সত্য পিঞ্জর’ পর্ব ২,০৩

0
490

‘সত্য পিঞ্জর’
পর্ব ২,০৩
তাবিনা মাহনূর
০২

জামিল স্ত্রীর প্রতি বিরক্ত হয়ে বললো, ‘তুমি এ কাজটা কীভাবে করলে আনিকা? একটা মেয়েকে এভাবে বিব্রত করার কোনো দরকার ছিল?’

আনিকা কৈফিয়তের সুরে বললো, ‘আমি আসলে ওর দিকে তাকিয়ে অন্যরকম হয়ে গিয়েছিলাম। কত মিষ্টি মেয়েটা, অথচ জীবনের কোন ঠিকানা নেই।’

– তাই বলে ব্যক্তিগত বিষয় জানতে চাইবে? এরপর যে মেয়েটা উঠে গেল, এই অপমান নিতে ভালো লাগলো তোমার?
– আহা আপনি রাগ করছেন কেন? আমার পুরো কথাটা শোনেন আগে। মেয়েটা অপমান করলো কোথায়? আমি যখন প্রশ্ন করেছিলাম, সে উত্তর না দিয়ে সবজির পাকোড়া আর পায়েস নিয়ে এসেছিল। হাসিমুখে খেতে বলেছিল। রান্নাঘর থেকে চা নিয়ে আমার সামনে দিয়েছিল।

তবু জামিলের মন মানে না, ‘তুমি একদম শিশুর মতো আনিকা। মেয়েটা এভাবেই অপমান করেছে তোমাকে। সে কি ঝগড়া করবে নাকি! মেয়েটা কি তোমাকে বলেছে একবারও, আপু আপনি ছয় বছর পর বাচ্চা নিলেন কেন? এতোদিন কি সমস্যা ছিল?’

আনিকা স্বামীর হাত ধরে বললো, ‘সত্যিই, এসব কোনো প্রশ্ন করেনি। কত মানুষ আমাকে কত কথা বলেছে!’

জামিল বললো, ‘সেদিন আমার সামনেই আমার আত্মীয়া তোমাকে বন্ধা বলে কষ্ট দিলো। এসব তোমার বেশি কথা বলার অভ্যাসের কারণে হয়েছে। বলার কি দরকার ছিল যে তোমার ইউটেরাসে সিস্ট আছে? এই সিস্ট যে তেমন ক্ষতি করে না এটা আর কে বোঝাবে উনাদের!’

জামিল আনিকার প্রতি অত্যন্ত দুর্বল আর যত্নশীল। আনিকাকে কষ্ট দিয়ে কথা বললে সে বেশ রেগে যায়। আনিকা সেটা বুঝতে পারে। সে হেসে জামিলের কাঁধে মাথা রেখে বললো, ‘এগুলো বাদ দিন। আপনি আমার ভাইয়ের জন্য পাত্রী খুঁজে বের করুন।’

জামিল চুপ করে আছে। তার স্ত্রী খুব সুন্দর করে ঝগড়া থামাতে জানে। এই বৈশিষ্ট্যটা তাদের দাম্পত্য জীবনকে শান্তিময় করে তোলে।
আনিকা বললো, ‘আপনার বন্ধু শিহাব তার বউ আর বোন নিয়ে একবার আমাদের বাসায় এসেছিল। ওই মেয়েটার খোঁজ নিন। আমার ভালো লেগেছিল মেয়েটাকে।’

– সতীন বানাবে?

চমকে তাকালো আনিকা, ‘মানে?’

জামিল স্ত্রীর ভয়ার্ত মুখ দেখে উচ্চস্বরে হেসে বললো, ‘দুষ্টুমি করলাম।’

আনিকা জামিলের বাহুতে ইচ্ছেমতো আঘাত করলো। হাসতে হাসতে তার হাত দুটো আঁকড়ে ধরে জামিল বললো, ‘আর কোনো কথা নয়!’

_____

রাতের মক্কা দেখতে অসাধারণ মোহনীয়। হোটেলের রুম থেকে কৃত্রিম আলোয় আলোকিত মক্কা দেখতে ভালোই লাগছে আরশের। তবে সে কল্পনা করছে আকাশের তারার আলোর উজ্জ্বলতায় মিশে থাকা দালানবিহীন মক্কাকে। যেখানে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিচরণ করেছেন, সাহাবীরা তার সাথী হয়ে ইসলামের দাওয়াত দিয়েছেন।

মোবাইলে ম্যাসেজের আওয়াজ এলে মনোযোগ ভাঙলো তার। ফোন হাতে নিয়ে মেজাজ খারাপ হয়ে এলো। একটু আগে সে তার অনুভূতি সম্পর্কে ফেসবুকে পোস্ট করেছিল। এর উদ্দেশ্য ছিল মানুষকে অনুপ্রেরণা দেয়া যেন তারা আর্থিক উন্নতির পাশাপাশি হজ ও উমরায় মনোযোগী হয়ে থাকে। আরশ প্রায়ই বিভিন্ন ধরনের লেখালেখি করে থাকে। এজন্য কখনো কখনো নারী ফিতনা তাকে ঘিরে ধরে। এই যেমন এখন, একজন তথাকথিত দ্বীনি বোন তাকে ইনবক্সে ম্যাসেজ করেছে, ‘আপনার অনুভূতি কত নির্মল!’

আরশের ইচ্ছে হলো ম্যাসেজের রিপ্লাই দিতে, ‘আমার অনুভূতি নির্মল নাকি পাখির মল, সেটা আপনি কীভাবে জানবেন?’ কিন্তু এসব লেখা মানেই শয়তানকে আরো বেশি প্রশ্রয় দেয়া। সে মেয়েটার আইডিতে গিয়ে ব্লক করে দিলো। একটা সামান্য ম্যাসেজের কারণে কাউকে ব্লক মারা অনেকের কাছেই বিস্ময়ের। আরশ কাউকে এগুলো বলে না। তবে তার ধারণা, মানুষ এসব শুনলে বলবে, ‘ভাই, এতোই যখন সমস্যা তখন ফেসবুক লক করে রাখলেই পারেন।’

সে মনে মনে উত্তর তৈরি করে রেখেছে, ‘কিছু ভাই বোন আছেন যারা ফলো করে উপকৃত হন। রাজ-নীতি, আইন, ইসলামী আইন আর রাষ্ট্রীয় আইন- এ সব জানতে অনেকেই ইনবক্সে প্রশ্ন করতেন। একই প্রশ্ন বারবার আসতো বলে পোস্ট হিসেবে ফেসবুকে আপলোড দিয়ে দিই যাতে মানুষ তা দেখে জানতে পারে। এ কারণে এখন এসব বিষয়ে কেউ বারবার ম্যাসেজ করে না। যেগুলো জানতে চায় সেগুলো আমার জানা না থাকলে বিভিন্ন বই পড়ার পরামর্শ দিয়ে থাকি।’

কিন্তু সে যেহেতু কাউকে দ্বীনি বোনদের ফিতনা নিয়ে কিছুই বলেনি, তাই এমন প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়নি তাকে। তবে ব্লক করার বিষয়টা শুরুতে ছিল না। তার প্রোফাইলের বায়োতে লেখা আছে, ‘বোনেরা ম্যাসেজ দেয়া থেকে বিরত থাকুন।’

সেই হিসেবে এক বোন তাকে ভিডিও কল করেছিল সরাসরি। সে চমকে উঠে তা কেটে দিয়েছিল। হাতের চাপে ধরে ফেললে সর্বনাশ হয়ে যেত! প্রচণ্ড রেগে গিয়ে সে ম্যাসেজ দিয়েছিল, ‘সমস্যা কি আপনার?’

মেয়েটার উত্তর ছিল, ‘ম্যাসেজ দিতে মানা করেছেন তাই কল দিলাম।’

এরপর থেকে প্রতিটা মেয়েকে সে ব্লক করে দেয় সীমা লঙ্ঘন করার পূর্বেই। কমেন্ট সেকশন ফ্রেন্ডস করে দেয়া তাই মেয়েদের কমেন্ট করার উপায় নেই। তবু শয়তান পিছু ছাড়ে না। সে ছোট এক শ্বাস ফেলে মনে মনে এসব মেয়েদের হিদায়াতের কামনা করে রাজীবকে ফোন করলো। রাজীব তার সহকর্মী। ফোনে টুকটাক আলাপ শেষে সে জানালো তার বাংলাদেশে ফেরার কথা।

রাজীব বললো, ‘তাহলে এখনই বলে দিই কথাটা। যেহেতু তোমার ওখানকার কাজ শেষ।’

– কি কথা রাজীব ভাই?
– রাশেদ স্যার তোমাকে নিয়ে অন্য পরিকল্পনা করে রেখেছেন।

ভ্রু কুঁচকে এলো আরশের, ‘কী পরিকল্পনা?’
– তোমাকে একটা মামলায় কাজ করতে হবে। তাই সিআইডি ডিপার্টমেন্ট এ পাঠাবে।

স্বস্তির শ্বাস ফেললো আরশ। সে ভেবেছিল ঝামেলায় জড়িয়ে ফেলেছে তাকে। অথবা চাকরি নিয়ে টানাটানি হবে। মনে মনে আল্লাহর প্রতি শুকরিয়া আদায় করে সে বললো, ‘গুরুতর কেস নাকি?’

– না, আবার হ্যাঁ। বেশ দৌড়াদৌড়ি আর দক্ষতার কাজ আছে এখানে, তরুণ ডিটেকটিভ লাগবে। এজন্য পুলিশের পোশাক ছেড়ে এখন সিআইডির পোশাক পরতে হবে তোমাকে।
– তাতে আপত্তি নেই। কিন্তু সমস্যাটা কি নিয়ে?

– আজিমপুর কবরস্থান নিয়ে। ওখানে অনেক ক্রাইম বাড়ছে। কিছুদিন আগে ওখানকার বাসিন্দা নোটিশ পাঠিয়েছে যে কবরস্থানের দেয়াল ভেঙে গিয়েছে। সেদিক দিয়ে চোর-ডাকাত, মদখোর, এরা রাতের বেলা প্রবেশ করে। তাই রক্ষীরা টের পায় না। আর টের পেলেও কিছু করার নেই। বললেই এক পোচ মেরে গলা ফুঁড়ে দিবে। আর একারণেই গত সপ্তাহে দুটো লাশ পাওয়া গিয়েছে যেটা নিয়ে বেশ তোলপাড় শুরু হয়েছে।
– ঠিকাছে ভাই। দেশে ফিরে বাকিটা শুনছি।

ভদ্রতার আলাপ সেরে ফোন রাখলো আরশ। ক্রিমিনলজি বিভাগে পড়াশোনা শেষ করে সরকারি চাকরিটা পেয়েছে সে। তার সুন্নী দাড়ি আর টাখনুর উপরে রাখা ফরমাল প্যান্ট কেউ ভালো চোখে দেখে না। তাকে সৎ সাহস জুগিয়েছিলেন ইহসান স্যার। যিনি এই বিভাগে দীর্ঘ পনেরো বছর ধরে দ্বীন মেনে চলছেন আল্লাহর প্রতি ভরসা রেখে। ছোট সমস্যার সম্মুখীন হলেও বড় কোনো হুমকি তার দিকে ধেয়ে আসেনি কখনোই। কিন্তু তিনি এখন ঢাকার বাইরে নারায়ণগঞ্জে আছেন। তাই অনুপ্রেরণার বাণী আরশের নিজের কাছ থেকেই নিতে হয়। মন থেকে সে তাওয়াক্কুল রেখে নিজেকে প্রতিনিয়ত আশ্বাস দিয়ে থাকে।

হঠাৎ করেই মনে পড়ছে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের কথা। দৃষ্টির হেফাজত করতে যেখানে হিমশিম খেতে হতো, সেখানে নারীরা প্রকাশ্যে তাদের সৌন্দর্য দেখিয়ে বেড়াতো। তার মাঝেই একবার ভুল করে দেখে ফেলেছিল একজনকে। একবার ভুল করে দেখে ফেললে তাতে ক্ষমা পাবার সম্ভাবনা আছে। কিন্তু সেই দেখাটা ছিল অন্যরকম। একবারই তাকিয়েছে সে, বেশ সময় নিয়ে। যখন মেয়েটা তার দিকে তাকিয়েছিল তখনই সে চোখ নামিয়েছিল। একবার, শুধু একবারই দেখেছিল। কিন্তু বেশ খানিকটা সময় নিয়ে!

শুধু নামটা জানা ছিল। এছাড়া একজন অন্য নারীর সম্পর্কে আর কিছুই জানার আগ্রহ ছিল না তার। তারপরও মনের মাঝে সেদিন শয়তানি ওয়াসওয়াসা চললো। তাহাজ্জুদের সালাত আদায় করে সিজদাহয় গিয়ে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইলো সে। প্রাণ ভরে দুআ করলো, যেন ওই এক পলক দেখা চেহারাটা সে ভুলে যেতে পারে। পরেরদিন সে জানতে পারলো, মেয়েটা তার পরিচিত ব্যাচমেটের প্রেমিকা। মুহূর্তেই মন থেকে মুছে গেল সবকিছু।

এরপর থেকে আলহামদুলিল্লাহ, তাকে কোন নারীর ছলনা স্পর্শ করতে পারেনি। সে ঊনত্রিশ বছরের যুবক। গাম্ভীর্যের আড়ালে থাকা হৃদয় গহীনের শূন্যতা সে বুঝতে পারে। আল্লাহর প্রতি ভরসা ও তাঁর রহমত আছে বলেই সে নিজেকে হেফাজত করতে পারছে।

_____

‘সুন্দরী, প্রেয়সী!
যাই ডাকি না কেন, সে যে রূপসী।
সব বিশেষণ হার মানে তার কাছে,
হৃদয়টাও যে তারই কাছে পরে আছে!
সে যে একটাই তারা, আমার রিশতা!’

গিটারের তালে গেয়ে ওঠা গানটা ঠিক সামনে বসে কেউ গাইছে। রিশতা একদম খেয়াল করেনি ব্যাপারটা। প্রতিদিন ক্লাস শেষে সে এই দিকের নির্জন জায়গাটায় বসে পড়াশোনা করে। হলের চেয়ে এই পরিবেশটা তার বেশি পছন্দ। যদিও এখানে আশেপাশে প্রেমিক প্রেমিকার সংখ্যা বেশি। এ কারণেই জায়গাটা নিরিবিলি আর ঝামেলা মুক্ত মনে হয় রিশতার। কেউ কারো দিকে খেয়াল করে না। সে এক কোণায় বেঞ্চের উপর বসে নোট করে। পড়াশোনা ছাড়া তার জীবনে আর কিছুই নেই।

আজকে সঙ্গী হিসেবে মিরা তার পাশে ছিল। পড়তে পড়তে হঠাৎ গানের আওয়াজ ভেসে আসলে সে ভেবেছিল এটা মিরার প্রেমিকের কাজ। তাই কোনোদিক না তাকিয়ে পড়ার বই আর খাতায় মুখ গুজে ছিল সে। যখন মনে হলো, গানটা তার মনোযোগে সমস্যা করছে তখন সে উপরে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেল। এই ক্যাম্পাসের সবচেয়ে পরিচিত মুখ, গায়ক রুদ্র ভাইয়া বসে আছে তার সামনে। পিছে ভাইয়ার বন্ধুদল। রুদ্র তাকে হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতে দেখে থেমে গেল। রিশতা পেছন ফিরে দেখলো, মিরা তার পিছে নেই। বিস্ময় নিয়ে বললো সে, ‘গানটা ইনাম ভাই গাইছিল না?’

মুহূর্তেই হাসির ফোয়ারা জেগে উঠলো। মিরা এসে তার মাথায় টোকা দিয়ে বললো, ‘এত বোকা কেন তুই? গানের মাঝে কতবার রিশতা নামটা ব্যবহার করেছে খেয়াল করিসনি?’

রিশতার বাকি স্মৃতি খুব ভালো মনে নেই। সেদিন রুদ্র বেশ কষ্ট পেয়েছিল তার আচরণে। সে খারাপ ব্যবহার করেনি, কিন্তু রুদ্রকে তখনই মেনে নেয়নি।

রুদ্র খুব কষ্ট পেয়েছিল কারণ গানটা সে শুধু রিশতার জন্য লিখেছিল। রিশতার প্রতি তার দুর্বলতা সে বিভিন্নভাবে বুঝিয়েছে। এক সময় রিশতাকে মেনে নিতে হয়েছে রুদ্রর ভালোবাসার জোর। আর এটা টিকে ছিল স্বাধীনতা নামক দ্বিধায় মোড়ানো অনুভূতির কারণে।

স্বাধীনতা। এই একটা শব্দের কারণে রুদ্র আর রিশতার সম্পর্কে ছিল না কোনো তর্ক-বিতর্ক। তারা একে অপরের সিদ্ধান্তকে শুধু সম্মান নয়, স্বাধীনতা দিয়ে থাকতো। যেমন রিশতা। সে চেয়েছিল পড়াশোনার সময়ে যেন এতটুকু অভিযোগ না তুলে রুদ্র। রুদ্রর মনটা বারবার তাকে দেখতে চাইলেও কখনোই মুখ ফুটে তা বলতো না সে। আর রুদ্র ছিল চেইনস্মোকার। গানের পাশাপাশি বন্ধুদের সাথে মাঝে মাঝে মদের আসর জমাতেও তার জুড়ি ছিল না। এগুলো নিয়ে সচেতনতা বলতে, রিশতা শুধু স্বাস্থ্যের দিকটা খেয়াল রাখতে বলতো। এছাড়া জোড়ালো ভাবে মানা করেনি সে। এটা স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ হয়ে যায় যা তারা দুজনেই অপছন্দ করতো।

অথচ এখনকার ভাবনায় কত তফাৎ! রিশতা এখন বুঝতে পারে, সবসময় স্বাধীনতা ভালো নয়। কিছু সময় পরাধীনতা খুব বেশি প্রয়োজন। এই পরাধীনতা হলো যত্নের, সম্মানের। স্বাধীনতা কিংবা মুক্তি শ্রদ্ধার বিষয় মনে হলেও তাতে ভালোবাসা নেই। সেখানে শুধু নিয়মের মাঝে চলা, নিয়ম করে কথা বলা। এই বুঝি কিছু একটা বলে ফেললাম আর তার অধিকারে হস্তক্ষেপ করে ফেললাম! এটা কেমন স্বাধীনতা!

কিন্তু ভালোবাসার যত্নে গড়ে তোলা পরাধীনতায় কোনো নিয়ম নেই। অন্তর থেকে যেই ভাবনা মুখ ফুটে বলতে ইচ্ছে করে, সেটাই বলে দেয়া যায়। একটু ভালোবেসে বলা যায়, ‘আজ পড়াশোনা থাক না?’ অভিমান নিয়ে বলা যায়, ‘আপনি ওই মেয়ের দিকে তাকালেন কেন? আমি দেখেছি, আমার শকুন দৃষ্টি দিয়ে!’ আর নয়তো দুজনই একে অপরের প্রতি অধিকারবোধ থেকে বলবে, ‘ভালোবাসি!’

নাকি ‘ভালোবাসি’ বলাটাও স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ?

‘না! আমার জীবনকে আপনি কেন ভালোবাসবেন?’
কেউ কি এটা বলে?

স্বামী স্ত্রীর সম্পর্কটা এখন শুধু জৈবিক চাহিদার জন্য। সংসারকে তারা প্রতিযোগিতার অঙ্গন মনে করে, যেখানে তারা দুজন প্রতিযোগী। রিশতা আর রুদ্রর সম্পর্কও এমন ছিল বলে তারা দুজনই দুজনকে স্বাধীনতা দিয়েছে। কি জঘন্য সিস্টেম!

ভাবতে ভাবতে কখন যে ফজরের আজান দিয়ে দিয়েছে, রিশতা টের পায়নি। সে ওযু করে সালাত আদায় করলো। সালাত পড়ে বিছানায় শুয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করলো। ঘুম আসছে না তার। বারবার মনে হচ্ছে, তার জীবনটাও পরাধীনতার শিকলে আবদ্ধ হয়ে যাবে। সেটা খুব বেশি যত্নের, ঠিক এখনকার রিশতা যেমন চায়।

বিছানায় উঠে বসলো রিশতা। আকাশের দিকে তাকিয়ে সে বললো, ‘এমনটা কেন মনে হচ্ছে আল্লাহ?’

_____

(ইন শা আল্লাহ চলবে)

‘সত্য পিঞ্জর’
পর্ব ৩.
তাবিনা মাহনূর

__________

ঢাকায় ফেরার তৃতীয় দিন অফিসে গেল আরশ। এই দুইদিন আত্মীয় স্বজনের সাথে দেখা করতে গিয়ে সময় পার হয়ে গিয়েছে। সৌদি থেকে ফিরলে সবার জন্য অবশ্যই জমজমের পানি আর খেজুর আনতে হয়, এটা অলিখিত নিয়মে দাঁড়িয়েছে। এছাড়াও কাছের মানুষদের জন্য মুসাল্লা এনেছেন নাজিফা। এগুলো যখন মানুষকে দেয়া হয়, তখন খুব শান্তি পান তিনি। মানুষের মুখে হাসি ফুটানোর আনন্দ অন্য কিছুর সাথে তুলনা করা যায় না।

অফিসে গিয়ে রাজীবকে দেখে সালাম দিয়ে আলিঙ্গন করলো আরশ। হাতে থাকা প্যাকেট তাকে দিয়ে বললো, ‘ভাই, সামান্য কিছু জিনিস এনেছি।’

রাজীব প্যাকেট হাতে নিয়ে বললো, ‘জমজমের পানি আছে তো?’
– জি ভাই।
– ওটাই অসামান্য আরশ। এই একটা জিনিস আনলে আর কিছু লাগে না।

কথোপকথন শেষে আরশ রাশেদের কেবিনে গেল। দরজা খুলতেই রাশেদ তাকে দেখে হাসিমুখে বললেন, ‘ভালোই ট্যুর দিয়ে আসলে আরশ?’

রাশেদ আধুনিক মুসলিম। সালাত আদায় করেন না, রমাদানে সিয়াম রাখেন না, সুন্নত মেনে চলেন না কিন্তু বিপদ দেখলে আল্লাহকে ডাকতে ডাকতে ক্লান্ত হয়ে যান। অবশ্য বিপদে আল্লাহকে তিনি স্মরণ করেন, এটাই অনেক বিস্ময়ের বিষয়। এমন মানুষগুলো আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস রাখে, ভরসা করে। তাদেরকে আন্তরিকভাবে দ্বীনের দাওয়াত দেয়া হলে অনেকেই হিদায়াতের সন্ধান পেয়ে যেতেন। তবে হিদায়াত সম্পূর্ণ আল্লাহর হাতে। তিনি যাকে ইচ্ছা তাকে সম্মানিত করেন, যাকে ইচ্ছা তাকে লাঞ্ছিত করেন। মানুষ শুধু চেষ্টা করতে পারে।

রাশেদকে একটা প্যাকেট এগিয়ে দিয়ে আরশ বললো, ‘আপনার জন্য স্যার।’
রাশেদ বেশ খুশি হয়ে একটা খেজুর মুখে দিয়ে হাতের ইশারায় আরশকে বসতে বললেন। আরশ বসলে তিনি তার পরিকল্পনা সম্পর্কে জানালেন।

– উমরা করে এসে শরীর ভালো আছে তো?
– আলহামদুলিল্লাহ, উমরা করে আরো বেশি সুস্থ মনে হচ্ছে নিজেকে।
– আলহামদুলিল্লাহ। তাহলে আমরা এখন অফিসিয়াল কথাবার্তায় চলে আসি।
– জি।

রাশেদ খাওয়া শেষ করে মূল আলাপে মনোযোগী হলেন, ‘তুমি এই বিভাগে নতুন। মাত্র এক দেড় বছরের যাত্রা তোমার। কিন্তু এর মাঝেই কাজের প্রতি তোমার প্রবল আগ্রহ আমি সহ উপর মহলের লোকেরা পর্যবেক্ষণ করেছে। তাই আজিমপুরের কেসটা তোমাকে ডিল করতে হচ্ছে। এটা আমার সিদ্ধান্ত। এখন তুমি বলো, তুমি কি চাইছো?’

আরশ বললো, ‘আমার আপত্তি নেই স্যার। কিন্তু ঘটনাটা যদি পরিষ্কার জানতে পারতাম আমার জন্য সুবিধা হতো।’

– শোনো, আজিমপুর কবরস্থানে অনেকদিন ধরেই ক্রাইম চলছে। এটা নতুন কিছু নয়। তাই কারো মাথা ব্যথা ছিল না এই নিয়ে। সমস্যা বেঁধেছে সামনের ইলেকশন নিয়ে। এবারের ওয়ার্ড কাউন্সিলর ইলেকশনে আজিমপুর যেই ওয়ার্ডের অধীনে, সেখানে দুজন বেশ ক্ষমতাশালী মানুষ প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে আছেন। তাদের মধ্যে আফজাল হক এতদিন সেখানকার কাউন্সিলর ছিলেন। কিন্তু ইলেকশনে উনার প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে লাবিব মোর্শেদ উনার সমকক্ষ। তাই এই দুজনের মাঝে মনঃযুদ্ধ চলছে।

আরশ প্রশ্ন করলো, ‘কেউ কি আফজাল হককে ফাঁসাতে চাইছে?’

রাশেদ মুচকি হেসে বললেন, ‘আরশ, এগুলো খুবই সাধারণ বিষয়। আজিমপুর কবরস্থানে নেশাখোরদের আড্ডা, খুন, লাশের হাড় চুরি- এসব নিত্যনতুন ঘটনা নয়। কত কাউন্সিলর গেল, কত আসলো! কেউই এ ব্যাপারে মাথা ঘামায়নি। কারণ স্থানীয় মানুষ সচেতন হয়নি কিংবা এসব নিয়ে ভাবার সাহস পায়নি। এখন নতুন করে কেন এই ঘটনা নিয়ে তদন্ত করতে হচ্ছে অনুমান করতে পারছো?’

আরশ ভ্রু কুঁচকে বললো, ‘বিরোধী দলের প্রতি ক্ষোভ কিংবা ইলেকশনে বিজয় নিশ্চিত করা?’

– আশ্চর্যের ব্যাপার কি জানো? লাবিব আর আফজাল একই দলের পদপ্রার্থী। এ কারণে ঝামেলা বেশি পোহাতে হচ্ছে। আমরা তো তাদের দাস। এখন আমাদেরকে যে কিনে নিবে, আমরা তারই হতে বাধ্য। কিন্তু সমস্যা হলো নির্বাচন নিয়ে। যাকেই আমরা অপরাধী হিসেবে দেখাই না কেন, সে যদি ইলেকশন জয়ী হয় তাহলে আমাদের চাকরি তো থাকবেই না, উল্টো প্রাণ নিয়ে আশংকায় থাকতে হবে।

আরশ বুঝতে পারলো, এই বিভাগে এতদিন তাকে নোংরা রাজ-নীতিতে জড়াতে হয়নি। কিন্তু সামনের পরিস্থিতি অনুকূলে নাও থাকতে পারে।

– কিন্তু যাকে দুর্নীতির সাথে জড়িয়ে থাকতে দেখবো, তাকে জনগণের সামনে উপস্থাপন করলে নিশ্চয়ই তার হার নিশ্চিত?

রাশেদ হতাশ হয়ে বললেন, ‘তুমি এতো বোকা কেন আরশ?’

আরশের নিজেকে সত্যিই বোকা মনে হচ্ছে। যদিও সে কারণটা জানে না। রাশেদ বললেন, ‘নির্বাচন কীভাবে হয়?’
চুপ করে আছে আরশ। রাশেদ বললেন, ‘অবশ্যই জনগণের ভোটেই হয়। দেয়ালেরও কান আছে, জানো তো?’
আরশ মুচকি হাসলো। রাশেদও হেসে বললেন, ‘যাই করো না কেন, আমরা মাইনকার চিপায় ফেঁসে যাবো।’

আরশ আবার হেসে ফেললো। মুচকি হাসিটা ধরে রেখে সে বললো, ‘আমাদের তাহলে কি করা উচিত স্যার? অন্যায় দেখেও না দেখার ভান করবো?’

রাশেদ বললেন, ‘এজন্যই আমি একটা পরিকল্পনা করেছি। তোমাকে এএসপির পোশাক ছেড়ে এখন সিআইডির পোশাক পরতে হবে।’

আরশ সম্মতি জানিয়ে বললো, ‘আমি প্রস্তুত আছি।’

_____

স্কুল থেকে ফিরে গোসল সেরে নিলো রিশতা। স্কুলে ক্লাস নাইন-টেনের বাচ্চাদের বাংলা পড়াতে গিয়ে সে নিজেই ঘুমিয়ে পড়ে। বাংলা বিষয়টা তার অপছন্দের। সে পড়াশোনা করেছে আইন বিভাগে। এই বিভাগে প্রায় এক বছর চাকরি করার পর ছেড়ে দিয়েছে। এখানে শুধুই দুর্নীতি। রিশতার ইচ্ছে ছিল ব্যারিস্টার হওয়ার। উচ্চ পদে যেতে হলে অতিরিক্ত তেল মারা ও চাপাবাজি শিখতে হবে, সেই সাথে অপরাধকে স্বাভাবিকভাবে নিতে হবে। যেখানে ন্যায়-অন্যায়ের পার্থক্য করা হয়, সেখানেই এই বিষয় দুটিকে মিলিয়ে ফেলা হয়েছে, তা মেনে নিতে কষ্ট হয় রিশতার। বাধ্য হয়েই মনকে শিক্ষকতার দিকে ফিরিয়ে নিলো সে। অন্যায়ের মাঝে থাকা কোনোভাবেই সম্ভব নয়।

গোসল সেরে যুহরের সালাত আদায় করে ভাত খেয়ে নিল সে। আজমেরী গিয়েছেন বোনের বাসায়। মর্জিনা খালা ঘুমিয়ে আছেন। খাওয়া শেষে রিশতা শশুরের ঘরে উঁকি দিলো। হিশাম সাহেবের চোখ খোলা। তারমানে তিনি ঘুমাননি। তিনি শুধু চোখ আর মুখ নাড়াতে পারেন। হাত-পা নাড়ানো, কথা বলা- সম্ভব হয়নি উনার। রিশতা হাসিমুখে বললো, ‘বাবা, আলুর দম দিয়ে রুটি খাবেন?’

হিশাম একবার চোখের পলক ফেললেন। এর অর্থ ‘হ্যাঁ’। রিশতা দ্রুত খাবার আনলো। হিশামের পিঠ বাঁকিয়ে হেলান দিয়ে বসিয়ে দিলো সে। আলুর দম চটকে রুটির ছোট্ট টুকরা দিলো যেন চিবিয়ে খেতে না হয়। হিশাম অবশ্য বেশি খেতে পারলেন না। বমি করে ফেললেন। রিশতার দিকে করুণ চোখে তাকালেন তিনি। রিশতা হেসে বললো, ‘বাবা, এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন? আমি কি বকা দিব আপনাকে? আমি তো আপনার মা।’

শশুরের জামা পরিষ্কার করে বিছানা পরিষ্কার করলো রিশতা। ঘরে গিয়ে আবার গোসল করলো সে। মনে পড়লো, হিশামকে খাবার পানি দেয়া হয়নি। গ্লাসে পানি নিয়ে ঘরে গেল সে। হিশামের চোখ ভর্তি অশ্রু। তা দেখে রিশতা বললো, ‘এই রোগের উছিলায় আল্লাহ আপনার গুনাহ মাফ করে দিবেন ইন শা আল্লাহ।’

রিশতা চোখের পানি মুছে দিয়ে পেছন ফিরে দেখলো, মর্জিনা খালা পর্দা ধরে দাঁড়িয়ে আছেন। সে বললো, ‘খালা খেয়েছিলেন?’
– হ্যাঁ খাইছি।
– আচ্ছা, সালাত পড়ে নিন।

মর্জিনা ভেতরে এসে হিশামকে দেখলেন। তারপর হেসে হেসে বললেন, ‘ভাইজান, বৌমা কি সারাজীবন এখানে থাকবে?’
হিশাম চুপ করে তাকিয়ে থাকলেন। মর্জিনা কি বলতে চাইছে সেটা তিনি বুঝতে পারলেন না। মর্জিনা আবার বললো, ‘আমরা যদি বৌমাকে বিয়ে দিই, তাহলে আপনি রাজি হবেন ভাইজান?’

দ্রুত পলক ফেললেন হিশাম। ঘন ঘন পলক ফেলার কারণে তার চোখে আবার জলের দেখা মিললো। তিনি উত্তেজিত হয়ে মুখ নাড়াতে লাগলেন। খুব চেষ্টা করলেন কিছু বলতে, কিন্তু মুখ দিয়ে ফ্যানা ছাড়া আর কোনো শব্দ বের হলো না।

রিশতা মর্জিনার দিকে তাকিয়ে বললো, ‘খালা! আপনি এমন মজা করবেন না অসুস্থ মানুষটার সাথে। যান সালাত পড়ে নিন। সময় চলে যাচ্ছে।’

মর্জিনা যাচ্ছেন আর হাসতে হাসতে বলছেন, ‘মেয়ে মানুষ বিয়ে ছাড়া চলা মুশকিল। আমি নাহয় হিজড়া, তাই বিয়ে ছাড়া চলতেছি। কিন্তু তুমি যা সুন্দরী!’

আজমেরী বেগমের এই কাজটার জন্য রিশতা তাকে আলাদা সম্মান দিয়ে থাকে। তা হলো, মর্জিনার মতো একজন তৃতীয় লিঙ্গের মানুষকে বাড়িতে আশ্রয় দেয়া। অবশ্য এর পেছনে একটা কারণ আছে। আজমেরীর দূর সম্পর্কের আত্মীয় হন মর্জিনা। এজন্য উনার ভাষা আঞ্চলিক নয়। গায়ের গড়ন শক্তিশালী আর কন্ঠ মোটা হওয়ায় তার পরিবার তাকে নিয়ে সন্দেহ করেছিল। ডাক্তারের কাছে গেলে তিনি কিছু টেস্ট দেন। এরপর যখন তার সমস্যা ধরা পড়ে, তখন তাকে নিয়ে আলোচনা হয় যে তাকে কোথায় রেখে আসা উচিত হবে। সেসময় আজমেরী দূর সম্পর্কের এই বোনকে নিজের কাছে নিয়ে আসেন।

আর এতে লাভ হয়েছে তারই। কেননা ঘরে তিন জন পুরুষ। তার হাতের কাজে সাহায্য করার মতো কাজের মেয়ে রাখতে তিনি সাহস পেতেন না। যতই হোক, তিনি নিজের সন্তানদের বিশ্বাস করতেন না এসব ব্যাপারে। হিজড়া হওয়ায় এসব ঝামেলা থেকে চিন্তামুক্ত থাকতেন তিনি।

আছরের সালাত আদায় করে রিশতা একবার আনিকাকে দেখতে যাওয়ার কথা ভাবলো। বাসায় সে একাই থাকে। গর্ভাবস্থায় মহিলাদের একা থাকাটা ঝুঁকিপূর্ণ। তবু উপায় নেই বলে আনিকার দিন কাটে একা। রিশতা মর্জিনা খালাকে বলে উপরে চলে গেল। আনিকা দরজা খুলে মুচকি হেসে বললো, ‘আসসালামু আলাইকুম রিশতা। এসো, ভেতরে এসো।’

দুজন মিলে বিভিন্ন গল্পে মেতে উঠলো। আনিকার কাছ থেকে সাহাবীদের সম্পর্কে জানতে খুব ভালো লাগলো রিশতার। আজ সে সাহাবিয়া খানসা (রাদিয়াল্লাহু আনহা) এর জীবনী শুনলো। তাঁর চার সন্তান যুদ্ধে শহীদ হয়েছিলেন। তিনি ছিলেন দৃঢ় তাকওয়ার অধিকারিণী এবং গর্বিত মা।

গল্পের এক ফাঁকে আনিকা রান্নাঘরে গেল চা বানাতে। তাকে সাহায্য করতে রিশতাও চলে গেল। রিশতা চুপচাপ স্বভাবের মেয়ে। গল্প যা হয়, আনিকাই বলে। রিশতা সেটা মনোযোগ দিয়ে শোনে। কলিং বেলের আওয়াজ এলে আনিকা বললো, ‘তুমি দাঁড়াও, আমি দেখি কে এসেছে।’

রিশতা তাকে থামিয়ে বললো, ‘আপনি বেশি চলাচল করবেন না আপু। আমি দেখছি।’

_____

আরশের অপেক্ষা শেষে দরজা খুলে গেল। আরশ মুচকি হেসে একবার উপরে তাকিয়ে দ্রুত দৃষ্টি নামালো। সে ভুল দেখেছে কিনা বুঝতে পারছে না। এই চেহারা গত পাঁচ বছর আগে একবার দেখেছিল, তাও আল্লাহর কাছে কত দুআ করেছিল ভুলে যেতে। সে ভাবছে, অন্য মেয়েকে হয়তো রিশতা ভেবে নিয়েছে। দুই ধাপ পেছনে গিয়ে নম্বরপ্লেট দেখলো সে। ঠিকই আছে, 4-A লেখা। সামনে থেকে আওয়াজ এলো, ‘আপনি কি আনিকা আপুর কাছে এসেছেন?’

রিশতার কন্ঠ চেনা নেই আরশের। কখনোই কথা হয়নি তাদের। সেই একবার শুধু দেখেছিল। চেহারাটা মনে রাখার একটাই কারণ, সবুজাভ চোখটা। মেয়েটার নাম যেমন উর্দু, দেখতেও পাকিস্তানিদের মতো।

নিচে তাকিয়ে উত্তর দিলো আরশ, ‘জি।’

– তাহলে ঠিক জায়গাতেই আছেন। ভেতরে আসুন।
– আপু কোথায়?
– রান্নাঘরে।

রিশতা পথ ছেড়ে রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে গেল। আরশ ঢুকলো না। আনিকা যতক্ষণ না তার সামনে এলো, ততক্ষণ পর্যন্ত সে দাঁড়িয়ে থাকলো। আনিকা ভাইকে দেখে উৎফুল্ল কণ্ঠে বললো, ‘তোর না সন্ধ্যার সময় আসার কথা ছিল?’

আরশ ভেতরে ঢুকলে তাকে জড়িয়ে ধরতে গেল আনিকা। কিন্তু সে দুই হাত উপরে তুলে বললো, ‘আপু! আমি হাত মুখ না ধুয়ে তোমাকে ধরবো না। ধরলে বাবুর ক্ষতি হতে পারে।’

ভাইয়ের সচেতনতা দেখে হেসে ফেললো আনিকা। রিশতার খুব ভালো লাগছে। তার আপন ভাই বোন নেই। থাকলে ছায়ার মতো পাশে থাকতো হয়তো! আরশ ফ্রেশ হতে গেলে রিশতা বললো, ‘আমি এখন আসি আপু।’

আনিকা চা নিয়ে এসে বললো, ‘আসি মানে? চা না খেয়ে যেতে দিচ্ছি না। আমার ভাইকে নিয়ে টেনশন করো না। ও খুব শালীন আর ভদ্র। বখাটে টাইপের না।’

– না আপু, আমি এটা ভেবে বলিনি। আপনারা ভাই-বোন সময় দিন নিজেদের।
– আমাকে নিতে এসেছে ও। বাসায় গেলে সবসময় একসাথে থাকা যাবে। এখন চা খেয়ে বলো কেমন হয়েছে?

কাপে এক চুমুক দিয়ে রিশতা মিষ্টি হেসে বললো, ‘মা শা আল্লাহ! আপনার চা দারুণ হয়েছে আপু।’

আরশ কথোপকথন শুনতে পেয়ে সেদিকে আর গেল না। রিশতা চা খেয়ে চলে গেল। এবার ভাইকে আপ্যায়ন করতে ব্যস্ত হয়ে গেল আনিকা। স্যান্ডউইচ আর কেক দিয়ে ভাইয়ের পাশে বসলো সে। আরশ খেতে খেতে প্রশ্ন করলো, ‘ভাইয়া জানে আজ তুমি আমার সাথে ধানমন্ডি যাবে?’

– হ্যাঁ জানে। তিনি মহা খুশি, বউকে আর একা থাকতে হচ্ছে না।
– একা কোথায় ছিলে? গল্পের মানুষ আছে দেখছি।
– আরে না, প্রতিবেশীরা প্রতিদিন আসে নাকি? তাও রিশতা আজ এলো আমার বাবু পেটে বলে। নাহলে ওর সাথে মাসে একবারও কথা হয় না।

রিশতা! সে তাহলে ভুল দেখেনি। তবে এ নিয়ে তার কোনো আগ্রহ নেই। মেয়েটা রুদ্রর গার্লফ্রেন্ড ছিল। হয়তো এখন বিয়ে হয়েছে তাদের। তার খাওয়া বন্ধ হয়ে গেল আনিকার কথা শুনে।

– মায়া লাগে মেয়েটাকে দেখলে। বিধবা হয়ে ছয়টা মাস ধরে একা একা চলছে।

বিস্ময় নিয়ে প্রশ্ন করলো আরশ, ‘রুদ্র মারা গিয়েছে?’

_____

(চলবে ইন শা আল্লাহ)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here