‘সত্য পিঞ্জর’
পর্ব ৯,১০
তাবিনা মাহনূর
০৯
__________
আতিকের ফোন চুরি করা রক্ষীর নাম সজল। সজলকে পুলিশ অন্য কাজে লাগিয়েছে। সে খুব আকুতি মিনতি করে জেলে না দেয়ার জন্য অনুরোধ করলে পুলিশের মাথায় অন্য খেল তৈরি হয়। ওসি রাশেদ তখন আরশকে ফোন করে তার পরিকল্পনার কথা বললে আরশের তা পছন্দ হয়।
সেই অনুযায়ী সজল এখন কারাবন্দি না থেকে কবরস্থানের মাঝে ছোট একতলা বাড়িটায় আছে যেখানে রক্ষীরা থাকে। তাকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে রাতের খবরাখবর জানানোর জন্য। যদি সে গুরুত্বপূর্ণ কোনো তথ্য দিতে পারে তাহলে তাকে ক্ষমা করে দেয়া হবে। আর যদি সে পালিয়ে যায় অথবা তথ্য গোপনের চেষ্টা করে তাহলে তাকে দ্বিগুন শাস্তি দেয়া হবে।
সজল বোকা ধরণের মানুষ। পুলিশের কথা মেনে নিয়ে সে এখন সারারাত জেগে থাকে কবরস্থানের ভেঙে পড়া দেয়ালের ফাঁকা দিয়ে কেউ প্রবেশ করছে কি না তা দেখতে। কিন্তু সমস্যা হয় রাত দুইটা-আড়াইটার দিকে। এসময় তার খুব ঘুম ধরে। সে জোর করে চোখ খুলে রাখলে চোখ দুটো জ্বলে যায়। দুইদিন ধরে এই দায়িত্বে আছে সে। আজ তৃতীয় দিনে তার চোখে ধরা পড়লো অন্যরকম দৃশ্য।
কবরস্থানে লাশের হাড় চুরি করতে অনেক লাশচোর আসে। তাদের জন্য বাড়তি নিরাপত্তা রয়েছে। অনেক শ্রমিক আবার সেই চোরদের সাহায্য করে। সজল এগুলোর মাঝে যায় না। এর আগেও দুই একবার সে এমন চোর দেখেছে, তবু কিছু বলেনি। হাড়গোড় চুরি করলে কি এমন ক্ষতি!
তবে আজ সে একই দৃশ্য খুব মনোযোগ দিয়ে দেখছে। কেননা, এক লোক কবর খুঁড়ছে এবং তারই পাশে দাঁড়িয়ে আছে আজিমপুর কবরস্থান শাহী মসজিদের নতুন ইমাম তারিক। সজল একবার ভাবলো, তারিক মনে হয় লাশচোরদের সাথে যুক্ত। তারপর আবার ইমামকে এতটা খারাপ ভেবে নেয়ায় তওবা করলো সে। ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার আগে ভাবলো, জিন-ভুত নয় তো?
এই ভাবনায় সে ভেতরেই থেকে গেল। আবার পুলিশের ভয়ে পা বাড়ালো। এভাবে ভেতর-বাহির করতে করতে শেষমেষ ইমামের কাছে গেল সে। ইমাম তাকে দূর থেকে দেখতে পেয়ে ডাকলেন, ‘ঘুমাননি সজল?’
স্বস্তি নিয়ে বুকে থু থু দিয়ে বোকা হাসি হাসলো সজল, ‘ঘুম আসতাছে না। আপনারে দেইখা ডরায় গেছিলাম। কি করতাছেন?’
কবর খুঁড়ছেন যিনি, তার পরনে পাঞ্জাবি আর লুঙ্গি। লোকটার মুখ অত্যন্ত ভীত। তার দিকে তাকিয়ে তারিক বললেন, ‘উপকার করছি সজল। কুফরী বন্ধে সাহায্য করছি।’
– কুফরী!
– হ্যাঁ। এই কবরে একজনের নামে তাবিজ গেড়ে রাখা আছে। এই লোকটা সেটাই তুলছে।
সজল ধীরে ধীরে ইমামের পাশে দাঁড়ালো। মৃদু কণ্ঠে বললো, ‘এই লোক ক্যাডা?’
তারিক উত্তর দিলেন, ‘উনার বড় বোনের সংসার ভেঙে যাচ্ছে, বারবার পেটের মধ্যে বাচ্চা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে আর উনার দুলাভাই পাগলের মতো হয়ে যাচ্ছে। হুজুর বলেছে উনার বোনকে কঠিন কুফরী করে রাখা আছে। কবরে তাবিজ পুঁতে রাখা যেটা না তুললে সমস্যার সমাধান হবে না।’
সজলের মুখে মায়া ফুটে উঠলো, ‘আহারে! মানুষ কত্ত খারাপ হইতে পারে! কিন্তু উনি কেন আইলো? অন্য জনরে দিয়া উঠান যাইতো না?’
– হুজুর বলেছেন রক্তের সম্পর্কের কাউকে এই তাবিজ উঠাতে হবে। উনার আরো ভাই বোন আছে, কেউই রাজি হয়নি। উনিও ভয় পেয়েছিলেন এমন কাজ করতে। কিন্তু বোনের কথা চিন্তা করে বাধ্য হয়ে এসেছেন। উনি বোনকে খুব ভালোবাসেন।
– নাম কি উনার?
– ইকবাল। ইকবাল ভাই কবরস্থানে ঢোকার জন্য সাহস পাচ্ছিলেন না। পরে আমার কাছে এসে সাহায্য চাইলেন।
ইকবাল কবরের অনেকটা গভীরে ঢুকে গিয়েছে। এখন একটা সাদা কাপড় দেখা যাচ্ছে। সজল সেটা দেখে ভয় পেলেও প্রকাশ করলো না। ইকবাল হঠাৎ হাত উঁচু করে বললো, ‘পেয়েছি! একটা না, পাঁচটা তাবিজ!’
সজল অবাক হয়ে দেখলো, কিছু তাবিজ আর একটা শাড়ির ছেঁড়া অংশ ইকবালের হাতে। সে সেদিকে তাকিয়ে বললো, ‘কিন্তু এই লোক জানলো ক্যামনে যে এই কবরেই তাবিজ আছে?’
ইমাম অদ্ভুত হাসি হাসলেন। সজলের বুকে যেন কেউ হাতুড়ি পেটাচ্ছে। ইমাম অবশ্য বেশিক্ষণ সেই হাসি ধরে রাখলেন না। দ্রুতই গম্ভীর হয়ে বললেন, ‘জীন ছাড়া আর কে জানাবে?’
সজল সেখানেই অজ্ঞান হয়ে মাটিতে পড়ে গেল।
_____
রিশতাকে আজিমপুর কেন্দ্রিক সমস্যার কথা বলে আরশের অনেকটা হালকা লাগছে। এসব বিষয়ে তার শুধু অফিসের কলিগদের সাথে কথা হয়। কখনো অফিসের বাইরের কাউকে সে কিছু বলে না। কিন্তু রিশতাকে বলে মনে হলো তার ভার অনেকখানি কমে গিয়েছে। রিশতা শুধু শোনে না, পরামর্শ দেয়। আরশ মনে মনে আনিকাকে অনেকবার ধন্যবাদ জানিয়েছে।
ফজরের সময় আরশ ঘুম থেকে উঠে দেখে, সে সোফাতে ঘুমিয়ে পড়েছিল। তার ঘাড় ব্যথা করছে। বিছানায় তাকিয়ে সে দেখল রূপকথার গল্পকথন থেকে জীবন্ত এক রাজকন্যা তার বিছানায় ঘুমিয়ে আছে। ঘুমন্ত রাজকন্যাকে জাগাতে সোনার কাঠি রুপার কাঠির জায়গা অদল-বদল করতে হবে। এমন ভাবনায় সে কিছুক্ষণ একা একা হাসলো। প্রেমের শুরুতে মানুষ একাই হাসে।
তার নূরজাহানকে জাগাতে ইচ্ছে করছে না। গায়ে কাঁথা নেই, শাড়ির আঁচল দিয়ে শীত কমানোর চেষ্টা করেছে রিশতা। আরশ উঠে দাঁড়িয়ে ড্রয়ার থেকে কাঁথা বের করে রিশতার গায়ে দিয়ে দিলো। বাথরুমে গিয়ে ওযু করে আসার পর তার মনে হলো, সে প্রকৃত অর্ধাঙ্গের মতো আচরণ করছে না। রিশতাকে জান্নাতে দেখতে চাইলে অবশ্যই পাঁচ ওয়াক্ত সালাতে নিয়মিত হতে হবে। রিশতার পাশে মেঝের উপর হাটু গেড়ে বসে সে ডাকলো, ‘জাহান?’
কোনো সাড়া নেই। আরশ আবার ডাকলো, ‘রিশতা?’
রিশতা একটু চোখের পাতা নাড়লো, কিন্তু চোখ দুটো বন্ধ রাখলো। আরশ এবার গালে হাত দিয়ে ডাকলো, ‘নূরজাহান?’
চোখ খুললো রিশতা। আরশ হাত সরিয়ে নিয়ে বললো, ‘সালাত পড়বেন না?’
দুই হাত দুই পাশে ছড়িয়ে আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসলো রিশতা। তার এমন শিশুসুলভ আচরণে আরশ মুচকি হেসে উঠলো। উঠে দাঁড়িয়ে বললো, ‘ঘুম কাটছে না?’
রিশতা দুই পাশে মাথা নাড়লো। আরশ তার মাথায় হাত রেখে বললো, ‘কষ্ট করে ওয়াশরুমে যান। মুখে ভালোমতো পানি ছিটিয়ে নিন।’
রিশতা ওযু করতে চলে গেল। আরশ দুটো মুসাল্লা বিছিয়ে রিশতার জন্য অপেক্ষা করলো। দুজন মিলে সালাত পড়ার পর রিশতা যখন বিছানার দিকে এগিয়ে গেল তখন আরশ বলে উঠলো, ‘আপনি সকালের আমল জানেন?’
– না। আমি শুধু ফরজ সালাতের পর আয়াতুল কুরসী পড়ি।
– এটা খুব ভালো আমল। প্রতি ফরজ সালাতের পর আয়াতুল কুরসী পড়লে জান্নাতে যাওয়ার মাঝে শুধু মৃত্যুটাই বাধা হয়ে থাকে। আমাদের রাসূলের একটা হাদিস আছে এমন। আরো কিছু আমল যুক্ত করে নিবেন ইন শা আল্লাহ।
– এখন কি করবো?
– আজ থাক। আমি আজ সময় পেলে আপনাকে এ সম্পর্কে জানাবো। আর আনিকা আপুর কাছ থেকে পর্দার ব্যাপারে জেনে নিবেন।
– ঠিকাছে।
রিশতা খাটের এক কোণে শুয়ে পড়লো। চোখ বন্ধ করে বললো, ‘সোফায় ঘুমানোর প্রয়োজন নেই।’
মুচকি হেসে উত্তর দিলো আরশ, ‘আমি ইচ্ছে করে ঘুমাইনি। কাজ করতে করতে ঘুমিয়ে পড়েছি।’
রিশতা আর কিছু বললো না। তার মাথায় এখন অন্য চিন্তা। কাল আরশ বলেছিল, বিরোধী দলের ক্ষমতা খুব কম। তারা নির্বাচনে জয়ী হলে সূর্য পশ্চিমে উঠে যাবে! অর্থাৎ তাদের জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। সুতরাং তারা এমন কাজ করবে না। যত ষড়যন্ত্রই করুক না কেন, তারা জিতবে না এটা তারা জানে। শুধু শুধু মামলায় জড়ানোর ঝামেলায় যাবে না। এমনটা হলে রিশতার ধারণা, আফজালই লাবিবকে ফাঁসানোর জন্য নিজেকে ভিকটিম বানাচ্ছেন। এটা সে এখনো আরশকে বলেনি। এসব ভাবতে ভাবতে সে ঘুমিয়ে পড়লো।
আরশ ঘুমায়নি। সে প্রতিদিন ফজরের পর ধানমন্ডি লেকের দিকে হাঁটতে চলে যায়। আজও যাওয়ার সময় মনে হলো, হাঁটার সময় একজন সঙ্গী থাকলে বেশ ভালো লাগতো। এমন ভাবনা কালকেও হয়নি। এক দিনেই তার চিন্তাধারায় কত পরিবর্তন!
_____
সজল চোখ খুলে নিজের ঘরের ফ্যান দেখতে পেলো। দ্রুত উঠে বসে এদিক ওদিক চোখ বুলিয়ে দেখলো, দিনের শুরু হয়েছে। খাট থেকে নেমে মুখ না ধুঁয়েই সে দৌড় দিলো ইমামের কাছে। গিয়ে জানলো ইমাম মসজিদে নেই। তরুণ ইমাম পড়াশোনা করছেন এখনো। তাই পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের সময় ছাড়া আর কোনো সময় তাকে তেমন পাওয়া যায় না। সে হতাশ হয়ে নিজের ঘরে ফিরে গেল। রাতে আবার আসতে হবে তাকে। রক্ষীর চাকরিটা সে ছেড়েই দিবে এবার।
ভুবনের ফোন না পাওয়া গেলেও নাম্বার দিয়ে তার কল রেকর্ড বের করা যেত। কিন্তু সমস্যা হলো, তার নাম্বার কারো জানা নেই। কবরস্থানের কর্মচারী কেউই ঠিকঠাক বলতে পারছে না। তার নাম দিয়ে অনেক নাম্বার রেজিস্ট্রেশন করা আছে বলে নির্দিষ্ট কোনটা জানা গেল না। আবার আতিক ভুবনের সাথে যেই নাম্বার দিয়ে কথা বলেছে তা কবরস্থানের নিজস্ব ল্যান্ডফোন দিয়ে। কার্তিক বেশ ভালো বুঝতে পারলেন, এ ঘটনা এমন একজনের পরিকল্পনায় হয়েছে যে সূক্ষ্ম চাল চেলেছে। সে বড় খেলোয়াড়। সব দিক চিন্তা করে প্রমাণ নষ্ট করে দিয়ে সে এগিয়ে গিয়েছে।
আরশের ধারণা, আতিককে নির্দেশ দেয়া হয়েছিল সে যেন ভুবনকে মেরে ফেলে। আর ভুবনকে নির্দেশ দেয়া হয়েছিল সে যেন আতিককে মেরে ফেলে। অর্থাৎ উভয়কেই এই আদেশ দেয়ায় দুজনের কাছে ধারালো ছুরি ছিল। এবং দুজনেই ফোনে মাদক ছাড়া আর কোনো আলোচনা করেনি। আবার ভুবন নিজের ফোন নম্বর গোপন রাখার চেষ্টা করেছে, আর আতিক ভুবনের সাথে স্বাভাবিক স্বরে কথা বলেছে। অর্থাৎ এক্ষেত্রে ভুবনের বিষয়টা নিশ্চিত না হলেও, আতিককে মূল টার্গেট করে খুন করা হয়েছে।
তবে ভুবন মারা যাওয়ায় বেশ লাভবান হয়েছে আসল চালবাজ। এসব প্যাচের কারণে কেসটা আরো জটিল হয়ে গিয়েছে। খুব সাধারণ কেস অথচ সমাধান করা যাচ্ছে না। মিলন আবার অন্য এক কেস হাতে নিয়েছেন। মিয়ানমারের বর্ডারে মাদক পাচার নিয়ে কক্সবাজার থানার পুলিশ ঢাকার সিআইডির সাহায্য চেয়েছে। এজন্য মিলন সম্পূর্ণ দায়িত্ব কার্তিকের উপর ছেড়ে দিয়ে কক্সবাজার গিয়েছেন। এখন কার্তিক তার চার জনের ছোট টিম নিয়ে ব্যস্ত। এই টিমে আরশ ছাড়া বাকিরা কেমন যেন উদাসিনের মতো কাজ করছে। তাই কাজের ধারা এগিয়ে যাচ্ছে ধীর গতিতে।
রিশতা ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে নিলো। বাইরে বেরিয়ে কার সাথে কথা বলবে বুঝতে পারলো না সে। আনিকার ঘরে আনিকাকে না পেয়ে নীচে ড্রইং রুমে গেল সে। সেখান থেকে রান্নাঘরে থাকা মানুষের কন্ঠস্বর শোনা যাচ্ছে। নাজিফা আর কাজে সাহায্য করার একজন মহিলা কথা বলছেন। রিশতার মনে হলো, নাজিফা তাকে মেনে নিতে পারছেন না। আনিকা বলেছে তার মায়ের সাথে বন্ধুর মতো সম্পর্ক গড়ে তুলতে। সে নিজেকে প্রস্তুত করে রান্নাঘরে গিয়ে বললো, ‘মা!’
নাজিফা তাকালেন। একটু হাসার চেষ্টা করলেন যেটা দেখে রিশতার মন খারাপ হয়ে এলো। বোঝাই যাচ্ছে নাজিফা সহজ হতে পারছেন না। তিনি কাজে মনোযোগ দিয়ে বললেন, ‘উঠেছো? খেয়ে নাও।’
– সবাই খেয়েছে?
– হ্যাঁ।
– আনিকা আপুকে দেখছি না যে?
– ও আরশের সাথে ডাক্তারের কাছে গিয়েছে। রেগুলার চেকআপের জন্য। আরশ নাকি দুদিনের ছুটি পেয়েছে।
– জি মা। অফিসের লোকই ছুটির ব্যবস্থা করে দিয়েছে আলহামদুলিল্লাহ। আমি কি কোনো কাজে সাহায্য করতে পারি?
কথাটা কেমন যেন আবেদনপত্রের মতো গোছানো মনে হলো রিশতার। সে বুঝতে পারছে না কীভাবে নাজিফার সাথে সময় কাটানো যায়। নাজিফার অবস্থাও একই। তিনি চায়ের কাপ নিয়ে বললেন, ‘এটা তোমার আব্বুকে দিয়ে আসো। আর কিছু করতে হবে না।’
এতেই রিশতা খুব খুশি হলো। চায়ের কাপ হাতে নিয়ে লুকমানের ঘরে গেল সে। বাড়ির সাত ও আট তলা মিলে ডুপ্লেক্স জায়গার উপরের তলায় আমান, আরশ ও আনিকার ঘর। একটা গেস্ট রুমও আছে। নীচে ড্রইং, ডাইনিং, রান্নাঘর ও লাইব্রেরি ঘর। আর একটা ঘর আছে যেখানে নাজিফা আর লুকমান থাকেন।
লুকমানের ঘরের দরজায় নক করে রিশতা ডাকলো, ‘আব্বু, আপনার চা এনেছি।’
লুকমান নরম মনের মানুষ। গম্ভীর স্বভাবের হলেও আন্তরিকতায় গলে যান তিনি। এখনো রিশতার মুখে আব্বু ডাক শুনে তিনি মুচকি হাসলেন। এই হাসিটা রিশতার প্রাণবন্ত মনে হলো। তার ঠোঁটেও হাসি ফুটে উঠেছে। লুকমানের হাতে কাপ দিয়ে সে বললো, ‘আব্বু, আপনার আর কিছু লাগবে?’
– না মা। তুমি খেয়েছো?
– জি না আব্বু।
– যাও আগে খেয়ে নাও। শরীরের খেয়াল রাখবে মা। আর সবাই তোমার আপন। কাউকে ভয় করো না কেমন?
– জি আব্বু।
রিশতা ফিরে আসতে গিয়েও বলে উঠলো, ‘আব্বু, আমি কি আপনার জন্য পাউরুটি টোস্ট করে দিব?’
লুকমান মহা খুশি হলেন। তিনি হাসিমুখে বললেন, ‘কষ্ট হবে যে মা?’
– কোনো কষ্ট নেই। আমিও খাবো।
– তাহলে দুটো দিও।
রিশতা রান্নাঘরে গিয়ে কাজ শুরু করে দিলো। তার খুব ভালো লাগছে। পরক্ষণেই মনে পড়লো আজ স্কুলে যাওয়া হয়নি, এমনকি ছুটিও নেয়া হয়নি। তার এখন ছাত্রীদের সাথে বিরক্তিকর সময় কাটাতে হতো। সে তো এমন জীবনই চেয়েছে যেখানে তাকে সম্মান দেয়া হবে, নিজের আয় মিলবে। তারপরও তার সংসারের কাজ করতে ভালো লাগছে। কেন?
তার ভাবনা ভুল ছিল। উপলব্ধিটা ভুল ছিল।
__________
(চলবে ইন শা আল্লাহ)
‘সত্য পিঞ্জর’
পর্ব ১০.
তাবিনা মাহনূর
__________
দুই দিনের ছুটি কাটিয়ে অফিসের দায়িত্ব পালনে চলে এলো আরশ। জাহাঙ্গীরের কাছে আফজাল ও লাবিবের খবরাখবর জেনে কার্তিকের কাছে গেল সে। কার্তিক হতাশ হয়ে চেয়ারের উপর হেলান দিয়ে বসে আছেন। তাকে দেখে তিনি সোজা হয়ে বসে বললেন, ‘আরশ, বিয়েটা তাহলে করলে?’
আরশ মুচকি হেসে চেয়ারে বসলো। কার্তিক বললেন, ‘এমনিই মামলা নিয়ে ঝামেলা চলছে। এর মধ্যে বিয়ে করে আরেক ঝামেলা আনলে আরশ।’
আরশ মুচকি হাসলো। প্রসঙ্গ বদলে গম্ভীর হয়ে বললো, ‘মামলার কি কোনো কূল কিনারা হয়নি স্যার?’
– না। আমি খুব চিন্তিত বুঝলে? সজল কোনো কাজ এগিয়ে দিতে পারেনি। তাই তাকে জেলে না ঢুকিয়ে জরিমানা চেয়েছি। ওই ব্যাটা জেল খাটবে না, টাকাও দিবে না। কাজও ঠিকঠাক করতে পারলো না। রক্ষীর চাকরিটা ছেড়ে দিবে বেয়াদবটা।
– এরপর কি করলেন স্যার?
– রাশেদকে বলে জেলে ঢুকিয়ে দিয়েছি। এক সমস্যার মধ্যে আরেক সমস্যার চাপ নেয়ার কি দরকার। সুযোগ দিয়েছিলাম ব্যাটাকে, হাতছাড়া করলে আমাদের কি করার আছে? ভেবেছিলাম টোপ দিয়ে টোপ ফেলবো। তা আর হলো না।
আরশ কিছুক্ষণ চিন্তা করে বললো, ‘স্যার, এমন কি হতে পারে না যে সজলকে মূল অপরাধী আতিকের ফোন চুরি করতে বলেছিল, এখন আবার জেলে থাকতে বলেছে যেন তাকে সন্দেহ করা না হয়?’
– এমন হওয়ার সম্ভাবনা কম আরশ। ওরা তাহলে সজলকে গুম করে ফেলতো, অথবা মেরে ফেলতো। এতটা ঝুঁকি নিতো না যে পুলিশের কাছে সাক্ষী রেখে দিবে।
– এটাও ঠিক। তাহলে সজলের বিষয়টা এখানেই থেমে গেল?
– হুম, তাছাড়া আর কি করার আছে! ওই ব্যাটার চ্যাপ্টার ক্লোজ। বিয়ের ছুটি মাত্র দুদিন কাটালে?
কার্তিক শুধুই বিয়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন। তিনি হাসতে হাসতে একটা খোঁটা দিয়ে দিলেন, ‘মো-ল্লা মানুষেরা দাওয়াত টাওয়াত দেয় না! টাকা খরচে খুব হিসেবি হয়। ভালো ভালো। ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল হবে।’
আরশ বিরক্ত হলেও সেটা প্রকাশ করলো না। কৈফিয়ত দেয়ারও চেষ্টা করলো না। সে বললো, ‘স্যার, একটা কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত শান্তি পাচ্ছি না আসলে। এজন্য ছুটি বেশি নিইনি। এই দুদিনও নিতে চাইনি, রাজীব ভাই ম্যানেজ করে দিলেন বিয়ের উপহার স্বরূপ।’
উপহারের কথা শুনে কার্তিক বিয়ে নিয়ে আর কথা বললেন না। আরশ মনে মনে হাসছে। সে বিয়েতে উপহার নিতে চায়নি। এ বিষয়টা তার অপছন্দ। তবে কার্তিকের মতো হাড় কিপ্টে লোককে থামাতে টাকা-উপহারের কথা আনতেই হলো। সে তো আর মিথ্যে বলেনি!
_____
আজ শুক্রবার। আরশের অফিসের কাজ নেই। বাড়ির পুরুষ মানুষগুলো জুম্মার সালাত পড়তে যাবে। যেহেতু বাড়িতে সব ছেলেরা এই দিনেই একত্র হয়, তাই শুক্রবারে নাজিফা সুস্বাদু খাবার রাঁধেন। চেষ্টা করেন সকলের প্রিয় খাবার রাঁধতে। দিনটাকে তারা ঈদের মতো উদযাপন করে। যেমন, আজ নাজিফা ও ফাতিহা মিলে লুকমানের প্রিয় সরিষা ইলিশ, আরশের পছন্দের চিংড়ির মালাইকারি আর আমান ও আনিকার প্রিয় গরুর মাংস রাঁধবে। ফাতিহার এই সব খাবারই পছন্দ। তাই তার জন্য বিশেষ করে শুধু জর্দা সেমাই রান্না করবেন নাজিফা। নাজিফার হাতের সেমাই খুব স্বাদের হয়।
সকাল থেকে রান্নাঘরে নানান আয়োজন চলছে। অনুষ্ঠানের মতো ভাব দেখে রিশতা একবার ভাবলো, আজ মনে হয় মেহমান আসবে। এ কথা আনিকাকে বললে সে বলে, ‘আজ আমার স্বামী আসবেন। এছাড়া আর কেউ আসবে না সুন্দরী!’
আনিকা রিশতাকে সুন্দরী বলে ডাকে। রিশতার খুব আপন মনে হয় তাকে। রিশতা রান্নাঘরে গিয়ে ফাতিহাকে দেখে বললো, ‘ভাবি, এবার আর বলবেন না আমি নতুন বউ। চার পাঁচ দিন হয়ে গেল বিয়ের। পুরোনো হয়ে গিয়েছি। এবার অন্তত কোনো কাজ করতে দিন?’
ফাতিহা হেসে হাত বাড়িয়ে রান্নাঘরে নিয়ে এলো রিশতাকে। তাকে পেঁয়াজ, রসুন কাটার দায়িত্ব দিলো ফাতিহা। রিশতার কাজের মাঝে নাজিফা এলেন। তিনি রিশতার সাথে কিছুটা সহজ হতে পেরেছেন। দুই বউকে কাজে সাহায্য করতে করতে তিনি বললেন, ‘রিশতা, তোমার পছন্দের খাবার কি?’
রিশতা মুচকি হেসে বললো, ‘আমার চিংড়ি মাছ খুব পছন্দ।’
– ভালোই হলো। আরশের প্রিয় খাবার এটা।
রিশতা কৌতূহলী হয়ে সবার প্রিয় খাবারের তালিকা শুনে নিলো। তার ইচ্ছে আছে, এমন এক শুক্রবারে সে সবাইকে রেঁধে খাওয়াবে। তার হাতের রান্নাও দারুণ!
সালাতে যাওয়ার আগে সবাই গোসল সেরে নিলো। আরশ গোসল শেষে ঘরে রিশতাকে দেখতে পেল না। গায়ের পানি মুছতে মুছতে সে আয়নার সামনে দাঁড়ালো। সেসময় বেশ দ্রুত হেঁটে আসতে দেখলো রিশতাকে। রিশতা এসেই বিছানায় শুয়ে পড়লো। তাকে এমন হন্তদন্ত হয়ে আসতে দেখে তার সামনে দাঁড়ালো আরশ।
– কি হয়েছে আপনার? শরীর খারাপ লাগছে?
রিশতার চোখ বন্ধ। মুখ গুঁজে রেখেছে বালিশে। আরশ উত্তর না পাওয়ায় বেশি কিছু জিজ্ঞেস করলো না। সালাতে যাওয়ার জন্য তৈরি হতেই রিশতা উঠে বসে বললো, ‘আমি আজিমপুর যাবো। আমাকে অনুমতি দিন।’
এ কথা বলে রিশতা নিজের পরিবর্তনে বেশ অবাক হলো। রুদ্রর কাছে সে কখনোই কোনো কিছুর জন্য অনুমতি চায়নি। অথচ মাত্র কিছুদিনের সম্পর্কে সে এখনই অনুমতি চাইছে। এই বিষয়টা তার মাঝে হঠাৎ চলে এসেছে।
রিশতার কথা শুনে আরশ পিছন ফিরে বললো, ‘কেন?’
– রু.. রুদ্রকে দেখতে যাবো।
আরশ সামনে ফিরে পাঞ্জাবি ঠিক করছে। যেন সে শুনেইনি কি বলেছে রিশতা। রিশতা আবার বললো, ‘দেখুন, আমি জানি আমার এই কাজটা ঠিক হচ্ছে না। এজন্য আমি চেয়েছিলাম আজকে না গিয়ে নিজেকে দমিয়ে রাখতে। কিন্তু আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। এটা এমন না যে রুদ্রকে আমি ভালোবাসি। এটা আসলে একটা অভ্যাস। যেমন, আপনাকে প্রতিদিন বাসায় থাকতে বললে আপনি অফিসে যেতে চাইবেন। তেমন আমারও প্রতি শুক্রবার…’
– তাহলে মেয়েটা আপনিই।
ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো রিশতা, ‘মানে?’
আরশ একবার রিশতার দিকে তাকিয়ে আবার নিজের কাজে মনোযোগ দিয়ে বললো, ‘আজিমপুর কবরস্থানে একটা মেয়ে প্রতি শুক্রবার জুম্মার আগে স্বামীর কবর দেখতে যায়। ইমাম তারিক তাকে এই অনুমতি দিয়েছে।’
রিশতা বিস্ময় নিয়ে বললো, ‘মানুষের জীবন সত্যিই সীমাবদ্ধ। কিসের সাথে কি মিলে গেল!’
আরশ মুসাল্লা হাতে নিয়ে বললো, ‘এখন যেতে পারবেন না।’
দাঁড়িয়ে গেল রিশতা, ‘আপনিও চলুন না হয়।’
– জুম্মার সালাত?
– তাহলে আমি একাই যাই?
আরশের প্রচন্ড রাগ হচ্ছে। স্বামী মারা গিয়েছে ছয় মাসের বেশি সময় হয়ে গেল। আরেকটা বিয়ে হয়ে গেল। তবু জড় পদার্থ দেখার জন্য অসুস্থ হয়ে পড়ছে মেয়েটা!আরশ রাগ দমনের বহু চেষ্টা করেও শেষে তা রক্ষা হলো না। শীতল কণ্ঠে বললো, ‘আপনার যেখানে খুশি সেখানে যান।’ বলেই সে আর অপেক্ষা না করে চলে গেল। তার ইচ্ছে ছিল আজ খুব অনুরোধ করে রিশতার কাছে রাসূলের সুন্নাহ আদায়ের জন্য আবদার করবে। তার আর রিশতার সম্পর্ক এখনো অপরিচিতর মতো। সেটা আজ থেকে স্বাভাবিক হতে পারতো, যদি না এই ঘটনা ঘটতো।
সালাত থেকে খাবারের পর্ব, এই সময়টুকু রিশতার খুব খারাপ কাটলো। সে আরশকে বন্ধু ভেবেছিল। তার ভাবনা সাগর বানিয়ে লোকটা রাগ দেখিয়ে চলে গেল। এখন বসে বসে খাচ্ছে আর মুখ গম্ভীর করে রেখেছে। দুই একবার রান্নার সুনাম করেছে। রিশতা রান্নাঘর থেকে সব দেখছে। সে আর ফাতিহা খাবার টেবিলের কাছে যাচ্ছে না।
ঘরে যেতে অস্বস্তি হচ্ছে রিশতার। তবু যেতে হলো সুন্দর শাড়ি পরার জন্য। বিকালে ফাতিহার মা বাবা আসবেন। তাদের সামনে রিশতাকে নতুন বউ হিসেবে পরিপাটি হয়ে থাকতে বলেছেন নাজিফা। রিশতা আলমারিতে শাড়ি দেখছে, এমন সময় আরশ বলে উঠলো, ‘বোরকা পরে নিন। আজিমপুর যাবো।’
রিশতার একবার মনে হলো সে বলবে, ‘যাবো না।’ আবার অন্য চিন্তা মাথায় এনে সে বললো, ‘কোন রঙের শাড়ি পরবো?’
আরশ রিশতাকে দেখে তার মনোভাব বোঝার চেষ্টা করলো। তার দিকে রিশতা উত্তরের আশায় চেয়ে আছে। আরশ চোখ বন্ধ করে সোফায় হেলান দিয়ে বসে বললো, ‘কোন রঙের শাড়ি আছে?’
– লাল, কালো, নীল পাড়ের সাদা শাড়ি, গাঢ় সবুজ…
– গাঢ় সবুজ। এর সাথে খোঁপা করা চুল। খোঁপায় থাকবে বকুল ফুল।
– বকুল কোথায় পাবো?
আরশ উঠে দাঁড়িয়ে বললো, ‘তৈরি হয়ে নিন। সব হাজির হয়ে যাবে।’
_____
– রুদ্র, আমি বিয়ে করেছি। কিন্তু আমার কোনো অনুভূতি নেই। না ভালো, না খারাপ। তবে জানো? আমার মাঝে অনেক পরিবর্তন এসেছে। আমি যা করছি, কিছুই অভিনয় নয়। সবটা আমার ভেতর থেকে কেউ যেন বলে উঠছে। এইযে সবুজ শাড়ি পরেছি, এটা উনার পছন্দে।
রিশতা মনে মনে কথা বলে। জোরেই বলতো কিন্তু আশেপাশের মানুষ তাকে পাগল ভাববে বলে মনের মাঝে রুদ্রর সাথে কথোপকথন চালিয়ে যায় সে। তার থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে আরশ এখানকার শ্রমিক আক্কাসের সাথে কথা বলছে। ইমাম সম্পর্কে জেনে তার তেমন কোনো সন্দেহ হলো না। এই ইমামের পরিবারের অবস্থা খুব নিম্ন পর্যায়ে। এজন্য পড়াশোনার পাশাপাশি ইমামের দায়িত্বটা নিয়েছে সে। এছাড়া মসজিদে বিনা পয়সায় থাকছে, তাই থাকার খরচ বহন করতে হচ্ছে না।
আরশ কথা শেষে রিশতার দিকে তাকালো। সে দেখতে পেলো, ইমাম তারিক হাঁটতে হাঁটতে সেদিকে যাচ্ছে। আরশও সেদিকে যেতে শুরু করলো।
– আসসালামু আলাইকুম।
ইমামের সালাম পেয়ে রিশতা উত্তর দিলো, ‘ওয়া আলাইকুমুস সালাম।’
– কিছু মনে করবেন না, আজ মুখ ঢেকেছেন দেখছি?
– মুখ ঢাকা কি পর্দার অংশ নয়?
বিব্রত ভঙ্গিতে হেসে বললেন ইমাম, ‘অবশ্যই এটা পর্দার অংশ। এজন্যই জিজ্ঞেস করেছি। আলহামদুলিল্লাহ! দেখে ভালো লাগলো। আপনি আর কতদিন আসবেন এখানে?’
আক্কাস চাচা যা জিজ্ঞেস করতেন, ইমাম তাই জিজ্ঞেস করতে শুরু করেছেন। রিশতা ছোট্ট শ্বাস ফেলে বললো, ‘আর আসবো না।’
বিস্মিত হলেন ইমাম, ‘কেন?’
সেসময় আরশ এলো। রিশতা সেদিকে গিয়ে আরশের হাত ধরে মনে মনে বললো, ‘রুদ্র দেখো, আমার স্বামী।’
আরশ রিশতার এমন কাজে হতভম্ব হয়ে গেল। পরক্ষণেই তার মনে হলো, হয়তো ইমামকে দেখে নিজেকে অনিরাপদ ভাবছে রিশতা। আরশ হাতটা শক্ত করে ধরে বললো, ‘ইমাম তারিক, পড়াশোনার কি অবস্থা আপনার?’
ইমাম ভ্রু কুঁচকে বললেন, ‘আলহামদুলিল্লাহ। আপনি কে?’
– আমি উনার স্বামী।
চমকে উঠলেন ইমাম, ‘কিন্তু উনার স্বামী…’
ইমামকে থামিয়ে আরশ বলে উঠলো, ‘আমিই স্বামী। আগেরটা অতীত। মানুষ নিজের পরিচয় অতীত দিয়ে দেয় না। বর্তমান দিয়ে নিজেকে পরিচিত করে। আপনি কি সবাইকে বলেন যে আপনি শের ই বাংলা স্কুলে পড়েন? নিশ্চয়ই তা বলেন না।’
ইমাম বুঝতে পারলেন আরশ তার জীবনী বেশ ভালোভাবেই জেনে এসেছে। গম্ভীর কণ্ঠে বললেন তিনি, ‘এত বিস্তারিত বোঝানোর প্রয়োজন নেই।’
ইমামকে বেশ রাগান্বিত মনে হলো। রিশতা দুজনের শীতল কথোপকথন দেখে বুঝতে পারলো, এদের মাঝে কোনো দ্বন্দ্ব আছে। আরশ রিশতার হাত ধরে বেরিয়ে এলো। ইমামের দৃষ্টি তার মোটেও সুবিধার মনে হয়নি। এখানে থাকলে সে রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না।
হাঁটতে হাঁটতে বকুল তলায় গেল আরশ। রিশতার হাত ছেড়ে সে হাটু গেড়ে বসলো। পরে থাকা তাজা বকুলগুলো কুড়িয়ে হাতের মুঠোয় জমা করছে সে। রিশতা মুচকি হেসে দেখছে। আরশের দুই হাত ভরে গেলে সে রিশতাকে ডাকলো, ‘এদিকে আসুন তো!’
রিশতা কাছে গেলে তার হাতে ফুলগুলো দিয়ে আরশ বললো, ‘গাছতলায় বসুন।’
আরশ আরো কিছু ফুল নিয়ে রিশতার পাশে বসে পড়লো। গাছের নিচে বসার জন্য সিমেন্টের তৈরি গোল একটা বসার জায়গা আছে। রিশতার কাছে বাকি ফুল দিয়ে বললো, ‘বাসায় গিয়ে সুতোয় গেঁথে দিব।’
অবাক হলো রিশতা, ‘আপনি মালা বানাবেন?’
পাল্টা প্রশ্ন করলো আরশ, ‘খুব কঠিন নাকি?’
মুচকি হেসে উত্তর দিলো রিশতা, ‘উহু।’
আর কোনো কথা নেই। বকুলের সুবাস মন জুড়িয়ে দেয়। শান্ত স্নিগ্ধ আবহাওয়ায় হতাশা এক নিমিষে ঝরে পড়ে, ঠিক বকুল ফুলের মতো।
রিশতা তার বোরকার পকেটে সব বকুল রেখে একটা আরশের দাঁড়িতে গুঁজে দিলো। আরশ একটু জোরে হেসে বললো, ‘কি করছেন?’
রিশতা হাসছে আর বলছে, ‘বাবুদের মতো দেখাচ্ছে।’
আরশের চোখ দুটো মুহূর্তেই অন্যরকম হয়ে গেল। রিশতার ভয় হয় সেই চোখে তাকিয়ে থাকতে। শুভ্র শীতল হাওয়ায় মন মাতানো মাতাল দৃষ্টি, এই চিত্রে এক রাশ কালো কালি মাখিয়ে রিশতা আরশের দাড়ি থেকে ফুল নিয়ে বললো, ‘একদম ভালো দেখাচ্ছে না। মেয়ে মেয়ে লাগছে। এটা আমার জন্যই থাক।’
আরশ চোখ বন্ধ করে গাছের সাথে হেলান দিয়ে বসলো। কিছুক্ষণ নীরবতা। রিশতার ভেতরে সংকোচ কাজ করছে। সে বুঝতে পারছে আরশের সাথে তার সম্পর্ক অন্য স্বামী-স্ত্রীদের মতো নয়। এটা যত বাড়বে, তাদের সম্পর্ক ততই ভঙ্গুর হবে।
নিস্তব্ধতা কাটিয়ে আরশ বলে উঠলো, ‘আপনাকে বিকেলে আনলাম ইচ্ছে করে। জুম্মার আগে অনেক ব্যস্ত থাকে সবাই। সেই সময়ে আপনার এই নেশাটা উপযুক্ত নয়। বিকেলে নেশা করা ভালো।’
রিশতা হাতে থাকা বকুলগুলো নিয়ে খেলছে। আপনমনে খেলতে খেলতে সে উত্তর দিলো, ‘নেশা কোনো সময়েই ভালো নয়।’
আরশ তবু তাকালো না, কিছু বললো না। তবে রিশতার শেষ কথায় সে চোখ খুললো।
– আমি এই নেশা একেবারে ছেড়ে দিয়েছি। রুদ্রকে বলেছি আমার বিয়ের কথা। আর কোনোদিন আসবো না ওর কাছে। হয়তো স্বার্থপরতা হয়ে গেল। কিন্তু মানুষ বর্তমান নিয়েই বাঁচে। তাই না?
__________
(চলবে ইন শা আল্লাহ)