সত্য পিঞ্জর’ পর্ব ১৮,১৯

0
418

‘সত্য পিঞ্জর’
পর্ব ১৮,১৯
তাবিনা মাহনূর
১৮
__________

নাজিফা বাইরের রাস্তার দিকে চেয়ে আছেন একমনে। এই তিনদিন ধরে ভোর থেকে সকাল পর্যন্ত তিনি বাড়ির বাইরে তাকিয়ে থাকেন। যখনই সময় পান, তখনই বারান্দায় ছুটে এসে দেখেন, ছেলেটা ফিরছে কিনা। বাড়ির বাইরে গাড়ির আওয়াজ, বাইক আসার শব্দ, কেউ মা বলে উঁচু কণ্ঠে ডেকে উঠলে- অবচেতন মনে নাজিফা ছুটে আসেন বারান্দায়। যখন লুকমানের ডাক পড়ে তখন তার হুঁশ ফিরে, ছেলেটা নিখোঁজ।

এখনো দাঁড়িয়ে আছেন বারান্দার প্রাচীর ধরে। সকালের নাস্তার সময় হয়ে গিয়েছে। ফাতিহা গর্ভবতী হওয়া সত্ত্বেও গত দুদিন ধরে সামলে যাচ্ছে। আজও ভোরে উঠে সালাত পড়েই কাজে নেমেছে। রিশতা অবশ্য একটু করে সাহায্য করে তাকে। আনিকা পারে না সতর্কতার কারণে। জামিল এসেছে কাল। যতদিন না আরশের খোঁজ পাওয়া যায় ততদিন সে থাকবে। স্ত্রীর যত্নে সবসময় খেয়াল রাখে সে। তাই স্ত্রীকে যেকোনো কাজের চাপ কিংবা মানসিক চাপ থেকে দূরে থাকতে বলেছে।

– মা!

চমকে পেছনে ফিরে তাকালেন নাজিফা। রিশতা শুকনো মুখে দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটাকে দেখে কেউ বলবে না তার স্বামীর সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে না। স্বাভাবিক চলনভঙ্গি, কিন্তু অস্বাভাবিক ঠান্ডা আচরণ করছে সে। ঠিক যন্ত্রের মতো। কোনো খারাপ কথা শুনলেই দৌড়ে ঘরে গিয়ে মাথা চেপে বসে থাকে রিশতা। নিজেকে শান্ত করে, বিড়বিড় করে কি যেন বলে। বাকিটা সময় সে চুপচাপ কাজ করে।

নাজিফাকে তাকিয়ে থাকতে দেখে রিশতা বললো, ‘খাবেন না?’

– তুমি খেয়েছো?
– না।

নাজিফা অদ্ভুত প্রশ্ন করলেন, ‘তোমার জীবনে কেন আমার ছেলেকে জড়ালে মা? তুমি যে আবার নিঃস্ব হয়ে গেলে।’

রিশতা নির্বিকার। নাজিফা বললেন, ‘আমার ছেলেটা কেন বিয়ে করতে চাইতো না এখন বুঝি।’

– মা, এখন কোনো দ্বীনদারের জীবনই আশংকামুক্ত নয়। সবার দাড়ি রাখাটা এখন জীবন সংকটের বিষয়। তাই ইফতিখার ছাড়াও বাকি দ্বীনদার লোকগুলোর বেঁচে থাকা কঠিন। তা প্রশাসনিক কাজ হোক, কিংবা সাধারণ দিনমজুরি হোক।

রিশতার কথা শুনে নাজিফা বললেন, ‘তাহলে আমরা বেঁচে থাকবো কি করে?’

– ধৈর্য হারানো মুমিনের বৈশিষ্ট্য নয় মা। তাওয়াক্কুল হারানো মুমিনের ভূষণ নয়।

অশ্রু ঝড়ালেন নাজিফা। আরশ হারানোর পর মেয়েটাকে দেখলেই তার মায়া কাজ করে। আজ মায়ার পাশাপাশি ভালোবাসা বেড়ে গেল। তিনি চোখ মুছে রিশতার হাত ধরে বললেন, ‘আজ না খেয়ে থেকো না। দুদিন ধরে শুধু পানি খেয়ে চলছো।’

– উনি যদি না খেয়ে থাকেন?

নাজিফা বললেন, ‘তুমিও না খেয়ে থাকবে? আরশ শুনলে কষ্ট পাবে। তোমাকে চলতে হবে না? লড়াই করতে হবে না? এভাবে না চলে ভেবে দেখো কি করা যায় মা।’

নাজিফা জোর করে খাইয়ে দিলেন রিশতাকে। রিশতা দুদিন পর খাবার খাওয়ায় বমি চলে এলো তার। খাওয়া শেষে ঘরে গিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লো সে। চিন্তার রাজ্যে নাজিফার বলা কথাগুলো নিয়ে কিছুক্ষণ নগর গড়লো সে। আমান ভাই ইতিমধ্যে ধানমন্ডি থানায় জিডি করেছেন। সাংবাদিক মাধ্যমের কেউ জানে না। নাকি জেনেও প্রচার করছে না? বিচ্ছিন্ন ভাবনায় রিশতার মাথা ব্যথা করে উঠলো। আরশের সাংবাদিক বন্ধু উসমানের কথা মনে পড়লো তার। কিন্তু জানাতে ভয় করছে। যদি উল্টোটা হয়?

তখনই ম্যাসেজ এলো তার ফোনে। ধীরে ধীরে উঠে বসলো সে। টেবিলের দিকে হাত বাড়িয়ে ফোন হাতে নিয়ে দেখলো, অচেনা নম্বর থেকে ম্যাসেজ এসেছে। যেটা ওপেন করে পড়লো সে, ‘আরশকে অক্ষত দেখতে চাইলে এই ব্যাপারে কাউকে জানাবেন না। কিছুদিন পর তাকে ছেড়ে দেয়া হবে। জানালে আরশের লাশটাও ফিরে পাবেন না। প্রমাণের কাগজগুলো খুঁজে আমাদের হাতে তুলে দিন।’

ওই নম্বরে ফোন করলো রিশতা। বন্ধ বলছে। তারমানে ম্যাসেজ দিয়েই ফোন বন্ধ করে দিয়েছে লোকটা। আরশকে ধরে রাখার কারণ বুঝতে পারলো রিশতা। সে আশি ভাগ নিশ্চিত, আরশ বেঁচে আছে। আরশের মুখ থেকে স্বীকারোক্তি না নেয়া অব্দি তারা তাকে মারবে না।

রিশতার অচেতন অবস্থা নিমিষেই স্বাভাবিক হলো। উত্তেজিত হয়ে সে আমানের ঘরের দিকে এগিয়ে গেল। পরক্ষণেই ঘরে ফিরে এসে পায়চারি শুরু করলো। সে কি করবে বুঝতে পারছে না। মাথা ব্যাথাটা বাড়ছে। মাথা চেপে সে বাথরুমে গেল। ওযু করে দুই রাকআত নফল সালাত আদায় করলো।

সালাত আদায়ের পর মন শান্ত হয়েছে। নিবিষ্ট মনে সে ভাবছে, উসমানকে সব জানাবে। কিন্তু মিডিয়ায় যেন তা প্রচার না হয়, এই প্রতিশ্রুতি রাখবে। ভাবনা অনুযায়ী ফোন করলো সে।

ফোন ধরতেই ভেসে এলো উসমানের কন্ঠস্বর, ‘আসসালামু আলাইকুম ভাবি।’

আরশের নম্বর থেকে ফোন আসা সত্ত্বেও উসমান বুঝে গিয়েছে এটা আরশ নয়। ভ্রু কুঁচকে রিশতা বললো, ‘ওয়া আলাইকুমুস সালাম। আপনি কীভাবে জানলেন?’

– ভাবি, সংবাদ মাধ্যমে কোনো খবরই গোপন থাকে না। আপনারা সূর্যের যেই আলো এখন দেখছেন, আমরা সেটা আট মিনিট আগেই দেখে ফেলি।
– তাহলে চুপ করে আছেন কেন?
– উপর মহলের নিষেধ। কেউ যদি ঘটনাটা ছড়ায় তাহলে চ্যানেলের মালিক সহ চৌদ্দ গুষ্টির অবস্থা টাইট করে ফেলবে। পত্রিকার ক্ষেত্রেও একই সিস্টেম।

উপহাস করে বললো রিশতা, ‘আপনিও!’

দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো উসমান, ‘আমাকে এমন মনে হলো ভাবি?’

চুপ করে আছে রিশতা। পরপুরুষের সাথে কথা বলতে খুবই অস্বস্তি হচ্ছে তার। কিন্তু প্রয়োজনেই বলতে হচ্ছে। আমান এখন অফিসে। যা করার দ্রুত করতে হবে।

– কাজের কথায় আসুন। আপনি কেন প্রচার করছেন না?
– আমার বন্ধুর জীবন জড়িত এখানে। ভাবি, সে বেঁচে আছি।
– জানি।
– কীভাবে?

রিশতা ম্যাসেজের কথা বললো। উসমান বললো, ‘সর্বনাশ! সব প্রমাণ তো…’

– চুপ! একদম প্রমাণের কথা উচ্চারণ করবেন না। আমাকে তারা নজরে রেখেছে। কল রেকর্ড এর হিস্ট্রি বের করে সব জেনে যেতে পারে।
– তাহলে এখন?
– ডুব দিন। দ্রুত!

উসমান হতভম্ব হয়ে বললো, ‘কোথায়?’

রাগ চড়ে গেল রিশতার, ‘এটাও যদি আমি বলে দিই তাহলে ওরা সব জেনে যাবে না?’

– ঠিকাছে ঠিকাছে। আমি দেখছি কি করা যায়।
– কোনোভাবেই ‘প্রমাণ’ শব্দটা কারো কাছে উচ্চারণ করবেন না। আমার মনে হচ্ছে, প্রমাণ পেলেও ইফতিখারকে ওরা ছাড়বে না। ওদের ক্ষোভ আমি এতদিনে চিনে গিয়েছি।
– আপনি যা ভাবছেন তাই ভাবি।
– আপনিও যেহেতু বুঝতে পারছেন, তাই এখন শত্রুর কাজ অনুযায়ী পরিকল্পনা আগান।
– জি।
– আমি আর ফোন করবো না আপনাকে।
– করলেও পাবেন না।

কথা শেষ। রিশতা স্বস্তির শ্বাস ফেললো। এখন সে নিশ্চিত হতে পারছে আরশ বেঁচে আছে। তবে উসমানের প্রাণ সংকটে। কেননা, প্রমাণ এখন উসমানের হাতে। পরিকল্পনা অনুযায়ী সে বাংলাদেশের বাইরে চলে যাবে খুব শীঘ্রই। তা নাহলে একবার যদি শত্রু পক্ষের কানে সব পৌঁছে যায়, তবে আরশ আর তাকে বাঁচানো প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়বে।

রিশতা এখন অন্য চিন্তায়। কার সাহায্য চাইবে সে? কাকে সে বিশ্বাস করবে?

_____

– মুখ হা কর বেয়াদব!

তারিকের ধমক কমে না। কথার শুরু ও শেষ হয় অশ্লীল গালি দিয়ে। আরশ অবাক হয় এমন মুনাফিকদের দেখে। তারিক মাদ্রাসা থেকে পাশ করেছে। আরশের ধারণা, ছেলেটা ক্বুরআনের অর্থ পড়েনি কখনো অথবা গভীরভাবে উপলব্ধি করেনি। অর্থ ও তাফসির পড়ার পরও কেউ কীভাবে অন্যায়ে জড়াতে পারে?

লিটন নামের ছেলেটা ভাত হাতে নিয়ে বসে আছে। চামচে করে আরশকে একবার করে খাইয়ে দিচ্ছে সে। তারিক ঘর থেকে বের হলো। ঘরে শুধু লিটন আর আরশ। পনেরো ষোল বছর বয়সী ছেলেটার চোখ দেখে মায়া কাজ করে আরশের। সে প্রশ্ন করলো, ‘নোংরা কাজে নেমেছো কেন ভাই?’

– কি করমু কন? আমি বাসার চাকর। আমারে যা কয়, তাই করতেই বাধ্য আমি।
– কার চাকর?
– ঐযে, ওইদিন দেখলেন না? কঠিন নাম ব্যাটার।
– জাহাঙ্গীর?
– হ হ। কি কঠিন নাম বাপরে! আমি জাইঙ্গা স্যার ডাকি। আমারে আবার এইজন্য মারে…

কষ্টের মাঝেও হেসে ফেলল আরশ। সে বলে উঠলো, ‘এখন কি বাসায় যাবে?’
– হ। আপনার ভাত খাওয়া হইলে বাসায় যামু।

আরশ মুচকি হেসে বললো, ‘তোমার জাইঙ্গা স্যারকে বলে দিও, আমি মরে গেলেও স্বীকার করবো না!’

_____

চার দিন পার হয়ে গেল, আরশের আর কোনো খোঁজ পায়নি রিশতা। উসমান এখনো দেশ ছাড়তে পারেনি। দেশ ছাড়লেই সে আরশকে মুক্ত করার ব্যবস্থা করবে। তাই হাত পা গুটিয়ে বসে থাকতে হচ্ছে রিশতাকে।

মাঝে মাঝে তার মনে হয়, সব বলে দিয়ে আরশকে মুক্ত করলেই শান্তি। এতে উসমানের জীবন গেলে যাবে! কিন্তু এমন বাজে চিন্তায় সে নিজেকে ধমক দেয়। এমন কাজ করলে উসমান ধরা পড়বে, কিন্তু আরশ ছাড়া পাবে না। এরকম অবস্থায় সে আরশের সাথে নিজের মনের কথাগুলো প্রকাশ করে একটা সিদ্ধান্তে আসতো। কিন্তু এখন তো আরশকেই খুঁজতে হবে, একাকী।

আরশেরও দিন কাটে নির্ঘুম। আঘাত পেতে পেতে এখন সে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছে। শরীরের কোনো অংশ বাদ নেই যেখানে আঘাতের চিহ্ন নেই। পিঠে চাবুক মেরে ক্ষত করে তাতে মরিচ গুঁড়া মাখিয়েছিল তারিক। তবু সে কিছুই স্বীকার করেনি। দাঁতে দাঁত চেপে সব যন্ত্রনা সহ্য করে গিয়েছে। একদিন পানির বালতিতে পা ডুবিয়ে তাতে ইলেকট্রিক শক দিয়েছিল নরকের কীটগুলো। অসহনীয় ব্যথায় কাতরে চিৎকার করেছে সে। তবু মুখ খুলেনি।

আজ নাকি আফজাল নিজে আসবে। তারিক আর অনিরুদ্ধ অপেক্ষায় আছে। তারিক বারবার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখছে সময় হলো কিনা। আসার শব্দ পেলেই পা চাটা শুরু করবে। আরশ নিস্তেজ হয়ে শুয়ে আছে। এতটা আঘাত সে পেয়েছে যে হাত পা খোলা অবস্থায় থেকেও তার লড়াই করার শক্তি নেই।

আফজাল এলেন। খড়ম পরে হাঁটলে যেমন শব্দ হয়, তেমন খট খট শব্দে হেঁটে ঘরের সামনে দাঁড়ালেন। তারিক তার পিছে দাঁড়িয়ে আছে। পেছনে আরো দুজন যাদেরকে আরশ চিনে না। আফজাল অনিরুদ্ধকে বললেন, ‘মেরে এই হাল করেছো কেন? এখন যদি কথা না বলতে পারে?’

অনিরুদ্ধ বিরক্ত হয়ে বললো, ‘আর বলবেন না স্যার! এই বেয়াদবের মুখ থেকে কিচ্ছু বের করা যাচ্ছে না। তাই রাগের মাথায় আমি আর তারিক অনেক বেশি মেরেছি। বেয়াদবের মুখ তবু খুলে না।’

আফজাল মিথ্যে অনুভূতি দেখালেন, ‘আহারে! এভাবে মারে কেউ নির্মম হয়ে? কি বাবা? তুমি দাঁড়াতে পারবে তো সামনের জীবনে?’

আরশ চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। বসার শক্তি নেই, দাঁড়ানোর কথা ভাবাই যায় না।

আফজাল এগিয়ে গিয়ে আরশের সামনে ঝুঁকে বললেন, ‘শেষ টোপ ফেলবো নাকি?’
আরশ নিশ্চুপ। আফজাল বললেন, ‘ঘরে সুন্দরী পাকি-স্তানি স্ত্রী। তারিকের খুব পছন্দ হয়েছে। তুলে নিয়ে আসতে এতটুকু সময় লাগবে না?’

আরশের মুখে গালি চলে এলো। তবু সে নিজেকে সংবরণ করে ক্লান্ত স্বরে বললো, ‘এসব করে পার পাবি না।’
– তুই পাবি না, তুই নিজের কথা চিন্তা কর।

আফজাল উঠে দাঁড়িয়ে হুঙ্কার দিলেন, ‘তারিক! এখনই এই বদ সিআইডির বউকে ম্যাসেজ কর। ওর বউ সব জানে। যদি প্রমাণ কোথায় আছে তা না বলে, তাহলে ওকে তুলে আনবি। কিন্তু এই কথা ওকে ম্যাসেজ করিস না। বলবি, না বললে ওর জামাইয়ের গলা ফুঁড়ে দিব একদম!’

তারিক কথা অনুযায়ী কাজ করলো। ম্যাসেজে আরশের জীবনের হুমকি লিখে রিশতাকে পাঠিয়ে দিলো। আফজাল বাঁকা হেসে বললেন, ‘তোর বউয়ের যা ছিরি করবো না! তুই ছুঁতেও ঘৃণা করবি।’

আরশের চোখের কোণে জল জমেছে। গড়াতে দিচ্ছে না নিজের দুর্বলতা প্রকাশ পেয়ে যাবে বলে। চোখ বুজে নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করে সে বললো, ‘কোনো কিছুতেই কোনো লাভ হবে না। আমি কিছুই বলবো না।’

_____

রিশতা চুপ করে বসে আছে। একটু আগে মর্জিনা খালা ফোন করেছিলেন। খোঁজ খবর নিলেন, কান্নাকাটি করে দুআ করলেন। তিনি সেখানে খুব ভালো আছেন। এই কৃতজ্ঞতায় যতবারই ফোন করেন, ততবারই কেঁদে কেঁদে দুআ করেন। স্বল্প কথায় আলাপ সারলো রিশতা। আরশকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, এই সম্পর্কে কিছুই বলেনি সে। মর্জিনা খালার স্বভাব তার জানা আছে। কোনো কথাই তিনি চেপে রাখতে পারেন না।

ম্যাসেজের শব্দে দ্রুত ফোন হাতে নিলো রিশতা।

‘আজকেই সব বলে দিবি। তা নাহলে তোর জামাইয়ের আঙ্গুল কেটে পার্সেল করে পাঠাবো। তবু যদি না বলিস, তাহলে মাথা কেটে পাঠাবো।’

এসব পড়ে বুক কেঁপে উঠে তার। এক মুহূর্তের জন্য তার মনে হয়েছিল, উসমানের নামটা বলে দিলে তার স্বামী মুক্তি পাবে। ‘উসমান’ শব্দটা লিখে আবার মুছে দিলো সে। হাত কাঁপার কারণে ফোন বিছানায় পরে গেল। ভয়ে তার পুরো শরীর কাঁপছে। মাথা চেপে ধরে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করলো সে। এমন ভয়াবহ ম্যাসেজ পড়ে তার ছুটে চলে যেতে ইচ্ছে করছে আরশের কাছে।

নিজেকে পজিটিভ বিষয়গুলো বুঝিয়ে ফোন হাতে নিলো সে। অচেনা নম্বরে পাল্টা ম্যাসেজ লিখলো, ‘আমার স্বামীর সাথে একটু কথা বলতে দিন।’

__________

(চলবে ইন শা আল্লাহ)

‘সত্য পিঞ্জর’
পর্ব ১৯.
তাবিনা মাহনূর

__________

রিশতার ম্যাসেজের কোনো উত্তর এলো না। অর্থাৎ আরশের সাথে তার কথা বলার কোনো সুযোগ নেই। সে হতাশ হয়ে কপালে হাত রেখে চিন্তায় ব্যস্ত। এমন সময় কাঙ্ক্ষিত কল এলো। উসমান ফোন করেছে। নম্বরটা বিদেশি। কল ধরতেই উসমান বললো, ‘আসসালামু আলাইকুম ভাবি!’

রিশতার সালামের উত্তর দিয়ে বললো, ‘ওয়া আলাইকুমুস সালাম। আপনি কি দেশের বাইরে?’

– আলহামদুলিল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ! কোনো সমস্যা হয়নি আসতে।
– কোন দেশে গিয়েছেন?
– সাউথ আফ্রিকা। এটাই আমার শেষ ঠিকানা।

অবাক হলো রিশতা, ‘মানে?’

মলিন কণ্ঠে বললো উসমান, ‘মানে, আল্লাহ চাইলে আমি আজীবনের জন্য সাউথ আফ্রিকাবাসী হয়ে যাবো। এসব কাগজ পত্র অনেক আগেই তৈরি করে রেখেছিলাম। ভিসা ছিল। তাড়াহুড়ো ছিল না বলে তেমন গুরুত্ব দিয়ে আসার ইচ্ছে ছিল না। কিন্তু, এই ঘটনার কারণে সবকিছু তাড়াতাড়ি করে ফেললাম। এখানে আমার বড় ভাই তার পরিবার নিয়ে থাকেন। অনেক আগে থেকেই বলছিলেন একবারে চলে আসতে। আলহামদুলিল্লাহ, আল্লাহ আমাকে রক্ষা করলেন।’

রিশতা বললো, ‘তাহলে আমি এখন আমার পরিকল্পনা অনুযায়ী চলবো?’

– অবশ্যই। আল্লাহর নাম নিয়ে শুরু করে দিন।
– জাঝাকুমুল্লাহ খইরন।
– আপনাকেও। আর, আল্লাহ যেন জান্নাতে আপনাদের উত্তম দম্পতি হিসেবে কবুল করে নেন।

ফোন রেখে রিশতা দেখলো কোনো ম্যাসেজ এসেছে কিনা। কিন্তু কোনো ম্যাসেজ আসেনি। চিন্তায় সে কিছুক্ষণ পায়চারি করে আনিকার ঘরে গেল। আনিকা ঘুমাচ্ছে। রিশতার খুবই জানা প্রয়োজন আরশের কোনো পুলিশের সাথে পরিচয় আছে নাকি। যদি তিনি একটু সাহায্য করতেন!

হঠাৎ তার মাথায় এলো, ইহসান নামের একজন অভিজ্ঞ ওসির সাথে আরশের অত্যন্ত ভালো সম্পর্ক ছিল। তিনিই আরশকে সাহস জুগিয়েছিলেন এই বিভাগে সৎভাবে কাজ করার জন্য। কিন্তু তার সাথে কীভাবে যোগাযোগ করা যায়, সেই চিন্তায় আবারো দিশেহারা বোধ করলো রিশতা।

মনে পড়লো তার, আরশের একটা ডায়েরি আছে যেখানে সে বিভিন্ন নম্বর টুকে রাখে। অতিরিক্ত চিন্তায় এই কথাটা তার মাথা থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল। সে ডায়েরি থেকে প্রত্যেক পৃষ্ঠায় ইহসান নামটা খুঁজতে শুরু করলো। খুঁজতে খুঁজতে কোথাও যখন নম্বর পেলো না তখন হতাশায় এদিক ওদিক পায়চারি শুরু করলো সে। আল্লাহর নাম নিয়ে আবার পুরো ডায়েরি খুঁজে সে ‘ইহসান স্যার’ নামে একটা নম্বর পেলো। তাতে ফোন করলো সে। প্রথমবার কেউ ধরলো না। দ্বিতীয়বার কল করার পর কেউ একজন বলে উঠলো, ‘আসসালামু আলাইকুম, কে বলছেন?’

রিশতার মনে আশা জাগছে। খুশি হয়ে সে বললো, ‘ওয়া আলাইকুমুস সালাম স্যার। আমি ইফতিখার আরশের স্ত্রী, রিশতা।’

প্রথমে চমকে উঠলেন ইহসান। তারপর মুচকি হেসে বললেন, ‘ওয়া আলাইকুমুস সালাম মা। কেমন আছেন আপনারা?’

মানুষটা তার ছোট হোক কিংবা বড়, ইহসান অপরিচিত সবাইকে আপনি করে বলেন। রিশতা সেটা বুঝতে পেরে তুমি করে বলার জন্য জোর করলো না। প্রতিটা মানুষের নিজস্ব ব্যক্তিত্ব থাকে যা তাকে সকলের চেয়ে আলাদা করতে সক্ষম হয়। সেই ব্যক্তিত্বে হস্তক্ষেপ না করলে মানুষটা নিজের মতোই সুন্দর থেকে যায়। অন্যের দেয়া চাপে তার সত্তার চরিত্রে আঘাত লাগে।

রিশতা বললো, ‘আলহামদুলিল্লাহ আলা কুল্লি হাল। স্যার, বিপদে পড়ে ফোন করেছি আপনাকে।’

– আপনার ফোন পেয়ে বুঝতে পেরেছি মা। আরশ বাবাকে নিয়ে সমস্যা হয়নি তো?

ঘটনা পুরোটা সংক্ষেপে বর্ণনা করলো রিশতা। ইহসান বললেন, ‘আপনি সংবাদ মাধ্যমে না জানিয়ে ভুল করেছেন।’

– স্যার, ইফতিখারের বন্ধু উসমান বলেছেন সাংবাদিকরা সবাই এ ব্যাপারে জানে। কিন্তু কেউই এ নিয়ে মুখ খুলছে না।
– পয়েন্ট! আমি ভুলেই গিয়েছিলাম এরা চাটুকার। উসমান কি বলে? সেও কি…
– স্যার, তাকে নিয়ে একটা বিশেষ ঘটনা আছে যেটা ফোনে বলা সম্ভব হচ্ছে না। আর এ কারণেই সে প্রচার করতে পারেনি।
– হুম, কিন্তু এখন কি মনে হচ্ছে আপনার? প্রচার করলে কোনো অসুবিধা হবে?
– না স্যার।

ইহসান বললেন, ‘তাহলে দ্রুত সোশ্যাল মিডিয়ায় বিষয়টা ভাইরাল করে দিন। জনগণের উপরে কোনো বিশেষ মানুষ নেই। জনগণ একবার ক্ষেপলে সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারীর অবস্থাও নাজুক হয়ে পড়ে। আমি যা বলছি তাই করুন।’

– জি স্যার। আর ইফতিখারকে খোঁজার ব্যাপারটা?
– ওটা আমি দেখছি। আরশ কোথায় আছে জানি না। তবে আমি নারায়ণগঞ্জ থানার কাজ সামাল দিই। এদিকটায় কিছু একটা ঘটছে যার আভাস আমি পেয়েছি। আপনাকে যা বলেছি তাই করুন।
– অনেক ধন্যবাদ স্যার, জাঝাকাল্লাহ খইরন।
– আল্লাহ আপনাদের সহায় হন। আমি যথেষ্ট চেষ্টা করবো।

ফোন রেখেই রিশতা নিজের ফেসবুক আইডিতে পোস্ট লিখতে শুরু করলো। পোস্টে আরশের একটা ছবি দিয়ে ক্যাপশনে তার হারিয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা গুছিয়ে লিখলো। আরশকে ট্যাগ করে পোস্ট করলো সে। আরশের আইডির পাসওয়ার্ড তার জানা নেই। তাই সেখানে গিয়ে কাউকে জানাতে পারলো না সে।

তবে নিজের ম্যাসেঞ্জারে বোনদের গ্রুপে খবর জানিয়ে দিলো সে। বিভিন্ন ইসলামিক গ্রুপে কথাগুলো গুছিয়ে লিখে ছবি সহ পোস্ট করলো সে। মাত্র এক ঘণ্টার মাঝেই আরশকে নিয়ে বাংলাদেশি ফেসবুক ইউজারদের একাংশ তোলপাড় শুরু করে দিলো।

আরশের ছবিটা নিয়ে ডিজাইন করে ‘ছয়দিন ধরে নিখোঁজ’ কথাটা বড় করে লিখে ছড়িয়ে দিয়েছে একটা গ্রুপ। সেটা সাধারণ মানুষ শেয়ার দিচ্ছে। যারা আরশকে আগে থেকেই চিনে, তারা তাকে নিয়ে তাদের মনোভাব ব্যক্ত করে দুআ চেয়ে পোস্ট করছে। অনেক ভাইয়েরা নিজ উদ্যোগে আরশকে খুঁজে বের করার উপায় তৈরি করছে।

দুই ঘণ্টার মাঝে সারা দেশে আরশের নিরুদ্দেশ হওয়ার ঘটনা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়লো। রিশতা কাঁদছে। তার কেন যেন খুব ভয় করছে, আবার আশাও জাগছে। মিশ্র এই অনুভূতি তাকে মানসিক কষ্ট দিচ্ছে। অবিরাম চিন্তা, মানসিক চাপ ও শারীরিক অসুস্থতার কারণে তার অবস্থা এখন পাগলপ্রায়। তার শান্তি মিলে, যখন সে সালাতে দাঁড়ায়।

আরো দুদিন পার হয়ে গেল। আরশকে খুঁজে পাওয়ার কোনো হদিস মিললো না। রিশতার খাওয়া দাওয়া আবার বন্ধ হয়ে গিয়েছে। বাড়ির সবাইকে সে বলেছে, গোপন সূত্রে সে আরশের বেঁচে থাকার বিষয়টা নিশ্চিত করেছে। কিন্তু এই ঘটনা বেশ কয়েকদিন আগের। এই দুদিনে আরশের কি হয়েছে, তা জানা সম্ভব হয়নি। এমনকি ওসি ইহসান নিজ থেকে কোনো ফোন করেননি বলে রিশতা ফোন করে বিরক্ত করতে চাইছে না।

অবশ্য তার মনে অজানা ভয় কাজ করছে। অবচেতন মন বলছে, ফোন করলেই বাজে খবর শুনতে হবে। তখন নিজেকে কীভাবে সামলে রাখবে রিশতা? এমন ভাবনা এলেই তার অনুভূতি শূন্য হয়ে আসে। কান্না আসে না আর। পুতুল রিশতা শুধু অপেক্ষায় থাকে। যদি একবার তার ইফতিখার দৌড়ে এসে বলতো, ‘বকুলগুলো নিন। মালা গাঁথবো।’

কিংবা মুচকি হেসে বলতো, ‘তুমিই তো আমি।’

ম্যাসেজের শব্দে ঘোর ভাঙলো রিশতার। এবার একটা এমএমএস পেয়েছে সে। ছবিটা ঘোলা হয়ে আছে। পরিষ্কার হওয়ার সাথে সাথে তার হৃদপিন্ড থেমে গেল যেন।
পায়ের বুড়ো আঙুল কেটে পাশে পরে আছে। কাটা পায়ের অংশে শুকনো মরিচের গুঁড়া মেশানো।

_______

আরশের পায়ে কোনো ক্ষতি হয়নি। ছবিটা নকল ছিল। ভয় দেখিয়ে রিশতার মুখ থেকে আসল সত্য বের করতে চাইছিল অনিরুদ্ধ।
সরাসরি আরশের ক্ষতি করতে পারতো তারা। কিন্তু তারা তা করতে পারেনি আরশের বিষয়টা জানাজানি হয়ে যাওয়ায়। যদি কখনো আরশ ছাড়া পেয়ে যায়, তাহলে তার অপূরণীয় ক্ষতি দেখলে জনগণ বেশ ঝামেলা করবে। হয় তাকে মেরে পুরোপুরি খালাস করে দিতে হবে, আর নয়তো স্বাভাবিকভাবে ফিরিয়ে দিতে হবে।

সমস্যা আরো একটা বেঁধেছে। ইহসান ঢাকার প্রধান থানাগুলোয় খোঁজ লাগিয়েছেন। রাশেদের চাকরি যাওয়ার বিষয় জানার পর তিনি সিআইডি কার্তিককে ধরেছিলেন। কার্তিক অবশ্য বেশ চালাকির সাথে উত্তর দিয়েছেন যেন তিনি কিছুই জানেন না। এতে আরো বেশি সন্দেহ করেছেন ইহসান।

আল্লাহর রহমাতে ইহসানের প্রচেষ্টায় আরশের আঘাত কমানো গিয়েছে। যদিও প্রতিদিনই তাকে মার খেতে হচ্ছে। কিন্তু তাকে মেরে ফেলার বিষয়ে দ্বিধায় আছে পুরো দল। দুদিন ধরে তার কাছে শুধু তারিক আসা যাওয়া করছে। আর কেউ দেখতে আসছে না। এতে আরশ দুটো ধারণা করেছে। হয় তাকে মেরে ফেলা হবে, আর নয়তো তার অবস্থান পরিবর্তন করা হবে। তাকে নিয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার ব্যস্ত আছে উপর মহলের লোকজন। তাই তার দিকে আপাতত লক্ষ্য রাখছে না তারা।

রিশতা সেদিন ছবি দেখে স্তব্ধ হয়ে বসে ছিল কিছুক্ষণ। তারপর ইহসানকে ফোন করে পাগলের মতো আকুতি মিনতি করেছিল যেন দ্রুত আরশকে খুঁজে বের করা হয়। তার প্রাণপাখি খাঁচার ভেতরে অনাহারে মরছে। রিশতার চোখে অশ্রু জমে না। কিন্তু তার মাঝে অস্বাভাবিকতা আবার দেখা দিয়েছে। ফাতিহা আর আনিকা রিশতাকে কোনোভাবেই বোঝাতে সক্ষম হয়নি আরশ ফিরে আসবে।

এই দুই দিনও পার হলো ক্লান্তিকে সঙ্গী করে। রিশতার ধ্যান জ্ঞান থাকে সালাতে, আল্লাহর সান্নিধ্যে। ইহসান অত্যন্ত চেষ্টা করছেন আরশকে খুঁজে বের করার। তার বারবারই মনে হচ্ছে, হাতের নাগালে আছে ছেলেটা। তার চোখে কেউ ধুলো মেরেছে। পরিষ্কার দেখতে হলে উপায় খুঁজতে হবে।

_____

দরজা খোলার আওয়াজ। তারিক এসেছে। আরশ চোখ বুজে শুয়ে আছে। এখন তার হাত বেঁধে রাখা। তারিক এগিয়ে গিয়ে একটা কাপড় তার চোখের কাছে নিয়ে বললো, ‘তোর এখান থেকে যাইতে হবে। কোথায় জানিস? হাহ! জানবি না বলেই তো ব্যবস্থা করতে এসেছি।’

চোখ বেঁধে দিয়ে তারিক উঠে দাঁড়ালো। আরশ যা ভেবেছিল তাই হতে যাচ্ছে। তার স্থান বদলে নেয়া হচ্ছে। এর মানে তার বিষয়টা ইতিমধ্যে বহুদূর এগিয়ে গিয়েছে যার কারণে এখানে তাকে রাখা এখন শত্রুপক্ষের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। কিন্তু চিন্তার বিষয় এই, তাকে নিয়ে এখান থেকে ঢাকার বাইরে চলে গেলে তার বেঁচে থাকার সম্ভাবনা প্রায় নেই বললেই চলে। কেননা সে তখন ‘গুম’ ব্যক্তিদের কাতারে পরে যাবে। ধীরে ধীরে মানুষ তাকে ভুলে যাবে।

তাই যাওয়ার পূর্বেই কোনো উপায় বের করতে হবে। এই মুহূর্তে কোনো পথ তার জন্য খোলা নেই। তবে সবচেয়ে শক্তিশালী পথ সবসময়ই খোলা। দুআ!
দুআ চালিয়ে গেল সে। এক সেকেন্ড থামলো না তার চঞ্চল ঠোঁট।

আরশকে নিয়ে ঝামেলায় পড়েছে আফজাল আর তার সাঙ্গপাঙ্গরা। দেশের টিভি চ্যানেল বাদে সব জায়গায় তার নিখোঁজের খবর ছড়িয়ে গিয়েছে। পত্রিকায় তার কৃতিত্বের কথা উল্লেখ করে বেশ আবেগী কলাম লিখছেন সাংবাদিকগণ। তাকে উচ্চ পদের মর্যাদা দেয়ার কথা ছিল সরকারের পক্ষ থেকে। অথচ এখন সেই সাহসী মানুষের কোনো খোঁজ নেই।

আরশকে উঠিয়ে তার দুই পাশে দুজন তার হাত ধরে রেখেছে। একজন এসে মুখ বেঁধে দিলো। অনিরুদ্ধ বললো, ‘বস্তায় পুরতে পারলে ভালো হতো। ব্যাটা যেই লম্বা! সব কিন্তু সাবধানে হওয়া চাই। তারিক!’

– জি ভাই।
– গায়ে লোহার চেইন কিংবা এ জাতীয় কিছু রেখো না। হাঁটলে শব্দ হয় এমন জিনিস সব ফেলে দাও।
– নো টেনশন! এগুলো কিচ্ছু নেই। গাড়ি কোথায়?
– কালীর বাজারের পেছন দিকে। আরশকে ঘিরে হাঁটবে সবাই। আর ও যদি পালানোর চেষ্টা করে কিংবা নড়াচড়া শুরু করে তাহলে গায়ে আগুন ধরিয়ে দিতে একটুও দ্বিধা করো না। এই মধ্য রাতে কেউ দেখবে না এখানে কি হচ্ছে।

আরশের সারা শরীরে পেট্রোল মাখানো। সে পালাতে চাইলেই তার দিকে জ্বলন্ত মোমবাতি ছুড়ে দেয়া হবে। এতে কোনো শব্দ হবে না, আরশকেও মারা যাবে। এক ঢিলে দুই পাখি!

বাংলোর বাইরে বেরিয়েছে আরশ। চারিপাশে নীরবতা। হাঁটার সময় পায়ের নিচে শুকনো পাতার খসখসে শব্দ আর ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক ছাড়া আর কোনো আওয়াজ নেই। কার্তিকের ফোর্স খুব সাবধানে আশেপাশে ছড়িয়ে আছে যেন সমস্যা দেখলেই সংকেত পাঠাতে পারে।

আর অল্প কিছু দূর। তারপর আরশ চলে যাবে বান্দরবান রুমা অঞ্চলে। যেখানে গহীন জঙ্গলে বন্য শূকরদের মাঝে ছেড়ে দেয়া হবে তাকে।

_____

– দুআ করতে থাকুন মা। আমরা এগিয়ে যাবো এখন।
– জি স্যার। আল্লাহ ভরসা।

আরশের অবস্থান জানতে পেরেছেন ইহসান। জানার পর ফোর্স নিয়ে কালীর বাজারের আশেপাশে গোপনে ছড়িয়ে পড়েছেন। আরশের কাছে লিটন যাওয়া আসা করতো। এই লিটনকেই ফাঁদ হিসেবে ব্যবহার করেছেন তিনি। আজ রাতে আরশকে নিয়ে এই জায়গা ছাড়ার ইঙ্গিত পাওয়ায় অপেক্ষা করছেন কখন তাকে বাংলো থেকে বের করা হবে। তাই রিশতাকে এই ঘটনা জানিয়ে আল্লাহর কাছে দুআ করতে বললেন।

খস খস আওয়াজ ভেসে আসলো। ইহসান কান খাড়া করে শুনছেন কিছু মানুষের পদধ্বনি। তিনিও আস্তে আস্তে এগিয়ে গেলেন। চশমার প্রান্ত ধরে উঁচু করে চোখ সরু করলেন। চারজন মানুষ দেখা যাচ্ছে। মাঝে কেউ আছে তবে বোঝা যাচ্ছে না। তিনি ডান হাত অনুপ্রস্থ বরাবর সোজা করে দুই আঙ্গুল নাচিয়ে কিছু একটা ইশারা করলেন। সঙ্গে সঙ্গে ফাঁকা গুলির আওয়াজ!

মুহূর্তেই আরশদের চারিপাশে পুলিশ সহ র‍্যাব ঘিরে দাঁড়ালো। এর মাঝে পেছনের দিকে আছে অনিরুদ্ধর নিয়োজিত পুলিশ যাদের কাজ ইহসানের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেয়া। তবে ইহসানের পুলিশের সংখ্যা বেশি হওয়ায় তারা একটু ভরকে গেল। অনিরুদ্ধ বললো, ‘রাস্তা ছাড়ুন!’

ইহসান বললেন, ‘আরশকে ফিরিয়ে দিন।’

আজ জাহাঙ্গীরও এসেছে। সে ভেতরে ভয় পেলেও তা মুখে প্রকাশ করলো না। কন্ঠ উঁচু করে বললো, ‘পথ ছাড়ুন নয়তো ফল ভালো হবে না।’

ইহসানের একই উত্তর, ‘আরশকে দিন। অযথা ঝামেলায় জড়ানোর ইচ্ছে নেই। তাকে ফেরত দিলে আমরা কেউ আপনাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলবো না। সম্পূর্ণ বিষয়টা এখানেই শেষ হয়ে যাবে।’

অনিরুদ্ধর উত্তর, ‘আমাদের কাছে কেউ নেই। কাকে কি করতে বলছেন?’

– আমরা সব জানি। পুরো ঘটনা ভিডিও করা হচ্ছে। যদি আরশকে হস্তান্তর না করা হয় তবে জনগণকে থামাতে পারবেন না!

অনিরুদ্ধ কিছুক্ষণ চিন্তা করে বললো, ‘নিশ্চয়তা কি? ভিডিওটা ডিলিট করবেন আমাদের সামনেই।’

– সব হবে। আগে আরশ চাই।
– ধামাচাপা কীভাবে দিবেন? ঘটনা সাজিয়েছেন?
– সবকিছু পরিকল্পনা করেই এসেছি। আরশকে চাই। এরপর বলা হবে, সে মাদক ব্যবসায়ীদের ধরিয়ে দেয়ায় তাকে আটক রাখা হয়েছিল। দোষ পুরোটাই মাদক ব্যবসায়ীদের উপর দেয়া হবে।

ইহসানের বুদ্ধির ধার দেখে অবাক হয়ে গেল জাহাঙ্গীর ও অনিরুদ্ধ। এই পরিকল্পনা পুরোটাই তাদের। ইহসান কীভাবে জানবে?

বেশ কিছুক্ষণ কথা কাটাকাটির পর অনিরুদ্ধর কথায় আরশকে সামনে আনলো তারিক। তার চোখের ও হাতের বাধন খুলে তাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়া হলো। সে চলতে পারছে না। হামাগুড়ি দিয়ে কিছুটা এগিয়ে যেতেই ইহসানের নিয়োজিত দুজন পুলিশ তাকে তুলে নিয়ে গাড়িতে ওঠালো। গাড়িতে থাকা স্ট্রেচারে শুইয়ে দেয়া হলো তাকে।

ইহসান আরশের করুণ অবস্থা দেখে প্রচন্ড কষ্ট পেলেন। ক্ষোভে তার শরীরে জ্বলন সৃষ্টি হচ্ছে। কিন্তু তিনি অত্যন্ত বুদ্ধিমান মানুষ। এখন রাগের মাথায় উল্টো কিছু বললে হিতে বিপরীত হতে পারে। তিনি বললেন, ‘আগে আপনারা যাবেন। এরপর আমরা যাবো এখান থেকে।’

অনিরুদ্ধ বলে উঠলো, ‘যা কথা হয়েছে সবটা যেন ঠিকঠাক থাকে। নাহলে শুধু আরশ নয়, আরো কত কি হতে পারে তা নিশ্চয়ই আপনার জানা আছে মহান নেতা!’

তাচ্ছিল্যের সম্বোধন শুনে ইহসান বললেন, ‘জানা আছে। আমাদের লক্ষ্য ছিল আরশকে খুঁজে বের করা। আর কিছু নয়।’

অনিরুদ্ধ, জাহাঙ্গীর, তারিক আর তাদের সাথে থাকা অন্য এক কর্মচারী পেছন ফিরে চলে গেল। নিজেদের পুলিশের সাথে গাড়িতে উঠে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হলো তারা। এখন বান্দরবান যাওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। ঘটনার মোড় পাল্টে গিয়েছে।

আরশকে নিয়ে দ্রুত হাসপাতালে যেতে চাইলেন ইহসান। গাড়ি ঘুরিয়ে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হলেন তিনি। কিন্তু আরশের মুখে বারবার এক কথা, ‘বাসায় যাবো!’

কিছুতেই মানতে চাইছে না সে। অবিরাম বলছে, ‘বাসায় যাবো। মাকে দেখবো। বাবাকে দেখবো। আনি আপু, আমান ভাইয়া। আমার নূরজাহান!’

__________

(চলবে ইন শা আল্লাহ)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here