্বস্তি আছে। অতএব, অবসর পেলেই ইবাদত করুন। এবং আপনার প্রতিপালকের প্রতি মনোনিবেশ করুন।’

[সূরা- আলাম নাশরাহ, আয়াতঃ৫-৮]

মন সায়রে বিষন্নতার দাপট ক্রমান্বয়ে ঊর্ধ্বগতিতে যাচ্ছে আজ। সে প্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটির লেকচারার হিসেবে জয়েন করেছে দু মাস হলো। গত ছয় বছরে ইরাফের বলা সবগুলো কথা হৃদয়ে গেঁথে সেও ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করেছিল। যে মানুষটা তার ভবিষ্যতের জন্য দিবাকে ছেড়ে যেতে দুবার ভাবেনি, সেই মানুষটাকে মনে করে দিবা কেন কষ্ট পাবে! সবকিছু ভুলে নিজের ক্যারিয়ার গঠনে সকল পরিশ্রম দেওয়া শুরু করল। সবশেষে সে স্বাবলম্বী হতে পারল। কিন্তু আবেগ অনুভূতির হিসেবগুলো এখনো অপূর্ণ রয়ে গেল তার। দিনার ভাবনায় ছেদ পড়লো কারও ডাকে।

‘কিরে, এখনো রেডি হলি না? ওরা সবাই চলে এসেছে তো।’

দিনা পেছনে ফিরল। তার বড় ভাই রাফি দাঁড়িয়ে আছে। ভীষণ খুশি দেখাচ্ছে তাকে। দিনা বলল,

‘আমি রেডি।’

‘সেকি! এত সাদামাটা হয়ে যাবি? বিয়েতে বউ যদি এত সাদামাটা হয়ে থাকে তাহলে কি ভালো দেখাবে?’

‘ভাইয়া এমন কেন করছেন আমার সাথে? আম্মু আব্বু আর আপনার সাথে আমার তো রক্তের সম্পর্ক! তবুও আমার সাথে বেঈমানী করছেন! সবাই কি আমার সাথেই এমন কেন করে বলতে পারবেন?’

রাফি বোনের মাথায় হাত রেখে বলল,

‘আমদের সামনে ঘটে যাওয়া সবকিছু সত্যি হয় না। এর পেছনে অনেক বড় কারণ লুকিয়ে থাকে। বাবা মা কখনো তার ছেলেমেয়ের খারাপ চান না। তারা উপর থেকে কঠোরতা আর রাগ দেখালেও তা সত্যি হয় না। এর পেছনে লুকিয়ে থাকে সন্তানের প্রতি অগাধ ভালোবাসা, মায়া আর যত্ন। বড় ভাইয়ের ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম নয়। তাই আমরা যা করছি তা বেঈমানী না।’

‘তাহলে কী?’

রাফি দিনার পাশে বসে নমনীয় কণ্ঠে বেশ কিছু কথা বলল। দিনা চুপচাপ শুনলো। কোনো কথা বলল না। সব কথা শোনার পর দিনা তার ভাইকে জড়িয়ে ধরল। যাই হোক না কেন বাবা মা ভাই বোনের মায়া খুব গাঢ় হয়। বিয়ের পর পুরো পরিবারকে ছেড়ে থাকতে হবে ভেবেই দিনার চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। রাফি বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,

‘বুঝতে পেরেছিস?’

দিনার মনে হাজারো তোলপাড় চললেও পরিবারকে কষ্ট দিতে চাইলো না। সে সংক্ষিপ্তভাবে উত্তর দিল,

‘হুম’

‘আচ্ছা ঠিক আছে। আমি যাচ্ছি। তুই আম্মুর সাথে বাহিরে আসিস।’

রাফি বেরিয়ে যেতেই দিনা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। হ্যাঁ, আজ তার বিয়ে। বাবা মা ও ভাইয়ের পছন্দের ছেলের সাথে বিয়ে। সব কথার শেষে রাফি যখন দিনাকে জিজ্ঞেস করেছিল, তখন সে দ্বিতীয়বার না ভেবেই সম্মতি জানিয়েছিল। এখন পরিবারের সবার খুশির জন্য চুপ থাকাটাই সর্বশ্রেষ্ঠ। তাছাড়া সে তো এখন আর অন্যকাউকে নিয়ে ভাবে না। তাই অসম্মতি জানানোর মানে হয় না। দিনার মা এসে তার চেহারায় আরেকটু প্রসাধনী মাখিয়ে নিয়ে গেল বাহিরে। অল্প কয়েকজন মানুষ, আত্মীয় আর পূর্ণতারা ছাড়া তেমন কেউ নেই। আকদ্ সাদামাটাভাবে করার মনোভাব ছিল দুই পক্ষেরই। দিনাকে সোফায় নিয়ে বসানো হলো। মাঝখানে পাতলা লাল ওড়না দেওয়া হয়েছে। ওপাশে বসে আছে দিনার ভবিষ্যত জীবনের সঙ্গী। বিয়ে পড়ানো শুরু হলো। দিনার দিকে রেজিস্ট্রি পেপার এগিয়ে দেওয়া হলো। দিনার চোখের কয়েকটি ফোটা অশ্রুতে ভিজে গেল রেজিস্ট্রি পেপারের কিছু অংশ। কাঁপা হাতে দীর্ঘ সময় নিয়ে স্বাক্ষর করে দিল সে।

____

বিয়ের ঝামেলা কিছুটা শীথিল হয়ে এলো। ঘড়ির কাটায় রাত আটটা। এরুম থেকে ঐ রুমে দৌড়াদৌড়ি করছে তিন বছরের ছোট্ট অরুনিমা। তার পিছুপিছু দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে হাঁপিয়ে উঠেছে পূর্ণতা। এক সময় রাগ করে অরিত্রকে ডেকে বলল,

‘তোমার মেয়েকে নিয়ে আর পারছি না। সেই দুপুরে খেয়েছে, এখনো অবধি নাস্তা খাওয়াতে পারলাম না। বেড়াতে এসেও দৌড়াদৌড়ি করছে। আমি ক্লান্ত হয়ে গেছি। তোমার মেয়েকে তুমি খাওয়াও।’

কথাটা বলেই নাস্তার প্লেটটা অরিত্রের হাতে ধরিয়ে দিল পূর্ণতা। এই শীতের মাঝেও তার নাকে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে উঠেছে। অরিত্র ভাবলো, আসলেই সন্তানকে বড় করতে মায়েরা কতটাই না কষ্ট করে! যে মেয়ে বিয়ের আগে এক গ্লাস পানি ঢেলে খেতো না, সে মেয়ে মা হওয়ার পর এক মুহূর্তের জন্যও সন্তানের যত্ন নিতে ভুলে না। এই যেমন পূর্ণতা বান্ধবীর বিয়েতে এসেও মেয়ের যত্ন নিতে ভুলছে না। আসলেই পূর্ণতা একজন দায়িত্বশীল মেয়ে, বউ এবং মা। অরিত্র পূর্ণতাকে দেখে আবারও এক প্রশান্তির শ্বাস ফেলল। মেয়েটাকে পেয়ে আসলেই সে খুব খুশি। তারা আপাতত দিনার রুমে বসে আছে। এই মুহূর্তে কেউ নেই এই রুমে। অরিত্র পাঞ্জাবীর পকেট থেকে রুমাল বের করে নরম স্পর্শে পূর্ণতার নাকের ডগায় জ্বলজ্বল করতে থাকা ঘামটুকু মুছে দিল। কোমল কণ্ঠে বলল,

‘মেয়েকে খাওয়ানোর দায়িত্ব আমি নিলাম। কিন্তু আমার বউটা কি নাস্তা করেছে?’

‘হয়েছে আর ঢং করতে হবে না। প্রেম উথলে পড়ছে!’

‘বারে! প্রেম উথলে পড়বে না! আমার বউয়ের সাথে প্রেম করার সবটুকু অধিকার আমার আছে। তাই তো বারবার হাজারবার তোমার প্রেমে পড়ি।’

‘আবারও শুরু হয়ে গেল! যাও তোমার মেয়েকে খাওয়ে আসো। আমি দিনার কাছে গিয়ে বসছি।’

‘যথা আজ্ঞা মহারাণী। ‘

আকস্মিক পূর্ণতার গালে একটা চুমু দিয়ে বেরিয়ে গেল অরিত্র। পূর্ণতা হতভম্ব হয়ে বসে রইল। ভাগ্যিস কেউ ছিল না। নাহলে কি পরিমাণ লজ্জায়ই না পড়তে হতো তার! অবশ্য কেউ থাকলে অরিত্র কখনো এমন কিছু করতো না তা পূর্ণতা জানে। সবার সামনে সবকিছু সোভা পায় না, সে যতই স্বাভাবিক হোক না কেন। এই বিষয়টা অরিত্র খুব মানে। সে তার স্ত্রীকে যথেষ্ট সম্মান করে। এমন কিছু কখনোই করবে না যাতে পূর্ণতা সবার সামনে অস্বস্তিতে পড়ুক। আর ভালোবাসা! সেই হিসেব রাখার মতো ক্ষমতা পূর্ণতার নেই। পূর্ণতা হালকা হেসে বসার ঘরে চলে গেল।

দিনা আর পাশে তার কয়েকজন কাজিন বসে আছে। পূর্ণতা দিনার পাশে গিয়ে বসল। কাঁধে হাত রাখতেই দিনা ছলছল চোখে তার দিকে তাকাল। পূর্ণতা চোখের ইশারায় তাকে আশ্বস্ত করল, সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। দিনার মন ভালো করার জন্য বলল,

‘এই মাফিন সবসময়ের মতো লেইট লতিফই রয়ে গেল। বিয়ে শেষ হয়ে গেল এখনো আসতে পারেনি ফকিন্নিটা।’

‘মিফতার পা মচকে গেছে। আসতে পারবে না বলেছে।’

‘কী বলিস! কবে মচকালো?’

‘কালকে।’

‘আহারে! তাহলে মিস করল বেচারি। ওকে ছাড়া আড্ডা তেমন জমে না।’

পূর্ণতার মন খারাপ হয়ে গেল। তখনই আগমন ঘটল মিফতার। জোরে করে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলল,

‘সারপ্রাইজ!’

চলবে…

#হৃদয়গ্রাহী
#পর্ব_১৭ শেষ
#সারিফা_তাহরিম

উৎফুল্ল হয়ে মিফতার দিকে এগিয়ে গেল পূর্ণতা। দিনার মুখেও হাসি ফুটল তৎক্ষনাৎ। মিফতাও এক পা বাড়াবে সে সময় ব্যাথার কারণে পড়ে যেতে নিতেই একজোড়া পুরুষালি হাত তাকে আঁকড়ে ধরল। পূর্ণতা মিফতাকে ধরার জন্য দ্রুত তার দিকে যাচ্ছিল কিন্তু ব্যক্তিটিকে দেখে থেমে গেল। ধূসর রঙের টি শার্ট পড়া ব্যক্তিটি মিফতাকে সন্তপর্ণে সোফায় এনে বসাল। নিজেও অপর পাশের সোফায় গিয়ে বসল। সবাই চুপচাপ দেখল দৃশ্যটি। কোনো কথা বলল না। মিফতা বসার পর সবার দিকে নজর বুলিয়ে নিল। সবাইকে এমনভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে ভ্রু কুচকে বলল,

‘কিরে, এভাবে তাকিয়ে আছিস কেন? মনে হচ্ছে আমাকে কখনো দেখিসনি বা বিশ্বের অষ্টম আশ্চর্য দেখছিস।’

ততক্ষণে পূর্ণতা দিনার পাশে এসে বসেছে। সে দিনার কানে বিরবিরিয়ে বলল,

‘বিশ্বের অষ্টম আশ্চর্যই তো মনে হলো। দেখে মনে হচ্ছিল কাব্য ভাইয়া আর মাফিনের রোমান্টিক দৃশ্য। যারা সারাদিন ঝগড়া করতে থাকে তাদের এত কাছাকাছি থাকার ব্যাপারটা দেখলে তো অষ্টম আশ্চর্যই মনে হবে তাই না?’

দিনা ‘হুম’ বলে চাপা হাসলো। মিফতা ভ্রুযুগলকে আরও খানিকটা কুচকে বলল,

‘এই এই তোরা কী নিয়ে ফিসফিস করছিস বল তো? তোদের মতলব তো ভালো ঠেকছে না। কী নিয়ে ষড়যন্ত্র করছিস বল তো?’

পূর্ণতা পাত্তা না দেওয়ার ভঙ্গিতে বলল,

‘আসবি যখন আরেকটু তাড়াতাড়ি আসলেই পারতি। সারাজীবনই লেট লতিফ রয়ে গেলি। এই শাস্তিতে তোর সাথে কথা বলার প্রশ্নই আসে না। আমাদের মেহমানের সাথে কথাবার্তা বলতে হবে। তা, কেমন আছেন কাব্য ভাইয়া? অনেকদিন পর দেখা মিলল আপনার। আমাদেরকে তো ভুলেই গেছেন।’

কাব্য নামক সুদর্শন পুরুষ এক গাল হেসে বলল,

‘এই তো আছি বেশ ভালোই। তোমাদের কী অবস্থা? সবাই বিয়ে টিয়ে করে একদম ব্যস্ত হয়ে পড়েছ। একবার খোঁজও নাও না এই ভাইটার। আরও বলো, আমি ভুলে গেছি!’

পূর্ণতা মিফতার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে আবার চোখ সরিয়ে রহস্যময় হাসি দিয়ে বলল,

‘ভালো যে আছেন, তা তো আবহাওয়ার অবস্থা দেখে বুঝতেই পারছি। তা বয়স তো কম হলো না। আপনার ছোট বোনদের বিয়ে হয়ে গেল অথচ আপনি বিয়ে করলেন না! আপনার বিয়ে কবে খাচ্ছি সেটা বলেন।’

কাব্য মিফতার দিকে একবার বাঁকা চোখে তাকিয়ে নিয়ে আফসোসের অভিনয় করে বলল,

‘কি আর করার বলো! এতকাল ধরে অপেক্ষা করছিলাম আমার স্বপ্নের সেই নিষ্পাপ, শান্ত, কোমল সেই রাজকুমারীর জন্য। কিন্তু তার পরিবর্তে যে আমার মা আমার জন্য এমন এক ঝগড়াইট্টা মহিলাকে আমার বউ বানাতে চাইবেন তা তো জানা ছিল না। অদৃষ্টের লিখন না যায় খণ্ডন। এখন আমি চাইলেও আমার সেই স্বপ্নের রাজকুমারীকে বিয়ে করতে পারব না। আমার মতো সুপুরুষের কপাকে জুটবে এক ঝাগরুটে নারী। হায় আফসোস!’

মিফতা এবার গর্জে উঠলো,

‘এ্যাহ! ওরে আমার সুপুরুষ রে! যে মানুষ এখনো প্রতি শুক্রবারে ফুটবল খেলে এসে বালি আর কাঁদামাটি নিয়ে বিছানায় গড়াগড়ি দেয়, মায়ের কাজ বাড়ায়, শান্তশিষ্ট মেয়ের সাথে ঝগড়া করতে থাকে সে নাকি সুপুরুষ। ভাই রে ভাই, তুমি যদি সুপুরুষ হও, তাহলে সুপুরুষদের তো এক বিন্দু পানিতে ডুবে মরে যাওয়া উচিত। আর আমার আম্মুও তোমাকে পছন্দ করেছে তাই বিয়ে করছি। নাহলে মার বয়েই গেছে তোমার মতো আজাইরা পাবলিককে বিয়ে করতে।’

কাব্য চোখ ছোট ছোট করে বলল,

‘ভাই কাকে বলো? কিছুদিন পর এঙ্গেজমেন্ট হলে আমি তোমার ফিয়ান্সে। তাহলে কিসের ভাই ডাকাডাকি?’

কাব্য-র কথায় দিনা আর পূর্ণতা ঠাট্টার সুর তুলে বলল,

‘ঘটনা এতদূর গড়ালো আর আমরা জানিই না! মাফিন আমাদেরকে বলতা তুমি, আর এখন নিজেই তলে তলে টেম্পু এ্যারোপ্লেন সব চালাইতেসো!’

মিফতা থতমত খেয়ে বলল,

‘আরে কী বলিস এগুলা! আমি কিছুই চালাই নাই।’

‘তাহলে এংগেজমেন্টের কথা জানালি না কেন?’

‘আরে ঐটা তো আম্মু গতকালকে আমাকে জানালো যে এই আপদের সাথে আমাকে বিয়ে দিতে চায়। বাবা আন্টি আঙ্কেলের সাথে কথা বলে কিছুদিনের মধ্যে এংগেজমেন্টের ডেট ফিক্সড করবে। দিনার বিয়ের ঝামেলা শেষ হলেই জানাবো ভেবেছি। তাই বলা হয়নি।’

এভাবে তাদের মধ্যে টুকটাক কথা আর দুষ্টুমি চলতে লাগলো। একটু পরে অরিত্র তার মেয়ে অরুনিমাকে নাস্তা খাওয়ানো শেষ করে তাকে কোলে নিয়ে বসার ঘরে উপস্থিত হলো। পূর্ণতা অরিত্র আর কাব্যকে পরিচয় করিয়ে দিল। তাদের কথার রেশ আরও কয়েক ধাপ বাড়লো। কাব্য মূলত মিফতাদের প্রতিবেশী। সেই ছোটবেলা থেকে তারা একসাথে ছিল। তাদের দুই পরিবারের খুব ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। কাব্য মিফতার চেয়ে তিন বছরের বড় হলেও ছোট থেকে একসাথে থাকার কারণে তারা দুজন ছিল একে অপরের খেলার সাথী। ছোট থেকে কখনো ‘তুমি’ কখনো ‘তুই’ সম্বোধনে চলতে থাকতো অসংখ্য খুনশুটি। দিনা আর পূর্ণতাও কাব্যকে চিনতো আর তাদের বাসায় যেতো। সবসময় কাব্য আর মিফতার ঝগড়া তাদের চোখে আটকে থাকতো। এখনো অবধি তাদের প্রচুর ঝগড়া হয়। কিন্তু সবকিছুর অন্তরালে দুজনের মনেই এক অদ্ভুত মায়া কাজ করে। হারিয়ে যাওয়ার ভয় কাজ করে, খুব ব্যাকুলতা কাজ করে। মিফতার আম্মু তাঁর মেয়ের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রাখার কারণে খুব সহজেই মেয়েকে পড়তে পারেন। এই বিষয়টাও বোধগম্য হতে খুব একটা দেরি হলো না। একসময় দেখা গেল, দু পরিবারের ইচ্ছাই একই সূত্রে গাঁথা। তাদের সিদ্ধান্তে মিফতা আর কাব্য উপর থেকে দায় সাড়া ভাব দেখালেও মনে মনে ভীষণ খুশি।

বসার ঘরে আড্ডা জমে উঠেছে বেশ। দু জোড়া কপোত-কপোতী উপস্থিত থাকলেও নব বিবাহিত দিনার বর অনুপস্থিত। অরিত্র তা খেয়াল করে বলল,

‘ দু বান্ধবীর লাইফ পার্টনার উপস্থিত আছে। আরেকজন অনুপস্থিত থাকবে কেন? উনি আসলে আড্ডা আরও ভালো জমবে। কী বলো পূর্ণতা?’

‘ হ্যাঁ, ঠিক বলেছ। কিন্তু উনি কোথায়?’

‘একটু বিজি ছিল। আমি দেখলাম কর্নারের রুমটাতে ফোনে কথা বলছে। আমরা যাওয়ার চেয়ে নববধূ গেলে ভালো হবে। শ্যালিকা, যান আপনার বরকে ডেকে নিয়ে আসুন।’

সবাই অরিত্রের কথায় সম্মতি জানালো। দিনা অস্বস্তিতে পড়ে গেল। যেতে ইচ্ছে করছে না তার। কিন্তু সবার বলার পরেও না গেলে বিষয়টা খারাপ দেখায়। তাই হাজারো দ্বিধা নিয়ে ভারি হয়ে আসা পা এগিয়ে দিল সেই রুমটার দিকে। দরজা হালকা ভেড়ানো। ভেতরে ঢুকবে নাকি ঢুকবে না এই নিয়ে হাজারবার ভেবে অবশেষে ঢুকেই গেল। খুব সাবধানে রুমে ঢুকল সে। শুভ্র রঙের পাঞ্জাবী পড়ে তার সদ্য বিবাহিত বর অপর পাশে ফিরে ফোনে কথা বলছে। কারও উপস্থিতি টের পেয়ে অপর পাশের ব্যক্তিকে বলল,

‘জ্বি আচ্ছা, আমি পরশু ফাইলটা রেডি করে পাঠিয়ে দিব। আমি পরে কথা বলছি।’

ফোন রেখে পেছনে ফিরল। এক পলক চোখাচোখি হতেই দিনা চোখ নামিয়ে নিল। তার চোখ পানিতে পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। নব বিবাহিত স্ত্রীকে দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলল ইরাফ। এত বছর পর তাদের সাক্ষাৎ! তাও আবার একদম নিজস্ব মানুষ হিসেবে! কেউ কোনো কথা বলতে পারলো না। দিনার গলা কাঁপছে। ইরাফ নিরবতা ছাপিয়ে বলল,

‘এখনো ভুল বুঝে যাচ্ছো?’

দিনা কান্না সংবরন করে বলল,

‘সেদিন সবটা বললেই পারতেন। এতটা কষ্ট পেতে হতো না।’

ইরাফ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,

‘সুযোগ বা ইচ্ছে কোনোটাই ছিল না। তোমার ভাইয়া আমাদেরকে একসাথে দেখে সন্দেহ করেছিলেন। একদিন খোঁজ নিয়ে যখন জানতে পারলেন তার সন্দেহটা ঠিক তখন তোমার বাবাকে নিয়ে আমার বাসায় গেলেন। তুমি খুব ভালো করেই জানো আমাদের আর্থিক অবস্থা খুব বেশি উন্নত ছিল না তখন। বাবা মারা যাওয়ার কারণে আমারই সংসার চালাতে হতো। তোমার বাবা আর ভাই আমাদের অবস্থা দেখে শর্ত দিয়েছিলেন তোমার পড়াশোনা শেষ হওয়া অবধি আমি যদি একটা ভালো ক্যারিয়ার গঠন করতে পারি তাহলে তোমাকে আমার সাথে বিয়ে দিবে। আমার মায়ের তোমাকে ভীষণ পছন্দ হয়েছিল। তাঁরও জেদ চেপে বসে তোমাকেই ছেলের বউ করবে। আমি যদি ভালো ক্যারিয়ার গঠন করতে না পারতাম তাহলে তোমাকে হারাতে হতো। এই নিয়ে আমি খুব ভেঙে পড়েছিলাম। আমি চাইলে সেদিন তোমাকে বলতে পারতাম। কিন্তু তোমার বাবার আরেকটি শর্ত ছিল, তোমার সাথে বিয়ের আগে যেন আর কোনো সম্পর্ক না রাখি এবং প্রথম শর্তের ব্যাপারে যাতে তুমি না জানো। যেন আমার সাথে যদি তোমার বিয়ে নাও হয়, তবুও তুমি পরবর্তী জীবনে আমাকে ভালোবাসার কথা স্মরণ করে কষ্ট না পাও। এজন্যই বলা হয়নি।’

একটু থেমে ইরাফ আবারও বলল,

‘কথার মর্মার্থ প্যাঁচানো হলেও কথাগুলো মিথ্যে ছিল না। আসলেই তখনকার প্রেমকে প্রাধান্য দিতে গেলে আমি সারাজীবনের জন্য আমার মূল ভালোবাসাকে হারাতাম। আমার ক্যারিয়ারেই আমার সার্থকতা লুকিয়ে ছিল। আমার ক্যারিয়ারের সাথে তুমি জড়িয়ে ছিলে। আমার মায়ের ইচ্ছে জড়িয়ে ছিল। আমার সবচেয়ে বড় চাওয়া পাওয়া জড়িয়ে ছিল। এজন্যই সবকিছু ছেড়ে ক্যারিয়ারের পেছনে ছুটেছি।’

দিনা শ্লেষাত্মক কণ্ঠে বলল,

‘আমি আসলেই বুঝতে পারিনি। আজ ভাইয়া আমাকে বলার পরে বুঝতে পেরেছি।’

ইরাফ আবেগ জড়ানো গলায় বলল,

‘এখন আর আগের মতো গুছিয়ে কথা বলতে পারি না। অনুভূতিগুলো গাঢ় থেকে আরও গাঢ় হয়েছে। কিন্তু তা আর ঠিকঠাক প্রকাশ করতে পারি না। ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ করে অপরূপ প্রেমের পাহাড় গড়তে পারি না। আমার এই প্রেমহীন শহরে এক পশলা প্রেমে বৃষ্টি ঝড়াবে মেয়ে? আমায় তোমার জীবনে প্রবেশের অধিকার দিবে?’

দিনা কোনো কথা বলল না। ইরাফের বুকে মিশে গেল। অজস্র অনুভূতি মেশা অশ্রু বিসর্জন দিল। ইরাফও তাকে জড়িয়ে ধরল। অনেক সাধনার পরে মেয়েটিকে পেয়েছে সে। বুকের ভেতর সুখের এক চিনচিনে ব্যথা হচ্ছে। দিনা বলল,

‘প্রেমের শুরুটা তুমি করেছ, শেষটা নাহয় আমি করি? ভালোবাসার দায়িত্ব আমি নিলাম, আর তা অনুভব করার অধিকার তোমার।’

আরও কিছুক্ষণ একান্ত সময় কাটিয়ে তারা বসার ঘরে গেল। ছোট বেলার তিন বান্ধবী আর তাদের সুখের সংসার নিয়ে জমে ওঠা আড্ডার দৃশ্যটা সত্যিই নয়নাভিরাম।

___

অরুনিমাকে ঘুম পাড়িয়ে পূর্ণতা বারান্দায় এসে দাঁড়ালো। আজ অনেকদিন পর বান্ধবীদের সাথে জমিয়ে আড্ডা দিয়েছে। দিনার বাসা থেকে আসার পর দৃশ্যগুলো বারবার চোখের সামনে ভেসে উঠছে। ছোটবেলার সেই তিন বান্ধবী আজ কত বড় হয়ে গেছে! প্রত্যেকেই সুখ দুঃখের সময় কাটানোর জন্য প্রিয়তম জীবনসঙ্গী পেয়েছে। জীবনসঙ্গীর কথা মনে হতেই পূর্ণতা ছয় বছর আগের স্মৃতির অতলে হারিয়ে গেল আবারও।

হুট করেই তার জীবনে এক অচেনা পুরুষের আগমন হলো। বাবার পছন্দের ছেলের সাথে বিয়ে হলো। কিন্তু বাবা মায়ের ভুল বুঝার কারণে রাগটা সেই নির্দোষ মানুষটার উপর ঝাড়লো। কিন্তু ব্যক্তিটা একটাবারের জন্যও বিরক্ত হয়নি। বরং পূর্ণতাকে সময় দিয়েছিল। সর্বোচ্চ সম্মানটুকু নিশ্চিত করেছে সে। রাগটা কমতেই পূর্ণতা অনুতপ্ত হলো, মানুষটাকে বুঝতে শুরু করল। অবশেষে সেই ব্যক্তির প্রেমজালে ফেঁসে গেল! হালাল প্রেম।

পূর্ণতার পরীক্ষা শেষ হওয়ার এক মাস পরেই তাদের রিসিপশন হয়। পূর্ণতা আর অরিত্র আরও কাছাকাছি এলো। অনুভূতিগুলো জোড়ালো হতে থাকলো। পূর্ণতার স্বাবলম্বী হওয়ার ইচ্ছে ছিল প্রবল। এই ক্ষেত্রে অরিত্র আর তার পরিবারকে সবসময় পাশে পেয়েছে পূর্ণতা। তিন বছর পর পূর্ণতার কোল করে আসে ছোট্ট ‘অরুনিমা’। অরুনিমাকে পেয়ে তাদের খুশির অন্ত ছিল না। অরিত্র খুশি ছিল তার রাজকন্যাকে পেয়ে। পূর্ণতাও আল্লাহর কাছে চাওয়া জিনিস পেয়ে খুব খুশি ও কৃতজ্ঞ। সে সবসময়ই দোয়া করতো আল্লাহ যেন তাকে মেয়ে সন্তান দেয়। সে তার মেয়ের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলে চাপহীন জীবন দিতে চাইতো। সবাইকে দেখিয়ে দিতে চাইতো অবিশ্বাস, চাপ, জোর দিয়ে মেয়েকে বড় করে তার কাছে যাওয়া যায় না, বরং দূরত্ব সৃষ্টি হয়। তার মেয়েকে মানুষের মতো মানুষ করে সবাইকে এটাও শেখাতে চায়, মেয়েদেরকে অবজ্ঞা নয় বরং সম্মান করতে হয়।

পূর্ণতার বাবার ইচ্ছে ছিল পূর্ণতা একজন ভালো সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হবে। পূর্ণতা তার বাবার ইচ্ছে পূরণ করেছে। সে আপাতত একটা মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানি চাকরি করে বেশ সফলতা অর্জন করেছে। এর পেছনে অরিত্রের অবদান অবর্ণনীয়। একটা সুন্দর পরিবার, একটা ভালো ক্যারিয়ার আর একজন ভালো জীবনসঙ্গী পেয়েছে সে। নামের মতো জীবনেও পূর্ণতা পেয়েছে সে। সে সবসময় স্বীকার করে,

‘আসলেই বাবা মায়েরা সবসময় সবকিছুর বিনিময়ে সন্তানের সর্বোচ্চ মঙ্গল কামনা করেন।’

পূর্ণতার ভাবনায় ছেদ পড়লো উষ্ণতার ছোঁয়ায়। অরিত্র পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে কাঁধে থুতনি রেখেছে। অরিত্রের গভীর আলিঙ্গনে আবদ্ধ হয়ে কেঁপে উঠলো পূর্ণতা। অরিত্র সেই স্নিগ্ধ কণ্ঠে বলল,

‘কী ভাবছো হৃদয়াক্ষী?’

‘তেমন কিছু না। এই ছয় বছরের স্মৃতিচারণ করছিলাম। ঘুমাবে না?’

‘তোমার কথার ছন্দপতনে আমার
রাত কাটে নির্ঘুম,
তোমার মাদকমন্ত্র আঁখিতে হয়
আমার অন্যরকম খুন!

আজ আমার হৃদয়াক্ষীর সাথে জোছনাবিলাস করব। একটু প্রেমালাপ করে, তোমার চোখে চোখ রেখে আরও একটা রাত্রিকে সাক্ষী করতে চাই।’

পূর্ণতা হাসলো। এই মানুষটার প্রতিটি কথায় প্রগাঢ় অনুভূতি হয় তার। ‘আমি চা নিয়ে আসি’ বলে নিজেকে ছাড়িয়ে রান্নাঘরে চলে গেল। কিছুক্ষণ পরে ধোঁয়া ওঠা চা নিয়ে অরিত্রের কাছে এসে দাঁড়ালো। বারান্দার দোলনাটায় পাশাপাশি বসলো দুজন। অরিত্র পূর্ণতাকে নিজের সাথে জড়িয়ে ধরল। পূর্ণতাও পরম আবেশে অরিত্রের কাঁধে মাথা রাখল। অরিত্র বলল,

‘এভাবে অজস্র জোছনা তোমার সাথে কাটাতে চাই হৃদয়াক্ষী। স্বপ্নের মতো অনুভূতি দিয়ে সাজানো থাকবে প্রত্যেকটা জোছনা। সাথে থাকবে এক পেয়ালা প্রেমের পরশ, এক চিমটি নেশা।’

___সমাপ্ত___

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here